• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • আর বিলম্ব নয় : সম্বিত বসু



    আগে বাঙালি ছিল ঝাড়া হাত-পা। এখন তাড়া হাত-পা। তার সারাদিন ঝকমারি, বাহাদুরি, কাড়াকাড়ি, কারিকুরি! গলায় কুচ করে কাঁটা গিঁথে গ‌্যাঁড়াকল! তবে মৎস‌্যর না — ঘড়ির। এই হল মাৎস্যন‌্যায়! পাসওয়ার্ড আগে ছিল ‘আলস‌্যপ্রিয়’। এবেলা পালটে ‘হন্তদন্ত’। ফলে গাঁকগাঁকিয়ে দৌড়। জুতোর মরণ। ছুতোর বরণ। এর-ওর সঙ্গে পাঙ্গা ও দাঙ্গা। মেট্রো থেকে নেমেই— দেচ্ছুট, সক্কলের আগে! বাইরে নির্ঘাত জীবনদেবতা, হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে অপেক্ষায়। অবশ‌্য কখনও পপাত চ, মমার চ! পাতাল-লোকের ছ‌্যাবলা হাসি। মেট্রোর ট্র্যাক যে দৌড়নোর নয়, সেকথা বাঙালিকে কেউ কখনও বলেছে? যদিও মেট্রো ব’লে না, বাঙালি সর্বত্রই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটছে। রেল স্টেশনে, বাসের পিছনে, ট্রেডমিলে, এমনকী, অন্তমিল দেখলেও সে ছোটে।

    এদিকে ট্রাম কমছে, গ্রামও কমছে। নিড়বিড়ানি ঘ‌্যাচাং ফুঃ! স্থির বলে কিছু নেই। পিথবিখানাই তো হাঁকপাঁক করে পাক খাচ্ছে বটে। স্থির-টির সাম্রাজ‌্যবাদীদের কনসেপ্ট। ধাঁ-ধাঁ করে উতরে যাওয়ার ধাঁধাই আসল সত‌্য। মিথ্যে শালা বনলতা সেন, উনি নাকি দু’দণ্ড শান্তি দেবেন! জীবনানন্দ সময় বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু উনি হদ্দ বোকা। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছেন, আরে, দৌড়লেই তো হত, দু’-দ’ণ্ডের জায়গায় চার-ছ’দণ্ড হত। বনলতা সেনের সঙ্গে জমে ক্ষীর। তাছাড়া, না-দৌড়লে বাঙালির এই অ‌্যাদ্দিনের মধ‌্যপ্রদেশীয় ঐতিহ‌্য, এ কমত কোন জাদুবলে— সকালবেলা পাতিলেবুর জলে?

    হুটহাট বদল হচ্ছে মধ‌্যরাতে। মধ‌্যদুপুরেও। শুধু সরকার বদল হচ্ছে না, না-কেন্দ্রে, না-রাজ্যে। এ ব‌্যাপারে নাকি তাড়া নেই। ছোঃ! চোখের সামনে ডিম পাড়ছে আর ড্রিম ভাবছে। কখনও ঘোড়ার ড্রিম। তার আগেই ঘোড়া বেচাকেনা হয়ে যাচ্ছে। হ‌্যাঁ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। কারণ বসার সময় নেই, উঁ-হুঁ! ঘুমলেও চটজলদি যাতে স্বপ্নটপ্ন বাগানো যায়, এসেছে ঝিন‌‌চ‌্যাক ড্রিমক‌্যাচার। যার যেমন স্বপ্ন, সে চলছিল দিব্যি। এখন পাশ দিয়ে অন্যের স্বপ্ন দেখে মার ছোঁ! হাফটাইমে স্বপ্ন বদলে যায়, এমন কেতাদুরস্ত জিনিস। যদিও কিনতে গিয়ে দোকানদারের সঙ্গে বে-আদব ঢুঁসোঢুঁসি হতেই পারে। যাকে বলে ‘ড্রিমক‌্যাচাল’।

    যা হবে ভাই, স্পিডে হবে। একহাতে মাথা চুলকোবে, আরেক হাতে দেড়শো কবিতা লিখবে। রাত্তিরবেলা ছাপাখানার গলিতে গিন্সবার্গ বোহেমিয়ান নাট্য। জল দেবে না মদে, ওতে নেশা লেট করে পৌঁছয়। সকালে প্রেসমালিককে খামচাবে, অনুনয়-বিনয়-নয়নয় করে মাথা কামড়ে পরের সকালে ফাটকা ও টাটকা মুদ্রণ। ছাপায় কয়েকখানা ফোঁড়া মাস্ট! ব‌্যস, কবিরেব প্রজাপতি। ব্রহ্মতালু চুলকে হিট!

    দুগ্গাপুজোয় ষষ্ঠীর জন‌্য আর হাঁ-করা হাপিত্যেশটিত্যেশ নেই। উদ্বোধন আগে, ‘হাই মম, ওয়াস্সাপ, বাবার সাপটা আনোনি? ভাবছিলাম একটু বিষছোবলের নেশা করব’-ও আগে। পুজোবার্ষিকী ৪ মাস আগে প্রিম‌্যাচিওর ডেলিভারি দিলে, স্বয়ং দুগ্গা পরিবার মণ্ডপে মাস্ক খুলে খাড়া পর্যন্ত হতে পারবে না— এ কী ধরনের দেবতন্ত্র? আর তাদের দেখার জন‌্য যে ভিড় হবে, ঠেলাঠেলি হবে, কাদা-ঘাম-রাম মাখামাখি হবে— সেটাই তো স্বাভাবিক মশাই! এ-ও তো গণতন্ত্র।

    তার ওপর এখন স্পিড আর ‘স্পিড’ নেই, ই-স্পিড হয়ে গেছে— ফাইভ-জি! ভিডিও এত চকচকে যে, যে কারও ব্ল‌্যাক হেড্‌স গোনা যায়। এ যুগে এসে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? নিজেকে অন‌্যমনস্ক করে ইতিউতি চোখ চালায়? ক‌্যাবলাকার্তিক! লোকে ছ‌্যা ছ‌্যা করবে। ফলে বাঙালিও যুগাভিসারে। বেজায় তাড়ায়।

    পৃথিবী ঘুরছে। ফলে যারা স্থির, তারাও আসলে থমকে নেই মোটে— এমন অলস কল্পনা কেউ কেউ করে থাকত এককালে। এই আলস্যের সঙ্গে অকর্মণ‌্যতার যদিও বনিবনা নেই। দৈনন্দিন দুনিয়াদারির বাইরে, তাদের কাছে বসলে আশ্চর্য জগৎ চিচিং ফাঁক হয়ে হয়ে যেত।

    সে লোকগুলোর দেখা মিলছে না অনেক দিন।

    কী ব‌্যাপার বলুন তো?



    অলংকরণ (Artwork) : ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments