দিলীপকুমার রায়ের জন্মের পর একশো পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এককালে সাড়া জাগানো ব্যক্তিত্ব আজ বিস্মৃতপ্রায়। কবি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একমাত্র পুত্র দিলীপকুমার বাল্যকাল থেকেই সংগীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারে সংগীতসাধনার ধারা কয়েকপুরুষের। পিতামহ কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ধ্রুপদী সংগীতে রীতিমতো বিখ্যাত ছিলেন। কবিতা ও নাটকের পাশাপাশি সংগীত রচনা ও সুর প্রয়োগেও পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল কম খ্যাতিমান নন। স্বভাবতই দিলীপকুমার ছিলেন সুকন্ঠ, সংগীতপ্রাণ। খুব অল্প বয়সেই মা সুরবালাকে চিরতরে হারান দিলীপকুমার — কৈশোর না পেরোতেই বাবাকেও হারাতে হল। তাই কি গোটা জীবন এক অদ্ভুত বৈরাগ্য তাঁকে চিরভ্রাম্যমান করে রেখেছিল? প্রখর মেধাবী ছিলেন দিলীপকুমার। বিজ্ঞানের যশস্বী ছাত্র, আবার কাব্যসাহিত্যের গভীর অনুরাগী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করা থেকে কেম্ব্রিজে গণিতের ট্রাইপোস — প্রথাগত বিদ্যার্জনে উজ্জ্বল কৃতিত্বের অধিকারী, আবার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতশাস্ত্রে প্রগাঢ় তাঁর পাণ্ডিত্য। অসাধারণ সুকন্ঠের অধিকারী হওয়ার ফলে গায়ক হিসেবে তাঁর খ্যাতি অল্প বয়স থেকেই ছড়িয়ে পড়ে। সুকন্ঠের সঙ্গে একেবারে নিজস্ব গায়কী এবং সংগীতশাস্ত্রে নিবিড় অধিকার জীবিতকালে তাঁকে একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিল। তাঁর সময়ের পৃথিবী বিখ্যাত দেশি এবং বিদেশি বহু ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। বস্তুত তাঁর মনের একটা ঝোঁক ছিল মনস্বী-সঙ্গের দিকে। বিশেষ করে সাধু-সঙ্গের দিকেও। ব্যক্তিগতভাবে শ্রী অরবিন্দের একান্ত ভাবশিষ্য ছিলেন। পরে পুণাতে ১৯৫৯ সালে হরিকৃষ্ণমন্দির নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। গীতিকার, সুরস্রষ্টা, সুগায়ক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ দিলীপকুমার একজন ঔপন্যাসিকও বটে। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি দেশে বিদেশে ছড়ানো — নিছক আখ্যান নয় বিচিত্র ডিসকোর্সের উপস্থাপনে তাত্ত্বিক ঝোঁকই তাঁর সাহিত্যে প্রবল।
আজ তাঁর মৃত্যুর বিয়াল্লিশ বছর পরে যখন কয়েকটি রেকর্ড ছাড়া সেই কিংবদন্তী কন্ঠস্বরের স্মৃতি ম্লান হয়ে এসেছে, তাঁর উপন্যাসগুলিও আজ প্রায় অনাদৃত, তাঁর উজ্জ্বল মনোজ্ঞ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই প্রয়াত, তখনো একটি গ্রন্থ তীব্র প্রাসঙ্গিকতা ও সুগভীর চিন্তনে, বিরল তথ্য পরিসজ্জায় সমান ঔৎসুক্য সঞ্চার করে। দিলীপকুমারের লেখা ‘তীর্থংকর’, ইংরিজিতে যে বইটির নাম ‘Among the great’। পাঁচজন অভ্রভেদী ব্যক্তির সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা রয়েছে এই গ্রন্থে, রবীন্দ্রনাথ, শ্রী অরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী, রোমাঁ রঁলা ও বার্ট্রান্ড রাসেল। স্বভাবতই এই ব্যক্তিরা যে মানসিক উচ্চতায় বিহার করতে অভ্যস্ত — তাঁদের সঙ্গে বিচিত্র বিষয়ে প্রায় সমকক্ষের মতো কথোপকথন চালানো, সুনিপুণ সারথ্যে আপন বিনয়াবনত অবস্থান বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া অতি সুকঠিন কাজ সন্দেহ নেই। দিলীপকুমার এই অভিযাত্রায় একশো শতাংশ সফল। আজ আমরা রবীন্দ্রনাথ, শ্রী অরবিন্দ ও মহাত্মা গান্ধী — ভারতের এই তিন মহামানবের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতায় চোখ রাখব।
এই আলোচনায় প্রবেশের আগে আলোচক দিলীপকুমারকে আরেকটু চিনে নেওয়া যেতে পারে। আধ্যাত্মিকতার দিকে প্রবল আকর্ষণ গোড়া থেকে থাকলেও সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ও সুহৃদ দিলীপকুমার রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, সমকালীন বিশ্ব সম্বন্ধে মোটেই অন্যমনস্ক নন, বরং এই সব বিষয়ে তাঁর প্রখর নিজস্ব অভিমত আছে। যে তিন জনের সঙ্গে কথাবার্তা আমরা লক্ষ করব তাঁদের মধ্যে শ্রী অরবিন্দ দিলীপকুমারের গুরু — তাঁর বিষয়ে সংশয়হীন আনুগত্য ও ভক্তি রয়েছে তাঁর, মহাত্মা গান্ধীকে ব্যক্তিগত ভাবে গভীর শ্রদ্ধা করলেও, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ দিলীপকুমারকে মুগ্ধ করেনি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়বৎ সম্পর্ক ছিল তাঁর। কবি ডাকনাম ‘মন্টু’ বলেই তাঁকে সম্বোধন করতেন। সুসাহিত্যিক, কবি দিলীপকুমার সাহিত্যের ভাষাক্ষেত্রে রবীন্দ্র-অনুসারী বর্গেরই অন্তর্গত। দুজনেই সুরপাগল মানুষ — কিন্তু সেখানে মতবিরোধও কম নয়। মতবিরোধ সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রেও রয়েছে। আত্যন্তিক ভক্তিতে নিজের অভিমত বিলুপ্ত করে দেওয়ার লোক দিলীপকুমার নন। বরং প্রবল তার্কিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। তাঁর তর্কমুখরতার হাত থেকে স্বয়ং গুরু অরবিন্দও নিস্তার পাননি। অন্যে পরেকা কথা। তর্কে প্রবৃত্ত করিয়ে, বিপরীত মতামতের দ্বান্দ্বিকতায় এই মহান ব্যক্তিত্বদের মহিমা অভিনব উপায়ে উদ্ভাসিত করেছেন তিনি ‘তীর্থংকর’ গ্রন্থে। কথোপকথন যথাযথ ভাবে নথিবন্ধ করার ব্যাপারে দিলীপকুমার পুরোপুরি পশ্চিমী রীতি মেনে চলেছেন — সন তারিখের ত্রুটিবিচ্যুতি নেই কোথাও। আলাপচারী দিলীপকুমার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন তা এই প্রসঙ্গে স্মতর্ব্য।
‘দিলীপকুমারের একটি মস্ত গুণ আছে, তিনি শুনতে চান, এই জন্যই শোনবার জিনিষ তিনি টেনে আনতে পারেন। শুনতে চাওয়াটা অকর্মক পদার্থ নয়, সেটা সকর্মক। তার একটা নিজের শক্তি আছে, বলবার শক্তিকে সে উদ্বোধিত করে। যে মানুষ বলে তার পক্ষে সে বড় কম সুযোগ নয়। কেননা বলার দ্বারাই আপন মনের সঙ্গে আমাদের সত্যকার পরিচয় হয়। দিলীপকুমার অনেক সময়ে আমাকে এই আত্মচিন্তা-আবিষ্কারের আনন্দ দিয়েছেন।’
দিলীপকুমারের সঙ্গে আলাপ করার সময় রবীন্দ্রনাথ একটি দুর্লভ ও বিরল অন্তরঙ্গতায় ধরা দিয়েছেন। কবির স্বভাবে একটি সুদূরতা অনেকেই লক্ষ করেছেন। তাঁকে প্রথম দেখার প্রসঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো যে নিঃসঙ্গ দীপ্ত আভিজাত্যের কথা বলেছেন। যে ক’জন মানুষের কাছে তিনি মনের দরজা কিছুটা হলেও খুলেছেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই দিলীপকুমার একজন। নিজের চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে অতুলপ্রসাদ ও দিলীপকুমারকে তিনি যে ক’টি কথা বলেছেন তা লক্ষ করা যাক,
‘আমি সত্যিই বহুবার অনুভব করেছি যে আমাকে দিয়ে একটা বিশেষ কাজ করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন বলেই কর্মকর্তা আমাকে কর্মের চাপে ফেলেছেন কিন্তু অপকর্ম করাননি, নানা দুঃখ বেদনায় হাবুডুবু খাইয়েছেন কিন্তু তলিয়ে যেতে দেননি। এক কথায়, বিধাতা সব রকম অভিজ্ঞতার বোঝাই আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন কিন্তু পিষে ফেলেননি, নানা বাঁধনে বেঁধেছেন কিন্তু কোনও শিকলে বন্দি করেননি, যেমন অন্য পাঁচজনকে করেছেন — বা তারা হয়েছে, যা-ই বলো।’একে কিন্তু কবি নিয়তিবাদ বলেননি। বাঁশিওয়ালার আশ্চর্য উপমা টেনে তিনি অনেকের মধ্যে কেউ কেউ কীভাবে বিশেষ হয়ে ওঠে তার ব্যাখ্যা করেছেন। বাঁশিওয়ালা রকমারি বাঁশি বানায়, প্রতিটিই আলাদা আলাদা রকম বাজে। কিন্তু দু একটা বাঁশি যেন তারই মধ্যে উতরে যায়, এই বাঁশি ক’টি বাজাতেই যেন বাঁশিওয়ালার বেশি ভালো লাগে। এই বাঁশিগুলো যেন সবদিকে মাপসই। তেমনি প্রতি মানুষকেই বিধাতা আলাদা করে গড়েছেন কিন্তু কয়েকটি আধার বেশি উতরে যায়। ‘তাদের অভিজ্ঞতায় গঠনপ্রকৃতি, গুণ সমাবেশ, ঘটনার যোগাযোগ সবেরই পিছনে যেন রয়েছে একজন অদৃশ্য কারিগরের, কি বলব — design — মতলব। তবে আমি এ-ধরনের কথা বলতেও অহংকার করতে চাইনি বিশ্বাস কোরো। বরং ঠিক উলটো, কেননা আমি এ কথা বলছি আমাদের আমিত্বকে ফাঁপিয়ে তুলতে নয় — এই সব যোগাযোগকেই বড় করে ধরতে।’
আমাদের মনে পড়ে যাবে এই বাঁশির উপমাটি বারবার গানে কীভাবে এনেছেন কবি। ‘কত যে গিরি, কত যে নদীতীরে বেড়ালে বহি ছোট এ বাঁশিটিরে।’ কিংবা ‘তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিঃশ্বাস দাও পুরে, শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে।’
এরপর কথাপ্রসঙ্গে কবি নিজের বাল্যকালের অনাদর ও অবজ্ঞার কথা জানিয়েছেন বিরল ভঙ্গিতে। জোড়াসাঁকোর বৃহৎ বনেদী পরিবারে শিশু রবি ছিলেন অনেকটাই অবজ্ঞাত।
‘আমি ছেলেবেলা থেকে যেরকম একলা-একলা মানুষ হয়েছি ও যে-অবজ্ঞার মধ্যে গড়ে উঠেছি তাতে আমার মধ্যে একটা ভীরুভাব — shyness — বদ্ধমূল হয়ে গেছে যার প্রভাব আমি আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। … আমার শৈশবে যে কী অনাদর ও ঔদাসীন্যের মাঝখানে কেটেছে জানোনা। আমাকে সবাই ভাবত অপদার্থ।’
এরপর তাঁর জীবনে নারীর ভালোবাসা কীভাবে প্রভাতে অরুণরাগের মতো দেখা দিয়েছে অকপটে তার স্মৃতিচারণ করেছেন। আন্না তড়খড় এবং বিলেতে স্কট পরিবারের মেয়েদুটির কথা এসেছে। নারীপুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও আলোচিত হয়েছে। সেটা ১৯২৬ সাল। পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি লেখা হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠক জানে তাতে এই বিষয় নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। দিলীপকুমারের সঙ্গে আলাপে মোটামুটি তারই অনুরণন। তবে বিবাহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে কবির। পুরুষের কাজে নারীর আন্তরপ্রেরণা বিষয়ে কবির যে বিশিষ্ট ধারণা তার প্রকাশও রয়েছে। অভিমতগুলির সারাংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে।
‘সর্বগুণবতীকে ভালবাসা হয়তো দুঃসাধ্য। ভালবাসা হয়তো গুণের কিছু অভাবে খুশি হয়। অভাব না থাকলে সে যে বেকার হয়ে পড়ে। পরস্পরের মিলের উপরেই ভালবাসা, এও একটা বানানো কথা — তার গভীরতর ভিত্তি অমিলের উপর।’এইসূত্রে প্রাচীন ভারতের সমাজ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো তাত্ত্বিকরা নিশ্চয়ই মানতে চাইবেন না। তাঁর মনে হয়েছে ভারতবর্ষে, গ্রিসে, রোমে ব্যাপকভাবে স্ত্রী-প্রকৃতি আপন প্রশস্ত স্থান পায়নি বলেই পুরুষ আপন স্বভাবের অন্তর্নিহিত প্রয়োজনে এমন একদল মেয়ের জন্য বিশেষ স্থান করেছিল যারা নহে মাতা, নহে কন্যা, নহে বধূ। বর্তমান যুগের পণ্যস্ত্রীদের আদর্শে তখনকার মোহিনীদের বিচার করা ভুল। দেহতৃষ্ণার জন্য নয় তারা, বরং চিত্ততৃষ্ণা নিবারণ করত। উদাহরণ স্বরূপ তিনি ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের বসন্তসেনার কথা এনেছেন। দিলীপকুমার কিন্তু আধুনিক সমাজদৃষ্টির প্রেক্ষিতে যথার্থ প্রশ্নটি তুলেছেন। ‘সমাজের আশ্রয় থেকে মেয়েদের এরকম বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া কি তাদের প্রতি অত্যাচার নয়?’‘মানবসভ্যতাকে সৃষ্টি করে তোলা মুখ্যভাবে পুরুষের দ্বারা ঘটেছে। এই সৃষ্টিকার্যে মেয়েদের ব্যক্তিরূপের যে-প্রভাব সে হচ্ছে পুরুষের চিত্তকে গৌণভাবে সক্রিয় করে তোলা। আমাদের দেশের জ্ঞানীরা স্ত্রী-পুরুষের মনোমিলনের এই রহস্যকে স্বীকার করেছেন, তাই মেয়েদের বলেছেন শক্তি অর্থাৎ জৈব-সৃষ্টিতে পুরুষের যে স্থান, মানস-সৃষ্টিতে সেই স্থান মেয়েদের।’
‘মেয়েরা যে রহস্যময় আকর্ষণে পুরুষদের চিত্তকে টানে তাকে ইংরেজিতে বলে charm, বাংলায় তাকে বলা যেতে পারে হ্লাদিনী শক্তি। বস্তুত এ-নামের দ্বারা অর্থ ব্যাখ্যা করা হল না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যেমন ধ্বনিতে গন্ধে উত্তাপে আলোতে স্পন্দনে কম্পনে বর্ণচ্ছটায় মিলিত হয়ে একটা অপরূপ অতি সূক্ষ্ম জাল নিরন্তর বিস্তারিত করে রেখেছে, যা আমাদের দেহ মন প্রাণকে অহরহ নানারকম করে শিউরে দিচ্ছে, বাজিয়ে তুলছে, জাগিয়ে রাখছে, মেয়েদের হ্লাদিনী শক্তিও তেমনি — তাকে স্থূলরকম করে নির্দেশ করা সহজ নয়।’
রবীন্দ্রনাথ যেন এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মতে মেয়েরা যেখানে গৃহিণী সেখানে বিশেষ গৃহেই তাদের অধিকারের সীমা, যেখানে তারা হ্লাদিনী সেখানে তারা সমস্ত বিশ্বের। এবং যে মেয়ের মধ্যে এই হ্লাদিনীশক্তির বিশেষ প্রতিভা আছে সে আপনার এই শক্তিকে জানে, সে যদি এই শক্তিকে বিচিত্র ও বিস্তীর্ণভাবে প্রয়োগ করবার সহজক্ষেত্র না পায় তাহলেই তার রুদ্ধশক্তি সংকীর্ণ ক্ষেত্রে বিকৃতি ঘটায়। প্যারিসের সালঁতে অনন্যা নারীদের মোহিনীশক্তির চমৎকারী প্রভাবের কথা তাঁর মনে হয়েছে। আবার পুরুষচিত্তের সম্পূর্ণতার জন্য নারীর নিগূঢ় প্রবর্তনা আধ্যাত্মিক সাধনাতেও কতো জরুরি সেই সূত্রে তিনি বুদ্ধ-সুজাতা এবং যীশুর প্রতি মেরি মার্থার ভক্তিনিবেদনের প্রসঙ্গ তুলেছেন। এখানে যে প্রসঙ্গটি অনুক্ত থেকে যায় তা হল মেয়েরা নিজেরা যেখানে সাধক বা স্রষ্টা হতে চাইবে সেখানে প্রেরণা জোগানোর দায় কার থাকবে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা যে কিছুটা একপেশে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে বদ্ধ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নারীর ভালোবাসা সম্পর্কে তিনি এমন একটি অপূর্ব ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেছেন যার সামনে আমাদের তর্কেচ্ছা মিলিয়ে যায়। মাথা নত হয়।
‘আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে; যে, কোনও মেয়ের ভালবাসাকেই আমি কখনও ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি — তা সে-ভালবাসা যে-রকমই হোক না কেন। প্রতি মেয়ের স্নেহ বলো, প্রীতি বলো, প্রেম বলো আমার মনে হয়েছে একটা প্রসাদ — favour: কারণ আমি এটা বারবারই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালবাসা তা সে যে-রকমের ভালবাসাই হোক না কেন — আমাদের মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায় — সে ফুল হয়তো পরে ঝরে যায় কিন্তু তার গন্ধ যায়না মিলিয়ে।’যে প্রসঙ্গটি রবীন্দ্রনাথ-দিলীপকুমারের চিরকালের তর্কাতর্কির বিষয় তা হল সঙ্গীত। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে এবং অন্য গানেও গায়কের improvisation-এর স্বাধীনতা স্বীকৃত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে গায়কের এই স্বাধীনতা দেননি। এই ব্যাপারে তিনি পুরোদস্তুর পাশ্চাত্যপন্থী। এখানেই দিলীপকুমারের আপত্তি। Improvisation কে তিনি নাম দিয়েছেন সুরবিহার। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ‘তোমাদের মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের দিয়ে আমার ভয় নেই, কিন্তু এ পথ সবারই জন্য নয় জেনো। যাকে তাকে যদৃচ্ছা পক্ষবিস্তার করার স্বাধীনতা দিলে তাতে সুফলের পরিবর্তে অপফলটাই ফলবে।’ কার্যত দিলীপকুমারকেও কবি সুরবিহারের স্বাধীনতা দেননি বলেই জানি।
দিলীপকুমার ও রবীন্দ্রনাথ দুজনই ধ্রুপদী সঙ্গীতের রসজ্ঞ। যদিও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বাংলায় কীভাবে বাঙালির নিজস্ব সঙ্গীতধারা গড়ে উঠেছিল তার ব্যাখ্যাসূত্রে রবীন্দ্রনাথ নিজের গানকে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের অন্তর্গত করে দেখেছেন। এই সূত্রে কীর্তনগান প্রসঙ্গে তিনি যে পরিচয় দিয়েছেন তার সারাংশ উদ্ধৃত করা হল। এমনভাবে বোধহয় কেউ বাঙালির এই গায়নঐতিহ্যকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারেনি।
‘হিন্দুস্থানি গানের রীতি যখন রাজা বাদশাদের উৎসাহের জোরে সমস্ত উত্তর ভারতেও একচ্ছত্র হয়ে বসল তখনও বাঙালির মনকে বাঙালির কন্ঠকে সম্পূর্ণ দখল করতে পারেনি। বাংলায় রাধাকৃষ্ণের লীলাগান দিলে হিন্দুস্থানি গানের প্রবল অভিযানকে ঠেকিয়ে। এই লীলারসের আশ্রয় একটি উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানের ধারাটিকে নিয়ে কীর্তন-গান হয়ে উঠল পালাগান। স্বভাবতই পালাগানের রূপটি নাট্যরূপ। হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে নাট্যরূপের জায়গা নেই।’এই অভিমত পড়লে অনুভব করি রবীন্দ্রসংগীতে কীর্তনের সুরের বিচিত্র ব্যবহারে কতোখানি আবেগ, মুগ্ধতা ও একাত্মতা রয়েছে।‘কীর্তনে জীবনের রসলীলার সঙ্গে সঙ্গীতের রসলীলা ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত। জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মতন নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে বিচিত্র। ডোবা বা পুকুরের মতন একটি ঘের দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধা নয়। কীর্তন চেয়েছিল এই বিচিত্র বাঁধা ধারার পরিবর্তমান ক্রমিকতাকে কথায় ও সুরে মিলিয়ে প্রকাশ করতে।’
‘কীর্তনের আরও একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই। বাংলায় একদিন বৈষ্ণব ভাবের প্রাবল্যে ধর্ম-সাধনায় বা ধর্ম-রসভোগে একটা ডিমক্রাসির যুগ এল। সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কন্ঠে প্রকাশ পেতে চেয়েছিল। সে- প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তার ঘাটে। বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছাস গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল’।
কীর্তনে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি — রবীন্দ্রনাথের মতে বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও সেই ধারাই স্ফূর্তি পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি নিধুবাবু, শ্রীধর কথকের টপ্পা গান, হরুঠাকুর ও রাম বসুর কবিগানের কথা তুলেছেন। দিলীপকুমার কিন্তু তাঁর বিপরীত মতের কথা তুলতে ছাড়েননি,
‘আপনি যেমন কথাকে ছাড়িয়ে যাওয়াটা সুরের পক্ষে অপরাধ বলে মনে করেন, আমিও তেমনি বলি কথার চাপে সুরের শ্বাসকষ্ট হওয়াটা দোষের — এই মাত্র।’কবি দিলীপকুমারের বক্তব্যের ভিতরে লুকোনো অভিযোগের তীরটি অব্যর্থভাবে তুলে নিয়েছেন, ‘নালিশটা এই যে, আমার রচিত অধিকাংশ গানেই আমি সুরকে খর্ব করে কথার প্রকাশ করে থাকি… নিজের রচনা সম্বন্ধে নিজে বিচারক হওয়া বেদস্তুর, কিন্তু দায়ে পড়লে তার ওকালতি করা চলে। সেই অধিকার দাবি করে আমি বলছি, আমার গানের কবিতাগুলিতে বাক্যের আসুরিকতাকে আমি প্রশ্রয় দিইনি, অর্থাৎ সেইসব ভাব সেইসব কথা ব্যবহার করেছি সুরের সঙ্গে যারা সমানভাবে আসন ভাগ করে বসবার জন্যেই প্রতীক্ষা করে।’
দিলীপকুমার বারবার উল্লেখ করেছেন আলাপের সময় রবীন্দ্রনাথের কন্ঠস্বরের স্নিগ্ধতায়, উপমায়, চাহনিতে — এক কথায় তাঁর ব্যক্তিরূপের মহিমা তাঁকে অভিভূত করেছে। বিতর্ক কম হয়নি কিন্তু কবির ব্যক্তিত্বের মাধুর্য যেন সর্বাতিশায়ী হয়ে দেখা দিয়েছে। দিলীপকুমারের ‘ধূসরে রঙিন’ উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন লেখাটি ‘ইনটেলেকচুয়াল’ হওয়া সত্ত্বেও অনেকের ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ গল্পে বুদ্ধির প্রবেশকে Persona non grata বলে খেদিয়ে দিতে চাওয়ায় অনেকে রুখে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ যখন রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বের লেখা সম্বন্ধে ‘ইনটেলেকচুয়াল’ বিশেষণ দেওয়া হচ্ছে তখন তিনি নিজে এই বিষয়ে কী অভিমত দিয়েছিলেন তা জানার ইচ্ছে হয়। রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, ‘লেখকের যেটা বলবার কথা পাণ্ডিত্য যখন সেটাকে ছাড়িয়ে যায় তখন সাহিত্যের হয় ভরাডুবি। সে-সমস্ত রচনাই ব্যর্থ হয়েছে যাতে পাণ্ডিত্য দিয়ে চোখ বাঁধিয়ে দেবার চেষ্টা আছে। সাহিত্যে জাহিরিপনার স্থান নেই।’
কী গভীর ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিল তাঁর বাংলা ও বাঙালিকে ঘিরে। তাঁর মনে হয়েছে কল্পনাশক্তির বিকাশে সমস্ত ভারতবর্ষে বাঙালির জুড়ি মেলেনা। বাংলার মাটিতে আছে ফলপ্রসূ কল্পনার বীজ। তবে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, নাচ, গানকে অবজ্ঞা করে নিরবচ্ছিন্ন রাজনীতির চর্চাতে দেশের প্রাণ শুকিয়ে যাচ্ছে। বাঙালির মহদ্দোষ যে কোথায় তা নির্দেশ করতে গিয়ে দেশবাসীর কাছ থেকে কী পরিমাণ আঘাত তাঁকে পেতে হয়েছে তা উল্লেখ করতে যেমন ভোলেননি, বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ আখ্যা দিয়ে আলাদা করে কিন্তু বলতে ছাড়েননি, ‘বাংলার মেয়েরা বড় ভাল’। একথা ভেবে আমার আনন্দ হয় যে, এদের কাছ থেকে আমাকে আজ পর্যন্ত সামান্য আঘাতটুকু পেতে হয়নি।’ কিন্তু মেয়েদের ও সীমাবদ্ধতা আছে। ‘যতই কেননা গান গাক কবিতা লিখুক নাচ শিখুক, বিয়ে হলেই তারা আত্মসমর্পণ করে একমাত্র ঘরকন্নার কাছে। মুখে তারা যতই হাঁকডাক করুক না কেন, তাদের মনপ্রাণ মানে এক ঘরকে। ভবিষ্যতে হয়তো তাদের মধ্যে এ-সাহস গড়ে উঠবে যার জোরে তারা অকুতোভয়ে বলতে পারবে যে, ঘরকন্নার চেয়ে নাচ গান কবিতা বড় — কিন্তু এখনও সে দিন সুদূর। তবে ওদের তরফের কথাটাও ভেবো। প্রকৃতি বেঁধেছে ওদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে। তাই গৃহ সংসার ছেলে মেয়ে এসবের কাছে ওরা ধরা না দিয়ে পারে না।’
এই সংলাপ ১৯৩৮ সালের। তারপর বাংলার ওপর দিয়ে অনেক দুর্দৈব গেছে। কিন্তু মেয়েরা ডানায় রৌদ্রের গন্ধ পেয়ে গেছে অনেকখানি। ঘরের মেয়েরা বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে, ‘কালান্তরের’র ‘নারী’ প্রবন্ধে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে ভবিষ্যৎবাণী অনেকখানি সত্য হয়েছে। পথ অবশ্য এখনো বিপুল বাকি।
‘কেন টাঙাব বলো দেখি — যখন দেয়াল আমরা তুলেছি শুধু আশ্রয় পেতে, বাসা বাঁধতে? দেয়ালের আসল যে- সার্থকতা তা ছাড়া অন্য সার্থকতা তাকে দিতে যাওয়াই বা কেন — এভাবে কোমর বেঁধে।’প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যভাণ্ডারই গান্ধীজির কাছে যথেষ্ট। কোনো শিল্পকলাই তাঁর কাছে তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমাদের মনে থাকে সঙ্গীতকেও তিনি ধর্মজীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখেছেন — সঙ্গীতের অন্য প্রয়োজন সম্ভবত তাঁর মনে স্থান পেত না। প্রকৃতি এবং জীবনের মহিমাই সব থেকে বড়ো, কোনো শিল্পই তার ধারে কাছে আসতে পারবে না কোনোদিন - এই দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করে গান্ধীজি জানিয়েছেন, ‘শিল্প হল জীবনের নিহিতার্থ, সৃষ্টির মুকুটমণি, বেঁচে থাকার মূল হেতু — এ ধরনের কথা শুনলে না হেসে থাকতে পারা যায়?’ চকিতে মনে পড়ে যাবে ভারতের মন্দিরগাত্রের মিথুন ভাস্কর্য সম্পর্কে গান্ধীজির তীব্র প্রতিকূল মন্তব্যের কথা। সঙ্গত ভাবেই দিলীপকুমার স্মরণ করেছেন গান্ধীজির গুরু টলস্টয়ের What is Art গ্রন্থটি। নাটকের মহলা দেখতে গিয়ে শ্রান্ত ক্লিষ্ট হয়ে ফিরে এসে তিনি ধিক্কার দিয়েছিলেন শিল্পকলাকেই।
‘শুধু যে এতে বিপুল পরিশ্রম তাই নয় — এ ধরনের শিল্পের জন্যে নটনটীদের সমস্ত জীবন যায় নষ্ট হয়ে। শত শত লোক আশৈশব শেখে হয় হাত-পা ছোঁড়া (এদের বলা হয় নাচিয়ে), না হয় কন্ঠকসরত বা যন্ত্রতাণ্ডব (এদের নাম — গাইয়ে-বাজিয়ে), নইলে হয়তো বা রংচং দিয়ে হাজারও মূর্তি আঁকা (এদের নাম চিত্রকর) না হয় শব্দ নিয়ে ভেলকিবাজি (এদের নাম কবি)। ফলে হয় কি, এইসব লোক — অনেক সময়ে এরা বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়েই জন্মায় কিন্তু — তাদের একপেশে উদ্ভট পেশাদারির ফলে হয়ে দাঁড়ায় অমানুষ, জীবনে সব সার্থক কাজেরই অর্থবোধ খুইয়ে শেখে শুধু হাত-পা, জিভ বা আঙুল নিয়ে নানারকম চাতুরী খেলতে।’
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে সাহিত্যও কি তাহলে শব্দ দিয়ে এক কাল্পনিক জগৎ তৈরি করা নয়? টলস্টয় নিজে সেই কাজে বিপুল শ্রম ও শক্তি নিয়োগ করলেন কেন? বিশ্বজনীন শিল্পের মূল্যের কথা অবশ্য টলস্টয় বলেছিলেন — যা সমাজে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষের বিভেদ ঘুচিয়ে দেবে।
গান্ধীজিও এই বিশ্বজনীন শিল্পের কথা বলেছেন। সমাজে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ যেখানে আলস্য গ্লানি ও অজ্ঞানের অন্ধকারে জীবন্মৃতের মতো রয়েছে সেখানে শৌখিন শিল্পকলার জন্য সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ খুঁজে পাননি তিনি।
‘এর চেয়ে দুঃখীর দুঃখ দূর করার জন্যে তাদের মঙ্গলের জন্যে জীবন উৎসর্গ করা কি ভাল নয় — যে পৃথিবীর প্রতি স্তর আজও মানুষের চোখের জলে সিক্ত সেখানে প্রতি মানুষেরই কি কর্তব্য নয় তার প্রাণের দরদ নিয়ে অপরের অশ্রু মুছিয়ে দেওয়া।’আদর্শ হিসেবে এই মনোভাব নিশ্চয়ই অনন্যসাধারণ কিন্তু মানবপ্রকৃতির মূলগত বৈচিত্র্য ও প্রবণতাকে এখানে মূল্য দেওয়া হয়নি। ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’ যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন তাঁরা প্রণম্য কিন্তু সকলের পক্ষে কি এই ত্যাগস্বীকার সম্ভব? আর তারজন্য শিল্পকলাসমূহকে অবজ্ঞা করলে এই পৃথিবী কি নিতান্ত বিবর্ণ আকর্ষণহীন হয়ে পড়বে না। তবে এইসব প্রশ্ন তোলা হয়তো বাতুলতামাত্র।
চরকা এবং খদ্দর নিয়ে দিলীপকুমার গান্ধীজির আদর্শ সমর্থন করতে পারেননি। প্রখ্যাত শিল্পপতি আম্বালাল সারাভাই ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, তিনি গান্ধীজির অনুরাগীও বটে। কিন্তু দিলীপকুমারের মতো আম্বালাল ও চরকা কাটার বিপক্ষে। সোজাসুজি তিনি বলেছেন, ‘সারাদিন মহাত্মাজি যে সুতোটুকু চরকায় কাটছেন তার হাজারগুণ সুতো আমার মিলে কীভাবে এক সেকেন্ডে কাটা হয় স্বচক্ষে দেখবে চলো। ... মহাত্মাজি যখন অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন তখনই আমার সবচেয়ে দুঃখ হয়। যে যেটা জানেনা সেটা নিয়েই মাথা ঘামাবে কেন বলো দেখি?’
অথচ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে কীভাবে বিরোধী সহকর্মীদের খদ্দরের দিকে টেনে আনলেন গান্ধীজি নিজের চোখে দেখেছেন দিলীপকুমার। মিটিংটি হচ্ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাসগৃহে ১৯২৪ সালে। কত অধিনায়ক যে ছিলেন সেখানে, দেশবন্ধু, কেলকার, তুলসীচরণ, শেরওয়ানি, জয়াকার, শরৎ বসু, রাজাগোপালাচারী, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ, কংগ্রেসের প্রোগ্রাম নিয়ে তুমুল তর্ক, প্রায় সবাই খদ্দরের বিপক্ষে এবং সজোরে নিজস্ব মত প্রকাশ করছেন। আশ্চর্য সংযম নিয়ে রইলেন গান্ধীজি এবং অসীম ধৈর্যে শেষ পর্যন্ত সবাইকে দলে টানতে পারলেন — সকলকেই গ্রহণ করতে হল খদ্দর। বস্তুত তাঁর ব্যক্তিত্বের স্মিত প্রশান্তি, দার্ঢ্য, মাধুর্য, সারল্য বারবার মুগ্ধ করেছে দিলীপকুমারকে, মতে না মিললেও শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন। গান্ধীজির মধ্যে তিনি লক্ষ করেছেন একটি সুদূর বৈরাগ্যের ভাব এবং পারলৌকিক প্রবণতা, Other Worldliness, গীতার বিখ্যাত শ্লোকের বাস্তব রূপ যেন, ‘যাকে না পারে কেউ উদ্বিগ্ন করতে, যে লোককেও দেয় না কোনও উদ্বেগ।’
কিন্তু সত্যিই কি তাই, ১৯২৬ সালেই দিলীপকুমার তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান মিলন সম্পর্কে কী মনে হয় আপনার?’ কী উত্তর দিয়েছেন গান্ধীজি?
‘আমি কী করতে পারি বলো — এক চেষ্টা করা ছাড়া?’… কঠিন দিলীপ! মুসলমানকে হিন্দু বিশ্বাস করে না, হিন্দুকে মুসলমান বিশ্বাস করে না। বাইরের অনুশাসনে কি হবে বলো, যদি ভিতরটা আগে না ঠিক হয়? আর আমার বিশ্বাস করার কথা বলছ, কিন্তু এটা জেনো যে নিজের শক্তির সম্বন্ধে আমার কোনও ভুল ধারণাই নেই’ — (I have no illusions about my own power.) এর মধ্যে কি নিবিড় এক নৈরাশ্যই পরিস্ফুট দেখিনা আমরা? দিলীপকুমারকে লেখা চিঠিপত্রে গান্ধীজির নিরভিমান স্নেহশীলতার কোনো অভাব ঘটেনি, যদিও তিনি জানতেন তাঁকে দিলীপকুমার দেশের সেরা রাষ্ট্রনীতিক বলে মনে করেননা।
‘এমনকী আক্ষেপই করতাম তাঁর জীবনের শেষ কয় বৎসর তাঁর নেতৃত্বে দেশের সমূহ ক্ষতি হয়েছে বলে। এ-ও তিনি জানতেন যে, তাঁকে আমি সদাশয়, সজ্জন মহৎ মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করতাম — বড় দেশনায়ক, ভাবুক বা দার্শনিক বলে নয়। … শেষ জীবনের রাষ্ট্রনৈতিক নায়কত্বের দরুন আমার মন ক্রমশ তাঁর প্রতি এতই বিরূপ হয়ে উঠেছিল যে, যদিও তিনি আমার মন টানতেন তবু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পর্যন্ত আমার ভয় করত। একথাও তিনি জানতেন। জানতেন তাঁর চরকা, সেকেলিয়ানা, অহিংসা, প্রার্থনাসভায় জোর করে উদার হবার চেষ্টা, হিন্দিভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করে দাঁড় করানোর অন্যায় আন্দোলন — এ সমস্তই আমাকে ব্যথিত করে তুলত, … একটি কারণে এসব কথা খোলাখুলি বলা বাঞ্ছনীয়। সেটা এই যে, তাঁর ব্যক্তিরূপের এই জাদুশক্তিতে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, মতের গভীরে অনৈক্য সত্ত্বেও তিনি মানুষকে কাছে টানতে পারতেন। নইলে আমার মতন অসহিষ্ণু মানুষের পক্ষে তাঁর দৃষ্টি ও মনোভঙ্গিম লোককে ভালবাসা তো দূরের কথা — শ্রদ্ধা করাও অসম্ভব হত।
মাঝে মাঝে দিলীপকুমারের মনে হত গান্ধীর একরোখা দীক্ষা দেশের সমূহ ক্ষতি করছে অথচ কেউ প্রকাশ্যে মৃদু প্রতিবাদ পর্যন্ত কেন করছে না। তাঁর কোন কোন নীতি দেশের ক্ষতি করছে তা দেখিয়ে দেবার ইচ্ছে হত কিন্তু রাজনীতি নিয়ে বেশি লেখালেখি করার ব্যাপারে তাঁর গুরু শ্রী অরবিন্দের বারণ ছিল। বন্ধু সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধীজির মতবিরোধ নিয়েও দিলীপকুমার হয়তো এই কারণে কোনো আলোচনা করেননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারত স্বাধীন হল — দেশভাগের পর। ১৫ ই অগাস্ট শ্রী অরবিন্দের জন্মদিন বলে তাঁর শিষ্যবর্গ বিশেষ আনন্দিত হয়েছিলেন এবং এর মধ্যে একটি দৈবী প্রভাব দেখেছিলেন। যদিও আমরা যতোদূর জানি লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৫ অগাস্ট দিনটি নির্বাচন করেন কারণ জাপানের মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী পূর্ণ হয়েছিল ঐ তারিখে। এর সঙ্গে বরং জড়িয়ে আছে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমাবর্ষণ ও তার প্রতিক্রিয়ার ভয়ংকর ইতিবৃত্ত। তবে দিলীপকুমার দেখেছেন বিশ্বাসী ভক্তের দৃষ্টিতে — তা নিয়ে তর্ক চলেনা। স্বাধীনতার পর গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি একটি বিশেষ কারণে। ‘বন্দেমাতরম’ এর একটি কোরাসের উপযোগী সুর দিয়েছিলেন তিনি, ইচ্ছা ছিল সেটি ভারতের জাতীয়সঙ্গীত রূপে গৃহীত হোক।
‘আকাশে বাতাসে তখন গুজব — জওহরলাল বন্দেমাতরমকে পাশ কাটিয়ে “জনগণমন অধিনায়ক” গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নিজে অঙ্গীকার করেছেন ও করাতে চেয়েছেন দেশবাসীকে। বন্দেমাতরমের এই অবমাননায় আমরা সবাই গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, গাঁধীজিকে আমার সুরটি শোনালে তিনি সানন্দে বন্দে মাতরমের তরফে রায় দেবেনই দেবেন — আর তা হলে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে সবচেয়ে সহজে।’
যদিও গান্ধীজি কী করবেন তা পড়ে ফেলা সহজ নয় তিনি জানতেন। মহাত্মাজি কখন যে কী করে বসেন কেউ তার হদিশ দিতে পারত না — তাঁর বন্ধুবর্গ, আত্মীয়স্বজন, প্রিয় শিষ্যরা — কেউই না। গান্ধীজিকে ‘বন্দেমাতরম’ ও ‘সারে জহাঁসে আচ্ছা’ দুটি গানই দিলীপকুমার শুনিয়েছিলেন। প্রার্থনাসভায় গান্ধীজি ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটির সুরের বিশেষ প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হয়নি বলাই বাহুল্য। দিলীপকুমার যে জওহরলাল নেহেরুকে তেমন পছন্দ করতেন না তা তিনি গোপন করেননি। তাঁর মনে হয়েছে য়ুরোপই জওহরলালের ধ্যান, বিজ্ঞানই তাঁর জ্ঞান। ভারতের আধ্যাত্মিক দীক্ষার ধারপাশও তিনি মাড়ান না।
‘শ্রী অরবিন্দ কী বস্তু যদি জওহরলাল একটু বুঝতেন। দুঃখ এই জন্যে যে, যে লোক ভারতকে আবিষ্কার করে তার খবর দিতে উদ্যত হয় বই লিখে সে যদি জানত যে, ভারতকে আবিষ্কার করা উদ্ভট হয়ে ওঠে নাস্তিক কি অজ্ঞেয়বাদী (agrostic) হয়ে!’
পাঠকের মনে হয় দিলীপকুমার কি ভারতের নাস্তিক্য দর্শনের ঐশ্বর্যময় ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছিলেন?
প্রার্থনাসভায় যে অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল, তা সুখপ্রদ নয়। সদ্য দেশভাগ, দাঙ্গার হানাহানি, উদ্বাস্তুদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা তখন তলানিতে। গান্ধীজির প্রার্থনাসভায় রামনাম, গীতা এবং কোরান পাঠ হল। কোরান পাঠের সময় শ্রোতাদের, বিশেষ করে শিখদের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য ও ক্ষোভ অপ্রকাশিত রইল না। পরের দিন প্রার্থনা শুরু হওয়ার আগে একজন বয়স্ক শিখ এসে দিলীপকুমারকে বলেই ফেললেন, ‘সাধুজি! আপনি ঠিক বিচার করুন — মিনতি করি। বলুন ন্যায্য কথা : যারা আমাদের হত্যা করেছে ঘর পুড়িয়েছে, এমনকী মেয়েদের ধ’রে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জত করেছে তাদের কোরানের কলমা আমাদের কানে শুনতে হবে — প্রাণে জপতে হবে! এ কি জুলুম নয়? এসব শোনা আমাদের পক্ষে হারাম — এখানে আমরা এসেছি মহাত্মাজির বাণী শুনতে, কোরানকে কুর্নিশ করতে নয়।’
দিলীপকুমার লক্ষ করেছেন কী প্রচণ্ড অভাব সভাতে শান্ত নিস্পৃহ মনোভাব ও পরমতসহিষ্ণুতার। যদিও ‘গান্ধীজির জয়’ ধ্বনিতে কোনো কমতি নেই। তাঁর মনে হয়েছে গান্ধীজি কি বুঝতে পারছেননা শ্রোতারা প্রার্থনাসভায় এসেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের টানে, সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়।
‘মহাত্মাজি হয়তো ভাবতেন হয়রানকে কোরান-কাহিনি শোনান দরকার যেন তেন প্রকারেণ। কিংবা হয়তো ভাবতেন ভগবানের নানা নামকে এক ভক্তির হাঁড়িতে সিদ্ধ করে পরিবেশন করলেই প্রতি নামার্থী বলবে — কী চমৎকার ভাতে-ভাত!’
পরিস্থিতি দিলীপকুমারের কাছে এতোটাই উত্তপ্ত ও আক্রমণাত্মক মনে হয়েছিল যে আগে যে সুফি গানটি সভায় গাইবেন মনে করেছিলেন সেটি গাওয়া আর উচিত মনে হল না। হয়তো অনেকের মনে এই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে গান্ধীজি মুসলমানদের গুণগান করার জন্যই গানটি বিশেষ করে গাওয়াচ্ছেন। বদলে আবুল হাফিজ জলন্ধরীর একটি নীতিবাদী গান তিনি গাইতে আরম্ভ করলেন। এই গভীর গানটি অবশ্য সব শ্রোতার মন ছুঁয়ে গেল। সেদিন প্রার্থনা সভা থেকে ফেরার পথে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর যে কথাবার্তা হয়েছিল তা একটু উদ্ধার করা যাক,
‘মহাত্মাজি এক গাল হেসে বললেন: ‘জানো — আমি সর্বান্তঃকরণেই চেয়েছিলাম যাতে তোমার লখনউ যাওয়া না হয়?’আমিও হাসলাম: ‘আর আমাদের দেশে কি তা ঘটতে পারে যা আপনি চাননা?
মহাত্মাজি মাটির দিকে চোখ রেখে বললেন: “ঠাট্টা করে তুমি যা বললে তা যদি সত্যি হত?”
কী গভীর বেদনা ছিল তার এই সংলাপটিতে। শুধু বেদনা নয় সুতীব্র ব্যর্থতার বোধ। একটি স্বীকারোক্তির পরম কারুণ্য দিলীপকুমারের মনকে আচ্ছন্ন করেছে। ‘এযুগে ভারতে হিংসার যে মহামারী এল মহাত্মাজির অহিংসার অনুপানে, সে রকম ব্যাপক মহামারী কখনও কোনও দেশে প্লাবনের জলের মতন লক্ষ লক্ষ নরনারীকে এমন চক্ষের নিমেষে বাস্তুহারা করেছে কিনা সন্দেহ। সাধে কি মহাত্মাজি দুঃখ পেয়েছেন? আর তাঁর নিজের ব্যর্থতা তাঁর নিজের অন্তরে কতখানি হতাশার অন্ধকার এনে দিয়েছে আমাদের বর্হিদৃষ্টি তার কতটুকু খবর রাখে?’ সব মতান্তর পার করে গান্ধীজির ব্যক্তিত্বের বিভা আবার দিলীপকুমারকে মুগ্ধ করেছে। ভিন্নরুচি, ভিন্নপন্থী, ভিন্নধর্মী জেনেও গভীর নির্মল স্নেহ থেকে তাঁকে কখনো তো বঞ্চিত করেননি তিনি।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বারভাঙা বিল্ডিং-এ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাদৃশ্য নিয়ে সন্ধ্যাবেলা বক্তৃতা দিচ্ছেন দিলীপকুমার। সভা কানায় কানায় ভরা। জার্মান সুরকার কুর্শমানের ঘুমপাড়ানি একটি জার্মান গান গাইছেন তিনি — নিদারুণ সংবাদটি এল অকস্মাৎ, গান্ধীজিকে একজন হিন্দু হত্যা করেছে গুলি করে। ঘটনাটি ঘটেছে দিল্লির সেই প্রার্থনাসভায় — যার অসহিষ্ণু ক্রুদ্ধ উত্তাপ প্রবল অস্বস্তিদায়ক হয়েছিল দিলীপকুমারের কাছে।
।।৪।।
এবার আমার পক্ষে যা দুরূহতম, বা দুঃসাধ্য — প্রবন্ধের সেই অংশে প্রবেশ করব। অর্থাৎ শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে দিলীপকুমারের কথোপকথনে। আধ্যাত্মিক জগৎ বিষয়ে নিতান্ত অনধিকারী এবং নিরক্ষর আমি, তাই শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখছি অজ্ঞানকৃত অপরাধের ভার বাড়াবার জন্য। সূচনাতেই একটি বাক্য মনে রেখে দিচ্ছি,শ্রী অরবিন্দ দিলীপকুমারকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘No one can write about my life because it has not been on the surface for man to see.’
এক বিদেশি বন্ধু রোনালড্ নিক্সন পরে সন্ন্যাসজীবনে শ্রীকৃষ্ণপ্রেম, দিলীপকুমারকে প্রথম শ্রী অরবিন্দের গীতার কথা বলেন। তারপর পত্রযোগাযোগের সূত্র ধরে অবশেষে দিলীপকুমার পন্ডিচেরি এসে শ্রী অরবিন্দের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। প্রথম সাক্ষাতের দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। মহাযোগীর সামনে প্রবল অভিভূত হলেও স্পষ্ট ও সরল প্রশ্ন করতে তাঁর কুন্ঠা হয়নি আমরা লক্ষ করি। তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল শ্রী অরবিন্দের যৌগিক সাধনের অনুযায়ী যোগ করতে গেলে সব ঐহিক কর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে গুহাপন্থী তাপস মতন হয়ে পড়তে হবে না তো? শ্রী অরবিন্দ প্রথম জানান, ‘যৌগিক সাধন’ বইটির প্রণেতা তিনি নন।
‘আমি কলম ধরে থাকতাম, বইটি লিখে যেত কোনও শক্তি সেই কলমের মুখে। আমি এ-সময়ে নির্ণয় করতে চাইছলাম — এ ধরনের ঘটনের মধ্যে কতখানি সত্য আছে আর মগ্নচৈতন্য থেকেই বা কতখানি ইঙ্গিত আসে।’
দিলীপকুমারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আসক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে এই নির্দেশ দেন।
‘কারণ এ-আসক্তিকে যদি তুমি পুষে রাখো তা হলে উপরের আলো অব্যাহতভাবে তোমার মধ্যে দিয়ে তোমার প্রকৃতির রূপান্তর সাধন করতে পারবে না। … অন্যের সঙ্গে ঐক্যবোধ বা অন্যের প্রতি স্নেহভালবাসার বিশ্বজনীন আনন্দ হল জীবন্মুক্তির ও সর্বাঙ্গীণ পরিণতির গোড়াকার কথা — আর এ-মুক্তি ও পরিণতি হল পূর্ণযোগের লক্ষ্য।’
দিলীপকুমার জানান যে তেরো বৎসর বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রভাবে পড়ার ফলে তাঁর দৃঢ় নৈশ্চিত্য জন্মায় যে ‘ঈশ্বর দর্শনই মানব্জীবনের উদ্দেশ্য।’ কিন্তু জীবন ও তাঁকে টানে — যেমন সামাজিক আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব স্নেহ সঙ্গীত এই সব। বিশেষ করে গান তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। সাধনার জন্য কি সঙ্গীতও ছাড়তে হবে? তাঁর মনে এই জিজ্ঞাসাও জেগেছে যোগ তাঁকে কী দেবে। এবং যতক্ষণ পার্থিব বাসনা থাকে ততক্ষণ পারমার্থিক আনন্দের স্বাদও পাওয়া যায়না কেন?
অসীম ধৈর্য্য ও প্রশান্তি নিয়ে শ্রী অরবিন্দ শরণাগতকে দিক নির্দেশ করেন।
‘একেবারেই পাওয়া যায় না একথা সত্য নয়। জীবনে খুব সুখের মুহূর্তেও অতৃপ্তির ফাঁক দিয়ে তো কত সময়েই উপরের আলোর ডাক আসে। তবে সে-ডাক মিলিয়ে যায় আধার তৈরি না হলে। তখন ফের আঁধার ছেয়ে আসে। তাই যোগ আমাদের ঠেলে দেয় উপর দিকে যেখানে আলো সহজে নেভে না।’তিনি আরো জানান বুদ্ধি বা শিক্ষা কিছুদূর অবধি আমাদের এগিয়ে দেয়। Reason was the helper; Reason is the bar. তাছাড়া আলাদা আলাদা আধার আলাদা আলাদা সাধনার অধিকারী, প্রতি আধার তার নিজের স্বভাবের পথেই সহজ পরিণতি খোঁজে। এরপর তিনি গভীর আলোকদৃষ্টিতে সামনে উপস্থিত দীক্ষা নেবার জন্য উন্মুখ তরুণটির অন্তস্থল পর্যন্ত দেখতে পান ও সুস্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দেন।‘আমি কেবল তাকে আমার যোগে দীক্ষা দিতে পারি যার কাছে এ যোগ ছাড়া অন্য কিছুই করণীয় মনে হয়না। তোমার মধ্যে এমন তৃষ্ণা তো এখনও জাগেনি। তুমি চাও জীবন-সমস্যার খানিকটা সমাধান। অর্থাৎ তোমার জিজ্ঞাসা - seeking হল আসলে মনের তৃষ্ণা — অন্তরাত্মার নয়।’দিলীপকুমার দুঃখ পেয়েছেন সন্দেহ নেই। অকপটে জানিয়েছেন কীভাবে দেশে ও বিদেশে মনস্বী, গুণী, জ্ঞানী ভাবুকদের কাছে প্রণিপাত, প্রশ্ন ও সেবা করে তত্ত্ব ও সত্যজিজ্ঞাসু হয়েছেন। সকলের কাছেই তিনি কৃতজ্ঞ। তবু জীবনের দুঃখ শোক অবিচার নিষ্ঠুরতা — হাজারও শোকাবহ দৃশ্যে প্রকৃতির অর্থহীন অপচয়ের দৃশ্যে, মানুষের ভাল না চেয়ে মন্দটাই চাওয়ার দৃশ্যে — বারবার তিনি বিচলিত হয়েছেন। মহৎ মানুষের কাছে গেলেই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে — ইনি কি সত্য পেয়েছেন? শান্তি?‘এ যুগে একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণের দেবের সম্বন্ধে অন্তর বলত হ্যাঁ, তিনি পেয়েছিলেন ‘যংলক্কা চাপরং লাভং মন্যতে নাবিকং ততঃ’ — মিলেছিল তাঁর সেই পরম ধন যা পেলে আর কিছু পাওয়ার থাকেনা। শ্রী অরবিন্দ গভীর সহানুভূতিপূর্ণ যে উত্তর দিয়েছিলেন তার কিঞ্চিৎ দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া জরুরি।‘আমার নিজেরও একসময়ে ইচ্ছা হত — যোগবলে জগৎটাকে মুহূর্তে দিই বদলে — মানবপ্রকৃতিটাকে ঢেলে সাজাই — জগতে মন্দ যা কিছু আছে, শোচনীয় যা কিছু আছে এই দণ্ডে লুপ্ত করে দিই আমার সাধন বলে। আমি প্রথমে এসেছিলাম এখানে, এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দেশ্য নিয়ে — যদিও আমার পণ্ডিচেরিতে আসার প্রধান কারণ — আমি এইখানেই যোগসাধনা করবার আদেশ পেয়েছিলাম। … লেলেকে আমি তাই বলি যে, যোগ সাধনা করতে আমি রাজি কিন্তু কর্মসাধনা ছেড়ে নয়। দেশ ও কাব্য দুইই আমি অত্যন্ত ভালবাসতাম। লেলে রাজি হল, দিল আমাকে দীক্ষা। কিছুদিন পরে আমাকে শুধু নিজের অন্তর-নির্দেশ মেনে চলতে বলে বিদায় নিল। আমি পণ্ডিচেরি এসে পূর্ণযোগ-সাধনায় বসলাম। কিন্তু সাধনা করতে করতে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই গেল বদলে। আমি দেখলাম যে আমি এখনি এখনি এসব করা সম্ভবপর ভাবতাম শুধু আমার অজ্ঞানের জন্যে। … কেননা আমি এই সত্যটা তখন জানতাম না যে জগতের মানুষকে উদ্ধার করতে হলে একজন মানুষের পক্ষে বিশ্ব সমস্যার চরম সমাধানে পৌঁছনোই যথেষ্ট নয় — তা সে মানুষ যতই কেন অসামান্য হোক না। শুধু নিজে অমৃতলোকে পৌঁছলেই হবেনা — বিশ্বমানবকেও হতে হবে অমৃতলাভের অধিকারী। কিন্তু তার জন্যে কালও অনুকূল হওয়া চাই। আসল সমস্যাটা হল ওইখানে। শুধু উপরের আলো নামতে রাজি হলে হবেনা — সে নামতেও পারে থেকে থেকে — কিন্তু তাকে সুপ্রতিষ্ঠ করা যাবেনা যদি নীচের আধার — গ্রহীতা আধার ধারণ করতে না পারে।’ঊর্ধ্বতর লোকের এমন কোনও আলো এ জগতে আনতে, এমন দিব্যশক্তিকে সক্রিয় করার কথা শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন যার নাম তিনি দিয়েছেন অতিমানস - Supermental শক্তি।দিলীপকুমার ও শ্রী অরিবন্দের মধ্যে এরপর যে কথোপকথন হয়েছে তার ভাষ্য প্রস্তুত করা আমার মতো সামান্য ব্যক্তির একান্ত অসাধ্য। তাই নির্বাচিত উদ্ধৃতির শরণাপন্ন হচ্ছি।
‘এ-শক্তির কাজ হবে কার উপরে?’সে সময়ে পন্ডিচেরি আশ্রমে পনেরো ষোলো জনের বেশি সাধক ছিলেন না। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে শ্রীঅরবিন্দের কথাবার্তা হত। দিলীপকুমার ছিলেন সাধারণ একটি হোটেলে। কিন্তু তিনি মহাযোগীর দেখা পেয়েছেন, নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরও পেয়েছেন। এমনকি ভেলকি বা মিরাকল প্রসঙ্গেও তিনি জিজ্ঞাসা করতে ছাড়েননি। শ্রী অরবিন্দ কিন্তু খুব সোজাসুজি উত্তর দিয়েছেন, কোনো ধোঁয়াশা না রেখে।‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনে — দৈহিক জগতে (Physical) বস্তুর (mattern)’ পরে।’
‘এ-চেষ্টা কি আগেকার যোগীরা করেননি?’
‘অতিমানস শক্তির সাহায্যে না। তাঁরা দেহ ও বস্তুকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাননি কেননা অধ্যাত্মশক্তি দিয়ে দেহের, বস্তুর রূপান্তর ঘটানো সবচেয়ে শক্ত। কিন্তু ঠিক সেইজন্যেই এ-কাজ করতে হবে।’ …
‘এ-শক্তিকে তাহলে আগে আপনাকে তো নিজে উপলব্ধি করতে হবে?’
‘তা তো বটেই। যুগে যুগে সব দেশেই নূতন ভাব বলো আলো বলো আইডিয়া বলো নামে একজনেরই মধ্যে। তার থেকে দুজন — চারজন — দশজন — এমনি করে ছড়িয়ে পড়ে। গীতাও তাই বলেছে ‘যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠ স্তত্তদেবেত্তরো জন:’ — শ্রেষ্ঠরা যা করবেন কনিষ্ঠেরা তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কিন্তু আমার যোগে ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে হল আমার কাজের আরম্ভ। অন্য অনেক যোগে উপলব্ধি realisation- হল চরম লক্ষ্য। আমার যোগে প্রকাশ — manifestation-ই হল মুখ্য উদ্দেশ্য। তার জন্যে বলেছি, আগে এই অতিমানস শক্তির নাগাল পাওয়া আমার চাই-ই। মানে, সেখানে আমায় উঠতে হবে — কেবল সে-ওঠার লক্ষ্য হচ্ছে এ শক্তিকে নামিয়ে আনা। আরোহন চাই অবতরণের জন্য।’
‘মেকি ঝুটো কোথায় নেই এ জগতে? কিন্তু ভেলকি আছে বলেই কি প্রমাণ হয় যে সাচ্চা বলেও কিছু নেই? জনশ্রুতি আছে বলে সত্যশ্রুতিও সব নামঞ্জুর? এভাবে দেখতে গেলে কোনও সত্যনির্ণয় হয় না। যোগজ্ঞরা সবাই জানেন এসব শক্তি কত প্রত্যক্ষ কত সত্য। এদের সাক্ষ্যও এতই জোরালো যে এদের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামানোর কথাও ভাবতে পারেন না।’পন্ডিচেরি থেকে ফিরে আসার পর দিলীপকুমার আবার ভেসে বেড়ালেন কর্ম থেকে কর্মান্তরে। এই সময় নিউইয়র্কের এডিসনের গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে এল জরুরি নিমন্ত্রণ। ফের সমুদ্রপারের বৃহৎ আহ্বানে সাড়া দিলেন। দেশবাসী গর্বিত, আনন্দিত। স্নেহাসক্ত রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র ও প্রীতিমুগ্ধ বন্ধু সুভাষচন্দ্র মিলে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটে এক বিরাট সভার আয়োজন করে অভিনন্দন জানালেন। ‘বন্ধুরা দিলেন সোনার কলম, রুপোর কাস্কেট। বান্ধবীরা লিখলেন কবিতা — পুস্তিকা করে রাতারাতি ছাপানো পর্যন্ত হয়ে গেল।’ আমেরিকার পথে রওনা দিয়ে ফ্রান্সের নীসে পৌঁছলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হল পল রিশারের। পল রিশার ও মীরা রিশার (পরবর্তীকালে পন্ডিচেরির শ্রীমা) শ্রী অরবিন্দের বিখ্যাত সহযোগী। দিলীপকুমার লিখেছেন পল রিশার এসেছিলেন তাঁর জীবনের সন্ধিলগ্নে তাঁর সুপ্ত বৈরাগ্যকে জাগাতে। ‘তাই আমি আমেরিকা না গিয়ে ফিরে এলাম ১৯২৭ সালের শেষে — ও শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে গুরুদেবের চরণচ্ছায়ায় আশ্রয় নিলাম ২২ নভেম্বর ১৯২৮ সালে।আবার এ-ও শুনতে পাই যে এসব শক্তিকে প্রয়োগ করলে আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষতি হয়?’
‘ক্ষতি হবেই এমন কোনও কথা নেই। করছে কে — আর কোন প্রেরণায় তারই উপর সব নির্ভর করে। ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে আত্মাভিমান থেকে, নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বা কোনও দেখানেপনার জন্যে যদি কেউ যোগবিভূতিকে জাহির করে তবে তাতে সমূহ ক্ষতি। কিন্তু যেসব যোগীরা নির্বাসনা, নিরভিমান, গীতার ভাষায় ‘সর্বভূতহিতেরতা’ তারা এসব শক্তির প্রয়োগ করে — উপরের আদেশে, নীচের আহ্বানে না। তাই ব্রহ্মজ্ঞ গুরুরা শিষ্যদের দীক্ষা দেবার সময়ে বলেন সব আগে চাই অহংকারমুক্তি বাসনামুক্তি — নইলে এসব বিভূতি বিপদই টেনে আনে — হাজারও গুহ্যশক্তির অপপ্রয়োগে। কিন্তু কোনও শক্তির ব্যভিচার আছে বলে যে সে শক্তিটাই বর্জনীয় এমন তো হতে পারে না। তা যদি হত সে শক্তিটাই বর্জনীয় এমন তো হতে পারেনা। তা যদি হত তাহলে তো বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই হত বর্জনীয়। বৈজ্ঞানিক শক্তি দিয়ে ভ্রষ্ট বৈজ্ঞানিকেরা বহু অন্যায় কাজ করছেন — সেজন্য শক্তিকে দায়িক করা ভুল। যোগবিভূতির বেলায়ও ওই কথা।’
আবার শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে আলাপ হয়েছে ১৯৪৩ সালে, সেই ঘরে যেখান থেকে ১৯২৬ সাল থেকে তিনি একবারও আর বেরোননি। প্রথম প্রশ্নটি ছিল সাধনার পথ বিষয়ে। শ্রী অরবিন্দ জানান, ‘মোটামুটি দুটি পথ আছে সাধনার। এক, বুদ্ধের যিনি বলতেন… যে, যদিও গুরু বা অন্য কারুর কাছ থেকে তুমি কমবেশি সাহায্য বা নির্দেশ পেতে পারো বটে, কিন্তু খতিয়ে তোমাকে চলতে হবে একলাই — নিজেরই শক্তিতে বনের মধ্যে থেকে পথ কেটে বেরুতে হবে। এক কথায় সনাতন তপস্যার পথ। অন্যটি হল গুরুবাদ — কি না গুরুকে ভগবানের প্রতিনিধি বলে বরণ করা — মেনে নেওয়া যে, তিনি নিজে পথান্তে পৌঁছেছেন বলে অপরকে পথের খবর দিয়ে তাদের সন্ধানের সহায় হতে পারেন। আমাদের আশ্রমে যারা আছে তাদের এই পথ।’
এরপর আলোচনা হয়েছে নেপথ্যশক্তিদের রীতিনীতি নিয়ে। দিলীপকুমারের মনে অকাল্টিজম¬¬ বা অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে সন্দেহ ছিল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রসঙ্গে যেসব কথা কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী তাঁর ‘সদ্গুরুসঙ্গ’ বইতে লিখেছেন সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। ভৌতিক আবির্ভাব বা শূন্যে চলা ইত্যাদি। শ্রী অরবিন্দ দিলীপকুমারের সন্দেহ ভঞ্জন করেছেন স্পষ্ট উত্তরে।
‘… জড়পদার্থকে যে শূন্যে উঠতে ও চলতে দেখা গেছে এটা যখন অকাট্য এবং যখন যোগীরাও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এ সত্য, তখন একে হুশ করে ডিসমিস করবে কেমন করে? হাজার হাজার অভিজ্ঞতা উপলব্ধি আমাদের হয় যাদের কোনও দিশাই পায়না আমাদের মন। খতিয়ে এতো মানতেই হবে যে, কোনও কিছু সত্য কিনা তার চরম কষ্টি-পাথর হল অভিজ্ঞতা (experience) আর অভিজ্ঞতা বলে যে শূন্যে-ওঠা বা চলা (levitation) বা কোথাও - কিছু-নেই-মূর্তি গড়ে ওঠা (materilaisation) এ ঘটে—’দিলীপকুমার জিজ্ঞাসা করেছেন ‘কিন্তু আপনি নিভৃতবাস থেকে বেরুবেন কবে?’… একথা কী করে মেনে নিই বলুন তো যে আপনার মতন দীপ্যমান মানুষ আর বেরুবেন না এই ছোট ঘরটি থেকে — চিরদিন থাকবেন এখানে বন্দি হয়ে?’ শ্রী অরবিন্দ অকপটে জানিয়েছেন কবে বেরুবেন তিনি জানেন না। … আমি মানস স্তরে তো আসীন নই আর। মন থেকে আমি কোনও কিছু করার সঙ্কল্প করিনা। … কী করব তা আমার আগে থেকে ঠিক করা থাকে না। তাই শুধু এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হব যে যা যা আমাকে করতে হবে — না করলেই নয় — সেসব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় যদি বেরিয়ে আসি, লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করি — ইত্যাদি।’ …এরপর পন্ডিচেরির অতিথিশালার রান্নাঘরে অদৃশ্য থেকে ঢিল পড়ার অপ্রাকৃত ঘটনার প্রসঙ্গ তোলেন শ্রী অরবিন্দ। শ্রীমা উত্তর আফ্রিকায় নেপথ্যশক্তি সম্বন্ধে চর্চা করেছিলেন বলে তিনি ধরতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা। দিলীপকুমার আশ্রমের অন্য অধিবাসীদের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। বাত্তল নামে এক চাকর ছিল শ্রী অরবিন্দের। তাকে ডিসমিস করাতে সে ক্রদ্ধ হয়ে বলেছিল সবাইকে সে বাড়িছাড়া করবে। সে যায় এক মুসলমান ফকিরের কাছে যে তান্ত্রিক অভিচার জানত। তারই তান্ত্রিক তুকতাকের দরুণ ঘটে ওই উৎপাত। মারণশক্তি যদি এমন লোকদের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয় যারা তাকে প্রত্যাখ্যান করবার শক্তি ধরে তখন সে ফিরে এসে মারককেই করে আক্রমণ। শ্রীমার দ্বারা প্রতিহত হবার পরেই বাত্তলের এমন অসুখ করে যে ডাক্তারেরা জবাব দেয়। পরে শ্রী অরবিন্দের করুণায় বাত্তল বেঁচে ওঠে।
দিলীপকুমার সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস থেকে তবু মুক্ত হতে পারেননি। শ্রী অরবিন্দ বারবার জ্ঞানাঞ্জনশলাকা ছুঁইয়েছেন। ‘শ্রীমা ও আমি তোমার পরে — শুধু তোমার পরেই নয়, আরও অনেকের পরেই করে আসছি আমাদের যোগশক্তির প্রয়োগ, বটে তো? আর তার ফলে অনেক কিছুই তো ইতিমধ্যে ঘটেছে, কেমন? তুমি এই যোগশক্তির ক্রিয়াকে চাক্ষুষ করোনি — কিন্তু তুমি বহুবার নিজের কাছেই স্বীকার করেছ যে — অনেক সময়েই তোমার মধ্যে বা আশেপাশে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যাকে ইন্দ্রজালের খেলা (miracle) বলেই তোমার মনে হয়েছে। … আধ্যাত্মিক শক্তির প্রত্যক্ষতা বাস্তবতা তার নিজস্ব। সে একটা মূর্তি নিতে পারে — যেমন একটা স্রোতের মতন — যার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যায় — যাকে খুব প্রত্যক্ষভাবেই পাঠানো যায় যে কোনও স্থানে — প্রয়োগ করা যায় যে- কারুর উপরে। অধ্যাত্মচেতনার মধ্যে শক্তি আছে ওতপ্রোত হয়ে এ হল একটি সত্যোক্তি সে-শক্তির প্রকৃতি সম্বন্ধে। কিন্তু এছাড়া এমনও হতে পারে যে – কোনও - আধ্যাত্মিক মানসিক বা প্রাণিক — শক্তির প্রয়োগ করা হল জগতের কোনও একটা বিশেষ স্থানে বিশেষ কোনও ফল ফলাতে। যেমন অনেক অদৃশ্য প্রাকৃতিক শক্তি আছে (কসমিক ঢেউ-জাতীয়) কি ধরো বিদ্যুতের প্রবাহ: তেমনি আছে মনের প্রবাহ, চিন্তার প্রবাহ, আবেগের প্রবাহ — যথা রাগ দুঃখ ইত্যাদি। এরা উধাও হয়ে গিয়ে উদ্দিষ্টদেরকে প্রভাবিত করতে পারে তাদের অজান্তে — কেউ কেউ হয়তো টের পায় — এ শক্তি আসছে, কিন্তু তারা জানে না কোত্থেকে এল — কেবল অনুভব করে সে শক্তির ফল।’
এ-মূল সাধনা বলতে কী বুঝব? আপনার তপস্যায় অতিমানস শক্তির অবতরণ?’
গুরুদেব অত্যন্ত শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে উত্তর দিলেন:
‘হ্যাঁ। আমার আসা সেই জন্যেই।’
শিষ্যের কাছে আপন স্বরূপ সম্পর্কে অনেকখানিই বলেছিলেন গুরু। দিলীপকুমারের মনে অনুতাপ দেখা দিয়েছে সঙ্গত ভাবেই। ‘এ হেন যুগপ্রবর্তকের কথায় আমি সংশয় প্রকাশ করেছি, তাঁর বাণী সম্ভব কিনা প্রশ্ন করেছি, তাঁর সঙ্গে গল্পালাপ তর্কাতর্কি করেছি এই অধিকারে যে আমাকে তিনি সম্বোধন করেছিলেন তাঁর চিঠিতে “a friend and a son” বলে।’ গীতায় অর্জুনের চিরসখা কৃষ্ণ সম্পর্কে অনুশোচনা মনে পড়েছে তাঁর।
‘সখা ভ্রমে সখা কৃষ্ণ বলি ডাকি’পরিশেষে একটি কথা নিবেদন করছি। যে তিনজনের সঙ্গে দিলীপকুমারের কথোপকথন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করা গেল, তাঁদের মধ্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই তাঁর বাংলায় কথাবার্তা হয়েছিল, গান্ধীজি ও শ্রী অরবিন্দ সম্পূর্ণ ইংরিজিতেই আলাপ করেছেন। দিলীপকুমার ‘তীর্থংকর’ গ্রন্থে নিজে যে অনুবাদ করে দিয়েছেন আমি সেটিই অনুসরণ করেছে। পাশে ‘Among The Great’ রেখে বাড়তি তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখেছি।
আহারে বিহারে এক শয়নে,
একাসনে হাসি-প্রগল্ভতা যত
করেছি প্রণয়ে তোমার সনে,
একান্তে কি সভামাঝে ভুলে তব
মানের হানি যে করেছি হায়,
না জানি’ তোমার মহিমা অপার—
ক্ষমিও সে-অপরাধ কৃপায়।’
গ্রন্থপঞ্জি:
(১) রচনাসংগ্রহ সপ্তম খণ্ড, দিলীপকুমার রায়, আনন্দ পাবলিশার্স।
(২) Among The Great. Dilip Kumar Roy, Hari Krishna Mandir Pune