• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | গল্প
    Share
  • ইচ্ছামৃত্যু : রাহুল রায়



    প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে বার বার হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখছে অজয়। দশটা প্রায় বাজে। অমলার সাড়ে ন’টায় এখানে মীট করার কথা। তারপর দশটা পনেরোর ট্রেন ধরে ঝাড়গ্রাম। স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা দূরে পিসিমার বাড়ি। সেখানে আজ যেতেই হবে এক বিশেষ প্রয়োজনে।

    অমলার ঠিক সময়ে আসা দরকার যেন ট্রেন মিস না হয়ে যায়। কিন্তু তার কোন পাত্তা নেই। এদিকে মোবাইলটা ও ধরছে না। হয়তো চার্জ দিতে ভুলে গেছে। অমলা একটু ভুলো মনের। তাই এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। এদিকে ঠিক কী যে করা দরকার, কিভাবে করা উচিত তাই ভেবে ভেবে সে ইতিমধ্যে গোটা পাঁচেক সিগারেট ধ্বংস করেছে। আর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আর একটা সিগারেট ধরাবে এমন সময় দেখতে পেল দুর থেকে অমলা আসছে। এতক্ষণে স্বস্তি। এ কাজ তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। হাতে-ধরা সিগারেটটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে সে অমলার দিকে এগিয়ে গেল।

    “এত দেরি করলে কেন? অজয়ের মুখে অস্বস্তির ছাপ সুস্পষ্ট, “আমি তো ভাবছিলাম তুমি আগের মতোই পিছিয়ে যাচ্ছ।”

    “পিছিয়ে যে যাই নি সেতো দেখতেই পাচ্ছ। কিন্তু মনে যে জোর পাচ্ছি না সেকথা বলাই বাহুল্য। নানা কথা নিয়ে এদিক-সেদিক ভাবতে ভাবতে দেরি হয়ে গেল। সরি।”

    “ঠিক আছে। আমার অবস্থাও প্রায় তোমার মতোই।” অজয় বেশ উত্তেজিত, “এখন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল, নয়তো ট্রেন মিস হবে। তখন আগের কয়েক বারের মতই সব গুবলেট হবে।”

    “যা হয় হবে, আমি তোমার সঙ্গে যাবো, তার বেশি কিন্তু কিছু নয়।” গলায় বেশ দৃঢ়তা এনে – “যা করার তোমাকেই করতে হবে।”

    “ঠিক আছে। ঠিক আছে। এখন চল তো।” এই বলে তারা দ্রুত পায়ে এগোল।

    অজয়ের পিসিমার বাড়ি যেতে হাওড়া স্টেশন থেকে ঘণ্টা দুয়েকের ট্রেন-জার্নি। স্টেশনে নেমে আবার বাসে প্রায় ঘণ্টা দুই, তারপর মিনিট কুড়ি পায়ে হাঁটা বা সাইকেল রিক্সা। ছোটবেলায় স্কুলের ছুটিছাটাতে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় পিসিমার বাড়ি আসা আর কয়েক দিন থাকা ছিল এক দারুণ আনন্দের ব্যাপার। পিসেমশাই কোন এক সাহেবি কোম্পানিতে ভাল পদে ছিলেন। সেই সূত্রে কলকাতায় মস্ত বাড়ি, আর এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে চমৎকার একটা বাংলো। বাংলোটা ঘিরে খানিকটা ক্লিয়ারেন্স ছাড়া বাকি কয়েক একর সম্পত্তির অধিকাংশ জঙ্গলে ভরা। সন্ধ্যে পড়তে-না-পড়তেই এখানে অন্ধকার এসে যায়। সন্ধ্যে ছুঁই-ছুঁই সময়ে বাংলোর বারান্দায় পিসিমার সঙ্গে বসে অজয় কতদিন রাত নামা দেখেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে মস্ত কালো আকাশে নানান তারার ভিড়। পিসিমা বলতেন, “ঐ দ্যাখ স্বাতী নক্ষত্র, ঐ কালপুরুষ।”

    পিসিমা প্রায়ই এখানে থাকতেন, আর পিসেমশাইও সময় পেলেই এই জনমানব শূন্য জায়গায় চলে আসতেন কলকাতার হইচই, গরম ইত্যাদি এড়াতে। হঠাৎই অল্প রোগভোগের পর পিসেমশাই মারা যান। পিসিমা আর কলকাতায় ফিরে যান নি। কলকাতার বাড়ি ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দিয়ে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন সেটাও প্রায় বছর কুড়ি হতে চলল। পিসিমাদের পয়সাকড়ির অভাব কোনদিনই ছিল না। তাই একজন রাতদিনের কাজের লোক, একজন মালী, আর এক চৌকিদার নিয়ে পিসিমা বেশ ভালই ছিলেন। কিন্তু বয়সটা আশি পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই উনি দ্রুত অশক্ত হয়ে পড়ছেন। সাধারণ বার্ধক্যজনিত ব্যাপারে যাতায়াত আস্তে হয়ে যাওয়া, কানে কম শোনা ইত্যাদি ছাড়াও ইদানীং কী এক রোগে ধরেছে। উনি সবসময় থুম মেরে বসে থাকেন। খাওয়াদাওয়া করতে চান না। যেন বাকি জীবনটা কোন ভাবে কাটিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া, এই তাঁর অভিপ্রায়। সেই পিসিমা, যার চিরকাল সব ব্যাপারে উৎসাহের কোন অভাব ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, এক-এক সময় পিসিমার সাথে তাল রাখতে হিমসিম খেতে হত অজয়ের। আজকের পিসিমার সাথে কোন মিলই নেই সেই আগের জনের।

    এখানে ভাল ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই অজয় একবার পিসিমাকে কলকাতায় এনে বড় ডাক্তার দেখিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে সাধারণ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ছাড়া তাঁর আর কোন রোগ নেই। তবে রোগ সম্ভবত মনে। একজন সাইকায়াট্রিস্টের নামও দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘পিসিমা তো পাগল নয়’ এই ভেবে, আর সময় হচ্ছে না এই অজুহাতে তা আর হয়ে ওঠেনি।

    এদিকে পিসিমা ইদানীং সব কিছু ভুলে যাচ্ছেন। কখন খেয়েছেন, কখন শুয়েছেন প্রায়ই মনে থাকছে না। তার সাথে এক নতুন উপসর্গ সাম্প্রতিক দেখা দিয়েছে। দু-বার দুপুরবেলা উনি বাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। কাজের লোকেরা ঘুমচ্ছিল। কেউ দেখে নি। তারপর খোঁজ খোঁজ। সৌভাগ্যবশত স্থানীয় লোকেরা চিনতে পেরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। তবে এই নির্জন অঞ্চলে স্থানীয় লোকের দেখা পাওয়া সহজ নয়। তাই এখন প্রায় খাঁচায় আটকে রাখার অবস্থা। আবার যখন একটু ভাল থাকেন তখন অনুশোচনার অভাব থাকে না।

    সেদিন অজয় পিসিমার কাছে গেছে। পিসিমা বললেন, “এভাবে বেঁচে থাকতে আর ভাল লাগে না রে। অনেক বয়স হল। এবার যাওয়ার সময় এসেছে।”

    তারপর একটু থেমে বললেন, “ইদানীং তো কতরকম ওষুধবিষুধ বেরিয়েছে।”

    অজয় মাথাটাথা একটু চুলকে বলল, “চিন্তা কোর না। ঠিকমতো ওষুধ পড়লেই ভাল হয়ে যাবে।”

    “না, না, আমি ভাল হওয়ার কথা বলছি না। এ ভাল হওয়ার নয়।”

    অজয় পিসিমার এই কথার কী উত্তর দেবে না জেনে চুপ করে রইল।

    অজয় চিরকালই পিসিমাকে খুব ভালোবাসে। তাই মাঝে মাঝে সময় পেলেই সে পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু তারও অবস্থা একেবারে তথৈবচ। যাতায়াতের খরচা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর পরে প্রায় বছর দুয়েক হল, অজয়ের কোন চাকরি নেই। মধ্যে টুকটাক, অল্পসল্প কিছু পেয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে জীবন চালানো মুশকিল। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকার ফলে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়েছে। কলেজে ভাল ছাত্র ছিল, ভালোভাবে ডিগ্রী পেয়েছে, এমএ-ও করেছে। কিন্তু যেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বক্রোক্তি প্রমাণ করতেই তার কোন স্থায়ী চাকরি এখনো জোটে নি। কলকাতা, মফঃস্বল, সব জায়গায়ই স্কুল, কলেজে চাকরির জন্য সে হন্যে হয়ে চেষ্টা করে চলেছে। এখনো পর্যন্ত বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। লীভ ভেকেন্সি ইত্যাদিতে অল্প কয়েক মাসের জন্য দু-একটা অস্থায়ী পড়ানোর ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। একটাই সুবিধে যে মা-বাবার সংসারে এখনো থাকা–খাওয়ার কোন অভাব হয়নি। কিন্তু আত্মসম্মান বলে তো একটা ব্যাপার আছে।

    এর মধ্যে অজয় আবার প্রেমে পড়েছে। এ যেন, ‘নিজে পায় না খেতে, শঙ্করাকে ডাক’ - এরকম ব্যাপার। কিন্তু চাকরি থাক বা নাই থাক প্রেমে পড়া তো মেপেজুপে, সময় বেঁধে হয় না। চাকরি খুঁজতে গিয়েই অমলার সাথে আলাপ। তার অবস্থাও প্রায় একই। মফঃস্বলের এক কলেজে চাকরির জন্য অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে দুজনেই এক জায়গায় হাজির, প্রায় একই সময়ে। দুজনেরই চাকরি–চাকরি করে হন্যে হওয়ার অবস্থা, তাই পোস্ট-অফিসের ওপর নির্ভর না করে নিজের হাতে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে এসেছে। আর কাজ সেরে দুজনেই প্রায় একসাথে সেই কলেজ থেকে বেরিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বেশ শীত-শীত ভাব রয়েছে। “এক কাপ চা খাবেন নাকি? বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।” অমলা বলে উঠল। আর সেই বলার মধ্যেই অজয় দেখে নিয়েছে তার চোখে মিষ্টি হাসির ঝিলিক, চোখের ওপর আলতো করে বুলিয়ে যাওয়া চূর্ণ কুন্তল। পকেটের ভাঁড়ে যে মা ভবানী সে কথা ভুলে অজয় রাজি হয়ে গেছে।

    রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে দুজনে চা খেতে বসেছে। অমলার কথায় একটা ডিমের ওমলেট নিতেও রাজি হয়েছে। কিন্তু তার বাড়ি ফেরার বাসের ভাড়া হবে তো? তার উসখুশুনি দেখে অমলা হেসে ফেলেছে, “পকেটে পয়সা নেই তো। ভাবতে হবে না মশাই। আমি দিচ্ছি।” তারপর অজয়ের দিকে একটা দ্রুত চাহনি হেনে, “পরের বার আপনি দেবেন।”

    যেন তারা পরের বারের জন্য তৈরিই ছিল, অর্থাৎ তাদের প্রেমে পড়তে দেরি হয়নি, আর এটা জানতেও দেরি হয়নি যে অমলার অবস্থাও প্রায় অজয়ের মতোই, অর্থাৎ সেও হন্যে হয়ে স্কুল, কলেজে চাকরি খুঁজছে। তবে অজয়ের সঙ্গে অমলার তফাত হল তার বাড়ির অবস্থা বেশ ভাল। তাই সেখানে চাকরি না পেলে পথে বসা বা অসম্মানের কোন ব্যাপার নেই, তবে বিয়ে-বিয়ে করে মা একেবারে মাথা খেয়ে ফেলছেন। বাবার স্নেহের কারণে এতদিন সেটা ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তবে অজয়ের মতো এক বেকারের প্রেমে পড়ার কথা জানলে বাবাও যে কতখানি তার পিছনে থাকবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

    অজয়ের ব্যাপারও তার বাড়িতে কেউ কিছু জানে না। তবে পিসিমার কথা আলাদা। তাই একটা লীভ ভেকেন্সি থেকে অল্প একটু টাকা জোগাড় করতে পেরেই সে অমলাকে নিয়ে পিসিমার কাছে হাজির। তাদের দেখে পিসিমা খুব খুশি। খালি তাই নয়। ইতিমধ্যেই মনে মনে একটা সম্পর্কও তৈরি করে ফেলেছেন। তাই ঘণ্ট খানেক কাটতে না কাটতেই তিনি বলেছেন, “আমার তো যাওয়ার সময় হয়েছে। এই বাড়ি ঘর, এইসব সম্পত্তি আমি তোদের জন্যই লিখে দিয়ে যাব। তোরা এখানে শান্তিতে থাকবি। কলকাতার ঐ ধুলো-ধোঁয়ায় লোকে থাকে কী করে কে জানে।”

    লজ্জায় দুজনেরই মুখ লাল হয়েছে - পিসিমা যে কী বলেন। তবে পিসিমার এই ইচ্ছের কথা শুনে তারা চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা করতে পারে। পিসিমা বুড়ো বয়সে এখানে থাকতে পারেন, কিন্তু তারা থাকবে কী করে? এখানে থাকলে স্থানীয় লোধা, সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের গ্রামের স্কুলে পড়িয়ে, তাদের মধ্যেই, তাদের মতো জীবন কাটাতে হবে।

    ।।২।।

    আইডিয়াটা অমলার মাথায় এসেছিল, “পিসিমাকে যা দেখলাম, আর কাজের লোকেরা যা বলল তাতে বুঝি যে পিসিমার অবস্থা বেশ সঙ্গিন।” তারপর একটু মুখ মুছে নিয়ে - “তা ছাড়া উনি বার বারই বলছিলেন যে এইভাবে অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। সে কথাটা সত্যি।”

    “তার মানে?” অজয় খুব উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। “তার মানে, তুমি কি বলতে চাও যে আমি পিসিমাকে মেরে ফেলি?”

    “আমি ঠিক তা বলি নি। ইউথেনেসিয়া বা ইচ্ছামৃত্যু তো আজকাল ইউরোপে প্রায়ই শোনা যায়।”

    “কিন্তু, এটা ইচ্ছামৃত্যু কি করে হল। এতো মেরে ফেলা।”

    “সেটা তুমি যে ভাবে দেখো। পিসিমাকে তাঁর ইচ্ছে পূরণ করতে সাহায্য করাটাও ইচ্ছামৃত্যুর মধ্যেই পড়ে। তাই না মশাই?”

    অজয় জানে যে অমলা যে ঠিক ভুল কথা বলছে তা নয়, কারণ পিসিমা নিজেই একদিন দুজনের উপস্থিতিতে একই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পিসিমা চাইলেই সে কথা মানতে হবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। সে কথা পিসিমাকে জানাতেও তারা ভোলেনি।

    সেদিন অজয় একা ছিল। পিসিমা তার চাকরিবাকরি বা তার অভাবের কথাটা বুঝে নিজেই কথা তুললেন, আর ব্যাপারটা একেবারে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন।

    “তুই কি মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাস? লজ্জা না করে আমায় বল। ও কী বলে?”

    অজয় একটু লজ্জায় লাল হয়ে, একটু তোতলা হয়ে বলল, “তা তো আমরা দুজনেই চাই। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?”

    “তোর কোন চাকরি নেই বলে কি তুই এই কথা বলছিস?”

    “অবশ্যই। বেকার ছেলেকে কে মেয়ে দেবে?” অজয় দৃশ্যতই হতাশ। “আর পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব?” অজয় হতাশায় দুহাতে মুখ ঢাকল। “বিয়ে করে থাকবো কোথায়, খাবো কি? দুজনেরই ভাঁড়ে মা ভবানী।”

    “আয়, আমার কাছে এসে শান্ত হয়ে বোস।” তারপর অজয়ের চুলে অশক্ত হাত বুলিয়ে দিলেন পিসিমা।

    “এখানে কিছু বিশেষ পাওয়া যায় না। তাই কলকাতা থেকে একজন উকিলকে ডেকেছি। শীগগিরই সে আসছে। আমি আমার ছেলেমেয়েদের কলকাতার সম্পত্তি আগেই দিয়ে দিয়েছি। সেটা লেখাপড়া করে আইনি করে নেব। আর এখানকার সব সম্পত্তি আছে সব আমি তোকে উইল করে দিয়ে যাব।” তারপর অজয়কে কাছে টেনে তার চিবুকে কাঁপা-কাঁপা হাত ঠেকিয়ে চুমু খেলেন।

    “তোর অমলাকে বিয়ে করার পথে আর কোন বাধাই থাকবে না। কিন্তু তোকে একটা কাজ করতে হবে।”

    “কি কাজ?”

    একটু থেমে, অত্যন্ত প্রিয়, নাতি-স্থানীয় অজয়ের দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে পিসিমা বললেন, “আমার যাওয়ার সময় হয়েছে রে। কিন্তু, আমি চাইলেই তো চলে যেতে পারবো না।” তারপর একটু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, “এই অথর্ব হয়ে আমি আর বেঁচে থাকতে পারছি না রে। তার চেয়ে তুই-ই এমন একটা ব্যবস্থা কর যে আমি সজ্ঞানে চলে যেতে পারি।”

    “কি যা তা বলছ, পিসিমা?”

    “নারে, যা তা নয়।” পিসিমা বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, “আমি পড়েছি আজকাল নাকি ঘুমের ওষুধ পাওয়া যায়। সেই ওষুধ বেশি ডোসে খেলে ঘুম আর ভাঙ্গে না। তা তুই এনে দে না আমায় সেই ওষুধ।”

    “মানে তুমি চাও আমি তোমায় মেরে ফেলব?” অজয় বেশ উত্তেজিতভাবে বলল, “না, না--তা আমি পারবো না।” অজয় উঠে দাঁড়াল।

    “আরে, না, না, উত্তেজিত না হয়ে চুপ করে বসে আমার কথাটা ভালভাবে শোন। এতো ইচ্ছামৃত্যু। এতো আমারই ভালর জন্য।”

    তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অজয়ের হাত ধরে পিসিমা বললেন, “তুই আমার জন্য এটুকু করতে পারবি না?”

    কোন কিছু বলার ক্ষমতা সেদিন অজয়ের ছিল না।

    অমলা পিসিমার এই ইচ্ছের কথা অজয়ের মুখে শুনেছে। তারা নিজেদের মধ্যে এ ব্যাপারে অনেক আলাপ করেছে। অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। শেষে তারা যা এক সময় অকল্পনীয় বলে মনে করেছিল, তাই করতে রাজি হয়েছে। ঘুমের ওষুধ কিনতে কোন অসুবিধেই হয়নি। পিসিমাকে জানাবে? অনেক আলোচনার পর তারা ঠিক করেছে - না পিসিমাকে কিছু জানানো যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ পিসিমা ভাবতেই পারেন যে সম্পত্তির লোভে অজয় এই কাজ করতে রাজি হয়েছে। অনুরোধ যদিও পিসিমার কাছ থেকেই এসেছে, কিন্তু মানুষের মন তো। কিছুই বলা যায় না।

    পিসিমা চলে যাওয়ার পর কাগজ-পত্র, উইল ইত্যাদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে। তারপর ভবিষ্যতের প্ল্যান।

    ।।৩।।

    আলোচনা, যুক্তিতর্ক করে কোন কাজ করার সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় বটে, কিন্তু তা হাতে-কলমে করা একেবারেই অন্য ব্যাপার। এর আগে তারা দু দু-বার ঘুমের ওষুধ নিয়ে পিসিমার বাড়ি গেছে। কিন্তু কাজের সময় পিছিয়ে পড়েছে। পিসিমা কিছুই জানেন না যে আজই তাঁর জীবন শেষ হবে তাঁর অত্যন্ত এক প্রিয়জনের হাতে, অথচ সেই প্রিয়জনকে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুমের ওষুধগুলো হাতে তুলে দিতে হবে, হাতে তুলে দিতে হবে জলের গ্লাস। হাত কাঁপবে না? চোখ ঠেলে জল আসবে না? আর পিসিমা যদি বুঝতে পারে? অজয় পারে নি। অমলাও তথৈবচ। সে অজয়কে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে যে সঙ্গে থাকা ছাড়া সে আর কিছু করতে পারবে না।

    এই তৃতীয় বারে তারা এক কঠিন সঙ্কল্প নিয়েছে - এবার যদি তারা কাজটা না করতে পারে তাহলে তাদের সম্পর্কও এখানেই শেষ, অর্থাৎ তারা আর কোনদিন দেখা করবে না। পিসিমা বাঁচলে তাদের সম্পর্ক মরে যাবে, আর পিসিমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারলে তারা সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখার পথে এগিয়ে যাবে।

    পিসিমার বাড়ি গিয়ে তারা যখন পৌঁছল তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। কোন অজ্ঞাত কারণে পিসিমা আজ একটু ভাল আছেন। খুব উৎফুল্ল হয়ে তাদের অভ্যর্থনা করে কাজের লোকদের ডেকে তাদের খাওয়াদাওয়া, রাতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। চোখে একটু মুচকি হাসির ঝিলিক এনে বললেন – “এই বাড়িতে ঘরের কোন অভাব নেই। বিয়ের আগে কিন্তু দুজন দু-ঘরে।” দুজনেরই লজ্জায় মুখ একেবারে লাল।

    খাওয়াদাওয়ার পর পিসিমা নিজের ঘরে শুতে গেছেন। পিসিমা রাতে উঠে জল খান। খাটের পাশে বেড-সাইড টেবিলে গ্লাসে জল ঢাকা দেওয়া রয়েছে। অজয় আগেই তাতে চারটে ঘুমের ওষুধ গুলে দিয়েছে। দেখে নিয়েছে তাতে জলে কোন গন্ধ হয়নি, যাতে পিসিমা কোন সন্দেহ না করতে পারেন। সব কিছু পরিকল্পনা মত চলছে।

    শুতে যাওয়ার আগে অজয় আর অমলা পিসিমার সাথে দেখা করতে এসেছে। অমলাকে দু পায়ে প্রণাম করতে দেখে পিসিমা আশ্চর্য হলেন – “আহা- হা, কী করো, কী করো। হঠাৎ প্রণাম কেন?” তারপর চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলেছেন – “তোমরা সুখী হও।” অমলা কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছে।

    অজয় চোখের জল ধরে রাখতে পারে নি। আর তাই দেখে পিসিমা মজা করে বলেছেন – “আমি তো আজই কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছি না। এতো চোখের জল ফেলছিস কেন? জানিস না, চোখের জলে অমঙ্গল হয়।”

    অমঙ্গল, এই অমঙ্গল তো তুমি নিজেই চেয়েছো পিসিমা। অজয় কোন রকমে কান্না চাপতে চাপতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

    সেই রাতে অজয় আর অমলা দুজনের কেউই চোখের পাতা বন্ধ করতে পারে নি। পিসিমা চেয়েছেন চলে যেতে, এটা তাঁর ইচ্ছামৃত্যু। কিন্তু মৃত্যুর ইচ্ছাটা এক কথা, আর সেই মৃত্যুটা ঘটানো আর এক। অপরাধবোধটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা অসম্ভব হয়েছে অজয়ের, বিশেষ করে তিনি যে তার অত্যন্ত আদরের পিসিমা। আর, আমি তো জলে ঘুমের ওষুধ দিই নি, এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমনোও অমলার পক্ষে অসম্ভব হয়েছে। নিজে না করলেও সেও তো এই খুনের সাক্ষী। খুন ছাড়া একে কি বলা যায় তার জানা নেই।

    বিছানায় ছটফট করতে করতে অনেক ভোরে দু ঘরে দুজনের ঘুম এসেছে।

    ।।৪।।

    অজয়ের ঘুম ভাঙল কাজের লোক লখিয়ার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে। চোখ মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে এসে দেখে অমলাও তার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। লখিয়া স্থানীয় ভাষায় উত্তেজিত ভাবে যা বলল তার তর্জমা করলে দাঁড়ায় – সে অন্য দিনের মতো সকাল আটটায় চা নিয়ে গেছে পিসিমার ঘরে। কিন্তু অনেক ঠেলাঠেলিতেও পিসিমা ওঠেননি। গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে তা একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা। সে বহু বছর পিসিমার সঙ্গে রয়েছে। নিজের মায়ের মতো দেখে। সে কেঁদেকেটে অস্থির।

    বয়স হয়েছিল, চলতে চলতে হঠাৎ হৃদযন্ত্র বিকল হয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আর এই গণ্ডগ্রামে কেউ মারা গেলে, আর তার মৃত্যুর ব্যাপার সাধারণ দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলে ডাক্তার ডাকা ইত্যাদির কোন প্রয়োজন আছে বলে কেউ মনে করে না। অজয় তার মোবাইল থেকে কলকাতায় পিসিমার ছেলে-মেয়েদের খবর দিয়েছে। দুজনেই বলেছে যে মা’র বয়স হয়েছিল। চলে যাওয়াটা শিগগিরই একদিন না একদিন ঘটতই। তাদের কলকাতা থেকে আসতে আসতে দেরি হয়ে যাবে। আর এখানে মৃতদেহ বরফে রেখে পচনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব ব্যাপার। তাই, তারা আসছে, কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা না করে মৃতদেহ দাহ ও সৎকার করার কথা বলেছে। তারা জানে যে অজয় তাদের মার কাছে ছেলের মতই ছিল। তাই অজয় মুখাগ্নি করলে কারোর কোন আপত্তি নেই। আর তাদের ইচ্ছেমত পিসিমার দাহ, সৎকার ইত্যাদি স্থানীয় শ্মশানে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

    ব্যাপারটা যে এত সহজে হয়ে যাবে তা অজয় বা অমলা কেউ ভাবে নি। অপরাধবোধটাও আর সেভাবে হুল ফোটাচ্ছে না। তার বদলে মনে হচ্ছে পিসিমা তো এই চেয়েছিলেন। তারা তো নিমিত্ত মাত্র।

    এবার আসল কাজের পালা। ছেলে-মেয়ের সামনেই পিসিমার আলমারির লকার খুলে টুকটাক কিছু গয়না ইত্যাদির পর বেরোল একটা বড় খামের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সেই ‘উইল’। পিসিমা কাঁচা কাজ করেন নি - খামটার মুখ আঠা দিয়ে সীল করা ছিল। তার ওপর কাঁপা-কাঁপা হাতে পিসিমার সই। ভিতরের দলিলে পিসিমার সই ও তারিখের পাশে উকিলের নাম, সই ও সীল। একেবারে পাকা কাজ।

    উইলটা পড়ার জন্য একটা গোল টেবিল ঘিরে অজয়, শানুদা আর মায়াদি বসেছে। অমলা অন্য ঘরে। অজয়ের ইচ্ছে পিসিমার উইলের সম্বন্ধে জেনে নিয়ে ওরা বিকেলের ট্রেন ধরে কলকাতা চলে যাবে। শানুদা পড়তে শুরু করলেন বাংলায় টাইপ করা পিসিমার উইল।

    এক নম্বর ফকির আলি লেন, কলকাতা ২৬ -এ আমার বাড়ি ছেলে শান্তনু আর মায়া পাবে সমান ভাগে। এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, রাসবিহারী শাখায় আমার কিছু জমা টাকা আছে - সেটাও আধাআধি ভাগ হবে শান্তনু আর মায়ার মধ্যে। ওই ব্যাঙ্কের ভল্টে আমার অল্প কিছু গয়না আছে। সেটা আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, ২৮ নম্বর রামতনু লেন, কলকাতা ৮ নিবাসী শ্রীপরিমল রায়ের একমাত্র পুত্র শ্রীঅজয় রায় যাকে বিয়ে করবে সে পাবে। আর সে যদি বিয়ে না করে তাহলে সেই গয়না বিক্রি করে সেই টাকা যেন রামকৃষ্ণ মিশনে দান করা হয়, দুঃস্থদের সেবার জন্য।
    সই করার দিন দেখে বোঝা যায় যে এই উইল মাত্র বছর দুয়েক আগে করা। বোঝা যাচ্ছে যে পিসিমা শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়লেও, ও সব কিছু ভুলে যাচ্ছেন এ কথা বললেও, উনি একেবারে পাকা কাজ করেছেন, একেবারে পরিষ্কার মাথায়।

    শানুদা উইল পড়ে চলল।

    কুলতলী গ্রাম, মৌজা, মেদিনীপুরের জমি, বাড়ি সব পাবে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, ২৮ নম্বর রামতনু লেন, কলকাতা ৮ নিবাসী শ্রীপরিমল রায়ের একমাত্র পুত্র শ্রীঅজয় রায়।

    এতক্ষণ অজয়ের বুকে দুরমুশের ধপ-ধপ আওয়াজ হচ্ছিল। এতক্ষণে তা শান্ত হল। শানুদা পড়ে চলল।

    শ্রীঅজয় রায় কুলতলী গ্রামের এই সম্পত্তির পুরোটা পাবে। তবে এক শর্তে। এই বাড়ি বিক্রি করা চলবে না। তাকে এখানে এসে থাকতে হবে। তার কাছে আমার অনুরোধ রইল যে সে যেন স্থানীয় লোকদের মধ্যে থেকে, তাদের উন্নতির জন্য সময় দেয়।

    পিসিমা খালি উইলে এই শর্ত রেখেই ক্ষান্ত হননি। উনি কলকাতার সেই উকিলের জন্য কিছু টাকা ধার্য করে গেছেন। উনি নিয়মিত খোঁজ রাখবেন অজয় যেন পিসিমার শর্ত অনুযায়ী তার পরবর্তী জীবনের পরিকল্পনা করে। অর্থাৎ অজয় পিসিমার সম্পত্তি ভোগ করবে অথচ এখানে থাকবে না – তা সম্ভব নয়।

    অজয়ের মাথায় চড়াৎ করে কিছু নড়ে উঠল। কিছুক্ষণ সে চেয়ারেই বসে রইল। সে না হয় এখানে থাকতে পারে এই সম্পত্তির অধিকার নিতে, পিসিমাকে ভালবেসে, কিন্তু অমলা? এক গ্লাস জল সে ঢক-ঢক করে খেয়ে ফেলল। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটা সিগারেট ধ্বংস করে ব্যাপারটা পুরোপুরি হজম করার পর টলতে টলতে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে দেখে অমলা নেই। একটু খোঁজ করতেই পেয়ে গেল টেবিলের ওপরে ভাঁজ করে রাখা একটা ছোট কাগজ। সেটা খুলে অজয় পড়ল —

    পাশের ঘর থেকে আমি সব শুনেছি। তুমি এখানে থেকে পিসিমার সম্পত্তি ভোগ করো, আর জঙ্গলে জংলীদের মতো থাকো। তাদের উন্নতির চেষ্টা করো। কিন্তু এতটা জীবন কলকাতা শহরে কাটানর পর এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে বাকিটা জীবন কাটান আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব আমাদের সম্পর্কের এখানেই শেষ। আমি কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। যোগাযোগ করার চেষ্টা কোর না, আমি নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিতে চাই।


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments