এ গল্প জীবনের জলছবি নয়। সূর্যের উল্টো দিকে থাকা জীবনের অন্ধকার দিকটাই এর মূল বিষয়বস্তু। যার নাম "পাখিঘর"। একটা বিরাট খাঁচা। তাতে হরেকরকমের পাখি। লাভলি, নাজমা, পিঙ্কি, হেনা, সোফিয়া, গোলাপ, কল্পনা আরো কত। না,এগুলো কোন পাখির নাম নয়। স্বামী,পরিবার পরিজন,সমাজ পরিত্যক্তা কতকগুলো মেয়ে। এদের মধ্যে কেউ নেপালী, কেউ বাংলাদেশি আবার কেউ নাম, গোত্রহীন, ঠিকানাহীন। জীবনটাকে বুঝে ওঠার আগেই মাংসপিন্ড হয়ে বিক্রি হয়ে যেতে হয়েছিল কোন দালালের কাছে। গন্তব্য অন্ধকার জগৎ। রোজ নতুন বিছানা, নতুন পুরুষ। তারপর প্রশাসনিক তৎপরতায় একদিন উদ্ধার হল কিন্তু আলো পেলনা। একটা খাঁচা থেকে বেরিয়ে বন্দী হল আর একটা খাঁচায়। যে খাঁচার নাম 'আশ্রয়'। চেনা পৃথিবীটার মধ্যে গড়ে ওঠা এ এক অন্য পৃথিবী। আর এই অচেনা পৃথিবীই লেখিকা মৃত্তিকা মাইতির প্রথম উপন্যাস 'পাখিঘর' এর পটভূমি। সম্ভবত এর আগে বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ হোমের জীবন নিয়ে কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি। হলেও এতটাই যৎসামান্য যে পাঠকের কাছে তা অধরাই রয়ে গেছে।
'আশ্রয়'একটা হোম। আস্তাকুঁড়ে ফেলে যাওয়া অথবা পুলিসি রেইডে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের আশ্রয়স্থল। শৃঙ্খলাবদ্ধ দমবন্ধ করা পরিবেশ। যত্নহীন জীবন আর হোম মাদারদের অনাবশ্যক শাসনে জর্জরিত মেয়েদের কাছে একদিন একরাশ ঠান্ডা বাতাস বয়ে নিয়ে আসে পরমা। এই হোমের নতুন হোম মাদার। সবার নতুন আন্টি। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মাতৃহারা পরমাকে রোজগারের সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় শহরে। সেখানে অনিন্দ্য এবং সুতপার বাড়িতে থেকে কাজ করার সময় সে কিছুটা লেখাপড়াও শেখে। তারপর পড়ে ফেলে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর , আশাপূর্না, মহাশ্বেতা। তাই বোধহয় অন্য হোম মাদারদের মানসিকতার সঙ্গে পরমার বিস্তর ফারাক।" 'প্রীতি, উর্মিলা আর সঞ্চিতা নিজেদের চারপাশে একটা দেওয়াল তুলে রেখেছে। মেয়েরা এই দেওয়াল টপকে তাদের কাছে পৌঁছতেই পারেনা।" আবার প্রীতি পরমাকে বলেছে "মেয়েদের সামনে একটা ইমেজ ধরে রাখতে হয়। বুঝিয়ে দিতে হয় তোমরা আমাদের মতো নও। আমরা আলাদা।" (পৃ ১৫) কিন্তু এ বিশ্বাস পরমার নয়। তার ফেলে আসা অতীতটাও বড় যন্ত্রনার। তবুও সে জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারায়নি। তার ভালবাসার আলোতে সে পাথর জমে থাকা হৃদয়গুলোকে খুঁড়ে ফেলতে চায়। রাঙিয়ে দিতে চায় ফিকে হয়ে যাওয়া শৈশবগুলোকে।
তার নিজের শৈশবটাও আজ ঝাপসা হয়ে গেছে। তাই মেয়েরা যখন তেঁতুল গাছ থেকে তেঁতুল পেড়ে দেবার আবদার করে হোমের ড্রাইভার শঙ্করের কাছে তখন পরমার মনে পড়ে যায় নিজের গ্রামের কথা। কিন্তু পরক্ষণেই পরমা বুঝতে পারে এ তার গ্রাম নয়। এখানে মেয়ে মানে শুধুই শরীর। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার শম্ভুনাথ ঘোষের একটা কথাতেই সেটা স্পষ্ট। শঙ্কর হোমের মেয়েদের আবদারে কচি তেঁতুল পেড়ে দিচ্ছে গাছ থেকে। তা দেখে শম্ভুনাথ ঘোষের সরস মন্তব্য, ''বউ এর শরীর তো ঢিলে হয়ে গেছে। দু-দুটো মেয়ে হয়ে গেছে, আর কিছু থাকে! এখানে কয়েকটা মেয়ে আছে বেশ ডাঁটো। টাইট ফিগার।"(পৃ-৩৪) একটা মন্তব্যেই মানুষটার ভেতর আর বাইরেটা পরিস্কার পড়ে ফেলা যায়। গা গুলিয়ে ওঠে পরমার। এও এক দুর্গন্ধময় পরিবেশ। এখানে রোজ নিরাপত্তার উৎসব হয়। কত মেয়ে উদ্ধার হয়ে এখানে এসে ঢোকে, আবার কেউ কেউ এখান থেকে বেরিয়ে পৌঁছে যায় তার পুরনো ঠিকানায়। পাখি আসে ,পাখি উড়ে যায়। কিন্তু বদলায় না হোমের পরিবেশ। বদলাতে চাইলে হোমে টেকা যায়না। সে কথা এখানকার সমস্ত কর্মচারীরাই জানে। কখনো কখনো পরমার কথায় তারা আড়ালে সায়ও দিয়েছে। হোমের একজন হোম মাদার সঞ্চিতা বলে , "আমাদের কপাল সেরকম নয়। মেয়েরা ঠিকঠাক খেতে পায়না, জামাকাপড় পায়না, হোম মাদারদের যা মাইনে পাওয়ার কথা তা তারা পায়না কিন্তু নবনীতা দত্তর কুকুরগুলোও এসি গাড়ি করে ঘোরে।"(পৃ-৬১) নবনীতা দত্ত এই হোমের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। আসলে মালকিন। তার নির্দেশে এখানে এমন অনেক কাজ হয় যে কাজের কোন কারণ খুঁজে পায়না পরমা। কেন ফরেনাররা এলে তাদের সামনে মেয়েদের নাচানো হয়, কেন হোমের আর এক আবাসিক রীমা অন্য মেয়েদের তুলনায় বেশী সুযোগ সুবিধা পায় আর কেনই বা তাকে নতুন পোষাক পরিয়ে দামি গাড়িতে করে মাঝে মধ্যে হোমের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়? পরমার কৌতূহলী মন বুঝতে পারে অনেক প্রশ্ন, অনেক ঘটনা অশরীরী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হোমের আনাচে কানাচে। যার হয়তো কোনো সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যাবেনা কোনোদিন। এ ব্যাপারে এখানে কেউ মুখ খোলেনা।
ছকভাঙা মানসিকতা নিয়ে কেউ বিধি নিষেধের বেড়াজালে বেশিদিন আবদ্ধ থাকতে পারে না। পরমাও পারলো না। সরকারী পরিদর্শকের সামনে মুখ খোলার জন্য তার চাকরী গেল। বসল বিচার সভা। "খোলা জানলা দিয়ে একটা ফড়িং ঢুকল। উড়ছে ঘুরে ঘুরে। বড় টেবিলের এক কোনায় বসল। আবার উড়ে গেল আলমারির মাথায়। সেখান থেকে দেওয়ালে। সেখানে হোমরাচোমরা একটা টিকটিকি। এগোচ্ছে। ফড়িংটা শান্তভাবে বসে। থিরথির করে কাঁপছে স্বচ্ছ ডানাদুটো। অন্য দিক থেকে আরেকটা টিকটিকি আসতেই আগেরটা ঘুরে গেল অন্যমুখে। একটা টিকটিকি এগিয়ে গেলেই অন্যটা তাকে ধাওয়া করছে। কে খাবে ফড়িংটাকে। হল না। তাদের লড়াইয়ের মাঝখান থেকে ফড়িংটা উড়ে বেরিয়ে গেল সেই জানলা দিয়ে।"(পৃ-২৩৫) অবর্ণনীয় একটা বিচার সভার দৃশ্যপট আঁকা হয়েছে এভাবেই। অভিযুক্ত পরমা যখন অভিযোগের ঘেরাটোপে বন্দী তখন তার মনটাও কি এভাবেই উড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জানলা দিয়ে! সে উত্তর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে 'পাখিঘর' উপন্যাসের কোন একটা পাতায়। কিন্তু প্রতিটা পাতায় যে শব্দ এবং ভাষার আলপনা আঁকা হয়েছে তা অনবদ্য।
আশ্রয় হোম এবং তার চারপাশের বর্ননা দিয়েই এ গল্পের শুরু। শুরুতেই লেখিকা পাঠকের মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন কাহিনীর মূল পটভূমিতে। এই হোম এবং তার আশেপাশের পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখিকা যেভাবে প্রতিটা কোনে আলোকপাত করেছেন তাতে চোখের সামনে স্পষ্ট একটা ছবি ফুটে উঠেছে। মূল কাহিনীর পাশাপাশি প্রত্যেকটা চরিত্র তাদের নিজের নিজের গল্প নিয়ে ডালপালা বিস্তার করেছে। সেখানে তারা স্বমহিমায় স্বতন্ত্র। এদের মধ্যে অন্যতম হোম মাদার পরমা, প্রীতি, সঞ্চিতা,উর্মিলা এবং আবাসিক রীমা, নীতু, কল্পনা, জুলেখা। গল্পের শুরু থেকে লেখিকা যে সূত্রগুলো ছাড়তে ছাড়তে এগিয়েছেন ,পরবর্তীতে সেগুলো জুড়েছেন নিখুঁত ভাবে। কিছু কিছু জায়গায় চরিত্রানুযায়ী ভাষার ব্যবহার প্রশংসাযোগ্য। যে ভাষা চরিত্রগুলোকে একে অপরের থেকে আলাদা করেছে। বিহারি মেয়ে নীতু, সে কথা বলে আধা বাংলা আধা হিন্দিতে। "তুমি মুঝে মাকে পাস পাঠিয়ে দাও আন্টি।" সোনাগাছি থেকে আসা তানজিলা আর সাহানা, যাদের মুখের কথায় শুধু ভাষা নয়, তাদের সামাজিক অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে যায়। "ওরে আন্টি ,ছেড়ে দে আমাদের। বন্ধ থাকতে পারছিনা এখানে। পুলিশ ঢ্যামনাগুলো যেখান থেকে ধরে এনেছে সেখানেই দিয়ে আয় রে।" এরকমই আর একটি ভাষা - পরিচয় যুক্ত চরিত্র নেপালী মেয়ে কল্পনা। সে বাংলা বা হিন্দি ভালো করে বলতে পারে না। শুধু থারু আর গোর্খালি। সেই ভাষাতেই সে গান গায়,"রেশম ফিরিরি...... রেশম ফিরিরি..... উড়ি না যাউ কি ডাঁড়ামা বাঞ্জাং রেশম ফিরিরি.... ("মন আমার রেশমি রুমাল...... উড়ব শুধু উড়ব.... না কি চলে যাব উঁচা পাহাড়ের উপরে"।) এই আলাদা আলাদা চরিত্রগুলো হয়তো দেখা বা না দেখা। দেখা অদেখার মাঝের ফাঁকটুকু রচনাকার ভরাট করেছেন নিপুন সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে।
লেখিকা মৃত্তিকা মাইতির জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির এক অখ্যাত গ্রাম কাদিরপুরে। অস্বচ্ছল পরিবারে বড় হয়ে ওঠার কারণে প্রথাগত শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু জীবনের তাগিদে তাকে যা যা করতে হয়েছে তাতে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী শিক্ষিত হয়েছেন। পরবর্তী কালে সেই শিক্ষা প্রকাশ পেয়েছে তার লেখালেখির মধ্যে দিয়ে। বেশ কিছু নামী, দামী পত্রিকাতে তার লেখা গল্প এবং গদ্য প্রকাশিত হলেও উপন্যাস হিসেবে এটাই প্রথম। কিন্তু নবীনত্বের ছোঁওয়া কোথাও নেই। বরং কাহিনী বিন্যাস, চরিত্রাঙ্কন এবং শব্দ চয়নে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
শুধুমাত্র হোম জীবনের অন্ধকার দিকটা তুলে ধরাই লেখিকার মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। তাই গল্পের শেষে এক চিলতে আলোর রেখাও দেখিয়েছেন। যেখানে বুকের মধ্যে অভিমান আর মাথার মধ্যে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে হোম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও শেষবারের মতো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পরমা ভাবছে, "তার সব আশ্রয় বরাবরই নড়বড়ে। কিন্তু মেয়েদের এই আশ্রয়টা যেন নড়ে না যায়। তাহলে তারা থাকবে কোথায়? এখান থেকেই তো নিজের জায়গা খুঁজে পাবে অনেকে।" (পৃ-২৪৩) ঠিক। আবার কেউ কেউ ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে হয়তো কোনো একদিন পৌঁছে যাবে জীবনের শেষ ঠিকানায়। মাঝখানের এই বেঁচে থাকাটুকু নিশ্চিত করতে, মাথার ওপর ছাদ আর দু’বেলা দু'মুঠো গরম ভাত নিশ্চিত করতে এই হোমগুলোকে আজ প্রয়োজন। বড্ড বেশি করে প্রয়োজন। অনেক ভালোর মধ্যে কিছু মন্দকে বাদ দিতে পারলে ক্ষতি কী?
"অন্ধকারের উৎস হতে / উৎসারিত আলো /সেই তো তোমার আলো!/ সকল দ্বন্দ্ববিরোধ- মাঝে /জাগ্রত যে ভালো / সেই তো তোমার ভালো।।"