আমার দাঁড়ানোতে দাঁড়ি টানার জন্য তখনই একটা ফোন এল। ফোনের উল্টোদিকে শ্যামল, আমার ছায়াসঙ্গী, আমার সহকবি বেশ উত্তেজিত ভাবে বলল, বস্, কী ব্যাপার এখনও এলে না। এদিকে তো...। তাড়াতাড়ি জোড়া-পুকুরের সামনে চলে এস।
শ্যামল আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়লেই ওই “বস” আর “তুমি” শব্দগুলো আমাকে ফ্রী-তে বিতরণ করে। তবু ওর মুখে “এদিকে তো” শুনে বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। বেশ কিছুদিনের অনুপস্থিতির পর আমার আজ জোড়া-পুকুরেই যাওয়ার কথা ছিল। জোড়া-পুকুরের একটা মাছ আমার নজরে আছে বহুদিন। কিন্তু কিছুতেই সে মাছটাকে আমার প্রিয় গানটা, “তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল” শোনাতে পারছিলাম না। যতবারই ছিপ নিয়ে তার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করেছি, আমার স্ক্রিপ্ট এলোমেলো করে দিয়ে অন্য কেউ এসে গেছে সেখানে। আজ ভেবেছিলাম নতুন চার নিয়ে বাজারটা যাচাই করব। কিন্তু মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন হবে না।
শ্যামলকে বললাম, কী ব্যাপার বল তো, এত হাঁফাচ্ছিস কেন?
--হাঁফাবো না? তোর মাছ তো মাছরাঙা এসে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শ্যামল অকপট।
--উড়ে গেছে? কথা বলতে গিয়ে এবার মনে হল, আমি নিজেই হাঁফাচ্ছি।
--না এখনও পুরো যায়নি, তবে সাজগোজ প্রায় সারা। তাড়াতাড়ি আয়।
শ্যামল আর আমি দু’জনেই অসময়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পাড়া-বেপাড়ার পুকুরগুলোতে ঢুঁ মারি, মাছ দেখি আর কবিতা লিখি। আমাদের মগজে কে যেন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে যে কবি হতে গেলে সনাতনী পদ্ধতির পড়াশোনাটা আগে ছাড়তে হয়। ছেড়েছি। এবং আমরা দু’জনেই নিশ্চিন্ত যে, ভবিষ্যতে আমরা বড় কবি হবই হব। কেন জানি না, আমরা দু’জনেই বিশ্বাস করি ভালো কবিতা লিখতে গেলে প্রতিনিয়ত মৎস্য দর্শনটাও অনিবার্য হওয়া উচিত।
এই মৎস্য দর্শনের দৌলতে আমরা দু’জনে অনেক কিছু খুব কাছ থেকে দেখার আর বোঝার সুযোগ পেয়েছি। পিছন ফিরলে প্রথমেই আমার মনে পড়ে বর্ধন পুকুরের একটা মাছের কথা। মনে আছে সে মাছটা আমাদের খুব খেলিয়েছিল। আমরা সেদিন বর্ধন পুকুরে মূল বাঁধানো ঘাটে বসে মাছ দেখছিলাম। গরমকালে বিকেলের দিকে এমনিতেই বহু মাছ জলের নিচ থেকে উপরে চলে আসে গায়ে হাওয়া লাগাতে। আমি আর শ্যামলও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কবিতার রসদ জমা করছিলাম। হঠাৎ শ্যামলই বলল, দেখ দিব্যেন্দু, একটা মাছ কিন্তু বার বার আমাদের সামনে এসে টুকি দিয়ে চলে যাচ্ছে।
শ্যামলের কথা শুনে আমিও একটু নজরদারি করে দেখলাম, হ্যাঁ, শ্যামল ঠিকই বলেছে। দেখলাম, সে মাছ বারবার কানকো হেলিয়ে আমাদের দুলিয়ে মাঝে মাঝেই খুব কাছে এসে ফের অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আমি শ্যামলকে বললাম, চল তো, একটু অন্য দিকে গিয়ে দেখি কী হয়।
আমি আর শ্যামল তারপর সেই বাঁধানো ঘাট ছেড়ে আরও কিছুটা দূরে একটা গাছের নিচে দাঁড়ালাম। দেখি, হ্যাঁ, পাড় ঘেঁষে সে মাছ সেখানেও হাজির। এরপর আমরা আরও কয়েকবার জায়গা বদল করেছিলাম কিন্তু বদলায়নি চিত্রটা। শেষে শ্যামল বলল, দিব্যেন্দু চল কেটে পড়ি। শ্যামলের কথা শুনে অবাক আমি বললাম,
কাটবো কেন? আমরা কী কোনও অন্যায় করছি নাকি? কবিতা লেখা কি অপরাধ?
--না, কবিতা লেখা অপরাধ নয়। তবে তোর কি মনে হয় যে এই বাউন্ডুলে মাছ দেখে কলমের গোড়ায় কবিতা আসবে?
--বাউন্ডুলে মাছ?
বাউন্ডুলে না তো কী? কোথায় আমরা চার ফেলব তা না এদিকে মাছ নিজেই চার নিয়ে ঘুরছে শিকারির মতো। শালা, দেখে-শুনে মনে হচ্ছে মাছটা আমাদের নিয়েই কবিতা লিখতে চায়। শ্যামল বেশ উত্তেজিত ভাবে বলল কথাগুলো।
শ্যামলের কথায় আমারও হুঁশ ফিরে এল। ভেবে দেখলাম, আরে শ্যামল তো ঠিকই বলেছে। আমরা নয়, মাছটাই তো আমাদের অনুসরণ করছে। তবু কবি বলে কথা, তাই শ্যামলকে বললাম, আচ্ছা শ্যামল, একে নিয়ে কি কোনও কবিতাই লেখা সম্ভব না?
আমার কথা শুনে শ্যামলেরও বোধহয় আবেগ, অনুভূতি উথলে উঠেছিল। সে বলল, কবিতা নয়, তবে এ মাছকে আমি একটা নতুন নাম দিতে পারি।
শ্যামলের জবাব শুনে বেশ বিরক্ত লাগছিল। শালা আমি মরছি কবিতার গর্ভ যন্ত্রণায় আর উনি এলেন মাছের নতুন নাম নিয়ে। তবু বিরক্তি চেপে বললাম, বল, কী নাম দিলি ওর শুনি।
--মাছোড়বান্দা। শ্যামল মুখ টিপে হেসে বলল।
সত্যি বলতে কী, নামটা আমারও ব্যাপক পছন্দ হয়েছিল, যদিও আমার মনে হয়েছিল “মাছোড়বান্দা” আসলে আমি আর শ্যামল, ওই মাছটা নয়। শ্যামলকে সে সব না বলে সেদিন ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলাম, দারুণ বলেছিস। আর শোন, এই শব্দটা আমি একটা আধুনিক কবিতায় ব্যবহার করব। তোর কোনও আপত্তি নেই তো? শ্যামল ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ধুর, আপত্তি কীসের। তোর যা ভালো লাগে তুই কর।
কোন ঋতুতে আমরা কোন পুকুরে যাব সে সম্বন্ধে আমার আর শ্যামলের একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। আমাদের এলাকাতেই আছে ম্যাজিক পুকুর। ওখানে শীত এলেই পুকুর শুকিয়ে একদম খটখটে হয়ে যায়। আমরা তাই শীতকালে ও পথ মাড়াই না। আবার বর্ষায় সেই একই পুকুরে যেন মাছের বান আসে। ম্যাজিক পুকুর নামটা অবশ্য আমার আর শ্যামলের দেওয়া। শীতে খটখটে আর বর্ষায় অমন ফুটফুটে রূপ ধারণ করে বলে আমরা সে পুকুরের অমন নাম রেখেছি।
সেবার শীতকালে আমি আর শ্যামল পকেটে কলম, হাতে বাঁধানো খাতা নিয়ে ম্যাজিক পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ শ্যামলই বলল, দিব্যেন্দু, একটা মাছ দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
--এই খটখটে জলহীন পুকুরে তুই মাছ দেখছিস? তোর মাথাটা দেখছি সত্যিই গেছে। ভুলে যাস না, এটা ম্যাজিক পুকুর আর এখন শীতকাল। বাঁদরামো হচ্ছে? বেশ রেগে গিয়েই বললাম কথাগুলো।
--এই তোর এক দোষ দিব্যেন্দু। পুরোটা না দেখে, হাবিজাবি বকে যাস খালি। পুকুরটার ডান দিক ঘেঁষে একবার তাকা, তাহলেই দেখতে পাবি আমি ঠিক বলছি কি না। শ্যামল গলা তুলে বলল।
--কেন ডান দিকে আবার কী আছে? ওখানে তো এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ধেয়ে আসা কিছু নোংরা জল ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা না।
--হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। ওই নোংরা জলেই নজর দে তুই। তাহলেই দেখতে পাবি ওখানে মাছ আছে কী নেই।
শ্যামলের কথা শুনে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ও ঠিকই বলেছে। মন ভালো করে দেবার মতো একটা মাছ ওখানে নড়াচড়া করছে। আমি শ্যামলকে বললাম, কী ব্যাপার বল তো? এ তো মনে হচ্ছে অল্প জলের মাছ। আমার কথা শুনে শ্যামল বলল, আমার মনে হয় আসলে মাছটা অনেক বড় জলের বাসিন্দা। কিন্তু এখন সময় খারাপ তাই বোধহয় অল্প জলে ওকে এত উদাস লাগছে।
--ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আমরা কি ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে পারি? শেষ বাক্যটা আমি শ্যামলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম।
--হুম্ম্, লেখা যেতেই পারে। তবে আমার কিন্তু অন্য চিন্তা হচ্ছে। শ্যামলকে উদ্বিগ্ন দেখায়।
--কী মনে হচ্ছে তোর? আমিও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।
আমার মনে হচ্ছে ম্যাজিক পুকুরে এই অকালের মাছ থাকতে আসেনি। শ্যামল বেশ দার্শনিক গলায় বলে কথাটা।
মানে?
মানেটা তুই ভালোই বুঝেছিস। খারাপ কিছুর সাক্ষী থাকার থেকে চল আমরা এখান থেকে কেটে পড়ি।
শ্যামলের শেষ কথাটা শুনে আমার বেশ রাগ হয়ে গেল। বললাম, কবি মানুষ আমরা। আমাদের কি অত অল্পেই বিচলিত হলে চলে? বরং এখানেই বসে আজ কবিতা লিখব আমরা। তেমন কিছু দেখলে কলম ছেড়ে কলজের জোর দেখাতে হাজির হব আমরা।
শ্যামল - মনে হল আমার কথাগুলো অনেকটা দায় পড়ে গিলে নিল। তারপর মুখ ব্যাজার করে বলল, কবিতার প্রথম লাইন তা হলে তুই লেখ।
লিখলাম। তারপর জোরে জোরে পড়লাম, “জ্বলেও উদাস তাই ওকে তুমি শ্রাবণে পোড়াও”। লাইনটা শুনে শ্যামল জিজ্ঞেস করল, এই “তুমি”টা কে রে? তোর এই এক দোষ, কথায় কথায় তুই কবিতায় “তুমি” টেনে আনিস।
ভেবে দেখলাম কথাটা সত্যি। তাই ফের লিখলাম, “জ্বলেও উদাস তাই ওকে কেউ শ্রাবণে পোড়াও”। “তুমি”র জায়গায় “কেউ” আনার পর দেখলাম শ্যামল আর কিছু বলল না। এবারে শ্যামলের পালা। শ্যামলও দেখলাম মিনিট দুয়েক ভেবে লিখল, “এখন শীতের বেলা – জল নেই, শিমুল ওড়াও”।
লাইনটা পড়েই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি ভুরু কুঁচকে শ্যামলকে বললাম, অন্ত্যমিল আনার জন্য যা খুশি তাই লিখছিস। ধুস্স্, কিস্সু হয়নি। আবার লেখ।
শ্যামল ব্যাজার মুখে এবার পর পর লিখল, “জ্বলেও উদাস তাই ওকে কেউ শ্রাবণে পোড়াও/ যেভাবে অনন্ত পোড়ে বসন্তদিন – কৃষ্ণচূড়াও”। এবার লাইনটা আমার মোটামুটি পছন্দ হল। শ্যামলকে সেই ভালো লাগার কথাটা বলতে যাবার আগেই আবার শ্যামলের আর্তনাদ, বস্, মাছটা হাওয়া হয়ে গেছে।
আমিও কবিতা ছেড়ে মাথা তুলে দেখি, নেই, নেই, সে মাছ কোত্থাও নেই। বললাম, শ্যামল, মালটা থুড়ি মাছটা কোথায় গেল বল তো?
--আমিও তো সেটাই ভাবছি। যাক গে ভালোই হল।
--কী ভালো হল?
--ভালো হল মানে দু’ লাইন কবিতা হল। এখন চল, পরে দু’জনে মিলে কবিতাটা শেষ করে নেব।
পরদিন আমরা আবার গেছিলাম ম্যাজিক পুকুরে। সেদিনও কী আশ্চর্য, সেই একই মাছ দেখলাম খুব আনমনা কী যেন ভেবে চলেছে। শ্যামলকে বললাম, চল, আজ একটু কাছ থেকে দেখি মাছটাকে। শ্যামল বলল,
বেশি কাছে যাওয়াটা একটু ঝুঁকির হয়ে যাবে বস।
কেন, ঝুঁকি হয়ে যাবে কেন?
--দেখছিস না, চারদিকে লোকজন প্রায় নেই। বেশি কাছে গেলে যদি মাছের মালিক অন্য কিছু ভেবে তাড়া করে তো ব্যাপারটা পুরো ঘেঁটে যাবে।
শ্যামল তার কথায় যুক্তির মশলা গুঁজে দিয়ে যেটা হাজির করল, তাকে অস্বীকার করার উপায় না দেখে সেদিনটাও দূর থেকে “তাকে” দেখে ফের দু-লাইন লিখলাম আমরা। এবারে শ্যামল লিখল প্রথম লাইন, “এখন শীতের বেলা সব নদী ঢেকেছে দু-চোখ”।
শ্যামল, বুঝতে পারলাম বদমাইশি করে শেষে “চোখ” শব্দটা রেখে গেছে, যাতে অন্ত্যমিল নিয়ে আমি পুরো ঘেঁটে যাই। আমিও “রোখ” জাতীয় বেশ কিছু শব্দ কলমে নাড়াচড়া করে প্রচুর চাপ নিয়ে লিখে দিলাম, “এখন শীতের বেলা সব নদী ঢেকেছে দু-চোখ/ নিতান্ত শিশিরে লিখি জমা, লিখি হিসেবী খরচও”।
এবার শ্যামল প্রতিবাদ করেছিল অন্ত্যমিল নিয়ে। আমি খুব বিজ্ঞের মতো মুখ করে বললাম, অন্ত্যমিলের এটাই লেটেস্ট ট্রেন্ড। শ্যামল তাও লাইনটা মেনে নিচ্ছে না দেখে ওকে বললাম, তবে দ্বিতীয় লাইনটাও তুই-ই লেখ। শ্যামল দেখলাম এবার চেপে গেল।
এরপর আমরা আরও কয়েকদিন সব ছেড়ে ওই ম্যাজিক পুকুরেই গেছিলাম। আমাদের সাহস বাড়ছিল। প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে মাছটার কাছে এগোচ্ছিলাম। একদিন খুব কাছ থেকে মাছটাকে দেখে, এই প্রথম, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। এতদিন মাছ মানে আমার বা শ্যামলের কাছে ছিল কবিতা লেখার রসদ। কেন জানি না মাছটার ধ্রুপদী অবস্থান আমাকে একদম শুইয়ে দিয়েছিল। শুনেছি প্রেমে পড়লে আনাড়ি কলম থেকেও কবিতা বেরয়। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটেছিল। আমার কলমের সমস্ত রসদ কেউ যেন শুষে নিয়ে জমা করেছিল আবেগের জতুগৃহে। ফলে, শ্যামলের প্রচুর গালাগাল সত্বেও আমার কলম দিয়ে আর কিছু বেরচ্ছিল না।
শ্যামল একদিন রেগেমেগে বলল, তোর এই এক তরফা প্রেমের আমি নিকুচি করেছি। আজ চল ম্যাজিক পুকুরে, আমি এর একটা হেস্তনেস্ত করবই। শ্যামলের কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, হেস্তনেস্ত মানে? শ্যামল গলায় আরও জোর এনে বলল, আজ তোকে তোর মৎস্যগন্ধার সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে দেব।
শ্যামলের কথা শুনে, বুঝতে পারলাম যে, আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। বললাম, আজ থাক, তার চেয়ে আজ আমরা বরং জোড়া পুকুরের দিকে যাব। শ্যামল বলল, কেন চাঁদু, ভয় করছে বুঝি?
--না, ঠিক ভয় নয়। তবে একটু যেন নার্ভাস লাগছে। আমি কাঁপা গলায় বলি।
--শোন, তোর কথায় আজকে জোড়া পুকুরেই যাচ্ছি। আজ যদি তোর কলম থেকে কবিতা না বেরয় তো আমি এরপর থেকে একাই কবিতা লিখব।
শ্যামল, তুই এমন একটা কথা বলতে পারলি?
--অ্যাই চুপ কর তো। তোর ন্যাকা ন্যাকা কথা বন্ধ করে এবার চল জোড়া পুকুরের দিকে। শ্যামল ধমকে থামাল আমাকে।
সেদিন আমি আর শ্যামল জোড়া পুকুরেই গেলাম। জোড়া পুকুরের কাছে গিয়েই শ্যামলের আর্তনাদ, বস, সে মাছটা তো দেখছি এখানে ঘাঁটি গেড়েছে।
শ্যামলের কথা শুনে আমিও দেখলাম, হ্যাঁ, সে মাছটাই বটে। বুঝতে পারছিলাম না, কে এই মাছটাকে ওখানে নিয়ে এল আর কেনই বা নিয়ে এল। শ্যামলকে বললাম, খোঁজ লাগা তো এই মাছটা এখানে কেন। উত্তরে শ্যামল বলল, ব্যস, হয়ে গেল। তার মানে আজও এক লাইন কবিতা বেরবে না। তোকে নিয়ে শালা আর পারা যায় না।
--আরে আমি আবার কী করলাম। এই মাছটা যে জোড়া পুকুরে চলে আসবে সেটা আমি কী করে জানব? আমি কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করি।
--আমার তো এখন মনে হচ্ছে তুই আগেই জানতি যে মাছটা এখানেই আছে আর সে জন্যেই ম্যাজিক পুকুরে না গিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এলি। শ্যামল চোখে-মুখে সন্দেহ এনে কথাগুলো বলে। বিশ্বাস কর শ্যামল, আমি এর কিছুই জানতাম না। আর জানলে তোকে বলতাম না?
এরপর যে কোনও কারণেই হোক, শ্যামল একদম চুপ করে যায়। ওকে চুপ দেখে আমার চিন্তা বেড়ে যায়। বলি, শ্যামল, বিশ্বাস কর...
শ্যামল আমাকে কথা শেষ করতে দেয় না। হাতের ইশারায় সে আমাকে চুপ করতে বলে আঙুল তুলে দেখায় কিছু একটা। কিছুই বুঝতে না পেরে আমি বলি, কী দেখাচ্ছিস?
তুমি একটা মাথামোটা। দেখতে পাচ্ছিস না বিল্টু মিত্র মাছটার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে মুড়ি খাওয়াচ্ছে।
বিল্টু মিত্র এই অঞ্চলের মোটামুটি প্রভাবশালী লোক। তাঁর অনেক গুণের মধ্যে একটা হল, তিনি একটা লিটল ম্যাগ চালান। বিল্টু মিত্র নিজে গল্প লেখেন এবং ওনার লেখার হাত খারাপ নয়। আশপাশের অনেকের লেখাই ওঁর পত্রিকায় ছাপা হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কারণে আমার বা শ্যামলের কোনও কবিতা ওঁর ম্যাগে কখনও জায়গা পায়নি।
আমার আর শ্যামলের জেদ ছিল, লেখা কেউ নিজে থেকে না চাইলে আমরা সেখানে লেখা দেব না। যথারীতি বিল্টু মিত্র আমাদের মতো “হরিদাস পাল”এর লেখা চেয়ে নেওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি বলে ওঁর ম্যাগে আমাদের কোনও কবিতাই কখনও মুখ দেখানোর যোগ্যতা অর্জন করেনি।
আমরা, বিশেষ করে আমি, খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করছিলাম বিল্টু মিত্রের কার্যকলাপ। বেশ একটা অন্তরঙ্গ ভাব নিয়ে বিল্টু মিত্র মাছটার আরও কাছে যাবার চেষ্টা করছিল। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, মাছটা সে অন্তরঙ্গতা ঠিক পছন্দ করছে না, অথচ অমন মাপের মানুষকে ঠিক সেভাবে উপেক্ষাও করতে পারছে না।
দৃশ্যটা দেখে আমার বুকের ভেতরটা, খুব স্বাভাবিক, বেদম জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল বিল্টু মিত্রকে কিছু একটা বলি। হয়ত তাই করতাম, কিন্তু তার আগেই দেখি বিল্টু মিত্র আমাদের দুই মক্কেলের দিকেই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছেন। আমি ভেতরে ভেতরে আরও ঘেঁটে গেলাম।
বিল্টু মিত্র আমাদের একদম কাছে এসে বললেন, এই যে জোড়া ফলা, তোমরা নাকি এখন বাজার কাঁপানো সব কবিতা লিখছ। বিল্টুদার এমন প্রশংসা শুনে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। বললাম,
--কী যে বলেন বিল্টুদা। কোথায় আপনার লেখা আর কোথায় আমরা।
--আরে আমি তো গল্প লিখি। সে যাক, শোনো, তোমাদের আমার খুব দরকার।
--আমাদের? আমি আর শ্যামল একসঙ্গেই বললাম।
--হ্যাঁ, তোমাদের।
--কী দরকার বলুন। শ্যামল বেশ গলা নামিয়ে কথাটা বলল।
--তোমরা আমাকে কিছু দু-লাইনার, থ্রি লাইনার বা ফোর লাইনার দিতে পারো?
--আপনার ম্যাগে ছাপবেন বুঝি? আবার শ্যামলের প্রশ্ন।
--না, প্রথমেই ছাপব না। আগে দেখে নেব, তারপর ছাপার ব্যাপারটা ভাবা যাবে।
--তা বেশ তো, এখনই দেখে নিন। এখানেই। তারপর বলুন সেগুলো ছাপার যোগ্য কি না। এবার আমি বললাম কথাটা।
--দেখ ভাই, এ সব এ ভাবে হয় না। লেখা যেমন একটা মুডের ব্যাপার, লেখা পরীক্ষা করাটাও একটা মুডের ব্যাপার। তা, তোমরা কবে লেখা দেবে বল?
--আমরা তো এদিকে প্রায়ই আসি, এর মধ্যে কোনও একদিন আপনার হাতে লেখাগুলো তুলে দেব। শ্যামল নিশ্চিন্ত করে বিল্টুদাকে।
পরের দিন আমরা বেছে বেছে কয়েকটা টু-লাইনার নিয়ে গেলাম বিল্টুদার কাছে। বিল্টুদা প্রথমেই “শুনেছি তোমার মাঝি ভালোবাসে খুব ঝুরো মাটি/ তুমি তাই ঝরে যেতে চাও একা – হলুদ দোপাটি” পড়ে বললেন, হুম্ম্, এটা আমার চাই। তারপর, “বলছ এ প্রেম নয় – তাহলে তো মাটি/ কে বল খসাবে তবে আলতো খোঁপাটি” পড়ে বললেন, হুম্ম্, এখানেও দেখছি “মাটি” আছে। তবু এটাও আমার লাগবে। এবার “ধোঁয়াতে পূরবী রাগ শঙ্খে ধ্বনি আনে জল/ প্রসাদী থালায় দেখি পড়ে আছে শুধু কিছু বুক কাটা ফল” পড়ে বললেন, এটায় বেশ একটা ইয়ে ইয়ে ভাব আছে, এটাও নিলাম।
এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা টু-লাইনার পছন্দ হল বিল্টুদার। শ্যামল বিল্টুদাকে বলল, এ গুলো ছাপা হলে কবির নাম লিখবেন, “দিল”। কবির নাম শুনে মনে হল বিল্টুদার পিলে চমকে উঠল। তিনি বেশ অবাক হয়ে বললেন, কেন, এমন নাম কেন?
বিল্টুদা, এটা বুঝলেন না। দিব্যেন্দুর “দি” আর শ্যামল এর “ল” দিয়ে এই নামটা তৈরি হয়েছে। আসলে আমরা দু-জনে মিলে লিখি তো তাই এই ব্যবস্থা।
“ব্যবস্থা”টা বিল্টুদাকে ব্যাপক চমকে দিয়েছে সেটা ওঁর চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আমরা ফিরে আসবার সময় আড় চোখে দেখলাম পৃষ্ঠাবন্দী আমাদের লেখাগুলো বিল্টুদা তার বুকপকেটে রেখে দিল।
সেদিন থেকে জোড়া-পুকুরে আমার জন্য দু’টো টান তৈরি হয়ে গেল। এক, আমার প্রিয় মাছ আর দুই, “দিল”এর কবিতা। অন্য পুকুর ছেড়ে আমি তখন রোজই আসা শুরু করেছি জোড়া পুকুরে আর শ্যামলও বাধ্য হয়ে আমার প্রথম প্রেমের পরিণতি দেখার জন্য আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকত।
এর মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার প্রিয় মাছটাকে ম্যাজিক পুকুর থেকে জোড়া পুকুরে আনার মূল কারিগর হল বিল্টু মিত্র। আমার ধারণা, বড় জলের মাছ ম্যাজিক পুকুরের ওই আবদ্ধ অবস্থাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না বলেই বিল্টুদার শরণাপন্ন হয়েছিল। আর বিল্টুদাও সে সুযোগটা নিয়ে সে মাছকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এত সবের মধ্যেও আমার ভালো লাগত যখন দেখতাম বিল্টুদার ছিপ এড়িয়ে সে মাছ বারবার পালিয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই বেশ চলছিল। ঠিক ছিল, আর দু-একদিনের মধ্যেই শ্যামলের সেই “হেস্তনেস্ত” ব্যাপারটা সেরে নেওয়া যাবে। ঠিক তখনই আমার জন্ডিস হল। বাড়ি থেকে বেরনো বারণ। শরীরে কষ্ট, মননে ধ্বস্ত আমি এরপর অন্তত পনের দিন জোড়া-পুকুর মুখো হতে পারিনি।
মোটামুটি সুস্থ হবার পর আজই কথা ছিল আমি আর শ্যামল ফের যাব জোড়া-পুকুর পানে। হঠাৎ বৃষ্টিতে আমি চিলেকোঠায় আটকে পড়লেও শ্যামল ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছিল স্পটে। সেখান থেকেই এই ফোন, মাছরাঙার ভয় দেখানো ফোন।
আমি পড়ি-মরি করে দৌড় লাগালাম। ওখানে পৌঁছে যা দেখলাম সেটা দেখার জন্য আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম সে মাছ তখন বিল্টু মিত্রের নাগালে পৌঁছে গেছে। নাকে নোলক, কপালে সিঁদুর, কী দারুণ দেখাচ্ছিল মাছটাকে। আমার শরীরে তখন “অদ্ভুত এক আঁধার” নেমে এসেছে। মনে হচ্ছিল ওখানেই পড়ে যাব।
সেই অবস্থায় শ্যামলকে বললাম, চল, আমাদের আর এখানে থেকে কাজ নেই। শ্যামল আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিল। ও বলল, ঠিক আছে, চল। আমাদের এখন চলে যাওয়াই ভালো। বিল্টুদা এখনও আমাদের দেখেনি। সে একবার আমাদের দেখলেই হয়ত ডেকে বসবে।
বাড়ি ফিরে যাবার জন্য আমরা পিছন ফিরে দু-পা এগিয়েছি কী এগোইনি, পিছনে শুনতে পেলাম বিল্টুদা একজনকে বলছে, জানেন তো, এ মাছটা আসলে অনেক ভালো জলের মাছ। ওর বেশিরভাগ সঙ্গী-সাথীরাই আয়লার আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অন্য কোথাও ছিটকে গেছে। তাই আমি দায়িত্ব নিয়ে একে আমার অ্যাকোরিয়ামে নিয়ে এলাম। আশা করি ও এখানে ভালোই থাকবে।
এবার আমাদের চোখ গেল বিল্টুদার সাজানো-গোছানো অ্যাকোরিয়ামটার দিকে। ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি সে অ্যাকোরিয়ামের চার কোনায় কিছু কবিতা সাঁটানো আছে। কৌতূহলী আমি আর শ্যামল সে কবিতাগুলো দেখতে দু-পা এগোতেই শুনতে পেলাম, বিল্টুদা একজনকে শোনাচ্ছে, “বলছ এ প্রেম নয় – তাহলে তো মাটি/ কে বল খসাবে তবে আলতো খোঁপাটি”। হা, হা, হা। আরও শুনবে, “শুনেছি তোমার মাঝি ভালোবাসে খুব ঝুরো মাটি/ তুমি তাই ঝরে যেতে চাও একা – হলুদ দোপাটি”। বিল্টুদা যখন টু-লাইনারগুলো সবাইকে শোনাচ্ছিলেন, আমি চোখ বড় বড় করে দেখলাম আমার প্রিয় মাছের ঠোঁটদুটো যেন আবেগে নড়ছে, তার কপালের সিঁদুর যেন আরও রাঙা হয়ে উঠছে। আবেগে রঙিন আমি ভিতরে ভিতরে তখন একটা অন্য ভালোলাগা টের পাচ্ছিলাম।
ঠিক তখনই কে একজন বলল, বিল্টুদা, আপনার কবিতার হাতটাও দেখছি দারুণ। বিল্টুদাকে দেখলাম অম্লান বদনে টু-লাইনারগুলোর সব প্রশংসা বেশ হাসিমুখে নিজের করে নিচ্ছেন। বিল্টুদা সেই লোকটাকে বলল, এ গুলো জাস্ট টু-লাইনার। আসলে কী জানেন, আজকাল লোকের হাতে সময় কম। তাই এই ছোট্ট পুরিয়া আর কী!
আমার মনে হচ্ছিল, পা দু-টো কেউ মাটিতে বেঁধে রেখেছে। এক পা-ও এগোতে পারছিলাম না। তারপরেই সবে বলতে যাচ্ছি, শালা চিটিংবাজ...
শ্যামল খপ করে আমার মুখ চেপে ধরল। বলল, চুপ। আমি বললাম, কেন চুপ করব। শালা আমাদের কবিতা নিয়ে...
শ্যামল আবারও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, জানি তো। কিন্তু আমাদের কাছে তো কোনও প্রমাণ নেই বস। এ ছাড়া বিল্টু মিত্র প্রভাবশালী মানুষ, লেখালিখির বাজারে ওঁর পরিচিতি আছে। লোকে বরং আমাদের মিথ্যেবাদী ভেবে চেপে ধরতে পারে। তুই চুপ কর বস। আর শোন, কবি নয়, কবিতাই আসল। এই যে এত লোক আমাদের টু-লাইনারগুলোকে ভালো বলছে, এটাই তো আমাদের আগামীতে আরও ভালো লেখার টনিক হিসেবে কাজ করবে।
শ্যামল, কোনও সন্দেহ নেই আমার থেকে অনেক বেশি ম্যাচিওরড। ওর কথায় আমার চোখের কোণ বেয়ে সামান্য বৃষ্টি নেমে এল। তারপর ধরা গলায় শ্যামলকে বললাম, বাড়ি চল।
শ্যামল শ্যামলের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল, আমি আমার। পথে অনন্তদার সঙ্গে দেখা। অনন্তদা প্রত্যেক সপ্তাহে নিয়ম করে আমাদের বাড়ি থেকে ময়লা জামা-কাপড় নিয়ে গিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রি করে ফের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। সেই অনন্তদা বলল, এটা কী ভালো হল দিব্যেন্দুদা?
আমি তখন মরছি নিজের জ্বালায় আর তার মধ্যে অনন্তদার এই হেঁয়ালিমার্কা কথা যেন পিত্তি জ্বালিয়ে দিল। বেশ গলা তুলেই বললাম, কী বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো তো অনন্তদা।
--বাবু, মানে তোমার বাবা আজকাল আমারে আর জামাকাপড় দিচ্ছেন না।
--কেন? এবার প্রশ্নটা নিজে থেকেই বসে গেল আমার মুখে।
--শুনেছি বাবু একটা বড় লন্ড্রিতে কাপড়-জামাগুলো দিচ্ছেন।
--কেন? আমি আবারও প্রশ্ন করলাম।
--শুনলাম আজকাল আমার কাপড় ধোয়া নাকি বাবুর পছন্দ হচ্ছে না। তাই...
--তবে তো ঠিকই আছে। এতে আবার ভালো-খারাপের কী আছে?
--আছে গো দিব্যেন্দুদা আছে।
এরপর দেখলাম অনন্তদা বেশ বড় করে হাসছে, হেসেই চলেছে। আর থাকতে না পেরে বললাম, তুমি হাসো, আমি চললাম বাড়ি।
আমার কথা শুনে অনন্তদা তার হাসি থামিয়ে বলল, দিব্যেন্দুদা তোমাকে চুপি চুপি একটা কথা বলি, আর কাউকে বোলো না যেন।
আবার সেই হেঁয়ালি। এবার বেশ রেগে গিয়ে বললাম, ভাঁট না বকে যা বলতে হয় তাড়াতাড়ি বল। আমার কথা বলার ভঙ্গিতে অনন্তদা একটু অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, কী জানো তো দিব্যেন্দুদা, বাবু তো আর জানে না যে ওই লন্ড্রি আমাকে দিয়েই কাপড় কাচায়। কথাটা শেষ করে অনন্তদা ফের হেসে উঠল।
অনন্তদার শেষ কথাটা আমাকে একটা সম্পূর্ণ অন্য জগতে নিয়ে চলে গেল। ভেতরে ভেতরে আমি টের পেতে শুরু করলাম যে, আমার মুখের এবং মুডের পরিবর্তনের ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে। আমিও অনন্তদার সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলাম। আমার হাসি দেখে অনন্তদা বেশ বোকা বোকা মুখ করে নিজের হাসি থামিয়ে দিল দেখে বললাম, কী ব্যাপার অনন্তদা, তুমি হাসি থামালে কেন। তুমিও হাসো, আমিও হাসি। অনন্তদা তবু চুপ করে আছে দেখে বললাম, ধুস, তুমি না একদম যা-তা। সে যাক, তুমি না জেনেই আমার একটা বড় উপকার করেছ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ অনন্তদা।
আমার কথা শুনে আরও অবাক অনন্তদা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল, যেন আমি একটা অন্য গ্রহের জীব।
আমি আর না দাঁড়িয়ে একা একাই, “বাবু তো আর জানে না যে ওই লন্ড্রী আমাকে দিয়েই কাপড় কাচায়” বলতে বলতে বাড়ির দিকে এগোই। আমার মনে পড়ে প্রিয় মাছের মুখ, মনে পড়ে বিল্টুদার মুখ, মনে পড়ে আমাদের টু-লাইনারগুলোর কথা। আমি চোখ বুজে সে দৃশ্যটার কথা ভাবার চেষ্টা করি যেখানে বিল্টুদা অ্যাকোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে আমাদের টু-লাইনারগুলো পড়ছে আর আমার প্রিয় মাছের ঠোঁট নড়ে উঠছে, কপালের সিঁদুর আরও রাঙা হয়ে উঠছে।
আমার আবেগ জুড়ে তখন রবীন্দ্রনাথ। মনে পড়ে, কবিগুরুর “বাঁশি” কবিতার অমোঘ দুটো লাইন – “ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া... / পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর”।
আমি অপেক্ষা করি ফের কবে বিল্টুদা আমাকে, আমাদের টু লাইনার লেখার কথা বলবেন!