• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Shakti Chattopadhyay | প্রবন্ধ
    Share
  • যতিচিহ্নের শক্তি: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহার ও প্রয়োগ : রাজদীপ রায়



    বাক্য রচনা করতে গেলেই পড়বার দমের সাপেক্ষে যতিচিহ্নের প্রয়োজন হয়। একটি লেখা পড়তে গেলে (সেটা মনে-মনে হতে পারে কিংবা জোরে উচ্চারণ করে) থামতেই হবে এবং তখনই বাক্যের শরীরে আত্মার মতো জেগে উঠবে যতিচিহ্নের উপস্থিতি। কোনো অতিলৌকিক বিষয় নয়, বরং বাংলা গীতিকবিতার মর্মে যতিচিহ্নের চেতনা প্রাকৃত ও প্রকৃত আত্মার যৌক্তিকতা হয়েই প্রথম থেকে অনিবার্য হয়ে থেকেছে। তবু আলগোছে চোখ পড়লেও তাকে নিয়ে পৃথক আলোচনার অবসর গড়ে ওঠেনি তেমন। তার চেয়ে বরং নজর পড়েছে ছন্দের রীতিকৌশলের ওপর, অলংকারের অভিনবত্বের দিকে। তবে সে-সব দীক্ষিত কতিপয় পাঠকের বিষয়। বাংলা কবিতাপাঠকের বৃহত্তর অংশই এসব খতিয়ে দেখতে চান না। যতিচিহ্ন তাই আম কবিতাপাঠকের কাছে উপেক্ষার ব্যাপার। কিন্তু সচেতন লেখকমাত্রেই যতিচিহ্ন ব্যাবহারের ক্ষেত্রে যত্নশীল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, এই দৃষ্টিভঙ্গি ও লিখন-কৌশলের সূক্ষ্মতা মাথায় রেখে পড়লে, তার নানাপ্রকার ঐশ্বর্য প্রকাশ্যে আসে; আসে তার প্রয়োগবৈচিত্র্যর দিকগুলি। বাংলা ভাষায় যতিচিহ্নর ব্যবহার বা প্রয়োগ নিয়ে পাঠকের সচেতনতা নেই কেন? কেন তার ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে যতিচিহ্নর অধ্যায় সবশেষে আসে? অথচ বাংলা গদ্যচর্চাকে কেন্দ্র করে যতিচিহ্নর পূর্ণাঙ্গ বাবহার শুধু বাংলা গদ্যকেই সমৃদ্ধ করেনি, বাংলা কবিতাকেও মধ্যযুগব্যাপী এক দাঁড়ি, দুই দাঁড়ির ব্যবহার থেকে বাঁচিয়ে তার মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছে। যতিচিহ্নকে স্বেচ্ছাচারের সঙ্গে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিভিন্ন লেখায় চোখে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বিদ্বজনকে যতিচিহ্নর ইচ্ছেমতো ব্যবহারের নিদান দিতে লক্ষ করা যায়। বাংলা বানান নিয়ে কিন্তু এতটা অশিক্ষার প্রতিফলন দেখা যায় না। কিন্তু যতিচিহ্ন প্রয়োগের বেলায় ব্যক্তির স্বেচ্ছাচার এতটাই বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তখন স্বাভাবিক ব্যাকরণ-বোধ লুপ্ত হয়ে ভাষার বারোটা বেজে যায়। সবাই তো আর স্বাধীনতা নেওয়ার যোগ্য নন!

    মনে হতেই পারে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিকৃতির মধ্যে যতিচিহ্নর আনাগোনা লক্ষ করতে গিয়ে যতিচিহ্ন নিয়ে অহেতুক আশঙ্কা প্রকাশের কারণটা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু একেবারে সচেতনভাবেই, জেনেশুনে, ভুল করে, গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করবার চিরায়ত স্তুতিমূলক আলোচনার প্রদেশে ভাষার অভিমুখকে সামনে রেখেই এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা করা হল। কেননা শক্তি স্বয়ং নিজেকে কবিতায় স্বেচ্ছাচারী বললেও, যতিচিহ্ন প্রয়োগে তাঁর সুচিন্তিত পদক্ষেপ এ-কথাই জানায়, জাত-কবির ব্যাকরণবোধ থাকে, থাকতে হয়। ‘বোধশব্দ’-এর ‘যতিচিহ্ন’ সংখ্যায় নীলাদ্রিশেখর দাশ আধুনিক বাংলা ভাষায় যতিচিহ্ন ব্যবহারের সংখ্যাতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিশ্লেষণ নিয়ে প্রণিধানযোগ্য আলোচনা করেছেন। সেখানে স্পষ্টতই জীবনময় রায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির উদাহরণ টেনে বলেছেন:

    রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনার বিরুদ্ধে গিয়ে যতিচিহ্নর ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করবেন এবং সেগুলির ব্যবহারিক ভাষাতাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করবেন, এমন সম্ভাবনা সেকালের সমাজে ছিল বলে মনে হয় না। ফলে লিখিত বাংলায় যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, ব্যবহার করার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, এগুলির ব্যবহারে অন্য ভাষার বা দেশি পণ্ডিতদের কোনো অবদান আছে কি না, ব্যবহার না শিখলে ভাষাটিকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে সুবিধা বা অসুবিধা হবে কি না—এইসমস্ত বিষয় নিয়ে কেউ কোনো আলোচনা করার চেষ্টাই করেননি।
    ষে-কারণেই জটিলতা বেড়েছে। অবজ্ঞা বেড়েছে। অমনোযোগ কম কিছু নয়। এইসমস্ত পেরিয়ে তো কোনো টেক্সটের রিডিং নেওয়াই সম্ভব নয়, তা সে গদ্য হোক কিংবা পদ্য। পদ্যের নিবিষ্ট পাঠকমাত্রেই জানেন, পদ্যের গলিঘুঁজি কিঞ্চিত্‍ বিস্তৃত ও অভিসন্ধিময়। প্রতিটি শব্দের থাকা না-থাকা যেখানে সংকেত, স্পেস বা স্পেসের অভাব যেখানে কবিতার আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত, যতিচিহ্নগুলিকে কি তুমুল হেলায় ‘নোকর-চাকর’ বানিয়ে দেওয়া যায়?

    শক্তির কবিতায় কোনো ক্রোনোলজি মেনে নয়, বরং চলতে-ফিরতে তাঁর কাব্য-সংকলনের ভেতরে যেমন প্রবণতা দেখতে পাবো, তাকেই সরাসরি তুলে আনা হবে তার যতিচিহ্ন-গত ব্যবহারের তাত্‍পর্যে। প্রথমেই মনে পড়ে ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’ কবিতাটির কথা। যতিচিহ্ন ব্যবহারের জন্যে নয়, নামকরণের জন্যে। কবিতার এরকম কোনো লাইন দিয়ে নামকরণ শক্তির কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে কবিতাটি পড়লে এর যতিচিহ্ন-ব্যবহারের অভিনবত্ব চোখে পড়ে। অভিনবত্বটি এই: কবিতার চারটি স্তবকের শেষ লাইনে একমাত্র যতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়ির ব্যবহার। দাঁড়ির ব্যবহার না বলে দাঁড়ির অপেক্ষা বলা যেতে পারে। কেমন সেই প্রথম স্তবক? একবার দেখে নেওয়া যাক:

    দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত
    কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে
    চরের বালিতে তাকে চিকিচিকি মাছের মতন মনে হয়
    মনে হয় হৃদয়ের আলো পেলে সে উজ্জ্বল হতো।

    একটিই প্রসঙ্গ চলেছে: তবে তার জন্যে যতিচিহ্ন ব্যবহার এমনটা হবার কোনো কারণ নেই। প্রথম ও তৃতীয় লাইনের শেষে কমা অন্তত বসতেই পারতো। কিংবা প্রথম লাইনের শেষে জীবনানন্দীয় ঐতিহ্য মেনে একটি ড্যাশচিহ্ন প্রয়োগে বাকি কবিতার যাত্রা সূচনা করতেই পারতেন তার মনন-সন্তান শক্তি। সেসব কিছুই না-করে বরং তিনি স্বাভাবিক রীতিনিষ্ট একটি কবিতায় বৈচিত্র্য আনলেন যতিচিহ্ন না-ব্যবহারে। তিনি প্রথম তিনটি লাইনে কোনো যতিচিহ্ন বসালেন না, এবং এই তিনটি লাইনের যোগসূত্র তৈরি করলেন প্রথম লাইনের শেষ ও দ্বিতীয় লাইনের শুরুর মধ্যে রিপিটেশন রেখে। আশ্চর্যের কথা, যে রিপিটেশন প্রকরণগত ত্রুটি, তাকেই শক্তি কবিতায় ব্যবহার করলেন এই যতিচিহ্নহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ-কারণেই প্রথম লাইনের শেষ আদতে দ্বিতীয় লাইনের শুরু, তৃতীয় লাইনের শেষ থেকেই চতুর্থ লাইনের শুরু। এর মাঝখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনের শেষ ও শুরুর মধ্যে যে ইচ্ছাকৃত অমিল রাখা হল, তা এই বৈচিত্র্যর কারণেই। দেওয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র পুড়ে যাওয়ার পদ্ধতি সারারাতের অসীম দীর্ঘতা পেয়েছে, দিনের আলো ফুটে গেলেও রাতের অন্ধকার তো অবিনশ্বর; এ-প্রসঙ্গে কথা শেষ হয়নি বলেই পরের লাইনে ওই প্রথম লাইনের বাক্যের অংশ টেনে তিনি জানিয়েছেন কাল সারারাত ধরে নক্ষত্রর ‘পাখা’, অর্থাত্‍ দেহাবশেষ টুকরো-টুকরো হয়ে ঝরে পড়েছে। এবং এই প্রক্রিয়াটি যে অসীম একটি পদ্ধতি যা ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়েছে। চরের বালিতে পড়ে থাকা সেই দেহাবশেষকে মাছের মতন মনে হচ্ছে। প্রসঙ্গ একই থাকলেও অনুষঙ্গ পালটে গেল। আকাশের কবিতা নেমে এল মাটিতে। দ্বিতীয় লাইনের শেষে তাই পর্ব বিভাজক একটি কমা বা সেমিকোলন আসতেই পারতো। কিন্তু শক্তি আকাশ ও মাটিকে একটি বন্ধনীর মধ্যেই রাখতে চাইছেন তার অখণ্ড অভিজ্ঞতায়। সে-কারণেই তার মনে হচ্ছে যদি নক্ষত্রের ওই পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ, যা ক্রমশই আলো হারিয়ে ফেলছে, তাকে যদি হৃদয়ের আলো দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেতে পারতো (সে উজ্জ্বল হতো)। এই পুরো রূপকল্প কবির কাছে ছেদহীন একটি পদ্ধতি। সে-কারণে বাক্য নয়, অর্থবোধ নয়, রূপকল্প পরিণতি পাবার পরেই তিনি সর্বোত্তম যতিচিহ্ন ব্যবহার করেছেন--দাঁড়ি। এখন, দাঁড়িই কেন? তাহলে কি বাকি কবিতার সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই? পরের অংশ কি শুরু হয়েছে অন্য কোনো প্রসঙ্গ দিয়ে? কী সেই প্রসঙ্গ? দূর থেকে নক্ষত্রের তামাম উইল বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে থাকে, সেও-তো বাগানেই। এরপর কবিতার প্রতিটি স্তবক শেষেই দাঁড়ি বসে। বক্তব্য-প্রধান কোনো কবিতায় এর চেয়ে ভানহীন যতিচিহ্ন আর কী-ই বা হতে পারে?

    ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়’ শক্তির অন্যতম জনপ্রিয় ও চর্চিত কবিতা। কৃত্তিবাসের মিথ হয়ে যাওয়া দিনগুলোর, রাত জেগে কলকাতা শাসন করবার দিনগুলোর একটা চেনা নির্যাস মেনেই কবিতার লাইনগুলো এলোমেলো। মাতাল একটা লোক বাড়ি ফিরছে বা কোথায় ফিরছে আদৌ জানে না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করার জন্যেই দেওয়ালের সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে যাচ্ছে, কার্নিশের সঙ্গে কার্নিশ। এই যে বাড়ির ভিতর বাড়ি, পায়ের ভিতর পা, বুকের ভেতর বুক পেরিয়ে কবিতা চলে যাবে হৃদয়ে শুধুমাত্র একটি সন্দেহজনিত প্রশ্নে—“আর কিছু নয়—(আরো অনেক কিছু?)”, প্যারেনথেসিসের অমোঘ ব্যবহার এইজন্যে, যে-মানুষটা দ্রষ্টা, তার সামনের জগত বাস্তব-অবাস্তবের দোটানায় দ্বান্দ্বিক। সে-কারণেই বুকের ভেতর যে অবধারিত হৃদয়ের কথা আসবে, মনের কথা আসবে, সেই মনের প্রসঙ্গে চেপে গিয়ে একটি সন্দেহজনিত প্রশ্ন উঠে এলো প্যারেনথেসিস সহযোগে; যাকে এই দ্রষ্টা স্বীকার করতে চাইছে সম্মুখে ‘আর কিছু নয়’—এই বলে, তা-কি সত্যিই কিছু নয়? না কি ‘আরো অনেক কিছু?’। ড্যাশচিহ্ন থেকে প্রশ্নচিহ্নে এই যাতায়াত কবিতার অভিলক্ষই পালটে দিল। শুধু তাই নয়, ‘আর কিছু নয়—‘-এর শরীরী, সামাজিক স্থির সিদ্ধান্ত যখন অন্তর্মুখী ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দিল( আর কিছু নয়?), তখন সেই আরো কিছুর ব্যাখা হিসেবে আবার দ্রষ্টার কনফিউশন ফিরে গেল একই বক্তব্যের আবর্তনে। কিন্তু দ্রষ্টা যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, তা সত্য নয়; সত্যের ভান। সে-কারণে নিজের কথা চাপিয়ে দিচ্ছেন ‘তুমি’-র বহুল ব্যবহৃত সর্বনামে। এই ‘তুমি’ আর ওই দ্রষ্টার মধ্যে খুব কিছু পার্থক্য আছে কি? ‘হ্যাণ্ডস আপ’-এই শব্দবন্ধের পর প্রত্যাশিত ছিল বিস্ময়চিহ্নের ব্যবহার। শক্তির স্বকণ্ঠে যারা পাঠ শুনেছেন, সেখানেও তিনি যেভাবে এই শব্দবন্ধ পড়েছেন, নিশ্চিত বিস্ময়চিহ্নই বসা উচিত। তাহলে কথা ও কাজে ফারাক হল কেন? শক্তি আদতে বিস্ময়চিহ্নটি লুকিয়ে ফেললেন। এবং তাকে নিয়ে গেলেন এই কবিতার পরবর্তী এমন এক স্থানে, যেখানে এর ব্যবহার অমোঘ ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ হয়ে উঠল। হ্যাণ্ডস আপ—বলে কালো গাড়ির ভেতরে আবার কালো গাড়ি, এই পর্যন্ত দেখা দ্রষ্টার আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। সেখানে দৃষ্টিবিভ্রম প্রথম স্তর পেরিয়ে, দ্বিতীয় স্তর পর্যন্তই যেতে পেরেছিল। এখানে তৃতীয় স্তরে চলে গেল ভাবনার গাঢ় বৃত্ত। দৃষ্টির অন্তর্মুখী অনিবার্য তেজ দ্বিতীয় স্তর ভেদ করে তৃতীয় স্তরে আবার কালো গাড়ি দেখতে পেলেন। এমনকি সেই ত্রিস্তরে গিয়ে দ্রষ্টা দেখছে ‘সারবন্দী জানলা’, ‘দরজা’, ‘গোরস্থান’, ‘ওলোটপালোট কঙ্কাল’, এখানেও না-থেমে তার দৃষ্টির অন্তর্ঘাত তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে কঙ্কালের ভেতর শাদা ঘুণ, ঘুণের ভিতরে জীবন, জীবনের ভেতরে মৃত্যু। দীর্ঘ পর্যায় এইভাবে অন্তর্দৃষ্টি কর্ষণের ফলে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন: “মৃতুর ভিতরে মৃত্যু/ আর কিছু নয়!”। কবিতার অন্তরঙ্গ পাঠে এই পর্যন্ত পৌঁছে অভিভূত হয়ে যেতে হয় একটি চিহ্নের কাছে। পাঠক যেন এই চিহ্নের অমোঘ ব্যবহারে পৌঁছবেন বলেই ওই দ্রষ্টার সঙ্গে হেঁটে আসছিলেন। যে বিস্ময়চিহ্ন বসবার কথা ছিল ‘হ্যাণ্ডস আপ’-এর পর, তাকে কবি প্রত্যাশিত ক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়ে গেলেন অপ্রত্যাশিত ক্ষেত্রে। কেন এই চিহ্ন অমোঘ হয়ে উঠল? ওই দ্রষ্টা আগে জানতেন না, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। জীবনের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে যখন সে বিপর্যস্ত, পীড়িত, মুগ্ধ, অভিভূত অবস্থায় শেষ লগ্নে পৌঁছয়, তখন সে এই সত্য আবিষ্কার করে—জীবনের ভিতরে মৃত্যু। এই সত্যই তাকে আরেকটি মহতী জীবনসত্যের দিকে নিয়ে যায়--যদি জীবনের ভেতরে মৃত্যুই শেষ সত্য হয়, তাহলে মৃত্যুর ভিতরেও সেই অনন্ত মৃত্যুর বোধই মিশে থাকবে নিশ্চয়ই, যে-বোধ শক্তির একার, যে-বোধ আবার শক্তির একার নয়; অবশ্যই তিনি এই চিন্তনের উত্তরাধিকার পেয়েছেন জীবনানন্দের কাছ থেকে। এই সত্যের আবিষ্কার তাকে সর্বভূতে রোমাঞ্চিত করলো। সে-কারণেই ‘আর কিছু নয়’ এই কয়েনেজ শব্দবন্ধের পরে সেই লুকিয়ে নেওয়া বিস্ময়চিহ্নটি প্রকাশ্যে এলো। আশ্চর্যের বিষয়, শক্তি নিজেও কিন্তু এই কবিতা পাঠ করবার সময় এই সত্যটি পাঠকের কাছে রেখে জাননি। কবিতার পাঠ তো দু-রকম, এক—শ্রোতা হিসেবে তাকে শোনা, অদৃশ্য চিহ্নগুলো উপলব্ধি করা। অন্য ক্ষেত্রে সেই কবিতার দৃশ্যরূপ প্রত্যক্ষ করা এবং তাকে পাঠ করা। একটি শব্দবন্ধকে আশ্রয় করেই (আর কিছু নয়) তিনি যতিচিহ্নের বিবর্তন হল। ড্যাশচিহ্নের নিশ্চয়তা পেরিয়ে, সন্দেহসূচক প্রশ্নচিহ্নের মাধ্যমে সুবৃহত্‍ জীবন জিজ্ঞাসার শেষ প্রান্তে পৌঁছে প্রকৃত সত্য জানবার বিস্ময়বোধ-এইভাবে বিস্ময়চিহ্নের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে সম্পন্ন হল।

    দাঁড়ির থেকেও বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে কমা-র। একটি পূর্ণবাক্য থেকে আর একটি পূর্ণবাক্যের দিকে যেতে গেলে বাকস্পন্দ ও দমের কারণে কমা-র সাধারণ ব্যবহার হয়ে থাকে। দেখতে গেলে, সংবাদপত্রের গদ্যে বা অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে কমা, দাঁড়ি ও প্রয়োজনভেদে প্রশ্নচিহ্নর ব্যবহারেই কাজ মিটে যায়। কবিতার চলনে কখনো সেই বহু ব্যবহারে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া কমা--বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবিতার সত্যে’র প্রথম দুটি লাইন শুরু হচ্ছে এভাবে:

    কবিতার সত্যে আমি একঝলক মিথ্যের বাতাস
    লাগাই, কী পালটে যায় কবিতার সত্য একদিনে

    কবিতার লাইনে কমা প্রধানত অর্ধযতিপাতের সরলরৈখিক ব্যবহারে দেখা যায়। এক্ষেত্রে তাহলে ‘কবিতার সত্যে আমি’-র পর নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক বক্তব্যের সামান্য বিরতি মেনে কমা হয়। আবার শুধু শক্তি বলে নয়, এই প্রত্যাশিত কমা অনেকেই বসান-না অতি ব্যবহারের কারণে। আঠারো মাত্রার এই অক্ষরবৃত্তে আট মাত্রার পর অর্ধযতি পড়বে, তারপর বাকি দশমাত্রার পর পূর্ণযতি, অর্থাত্‍ দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ। কিন্তু এই লাইনে সে-কমা নেই। এমনকি লাইনের শেষে দাঁড়ি কিংবা কমা কিছুই পড়েনি। কিন্তু কেন? কেন এই কবিতার প্রথম লাইন যতিচিহ্ন ছাড়া হল, কেন বসল-না কোনো কমা বা দাঁড়ি, তার উত্তর রয়েছে পরের লাইনের প্রথম শব্দেই। লাগাই, এবং তারপরে একটি দূরদর্শী কমা। এই কমা-র জন্যেই আগের লাইনটি পড়তে হবে ওই মাঝের থামা বাদ দিয়েই। যতিচিহ্ন ছাড়াই, এমনকি ওই অর্ধযতির প্রত্যাশিত নিয়ম মেনে কখনোই থামা যাবে না একটুও। নির্ভুল পড়তে গেলে প্রথম লাইনে কোনো শব্দের থেকে কোনো শব্দে দূরত্ব রাখা যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে এ-কথাও, লাইনের শেষে কোনো যতিচিহ্ন প্রয়োগ হয়নি। সেই যতিচিহ্ন বসছে পরের লাইনের প্রথম শব্দের পরে। তাহলে কবিতাটা পড়ব কী করে? কবিতার সত্যে আমি একঝলক মিথ্যের বাতাস লাগাই,-- এভাবে। তাহলে লাগাই আগের লাইনে গেল না কেন? গেলে ছন্দ নষ্ট হত, প্রধান কারণ তো সেটাই। এবং তার সঙ্গে এটাও জরুরি বিষয়, লাগাই-এর পরে কমার ব্যবহার। লাগাই কিন্তু পরের লাইনের প্রথম শব্দ। তাহলে বাকি লাইনে কী আছে? “...কী পালটে যায় কবিতার সত্য একদিনে”। কবিতা তো সত্যস্বরূপ—একথা পূর্বজ্ঞান। সেই পূর্বজ্ঞানকে শক্তি বিভ্রান্ত করছেন সত্যির মধ্যে মিথ্যেকে আনতে চেয়ে। প্রথম লাইনটি, একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য হলেও শেষে যতিচিহ্ন না-বসায়, শেষ হয়নি। শেষ হয়েছে পরের লাইনের প্রথম শব্দের পর এসে—ওই কমার সাহায্যে। প্রথম লাইনের বাচ্যার্থ এই বক্তব্য জানায়, কবি নিজেই সেই মিথ্যের বাতাস। কিন্তু পরের লাইনে এসে বোঝা গেল কবি সেই মিথ্যের বাতাস কবিতার সত্যশরীরে বুলিয়ে দেবেন। এই কমা এখানে বসল বলেই এরপরের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এভাবে, মিথ্যের বাতাস কবিতার সত্যে লাগানোর জন্যে কবিতার সত্যিই পালটে যাচ্ছে একদিনে। চেনা কবিতা হয়ে যাচ্ছে অচেনা কুহকে পরিপূর্ণ।

    সন্দেহ ও প্রশ্নের বিষয়টি পরস্পরের আত্মীয়। অনেক প্রশ্নচিহ্নর মধ্যেই সন্দেহ থাকে। আবার সন্দেহ ও প্রশ্নের সঙ্গে থাকে বিস্ময়। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’-র ৬৮-সংখ্যক কবিতায় অষ্টক ও ষষ্ঠকের বিভাজনে প্রশ্ন ও বিস্ময়চিহ্নের অবিরাম খেলা চলেছে। প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয়েছে কবিতা: “এ কি আলিঙ্গন?”, এই প্রশ্নচিহ্নর উসকানি দিয়ে দিয়ে যে কবিতা শুরু হল, এর পরের লাইনেই পূর্ণযতি দাঁড়ির ব্যবহারে তার সম্ভাব্য উত্তরের প্রস্তাবনা বক্তব্য হয়ে পর-পর সজ্জিত হল। বাক্য, জ্ঞান, প্রয়োগনৈপুণ্যের, ধর্মের কথা ও তাড়ন একের পর এক লাইনে পুরো অষ্টক জুড়েই তার অস্বস্তি জানালো। অষ্টকের সঙ্গে ষষ্টকের সম্পর্ক তৈরিই হল প্রশ্নচিহ্ন থেকে বিস্ময়চিহ্নর পরিবর্তনে। এ যদি আলিঙ্গন হয় কিংবা না-হয়, তাহলে কী কী, তার একটা সন্ধান আমরা প্রথম আটটি লাইন জুড়ে দেখলাম। কবিতার দ্বিতীয় অংশে এসে কি বক্তব্য খুব কিছু পালটে গেল? পালটে গেল যতিচিহ্নর ব্যবহার। প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে যে-কবিতার শুরু হয়েছিল, তার অন্যতর মাত্রা এলো প্রশ্নচিহ্ন বিস্ময়চিহ্নে রুপান্তর হওয়ায়। এ কি আলিঙ্গন—এই শব্দবন্ধে যে প্রশ্নাতীত সন্দেহ উত্পন্ন হল, তাই বিস্ময়ের পর আবার বিস্ময়। ‘এ কি সভ্যতার জড়ানো চণ্ডালে আশিরগোড়ালিনখ!’, এরপর তো আবার উত্তর খোঁজা, তাই মানুষের গ্রাস টেনে নিয়ে অনিঃশেষ বেঁচে থাকবার মধ্যে যে ‘অনৈসর্গিক কাম’ প্রেরণা যোগায়, যে-কোনো উন্নত সৃষ্টির অন্তরালেই থেকে যায় তার সুস্থিত অবদমন, সেই তাড়নাই তো ঢের বেশি কাঙ্ক্ষিত শিল্পের কাছে। বিস্ময়চিহ্ন পেরিয়ে যখন এই উত্তর পেয়ে যাচ্ছেন কবি, তখন তার সন্দেহ পালটে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ জিজ্ঞাসায়। যার মধ্যে সন্দেহ তো নেই। বরং উত্তর খুঁজে পাওয়ার এক ধরনের স্বস্তি আছে। তাই কবিতার শেষ হচ্ছে যে জিজ্ঞাসায়, তা আদতে একটি উপলব্ধি। শুধু সেই বক্তব্যের মাঝখানে একটি ‘কি’ এনে, প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে, তাকে প্রশ্নের আকারেই উন্মুক্ত রাখলেন শক্তি পাঠকের কাছে। ‘শিল্প কি বিমূঢ়/ অনাসৃষ্টি আলিঙ্গন’, যা কি না একেবারেই সুস্থিত বাঁধা-গতের জীবনের বাইরের কোনো প্রণোদনা। যে-কারণেই শিল্পকে সমকামের বিরলতায় প্রতিষ্ঠিত করছেন কবি। এই কবিতা যখন লেখা হচ্ছে, তখন কি গিন্সবার্গ কলকাতায় এসেছেন? ‘চতুর্দশপদী’ কবিতাবলী’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে, আর গিন্সবার্গ এসেছিলেন ১৯৬২-তে। বিষমকামিতার প্রকাশ্য জীবনে ও চোরাগোপ্তা সমকামিতা সম্পন্ন একটি সমাজে থাকা একজন কবি যখন একজন উভকামী কবির সংসর্গে আসছেন, তখন কি গিন্সবার্গের জীবন ও কবিতা শক্তির শিল্প-বিষয়ক ধারণাকে প্রভাবিত করছে? সে-কারণেই অনাসৃষ্টি, অর্থাত্‍ সৃষ্টির বিরুদ্ধে এই আলিঙ্গন স্থাপিত হচ্ছে ‘পুরুষে-পুরুষে’। শিল্পের নতুন সম্ভাবনার কথাই বললেন শক্তি, এবং তাকে সম্ভব করতে হলে কবিকে বেছে নিতে হবে সত্যের ‘আগ্নেয় পথ’। হতে পারে সমাজের চিরকালীন অভ্যাসের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতে হল এই জন্যে। কবি নিজে প্রত্যয়ী। কিন্তু কবি পাঠকের কাছে উন্মুক্ত রাখতে চান এই ডিসকোর্স, তাই প্রশ্নচিহ্নের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়ল। একমাত্র যতিচিহ্ন ব্যবহারেই এই কবিতা প্রশ্ন থেকে উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবার প্রশ্নের ছদ্মবেশে নিজের সন্ধানকে সম্ভাবনাময় রেখে দিল।

    উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার হয় বিশেষ কোনো বক্তব্য বা নাম বোঝাতে। গদ্যে বা কথাসাহিত্যে মুখের উক্তির সাপেক্ষে উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার একটি পরিচিত পদ্ধতি। অনেকে আবার উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করেন না। তবে কবিতায় উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহারের বিষয়টা সচরাচর হয় না। অনেক কবিতাই এমন আছে, যেখানে প্রত্যক্ষ উক্তির ব্যবহারে পুরো কবিতাটা লেখা হয়েছে স্বীকারোক্তির ঢঙে; কিন্তু সেখানেও উদ্ধৃতির কোনো ব্যবহার রাখা হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ কবিতায় দুটি আলাদা উদ্ধৃতির ব্যবহার দুটি কারণে তাত্পর্যপূর্ণ। তীরে প্রচণ্ড কলরবের মধ্যে থেকেই সমবেত মানুষের কথা কোরাসের মতোই প্রথম স্তবক এবং পরের স্তবকে ফিরে আসছে। এটা কবির কথা নয়, সময়ের কথা, সমবেত মানুষের কথা। তাই বিশিষ্ট এবং উদ্ধৃতিযুক্ত। কবি তথা এই কবিতার দ্রষ্টা নিশ্চয়ই ওই সমাজেরই একজন, কিন্তু তবু এই কথা সকলের হয়ে তার। ওই ভেসে যাওয়া মৃতদেহটিকে কী অপরিসীম মায়ার চোখে দেখানো হয়েছে। রাজনীতির পথ কখনো অন্ধ হলেও যৌবনের এই অপচয় তো একজন গেরস্ত মেনে নিতে পারেন না; তাই এই প্রশ্ন কোনো দার্শনিক প্রশ্ন নয়, বরং ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনীর সঙ্গে এই সমবেত স্বরের সম্পর্ক আছে। এখানেও ওই মৃতদেহর বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে চাওয়া এই আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত জনতার প্রশ্ন তাই দার্শনিক উন্মার্গগামিতাকে পার করে গার্হস্থ্যরসে নিজের চোখের জল ভিজিয়ে নিয়েছে। এবং এখানে এই দুটি লাইন সময়ের সংলাপ, সে-কারণে কবিতার অতি আবশ্যক জরুরি অংশ। শুধু কবির ব্যক্তি-অনুভূতির কোনো সন্দর্শন নয়। এর পরের উদ্ধৃতিচিহ্নটি কাকে নিয়ে বসছে? সে কোনো ব্যক্তিমানুষ নয়। যে-প্রশ্ন ওই সমবেত জনতার পিতৃ-মাতৃ হৃদয় তুলেছিল, তার উত্তর দেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর মৃতের হয়ে উত্তর দেয় রাতের কল্লোল: ‘আমি স্বেচ্ছাচারী।’ওই ব্যক্তির স্বেচ্ছাচার, সময়ের স্বেচ্ছাচার, রাজনীতির স্বেচ্ছাচার সমস্ত এসে এই একটি বক্তব্যে স্থিতধি হয়ে পড়ে। এই বক্তব্য তাই বিশেষ এবং উদ্ধৃতিযুক্ত। পাঠকপ্রিয় ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতাতেও উদ্ধৃতিচিহ্নের প্রয়োগ হয়েছে এই নামকরণটি ঘিরেই। কেননা এই নামকরণ শব্দবন্ধ কবিতার মধ্যমণি। যখন নামকরণে রয়েছে, তখন যতিচিহ্ন-বর্জিত। যখন কবিতার প্রধান ভরকেন্দ্রিক লাইন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন উদ্ধৃতি ও প্রশ্নচিহ্ন সমেত। আর প্রশ্নচিহ্ন বসার কারণে যেমন এই লাইনটি হয়ে যাচ্ছে একটি আহ্বান, তেমনি সংশয় থাকছে এই প্রশ্নে এই ভেবে, অবনী বাড়ি আছে তো? শক্তির কণ্ঠে যারা এই কবিতার পাঠ শুনেছেন তারা জানেন এই তিনটি স্তবকে সন্নিবিষ্ট এই লাইনটি কখনোই একভাবে পড়া হয়নি। প্রশ্নে ক্রমশ সন্দেহের প্রলেপ পড়েছে।

    ‘ঝাউয়ের ডাকে’ কবিতায় সমুদ্র-তীরবর্তী পরিবেশের বিশ্বাসযোগ্য নির্মাণে যতিচিহ্ন সহায়ক হয়েছে। দলবৃত্তে লেখা এই কবিতার লিরিকধর্মী চলনে যতিচিহ্নর প্রয়োগ নেই প্রথম অংশে। প্রায় শেষের দিকে গিয়ে গতবছরের ভালোবাসার স্মৃতি যখন জেগে উঠছে মনের ভেতর, একাকিত্ব হয়ে উঠেছে আরো অসহনীয়। তখন মনে হচ্ছে:

    এখন সন্ধ্যা হয়েছে ঘোর, কেবল মেঘে-মেঘে-মেঘেই
                                                               দিন ফুরালো

    এই অংশের বিন্যাস এইজন্যে জরুরি, সঙ্গহীন প্রেমিকের আকুতির বিস্তার হয়েছে হাইফেন জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় আকাশব্যাপী মেঘের বিস্তারে। যতটা আলো কমবার কথা নয়, কমে এসেছে হঠাত্‍। পুরো আকাশজুড়েই মেঘ; সেই মেঘের বিস্তারকে চিত্ররূপ দিলেন শক্তি: ‘মেঘে-মেঘে-মেঘেই’, কী হল? দিন ফুরিয়ে গেল। ‘দিন ফুরালো’ কোথায় লেখা হল, ওই লাইনে না লিখে পরের লাইনের শুরুতে বা মাঝখানে নয়, একেবারে শেষে। ঠিক ওই ‘মেঘে-মেঘে-মেঘেই’-এর নীচে, ডানপাশে। দিনটা যেন ধ্বসে পড়লো অপেক্ষা করে করে। বিরহকাতর এই মানুষটি এখনো তার প্রিয় মানুষটিকে ভুলতে পারেনি। সে নেই তাই তার হাসিও ‘অবর্তমান’, অথচ সেই হাসিকেই অনুভব করছেন ঝাউয়ের ডাকে কাঙ্ক্ষিতজনকে খোঁজা মানুষটি। ডাক ভেসে আসছে ঝাউয়ের জঙ্গল থেকে “ও নিরুপম ও নিরুপম ও নিরুপম...”। এই ডাক অশেষ, এই তাড়ন, এই কষ্টের কোনো শেষ নেই। ত্রিবিন্দু বা এলিপসিস মূলত ব্যবহার হয় অনুক্তি বোঝাতে। এই ডাক সমস্ত ঝাউয়ের বনে ঘুরে বেড়াবে অবিরত। ত্রিবিন্দু সেই প্রবাহকেই সুনিশ্চিত করলো। তিনবার যেমন এই স্মৃতিকাতর আহ্বানকে পুনর্বার আবর্তিত করা হল, তেমনি বাকি আহ্বানের সম্প্রসারণকে অনুক্ত রেখে এই ডাককে অশেষ করে তুললেন কবি।

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এমন অনেক কবিতাই আছে, যেখানে তিনি নামকরণকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন এবং নামকরণের শব্দবন্ধই হয়ে উঠেছে কবিতার প্রধান কেন্দ্রভূমি। ‘অবনী বাড়ি আছো’-র প্রসঙ্গ আগেই এসেছে। শক্তির শেষ পর্যায়ের লেখা কবিতা: ‘শুধু এই’; কেমন এই কবিতার বিন্যাস? তিনটি লাইন, তার পরে ড্যাশচিহ্নযোগে ‘শুধু এই-’ লাইন। ড্যাশচিহ্নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যেমন পূর্ণ যতির মতো একটি বাক্যের অর্থকে শেষ করতে চায়, আবার সেই বাক্যের সঙ্গে পরবর্তী বাক্যের বা প্রসঙ্গের সংযোগ-স্থাপন করতে চায়। ড্যাশচিহ্নের এই প্রবণতা সবচেয়ে যিনি এক্সপ্লোর করেছিলেন, প্রত্যাশিতভাবেই তিনি জীবনানন্দ দাশ। এই কবিতায় বাকি নয়টি লাইনের বিষয়বস্তু কী? ‘সমস্ত প্রতাপ হল প্রায় অবসিত...’ কী অসামান্য এই ‘প্রতাপ’ শব্দের ব্যবহার। একটি শব্দে কৃত্তিবাসের সেই দাপুটে যৌবনমথিত দিনগুলোর কথা বুঝিয়ে দেওয়া হল। সব শেষ হবার পরেও কিছু মায়া থেকে যায় স্মৃতি হয়ে। কিন্তু ওই দামাল উদযাপনের ছায়ামাত্র। ‘শুধু এই—‘; প্রসঙ্গ শেষ হল, আবার পরের লাইনের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হল তখন, দেখা গেল পরের অংশেও এই বক্তব্যের সম্প্রসারণ হয়েছে। একসময়ের প্রতাপে কাটানো জীবন এসে আজ হয়েছে কোনোভাবে বেঁচে থাকা মাত্র। সেই দাপিয়ে বেড়ানো মুহূর্ত আজ যেন মূঢ়তা ছাড়া কিছুই নয়, সেই মূঢ়তার ‘অপনোদন’( নুদ্ ধাতু থেকে জাত এই শব্দ, এই ধাতুর অর্থ ধাক্কা মারা, সরানো, তাড়ানো, ইত্যাদি। এ-কারণেই অপসারণ, অপনয়নের ধাতুজাত অর্থের থেকেও নুদ্ ধাতুর ওই আগ্রাসন যথার্থ হয়েছে কবিতার অর্থগত ও ব্যঞ্জনার দিক থেকে।) হয়েছে, তার শান্তি আজ মানুষটার চোখেমুখে। ব্যক্তিগত বিদ্বেষকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারার সঙ্গেই কারোর সঙ্গে তঞ্চকতা করতেও আর মন চায় না। এই সমস্ত বক্তব্যের পরিশেষ উপলব্ধি কী? জীবন-যাপনে যত ক্লান্তিই থাক না কেন, বেঁচে থাবার চেয়ে শ্লাঘার আর কিছু নেই। এই সুঠাম নির্মেদ বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে তিনটি লাইন এবং তার সঙ্গে প্রসঙ্গক্রম বজায় রাখার জন্যে জরুরি হয়ে পড়ল ড্যাশচিহ্নের ব্যবহার। ধ্রুবপদের মতো আবর্তিত ‘শুধু এই’-এর পাশে এইজন্যে দাঁড়ি না বসে বসলো কোথায়? কবিতার শেষে। কবির যা বলবার ছিল, হয়ে গেছে; আর কিছু বলার নেই।


    ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?” শক্তির বিখ্যাত ও সুপরিচিত কবিতাগুলির একটি। কবিতার শুরুতেই ভাবছি-র পর একটি সচেতন সেমিকোলন। সচেতন এই জন্য, সেমিকোলনের ওজন, অর্থাৎ থামবার গতি কমার চেয়ে বেশি কিন্তু দাঁড়ির চেয়ে কম। অসম্ভব ভারসাম্য সৃষ্টিকারী এই চিহ্ন ব্যবহার করেছেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বুদ্ধদেবের গদ্যেও সেমিকোলনের অসামান্য ও ঘন-ঘন ব্যবহার চোখে পড়বে। তো, সেই সংবেদনশীল সেমিকোলন এখানে শক্তি অত্যন্ত সচেতনভাবে ব্যবহার করলেন। সচেতন ও সাহসী না হলে এই চিহ্নটি ব্যবহার করা যায় না। ‘ভাবছি; ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।’ দশ মাত্রার এই মুক্তক-মিশ্রবৃত্তের লাইনে ভাবছি-র পরেই কবিকে থামতে হবে পরের বক্তব্য বলবার কারণে। তবে বেশিক্ষণ ভাববেন না, তাহলে কবিতার গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। তাই দাঁড়ি এখানে নয়। সেমিকোলন বসে এই ইঙ্গিত দিল কী ভাবছেন, তিনি অনতিবিলম্বেই বলবেন, থেমে যাবেন না তার আগে। ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো—এ-কথা বলবার পর আর কোনো বক্তব্য বাকি থাকতে পারে না। তাই সুনিশ্চিত পূর্ণযতি। শুধু সেমিকোলনই নয়, এ কবিতায় শক্তি একাধিকবার কোলনচিহ্নের ব্যবহার করেছেন। তৃতীয় স্তবকের সেই অবিস্মরণীয় সমস্ত লাইন:

    এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
    চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়
    এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
    চিতাকাঠ ডাকে: আয় আয়

    জীবন যখন মৃত্যুর কিনার ঘেঁষে চলে যায়, তখন একজন মানুষ মৃত্যুর ডাক শুনতে পান। খাদের পাশে-র কঠোর নিঃসঙ্গতার মধ্যে চাঁদের এই আবেদন যথেষ্ট মোহময়ী। এই ডাক ডাকিনী বিদ্যামতেই তিন বার। আর গঙ্গা, লোকায়ত বিশ্বাসে, পবিত্রতার যে কাল্ট নিয়ে বয়ে যাচ্ছে, তার তীরেই দাহকার্য সমাপন হয়ে থাকে। সেখানে ঘুমন্ত দাঁড়ানো-অর্থে কি নিভে আসা সময়কেই ইঙ্গিত করছেন কবি? চিতাকাঠের ডাকের মধ্যে মোহ নেই, প্রত্যক্ষতা আছে, তাই সে ঘুমন্ত মানুষটির খাতিরে একবারের জায়গায় দু-বার ডেকেছে। এবং এই দু-ধরনের ডাককেই শক্তি বিশিষ্ট করেছেন তার আগে কোলনচিহ্ন ব্যবহার করে। এই কবিতার আরেকটি চোখে পড়বার মতো ব্যবহার হল শেষ স্তবকের চারটি লাইন, যেখানে ‘যাবো’—বলে আর বাকি কিছুই বলা হচ্ছে না, পরের লাইনে সেই প্রত্যাশিত বলা নামিয়ে এনে বলা হচ্ছে, কিন্তু, এরপর একটি কমা! যাবার কথা যার, সে তো যাবেই। ইচ্ছে না-থাকলেও। এটাই তো জীবনসত্য। তাই ‘যাবো’—এইকথা বলে সে ভাবছে, কী ভাবছে? জীবনের বিস্তার ভাবছে, দ্বিধান্বিত হচ্ছে। এরপরের শব্দ লিখতে কবি বেশ খানিকটা সময় নিলেন। চলে গেলেন পরের লাইনে। কিন্তু—আধুনিক মানুষের দ্বিধা। এরপর কমা ওই যাবার আগে থমকে যাওয়া, এবং তারপর ঘোষণার ভঙ্গিতে: ‘এখনি যাবো না’। কবিতার শব্দবোধ, ছন্দোবোধের সঙ্গেই ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে যতিচিহ্নের বোধ। এবং একে নিয়ন্ত্রণ করে কবিমন, তার দ্বিধা, সংকেত, অভিলক্ষ্য। ছন্দের সঙ্গে যতিচিহ্নের যোগ নিয়ে শক্তির ওপরেই ‘মাত্রার ছন্দে, গভীর অছন্দে’ নামের আলোচনায় চমত্কার একটি পর্যবেক্ষণ রেখেছেন দেবতোষ বসু। প্রথম বইয়ের লেখাগুলো থেকে শক্তি সম্পর্কে যে প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হল ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’ এবং ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’-তে মোট ১৬৩টি কবিতার মধ্যে মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দেই লিখেছেন ৬৩টি। দেবতোষ লিখছেন:

    অর্থাত্‍ মোট কবিতার তিনভাগের একভাগ লিখেছেন তিনি সেই ছন্দে যা তাঁর অব্যবহিত পূর্বসূরী এবং সমসাময়িক কবিরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। বাকি দুভাগ কবিতা তিনি লিখেছেন কলাবৃত্ত ও দলবৃত্ত ছন্দে, অধিকাংশ অবশ্যই দলবৃত্তে।
    সোজা কোথায়, প্রথম কবিতাবইতে কবি হিসেবে লিপিকুশলতার যে বৈচিত্র্য দেখালেন শক্তি, তার সম্পর্কে পাঠকের বিশেষ মতি তৈরি হল। কিন্তু পরবর্তী কাব্যগ্রন্থে ওই প্রত্যাশিত ছন্দ দুটির(কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত) দেখা পাওয়া গেল না। দেবতোষ লিখছেন এরপর:
    কিন্তু, না, পরবর্তী দুটি কাব্যগ্রন্থে, অনন্ত নক্ষত্রবীথি, তুমি অন্ধকারে, ও চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে শক্তি ওই দুই ছন্দে কবিতা লিখলেন না। প্রথম গ্রন্থে, নামটি ছাড়া, জীবনানন্দের কোনো প্রভাবই নেই, না ভাবনায়, না ছন্দোপংক্তিতে। কিন্তু একটি জিনিস লক্ষ করা গেল। জীবনানন্দের মতো তিনিও মাত্রাসমাবেশের রীতিমতো শাসন মানলেন না: ‘প্রতি ঘরে যেতে ইচ্ছে করে/ পিওনের মতো/ প্রতিটি বুকের কাছে”। পদগত আয়তনের অভিন্নতাকে বিচলিত করে শক্তি এখানে যতিস্থাপন করলেন বারো মাত্রা, ছ-মাত্রা ও আট মাত্রার পর, কথ্যরীতির স্বাভাবিকতাকে আনার জন্য।
    ‘পদগত আয়তনের অভিন্নতা’--বলতে কী বোঝাতে চাইলেন দেবতোষ? সমমাত্রার পদবিন্যাস। তাকে বিচলিত করছেন শক্তি ছন্দো-বৈচিত্র্য দিয়ে, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে যতিচিহ্নের বোধ। ‘প্রতি ঘরে যেতে ইচ্ছে করে—বললেই তো দশ মাত্রা হত, কিন্তু আরেকটি ‘ঘরে’ বসানো হল বিভিন্নতার সূত্রেই। পদগত আয়তনের যে বিভ্রান্তি শক্তি জেনেবুঝে তৈরি করছেন, তা কবিতার অন্তর্বয়নের সত্যিকে মেনেই। প্রতি ঘরে ঘরে (কোনো ঘর বাদ না পড়ে যায়! ঘরের সমগ্রে পৌঁছতে চান শক্তি) যেতে ইচ্ছে করে কার মতো? ‘পিওনের মতো’। অর্থাৎ চিঠির রেফারেন্স। ‘চাবি’ কিংবা ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’-এর মতো দীর্ঘ কবিতা, সেখানেও সম্পর্কের মাধ্যম হিসেবে বারবার চিঠির মোটিফ ব্যবহার হয়েছে। শক্তির কাব্যজগতে চিঠি যোগাযোগের খুব অব্যর্থ মোটিফ। সে-কারণেই পিওন-রূপী ওই ব্যক্তি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চান--অন্য কিছু নয়-- চিঠি। সেই চিঠি প্রাপকের কোথায় থাকবে? ‘প্রতিটি বুকের কাছে’। চিঠির কথা বলা হল না কোথাও, কিন্তু সর্বত্রই সেই অনুল্লিখিত চিঠি। পুরো বিন্যাস কেমন? ১২+৬+৮। প্রথমে পদবিন্যাস ঠিক নেই ওই পত্রপ্রেরকের আশঙ্কা থেকেই। যে চিঠি যাচ্ছে, সেই চিঠি গৃহীত হবে তো? প্রেরক তো তার জীবনের বিন্যাস সম্পূর্ণই করতে চান। সে-কারণেই মোট ছাব্বিশ মাত্রার একটি সমমাত্রিক লাইন শুধুমাত্র যতিবিন্যাসের অভিনবত্বে চেনা ছন্দে বৈচিত্র্য এনে দিল। সেই যাত্রাপথটাও ধাপে ধাপে, অসমমাত্রিকতা থেকে সমমাত্রিকতার দিকে নিয়ে গেল:

    প্রতি ঘরে ঘরে যেতে ইচ্ছে করে=১২
    পিওনের মতো=৬
    প্রতিটি বুকের কাছে=৮

    প্রচলিত মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দে সবচেয়ে ঐতিহ্যগত ও সুপরিচিত বিন্যাস আটের সঙ্গে এবং দশ কিংবা ছয়-মাত্রার সহযোগ। এখানে বারো মাত্রার সংশয়, ক্রমে পূর্ণতার দিকে এগিয়েছে। তাই আগে ছয়-মাত্রা, পরে আটমাত্রার লাইন। ৮+৬ নয়, ৬+৮। প্রতি ঘরে ঘরে( ৬ মাত্রার পর অর্ধযতিপাত) যেতে ইচ্ছে করে( ৬ মাত্রার পর অর্ধযতিপাত), এভাবেই ৬ মাত্রার অপূর্ণতা নিয়ে এগোতে থাকা একটি লাইন পূর্ণ হচ্ছে আটমাত্রায় গিয়ে। যতিপাতের এই ধারনা অনুযায়ী যে সর্বদা যতিচিহ্ন বসবে,এমন কোনো কথা নেই। তাই পাঠকের মনে কোনো ধরনের জটিলতা না সৃষ্টি করে বক্তব্য ও প্রসঙ্গ শেষ-হয়ে-আসা অংশে দাঁড়ি বসে যাচ্ছে পূর্ণযতির নিয়ম মেনেই।

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যকৃতি আলোচনা-প্রসঙ্গে একবার জয় গোস্বামী লিখেছিলেন:

    যে জীবনানন্দের প্রচ্ছায়ার কথা শক্তি সম্পর্কে সাধারণত বলা হয়, যে-ধারণার প্রমাণ শক্তির প্রথম যুগের কাব্যে তথা চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছের অন্যান্য অনেক কবিতাতেই আছে—তবু এই তীব্র চাপের আগুনে তিনি জীবনানন্দের থেকে এই বিশেষ কবিতাগুচ্ছেই পৃথক হয়ে জ্বলে পুড়ে গিয়েছেন। আজ, তাঁর সমসাময়িকদের থেকে, মৃত্যুর দূরত্বে দাঁড়িয়ে যাবার পর, দেখা যাচ্ছে সেই তারকাজ্বলন। জীবনানন্দের অক্ষরবৃত্ত ছন্দ অনেক ধীর গতিতে চলেছিল। সচেতনভাবেই জীবনানন্দ করেছিলেন এটা, বুদ্ধদেব বসু থেকে শঙ্খ ঘোষ, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন নিজের যুক্তিতে। দেখিয়েছেন, সেই অক্ষরবৃত্ত চলে ক্রমাগত ড্যাশ, কমা, সেমিকোলন ব্যবহার করে। শক্তিও দিচ্ছেন এই ড্যাশ, কমা, সেমিকোলন। বা দেরি করে দাঁড়ি। চরিত্রে তা সম্পূর্ণ আলাদা। বেগের দিক থেকে আলাদা,আগ্নেয়। (জয়ের শক্তি,২০০৮)
    সাম্প্রতিককালেও জয় গোস্বামীকে বিভিন্ন বক্তৃতায় কবিতা লেখার ও পড়বার প্রসঙ্গে যতিচিহ্নর ব্যবহার নিয়ে বলতে শোনা যায়। এই যে গতি, এটাই পদযোজনা। জীবনানন্দ ইচ্ছে করেই মন্থর হচ্ছেন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। আর জলপ্রপাতের তোড়ে কাব্যচর্চা করে যাওয়া শক্তি পূর্বসূরীর থেকে ঋণ গ্রহণ করলেও তাকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন স্বভাবে, লিপিকুশলতায়, যতিচিহ্নের নিয়ন্ত্রণে। পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া ও উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গ দিয়েই আপাতত এ আলোচনার ইতি টানা যাবে। জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র ১৮-সংখ্যক কবিতাটি পড়া যাক:

    কিংবা এই জীবনেরে একবার ভালবেসে দেখি!—
    পৃথিবীর পথে নয়,--এইখানে—এইখানে বসে
    মানুষ চেয়েছে কিবা? পেয়েছে কি?—কিছু পেয়েছে কি!—
    হয়তো পায় নি কিছু,--যা পেয়েছে, তাও গেছে খসে
    অবহেলা করে-করে কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে;--
    ধ্যানের সময় আসে তারপর—স্বপ্নের সময়!—
    শরীর ছিঁড়িয়া গেছে,--হৃদয় পড়িয়া গেছে ধসে!—
    অন্ধকার কথা কয়,--আকাশের তারা কথা কয়
    তারপর,--সব গতি থেমে যায়,--মুছে যায় শক্তির বিস্ময়!

    এবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’-র ৪০ সংখ্যক কবিতা(অংশত):

    যেবার ওদের সঙ্গে যেতে হল বেড়াতে পশ্চিমে—
    মানুষ বেড়ায়! তাই বহুদিন সাহাবাবুদের
    কালো ছেলেটির কাছে ছিলে তুমি, মোটে ফর্সা নয়
    আমার মতন, আহা প্লাতেরো, তোমারই কষ্ট হলো।
    পশ্চিমের থেকে কিছু ঘাস আমি তোমাকে পাঠাই
    খামের ভিতর, তুমি পোস্টাপিস থেকে চেয়ে নিও
    খামটা খেয়ো না, ওতে আঠা আছে, কালিতেও বিষ—
    পেটের অসুখ হলে কে তোমায় দেখবে প্লাতেরো?

    জীবনানন্দের আরেক সন্তান, বিনয় মজুমদার, সনেটধর্মী লেখাতেই যার প্রসিদ্ধি, তিনি ‘ফিরে এসো চাকা’-র একটি কবিতায়( অংশত উদ্ধৃত করা হল) লিখছেন:

    বাতাস আমার কাছে আবেগের মোথিত প্রতীক,
    জোত্স্না মানে হৃদয়ের দ্যুতি, প্রেম; মেঘ—শরীরের
    কামনার বাষ্পপুঞ্জ; মুকুর, আকাশ, সরোবর,
    সাগর, কুসুম, তারা, অঙ্গুরীয়—এ সকল তুমি।
    তোমাকে সর্বত্র দেখি; প্রাকৃতিক সকল কিছুই
    টীকা ও টিপ্পনি মাত্র, পরিচিত গভীর গ্রন্থের।
    অথচ তুমি কি, নারী, বেজে ওঠো কোনো অবকাশে?
    এতটা বয়সে ক্ষত—ক্ষত হয় নি কি কোনোকালে?

    অবশ্যই পরস্পর-বিরোধী উদ্ধৃতি আরও আছে। কিন্তু কাঠামোগত মেজাজের জন্যে এই তিনটি কবিতা সামনে রাখা হল। জীবনানন্দের কবিতায় যে যতিচিহ্নগত বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে, তা হল: জোড়া-যতিচিহ্নের ব্যবহার। যে মন্থরতা জীবনানন্দের কবিতার চলন-বৈচিত্র্য, সেই মন্থরতাকে আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে জোড়া-যতিচিহ্নের ব্যবহার। বিস্ময়-ড্যাশ(!--), কমা-ড্যাশ(,--), সেমিকোলন-ড্যাশ(;--)-এর পর পর ব্যবহার এই কবিতার গতিতে অতিশয় মন্থর করেছে। আরেকটি মন্থরতার কারণ এর ভাষাগত কৌশল। এইখানে, ছেদসহ পরপর দু-বার ব্যবহার, ‘চেয়েছে’, ‘পেয়েছে’, ‘পেয়েছে কি?’—এই লাইনটির সংশয়, দ্যোতনা, জিজ্ঞাসার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে ড্যাশচিহ্নের সহাবস্থানে। শক্তির কবিতায় জোড়া-যতিচিহ্নের ব্যবহার তো নেইই, তার সঙ্গে একক যতিচিহ্নের ব্যবহারও অত্যন্ত সীমিত। যতিচিহ্নর যথাযথ প্রয়োগের জন্যে শক্তির কবিতা পড়তে হচ্ছে কীভাবে? প্রথম লাইন পুরোটাই পড়তে হচ্ছে স্বাভাবিক বেগে; শেষে ড্যাশ, তাই পূর্ণযতির ভাব নিয়ে আসছে ড্যাশচিহ্ন। পরের লাইনে ‘মানুষ বেড়ায়!’-এর পর ‘তাই বহুদিন...’ থেকে ‘...কাছে ছিলে তুমি,’ প্রায় দেড় লাইন পড়ে যেতে হয় স্বাভাবিক গতির চেয়ে একটু বেশি গতিতেই, কেননা ‘সাহাবাবুদের’-এর পর লাইনটির অর্থবোধের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই পড়বার গতি থামানো যাচ্ছে না লাইন শেষ হওয়া সত্ত্বেও। একমাত্র চতুর্থ লাইনে তিনটি কমার ব্যবহার সামঞ্জস্য বজায় রেখেছে। একেবারে আট+দশে যতিচিহ্ন না-ফেলে প্রথম ছয় মাত্রার পর কমা, আটমাত্রার বন্ধের(আমার মতন, আহা) দুটি মাত্রা যাচ্ছে পরের অংশে, অসম মাত্রায় যতিচিহ্ন বসছে: আহা প্লাতেরো(২+৩), এর ফলেই স্বাভাবিক পড়বার গতি অতি সামান্য হলেও ব্যহত হচ্ছে। এটুকুই। জীবনানন্দের থেকে এখানেই শক্তি যতিচিহ্নর ব্যবহারে আলাদা। তার মানে এই নয়, শক্তি বাক্যের স্বাভাবিক গতিকে যতিচিহ্ন দিয়ে রুদ্ধ করেননি কখনো। জীবনানন্দের যতিচিহ্ন প্রয়োগের আরেকটি প্রবণতা হল একটি শব্দের পর ড্যাশচিহ্ন ব্যবহার করে কবিতার বক্তব্যকে বিস্তার দেওয়া। এই প্রবণতা পরে শক্তি এবং বিনয়ের কবিতায় এসেছে। ‘অবসরের গান’ কবিতার একটি লাইনে জীবনানন্দ লিখছেন: ‘আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,/ চারিদিকে মায়া—রোদ—ক্ষুদ—কুঁড়া—কার্তিকের ভিড়’, খুদকুঁড়ো তো একটাই শব্দ, তাকেও আলাদা করে দিচ্ছেন জীবনানন্দ, কেন? চারপাশের বিস্তৃত বঙ্গদেশের পরিধিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এইজন্যে তার সহায় হয়ে উঠছে ড্যাশচিহ্ন। শক্তি আর বিনয় কী করছেন, ড্যাশ না-ব্যবহার করে কমা-র (কখনো তার সঙ্গে প্রয়োজনবোধে সেমিকোলন) উপর্যুপরি ব্যবহারে বক্তব্যকে আরো সুনিশ্চিত ও সুচিহ্নিত করছেন। শক্তির অন্য একটি চতুর্দশপদীতে লিখছেন: “তুমি কি আর কখনো বহিবে না, বহিব একাকী/ দুঃখ ও স্মৃতির ভার, উপরন্তু, তোমারে, দিবসে?’’। প্রথম লাইনে দু-জনের একত্রে বয়ে যাবার যে-বাসনা, সেখানেই তো ছেদ এসে পড়েছে। বিচ্ছেদ হয়ে যাবার পর তাই ‘বহিব একাকী’। কী-কী বইবে? ‘দুঃখ স্মৃতির ভার’, এমনকি তোমাকেও তো(তুমি তো নয়, তোমার অনুপস্থিতি) বহন করতে হবে দিনমানে। সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে কীভাবে ভাষা বিশ্বাসযোগ্য ক’রে তুলল? দুঃখ ও স্মৃতির ভার—এই যথেষ্ট নয়, উপরন্তু আরো আছে, একসঙ্গেই বলা হচ্ছে না। ‘উপরন্তু’-র পর কমা, তারপর বলা হল: ‘তোমারে’। তারপরে কমা দিয়ে ‘দিবসে’, এবং প্রশ্নচিহ্ন। আমি তো একা বইব বললেই একা-একা শুধুমাত্র বইব-না নিজেকে। আমার সঙ্গে তোমার অনুপস্থিতির ভার থাকবে। সেই অনুপস্থিতির দুঃখ ও স্মৃতিই শুধু নয়, উপরন্তু—এসবের পর তোমাকেও বইতে হবে, ‘দিবসে?’। এখানে জিজ্ঞাসাচিহ্ন একটা সম্ভাবনার সূত্র রেখে যাচ্ছে। তোমার বিয়োগ-জনিত দুঃখ ও স্মৃতির ভার তো বইব, তার সঙ্গে তোমাকেও কি বইতে হবে একটি দিনের বিস্তৃতির মধ্যে? একটি লাইনের মধ্যে ঘন-ঘন তিনটি কমা এবং প্রশ্নচিহ্নের মাধ্যমে তার সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠা পেল। বিনয়ের সনেটধর্মী কবিতায় একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উদ্ধৃত কবিতার প্রথম স্তবকের প্রথম লাইনটি বাদ দিলে বাকি তিনটি লাইনেই কমা-র পরের পর ব্যবহার। জীবনানন্দের মতোই শব্দ দিয়ে একটি পৃথিবী গড়ে তোমার চেষ্টা করেছেন বিনয় এবং সেই চেষ্টা আরো ব্যাপক। জোত্স্না মানে হৃদয়ের কী—‘দ্যুতি, প্রেম; মেঘ’—এই পর্যন্ত বলে, মেঘের সঙ্গে ড্যাশ যোগে পরের শব্দ ‘শরীরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হল। শরীরের ব্যাখ্যা হিসেবে কী-কী বলা হচ্ছে এরপর? ‘কামনার বাষ্পপুঞ্জ’; ‘মুকুর’, ‘আকাশ’, ‘সরোবর’—পুরো লাইনটাই কমা দিয়ে লেখা হল। ড্যাশের পরিবর্তে কমা এবং প্রয়োজনবোধে সেমিকোলন—এখানেই শক্তি বিনয়ের মেজাজ জীবনানন্দের পথে এগিয়েও তার থেকে আলাদা ও স্বকীয় হয়ে পড়ল। বিনয় শুধু এই লাইনেই নয়, এই লাইনের সূত্র ধরেই পরের লাইনেও কবিতার ভাবকে টেনে নিয়ে গেছেন কমাচিহ্ন দিয়ে দিয়ে। কামনার বাষ্পপুঞ্জ থেকে মুকুর, আকাশ, সরোবরের বিস্তৃতি আরো বিরাট হয়ে পড়ছে সাগর, কুসুম, তারা, ---এ-সমস্তই এসে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ‘অঙ্গুরীয়’-তে। এই ‘অঙ্গুরীয়’ গোলার্ধের সমষ্টি। শক্তির কবিতায় কি সেমিকোলনের ব্যবহার নেই? শক্তি লিখছেন: “আমি ভালবাসবো, জানি গাছে ফুল ফোটানো দুষ্কর/ খর জল মূল খায়, জানি শাদা পিঁপড়ের ফুরফুরে/ শত্রুতা; অবশ্য জানি, শব্দ কত আদর্শ নির্ভর--”। এখানে আগের লাইনের অর্থবোধ প্রলম্বিত করে শাদা পিঁপড়ের ফুরফুরে শত্রুতার প্রসঙ্গ এলো, তার পরে কমা নয়, আরেকটু বেশি জার্ক, একটু বেশি সময়, থেমে চলবার প্রয়োজন হল। ভালোবাসার অর্থ তো গাছে ফুল ফোটানো। তবে তা সহজ কাজ নয়, অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। হতে পারে খর জল গাছটির মূল খেয়ে ওই ফুল ফোটবার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিল। পিঁপড়েও অনেকসময় গাছকে নষ্ট করে দেয়, শারীরিকভাবে (মানসিকভাবেও কি নয়?)। তাকেই অসামান্য একটি শব্দে ব্যঞ্জনায়িত করা হল। সেই ব্যঞ্জনাকে প্রতিষ্ঠিত করল কমা-কে অতিক্রম করে যাওয়া এই সেমিকোলনের ব্যবহার। আসলে কবিতা লেখার পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়েই কথা বলছেন শক্তি। বলছেন শব্দের নিহিত আদর্শবোধের কথা। সেটার পূর্বে একটা রূপকল্পের মোড়কে, যার ভেতরে সম্পর্কের সংশয় রয়েছে, যেমন একটি লেখার উত্তীর্ণতা নিয়েও থাকে, শত্রুতা-র পর সেমিকোলন যখন শক্তি ব্যবহার করেছেন, অত্যন্ত অমোঘ প্রয়োগ করেছেন। এই দুটি লাইনের যোগসূত্র যে ওই শব্দটি, সেটা বিশিষ্ট হয়ে উঠছে এই সেমিকোলনে। বোঝা যায়, ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই একজন কবির যতিচিহ্নের সংস্কার গড়ে ওঠে, তাকে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবহার করেই তবে তার সীলমোহর সম্পন্ন হয়।


    ঋণ:

    বোধশব্দ, যতিচিহ্ন সংখ্যা, বোধশব্দ, ২০২২

    প্রসঙ্গ: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিকল্প, ২০০০

    এই কাব্য এই হাতছানি, সম্পাদনা: দেবতোষ বসু, দে'জ পাবলিশার্স, ১৯৯৭

    জয়ের শক্তি, জয় গোস্বামী, প্রতিভাস, ২০০৮

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments