নাটকের বাকি দলটা তখন এক এক করে জমা হচ্ছে। পম্পা আমাকে সাতদিন ধরে বুঝিয়েছে যে সৃষ্টিশীল পারফর্মিং আর্ট্স্ যারা করে তারা একটু অন্য ধরণের চরিত্র। সাধারণের চেয়ে এদের উচ্ছ্বাস নাকি বেশি, তাই সাবধানে হ্যাণ্ডেল করার বিধি। এখানে আনাগোনা করাটা হল লরিতে চেপে কোথাও যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। থেকে থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। কিছু একটা ধরে দাঁড়াতে হয়।
- কামড়াবে কেউ? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। - চুল ছিঁড়তে আসবে?
পম্পা আমার চিবুক ধরে বলল – ভয় পেলে আমার পিছনে গিয়ে লুকোস। তোর কিচ্ছু হবে না।
দেখলাম মেয়েরা প্রায় সবাই অল্পবয়সী। আঠেরো থেকে পঁচিশ। কিন্তু বেশির ভাগ পুরুষের মাথায় আদিগন্ত টাক। পরনে সাদা বা বাদামী খদ্দরের কুর্তা। বুকের কাছে একটা বোতাম খোলা রেখে গরুকে ঘাস দেখাবার মতো এক গুচ্ছ পাকা চুল বার করা আছে। পম্পাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম – এই বুড়োগুলো কি তোমাদের মতো ছুকরিদের সঙ্গে লাইন মারার জন্য আসে? পম্পা আমাকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলল – সে বুড়োগুলো অন্য। সেগুলো কোনো কম্মের নয়, জ্ঞান দিতে আসে। আজ শুধু কাজের লোকেরা আসছে, যারা দলটা চালায়। এরা অনেক ভালো, তুই কথা দে, কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না।
- আচ্ছা, আচ্ছা। মুখে কুলুপ দিয়ে থাকব। কলেজের ছোকরারা আসে না কেন?
- এই তো নতুন বছর শুরু হচ্ছে। আসবে সবাই। কাজের ভার পড়লেই কেটে পড়বে। তাঁরা ভাবেন মুখ দেখে প্রথম দিনই মেন রোল দেওয়া হবে, বা নাটকের ডাইরেক্টর বানিয়ে দেওয়া হবে।
সবাই লনে জমা হয়েছি। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল পম্পা। সত্যা স্যর, সত্যা সর বলে একজন সাদা ফিনফিনে কুর্তা পরা ছোটখাটো চেহারার মানুষকে ঘিরে রেখেছিল অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। এনারও সাদা চুল, কিন্তু দাড়ি নেই। ইনি ড্রামার ডাইরেকটর। সত্যা স্যর সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন – কাল দিল্লীতে কোনো ব্রাইড বার্নিং হয়নি। একটা স্মরণীয় দিন। সেজন্য আজ সন্ধ্যেবেলা বন্ধুদের সঙ্গে বিলায়তি খাব।
আমার বগলের নিচে পলিথিনের ব্যাগে আটটা লোকাল পেপার। কাল বিকেলের হিন্দী কাগজগুলোতে বলছে রাজৌরি গার্ডেনে একটা মেয়েকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। অবশ্য সবকটা ন্যাশনাল ডেইলিতে আজ সকালে বেরোয়নি। ভাবলাম জিজ্ঞেস করি সত্যা স্যর কোন শহরের খবরের কাগজ পড়েন।
রামকৃষ্ণের মতো দাড়িওয়ালা এক পি-এইচ-ডি’র ছাত্র (পম্পার পরিচিত) গলাটা বাড়িয়ে বলল – স্যর আমাদের পাড়াতেই একটা হয়েছে। মেয়েটা হাসপাতালে আছে।
সত্যা স্যরের চশমা ঝুলে পড়ল। - সত্যি বলছিস ম্যাথু?
আমি পম্পাকে কাগজটা পাস করে দিলাম। পম্পা ম্যাথুকে ধরিয়ে দিল। ম্যাথু বলল – স্যর ইভনিং নিউজে আরেকটা দেখছি। একটু ছোট প্রিন্টে আছে। তার মানে কাল অন্তত দুজন জ্বলেছিল। আপনি সম্ভব হলে বিলায়তিটা ক্যানসেল করে দিন।
- ধ্যাৎ তেরে কি। সত্যা স্যর নিরাশ হয়ে বললেন। - তোদের পাড়ায় একটা শো দেওয়া উচিত নাকি?
- সেটাই বলতে এসেছিলাম। শো’য়ের পর আমাদের পাড়ার মেয়েটার বিষয়ে কিছু বলাও যায়। দাড়ি নাড়িয়ে পরামর্শ দিল ম্যাথু।
- সে তো পরের কথা। করার জায়গা আছে?
- দুর্দান্ত জায়গা আছে। মার্কেটের ঠিক মাঝখানের পার্ক। অনেক লোক হবে। একটা সাপুড়ে আসে মাঝে মাঝে। সে এলে আমরা ফুটিয়ে দেব।
- সাপের নাচ তো ভালো জিনিস! ফোটাবি কেন? প্লে-তে ঢুকিয়ে নে না?
- পয়সা ছাড়া করবে না স্যর। আমরা ছাড়া কেউ বিনা পয়সার শো করে না।
পরে পম্পা আমাকে বুঝিয়ে দিল। সত্যা স্যরের স্ট্যাণ্ডার্ড স্ত্রীট প্লে আছে বধূ হত্যা নিয়ে। রাস্তায় রাস্তায় করা হয়। পম্পাও করেছে কয়েক মাস আগে। দর্শকদের চোখ নাকি জলে ভরে যায়। কুকুরগুলো অবধি হাউ হাউ করে কাঁদে।
গল্পটা পম্পা সংক্ষেপে শুনিয়েছিল। নায়িকা সাহারানপুরের, দিল্লীতে বিয়ে হওয়ার পর যার উপর শুরু হয়েছে ডাউরির জন্য নির্যাতন। মেয়েটি বাপের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য চিঠির পর চিঠি লিখে যাচ্ছে, কিন্তু বাবা-মায়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। তারপর একদিন তার ভাই দৈবাৎ চিঠিগুলো হাতে পেয়ে পড়তে শুরু করবে। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে সেদিনই মেয়েটাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করা হচ্ছে। সেই টানাপোড়েন নিয়ে নাটক। শেষদৃশ্যের ব্যাকগ্রাউণ্ডে ট্রেনের আওয়াজ। বাবা-মা’কে না জানিয়ে ভাই তার বোনকে নিতে আসছিল। একদিকে ভাইয়ের পথ যত কমছে, অন্যদিকে বোনের জীবনের মেয়াদও ততই ফুরোচ্ছে। ভাই কি ঠিক সময়ে এসে পড়ে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে? এরকম একটা সাস্পেন্সের মধ্যে নাটক শেষ।
ঘটনা হল এই যে এ বছর দিল্লীতে রোজ অন্তত একটা করে বধূহত্যা হচ্ছে। শ-দেড়েক তো আমিই খবরের কাগজে দেখেছি। শিমলিপুরে আজ অবধি কেন হয়নি সেটা একটা রহস্য। মামার থিওরি হল আমাদের কেরোসিনের দোকান তেলের মধ্যে এমন কিছু মেশায় যে সেটাকে স্টোভে ভরে ছাব্বিশ মিনিট অসুরের মতো গায়ের জোরে পাম্প না করলে আগুন ধরে না। তেল ভালো হলে নাকি একটাও নতুন বউ বাঁচত না। ভাইয়ের কথায় তাল দিয়ে মা বলে – ঠিকই কইসে মেজদা। ধোপাবাড়ির সাবানগোলা জল কেরোসিনে মিশ খায়। আমি দেখসি। বউরে জ্বালাইতে গিয়া ফেল। সেই লগে অনেক আপ্স্টার্ট পরিবার শিমলিপুর থিকা উইঠ্যা যাইতে আসে। সব শুনে মামিমা আমাকে বলেছিল – এরা দুজন জানে না এমন কোনো জিনিস পৃথিবীতে আছে? তেল ভালো নয় বলে আমায় জ্বালায়নি বোধহয়।
- এই মিডিওকার স্ক্রিপ্ট সত্যা স্যরের লেখা? উল্লুকের মতো পম্পাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
পম্পা মুখটা রাগী রাগী করে বলল - আর পাকামো করিস না। তুই নিজে এর চেয়ে ভালো পারবি? ওদের একটা ছোট কমিটি আছে লেখার জন্য। সত্যা স্যর তার চীফ এডিটর। দর্শকরা ভালো করে না কাঁদলে উনি মাঝে মাঝে কমিটিতে রদল বদল করেন।
- দর্শকরা কোন জায়গাটায় কাঁদে?
- চিঠিগুলো যখন পড়া শুরু হয়। সত্যা স্যরের সহকারী মিস্ ভূমিকা ছিব্বরের নিজের হাতে লেখা এখানটা। বেশ এফেক্টিভ।
পাঠককে হাপুস নয়নে কাঁদানোর সুইচ বসাতে নাট্যকাররা এক্স্পার্ট। এর ইলেক্ট্রিকাল পার্ট্স্গুলো কোথাও পাওয়া গেলে আমার গল্পের চূণ ওঠা দেয়ালেও নিরীহভাবে বসিয়ে দেওয়া যায়। পম্পাকে বললাম - স্ক্রিপ্টের একখানা কপি যোগাড় করে দাও না? কিছু শিখি তাহলে।
- তুই নাটক লিখবি?
বলতে চাইলাম – সত্যা স্যরকে গিয়ে ধরো আমাকে যেন দলে নিয়ে নেন। আমি ওঁর পায়ের কাছে বসে ট্র্যাজেডি লেখা শিখব। তার বদলে আমার মুখ দিয়ে বেরোল – এত কম আগুন দিয়ে ব্রাইড বার্নিং-এর নাটক কী করে করো বলো তো তোমরা? মেইন ক্যারেকটারই তো স্টেজে এল না।
আর কী! পম্পা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল।
এক সময়ে আমি পম্পার আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম – ঠাট্টা নয়। একটা অন্য ধরণের এণ্ডিং শুনবে? যাতে আগুনের সত্যিকারের ভূমিকা আছে? মনে করো টেবিলে ম্যাথু বসে আছে, সত্যা স্যর নাচতে নাচতে এসে গোটা ছয়েক খবরের কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে বললেন – কোথাও আজ বধূ হত্যার খবর নেই। বিলায়তি হবে ম্যাথু! সোডা লাও। ব্যাস্, বলতে না বলতে বিলায়তি আর গেলাস চলে এসেছে। দুজনে মিলে ভাগ করে খেতে শুরু করলেন। এদিকে, খুব মৃদুভাবে, ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটা সারেঙ্গী কাঁদতে শুরু করুক। প্রথমে দর্শকরা বুঝতে পারবে না। পরে আস্তে আস্তে সেটা জোরে হয়ে যাচ্ছে। আচমকা বলা নেই কওয়া নেই নারীকন্ঠের বুক হিম করা আর্তনাদ। কোত্থেকে এল? ম্যাথু একটা আঙুল দিয়ে দেখাবে। চিৎকার এসেছে টেবিলের মাঝখানে ডাঁই করা কাগজগুলোর মধ্যে থেকে। সেখানে একটা ছোট ওয়াকম্যান লুকিয়ে রাখা হবে, বুঝেছ তো? সত্যা ইশারায় বললেন – কাগজগুলো সরিয়ে দাও ম্যাথু। ম্যাথু চুপি চুপি হাত বাড়িয়ে যেই কাগজগুলো তুলতে যাবে অমনি আবার তার মধ্যে থেকে সেই তীক্ষ্ণ রক্ত জল করা চিৎকার। সত্যা আর ম্যাথু তো ভয়ের চোটে গেলাস টেলাস উলটে চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। তার পর কী কাণ্ডটা হবে বলো তো? কাগজগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।
পম্পার মুখটা হাঁ হয়ে গেছে আমার স্ক্রিপ্ট শুনে। চুলের মধ্যে দিয়ে একটা হাত চালিয়ে সে বলল - হোয়াট এ ফুল! সেটে কেউ আগুন লাগায়? তুই কি মানুষ, না একটা তেরো ইঞ্চির গাধা? দর্শকদের আগে অভিনেতারা পালিয়ে গেলে নাটক করবে কে?
তেরো ইঞ্চির গাধা কথাটা পম্পা আমার কাছ থেকে মানে না জেনেই তুলে নিয়েছে। তার মুখে কথাটা শুনলে আমার প্রচণ্ড হাসি পায় বলে কোনোদিন শুধরে দিইনি। এখন মনে হল সাবধান করে দেওয়া উচিত। প্রকাশ্যে এই অশ্লীল শব্দগুলো তার মতো ভালো মেয়ের মুখে শুনলে লোকেরা কী ভাববে?
পম্পাকে বললাম - স্পেশাল এফেক্ট। শোনোই না। আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে সত্যা আর ম্যাথু মেঝেতে ঘষটে ঘষতে টেবিল থেকে দূরে সরছিলেন, এমন সময় পাগলা ঘন্টি বাজাতে বাজাতে দমকল এসে হাজির। চারজন ফায়ার ফাইটার এসে পাইপ দিয়ে জল দেওয়ার অভিনয় শুরু করল। কিন্তু আগুন আর ধোঁয়া বন্ধ হচ্ছে না। এবার কাগজগুলোর মধ্যে থেকে একটা গোটা শহরের মানুষ পুড়ে মরার আওয়াজ আসছে...। বিল্ডিং ভেঙে পড়ার শব্দ। স্কুলের বাচ্চাদের গলা। মহিলাদের কান্নার রোল। ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেডিওর খবর শুরু হল। জুলাই মাসের অমুক তারিখ, ১৯৮৩ সাল। গোটা শহরে আগুন লেগে গিয়েছিল আজ। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সব পুড়ে ছাই। একটা মানুষও বাঁচেনি। খবরটা শোনার পর ম্যাথু সত্যা স্যরকে বলবে – স্যর, আপনি কাগজগুলো আদৌ পড়েছিলেন? সত্যা স্যর দূরে সরতে সরতে বলবেন – ম্যাথু, তুই তো জানিস আমি ফাইন প্রিন্ট পড়তে পারি না।
পম্পা সব শুনে আমার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলেছিল – আমি জানি তুই কী বলতে চাইছিস। মানুষগুলো নয়, মরে গেছে পুরো শহরের মনুষ্যত্ব। কিন্তু সব জিনিস নিয়ে ঠাট্টা হয় না জয়। সত্যা স্যরকে তুই যা ভাবছিস উনি সেরকম না। অনাথাশ্রমে বড়ো হয়েছেন। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা। মন খুব ভালো। স্ট্রীট প্লে যে একটা প্র্যাকটিকাল এবং সর্বজনীন আর্ট এই ব্যাপারটা উনি বোঝেন। রাস্তার নাটককে ফিল্মীও হতে হয় একটু। অ্যাকশন, ইমোশন, ড্রামা, ডান্স্, এইসব রাখতে হয় তাতে। আমাদের এই যে স্পেশাল ট্রুপ রয়েছে নাচ আর গানের জন্য। এটা কার আইডিয়া ভাবছিস? সত্যা স্যরের।
আমি পম্পাকে লনের একটা গাছের গায়ে প্রায় ঠেসে ধরে বললাম - সত্যি করে বলো তো, তোমাকে কি নাচনেওয়ালী হিসেবে ইউজ করছে এরা? ছোট ঘাঘরার নাচ দেখিয়ে তোমার ভালোমানুষ সত্যা স্যর দর্শক টানেন, তাই না?
পম্পা একটু আমতা আমতা করে বলল – পার্টও পাই। তবে সবকটা নাচে আমাকে নামতে হয়। আমি না নামলে আশাদি কী করবে বল? নাচতে পারে এমন সদস্য তো কম। তারপর সে আমার হাতের নিচ দিয়ে ফুড়ুৎ করে গলে গিয়ে বলল - ওই দেখ, বলতে না বলতে আশাদি চলে এলেন। উনি আমাদের ট্রুপের লীডার। সবার সামনে আশাদি বলিস না কিন্তু। বাংলাও বলিস না। তখন বলবি আশাজী।
পম্পাকে জানানো যায় না এমন একটা গভীর পরিতৃপ্তিতে বুক ভরে যাচ্ছিল। কারণ আমাদের ক্লাসের সব ছেলেরই অনুচ্চার্য স্বপ্ন যে তার একজন নাচনেওয়ালী গার্লফ্রেণ্ড হবে।
- আশাজী অডিটোরিয়াম খুলিয়ে দিন। ওরা আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
চারদিক থেকে কাকুতি মিনতি আসছে। বিধু নভরেকর বলে আরেকটি দাড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোককে চিনেছিলাম। ইনি অভিনেতা ও মঞ্চ নির্দেশক, যে কথাটার মানে আমি বুঝিনি। বিধু বললেন – আশাজী, দারোয়ান চাবি নিয়ে পালিয়ে গেছে। তোমার কাছে তো ডুপ্লিকেট আছে। খুলে দাও না?
আশা শিকদার বাঙালি। একটু বেঁটে বলে জুতোয় বড়ো হীল। বয়স তিরিশ পঁয়ত্রিশ হবে। অর্থাৎ বাচ্চাদের দলে পড়েন না, আবার বুড়োদের মধ্যেও ধরা যায় না। পম্পার মতো হালকা সুতির চুড়িদার সালোয়ার আর কামিজ পরে এসেছেন।
আশা বিধুকে দেখে তর্জনী তুলে বললেন – যা তা বোলো না বিধু। ডুপ্লিকেট চাবি থাকবে কী করে? আমি কি এখানকার কর্মচারী? এখন ওরা ভিতরে ফ্যান চালিয়ে ঘুমোচ্ছে। চারটে বাজলে ঠিক সব খুলে যাবে। অডিটোরিয়াম কিন্তু আমি নাচের অডিশানের জন্য বুক করেছি, প্রথম এক ঘন্টা ওটা তোমরা এমনিতেও পাবে না। তোমাদের জন্য পাশের ঘরটা খুলে দেবে।
সত্যা স্যর এসে হাত জোড় করে বললেন – আশা, তোমার কাজ হয়ে গেলে আমি বিধুর সঙ্গে স্টেজে একটু প্র্যাকটিস করতে পারি? আমাদের আধ-এক ঘন্টার কাজ মাত্র আজকে।
আশাজী মিষ্টি হেসে ঘাড় নেড়ে বললেন – এক ঘন্টার বেশিই লাগবে হয়তো আপনাদের। কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, হল্ আমাদের হাতে থাকবে।
পম্পার কাছ থেকে জানলাম আশাদি দলটাকে একা হাতে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বর দুঁদে আই-এ-এস অফিসার। আশাদির একটা টেলিফোনে সব কাজ হয়ে যায়। বাকি সব ধুরন্ধরদের নাম কাগজে, ম্যাগাজিনে ছাপে। কিন্তু আশাদি না থাকলে এরা একটা স্টেজও পাবে না, রাস্তায় নাটক করে বেড়াতে হবে। পম্পার পিঠে হাত রেখে আশাদি বললেন – এই মেয়ে, তুই চণ্ডীগড়ে চলে গিয়ে আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছিস। পম্পা বলল – আবার তো ফিরে আসব। বেশিদিন কি থাকতে পারব দূরে?
আশাদি আমার দিকে দেখিয়ে বললেন – ততদিন এই নতুন ছেলেটাকে দিয়ে যাচ্ছিস নাকি? নাচতে পারে?
- না আশাদি। কাজ ভণ্ডুল করা ছাড়া কিছুই পারে না। দেখতে এসেছে।
সত্যিই চারটের সময়ে ঘরগুলো ম্যাজিকের মতো খুলে গেল। আশাজীর দলের সঙ্গে আমি আর পম্পা অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম। দল ছেড়ে দিচ্ছে বলে পম্পার আজ কিছু করার কথা নয়। কিন্তু আশাদি তাকে বললেন – এসেছিস যখন একটু কাজ করে যা।
গান আর নাচের অডিশন মিলিয়ে মেয়েদের সঙ্খ্যা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি। আশাদি প্রতিটি ছেলেকে অনুরোধ করছেন – এই ছেলে নাচবি? কোনো এক্সপিরিয়েন্সের দরকার নেই। শুধু দুটো ঠ্যাং থাকা চাই। আমরা সব শিখিয়ে দেব। শুনে দু-একজন রাজিও হয়ে যাচ্ছে।
অডিশন শুরু হয়ে গেল। পম্পা স্টেজের নিচে বসে নতুন ছেলেমেয়েদের নাম-ঠিকানা লিখছিল খাতায়। আমি দরজার কাছে একটা সীট নিয়ে বসে খবরের কাগজগুলো ভালো করে পড়বার সময় পেয়েছি। নেউলেদার লেখাটা খুঁজে বার করলাম। নেউলেদার রিপোর্টের শিরোনামা চীখতী লাশেঁ, মানে চিৎকার করছে এমন লাশগুলো। একটা লাশ থেকে কী করে নেউলেদা শিরোনামায় বহুবচনের লাশেঁ নিয়ে এসেছে সেটা পরিষ্কার নয়।
একটু পরে পম্পা স্টেজে উঠে এসেছিল। তারপর আমি কাগজে আর মন দিতে পারিনি।
পম্পা একদল নতুন ছেলেমেয়েকে কয়েকটা নাচের মুদ্রা দেখিয়ে দিচ্ছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ সহজ, কিন্তু আমি জানি যারা নাচতে পারে না তাদের হাত-পা এই সরল মুদ্রাটা দেখেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। পম্পা যখন নাচে তখন তার শরীর থেকে একটা লুকোনো বারুদের মতো বিস্ফোরক শক্তি বেরিয়ে আসে। প্রতিটি পদক্ষেপে স্টেজ কাঁপিয়ে দিয়ে তার দেহ মেঝে থেকে চার পাঁচ ইঞ্চি উঠে যাচ্ছে। এই পাওয়ারটা সে তার ছোট ঘরের গণ্ডির ভিতরে আমাকে দেখাতে পারে না বলে প্রায়ই দুঃখ করে। পম্পা স্টেজের উপর থেকে মাঝে মাঝে আমার দিকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে। যে কারণে আমি সেখান থেকে চোখ সরাতে পারছি না।
খানিকক্ষণ পরে আটজন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে স্টেজে উঠে পম্পার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই কয়েক মিনিটের নাচটা করে দেখাচ্ছিল। স্টেজের নিচে কারো ঘুঙুর বাঁধা হাত ঢোল থাবড়াচ্ছে। খুব ছোট হলেও নাচ এমন জমে উঠেছিল যে তালটা যখন দ্রুত হয়ে গেল তখন স্বতঃস্ফুর্তভাবে অডিটরিয়ামে দাঁড়ানো অন্য ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে উঠল।
এক ঘন্টার অনেকটা আগেই পাশের হল থেকে টুক টুক করে সত্যা স্যর আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা এসে অডিটোরিয়ামের সীট দখল করতে শুরু করেছিলেন। পম্পা তার নাচ শেষ করে ঘাম মুছতে মুছতে আমার পাশে চলে এসেছে। নাচবার পরে পম্পার চোখে মুখে একটা সম্পূর্ণ প্রশান্তির ছাপ এসে যায়। - কী ভাবছিস? সে তার পল্লবের ঝিল্লি দিয়ে অপাঙ্গে একটা বাণ মেরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
আর কয়েক সপ্তাহ পরে আমার বান্ধবী চণ্ডীগড়ের কলেজে রওনা দেবে। নিয়মিত তার নাচ দেখার পালা সাঙ্গ হবে আমার। বললাম - রাজধানী থেকে রাজনর্তকী চলে গেলে কি সেটা আর রাজধানী থাকে? কিশোরীদের মতো লজ্জায় লাল হয়ে পম্পা মুখ ফিরিয়ে নিল।
সেদিন অডিশান দেখতে গিয়ে আমরা এমন একটা জীবনের ড্রামা দেখে ফেলেছিলাম যেটা পম্পাও আশা করেনি। ঘটনাটা শুরু হয় তাদের নাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে।
পম্পাকে দেখে ম্যাথু এসে ঢুকেছিল আমাদের লাইনে। আমাদের সামনের রো’তে সত্যা স্যর আর তাঁর কিছু সঙ্গী এসে বসেছেন। একটু পরে আশাদি তাঁর দল ছেড়ে সত্যা স্যরের কাছে এসে বললেন – সত্যাজী, একটা প্রবলেম হয়ে গেছে।
সত্যা স্যর আশাদিকে দেখে সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রবলেম শব্দটা শুনেই তাঁর মুখ শুকনো বেগুনের মতো চুপসে গেছে। - অডিটোরিয়াম পাওয়া যাবে না? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আশাদি বললেন - আরে না, সে ভয় নেই। আমি তো চাই আপনারা আজ বেশিক্ষণ সময় পান। সেজন্য আমাদের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে দিচ্ছি। আসলে শুক্কুরবার আপনার অলঙ্কার হাউসে যে শো’টা আছে তার একটা কব্জা আটকে গেছে।
- কী আটকে গেছে?
সত্যার এক দিকে বিধু নভরেকর আর অন্য দিকে সত্যা স্যরের ডান হাত ও ডাকসাইটে সহকারী-নির্দেশিকা ভূমিকা ছিব্বর বসে ছিলেন। ভূমিকা ভাবলেন সত্যা স্যর শুনতে পাননি। তিনি জোরে জোরে বললেন – কব্জ্ আটকে গেছে। মানে কন্স্টিপেশান। আমি আপনাকে বলেছিলাম না নাটকে এত পি-জে ঢোকাবেন না?
আশাদি অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন – বাংলায় আমরা কব্জা বলি। মানে মানে ...।
পম্পা বলল – পুর্জা।
- কারেক্ট! সেটা খুলছে না।
শুনে সত্যা স্যরের ঘাড়ের উপর বসানো শুকনো বেগুন আরো শুকিয়ে ফুটো বেলুন হয়ে গেল। আমি এতক্ষণে বুঝে গিয়েছি সত্যা স্যরের জীবনের প্রধান ভয় এই যে আশাদির ছত্রছায়া তাঁর মাথার উপর থেকে সরে যাবে এবং তিনি উঁচুদরের মঞ্চ পাবেন না। অলঙ্কার হাউস দিল্লীর একটা ভয়ানক ইজ্জতদার জায়গা। হেঁজিপেঁজিরা সেখানে শো করতে পারে না।
সত্যা বললেন - তার মানে কী আশা? হল্ পাওয়া যাবে না? আমরা যে থ্রি-ফোর হাণ্ড্রেড টিকিট্স্ সেল করে দিয়েছি!
- না, না হল্ পাওয়া যাবে। তবে নাটকটা পালটাতে হবে।
শেষের কথাটা সত্যা স্যরের মাথায় ঢুকল না। আমরা যারা শুনতে পেয়েছি তারাও বেশ অবাক হয়ে গিয়েছি। সত্যা স্যর কিছু বুঝতে না পেরে তাঁর সঙ্গীদের দিকে চাইলেন। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে আশাদিকে জিজ্ঞেস করলেন – নাটক পালটাতে হবে মানে?
- মানে সিম্পল্। এই দহেজ বিরোধী নাটকটা করা যাবে না। অন্য একটা কিছু করতে হবে।
বিধু আর ভূমিকা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। তারপর ভূমিকা বললেন – কেন? এটা তো সরকারের এগেইন্সটে নয়। সরকারী পজিশানই তো পণপ্রথার বিরোধ। সবচেয়ে চলতি কন্টেম্পোরারি ইশ্যু এটা আশা। দূরদর্শনেও এই সাবজেক্ট ম্যাটার লাগাচ্ছে।
আশাদি সরকারকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। - সরকারকে কে ভয় পায়? আজ আছে, কাল নেই। প্রবলেম হচ্ছে মলোদীদের নিয়ে। ওরা তো দিল্লী ছেড়ে যাবে না। মোঘলদেরও আগে থেকে আছে এখানে।
সবাই অবাক। মলোদী নামটাও কারো চেনা নয়। কে এই মলোদী? কেন তাদের ভয় করতে হয়? সবার হয়ে সত্যা স্যর জিজ্ঞেস করলেন।
আশাদি তারপর অসুবিধেটা জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন। – একটু প্র্যাকটিকাল সাইডটা ভাবার চেষ্টা করুন সবাই। ফুল সেক্রেটারি র্যাঙ্কের অফিসার লাজপতজী চীফ গেস্ট হয়ে আসছেন। সঙ্গে থাকবেন তাঁর হবু বেয়াই-বেয়ান মলোদীরা। দিল্লী সিল্ক মিল্সের মালিক। মানে চীফ গেস্টের চীফ গেস্ট! দুদিন পরে লাজপতজীর ছেলের সাথে মলোদীদের মেয়ের বিয়ে। ম্যাসিভ্ লেনদেন হচ্ছে। সমঝতে হ্যাঁয় না আপ? ক্রোর্স্। দহেজ বিরোধী যে সব সস্তা ইয়ারকিগুলো আপনার নাটকে আছে সেগুলো জানার পর এক্স-ওয়াই-জেড নাক কান মুলে বলেছে – আশা এটা বন্ধ করো। নইলে সত্যা স্যরের নাম পালটে সত্যানাশ করতে হবে।
পরে পম্পা জানিয়েছিল এক্স-ওয়াই-জেড হলেন জেভিয়ার ইয়েসুদাস জামোরিন। আশাদির গোয়ানীজ বর। ম্যাথু পম্পাকে শুধরে দিয়ে বলল, ইয়েসুদাস নয়, ইয়েসুদিয়েন। মিড্ল্ নেমটা নাকি ভদ্রলোক নিজে যোগ করেছেন। মাঝে মাঝে পালটায়।
– চা-চা-চা-। সত্যা স্যর ধপাস করে বসে পড়ে বলতে শুরু করেছিলেন। ভূমিকা বললেন – চা আমি পরে আনিয়ে দেব, এখন একটু ঠাণ্ডা জল খাও সত্যা।
- না-না! চারদিনের মধ্যে নতুন নাটক কীভাবে হবে? বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ...।
স্টেজ থেকে আশাদির ডাক পড়েছে। আশাদি একটা হাঁক ছাড়লেন – বচ্চেলোগ তোমরা চালাও। আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর তিনি ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় সত্যা স্যরকে বললেন – এক ঘন্টার নাটক তো? কটা ডায়লগ আছে গুনেছেন?
– গুনতে হয় নাকি? সত্যা স্যর হাঁ করে ভূমিকার দিকে তাকালেন। ভূমিকা বললেন – দেড়শো-দুশো হবে।
আশাদি বললেন - একশো বেয়াল্লিশ। পাঁচটা মেইন ক্যারেক্টার। সব মিলিয়ে ধরুন গোটা পনেরো এমন সংলাপ আছে যেগুলো শুনলে মনে হয় লাজপতজী আর তাঁর স্ত্রীকে ল্যাম্পুন করা হচ্ছে। কালকের মধ্যে এগুলো পালটে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি মানে মহঙ্গাইয়ের উপর করে দিন। বুঝলেন না? সিভিল সার্ভেন্টদের মাইনে তো পে-কমিশন না বসলে বাড়ে না। তাদের কাছে প্রচণ্ড টপিকাল ইশ্যু। আর কিচ্ছু পালটাতে হবে না। ক্যারেকটার, সিচুয়েশন, স্টেজ স্ক্রিপ্ট সব আগের মতো থাকুক। জলের মতো সোজা বলছি না। কিন্তু ইম্পসিবল্ নয়। এই একটা শো ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। সেকেণ্ড শো যেখানেই হোক, তখন আবার যা ইচ্ছে তাই করবেন!
সত্যা স্যর, বিধু, আর অন্যান্য পাকাদাড়ি যে কজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেই সারিতে ছিলেন, তাঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় মূক। ‘জলের মতো সোজা’ কথাটা আশাদির মুখ থেকে বেরোনো মাত্র ভূমিকার ভুরু কুঁচকে মুখটা গোলাপি দইয়ের মতো জমে থমথমে হয়ে গিয়েছিল।
- আশা, এটা জোক হচ্ছে? আর সবাইকে চুপ দেখে একটু বিরতির পর ভূমিকা ক্ষিপ্ত মেজাজে বললেন। - তিন মাস ধরে কাজ হয়েছে নাটকের পিছনে। এত বড়ো প্রোডাকশান! এখন লাস্ট সপ্তাহে এসে লালাজীদের জন্য মেইন থীমটাকেই চপ্ করতে বলছ?
আশাদি একদম ঠাণ্ডাভাবে বললেন - ভূমিকা, আমি একবারও বলেছি মেইন থীমটাকে চপ করতে হবে? মেইন থীম যেমন আছে বহাল থাকুক।
- মেইন থীম দহেজই থাকছে? ভূমিকা একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছেন মনে হল।
- হোয়াই নট? শুধু ডায়লগগুলো পালটে দাও। দহেজের জায়গায় অন্য কিছু ঢোকাও সেখানে। মহঙ্গাই, সাস-বহুর খিটখিট, ফেমিনিজম্...
শুধু ভূমিকা কেন, এবার বিধুর মতো ঘোড়েল মক্কেলও পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে একটা ক্যাবলার মতো হাসি দিতে শুরু করেছেন দেখি।
সত্যা স্যর এদিক ওদিক তাকিয়ে সবাইকে চুপ দেখে বললেন – ডায়লগগুলোতে দহেজের বদলে খিটখিট ঢুকবে, কিন্তু থীমে দহেজ বহাল থাকবে?
আশাদি সত্যা স্যরের দিকে একটা তর্জনী দেখিয়ে বললেন – স্যর একদম ঠিক ধরেছেন আপনি। এবার বাকিদের একটু বুঝিয়ে দিন প্লীজ।
সত্যা স্যর ভূমিকার দিকে শিশু ছাগল যেভাবে মায়ের দিকে তাকায় সেইভাবে তাকিয়ে আছেন। ভূমিকা বেচারা কী বলা যায় বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করে যাচ্ছেন। খানিকক্ষণ এইভাবে চলার পর সকলেই নিশ্চিত হল আশাদি এর বেশি কিছু খোলসা করবেন না। শেষে নিরুপায় ভূমিকা বললেন – আশা, ডায়লগ থেকে দহেজ বাদ দেওয়ার পর সেটা থীমে কীভাবে বহাল রাখা যায় তা আমাকে দয়া করে একটু বুঝিয়ে দেবে তুমি?
দেখা গেল আশাদির জবাব তৈরীই আছে। ভূমিকার দিকে ঘুরে পটাং করে তিনি বললেন - আমি কী করে বোঝাব ভূমিকা? ডায়লগ তো তুমি লেখো!
এই জায়গাটাতে এসে ম্যাথুর ঘাড় পম্পার দিকে ঘুরতে শুরু করে। সে, পম্পা, আর আমি পিছনের সারীতে বসে সমস্ত শুনছিলাম। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম তার লিচুর মতো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে ধরা চোয়াল জুড়ে একটা পাগলাটে উল্লাস।
এতক্ষণে আমার মাথায় ঢোকে যে একটা বিপদ ঘটতে চলেছে।
ভূমিকার গোলাপি মুখ ধাঁ করে লাল হয়ে গিয়েছিল। সাঙ্ঘাতিক চটে গিয়ে থাকলেও সেটা দেখাবেন না বলে ঠোঁটে একটা কষ্টসৌজন্যের মুস্কান ধরে রেখেছেন। হাত দুটো জোড় করে তিনি বলছিলেন - ক্ষমা করো। এই কাজটা আমার সাধ্যের বাইরে।
আশাদি যেন ভূমিকাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গলায় একটা সহানুভূতির সুর ফুটিয়ে বললেন – আরে থীম মেঁ কেয়া পড়া হুয়া হ্যায় ভূমিকা? পাওয়ার তো সব ডায়লগে। থীমকে মারো গোলি আর ডায়লগের হুলিয়াটা একটু পালটে দাও না?
বিধু নভরেকরকে কিছুক্ষণ যাবৎ ভূমিকার ফোঁসফোঁসানি উপভোগ করে আসতে দেখেছিলাম সবাই। ভূমিকা নিরুত্তর থাকায় হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল আশাদি শুকনো সলতের মুখে যথেষ্ট আগুন যোগাতে পারছেন না। এবার তাঁকে আশাদি আর ভূমিকার মধ্যে টেংড়ি নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। – নাটকের নামের মধ্যে দহেজ শব্দটা আছে না? চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিধু। - সেটাও তাহলে পালটানো চাই ভুমিকা। কাগজে কাগজে ইস্তাহার পড়ে গেছে অবশ্য। তাতে কী? ভুলচুক তো হয়।
আশাদি বিধুকে নিরস্ত করে বললেন - ‘দহেজ মুবারক’ নাম তো? মোটেও পালটাতে হবে না। খুব চলবে। আমি তো বকে বকে থকে গেলাম। নাম থাকুক। থীম থাকুক। থাকতে চাইলে সব কিছুই থাকুক।
- আঃ! বিধু উচ্ছ্বসিত। - ‘দহেজ মুবারক’ নাম থাকতে পারে। থীমও হবে ডাউরি। কিন্তু নাটকের মধ্যে ডাউরি নিয়ে যে ডায়লগগুলো আছে সেগুলো কুচকুচ করে কেটে ঢুকবে মহঙ্গাই। কী সুপারহিট দুর্দান্ত আইডিয়া! সেকেণ্ড শো থেকে ডাউরি ফিরেও আসতে পারে ডায়লগে, কিন্তু তখন নাটকের নাম হয়ে যাবে মহঙ্গাই!
সত্যা স্যর, যিনি একটু আগে দু-হাতে কপাল চেপে ধরে বসে পড়েছিলেন, আর সহ্য করতে না পেরে ট্র্যাফিক পুলিশের মতো হাত তুলে বিধুর পথ আটকে বললেন – থামো! যত্ত সব উদ্ভট ইয়ারকি তোমার। ‘দহেজ মুবারক’ নাম দিয়েছি ডাউরির উপর স্যাটায়ার করব বলে। নাটকে ডাউরির কুফলগুলো না দেখালে চলবে কী করে?
বিধু কোনো উত্তর না দিয়ে ঠোঁট চেটে শুকনো হাসিটা ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন। আশাদি নিজের বেঁটে শরীর চিতিয়ে কিছুটা উচ্চতা সংগ্রহ করে শুধোলেন – স্যর, নাটকের নাম ‘ঈদ মুবারক’ হলে আপনি ঈদের কুফল দেখাতেন না সুফল?
- ঈদ? মানে যেটা রোজার পরে...?
- আমি বলছি যে থীমে দহেজ থাকুক, নামেও দহেজ থাকুক। শুধু তার কুফলের বদলে সুফলগুলো দেখাতে দোষ কী?
সত্যা স্যরের চোয়াল ঝুলে বুকে এসে ঠেকে গেছে।
ভূমিকা ফ ফ করতে করতে বলছেন – অলঙ্কার হলে শো করার জন্য দহেজের সুফল দেখাব আমরা?
জবাব কারো কাছে নেই। আশাদি আঙুল তুলে সবাইকে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে স্টেজে ফিরে যাচ্ছিলেন।
আমাদের সামনের সারিতে যেন একটা মার্কিন হেলিকপ্টার এসে নাপামের বোমা মেরে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে গাছপালা, ধানের ক্ষেত। ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান, ইতিহাস, ভূগোল, সমস্ত শেষ। সত্যা স্যরের মাথাটা স্লো মোশনে সামনের সীটের উপর নেমে আসছে। ধরা গলায় তিনি বললেন – এত করার পর ক্যানসেল হয়ে যাবে শো?
ভূমিকা ভিয়েৎকং আর্মির মতো তেড়েফুঁড়ে উঠে বললেন – আশা আর তার বর মিলে যা ইচ্ছে করছে। ফ্যাসিস্ট কাপ্ল্। এদের মন্মানি করতে দেওয়া যায় না। আমাদের ফাইট ব্যাক করতে হবে।
বিধু বললেন – রাত জেগে একটু কাটছাঁট করে দাও না। দুদিন রিহার্সালের সময় আছে এখনো। এইটুকু তো দলের স্বার্থে করতেই হয়। তোমরা লেগে পড়ো এক্ষুনি।
- লেগে পড়ো এক্ষুনি! চিড়বিড় করে উঠে বিধুকে ভেঙাবার জন্য দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন ভূমিকা ছিব্বর। - এক রাতের মধ্যে একটা ন্যারেটিভ উলটে দেওয়া যায় নাকি? এটা কি একটা বিছানার তোষক? না বারো হাত স্টেজে কোথায় কার ব্যাকসাইড রাখা হবে তাই নিয়ে তোমার মতো তেরো হাত আঁতলামো? র্যানডমলি ডায়লগ পালটে দিলেই চলে না। একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প দাঁড় করাতে হয়। সেটা যদি পারা সম্ভব হত, তাহলেও এক্ষেত্রে কাজটা ইম্মরাল।
পম্পার কাছে গল্প শুনে আর্টিস্টদের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে যেরকম একটা ধারণা করেছিলাম, এই গ্রুপটা তার চেয়েও বিচিত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করছিল। ‘ইম্মরাল’ শব্দটা উঠতে বিধু আর তাঁর সহকারী গোয়েল দুজনেই হাসিতে উপচে পড়লেন।
ভূমিকা সেটা দেখে বললেন - বিধু তোমার কেরিয়ারের জন্য তুমি আন-বান-শান, জমীর, সব বেচে দিতে পারো সবাই জানে। কিন্তু টীমের ছেলেমেয়েগুলো এখনো অত সিনিকাল হয়নি। তাদের কী জবাব দেব আমরা? লালাজীর কাছে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছি?
বিধু কোনো অপমান গায়ে না মেখে বললেন – সত্যি কথা জানাবার দরকার নেই। এটা আমাকে হ্যাণ্ডেল করতে দাও। বলব সত্যা স্যর একটা নতুন আইডিয়া পেয়েছেন। এই ডাউরির কুফল ব্যাপারটা বস্তাপচা হয়ে গেছে। এখন লেটেস্ট ট্রেণ্ড হচ্ছে সুফল।
- বিধু তুমি ইচ্ছে করে বাঁদরামো করছ। ভূমিকা হিসহিসিয়ে উঠে বললেন। - ইয়াং জেনারেশনের জন্য দুটোই চলতি ইশ্যু আছে। হয় খালিস্তানী টেররিজম্, নয় ডাউরি। প্রথমটা ভিন্দ্রাঁওয়ালের ভয়ে কোথাও করা যায় না। দ্বিতীয়টা আমরা সর্-কে-বল্ উলটে যদি দিই তাহলে আমাদের ব্র্যাণ্ডের কী হবে? ব্রাইড বার্নিং-কে সমর্থন করে নাটক লিখব নাকি এর পর? নতুন ছেলেমেয়েরা মুখে থুতু দেবে। কেউ আমাদের গ্রুপ জয়েন করবে কেন?
বিধু আমাদের সারীর ছেলেমেয়েদের শুনিয়ে সম্পূর্ণ নির্লজ্জভাবে বললেন - মেয়েরা জয়েন করবে নিজেদের ট্যালেন্ট দেখাবার জন্য। ছেলেরা জয়েন করবে মেয়েদের দেখার জন্য। আমরা তাদের কাজে বাধা দিচ্ছি কি? কাউকে কিচ্ছু জানাবার দরকার নেই।
আমাদের সারিতে অল্পবয়সীরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো নির্বাক হয়ে বড়োদের এই আলোচনা শুনছি। ম্যাথু হঠাৎ তার গলাটা বিধু আর সত্যা স্যরের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল – আপনি না জানালেও সবাই ঠিক জানতে পেরে যাবে।
আর যায় কোথায়? বিধু পটাং করে ঘুরলেন। ম্যাথু বেচারা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ার পর নিজের সিটে ফিরে আসতে পারেনি। বিধু খপ করে কলার ধরে এক হাঁচকা টানে তার মাথাটা নিজের কোলের কাছে এনে ফেলে বললেন – ম্যাথু, উল্লু কা পঠ্ঠা, তিরিশ বছর বয়স হতে চলল, তুই আর কতদিন বাচ্চা সেজে থাকবি? তোর বিয়ে হয়নি?
ম্যাথুর ঘাড়টা বিধুর কব্জায়। ম্যাথু গোঁ গোঁ করে বলল – হয়েছিল। টেঁকেনি।
- আমারটাও না। সেইজন্য এই দলটাকে টিঁকিয়ে রাখতে চাই। তুই মুখ বন্ধ রাখতে পারবি না?
- পারব। পারব।
- এই মুখার্জি! তুই পারবি?
শেষের ধমকটা পম্পাকে লক্ষ্য করে। বিধুর হাতের আরেক কোঁৎকা খেয়ে ততক্ষণে ম্যাথু আবার নিজের সিটে ফেরত চলে এসেছে।
পম্পা হঠাৎ একেবারে ভালো মেয়ে সেজে গিয়ে বলল – স্যর, আমি কিচ্ছু শুনতে পাইনি।
- ইউ আর স্মার্ট। লেগে থাক। হয় বিয়ে, নয় থিয়েটার। দুটোর মধ্যে অন্তত একটা তোর হবে। ঠোঁটে যে ব্যঙ্গের হাসিটা কায়েমি হয়ে ঝুলে ছিল, সেটা মুছে ফেলে বললেন বিধু নভরেকর।
আশাদির স্টেজে ফিরে যাওয়ার পর সকলের উচাটন এমন একটা তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল যে বিধুর পাশে বসা সত্যা স্যর মাথাটা সামনের সিটে না ঠেকিয়ে নিজেকে খাড়া অবস্থায় ধরে রাখতে পারছিলেন না। একটু পরে তিনি ধুঁকতে ধুঁকতে বললেন – এত কম সময়ের মধ্যে এরকম আমূল স্ক্রিপ্ট কেউ কখনো পালটাতে পারে? দ্য টাস্ক ইজ ইম্পসিবল্। ভুমিকা, এসো আমরা সবাই মিলে সারা রাত বিলায়তি খাই যাতে কাল সকালের মধ্যে কোমায় চলে যেতে পারি।
ভূমিকা ঠাট্টা হিসেবেও পরাজয় স্বীকার করতে পারেন না দেখলাম। হাসির বিন্দুমাত্র আভাস না দিয়ে তিনি বললেন – গেট আপ্ সত্যা। আমরা মাথা নোয়াব না। নাটক যেমন আছে তেমনই থাকবে। হোক হল্ ক্যানসেল। আমরা কনট প্লেসে ক্যানেস্তারা পিটে পিটে এক মাস স্ট্রীট শো করব।
ভূমিকা হাসতে না পারলেও, ম্যাথুকে আবর্জনার মতো নিক্ষেপ করার পর বিধুর দেঁতো হাসি একটা লক্ষ্য খুঁজে চলেছিল। ভূমিকার দিকে এবার ঘুরল সেটা। তিনি প্রচণ্ড খুশি হওয়ার ভাব দেখিয়ে বললেন – এটা আগে ভাবিনি কেন? তোমার গলায় একটা ক্যানেস্তারা ঝুলিয়ে রাস্তায় হাঁটালেই তো অনেক লোক এসে যাবে। স্ক্রিপ্টও লাগবে না কোনো!
এই গরমা-গরম আলোচনার মধ্যে পম্পা আমার কানে কানে বলল – আশাদি, ইচ্ছে করে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছেন।
- কেন? আমিও তার কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম।
- উনি একটা কিছু ভেবে রেখেছেন নিশ্চয়ই। ডায়লগের সংখ্যা ঠিক একশো বেয়াল্লিশ, এটা কে গুনল? এ সব এক্স-ওয়াই-জেডের কাজ। ভয়ঙ্কর তুখোড় লোক। মনে হয় ওদের সলিউশান আগেই ঠিক হয়ে আছে। এখন ভূমিকাকে স্টিমে ফুটিয়ে নরম করার জন্য প্রেশার কুকারের ডালাটা বন্ধ করে একটু ঘুরে আসতে গিয়েছেন।
পম্পা পৃথিবীর কয়েকটা মানুষকে খুব ভালো করে চেনে। আশাদি বোধহয় তাদের একজন। এক মিনিট বলে গেলেও, দেখা গেল দশ মিনিট হয়ে গেছে, আশাদির পাত্তা নেই। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টাইম টেবিল নিয়ে একদম সাধারণ কেরানী মার্কা কাজে ডুবে আছেন। এদিকে প্রেশার কুকারে চানার ডাল টগবগ করে ফুটছে। একটু পরে বিধু তাঁর সহকারী রকি গোয়েলকে নিয়ে আশাজীর সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলেন।
আশাদির সঙ্গে সেখানে বিধুর একটু গুজগুজ হল। ফিরে এল রকি গোয়েল, এবং ভূমিকার কানে ফুসফুস করল খানিকক্ষণ। রকি কী বলল আমরা শুনতে পেলাম না। কিন্তু ভূমিকা আবার হিসহিসিয়ে উঠে বললেন – কত বড়ো শয়তান! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
একটু পরে বিধু ফিরলেন আশাদিকে সঙ্গে নিয়ে। আশাদি হাত ঝেড়েঝুড়ে একটা পানের ডিবে কোত্থেকে বের করেছেন। সেটা খুলতে খুলতে বললেন – পান খায়েঙ্গে আপ মেঁ সে কোই?
সত্যা স্যর কুঁই কুঁ করে না বললেন। ভূমিকার আগুনের মালসার মতো মুখ অন্যদিকে ফেরানো। বাকিরা মাথা নাড়িয়ে নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করছিলেন। আশাদি একটা জাপানি সিঙ্গাড়ার মতো পুঁচকে খিলি নিজের মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বললেন – তো প্রবলেমটা কী? আপনারা জুনিয়ার মেম্বারদের মুখ চেয়ে ফটাফট কয়েকটা লাইন পালটাতে পারছেন না?
প্রেশার কুকার ফাটল এবার। ভূমিকা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন – এক রাতের মধ্যে এত বড়ো একটা নাটক পুরো বদলে দেবে কে? তোমার বাপ?
- ভূমিকা কেন মুখ খারাপ করছ? কাজটা তো তোমার। কী এমন শক্ত?
- ও। খুবই সোজা তাই না? তুমি আর তোমার সবজান্তা বর মিলে কেন করে দাও না তাহলে?
আশাদি ভূমিকার দিক থেকে মুখ সত্যা স্যরের দিকে ঘোরালেন। - স্যর, আপনি কিছু বলুন।
সত্যা স্যর হাত জোড় করে বললেন – আশা তুমি যদি পারো তো আমাদের বাঁচাও। আমরা চাই শো-টা হোক। লাজপতজীকেও চটাতে চাই না।
- আমি একটা স্ক্রিপ্ট আপনাদের এনে দিলে আপনারা করবেন?
- স্ক্রিপ্ট? কীরকম স্ক্রিপ্ট? কে লিখবে?
- আছে আমাদের সেক্রেটারিয়েটের রাইটার। একশো বেয়াল্লিশটা ডায়লগের মধ্যে কুড়িটা পুরোপুরি পালটাবে। আরো গোটা কুড়ি একটু টাচ করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি আনারও দরকার নেই। ডাউরির বদলে কিডনি লাগিয়ে দিন।
- কিডনি?
- হ্যাঁ। মনে করুন ননদের কিডনি ফেল করছে। বাবা-মায়েরটা ম্যাচ করেনি। নতুন কিডনির খরচ যোগাতে গিয়ে বাড়িতে টেনশন। সেম গল্প, একটু উনিশ-বিশ। শেষ পর্যন্ত ডাউরিতে পাওয়া টাকা দিয়েই কিডনি বাঁচবে – অর্থাৎ ‘দহেজ মুবারক’ নামটা একদম অন-পয়েন্ট! ট্র্যাজেডির বদলে কমেডি, শুধু এইটুকু পরিবর্তন।
- দহেজ প্রথাকে আমরা সমাজের জন্য স্বাস্থ্যকর বলব?
- যদি দেনেওয়ালা মালদার হয় আর স্বেচ্ছায় দেয়, তাহলে দহেজের সঙ্গে বিনোবা ভাবেজীর ভূদানের তফাৎ কোথায়? মহৎ কাজ নয় একটা?
আশাদির মুখ থেকে এটা শুনে এমনকী তাঁর গুণমুগ্ধ পম্পারও ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অপার বিস্ময়ের একটা তীব্র শ্বাস সুঁ-ই-ই বলে শিস দিতে দিতে ঢুকে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দেখা গেল সবার চেয়ে কম কট্টরপন্থী হলেন অনাথাশ্রমে পালিত সত্যা স্যর। আশাদির যুক্তিগুলো শুনে তাঁর চোখে মুখে একটা নতুন উদ্দীপনার আলো এসে পড়ছিল।
- আশা, তোমার আইডিয়াটা হয়তো খারাপ না। আমরা অনেকদিন কমেডি করিনি। দলের কিছু ছেলেমেয়ে চাইছিল করি। কিন্তু এসব লিখবে কে? হাতে এত কম সময়।
- এক্স-ওয়াই-জেড তো সেই জন্যই আছে, তাই না? ইম্পসিবল্কে পসিবল্ করা হল আই-এ-এস অফিসারের কাজ। ওদের অফিসে একজন চাপরাসি কাজ করে। বম্বের অসঙ্খ্য হিন্দী সিনেমার ডায়লগ আসলে দিল্লীতে বসে বসে ও-ই লেখে।
- সত্যি বলছ? কী নাম?
আশাদি একটা গোপন খবর দেওয়ার মত গলা একটু খাটো করে বললেন - করামাত খান গিদ্ধড়্!
- গীদড়? ফক্স্?
- গীদড় নয়, গিদ্ধড়্! শকুন। ডেড বডি সরিয়ে পৃথিবীটাকে পরিষ্কার রাখা যার কাজ। এটা ওর তখল্লুস্, মানে ছদ্মনাম।
- নামটা জবর, কিন্তু কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি শুনেছ ভূমিকা?
ভূমিকা তাঁর লিপ্স্টিকলিপ্ত অধরপটল অবজ্ঞার সঙ্গে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দু-দু-ইঞ্চি উলটে দিচ্ছিলেন। আশাদি সেটা ভালো করে দেখে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন – করামাত সাব-কন্ট্রাক্টরি করে বলে ওর নাম ওঠে না। অন্যদের নাম হয়। শোলের সেই প্রাইসলেস্ ডায়লগ দুটো মনে আছে?
- অ্যাঁ! এগুলো ওর লেখা নাকি? চোখ কপালে তুলে বললেন সত্যা স্যর।
- সরদার ম্যাঁয়নে আপকা নমক খায়া হ্যায়!
- তো অব গোলী খা!
আশাদি প্রশ্নটার সোজা জবাব না দিয়ে বললেন - শুধু শোলে কেন? এই ডায়লগটা শুনেছেন? অ্যায়সা তো আপুন দো হীচ্ বার আদমী কো ভাগতে দেখা। ইয়া ওলিম্পিক কা রেস্ হো, ইয়া পুলিস কা কেস্ হো।
সভা নিস্তব্ধ। বিধু, রকি, ভূমিকা, সত্যা স্যর, প্রত্যেকের মুখের অভিব্যক্তিতে যুগপৎ ঈর্ষা আর ভক্তি। চোখের সামনে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন হলে যেমন ঘটনাটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের উর্ধে উঠে গিয়ে একটা কস্মিক মহাজাগতিক অভিজ্ঞতা হয়ে যায়, সেরকম ব্যাপার। ম্যাথু শুধু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শিম্পাঞ্জীর মতো নিঃশব্দে তার মাড়ি বের করা হাসি হাসছে।
- আশা, এত বড়ো গুণী লোকটা শুধু চাপরাসি কেন?
- ডিগ্রী নেই যে! ক্লাস ফোর পাস। এদিকে উর্দুর একটা অথরিটি। গোটা সেক্রেটারিয়েটে সবার স্পীচ কে লেখে? করামাত খান। ডিগ্রী থাকলে গিদ্ধড়্ আজ নিজেই বিরাট অফিসার হয়ে যেত। এক্স-ওয়াই-জেড ট্যালেন্টটা চিনতে পেরে বম্বে থেকে ছিনিয়ে এনে চাপরাসির চাকরি দিয়েছে। চাপরাসির টুলে বসে স্পীচ লিখে লিখে তার দশ গুণ রোজগার। গুলমোহর পার্কে ফ্ল্যাট কিনল এই বছর। আশাদি আবার একটা সিকি পানের মিনি-খিলি বের করতে করতে বললেন।
- কিন্তু এই উস্তাদজী আমাদের নাটকটা কি এক রাতে ঠিক করতে রাজি হবেন?
- এক্স-ওয়াই-জেড বললে নিশ্চয়ই হবে। প্রশ্ন হল আপনি কি তাকে দিয়ে কাজটা করাতে চান? বসে ভাবুন। আমি একটু পরে আসছি।
চলে যেতে উদ্যত আশাদিকে ধরার জন্য সত্যা স্যর তাড়াতাড়ি সীট ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ভূমিকার কোলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। বেচারার চোখ থেকে চশমাও ছিটকে গেছে। আশাদি বিশুদ্ধ বাংলায় ‘ষাট ষাট’ বলতে বলতে সত্যা স্যরের বগলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তাঁকে তুলতে যাবেন, এমন সময় ভূমিকা আশাদিকে সরিয়ে নিজে কাজটা করার জন্য উঠতে গেলেন। তারপর একটা হাস্যকর ব্যাপার। ভূমিকা ছিব্বরের শরীরটা ভারী, হাত-পা-গুলো কুস্তিগীরদের মতো। নীচ থেকে সেই ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা খেয়ে হালকা-পলকা সত্যা স্যরের শরীরের জাহাজ চটি পরা পায়ের পাল সমেত শূন্যে উঠে গেল।
ভূমিকা ভুল বুঝতে পেরে বললেন – ধ্যাৎ তেরে কি!
পাশ থেকে বিধুর ঠোঁটকাটা সহকারী গোয়েল বলল – অ্যায় লো জী! দোনোঁ নে মিলকর স্যরজী কী অর্থী উঠা দী!
বাকিরা সবাই খিক্ খিক্ করে হাসতে লাগল।
সত্যা স্যর আশাদির হাতে ঝুলতে ঝুলতে বললেন - যেও না আশা। ভাবাভাবির সময় নেই। তুমি লোকটাকে রাজি করাও। এক্স-ওয়াই-জেডের পরামর্শের উপর আমার বিশ্বাস আছে। আই-এ-এস অফিসাররা কাঁচা কাজ করে না।
- আপনি অ্যাবসোলিউটলি শিওর? করামাত খান কাজটা করে দিলে আপনি সেটা গ্রহণ করবেন? আশাদি সত্যা স্যরকে সাবধানে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বললেন।
- সময়মতো পেলে মাথায় করে নেব আশা। এক্ষুনি ফোন করে দাও।
আশাজী ‘এক মিনিট’ বলে চলে গেলেন আবার।
আমি ভাবছিলাম এই গিদ্ধড়্ লোকটা কি আসলে আছে, না আশাদির বর একটা গল্পের চরিত্র বানিয়ে দিয়েছে? যা-ই হোক না কেন, তার নাম শোনার পর ভূমিকা একটু দমে গেছেন। দাঁত কিড়মিড়ও বন্ধ।
আশাদি সোজা গিয়ে নিজের ঢাউস ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে আবার ফিরে এসেছেন। সত্যা স্যরকে বললেন – দেখুন, স্ক্রিপ্টের বারোটা কপি ব্যাগে আগে থাকতেই ছিল। ভুলেও ভাববেন না যে আপনি নিজে থেকে না চাইলে আমি এগুলো দেখাতাম। আজ দুপুরে গিদ্ধড়্কে দিয়ে লেখানো হয়েছে। পাঁচটা কপি আছে পাঁচজন মেইন চরিত্রের জন্য, যাঁরা সবাই সিনিয়ার। যদি আপনাদের পছন্দ হয় আজকে তিন ঘন্টা রিহার্স করিয়ে দিন। বাকি সাতটা কপি সাতজন পার্শ্বচরিত্রর হাতে ধরিয়ে বলুন পড়ে আসতে। ওদের পরিবর্তনগুলো মাইনর। কাল পর্শু একটু প্র্যাকটিস করিয়ে দিলেই হবে।
কপিগুলো হাতে নিতে নিতে সত্যা স্যর বললেন - মাই গড, আশা। বলে বোঝাতে পারব না কীরকম কৃতজ্ঞ বোধ করছি! দরকার হলে ইণ্ডিয়া গেটের আলোতে চোখের বারোটা বাজিয়ে রিহার্সাল করব আজ।
- তা করবেন কেন? বলে রেখেছি, হল্ রাত নটা অবধি খোলা থাকবে। তার পর সবাইকে সেফলি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ি আসছে। ঠিক আটটার সময় আমি বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিঙ্ক্স্ পাঠিয়ে দেব। নিশ্চিন্তে এখানেই কাজ করুন স্যর।
- বি...রি...য়া...নি...?
- কেন? পছন্দ নয়? নিজামুদ্দীন থেকে হামিদের। আর সেই সঙ্গে থাম্স্-আপ!
পরে অনাথাশ্রমে পালিত সত্যা স্যর এমন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর চোখ দিয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে দরদর করে জল পড়তে দেখেছিলাম আমরা। এমনকি ভূমিকা ছিব্বরও এরকম একটা ফল আশা করেননি নিশ্চয়ই। এতগুলো ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ির জন্য বিরিয়ানি আসবে শোনার পর সবার মতো তাঁর মুখটা কোমল আর আপ্লুত হয়ে এসেছে দেখলাম।
- তুমি কি আগের জন্মে আমার মা ছিলে আশা? সত্যা স্যরকে আমি আশাদির কাছে গিয়ে বলতে শুনি।
আশাদি সস্নেহে সত্যা স্যরের হাত ধরে বলেছিলেন - স্যর আমি কিছুই করিনি। এক্স-ওয়াই-জেড প্রবলেমটা আবিষ্কার করার পর নিজের টিম লাগিয়ে স্ক্রিপ্টের ফুল্ অ্যানালিসিস্ করিয়ে নিয়েছিল কাল রাতে। সকালে করামাতের সঙ্গে মীটিং বসে। সে বলেছে চল্লিশ বছর আগে সেম গল্প একটা মারাঠি সিনেমাতে ব্যবহার হয়েছে। সেই সিনেমার হিরোইনের যক্ষ্মা হয়েছিল। করামাতের মতে যাঁহা যক্ষ্মা, তাঁহাই ডাউরি, আবার তিনিই কিডনি। গুড়দা নিয়ে কুড়ি পঁচিশটা জোক নাকি যে বছর জয়প্রকাশ নারায়ণজী পর্লোকে যান সেই বছর থেকে তার মাথায় ঘুরছে। কোথাও ব্যবহার করতে পারেনি বলে ফ্রাস্ট্রেশানে তার নিজের কিডনিদুটো আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এই সুযোগটা পেয়ে সে এমন খুশী হয় যে দুপুরের মধ্যে লেখা কম্পপ্লিট। দহেজকে স্টোরিতে এমন টেস্টফুলি এনেছে যে সব বাবা-মা’র ইচ্ছে হবে মেয়ের বিয়েতে তিজোরি খালি করে দেয়। লাজপতজী তো আপনার কেনা হয়ে যাবেন।
- ইট্স্ এ মির্যাকল্!
- মির্যাকল্ টির্যাক্ল্ কিছু নয় স্যর। জাস্ট গুড প্ল্যানিং। একটু আগে যা বললেন আর কি। আই-এ-এস অফিসাররা কাঁচা কাজ করে না।
আশাদি চলে যাওয়ার পর ম্যাথু আমাদের দিকে সরে এসে দাঁত খেঁচানো হাসি হাসতে হাসতে বলল – কক্ অ্যাণ্ড বুল্ স্টোরি। চাপরাসি কখনো ফিল্মের ডায়লগ লেখে? বা গুড়দার জোক বলতে না পেরে কারো গুড়দা খারাপ হয়?
- তাহলে কে লিখেছে? পম্পা তার প্রজাপতির ডানার চেয়ে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল।
- আবে, আধ ডজন আই-এ-এস অফিসার এক সঙ্গে লাঞ্চে বসে হে হে করতে করতে লিখে দিয়েছে। আমি দেখে এসেছি, ওদের অফিসে বেশির ভাগই সাউথের, হিন্দী জানে আমার চেয়েও কম। এই স্ক্রিপ্ট থেকে সাম্ভর আর বড়ার গন্ধ আসবে।
- আশাজী এত বড়ো মিথ্যে বলতে পারেন না।
ম্যাথু আর তেমন আস্তেও কথা বলছে না। সে বলল – কেন পারবেন না? কত আর খারাপ হবে লেখাটা? সত্যা স্যরের লেখা জোক কীরকম জানিস না? শ্বশুরজী দহেজ হিসেবে জামাইকে একমুঠো বোঁদে ধরিয়ে নিজের হাতটা তার শেরওয়ানীতে মুছতে যাচ্ছে। জামাই বলল – বাবুজী, নতুন শেরওয়ানীটাকে তো ছেড়ে দিন। তখন শ্বশুর রস মাখা হাতটা দেখিয়ে বলছে – ‘এটাই তোর দহেজ বেটা। কোথায় নিবি তাহলে? তোকে সবটা দিয়ে তবে তো বোঁদেগুলো ফেরত নেব’। ছিব্বর ছিঁড়ে না ফেলে দিলে এটা নির্ঘাত স্ক্রিপ্টে যাচ্ছিল।
ম্যাথু যাই বলুক, গিদ্ধড়্ নামটা আমার অপুর্ব লেগেছিল। আমি মনে মনে তার একটা ভাবমূর্তি এঁকে রেখেছিলাম। ছ-জন আই-এ-এস অফিসার নয়, সেই মূর্তি ছাই রঙের ইউনিফর্ম পরা একটা একলা আর হাড়-জিরজিরে চাপরাসির। সেক্রেটারিয়েটের বারান্দায় টুলের উপর বিরাট সাদা গোঁফ ঝুলিয়ে বসে সে পান খাচ্ছে আর কানে গোঁজা পেন্সিল হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে তার ছোট নোটবুকে লিখছে। ফাইল ডেলিভারি করার সময় সে এক আধটা ডায়লগও ডেলিভার করে আসে।
আমি আর পম্পা বিরিয়ানির জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। বাড়িতে পম্পার মা চিন্তা করবেন। আশাদির সঙ্গে আমরাও বেরিয়ে আসছিলাম। আশাদি পম্পার হাত ধরে বললেন – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আয় মুন্নি। এই ছেলেটাকেও নিয়ে আয়। ওকে আমরা দুজনে মিলে নাচ শেখাব।
- আশাদি, জয় তখন থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে গিদ্ধড়ের সঙ্গে আলাপ করবে।
আশাদি একটুও চিন্তা না করে আমার দিকে ফিরে বললেন – সত্যি নাকি? খুব খুশি হবে করামাত। তুই শো-য়ের দিন অলঙ্কার হলে চলে আয়। ওখানে থাকবে সে। দেখা করিয়ে দেব।
আশাদি আর পম্পার মধ্যে কানে কানে কী একটা কথা হল আর আশাদি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নিজের পথে চলে গেলেন।
আশাদি চলে যাওয়ার পর আমি পম্পাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – তোমাকে উনি কী বলছিলেন?
পম্পা বলল – কী আবার? বললেন, ছেলেটা তোর কে হয়?
- এই রে! তো তুমি কী বললে?
পম্পা তার হি-হি হাসিটা দিয়ে বলল – রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি।