বিমানবন্দরে তাঁর বন্ধু আসবার কথা। বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করেও বন্ধু না আসায় তিনি ট্যাক্সি ডেকে রওনা হলেন প্রিয় বোর্ডিংয়ের উদ্দেশে। কামনা করলেন বোর্ডিংটা যেন খুঁজে পান।
ট্যাক্সিতে বসে তাঁর মনে হলো যেন জাদুরাজ্যের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার ভেতর দিয়ে চলেছেন। যা দেখছেন সত্যি নয়, এক ধরনের প্র্যাংক। যেসব রাস্তা তিনি পেরিয়ে এলেন, সেইসব রাস্তাঘাট তিনি চিনতে পারলেন না। দুয়েকটি স্থানে এসে তাঁর পরীক্ষা দিতে বসে জানা উত্তর মনে না আসার মতো অবস্থা হলো।
মনের সিল্যুয়েটে দুলতে লাগল রাস্তায় বাঁদরের নাচ, ক্যানভাসারদের অঙ্গভঙ্গি, রাতের বিবরে দেহপসারিণীদের আনাগোনা, নিম্নআয়ী মানুষের ঘর্মাক্ত মুখ, শ্যাওলাধরা পাঁচিলের পাশে উদোম গায়ে বসে পাখার বাতাস, উত্তেজনাকর ফুটবল ম্যাচ, প্রভৃতি।
বোর্ডিং খুঁজে পেলেও চেনা মানুষগুলোকে পেলেন না তিনি। সাখাওয়াত সাহেব মারা গেছেন তিন বছর আগে, এখন তাঁর ছেলে বোর্ডিং চালায়। পুরোনো কর্মচারিদের মধ্যে কেরামত মিয়া এখনও আছে। সে খাতির করে সফদের সাহেবকে বোর্ডিংএ ওঠাল।
চারদিকে প্রচুর শব্দ, হট্টগোল। অনেক বড়ো বড়ো অট্টালিকা। স্থানটাকে তাঁর কাছে চিড়িয়াখানার মতো লাগছে।
এইসময় বন্ধু ফোন করলেন সফদের সাহেবের রোমিং মোবাইলে। তিনি জানালেন, জ্যামে আটকা পড়ে আছেন। সফদের সাহেব বললেন ফিরে আসতে। বন্ধু জানালেন, তিনি এমনভাবে আটকা পড়েছেন যে, তাঁকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে তার পর আবার ফিরে আসতে হবে। ফ্লাইওভারে তাঁর সিএনজি ভুল পথে গেছে।
হতাশায় ফোন রাখলেন সফদের সাহেব।
সাধু খাবার নিয়ে এল। চর্বিসমৃদ্ধ কালো রঙের গোরুর গোশত ও তেলতেলে পোলাও। সফদের সাহেব বললেন যে, পোলাও খাবেন না তিনি। করলা, মাছ ও শুঁটকির তরকারি থাকলে নিয়ে আসতে বললেন। সাধু জানাল, ভাতের সাথে আলুভাজি ও ডাল আছে।
‘নিয়ে আয়।’
ভাত ও বন্ধু একসাথে ঢুকল। সফদের সাহেব সাধুকে আরো এক প্লেট ভাত আনতে বললেন। ভাত খেতে খেতে জ্যামের গল্প করলেন বন্ধু আছির শিকদার। আছির সাহেবের ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল দেখে ও জড়ানো বাক্য শুনে সফদের সাহেব বললেন, ‘তোমার জীবনীশক্তি ক্ষয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ, ভেজাল খেয়ে, জ্যামে পড়ে, দূষণের শিকার হয়ে জীবন আর জীবন নেই।’
‘গ্রামের দিকে চলে যাও। শহরটা কেমন যেন বিলোম ঠেকছে।’
‘গ্রামে যাব কী হে, সেখানেও তো দূষণ। আমার গ্রামের বাড়ির পেছনে ইটের ভাঁটা গড়ে ওঠেছে। গিয়েছিলাম গ্রামে, টিঁকতে পারিনি।’
খাওয়া থামিয়ে তাকালেন সফদের সাহেব। বন্ধু নতমুখে খেয়ে চললেন। নতমুখেই তিনি বললেন, ‘জ্যামে-ভেজালে-দূষণে মানুষের মন খিটখিটে হয়ে গেছে।’
দুজনের আলাপ তেমন জমল না। আছির সাহেব কাল ফের আসবেন জানিয়ে রাত বারোটায় বিদেয় নিলেন।
ক্লান্ত সফদের সাহেব একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনায় ডুবে শেষ পর্যন্ত ঘুমে তলিয়ে গেলেন। সকালে ঘুম ভাঙল উদ্দীপনায়। বোধহয় ঘুমের মধ্যে তাঁর অবচেতন মন দিনটির একটা রূপরেখা তৈরি করে রেখেছিল।
সাধু নাশতা নিয়ে এল। কম তেলে ভাজা পরোটা ও ফুলকপি ভাজি। জুত করে খেতে বসলেন সফদের সাহেব। মনে মনে নিজেকে সাধুবাদ জানালেন--বড়ো কোনো হোটেলে উঠলে এই খাবার তিনি পেতেন না। সেইসাথে তাঁর ছাত্রজীবনের স্মৃতি রোমন্থন করার মওকা পেতেন না।
তিনি ছেলেবেলায় এই শহরে এসেছিলেন। বাবা ধোপার কাজ করতেন। পরে নিজেই ধোপার ব্যবসা ধরেন, যাকে ভদ্র ভাষায় লন্ড্রি বলে। লন্ড্রি স্থাপন করে সুনামের সাথে ব্যবসা চালিয়ে যান তিনি।
বাবা গত হওয়ার পর লন্ড্রির হাল ধরেননি সফদের, লন্ড্রির কাজটাকে ছোটোমানের কোনো কাজ মনে করতেন তিনি। সফদের সাহেব লেখাপড়ায় মন দিলেন। ভগ্নিপতি কুদ্দুস লন্ড্রিটাকে আপন করে নিয়ে সফদের সাহেব বা তাঁর মাকে লাভের কিছুই দিতেন না। সফদের সাহেবের নসিব ভালো ছিল। তাঁর বাবা দুই কাঠা জমি কিনে একটা সেমিপাকা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে সফদের সাহেব প্রৌঢ়া মাকে নিয়ে থাকতেন। তিনি ততদিনে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একটা কন্স্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নিয়ে মা-ছেলের সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি লন্ড্রি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করতে পারেন ভেবে ভগ্নিপতি কুদ্দুস তাঁর স্ত্রী সফদের সাহেবের বড়ো বোন ও তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে সফদের সাহেবের বাড়িতে আগমন বা কোনোরূপ যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে দেন।
সফদের সাহেবের সরলমনা মাতা ব্যথিত হয়েছিলেন, আর সফদের সাহেব হয়েছিলেন যুগপৎ উপহত ও বিস্মিত। তাঁর জন্য আরো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ভগ্নিপতি কুদ্দুস লন্ড্রির রোজগারের টাকায় ঠাটবাট দেখাতে নিজ গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে ভু্রিভোজনের পর সে সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির পেছনে শুকনো নালার ধারে বসে আপনমনে গান গাইছিল। এইসময় বজ্রপাত হয়। আক্ষরিক অর্থে বিনা মেঘে বজ্রপাত। মারা যায় কুদ্দুস। পরিবারের সদস্যরা শহিদের মর্যাদায় তাঁর লাশ দাফন করে, যেহেতু বজ্রপাতে হত হওয়াটা শহিদের শামিল।
কুদ্দুসের মৃত্যুর পর সফদের সাহেবের বুবু ছেলে-সহ বাপের বাড়িতে চলে আসেন শ্বশুরবাড়ির লোকদের অত্যাচারে। লন্ড্রি উচ্ছন্নে গেল--কে লন্ড্রি দখল করবে, এরকম কোনো সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছাতে না পেরে। সফদের সাহেব ততদিনে বিয়ে করেছেন, একটি ছেলে হলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশে চলে যাবেন। মাকে দেখার জন্য বড়ো বোনকে অনুরোধ করলেন, বোনের ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
সফদের সাহেবের বউ সেতারা বিএ পাস, আকর্ষণীয়া ও বুদ্ধিমতী, আর তেমনি ছিলেন মায়াবতী। বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না। সব আয়োজন যখন পাকাপোক্ত, বিদেশ যাত্রা চূড়ান্ত—সেই সময় সেতারা ধরাধাম ত্যাগ করলেন। দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়া সেতারা বেগম একটা রোগ পুষছিলেন। সেই রোগ বহুবছর যাবত বহন করে তিনি স্বামীকে এই বিষয়ে কিছু জানাননি। লিভার সিরোসিস ঘাতক হয়ে হানা দেয় অবশেষে।
বিদেশ যাত্রা বন্ধ করেননি সফদের। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তিনি দূরদেশে পাড়ি দিলেন। স্ত্রীর খুব শখ ছিল ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। সেই শখ সফদের সাহেব পূরণ করবেন...।
সফদের সাহেব হাঁক ছাড়লেন, ‘সাধু।’
একটা কিশোর ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর নাম সাধু হলো কেন? তুই কি সাধু বংশের সন্তান?’
বিটকেলে হাসি দিল সাধু।
‘হাসছিস কেন?’
‘হাসি আইল তাই হাসলাম। আমি বদ বংশের সন্তান। আমার জর্ম হওয়ার পর আমি যেন বাপের মতো পিচাশ না হই সেইজন্য আমার মা আমার নাম দিল সাধু। আমার বাপ ছিল খাড়া শয়তান। মারে অত্যাচার করত। গাঞ্জা খাইত। আর আমার নানার বাড়ি গিয়া খালি টাকা চাইত।’
‘ও আচ্ছা। কথা সুন্দর করে বলবি। মানুষজন পছন্দ করবে তোকে। শব্দটা জর্ম না, জন্ম। আর পিচাশ না, পিশাচ।’
‘জি।’ সাধু ইতস্তত করে।
‘আর কিছু বলবি?’
‘জি, কইতে চাইছিলাম যে, আমিও গাঞ্জা ধরছিলাম; অহন ছাড়ান দিছি। কাজ লইছি এই বডিংয়ে।’
‘হুমম। ভালো কাজ করেছিস। গাঁজাটাজা খাবি না তো আবার?’
‘না, আমি অহন ভালো আছি। আপনে কোন্ দেশে থাহেন? সৌদি?’
‘না, অন্য একটি দেশে। আচ্ছা সাধু, শিকদার এখনও আসছে না কেন?’
‘বোধহয় জামে পড়ছে।’
‘এটা তো জ্যামে পড়ার বিষয় না। দিন গড়িয়ে গেল। আমার মনে হয় সে অসুস্থ। কাল মাথা ধরেছে বলেছিল।’
‘মোবাইলে ফোন দেন।’
‘দিয়েছিলাম, ধরছে না।’
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও এলেন না শিকদার সাহেব। অনেকটা অভিমান ভরেই সফদের বেরিয়ে পড়লেন বাইরে। বোর্ডিং থেকে পশ্চিমের সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন তিনি। তারপর লোকে লোকারণ্য যে স্থানে এসে থামলেন তিনি, সেই স্থানটা তিনি চিনতে পারলেন। এককালে এই স্থানে তিনি অনেক বিচরণ করেছেন। শীতের সময় সস্তা দামে শীতবস্ত্র কিনেছেন। জুতা পলিশ করিয়েছিলেন। গুলিস্তান সিনেমা হলে সিনেমা দেখেছেন ব্ল্যাকে টিকেট কেটে।
...ফুটপাত দখল করে বসা আজব ও চাকচিক্যময় পণ্যসামগ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন সফদের। রাস্তার একপাশে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে অজস্র ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী। এক জোড়া ছোটো কালো স্পিকারের দিকে চোখ আটকে গেল--তিনি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালেন। এত সুন্দর স্পিকার এই শহরের রাস্তায় মেলে, এমনটি কখনও কল্পনা করেননি।
দরদাম করে স্পিকার দুটি কিনলেন তিনি। ল্যাপটপে লাগিয়ে পছন্দের গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাবেন। তিনি বিক্রেতা ছেলেটাকে বললেন স্পিকার মোবাইলে লাগিয়ে টেস্ট করে দিতে। ছেলেটি একটা চওড়া মোবাইলে লাগিয়ে সাউন্ড টেস্ট করে দিল, একটা ব্যাগে ভরে দিল ছোট্ট দুটি যন্ত্র।
কেন যেন আনন্দে ভরে উঠল মনটা। তিনি ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে উল্টো পথে বোর্ডিংয়ের দিকে চললেন। এইসময় পেছন থেকে একটা কন্ঠ শুনতে পেলেন সফদের।
‘দাঁড়ান, স্যার।’
তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেই বিক্রেতা ছেলেটা এসে বলল, ‘আমার মোবাইল, স্যার। কিছু মনে করবেন না।’
কথাটা বলে তরুণ ছেলেটি সফদের সাহেবের ব্যাগ দেখল। তারপর হাহাকার করে বলল, ‘আমার মোবাইল নাই। ওইটা তো পাইতেছি না। ‘স্যার কিছু মনে করবেন না’ বলে ছেলেটি সফদের সাহেবের প্যান্ট-শার্টের পকেট হাতড়াতে শুরু করল। তিনি অসহায় ভঙ্গিতে তাঁর শরীরের যত্রতত্র হাত রাখতে দিলেন ছেলেটিকে। ছেলেটি তার গোপনাঙ্গও হাতড়াল।
‘হায়, হায়। কই গেল মোবাইল।’
বলে ছেলেটি আক্ষেপ করতে লাগল। সফদের সাহেব বললেন, ‘আমার পায়ের জুতা খুলব? মোজার ফাঁকে তো লুকিয়ে রাখতে পারি।’
‘সরি, স্যার। জুতা খুলতে হবে না।’
ছেলেটির চোখেমুখে সন্দেহের ছায়া মিলিয়ে গেলেও সেখানে ফুটে উঠল হতাশা।
কথা না বাড়িয়ে সফদের সাহেব ফের হাঁটা ধরলেন। বোর্ডিংয়ে ফিরে এসে দেখলেন বসে আছেন আছির শিকদার। সফদের সাহেব খুশি মনেই বললেন, ‘এই তোমার আসার সময় হলো? মোবাইল ধরো না। ব্যাপারটা কী?’
‘সেটটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে দিতে গিয়েছিলাম, তাই দেরি হলো।’
সাধু রাতের খাবার নিয়ে এল। মেনু পছন্দ হলো সফদের সাহেবের। বার বার ঠেলে আসছিল সন্ধ্যের অপাঙ্কতেয় ঘটনাটা। তিনি পাবদা মাছের তরকারি-করলাভাজি-ডালে মিশে গিয়ে ভুলে গেলেন বিচ্ছিরি ঘটনাটা।
খেতে খেতে আছির শিকদার বললেন, ‘নিজের বাড়িতেও তো যাও নাই মনে হচ্ছে।’
‘বাড়ি কি আর আমার নিজের আছে? দখল হয়ে গেছে।’
‘কী বলছো! বাড়িটা তো তোমার। দখল হবে কেন?’
‘বাড়িটাতে আছে কুদ্দুস মিয়ার জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আমি বিদেশে চলে যাবার পর পরই বুবু আমাকে সব জানায়। তারপর বুবুও মারা গেল শোকে-দুঃখে। বুবুর কচি ছেলেটাকে তারা ঘর থেকে বের করেই দেয়। সে পথে পথে ঘুরে একসময় মদ-গাঁজা ধরে। পরের বার এসে ছেলেটাকে পাইনি। সে নানা কুকীর্তি করে বেড়ায় বলে শুনেছিলাম। কিন্তু তার সন্ধান আমি পাইনি।’
‘তুমি বলছো, তোমার বাড়ি আর তোমার নাই?’
‘তা বলছি না। দলিলপত্র তো সব আমার কাছে। তারা ভোগদখলে আছে।’
‘তাহলে উদ্ধার করো। দেখি আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে পারি কিনা।’
‘এই যাত্রায় তা আর করছি না।’
‘হুমম,’ মাথা নাড়লেন শিকদার সাহেব। কৌটা থেকে পান বের করে মুখে পুরে বললেন, ‘কতদিন থাকবে?’
‘আমার বউ আর ছেলে একমাস মাত্র অনুমোদন করেছে।’
‘তোমার কি আর সন্তানাদি হয়নি?’
‘না, আমার বউ সন্তান ধারণ করতে পারেনি। তবু আমি সুখী। কেন জানো? সে সেতারার মতোই মমতাময়ী ও কেয়ারিং। আমার ছেলেটাকে সে নিজের করে নিয়েছে। ছেলেও তার মাকে পছন্দ করে। এদিক থেকে ভাগ্যবান আমি।’
সফদের সাহেব পরদিন গেলেন কবরস্থানে। তিনি বিদেশে পাড়ি দেবার আগে একটি বছর প্রতি জুম্মাবারে নিয়মিত কবরস্থানে যেতেন। কবর পরিচর্যার জন্য কবরস্থানের এক কর্মচারিকে নিয়মিত টাকা দিতেন।
তাঁর চোখে সুস্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে সেতারার কবর। একটা জবা গাছ, তাতে বুলবুলি পাখির লাফালাফি। সরুপথ থেকে বাঁ-দিকে একটা মাজারের মতো ঘরের পাশের সারিতে সেতারার কবর।
...স্থানটিতে এসে বিচলিত হলেন সফদের সাহেব। তিনি চিনতে পারলেন না সেতারার কবর। অসহায় ভঙ্গিতে তাকালেন। অনেকগুলো জবা গাছ। সবগুলো কবর দেখতে একইরকম। নামফলকবিহীন কবরগুলোর একটি হবে, কিন্তু কোনটি তা তিনি চিনতে পারলেন না।
‘ভাবি সাহেবার কবর খুঁজে পেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই,’ আছির শিকদার বললেন, ‘দোয়াখায়েরই মূল কথা। এসো, এখানে কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে মুনাজাত করি।’
...কবরস্থান থেকে সফদের সাহেব বেরিয়ে এলেন ভারাক্রান্ত মনে।
এই চিরচেনা শহরটায় একটি পরিচিত মুখ দেখতে পেলেন না সফদের সাহেব। একমাত্র শিকদার সাহেব ছাড়া আর কোনো বন্ধুর খোঁজ বা দেখা পেলেন না। তাঁর এক কলিগের সন্ধান দিলেন বন্ধু।
‘তোমার এক কলিগ ছিল না, নাম শাহ আলম?’
‘শাহ আলম? ছিল। সে কোথায়? কেমন আছে?’
‘সে আমাদের মহল্লায় থাকত চাকরিতে জবাব পাবার পর। তোমার সেই কন্স্ট্রাকশন কোম্পানি তার চাকরি নট করে দেয়। এখন সে পাগলাগারদে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সারা জীবন অভাব-অনটনে কাটিয়ে শেষ বয়সে মস্তিষ্ক সেই ধকল আর সইতে পারেনি।’
স্তব্ধ হয়ে গেলেন সফদের সাহেব। একটা বিচিত্র ক্লেদাক্ত ঢেউ খেলে যায় বুকের ভেতর।
দুজন পার্কে বসে ছিলেন। কোথাও গিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না সফদের সাহেব। শেষে শিকদার একদিন বন্ধুকে পার্কে নিয়ে আসেন। অযুত কালো মাথার ভিড় ও চিৎকার-শব্দের বাইরে সবুজ ঘাস ও গাছ তাঁকে স্বস্তি দিল।
তারপর যে কদিন সফদের সাহেব ছিলেন এই শহরে, বন্ধুকে সাথে নিয়ে এসে বসতেন পার্কের গাছতলায়।
দীর্ঘ এক দশক পর তিনি এই দেশে এসেছেন। এক দশকের অর্ধেক তাঁর কেটেছে স্বপ্নে, অর্ধেক বাস্তবে। স্বপ্ন দেখতেন তিনি বাংলাদেশে এসে একটা বাংলোবাড়ি বানিয়ে সেখানে বসে চা খেতে খেতে পাখির গান শুনছেন। আর বাস্তবে চলে যেতেন মন্ট্রিয়াল নামের অতি আধুনিক শহরে তীব্র তুষারপাতের মধ্যে একটা চেইন স্টোরের ভেতরে দাঁড়িয়ে স্টোর সাফসুতরোয় ব্যস্ত হয়ে গিয়ে। তবু একটুকরো প্রশান্তি ছিল তাঁর। ছেলেকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারছিলেন। ছেলেটিও হয়েছে সেতারার মতো, মায়ের মতো চোখ। শান্ত, ধীরস্থির ও পড়াশোনায় ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, সে বাপের কষ্টটা বুঝতে পারত।
ছেলে এখন সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পার্ক-ক্যানেডায় ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরি করছে। সে বিএমডব্লিউ গাড়ি চালায়। ব্লেনভিল এলাকায় যেখানে সফদের সাহেব আছেন নিজের কেনা হাউসে, কাছাকাছি স্থানে ছেলে জারিফ একটা অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং দিয়েছে। এই বিষয়টিতে তিনি পরম সুখী, স্ত্রীর ব্যাপারেও তিনি তৃপ্ত। কেবল একটি বিষয়ে মন তাঁর খুঁতখুঁত করে উঠল...।
...লাগেজ চেক করিয়ে ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে সফদের সাহেব রেলিংয়ের ওপাশে অপেক্ষমান বন্ধুর কাছে এলেন। টলমল করছিল শিকদার সাহেবের চোখ। তিনি বললেন, ‘সফদের, মরার আগে আরেক বার বুঝি দেখা হবে না।’
‘এসব কথা না বললেই কি নয়,’ ভাঙা গলায় কোনোক্রমে কথাটা বলে সফদের সাহেব পকেট হাতড়ে পার্স বের করে সেখান থেকে কিছু ডলার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভালো কোনো কাজে লাগিয়ো টাকাটা। দুই হাজার ডলার।’
‘এত টাকা!’ বলে শিকদার সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘আর এখানে দুই হাজার ডলার। সাধুর জন্য।’
‘সাধুর জন্য!’
‘হ্যাঁ, সে আমার ভাগ্নে, মানে বুবুর ছেলে। আমি বিদেশে পাড়ি দেবার সময় খুবই ছোটো ছিল সে।’
রুদ্ধকন্ঠে বললেন সফদের সাহেব, ‘হতভাগাটাকে ওই দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একেবারেই অখাদ্য।’
সফদের সাহেব চোখ মুছতে মুছতে ইমিগ্রেশনের দিকে চললেন। সেদিকে দুই হাত বাড়িয়ে আগাতে গিয়ে শিকদার সাহেব ধাক্কা খেলেন স্টেইনলেস স্টিলের রেলিংয়ে।
…ইমিগ্রেশন অফিসার নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ক্যানেডিয়ান পাসপোর্ট দেখলেন। তাঁরপর সেটা সফদের সাহেবের কাছে ফেরত দিলেন তেমনি ভঙ্গিতে।
প্লেনে তাঁর নির্ধারিত আইল সিটে বসে আরেকবার চোখ মুছলেন সফদের সাহেব। প্লেন অনেকক্ষণ দৌড়ে তারপর উড়াল দিল। পাকস্থলির আশেপাশে একধরনের শূন্যতা অনুভব করেন তিনি। সফদের সাহেব চোখ বুজে ডুবে গেলেন এক সুখকর ভাবনায়। দুইটি চেনা ও আপন মুখ দেখবেন তিনি। একটি তাঁর সন্তানের, অন্যটি স্ত্রীর মুখ।
এই দুইটি মুখ ছাপিয়ে তাঁর চেতনায় ছায়া ফেলে অস্পষ্ট আরেকটি মুখ।