আমার অফিস ছিল ভাড়া বাড়িতে। গাড়িবারান্দা সহ। পোর্টিকো পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ডান দিকে আমাদের বড় সাহেবের অফিসঘর। করিডর পার হলে বড়বাবু ও অন্যান্য ক্লার্ক-বাবুদের বসার জায়গা। দু’-চার জন পিয়ন ঘুরে বেড়ায়, কখনো ফাইল নিয়ে এঘর-সেঘর, কখনো চা নিয়ে অফিসারদের ঘরে। অফিসের বাইরে চায়ের দোকানের দুটো এঁচোড়ে পক্ক ছেলে সবাইকে চা দিয়ে যায়, গ্লাসে। শুধু অফিসারদের ঘরে চা দেয় অফিসের পিয়ন, অফিসেরই কাপে। আমি আগে গ্লাসেই চা খেতাম, এই অফিসেই। এখন কাপে চা খাই । অনেক পরে প্রোমোশন বদলি হয়ে অফিসার হয়ে যাই অন্য অফিসে। বছর দশক পরে ফিরলাম এই অফিসেই। অনেক পুরনো কর্মচারিরা এখনো আছেন, কেউ কেউ অবসরও নিয়েছেন। সবাই খুব খুশি আমি ফিরে আসাতে। ছোট অফিসারেরা অনেক কাজে লাগে। বড় সাহেবের কানে দুঃখের কাহিনী শুনিয়ে ছুটি মনজুর করাতে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ওঠাতে, মেডিকেল বিল পাইয়ে দিতে, পছন্দমত জায়গায় বদলি হতে, আরও কত কি। আর পাঁচটা সরকারি অফিসের মত আমার ঘরের সামনেও টুল নিয়ে একজন পিয়ন বসে থাকে, ফাইল কাগজপত্র দেওয়া-নেওয়া করে, চা এনে দেয়। লোকজন দেখা করতে এলে নাম লেখা চিরকুট দিয়ে যায়, ডাকলে ভেতরে পাঠায়।
শনিবার বিকেল চারটায় অফিসে বসে কাজ করছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই হাতের কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব, পুরো সন্ধ্যেটা পাওয়া যাবে। হঠাৎ হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো লোকটা, সাথে বাচ্চা একটা মেয়ে। ঢুকেই মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে, আমার টেবিলের সামনে। আমি হতবাক, এমন তো কখনো হয় না। পিয়নটা কোথায় গেল? ওর চোখ এড়িয়ে একটা মাছিও ঢুকতে পারে না!
মেয়েটিকে এক ঝলক দেখলাম, আমার নাতনির থেকে অনেকটাই বড় হবে। বয়স বছর ছয়, পরনে ফ্রকটা বেশ নোংরা। খালি পা, হয়তো বাইরে চটি খুলে এসেছে। চোখের দৃষ্টি শান্ত। শ্যামলা রঙ, মুখটা বেশ কমনীয়, মুখের সামনে দু-চার গোছা চুল এলোমেলো পড়ে আছে। অবাক বিস্ময়ে আমায় দেখছে, ঘরটা দেখছে, টেবিলে আমার ফোনটা, মাথার ওপরে ফ্যান। বাবা পাশে মাটিতে শুয়ে কেঁদে যাচ্ছে, ও দাঁড়িয়ে দেখছে। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। এদিকে লোকটা কেঁদেই চলেছে। বললাম--আরে কে তুমি? কী হলো, এত কান্নাকাটি করছো কেন? কী হয়েছে তোমার?
কোনো কথা নেই, খালি কান্নার আওয়াজ। সাষ্টাঙ্গে শুয়ে আছে আমার টেবিলের সামনে। এরকম মাটিতে পড়ে থাকলে বিব্রত লাগাই স্বাভাবিক, তার ওপর কান্না। বিরক্ত হয়েই বললাম--কী ব্যাপার তোমার? কী নাটক শুরু করেছো অফিসে ঢুকে?
এবার উঠে দাঁড়াল, কাঁদতে কাঁদতেই; ডুকরে ডুকরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
লোকটাকে চেনা লাগছিল, আমাদের কোনো অফিসেরই এক গুদামের পিয়ন হবে, ঠিক কোনটার ঠাওর করতে পারলাম না।
ভালো করে তাকালাম মেয়েটার দিকে। চমকে উঠলাম। মুখের সামনে ঝোলা চুলের গুচ্ছ সরে গেছে, ওপরের ঠোঁটের মাঝখান অনেকটা কাটা। কাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তিন চারটে দাঁত দেখা যাচ্ছে। মুখের কমনীয়তাকে গ্রাস করেছে ওই সামান্য ফাঁকটুকু। সুখকর দৃশ্য অবশ্যই নয়।
--বাঁচান স্যার। এই একমাত্র সন্তান আমার, দেখুন ওর অবস্থা। দয়া করে ওকে বাঁচান স্যার। চোখ মুছে বললো লোকটা।
--ডাক্তার দেখাও, অপারেশন করলেই ঠোঁট ঠিক হয়ে যাবে। এত কান্নাকাটির কী দরকার।
--বড় করে হাঁ কর। বলেই লোকটা মেয়েটার গাল দু’টো চেপে ধরল। এত জোরে, মুখটা নিজে থেকেই হাঁ হয়ে গেল।
কেঁপে উঠেছিলাম। আমি আগে কখনো দেখিনি। মুখের ভেতরে এমন একটা অস্বাভাবিক শূন্যতা, অপূর্ণতা, যেন অজানা অদ্ভুত এক ভয়াবহতা! ওর মুখের ভেতরে তালু নেই।
ইংরাজিতে বলে ক্লেফট লিপ্স ও ক্লেফট প্যালেট অর্থাৎ বিভাজিত ঠোঁট ও তালুহীন মুখগহ্বর। জন্মসূত্রে পাওয়া শারীরিক ত্রুটি। আমি ক্লেফট লিপ্স আগে দেখেছি, কিন্তু প্রথম দেখলাম ক্লেফট প্যালেট।
জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটিকে--তোমার নাম কী?
যে শব্দ গলা দিয়ে বেরোলো, তা আর্তনাদের সমতুল্য। তালুর অভাবে স্বর শুনতে লাগছিল গোঙানির মত। কথা বলার চেষ্টা করলে, শিশুটিই হয়তো কষ্ট পাবে। বাবাকে বললাম--ডাক্তার দেখাও, ঠিক করে দেবে।
--মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। মহিলা ডাক্তার দেখেছে, বলেছে অপারেশন করবে, পঁচিশ হাজার টাকা লাগবে।
পঁচিশ হাজার টাকা ওর মাস-মাইনের অনেক গুন বেশি, পাবে কোথায় একসঙ্গে এত টাকা?
--সরকারি হাসপাতালে তো সবই বিনা পয়সায় হয়। টাকা লাগবে কেন?
--ডাক্তারনি ম্যাডাম বলেছেন।
--নাম কী ডাক্তারের?
--বিজয়া প্রামাণিক।
চুপ হয়ে গেলাম। ডাক্তার প্রামাণিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নামকরা প্লাস্টিক সার্জেন। খবরের কাগজে ওঁর চিকিৎসার সাফল্য দুয়েক বার বেরিয়েছে। বিয়ে করেননি, বছর পঞ্চাশের কাছে বয়স। কলেজের বাইরে, গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে ক্যাম্প করে অনেক গরিব মানুষের সেবা করেন। ওঁর মত ডাক্তার যদি বলেছেন, তার মানে সার্জারির জন্য কিছু জিনিস লাগবে যা সরকারি সাপ্লাইয়ের মধ্যে নেই। সেই খরচটা ওকেই করতে হবে।
সত্যি–মিথ্যে কে জানে! প্রেসক্রিপশন দেখতে চাইলাম।
থলে থেকে বার করে দিল হাতে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাগজে ডাক্তার বিজয়া প্রামাণিকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন। অপারেশনের জন্য কত টাকার প্রয়োজন, তাও লেখা। জিজ্ঞেস করলাম,
--তুমি তো সরকারি চাকুরে, বিল দিয়ে দিলে অফিস টাকা দিয়ে দেবে। অসুবিধে কোথায়?
এর পরের কথার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
--আমি পনেরো বছর ধরে অস্থায়ী পিয়ন স্যার, দিনমজুর হিসেবে কাজ করি। আজও পার্মানেন্ট হইনি। আমাকে অফিস থেকে চিকিৎসার টাকা দেবে না।
ঠিকই বলছে। একটা পয়সাও পাবে না অতিরিক্ত, দিনের মজুরি ছাড়া।
এমন বেশ কিছু লোক রয়েছে, যারা কোনও এক সময়ে সরকারি কাজেই দিন মজুরের মত ঢুকে গিয়েছিল, তারপর রয়েই গিয়েছে, যদি কোন দিন চাকরি পাকা হয়ে যায়। তাদের সরকারের আদেশ অনুসারে বার করে দেওয়ার কথা। অধিকাংশই বেরিয়ে গেছে সব অফিসে, দু’-এক জন রয়ে গেছে। বিনা অপরাধে কারো জীবিকা কেড়ে নিতেও সাহস লাগে।
কিন্তু এখন আমিই বা কী করব! মেয়ের এ অবস্থা তো নতুন নয়। আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই কথা, কী ভেবে এসেছে? এত লোক থাকতে আমার কাছে কেন? আমি তো সাধারণ সরকারি অফিসের ছোটখাটো কর্মচারি ছিলাম সারা জীবন, বুড়ো বয়সে অফিসার হয়েছি। মাইনা অনেকটাই বেড়েছে সত্যি, কিন্তু দানসত্র করার মত তো নয়। সামনে দাঁড়িয়ে এসব দুঃখের কাহিনী শুনে কি আমি নিজের সঞ্চয় থেকে অপারেশনের জন্য অর্থসাহায্য করব? পাঁচ-সাতশো টাকা হলে হয়তো করতে পারতাম, কিন্তু পঁচিশ হাজার টাকা আমার কাছেও অনেক। আর কথা নয়, শক্ত হতে হবে। মেয়ের জন্মসূত্রে পাওয়া ছ’-বছরের পুরনো বিকৃতি দেখিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ানো ন্যায্য পন্থা নয়। লোকটি হাতজোড় করে দাঁড়িয়েই আছে, আর মাঝে মাঝেই চোখ উথলে জল পড়ছে। মেয়েটা উদাস ভাবে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
--আমি কী করতে পারি? আমার কাছে কেন এসেছ? আমি কী করবো! যাও এখান থেকে। বাধ্য হলাম বলতে।
আবার লোকটা কেঁদে উঠল--কতজনের কাছে গিয়েছি। আপনারা সব অফিসার মানুষ, একটু সাহায্য করলে অভাগা মেয়েটা …
বেরিয়ে যাচ্ছিল। মনে হলো, বোধহয় নিষ্ঠুরতার মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছে। ডাকলাম, হাসপাতালের কাগজগুলোর জেরক্স চেয়ে বললাম--ঠিক আছে, কাগজ তো রইল। দেখব, যদি কিছু করা যায়।
জানি না কেন ইশ্বর আমার মুখ দিয়ে কথাটা বলালেন।
আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে প্রণাম করল লোকটা। স্বগতোক্তির মত বলল--নিশ্চয়ই হবে। চল্ মা।
কাজে মন বসছে না। রাগ হচ্ছিল, উটকো ঝামেলায় পড়লাম। নিজের পিয়নটাকে সন্দেহ হলো, বিশ্বাসঘাতকতা করে লোকটাকে ছেড়ে দিয়েছে ভেতরে ঢুকতে। কোনও অজুহাতের সুযোগ না দিয়ে ভালোভাবে বকাঝকা করে, রাগের একটু উপশম হলো। মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
মাস দুয়েক কেটে গেছে।
--তেলা মাথায় সবাই তেল দেয়। সকালে চা খেতে খেতে রমা একদিন খবর কাগজ থেকে মুখ তুলে একটু যেন বিরক্তির সুরেই বলে উঠল।
--কেন কী হলো?
--এয়ারকন্ডিশন বাসে যারা যেতে পারে, তাদের আবার সরকার কেন এত টাকা দেয়। চিকিৎসা তো চলছেই।
খবরের কাগজটা নিয়ে পড়লাম, একটা দূরপাল্লার এয়ারকন্ডিশন বাসের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ভাগ্যগুণে সবাই প্রাণে বেঁচে গেছে, তবে বেশ কিছু আহত। তাদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ-তহবিল থেকে প্রত্যেক আহতকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
রমাই বলল--সেই যে মেয়েটার গল্প করেছিলে, তার তো পঁচিশ হাজার মাত্র দরকার ছিল। তাকে সরকার দেবে না। যত্তোসব।
উদাস চোখ, দুঃখী মুখটা মনে পড়ে গেল। তারও তো দরকার ছিল।
তবু সরকারের নুন খেয়েই তো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বেঁচেবর্তে আছি। আড়াল করতেই বললা্ম--তা কেন? জানলে তো দেবে। কেউ বলেছে গিয়ে সরকারকে?
--যাও না, তুমিই গিয়ে বলো না।
কী আশ্চর্য! আমি সামান্য কর্মচারি, আমার মতন অফিসার হাজার হাজার আছে। আমি কী করব! প্রচণ্ড রাগ হলো। চুপ করে গেলাম। সারা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে, মুচকি হেসে রমা চায়ের কাপ দু’টো নিয়ে যেতে যেতে বলে গেল--তপেশদাকেই বলে দেখো না।
তপেশদা রমার পিসতুতো দাদা, বছর পাঁচেকের বড় হবে। আমার কাছাকাছি বয়স। এক ডিপার্টমেন্টে ডেপুটি সেক্রেটারি, ব্যবহার করে যেন অনেক বড় অফিসার, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে। কারো বিয়েবাড়িতে দেখা হলে এমনভাবে ডাকবে, আমি যেন অধস্তন নতুন এক ছোকরা। আমি সে ভদ্রলোক থেকে দূরেই থাকি। রমারও ধারণা ওর দাদা বিরাট চাকরি করে। গল্পটা করাই উচিত হয়নি আমার। আর কথা না বাড়িয়ে অফিস যাওয়ার জন্য স্নানঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
কিন্তু রমার কথাটা যেন মাথা থেকে বেরোলো না। অফিসে কাজের মধ্যেও ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে মাথায়। মুখের ভেতরের সেই ভয়াবহ শূন্যতা, আর শিশুমুখের উদাস দুঃখী চোখদুটোও যেন তাড়া করতে লাগল।
সন্ধ্যে বেলায় অফিস থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে ঢুকলাম গিয়ে তপেশদার বাড়িতে।
--কী মনে করে ভায়া। বাইরের ঘরে টিভির খবর থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলেন তপেশদা।
ভণিতা না করে মেয়েটির কথা বললাম। এও বললাম যে, ওঁর আদরের মামাতো বোনটি মনে করে, তার দাদাই কিছু করতে পারবে। তার কথাতেই এসেছি, তাও বুঝিয়ে দিলাম। একটু অবাক হয়েই দেখলাম, কোনও রকম বড় বড় কথা না বলে গুরুত্ব দিলেন বোনের অনুরোধকে। সব কাগজপত্র দেখলেন। বেরোবার আগে বললেন--রমাকে বোলো, হয়ে যাবে। টাকাটা হাসপাতালে চলে যাবে।
আমি কেউ নয়। আমার অফিসের পিয়ন, আমার কাছে এসেই কেঁদে পড়েছিল, আমি তবু কেউ নই।
দিন সাতেক পরে আবেদনপত্রটা সই করে কাগজপত্র সমেত দিয়ে আসি, তপেশদাও ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আমার আর কিছু করার নেই। বলেছিলাম “দেখবো”, দায়িত্ব সেরেছি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
সময়ের সাথে জীবন চলছিল নিজের প্রবাহে। কখনো মাঝেমধ্যে মেয়েটার কথা মনে হতো। সেই আধময়লা জামা, সুন্দর চুলের গোছা ছড়িয়ে আছে মুখের চার পাশে, শান্ত চোখ দুটো। কে জানে কী আছে ওর ভাগ্যে। এই বিকৃতি আমাদের সমাজ মেনে নেবে না, অপাংক্তেয় হয়ে থাকতে হবে সারা জীবন।
আরও মাস চার পরে আবার ছন্দ পতন।
আমার অফিস চেম্বারে সকাল এগারটাতে আবার সেই পিয়ন হঠাৎ দরজা ঠেলে খুলে ঢুকল, সঙ্গে সেই বাচ্চা মেয়েটা। ঠিক আগের বারের মতই আমার টেবিলের সামনে, মাটিতে সাষ্টাঙ্গে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে যাচ্ছিল লোকটা। আমায় না জানিয়ে আবার এদের আমার অফিস ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি প্রচণ্ড রাগে ভাবছিলাম আমার নিজের পিয়নের কাছে লিখিত কৈফিয়ত চাইব আজ।
বাবা কেঁদে চলেছে, মেয়ে দুই হাতে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাচ্চাটাকে দেখে সামলে নিলাম নিজেকে।
বললাম--কী হলো, এখনো হয়নি? টাকা দেয়নি? আমি আবার গিয়ে বলব, মনে করিয়ে দেব।
অফিসে কিছুই গোপন থাকে না, ফর্ম ভর্তি করে ডাক্তারের সুপারিশ ও অন্যান্য কাগজ-সহ মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ-তহবিলে আবেদন করা হয়েছে, জেনে গিয়েছে নিশ্চয়ই।
ধীরে ধীরে উঠল লোকটা। সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের সিলিঙের দিকে প্রণাম করে যাচ্ছে। মেয়েটাকে বলল--দেখা মা, স্যারকে মুখটা দেখা, এখন যত লজ্জা।
বলে হাতটা সরিয়ে দিল ওর মুখের সামনে থেকে।
আবার চমকে উঠলাম। ওর ঠোঁট দু’টো, অন্য সব ঠোঁটের মতই, কোনও পার্থক্য নেই, শুধু একটা হাল্কা সেলাইয়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। তাও কিছু দিন পরেই মিশে যাবে। সুন্দর কমনীয় সুশ্রী মুখ। শান্ত চোখে আজ হাসির ঝিলিক। একটা খুশির ছোঁয়া আমার ভেতরেও নাড়া দিচ্ছিল।
--দেখা মা, হাঁ কর।
বলে আবার আগের মত, বাচ্চাটার গাল দু’টো এত জোরে টিপে ধরল, মুখটা অনেকটাই বড় হাঁ হলো। দেখলাম, সেই শূন্যতা, অপূর্ণতা আর নেই। মুখের ভেতরটা আর সবার মতই, পরিষ্কার ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে। বললো
--বল, স্যারকে নমস্কার।
--নমস্কার স্যার।
পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন উচ্চারণ।
লোকটার মুখে হাসি, দুই গাল বেয়ে দুয়েক ফোঁটা জল বয়ে চলেছে।
একটু অবাক হয়েই বললাম--তুমি তো দেখছি আগের চেয়েও বেশি কাঁদছ। এখন তো শুধু আনন্দে হাসির কথা।
লোকটার চোখের জল দেখতে দেখতে আমার চোখও ভিজে আসছিল। বিরক্ত হয়ে বললাম--যাও এখন, আমার অন্য কাজ আছে।
মুখটা একটু ওপরে তুলে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল।
সারা জীবনে আর দেখা হয়নি বাবা আর মেয়ের সঙ্গে।
অলক্ষ্যে কেউ যেন সবার ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, কোন মানুষকে দিয়ে কী করাবেন, তাও।