• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সান্তা ও মান্তার গল্প : বিশ্বদীপ সেনশর্মা



    শাশ্বতী নিউজার্সিতে তাঁদের বাড়ির ব্যালকনিতে বসে ছিলেন। বাইরের তাপমাত্রা এখন শূন্যের থেকে কয়েক ডিগ্রী নীচে৷ কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে পেঁজা তুলোর মত বরফ পড়ছে। কদিন থেকেই পড়ছে। বাড়ির লন, রাস্তাঘাট, পার্ক, খেলার মাঠ, সব কিছুই বরফে ঢাকা পড়েছে। প্রতিদিন সকালে প্রশাসন থেকে লোক এসে বরফ পরিষ্কার করে দিয়ে যায়, আবার পড়ে। চারিদিক একঘেয়ে যেন সাদা চাদরে ঢাকা এই দৃশ্য দিনের পর দিন দেখতে দেখতে বিরক্ত লাগে। তবে এখন ক্রিসমাসের সময়, আজ ক্রিসমাস ইভ। রাত পোহালেই মেরি ক্রিসমাস। তাই দোকানপাটগুলি রঙিন আলোর মালায় সেজে উঠেছে। প্রতিটি বাড়ির সামনে সুসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রী। সন্ধ্যা হলে এই খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই অনেকেই ক্রীসমাসের আলো দেখতে আর শেষমুহূর্তের কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়বে। শাশ্বতীরাও হয়ত বেরতেন, কিন্তু বিশেষ কাজে সম্বিৎকে গাড়ি নিয়ে একটু বেরতে হয়েছে। তাই পাঁচ বছরের মেয়ে মান্তাকে নিয়ে শাশ্বতী বাড়িতে।

    —মম। মান্তা ঘুম থেকে উঠে এসেছে। শাশ্বতীকে জড়িয়ে ধরে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ আদর চাই। শাশ্বতী তার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বললেন, যাও আজ তো ছুটি। নতুন স্টোরিবুকটা নিয়ে বসে পড়ো।

    মান্তা বলল, ওকে। তারপর বলল, মম, আই হ্যাভ চেঞ্জড মাই উইশ। —মানে?

    —মান্তা বলল, আগে একটা রোবট চেয়েছিলাম। এখন তার বদলে একটা গীটার বাজান বার্বি ডল চেয়েছি। আয়াম সিওর সান্তা উইল গেট ইট।

    শাশ্বতী প্রমাদ গণলেন। রোবট অলরেডি আনিয়ে রাখা হয়েছে৷ এখন শেষমুহূর্তে গীটার বাজান বার্বি কোথায় পাওয়া যাবে?

    তিনি মুখে কিছু বললেন না। মান্তাকে পড়াতে বসিয়ে সম্বিৎকে ফোন করলেন। সম্বিৎ সব শুনে বলল, দেখছি, সুপারমার্কেটে কোথাও না কোথাও হয়ত পেয়ে যাব।

    শাশ্বতী আবার ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন। এখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার ও বরফের মধ্যে চারিদিকে ক্রীসমাসের আলো দেখতে ভারি ভাল লাগছে। দেখতে দেখতে শাশ্বতী অনেক বছর আগে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন।



    তখন তাঁর বয়স কত হবে… মান্তার মতই। উত্তর কলকাতার যৌথ পরিবার থেকে তাঁরা সবে ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন। বাবা রজত, মা সুতপা আর শাশ্বতীকে নিয়ে তিন জনের ছোট্ট সংসার।

    সেদিনও ছিল ক্রিসমাস ইভ। স্কুলে একটা ফাংশন ছিল তাই শাশ্বতীকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। স্কুল থেকে ফেরার পর সুতপা দেখলেন, শাশ্বতীর মুখ ভার৷ তিনি জিগ্যেস করলেন, কি হয়েছে মামণি?

    শাশ্বতী বলল, মম, বি সেকশনে মিমি পড়ে, আজ আমাদের সঙ্গে ফাংশন করতে এসেছিল। ও না খুব দুষ্টু, বলছিল সান্তাক্লজ বলে আসলে কেউ নেই, গিফটগুলো সবার বাবা-মারাই লুকিয়ে নিয়ে এসে ক্রিসমাস ট্রির তলায় রেখে দেয়। সত্যি মা?

    সুতপা মুশকিলে পড়লেন৷ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সান্তা ক্লজকে আমিও দেখিনি৷ তবে আমাদের ছোটবেলাতেও সে গিফট নিয়ে আসত। বাবা -মা বলতেন সে রাতের বেলা লুকিয়ে আসত।

    শাশ্বতী ওইটুকুতেই খুশি হয়ে বললেন, তা হলে সান্তা আছে, না মা?

    সুতপা এবারে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আছে৷ কিন্তু তুমি খেলবে তো নীচ থেকে খেলে এসো, সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

    শাশ্বতী খেলতে চলে গেল। কিন্তু একটু পরেই কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে বলল, তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বললে৷ নীচে খেলার সময় কান্তার দিদিও আবার বলল, সান্তা ক্লজ নেই। তোমার সঙ্গে আড়ি আড়ি।

    সে কাঁদতে কাঁদতেই নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে সুতপা খেতে ডাকতে গিয়ে দেখলেন মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, চোখের তলায় কান্নার দাগ শুকিয়ে রয়েছে। তাঁর বড় মায়া হল।

    একটু পরে রজত বাড়ি ফিরতে সুতপা পুরো ঘটনাটা বললেন। রজত বললেন, হুঁ, ছেলেমানুষ, হঠাৎ করে জেনে যাওয়ায় মনে আঘাত পেয়েছে। আর দু-একটা বছর পরে নিজেই বুঝে যেত। দাঁড়াও দেখছি কি করা যায়।

    সুতপা অবাক হয়ে বললেন, এখন আর কি করবে?

    রজত বললেন, দেখি। তারপর তিনি অফিসের জামা-কাপড় না ছেড়েই টেলিফোন নিয়ে বসলেন। বেশ কয়েকটা ফোন করার পর বললেন, হয়েছে।

    সেদিন অনেক রাতে রজত শাশ্বতীকে ডেকে তুলে বললেন, মামণি দ্যাখ, কে এসেছে!

    শাশ্বতী ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে অবাক।

    বাবা আর মার সাথে লাল-সাদা পোষাক পরা, সাদা দাড়ি-গোঁফ, কাঁধে ঝোলা ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে? আপনা থেকেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, সান্তা ক্লজ!!

    সান্তা গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে মুচকি হেসে ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে একটা খুব সুন্দর প্যাকেট বার করে তার দিকে এগিয়ে ধরল। সে প্যাকেটটা নিল, কিন্তু এত অবাক হয়ে গেছে যে থ্যাঙ্ক ইউ বলতেও ভূলে গেল। সান্তা এবার তাকে হাত নেড়ে টা-টা করল, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাবা হেসে বললেন, এ বারে বিশ্বাস হল তো? নে, আবার ঘুমিয়ে পড়।

    শাশ্বতী অতীত থেকে ফিরে এলেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন মেয়ে যাতে দুঃখ না পায় তার জন্য রজত সেদিন রাত্রে কত যোগাড়-যন্ত্রই না করেছিলেন।

    ...মম।

    মান্তা ডাকছে। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। তিনি উঠে গেলেন। মান্তাকে খাইয়েটাইয়ে একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এলেন।

    শাশ্বতী আবার ব্যলকনিতে এসে বসলেন। কাঁচের ওপারে মিহি তুলোর মত বরফ পড়েই চলেছে। কাল সকালে গ্যারেজের সামনে আর বাগানে উঁচু হয়ে বরফের স্তর জমে থাকবে, সম্বিৎ গামবুট পরে বেলচা দিয়ে পরিষ্কার করবেন, নয়ত গাড়ি বার করা যাবে না।

    সম্বিতের মেসেজ ঢুকল। পুতুলটা পাওয়া গেছে, সে মিনিট পনেরর মধ্যে আসছে।

    শাশ্বতীর মুখে হাসি ফুটল। কাল সকালে মান্তা উঠে খুব খুশি হবে। তবে এবারে ওকে ধীরে ধীরে বলে দেওয়াই ভাল। তাঁর মনে হল, শোক-তাপের এই পৃথিবীতে বড় হতে হতে সব শিশুই একদিন জেনে যায় সান্তা নেই। উত্তর মেরু থেকে হরিণে টানা বরফের স্লেজে করে শিশুদের জন্য নানা রঙের প্যাকেট নিয়ে কেউ আসে না। জেনে কদিন একটু মন খারাপ হয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে সয়ে যায়। এরই নাম বোধহয় বড় হওয়া।

    নাকি আসলে কেউ বড় হয় না? মানুষের হৃদয়ের গভীরে একটি শিশু লুকিয়ে থাকে। দুঃখ-কষ্ট সমস্যায় জর্জরিত মানুষ যখন হাঁফিয়ে ওঠে, শিশুটি গভীর প্রত্যয়ে জানে একদিন রাতে চুপি চুপি সেই লাল-সাদা পোষাক পরা বুড়োটা আসবে আর তার ক্রিসমাস ট্রীর তলায় রেখে যাবে আশ্চর্য এক উপহার। সে সেই বিশেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে।

    সম্বিতের গাড়ি এল বোধহয়। শাশ্বতী গায়ে একটা শাল জড়িয়ে উঠলেন। ওর হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে৷

    পৃথিবীর শিশুদের জন্য আরও একবার সান্তার আসার সময় হয়ে এল৷



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments