• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • প্রেম নেই — একটি জনপ্রিয় উপন্যাস : রবিন পাল



    শতবার্ষিকী সমাগত বলেই গৌরকিশোর ঘোষের রচনা সম্পর্কে পুনর্বিচারের সুযোগ পাওয়া গেল। Charismatic authority তাদেরই বলা হয় অনেক মানুষকে যারা প্রভাবিত করতে পারেন, এ ধরনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব তাঁর লেখক সত্তা দিয়ে affectual or emotional commitment বিস্তার করতে পারেন বিবেকবান মানুষজনের মধ্যে, যা বলেছিলেন Max Weber, যাদের বিশেষ লেখন সত্তা, ভাষক সত্তা, সংকট মোচনের বাণী তুলে ধরতে সমর্থ হন। গৌরকিশোর ঘোষ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও এমন একজন লেখক। লক্ষ্য করছি শ্রীকুমার, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভৃতি অনেকে গৌরকিশোরের রচনা সম্পর্কে নীরব। [অরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কালের পুত্তলিকা’ বইতে ‘জবানবন্দী’ গল্পটির আলোচনায় তাঁর নির্মোহ জীবন জিজ্ঞাসার কথা বলেন। মেনকা বিপত্নীক ভবেশবাবুর আশ্রয়ে গর্ভবতী হয়, যা সুশীলকৃত। তিন জনের তিন প্রশ্ন, তিন যন্ত্রণা, তিন দুঃখ। অকুণ্ঠ বাস্তবানুরাগ, অন্তর্মুখী তীক্ষ্ণদৃষ্টি প্রশংসিত।] ব্যতিক্রম – ক্ষেত্র গুপ্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ রায়। অন্যদিকে আজকের বাংলা পাঠক সমাজে গৌরকিশোরের জল পড়ে পাতা নড়ে - এই ট্রিলজি জনপ্রিয়, ২য় খন্ড ‘প্রেম নেই’, ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডটি বঙ্কিম পুরস্কার পায় এবং আমি যে খণ্ডটি ব্যবহার করছি তা পঞ্চদশ মুদ্রণের একটি। পাঠক সমাজে এই ২য় খণ্ডটি আদৃত, বিশেষত: মুসলমান পাঠক সমাজে। ক্ষেত্র গুপ্ত গৌরকিশোরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের উল্লেখ করেন এবং তাঁর আলোচনার প্রারম্ভেই বলেন - ‘সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গ নকশাকার রূপে গৌরকিশোর বিখ্যাত ছিলেন’ এবং তাঁর লেখায় এমন কিছু ‘বৈশিষ্ট্য’ আছে যাকে বাদ দেওয়া যাবে না। ‘প্রেম নেই’ খণ্ডটি একটি উল্লেখযোগ্য ‘মাইলস্টোন’।

    জানা যাচ্ছে ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত তিনি ক্রমাগত পেশা বদলেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ফিটার। এ. আর. পি রোস্কউ সার্ভিসের খালাসি, রেস্তোরাঁর বয়, কাঠের কনট্রাক্টর, রোড সরকার, বিমান জাহাজের ফিটার, ট্রেড ইউনিয়ান অর্গানাইজার, রেশন দোকানের কেরানি, ইস্কুল মাস্টারি, ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট, কার্ডবোর্ড ও বীমা কোম্পানির দালাল, বালতির কারখানার এজেন্ট, ভ্রাম্যমাণ নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ড কাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানী, প্রুফ রিডার, মোসাহেব। এই অস্থির জীবিকাশ্রয় ছোটগল্প বা ছোট উপন্যাসের রসদ যোগান দিতে পারত। কিন্তু এই বঙ্গীয় জীবন বিচিত্রা তাঁর রচনায় আসেনি। সুবোধ ঘোষের সঙ্গে এইখানে তাঁর মিল। কিন্তু ফসিল, অযান্ত্রিক, সকলি গরল ভেল, ধরনের কোনো লেখা আমরা পাই না। তবে আনন্দবাজারে দুজনেই চাকরি করেছেন দীর্ঘকাল।

    এক পাঠক আনন্দবাজারে একটি পত্রে জানান — তিনি এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার কর্মী হিসেবে রিলিফ কমিটিতে কাজ করেন, লঙ্গরখানা চালান, একসময় প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেন। দলের পক্ষ থেকে লালমণির হাটে রেলকর্মী ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পটভূমিতে লেখা ‘সাগিনা মাহাতো’ উপন্যাস, ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী হা হা’র মতো গল্প বা ‘প্রেম নেই’ বা ‘মনের বাঘ’ নামে উপন্যাস, ‘ম্যানেজার’, ‘একটি হত্যা একটি লাশ একটি আততায়ী’র মতো গল্প। ম্যাগসেসে পুরস্কার পান, জরুরী অবস্থা কালে প্রতিবাদী সত্তার জন্য কারারুদ্ধ হন ১৯৭৫-এ। কোরিয়ার এক পুরস্কার-ও পান। লেখকের ‘বিপন্ন স্বাধীনতা’ মানবতার জন্য কাতরতা, এম. এন. রায় এর প্রতি আগ্রহ — তাঁর বহুমুখী সত্তার পরিচয় বহন করে। ঘটনা হল — নানা বর্ণের কম্যুনিস্ট সমাজে তিনি পরিত্যক্ত। ইরাবান বসু রায় লেখেন — ‘প্রেম নেই’তে ঘটনা বিবরণের খুঁটিনাটি যতটা জোর পায়, চরিত্র ততটা পায় না। অবশ্য এর কারণ তিনি লেখক হিসেবেই ‘নিকৃষ্ট’। (সত্তর দশকের বাংলা উপন্যাস, সত্তর দশক) তাঁর বহুমাত্রিক জীবন কথা তুলে ধরলাম। আপাতত: ‘প্রেম নেই’ উপন্যাস খণ্ডটি অবলম্বনেই কিছু অল্পবিস্তর কথা বলা যাবে।

    গৌরকিশোর কালের বিপন্নতার ছবি তুলে ধরেন — ‘সকলেই আজ সন্ত্রস্ত, নকশালপন্থী, সি পি এম, এম. এল. এ, এম. পি, শিক্ষক ছাত্র শ্রমিক কেরানী পুলিশ, সাংবাদিক, অভিনেতা সব্বাই। প্রশ্রয় পাওয়া খুনী বেপরোয়া, পাইপগান আর রিভলবারের নলই ক্ষমতার উৎস। (দেশ, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮) রাজনীতির লোক না হয়েও জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর ‘কলকাতা’ পত্রিকার ‘জরুরি অবস্থা’ প্রতিবাদী সংখ্যা বার করেn যা রাষ্ট্রদ্রোহী বলে সাব্যস্ত হয়। স্বৈরাচার বিরোধিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে মাথা ন্যাড়া করেন, জেল থেকে ওজস্বিনী ভাষায় স্বৈরাচার বিরোধী এক প্রচারপত্র দেশবাসীর উদ্দেশে বাইরে পাঠান। সে লেখার শেষে বলেন — আসুন নিগ্রহ ভোগের দ্বারা প্রসন্ন চিত্তে সন্ত্রাসকে পরাভূত করি। এবং জয় হোক গণতন্ত্রের। জয় প্রেমের ও মানুষের। এই অ্যানার্কিজম সমর সেনের মতো সাংবাদিককেও ‘আশাহত’ করে। অন্যদিকে কলকাতায় হকার উচ্ছেদ, কয়েক লক্ষ মানুষ কর্মহীন, অন্নহীন। সে সময় নানা শিল্প সংস্থায় লে অফ লক আউট ক্লোজার, পুলিশের গুলি। (জোয়ার ভাঁটায় ষাট সত্তর, অমলেন্দু সেনগুপ্ত) প্রতিবাদী জ্যোতির্ময় খালি পায়ে হাঁটা শুরু করেন, পরে এরশাদের কবিতা নিয়ে জনসমক্ষে আসেন। তারপর আমেরিকা যাত্রা। গৌরকিশোরের পরবর্তী কথাসাহিত্যে বা রচনায় জরুরী অবস্থার ভারতব্যাপী বিপন্নতার বিন্দুমাত্র ছায়া পড়েনি। ('প্রেম নেই' ১৯৮১-তে প্রকাশিত, ‘আমাকে বলতে দাও’, ১৯৭৬-তে) প্রজ্জ্বলিত ক্ষণিকের ঔজ্জ্বল্য হিসেবে। উত্তর পুরুষ লেখক সমাজে তেমন অনুপ্রেরণা সঞ্চারী ছিলেন কি?

    যে মুষ্টিমেয় আলোচক গৌরকিশোরের উপন্যাস নিয়ে কথা বলেছেন তারা সবাই ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসটির কথা বলেছেন, কিছু আলোচনাও করেছেন। আমিও ‘প্রেম নেই’-এর কথা বলব। স্বীকার করছি তাঁর অন্যান্য বইপত্র পড়ার সুযোগ হয় নি।

    ‘দেশ মাটি মানুষ’ নামের একটা ট্রিলজি লেখার কথা ভেবেছিলেন।, তার ১ম খণ্ড ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ (১৯৭৮) দ্বিতীয় খণ্ড ‘প্রেম নেই’ (১৯৮১) তৃতীয় খণ্ড প্রতিবেশী (১৯৯৫)। ড. চন্দন কুমার কুন্ডু জানান (ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ, বাংলা উপন্যাসের দর্পণে) প্রথম খণ্ডের ঘটনাকাল ১৯২২ থেকে ১৯২৬, দ্বিতীয় খণ্ডের ঘটনাকাল ১৯৩৫-৩৭ এবং তৃতীয় খণ্ডের ঘটনাকাল ১৯৪৬ পর্যন্ত। এই ট্রিলজির পাত্র-পাত্রীদের জীবনচলিষ্ণুতার পটভূমিতে রয়েছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বকাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সামাজিক ঐতিহাসিক প্রসঙ্গকথা। সেই কারণে ‘প্রেম নেই’ যেহেতু আমার আলোচ্য তাই এই পটভূমিটি স্মরণ রাখতে চাই। এই দ্বিতীয় খণ্ডটি লেখক তিনটি পর্যায়ে হাজির করেছেন। তা হল — আওরতে হাসিনা, মধ্যিখানে চর, দিগন্তে কালবৈশাখী। এই উপনামগুলো থেকে পাঠক আন্দাজ করতে পারেন লেখক প্রথমে মুসলিম নারী জীবনের গ্রামে বেড়ে ওঠার, প্রেম ভালোবাসার কথাকে প্রাধান্য দিয়েছে্ন। পুরুষ চরিত্র, প্রামীণ মুসলমান জীবন আনতেই হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুমিত হয় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যবধান কথা। এবং তৃতীয় পর্যায়ে আসছে এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কগত দ্বন্দ্বের ও সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কালবৈশাখী্র কথা। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে ‘প্রেম নেই’ এই ৩৪২ পৃষ্ঠার উপন্যাস কেন লিখলেন তিনি। তাঁর পয়েন্ট অফ ভিউ কি ছিল, পার্সপেক্টিভ কি ছিল? Gerard Genette এসব নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ পার্সপেক্টিভ এর বদলে mood কথাটি ব্যবহার করে জটিল করে তুলেছেন ব্যাপারটা। সোজা কথায় ঔপন্যাসিক এই ট্রিলজি কেন লিখতে চান, এই ‘বড়ো সময়’ (অশীন দাশগুপ্ত) নিয়ে নানান ব্যাখ্যা ও মত আছে। তিনি অর্থাৎ ঔপন্যাসিক কেন এই জীবনরূপ দিতে চাচ্ছেন? সেসব কথা উপন্যাসের শুরুতে নেই। ট্রিলজির সার্বিক নাম — ‘দেশ মাটি মানুষ’ কেন? এ কোন দেশ? এ কোন মানুষ? মুসলমান মানুষের ছবি আছে, যদিও তা খণ্ডিত, হিন্দু জীবনের ছবি কি আছে, কতটুকু আছে? ‘প্রতিবেশী’র ভূমিকায় গৌরী আইয়ুব বলেছিলেন — ‘ভারত ইতিহাসের এই সুপরিচিত ট্র্যাজিডি গৌরের উপন্যাসেও দুটি মানব-মানবীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজিডিতে পরিণত হয়েছে তৃতীয় খণ্ডে এসে।’ দেশের ট্র্যাজেডি শেষ হল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিতে। এটা ঘটলে দেশের ট্র্যাজেডি উন্মোচন, উপস্থাপন ম্লান হয়ে যায় পাঠকের কাছে।

    ১ম পর্বে (আওরতে হাসিনা) আছে ১৪৬ পৃষ্ঠা, ৩১টি অধ্যায়। টগর আর বিলকিসের তারুণ্য, পুকুরঘাটে মস্করা, শিক্ষাবঞ্চিত দুই মেয়ের জীবন পুরুষ কর্তৃক নিগ্রহ, এবং শাস্ত্রশাসিত জীবন। স্বামী ধারণাও সমাজ ও শাস্ত্র নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে দুই ধর্মের দুই সখী, কিন্তু ভিতরে ভিতরে গভীর শিকড় প্রসারিত হিন্দু মুসলমান বিভিন্নতা যা চমৎকার দেখানো হয় কাঁখে জলের ঘড়া আর মুসলমান বন্ধুর স্পর্শ চমৎকার উপমা দিয়ে — ‘দুজনের মাঝখানে মোটা দাগ কাটা নদীর মতই। মুসলমান তরুণী পড়ে গুলদাস্তার কাহিনী — যা পিপাসার্ত লোকের কাছে ঠান্ডা জলভর্তি গেলাসের মত। (পৃ. ৯) হজ করা, ‘বাসাসুল আম্বিয়া’ পুঁথি। বিলকিসের বর ফটিক বা শওকত, কলকাতায় শিক্ষাপাত্র। কলকাতায় ওকালতি পাশ (পৃ. ১৪) ফুটকির চোখে কলকাতা বিস্ময়ের স্থান (পৃ. ১৬) যেখানে পর্দা নেই, মেয়েরা বেপর্দা রাস্তাঘাটে ঘোরে আবার নমঃশূদ্রদের সঙ্গে দাঙ্গা, হিন্দুরা মুসলমানের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্র আঁটছে (পৃ. ১৯), ‘কড়িনামা’র উল্লেখ, অ্যান্টনি বাগানের মুসলিম মেসে অতিবাহন, দেবদাস দেখা (১৯৩৫), লেখক ফটিকের ভাবনায় (শ্বশুরকে চিঠি) দেখান — ‘কলকাতায় এসে দেখছি মুসলিম সমাজে বেশ জাগরণ হচ্ছে’। (পৃ. ৬) কিন্তু পুরো বইটায় এই মুসলিম জাগরণের পরিচয় নেই। বরং হিন্দুর প্রতি রাগ — মাস-বিভাগে রাগ — ঘাট বাঁধানো নিয়ে ঘোঁট — মৌলবাদীদের ভূমিকা — হিঁদুর মেয়ে মুসলমান ছাওয়ালের সঙ্গে বিয়ে, ফটিকের হিন্দু তরুণী বন্ধু (মিস পালিত) মেজো কর্তা বলে — বিদ্যা বলো জ্ঞান বলো এ সব অর্জন, তার ভালো মন্দ দু দিকই আছে (পৃ. ৬৪) দেশের, চাষী জীবনের দুরবস্থা, রামতারণ গোমস্তার অত্যাচার, কলকাতার মুসলমান বড়ো অদ্ভুত জাত, (পৃ. ৭৫) কিন্তু হিন্দুরা থাকতে দেয় না, টিউশানী পায় না, আবার ফটিক খদ্দরের সুতো কাটে, স্বদেশীদের চর (পৃ. ৭৬) — পুরো বইটায় ফটিকের নবজাগরণ অভিঘাতের ছবি নেই, হিন্দু কর্তৃক নিগ্রহের ক্ষোভ নেই, স্বদেশী জীবনাচরণ নেই। শুধু উল্লেখ। দাউদের লালসা বড়ো হয়ে ওঠে। হিন্দু লেখক মুসলমান লেখক (পৃ. ৮১) বিস্তার নেই। মুসলমান দেখলে নাক সিটকানি, ঠান্ডা, পাশ দেওয়া নিয়ে বিদ্রূপ, মৌলবিদের ইন্ধন, মৌলবীরা উসকায় — ‘ভাই মুসলমান, সামনে অন্ধকার, হুঁশিয়ার হও। (পৃ. ৯৪) হিন্দুদের পা চাটা, শয়তানের চর হচ্ছে, শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ইসলামের প্রভাব কমে যাচ্ছে (পৃ. ৯৫) দুটো যুগের মোকাবিলার মুখোমুখি (পৃ. ৯৬) নেহাৎই কথার কথা। অন্যদিকে রামানন্দ পণ্ডিতের মুসলমান ঘৃণা। (পৃ. ৯৮) সাধারণ মানুষের মনে পারস্পরিক ঘৃণার বীজ বপন। পণ্ডিত মশায় অন্ধ জাতিগর্বে ভরপুর। মিস লতিকা পালিত, সরোজিনী নাইডু (পৃ. ১০৭) গুরুত্ব পায় নি। ফটিকের গরীব বোধ সুব্যবহৃত। তার পত্নী প্রেম। মুসলমান সমাজে মেয়েদের দাবিয়ে রাখা (পৃ. ১২৫) স্বামী স্ত্রী সম্পর্কায়ন বড়ো, পাঠকপ্রিয়করণের কৌশল, পাটের মহাজন আগরওলার আড়তের ছবি। মুসলমানদের জোট বাঁধার ইঙ্গিত (পৃ. ১৩০) পাটের পয়সায় হিন্দুরা সব ফেঁপে উঠছে, আর গরীব মুসলমান চাষি ঋণগ্রস্ত (পৃ. ১৩১) প্রজা পার্টির ১/২ বার উল্লেখ, আড়তদারদের ফাঁদ। গ্রাম ও গঞ্জের জীবন। দাউদ চরিত্রায়নে দুশ্চরিত্রতা। ফুটকি, কালোজিরে (বেশ্যা) — ব্যক্তিক কামনা বেশি গুরুত্ব পায়।

    উপন্যাসটির দ্বিতীয় পর্যায়ের নাম — ‘মধ্যিখানে চর’। উপন্যাসটির মুখ্যচরিত্র শফিকুল প্রাণপণে চেষ্টা করত কোর্টকাজে সফল হতে। জানা যাচ্ছে সে একবছর হতে চলল জেলা শহরে আদালতে যাতায়াত করছে। সহকারী শিক্ষকের চাকরি খালি হয়েছিল, কিন্তু বউ বিলকিস তা নিতে দিল না। মৌলবী জয়নুদ্দিন তার উপকার করতে চায়, মুসলমান বলেই। জয়নুদ্দিনের উপলব্ধি — ‘হিঁদুরা কি মুসলমানের জন্য কিছু করে?’ তার ছেলে উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে চলে যায় রেঙ্গুনে। শফিকুল চাষীর ছেলে, তার না আছে পয়সা, না সামাজিক প্রতিষ্ঠা। আদালতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন — ‘দিগীন মিত্তির ও ভুবনমোহন বাঁড়ুজ্জে। খোনকার ইলেকশানে দাঁড়ায়, ব্যক্তিক সংকট, গোষ্ঠীগত বিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। খোনকার ভোটে দাঁড়িয়ে জিগির তোলে — মোসলেম সংহতি চাই। এখানে বিলকিসের একটা স্বপ্নদৃশ্য যাতে যৌন ইঙ্গিত আছে। মৃত ফুটকির কথা, স্বপ্নে। ফটিকের ভাবনায় বন্ধু মিস পালিতের প্রসঙ্গ। বিলকিসের অসুখ বাঁকা পথ ধরে। অন্যদিকে মুহুরি হরিবল্লভ এক মামলা এনে হাজির করে। ধর্ষণের মামলা। মামলা নিয়ে মেতে ওঠে শফিকুল। যদিও শফিকুলকে অসাম্প্রদায়িক রাখার চেষ্টা করেন লেখক। কোর্ট দৃশ্য উপস্থাপনা নয়া কৌশল। সময়টা ১৯৩৬-এ। খাদু প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী — ‘হিঁদুর জাতই হল দুমুখো সাপের জাত’ এবং হিঁদুদের সে বিশ্বাস করে না, পুন্নু ম্যাকরা তার সর্বনাশ করে ছাড়ছে। গয়া-ও বলে — ‘হিন্দু সমাজ বাবুদের সমাজ। হিন্দুরা অবস্থাপন্ন, মুসলিমরা গরীব। বশির বলে — জমিদার ও মহাজন তারা মুসলমানদের পাকে পাকে বেঁধেছে। অতএব — জোট বাঁধতে হবে। তবে — বশিরের মত — হিন্দু মুসলমান চাষী সব এক হলেই বিরুদ্ধপক্ষ জব্দ হবে। কেউ কেউ অন্ধ মুসলমান, কেউ কেউ হিন্দু মুসলমান জোটে বিশ্বাসী। ধর্মান্ধরা উসকারি দেয় বলেই দাঙ্গা বাঁধে। সংহতির অভাবে অবিশ্বাস। আর বাঁচতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মহাজনের কাছে চাষীদের টিকি বাঁধা, কৃষিঋণের পাহাড়। আর বিয়েতে পণ না নেওয়া। মুসলমানদের সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মহাজনদের ভূমিকা। এক হল- আল্লায় বিশ্বাস আর এক ঐক্য। অন্যদিকে আদালতের চাকরিতে অসফল শফিকুলের সংসার চলে শ্বশুরের পয়সায়। মেয়েদের ওপর পুরুষের চাপ, সাধারণ চাষীদের ওপর চাপ। বউ স্বামী নির্ভর কিন্তু তার মধ্যে বিচক্ষণতার অভাব। আদালত দৃশ্য, স্বামী-স্ত্রী কথা, স্বপ্ন নানান কৌশলে মুসলমান নারী পুরুষের উন্মোচন। হিন্দুরা জমায়েত করতে বাধা দেয়। মাঝে মাঝে হিন্দু মুসলিম চাষীদের ঐক্য — জমিদার আর মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। বশিরের বাড়িতে বৈঠকে দেখা যায় — ক) কৃষক ও ঘাতকদের মধ্যে মুসলমান বেশি খ) মুসলমানদের ছোট চাকরি আর তাদের মালিক জমিদার ও মহাজন। মৌলবীরা স্পষ্টত: সাম্প্রদায়িক — সম্বোধন — ‘বঙ্গের মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ’। এখানে একটু বলা হয় — অনেককাল ধরে হিন্দুদের অব্যাহত শোষণ। এ সংকট থেকে পরিত্রাণে হিন্দু বান্ধবী লতিকার সাহায্য দরকার। যদিও মিস পালিতের ভূমিকা উপন্যাসে স্পষ্ট নয়। এইবার অস্থির শফিকুলের মধ্যে বাড়িওলার মেয়ে সইফুন প্রসঙ্গে যৌন অভিলাষ, যৌনতার সংকট এখানে অধিকতর গুরুত্ব পায়। প্রসঙ্গত: শফিকুল মৌলবী সাহেবকে জানায় — ‘তুর্কি, রাশিয়া মেয়েদের মুক্তি দিয়েছে।' কিছু ফ্যান্টাসি, কিছু বরেণ্য হিন্দু নারী। এইখানে লালসাকৌশলী দাউদকে গল্পে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হয়। সামাজিক অর্থনৈতিক সংকট আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আবছা হয়ে যায় যৌন তৃষ্ণা, যৌন চিন্তা, দাউদ, সইফুল, মিস পালিত ইত্যাদির ভাবনা বলয়ে। ছবির মা হওয়ার সংবাদ ঘটনা পরম্পরায় চাঞ্চল্য আনে না। ফটিকের মনোদ্বন্দ্ব, ইসলাম পুরাণ আছে। কিন্তু নারী মুক্তির কথা গুরুত্ব পায় না। মাঝে মধ্যে চরিত্রগুলোর মধ্যে (বশির ইত্যাদি) হিন্দু বিদ্বেষ। মুসলমানদের আদিদেশ কোথায়, খোদার শাস্তি আছে তবে — হিন্দুরা যে চারদিক লুটেপুটে খাচ্ছে এবং লিগের বর্ধিষ্ণুতা (পৃ. ২২৩) তরুণ শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্রবোধের জোয়ার (পৃ. ২২৪) ফটিকের উপলব্ধির জগতে নানামুখী তরঙ্গ। উদারপন্থী মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথা (পৃ. ২৩০) তবে এসব গুরুত্ব পায় না।

    উপন্যাসটির ৩য় পর্যায়ের নাম — ‘দিগন্তে কালবৈশাখী’। এই পর্যায়টি পড়ার পর পাঠক বুঝতে পারেন — এখানে ‘কালবৈশাখী’ নানা ভাবে প্রকাশিত। প্রথমত: বিবেকানন্দ বঙ্কিম প্রভৃতি সূত্রে দিগম্বরবাবুরা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ তুলছেন। অন্যদিকে পাড়ায় পাড়ায় নির্বাচন কালে হিন্দু মুসলমানের বিরোধ প্রকট হয়ে উঠছে। শফিকুলের ব্যক্তিগত জীবনে নানা আলোড়ন — সাময়িক আবেগ বশত: ‘সইফুন’ বাড়িওলার মেয়েকে কাছে টেনে নেওয়া, তাছাড়া সুকৌশলী দাউদের লক্ষ্য অর্থ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং সইফুনকে হস্তগত করা। তবে এই শেষ পর্যায়ে ইতিহাস স্পষ্টতর হয়ে ওঠে — হিন্দুসভা, জাতীয়তাবাদ, প্রজা সম্মেলন, প্রজা আন্দোলন, দল ও দলবদল এ সবকিছু শফিকুলের সামনে। যদিও সে গোঁড়া মুসলিম নয়, দাউদের কৌশল বিস্তার, গরীব মুসলমানদের জন্য শফিকুলের দুশ্চিন্তা, বড়ো পরিসরে মহম্মদ আলির সুপারিশ গ্রহণ করে কংগ্রেস, মুসলিম সংহতি তৈরিতে তার দ্বিধা, তবে বিরোধের এই ক্রমবর্ধমান পটভূমিতে শফিকুলের ভাবনা বিনিময়, বন্ধু রাজনৈতিকতার সাথী দেখানো হয় নি। বরং দাউদ চরিত্রটি তার ধূর্ততা – নানাবিধ - সুচিত্রিত। দাউদের মনেও আশঙ্কা সইফুন প্রাপ্তি বিষয়ে ধীরে ধীরে কালবৈশাখীর মেঘের মতো জমাট বেঁধে উঠতে থাকল। (পৃ. ২৮৩) দাউদের মনে হিন্দু বিদ্বেষ (হিন্দু চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে নেমতন্ন করার কোনো মানে হয় না।) পেমেন্ট প্রসঙ্গে গাজী গোলামের সঙ্গে কথাবার্তায় জানা যায় — ‘তাদের দিকে কৃষক প্রজারা খোনকারকে হারাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।’ বারংবার গ্রেপ্তার সফিকুল যে প্রজা খেপানোর মাতব্বর তা অবশ্য দেখানো হয়নি। আবু তালেব-এর সঙ্গে কথাবার্তায় ‘মান্যবর খাজা নাজিমুদ্দিনের’ কথা, সুযোগ্য ভাইস চ্যান্সেলর (হাসান সোহরা ওয়ার্দি) কথা ইতিহাসের সামগ্রী (পৃ. ২৮৯)।

    মৌলবী জয়নুদ্দিনের কথাবার্তায় প্রকট হিন্দু বিদ্বেষ, ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকা স্বদেশী ওয়ালাদের গীতা বেদ বাইবেল’- এটাও ইতিহাসের সামগ্রী। শফিকুল মুসলমান মৌলবাদীদের সঙ্গে মেশে, কিন্তু লিবারাল মুসলমান তার চারপাশে নেই। হিন্দু মাত্রকেই শত্রু ভাবতে পারে না। শফিকুলের চিন্তায় লেখক দেখান — ‘হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্ব মূলত: মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চাকরি এবং রাজনীতি এই দুইয়ের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব।’ (পৃ. ২৯৩) দাউদ ও গাজী গোলামের কথাবার্তায় মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির মদত পাওয়ার (খান বাহাদুরের) কথা। গাজী গোলাম কৃষক প্রজা পার্টিকেই হিন্দুদের দালাল বলছে। (পৃ. ২৯৭)। ভোট ও জনগণ আলোচ্য, সেখানে নারী লালসা প্রকট ‘বিবি আর মুরগি যত ছোট তত তার স্বোয়াদ’ (পৃ. ২৯৯) লেখকের শিল্প কৃতিত্ব প্রকাশ পায়। দাউদের ভাবনাবলয়, মৌলবী সাহেবের মুসলিম বিশ্বাস উপস্থাপনায় লেখকের কৃতিত্ব। মৌলবীর ভাষা ব্যবহারের প্রভাববিস্তারী ভঙ্গিমা (পৃ. ৩০০) লেখক কৃতিত্ব পরিচায়ক। মেয়েদের শিক্ষা প্রসঙ্গ সুকৌশলে সংলাপে (মৌলবীর) ব্যক্ত। আংরেজিবালা ও গোঁড়া মুসলিম — দুটোই বাস্তব, লেখক সচেতনতা। কৃষক প্রজা দলের ভাবনা, বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট এসব লেখক সদ্ব্যবহার করেছেন। এ এক রাজনৈতিক সার্কাস — মোক্ষম উপমা। কলকাতা ফেরৎ দুটি মুসলমান যুবককে (দিলওয়ার ও কাসেম) দেখানো হয়, কিন্তু গুরুত্ব পায় না। অমৃতবাজারে সাহেবের ধিকৃত (হক্ সাহেবের) প্রজাস্বত্ব আইনের সংস্কার, পার্লামেন্টারি বোর্ডে ১১জন অবাঙালি, জমিদারী উচ্ছেদের কথা বলে লোক ঠকানো — এসব নিছক না বলে কথাবার্তায় এনে ভালো করেছেন। ৩য় পর্যায়ে ১১ অধ্যায়ের উপস্থাপনা সৃজনে লেখকের কৃতিত্ব। সেখানে আঞ্চলিকতা। সংলাপে ধ্বন্যাত্মকতা ব্যবহারে নৈপুণ্য, খোনকারের আবেগময় মুসলমান ঐক্য দলাদলি ঝটাপটি প্রসঙ্গে বাদুড়ের উপমা (পৃ. ৩২৩) নৈপুণ্য প্রকাশী। হিন্দুদের কাগজ আনন্দবাজার বাগবাজারি ইংরেজি অমৃতবাজার উল্লেখে উপস্থাপনার ব্যাপকতা চমৎকার। হকের প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনা, কংগ্রেসে জোরদার হিন্দুত্ব, নতুন নতুন মতলব দুপক্ষে। সইফুনকে আয়ত্তে পেয়ে দাউদ ব্যক্তি কামনা ও রাজনৈতিক উপলব্ধি একই সঙ্গে আনা হয়। ১৪ নং অধ্যায়ে প্রজাপার্টি ও লীগে কোয়ালিশন - ইতিহাসের সামগ্রী। ফজলুল হকের উদ্যোগ-। কিন্তু ক্রমান্বয় বিষণ্ণ শফিকুল — ‘তার বোধের দিগন্তে আসন্ন এক কালবৈশাখীর ক্রুদ্ধ আয়োজন দেখতে পাচ্ছে’। (পৃ. ৩৩৭) ধর্ম বাটখারায় মানুষ মূল্যায়ন যে যথার্থ হয় না এটা শফিকুল বিশ্বাস করে। মুসলিম উগ্রতাকে সে ভয় করে। উপন্যাসের উপান্তে — শফিকুল ও বিলকিসের বাচ্চার মৃত্যু — যা ব্যক্তিক সংকট। শেষ পর্যন্ত সে ছবি অর্থাৎ বিলকিসকে একান্ত আশ্রয় করতে চায়।

    উপন্যাসটির নামকরণ — প্রেম নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয় না হিন্দু ও মসুলমানের মধ্যে বিংশ শতাব্দীতে প্রেমের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়েছে। লেখক অবশ্য গৌচন্দ্রিকায় এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে ৩য় পর্যায়ের ৪র্থ অধ্যায়ে ফটিকের উপলব্ধির যে বিবরণ লেখক দিয়েছেন তাতে ব্যাপারটা স্পষ্ট। দাম্পত্য শয্যায় তা ব্যক্ত হয়েছে। ফটিক বুঝতে পারে — ‘যে আন্দোলনই শুরু হোক না কেন শেষ পর্যন্ত তা হিন্দু-মুসলমান সংঘাতেরই পটভূমি তৈরি করে তুলছে। (পৃ. ২৭৯) কবীর লালন চণ্ডীদাস এঁরা মানুষে মানুষে সমত্বের কথা বলেছেন। ত্রিশের মানুষ দেখছে তা হয় না, কারণ ‘আমাদের প্রেম নেই, আছে রাজনীতি’। (পৃ. ২৮০)। সে আরো ভাবে, ‘প্রেমের অভাবেই মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে। প্রেমই মানুষকে কাছে টানে। প্রেমই জাত পাত এই সবের ভেদ চিহ্ন উড়িয়ে দেয়। তখন তার সামনে যে সমস্যাই আনো তা অর্থনীতিই হোক আর রাজনীতিই হোক তার সমাধান সহজ হয়ে ওঠে।’ (পৃ. ২৮০) ভালো কথা। এই ইউটোপিয়া বাস্তব করতে উপন্যাসের এই মুখ্য চরিত্রটি কি করেছে? হিন্দু মুসলমান মৈত্রীর প্রচেষ্টা বা তৎপরতার কোনো ছবি / ঘটনা এ উপন্যাসে নেই। আর এক জায়গায় ফটিকের ভাবনা একাকীত্বের। ‘চরটা দেখি প্রতিবারই বাড়ছে। আর যা ছিল একটা প্রবল বেগবতী ধারা তাকে এই বিভাজক বালুর চরটা ক্রমশ দুটো শীর্ণ বেণীতে পরিণত করে তুলছে। চরটা যত বাড়ছে, দুটো স্রোতকে তত ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’ (পৃ. ২০৫) তাকে গোঁড়ারা বলে— ‘হিঁদুদের গুলাম।’ (পৃ. ২২৮) রেজাউল করীমের গলা মেলানোর কথা মনে পড়ে। ‘প্রতিবেশী’ উপন্যাসে ইতিহাস কাল প্রসারিত হয়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের ঐক্যমনস্কতা, শ্রদ্ধানন্দের মৃত্যু, ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট ডিরেক্ট অ্যাকশন, মৈত্রীর যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, শত সহস্র মানুষ ছিন্নভিন্ন, তারপর খণ্ডিত ভারত ও স্বাধীনতা। দুই সম্প্রদায়ের প্রেমের সমাধি।

    সেই সূত্রে বলা চলে ‘প্রতিবেশী’ নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। হিন্দু মুসলমান মৈত্রীর প্রয়াস শফিকুল দেখায় নি, শামিম গাঁয়ে ফিরে বন্ধুদের হিংস্রমন দেখে ভয় পেয়েছে। অমিতার স্মৃতিতে ছিল বিভিন্ন স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানে পৃথক পানি। আলাদা নির্বাচন, আলাদা দেশ, কিন্তু মৈত্রী আসেনি। একমাত্র মৃত্যুতেই সম্প্রদায়ের সমত্ব।

    কোনো কোনো উপন্যাসের আলোচনায়, ফিকশনাল ন্যারেটিভ ও হিস্টরিকাল ন্যারেটিভ-এর সমন্বয় বা পারস্পরিকতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘প্রেম নেই’ তেমনই একটি উপন্যাস।

    অমর্ত্য সেন বলেছিলেন — মুসলিম বিজয়ের পরে (ত্রয়োদশ শতাব্দী) হিন্দু ও মসুলমানরা ‘বিভিন্নভাবে সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন।’ কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে বরাবরই মানসিক সংকীর্ণতা ছিল। একটা সময় জমিদার রবীন্দ্রনাথ কোরবানি নিয়ে বিবাদ ওঠায় মুসলমান প্রজাদের ডেকে বলে দেন তারা যেন কাজটা এমনভাবে সম্পন্ন করে যাতে হিন্দুরা অকারণে আঘাত না পায়। (হিন্দু মুসলমান) এ হল স্থিতাবস্থার পরিস্থিতি। জাজিমে বসা না বসার বিধানও মুসলমানরা মেনে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন হিন্দু ও মুসলমানে আছে ধর্মগত ভেদ এবং সামাজিক শক্তির অসমকক্ষতা। হিন্দু ও মুসলমান পার্থক্য কুশ্রীভাবে বেআব্রু। স্বদেশী প্রচারক দলের মুসলমান বন্ধুকে তৃষ্ণা মেটাতে দাওয়া থেকে নেমে জল খেতে বলে। বাস্তব হল ‘পরস্পরের পার্থক্যর উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া।’ (উপন্যাসটির সূচনা অংশে বিলকিস ও টগর এর রঙ্গ ঠাট্টা সব চুরমার হয়ে যায় টগরের আর্তনাদে — ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য ঘড়া মেজে ডুব দিয়ে জল ভরা। উপন্যাসের আর কোথাও এই বাস্তবের দ্বিতীয় উদাহরণ নেই)। মুসলমান রাজত্বে ‘একটা আধ্যাত্মিক উদ্বোধনের কাজে ‘কত হিন্দু সাধু ও মুসলমান সুফির অভ্যুদয় হইয়াছিল’, অনৈক্যের মধ্যে সত্যের অধিষ্ঠান আবিষ্কার। (স্বাধিকার প্রমত্ত) রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন — ‘ধর্মমতে হিন্দুরা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল।’ একথা গৌরকিশোরে স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বলেন— বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্বে নেতাদের মধ্যে চেনা কয়েকজন ছিলেন মুসলমান। স্বদেশী আন্দোলনের পরও লিয়াকত হুসেন ‘বন্দেমাতরম’ গান গেয়ে বেড়াতেন, দুই সম্প্রদায়ের মিলনের জন্য স্বদেশী নেতারা নানা প্রয়াস চালাতেন। (সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ) মুসলমান জমিদাররা নিজ স্বার্থেই মুসলমান চাষিদের তাতিয়ে তুলতেন। (পূর্বোক্ত) দাঙ্গার সময় হিন্দু নারী ধর্ষণ চেষ্টা। স্বদেশী, বয়কট, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাঙলার মুসলমান সমাজের বেশিরভাগই যোগ দেয়নি। কিন্তু যারা যোগ দেন তারা এলেন নতুন চেতনা নিয়ে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালীত্বের চেতনার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন বিনয়কুমার সরকার। (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য- বাঙালীর নতুন আত্মপরিচয়, পৃ.৭৩)

    ড. চন্দনকুমার কুন্ডু বলেন— এই এপিক ট্রিলজির সময়সীমা ১৯২২ থেকে ১৯৪৬, এবং ‘প্রেম নেই’-এর ঘটনাকাল ১৯৩৫-৩৭ খৃষ্টাব্দ। (ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ) প্রথমেই স্মর্তব্য অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ বাংলা উপন্যাসের দর্পণে তৈরি হল ১৯০৬, ৩০ ডিসেম্বর। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ১৯৩৬, মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী।

    খিলাফৎ আন্দোলন। মুসলমান সম্প্রদায়গত সত্তা তৈরি, ধর্মকে মূল, সে অনুযায়ী উন্নয়ন, সম্প্রদায় হিসেবে ধর্মীয় নব ধারণা। স্বল্পসংখ্যক মুসলমান বৃহৎ ভূস্বামী, বেশির ভাগই দরিদ্র কৃষক (উচ্চ কোটিরা কায়িকশ্রম বিরোধী) উপন্যাসে মুসলমান কৃষকদের কথা কতটুকু? শফিকুল চাষার ছেলে, শুধু উল্লেখ, চাষীত্ব নেই।

    পেশাদারী মধ্যস্তরীয় কম, বিশিষ্ট মুসলমানী সভা দানা বাঁধছিল উনিশ শতকের গোড়া থেকে। প্রথম মুসলমান সংগঠন বাংলায় আঞ্জুমান ই ইসলামি ১৮৫৫, লক্ষ্য- মুসলমানদের স্বার্থ পুরণে উৎসাহ দান, ব্রিটিশের কাছে আনুগত্য প্রকাশ। (উপন্যাসে এসব নেই)

    স্যার সৈয়দ মুসলমানদের আধুনিক করার উদ্যোগ নেন, আলিগড়ে মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (১৮৭৫), ১৯৩৭-এ ফজলুল হক ও তাঁর কে.পি.পি নির্বাচনে মুসলিম লীগের কাছে চ্যালেঞ্জ, এ বছরই লীগে যোগ কিন্তু জিন্নার রাজনীতিকে অনুমোদন করেননি, ১৯৪১-এ জিন্না কর্তৃক কঠোরভাবে তিরস্কৃত হলে জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদ ও লীগ উভয় জায়গা থেকে ইস্তফা। হক শ্যামাপ্রসাদকে সহযোগী নেতা করে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যৌথ সরকার গঠন করে। কিন্তু তা ভেঙে দেওয়া হয় ১৯৪৩ মার্চে এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা প্রতিষ্ঠা, এতে লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। লীগ নির্বাচনে জয় পায় বিপুলভাবে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব লীগ কেন গ্রহণ করেছিল এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার কথা বলেন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় (পৃ.৫২৭)। ১৯৪৬, ১৬ আগস্ট থেকে পাকিস্তানের জন্য গণআন্দোলন আরম্ভ হয়। কলকাতার মহা হত্যাকাণ্ড। জয়া চ্যাটার্জির মতে ১৯৩০ এর শেষদিকে হিন্দু সংগঠনগুলি (হিন্দুসভা, ভারত সেবাশ্রম, হিন্দু মহাসভা) একত্রিত হতে, স্বেচ্ছাসেবীদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। সুরঞ্জন দাসের মতে উচ্চকোটির ও সাধারণ মানুষের সাম্প্রদায়িকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস। ওয়াভেল মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে ভারতীয় অন্তবর্তী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। জওহরকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৯৪৬, ২ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস প্রভাবিত সরকার শপথ নেয়। কিন্তু পরে লীগকেও সরকারে যোগদানে রাজি করানো হয়। লীগের দাবিগত জটিলতা। জিন্না পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ চাইছিলেন না। মাউন্ট ব্যাটেনের ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ১৯৪৭-র ১৫ আগস্ট। পাঞ্জাব ও বাংলার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে উদ্বেগ। পাঞ্জাবে হিংসাত্মকতা। বাংলায় সুরাবর্দী ও আবুল হাশিম পরিচালিত এক গোষ্ঠী ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দের মে মাস থেকে ঐক্যবদ্ধ সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাব দিতে শুরু করে, শরৎ বোসও সমর্থন করে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা ভাবত এটি পাকিস্তান সৃষ্টির কৌশল যার মধ্যে থাকবে অর্থনৈতিকভাবে ধনী পশ্চিমবঙ্গ। এই প্রস্তাব বাতিল। ১৯৪৭ এপ্রিল থেকে স্থানীয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সুসংগঠিত অভিযান গুরুত্ব পায়। জুন মাসের শেষে ভারত ভাগ বাস্তব। ২০ জুন বাংলার অ্যাসেমব্লি ও ২৩ জুন পাঞ্জাবের অ্যাসেমব্লি দেশভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। এই জটিল পালাবদল পর্ব শেষ দুটি পর্বে (প্রেম নেই, প্রতিবেশী) অতি সামান্যই, অস্পষ্টতায় পরিবেশিত।

    কৃষকপ্রজা পার্টি, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, মুসলিম লীগ, স্ত্রী শিক্ষা, মিলিট্যান্ট ন্যাশনালিজম, প্রজা ও লীগ, কংগ্রেস ও প্রজা কোয়ালিশন, ১৯৩৫-এ গভর্ণমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট প্রভৃতি অনেক সামাজিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অন্তত আমার কাছে ব্যক্তি চরিত্রের গঠনে ইতিহাসের অভিঘাত খুবই সামান্য। বিবেকানন্দ, বঙ্কিম, সরোজিনী নাইডু, রেজাউল করীম, কবির, নানক, কাজী আবদুল ওযুজ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রভৃতির উল্লেখ আছে। কিন্তু শফিকুল বা ফটিককে এই আলোকশিখা গড়ে তুলতে পারেনি। উপন্যাস শেষে ফটিক একমাত্র স্ত্রীকেই বলে— ‘তুমি আমাকে ধরে রেখো ছবি’। শফিকুল কি সত্যিই ‘ঘড়ির পেন্ডুলাম’ হতে পেরেছিল?

    সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে আমার পছন্দসই। তিনি বলেন— গৌরকিশোরের কথাসাহিত্য ‘আঙ্গিক ও অনুভবের দিক থেকে সহজেই দুভাগে ভাগ করে দেওয়া যায়। ছোট এলাকায় প্রখর আলোকপাত, পাত্রপাত্রী কম, নিবিড়তা বেশী। (এই দাহ, কমলা কেমন আছে) অন্যত্র অনেকখানি এলাকায় ছড়িয়ে আলো ফেলা, পাত্রপাত্রীর অনেক নিবিড়তার সুযোগ কম, দেশকালের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। (জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, প্রতিবেশি) আমার মনে হয় এই দ্বিতীয়ভাগের লেখাতেও ছোট জায়গায় প্রখর আলোকপাতের ঝোঁকটা অত্যন্ত বেশি। ইতিহাসের বড়ো সময়ের অন্তর্গত করতে পারেননি চরিত্রগুলিকে। শেষোক্ত তিনটি রচনা ‘রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক’। কিন্তু এপিক পড়ার অভিঘাত আসে না’। (বাংলা উপন্যাস ও তার আধুনিকতা)

    ক্ষেত্র গুপ্ত মার্কসবাদ মনস্ক হয়েও একই কথা বলেন— অর্থাৎ ‘শেষদিকের বইগুলিতে আবার কতকটা মূল ধারায় ফিরে যান।’ রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণতা অপেক্ষা যৌন মনস্তাত্ত্বিকতায় ঝোঁকেন বেশী মাত্রায়। ‘প্রেম নেই’ প্রসঙ্গে বলেন— তাঁর সেরা লেখা। ক) মুসলিম জীবনের পরিবারের ও সমাজের অতিঘনিষ্ঠ ছবি এঁকেছেন। খ) যশোহর জেলার কুষ্ঠিয়া অঞ্চলের গ্রাম ও আধা শহরের ভূগোলে নিবিষ্ট গ) শেষদিকে রাজনৈতিক আশাভঙ্গ, প্রথম পুত্রের মাতৃগর্ভে বিনষ্টি রূপকের মতো ঘ) বিশালতা আছে সাধারণ জীবনাত্রয়ী ঙ) নাট্যমুহূর্তের সংযমী প্রকাশ চ) কুষ্ঠিয়া অঞ্চলের ভাষারীতি, সংলাপে বর্ণনায় ব্যক্ত। মুসলমান সমাজের নিবিড় ছবির জন্য প্রশংসা পান। অশ্রুকুমার সিকদার বলেন— বিলকিস ও টগর চিত্রায়নে ‘সামাজিক দূরত্বের কথা’ (আর কোথাও নেই)। বঞ্চিত হিন্দু এবং বঞ্চিত মুসলমানের বিকারের দিকটা চমৎকার চিত্রিত। (ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য)।

    তাঁর শতবর্ষ উদযাপন কালে সুগত বসু এবং রুশতী সেন দুটি লেখা লিখেছেন। এঁদের বক্তব্য নিয়ে কিছু কথা বলার সামর্থ্য নেই। সুগতবাবুর বক্তব্য— ক) ‘গান্ধীর পথ ধরেই গৌরকিশোর ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে চিহ্নিত করেছিলেন মনুষ্যত্বের শত্রু হিসেবে’। খ) যে দেশপ্রেম মানবিকতাকে মূল্য দেয় সেই দেশপ্রেম খাঁটি। (তাই কি?) গ) গৌরকিশোরের ইতিহাসবিদ এবং মাস্টার অব পলিটিক্যাল স্যাটায়ার ঘ) সাহসী প্রতিবাদী সাংবাদিক। ঙ) উনিশশো বিশের শতকের মধ্যভাগে গ্রাম ও শহর বাংলার অপূর্ব বিবরণ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ উপন্যাসে।। বিনয়ের সঙ্গে বলি উপন্যাসটি মুসলমান জীবনের নিপুণ বিবরণ এবং খণ্ডিত বিবরণ। শহরবাংলা কি গুরুত্ব পেয়েছে? গান্ধী দেশবন্ধু রবীন্দ্রনাথ পরিত্রাণের পথ নির্দেশক সুগত এবং গৌরকিশোরের কাছে। সুগত বলেন ‘১৯৭২-এ নানা দ্বিধা-সংশয় থাকা সত্ত্বেও সিপিএমের চাইতে নব কংগ্রেসকেই মন্দের ভাল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।’ এটা অবশ্য বুদ্ধিবিবেচনার পরিচায়ক নয়। তার ৩ বছরের মধ্যেই নব কংগ্রেসভক্ত লেখক জরুরী অবস্থার প্রতিবাদে সোচ্চার হন কি ভাবে? ফ্যাসিবাদ কংগ্রেসের নানা ভাগে কি ছিল না? কণ্ঠরোধ বা লেখার অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হবার সক্রিয়তার আর কোন পরিচয় জেল মুক্তির পর আছে? সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ভারতের ইতিহাসে কতটুকু? দেশবন্ধু ও তার চিন্তা কতদূর সীমাবদ্ধ এ বিষয়ে ‘ইতিহাসবিদ’ দুজনের বক্তব্য কি? বহমান ইতিহাস এ বক্তব্যের অসারতা দেখিয়ে দেয়। রশভী সেন তাঁর পূর্বার্জিত দক্ষতায় গৌরকিশোরের কথাসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা দেখাতে গিয়ে হুজুগপ্রিয় পাঠকসমাজের ঔদাসীন্য নিয়ে মন খারাপ করেছেন। গৌরসত্তার যথার্থ্য নিরূপণ রসজ্ঞ সমালোচকবৃন্দও করেন নি, তবে মুসলমান জীবননির্ভর ট্রিলজি তো বেশ জনপ্রিয়। তবে তাঁকে চেনার মধ্যে নানা জটিলতা আছে, পূর্বাপর অসঙ্গতি আছে, সাধারণ পাঠকদের কাছে আদৃত নন এমন অনেকেরই একজন তিনি। আলোকবর্তিকা কি না বলতে পারব না। তিনি একলা চলার পথিক, সেই পথিকবৃত্তি তো এবার কিছুটা সম্মান পাবে বলেই মনে হয়।



    অলংকরণ (Artwork) : ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments