• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • আশ্বিনের সত্যজিৎ : জয়দীপ মুখোপাধ্যায়



    প্যালেট থেকে ধূসরবর্ণা রং নিংড়ে তুলির নরম আঁচড়ে টান টান করা ফ্রেমবন্দী ক্যানভাসে তাঁর সেরা স্ট্রোক দিলেন শিল্পী ওয়াসিম কাপুর। বিষয়ের প্রতিপাদ্য ছিল সত্যজিৎ রায়ের কল্পিত সিনেমায়িত ইমেজকে চিত্ররূপ দেওয়া। শিল্পীদের মন আঙিনায় ভেসে বেড়ানো ইমেজগুলো দিয়েই তো চিত্র ক্যানভাস তৈরি হয়, এখানেও তাই-ই হলো। সত্যজিৎ রায়ের প্রতীকী আশ্বিন চিত্রায়িত হলো শিল্পীর ভাবনার ক্যানভাসে। ১৯৫৫ সাল পরবর্তী বাঙালির আশ্বিন-ভাবনায় ধরা দেওয়া প্রথম ইমেজ, চারিদিকে আশ্বিনের ধবধবে কাশ, তিনটি চরিত্রের অবিস্মরণীয় উপস্থিতিতে - অপু, দুর্গা আর দূর সীমানার ওপারেতে ধোঁয়া উড়িয়ে কোন অলীক স্বপ্নপুরীতে চলে যাওয়া রেলগাড়ি। যে রেলগাড়ি হয়তো কোনও আশার অস্তিত্বের সন্ধানে নিয়ে যাচ্ছে নতুন কোনও জীবনের খোঁজ দিতে। সিনেমায় ব্যবহৃত সত্যজিৎ-ভাবিত এটা এমন একটি ফ্রেম, যা সত্যজিতের সিনেমা ভাবনার সাথে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই রয়ে গেল। এটাই আশ্বিন। সত্যজিতের আশ্বিন।

    “তখন দেবতারা বললেন – সর্বনাশ, এই অসুরের সঙ্গে তো পারা যাচ্ছে না! ব্রহ্মা একে এমন বর দিয়েছেন যে কোনো পুরুষ দেবতা একে বধ করতে পারবে না। তখন বিষ্ণু বললেন যে – এসো, আমাদের শরীরে যে তেজ একসঙ্গে মিশিয়ে আমরা এমন এক দেবী সৃষ্টি করি, যার হাতে মহিষাসুরকে মারতেই হবে। সেই চার জনের তেজ – ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আর ইন্দ্র – আর সেই সঙ্গে আরো সব দেবতাদের তেজ একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি হলেন দেবী দুর্গা। এই দুর্গার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র” – এভাবেই দেবী দুর্গার প্রকাশকে তাঁর নিজস্ব সাবলীল ও ঝরঝরে ভাষায় সত্যজিৎ রায় ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর “জয়বাবা ফেলুনাথ” ছবিটিতে।

    “জয়বাবা ফেলুনাথ” মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। অর্থাৎ ছবিটির শুটিং হয়েছিল তার আগের বছর। হয়তো আশ্বিনে নয়। হয়তো তার কিছু আগে বা পরে। কিন্তু ছবিটিতে আশ্বিনের আবহাওয়াকে ডিটেলিং-এ ধরেছিলেন সত্যজিতবাবু। মেঘহীন আকাশ, আসছে শীতের হাল্কা পোশাক আর ছবিটি জুড়ে ছিলো দেবীমূর্তির কাঠামো থেকে চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার বিভিন্ন ক্রম। একটানাভাবে, তথ্যচিত্র আঙ্গিকে এই ক্রমটি বর্ণিত হয়নি। গল্পটির মূলধারা--ডিটেকটিভ ফেলুদার রহস্য উন্মোচনকে ঘিরে। সেই রহস্যকে আরো ঘনীভূত করেছিল গল্পের বারাণসীতে কল্পিত ঘোষালবাড়ির বংশানুক্রমিক দুর্গাপুজো। ‘নায়ক’ ছবিতে নায়ক অরিন্দম (অভিনয়ে উত্তমকুমার) সংলাপে বলেছিলেন তাঁদের কিশোরবেলার পাড়ার পুজো হতো দেবীর চালচিত্র শিল্পসুষমায়। ওটাই প্রথম পছন্দ ছিল অরিন্দমের। অর্থাৎ যখন কিছু চরিত্রের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আদানপ্রদান পরিচালকের অল্টার ইগোকে specify করে, তখন সংলাপের মধ্যে দিয়ে অথবা বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে চিত্রনাট্যের মাধ্যমে ব্যক্ত করে দিয়ে যান পরিচালকেরা। সুতরাং ‘নায়ক’ ছবির সূত্র ধরে এটা মনে করা যেতেই পারে, সত্যজিতের দুর্গাপ্রতিমার রূপরেখাও চালচিত্রে ঘেরা সাবেক দুর্গা। এই সাবেকিয়ানার প্রতি আসক্তি হয়তো সত্যজিৎবাবুর মনে আসতে পারে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে আচার্য নন্দলাল বসুর শিক্ষণরীতির প্রেরণায়, যেখানে ১৯৪১-৪২-এ ওই কলাভবনেই তাঁর অধীনে ছাত্রজীবন কাটিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। নন্দলালবাবু ও অপর শিল্পী বিনোদবিহারীর অঙ্কণরীতি ছিল ভারতীয় ট্র্যাডিশানাল শিল্পবিস্তারের প্রেক্ষিতেই। ফলে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এ দেবীর পিছনের ফ্রেমের চালচিত্রটি নিজের হাতে সযত্নে সাজিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। ঠাকুরদালানের বাকি সেট-টি সত্যজিৎবাবুর পরামর্শে সাজিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

    দুর্গা ঠাকুরকে ঘিরে সর্বসাকুল্যে দুটি মাত্র ফটোগ্রাফ পাওয়া গেছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। একটি, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবির শুটিং-র আগে পরে পিছনে দেবী দুর্গার খড়ের কাঠামোর সামনে ৩৫ মিমি অ্যরিফ্লেক্স ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে স্থির চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষের তোলা ফটোতে relaxed সত্যজিৎ, আর একটা দেবী সরস্বতীর মূর্তিটির মাথার কেশ-মুকুট নিজের হাতে রং করছেন শিল্পী সত্যজিৎ। একাগ্রতায় পরিপূর্ণ মুখাবয়বে অসামান্য আবেগায়িত এক পটভূমি। যদিও ছবিটিতে দেবী দুর্গার চক্ষুদান করেছিলেন শশীবাবু চরিত্রটি, যেটাতে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তী মৃৎশিল্পী, কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার শ্রীশ চন্দ্র পাল।

    ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটির গল্পের সঙ্গে এই দুর্গাপ্রতিমার যোগাযোগ অতি ঘনিষ্ঠ – ভীষণভাবে attached আবার detached-ও বটে। পাচারচক্রের মাথা মগনলাল মেঘরাজ বারাণসীর ঘোষালবাড়ির প্রাচীন গণেশ মূর্তি যেন-তেন-প্রকারেণ নিজের করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে শুনে, শিশু চরিত্র রুকু ওরফে ক্যাপ্টেন স্পার্ক আর তার দাদু অম্বিকা ঘোষাল ঠিক করলেন বাড়িতে রাখা পারিবারিক ঐতিহ্যমণ্ডিত গণেশের ছোট্ট দামি মূর্তিটি আপাতত লুকিয়ে রাখবেন তাঁদের ঠাকুরদালানে নির্মীয়মাণ দুর্গাপ্রতিমার বাহন সিংহের মুখের ভিতর, চিউয়িং গাম দিয়ে। এই আইডিয়াটা তাঁরা পেয়েছিলেন জটায়ু ওরফে ফেলুদার সঙ্গী রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলির উপন্যাস “করাল কুম্ভীর” পড়ে। এই গণেশের কারণেই মগনলালের পোষ্য গুণ্ডাদের হাতে খুন হন শশীবাবু। বিজয়া দশমীর দিন ফেলুদার গোয়েন্দাবুদ্ধিতে মগনলাল ধরা পড়ে, ধরা পড়ে সাজানো ভণ্ড সাধু মছলিবাবাও। গণেশ উদ্ধার হয়। অতঃপর প্রকাশ হয়, এই গণেশ আসলে নকল, আসল গণেশ ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিয়েছেন অম্বিকা। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির সাফল্যে প্রসন্ন ঘোষালমশাই এই নকল গণেশটি ফেলুদার পারিশ্রমিক বাবদ উপহার দেন।

    ছবিটির সারসংক্ষেপ। কিন্তু বৈচিত্র্যে, নাটকীয়তার উপস্থাপনে, কাহিনীর বিস্তারে এবং সিনেম্যাটিক ভাষার অতি উৎকর্ষ বিন্যাসে গড়ে ওঠা এই ছবিটির দৃষ্টিকোণে দুর্গা পুজোর উপস্থিতি শুধুমাত্রই প্লট সাজানোর জন্য। একমাত্রিক ডাইমেনশান। আসলে যেমন ভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গাঙ্গুলি বা রাজ চক্রবর্তীর কয়েকটি ছবিতে নানাভাবে দুর্গা পুজোর উৎসবকে নিয়ে বাঙালি মনের উৎসমুখ বিধৃত হয়েছে, বাঙালি জীবনালেখ্যর সাথে, বিষয়বস্তুর অভিঘাতে, দুর্গা পুজো একটা স্বতন্ত্র স্সত্তা নিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, ঠিক সেভাবে, সত্যজিৎ বাবুর ছবিগুলোতে পুজোমু্খী বিষয় সঞ্চারণ কোনও আলাদা মাত্রায় প্রকাশিত হয়নি। তবু প্রায় খান তিরিশের কাছাকাছি নির্মিত সত্যজিৎ-সৃষ্ট ছবির কাব্যতীর্থে সত্যজিৎ কি কখনো পুজোর মাসের বাঙালি জীবনকে প্রতিভাত করে্ননি? এটা ভাবলে কিছু দৃষ্টান্ত থেকে আমরা সরে যেতে পারি। আশ্বিন মাস তো পুজোর মাস, বাঙালির হৃদয় আকুল-করা। সেই প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করে যাননি সত্যজিৎ তাঁর প্রথম ছবিতেই। ‘পথের পাঁচালী’ গ্রাম বাংলার জীবনের আদরণীয় বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের রায়বাড়ির পুজোয় ছোট অথচ আনন্দঘন পুজো পরিবেশ দৃশ্যমান হয়েছে। অকাল বর্ষণে অপু-দুর্গার গা ভিজিয়ে গ্রাম পরিক্রমা এবং তার পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অসুস্থ দুর্গার মৃত্যু যেন মহাকালেরই বিসর্জন প্রক্রিয়া। সর্বজয়ার নীরব কান্নার মানে বুঝতে পেরে দূরদেশ থেকে আগত হরিহরের “দুগ্গা মা” বলে হাহাকারের কান্না সকলের কোমল মনে আবেগ আনে। এই অপু, দুর্গা, হরিহর বা সর্বজয়ার নামাঙ্কণগুলো পথের পাঁচালি উপন্যাসে দিয়ে গেছেন লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। সেই নামগুলো অপরিবর্তিতই রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই দুর্গার কোনও mythological interpretation দেননি সত্যজিৎ, relate করার চেষ্টাও করেননি। তবু যেন আশ্বিনের শ্বেতশুভ্র কাশফুলের চিরকালীন সে দৃশ্য এবং অসাধারণভাবে সিনেমার পর্দায় উপস্থাপিত ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটির দৃশ্যায়্ন কেমন যেন মন উদাসী আশ্বিনের গ্রামবাংলার চালচিত্রকেই ধরে।

    ‘পথের পাঁচালি’ নির্মাণের বছর পাঁচেক পরেই তৈরি হয় ‘দেবী’ ছবিটি। টাইটেল কার্ডে নতুনত্ব এনেছিলেন শ্রী রায়। এখানে টাইটেল কার্ডে দেবী দুর্গার নির্মীয়মাণ মুখের উপরেই সুপার-ইমপোজড হয় ছবির শীর্ষ লেখা। যত নামের অলংকরণগুলো এগোয়, দেবী দুর্গার মুখটিও তৈরি হতে থাকে। টাইটেল কার্ড প্রদর্শনের ক্যামেরা ট্রলি ব্যাক করে সম্পূর্ণ মূর্তিটিকে ধরেন সত্যজিৎবাবু দেবীর মুখের উচ্চতায় ক্যামেরা বসিয়ে। দেবী দুর্গার মুখটি সমগ্র পর্দা জুড়ে দৃশ্যমান হয়। এই সমগ্র দৃশ্যে কালীকিঙ্করের (অভিনয়ে ছবি বিশ্বাস) জমিদার বাড়িতে পুজোর আনন্দে শরিক গ্রামবাসীদের পুজোর ছোট্ট মন্তাজ দৃশ্যের মধ্যে তুলে ধরা হয়, সেখানে রাত-আকাশে আলোর রোশনাই প্রতিভাত হয় শিশুর আনন্দোচ্ছ্ল মুখের expression-এ। আর ঠিক তার অব্যবহিত পরেই নদীপাড়ের আসন্ন সন্ধ্যের দৃশ্যে লং টপ শটে আমরা দেখতে পাই গ্রামের প্রতিমা বিসর্জনের এক সামগ্রিক প্রতিরূপ, কিংবদন্তী চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের অনন্যসাধারণ ক্যামেরাবন্দীতে।

    “মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন দেবী। মহিষাসুর বললেন, দেবী, তোমার হাতে মরতে হবে জানি, তুমি এমন করো যেন তোমার পুজোর সঙ্গে সঙ্গে লোকে আমারও পুজো করে। দেবী বললেন, তথাস্তু। তথাস্তু শব্দের মানে তাই হোক। সেই থেকে মহিষাসুর রয়ে গেলেন দেবীর পায়ের তলায়। আর দেবীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও পুজো হতে লাগলো!” – ফিরতেই হলো সেখানে, জয়বাবা ফেলুনাথের সেই দৃশ্যে, শিশু ক্যাপ্টেন স্পার্ককে যেখানে দুর্গা পুজোর সার্থকতার গল্প শোনাচ্ছেন প্রতিমাশিল্পী শশীবাবু। এ যেন এক বহমানতা, বৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ প্রপিতামহ-সম শশীবাবু সহজতম ভাষার আবরণে দেবীর আগমনী-হেতু সঞ্চারিত করে যাচ্ছেন নবপ্রজন্মকে।

    এভাবেই সত্যজিৎ-রীতিতে আশ্বিন এসেছে গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বাভাবিক ছন্দে, গল্পের প্রয়োজনে, কাহিনী-ব্যাখ্যায়। দেবী দুর্গার জন্মকথার গল্প। মানবী দুর্গাদের সামাজিক মূলস্রোতের অন্তর্নিহিত জীবনছন্দে।



    অলংকরণ (Artwork) : সৌজন্য : Jabberwock : July 2021
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments