[যুদ্ধের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত দুই শিবিরের সৈন্যরা। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনের একমাত্র যোগসূত্র একটা কুকুর। কিন্তু সেই কুকুরটির কপালে কী লেখা আছে? যুদ্ধের অযৌক্তিকতা, অর্থহীনতার আরেকটি মর্মভেদী ব্যাখ্যান হিসেবে ধরা যেতে পারে কি এই গল্পটিকে?
মূল গল্পের শিরোনাম 'টেটওয়াল কা কুত্তা'। কাহিনীর প্রেক্ষাপট দেশভাগের কয়েক মাস পরের কাশ্মীরের যুদ্ধ। টেটওয়াল কাশ্মীরে অবস্থিত ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি স্থান।
গল্পটির প্রথম প্রকাশ ইয়েজ়িদ পত্রিকায় (১০-১১ অক্টোবর, ১৯৫১)। এই অনুবাদের জন্য ব্যবহার করেছি দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস্ প্রকাশিত (২০২১) কুল্লিয়াত-এ-মাণ্টো'র প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত সংস্করণটি।]
—অনুবাদক
বেশ কিছুদিন ধরেই উভয় পক্ষ নিজেদের ট্রেঞ্চে জড় হয়েছিল। দিনের বেলায় দুদিক থেকেই দশ-বারো বার গোলাগুলি চলত বটে, কিন্তু গুলির আওয়াজের সঙ্গে মানুষের আর্ত চিৎকার বিশেষ শোনা যেত না। আবহাওয়া বড়ই মনোরম। বাতাস বুনো ফুলের গন্ধে ম-ম করত। পাহাড়ের খাড়াই আর ঢালে প্রকৃতি নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত। তার কাছে যুদ্ধের কোনও খবর নেই। পাখির ডাক তেমনি শোনা যেত। ফুল তেমনি ফুটত। তন্দ্রাচ্ছন্ন মৌমাছিরাও সেই পুরোনো ঢঙে মধু আহরণে ব্যস্ত। পাহাড়ে গোলাগুলির আওয়াজের প্রতিধ্বনি হলে পাখিরা ঘাবড়ে গিয়ে উড়তে শুরু করত। বাদ্যযন্ত্রের কোনও ভুল তারে হাত পড়ে বেসুরো আওয়াজ বেরোনোর মত। সেপ্টেম্বরের শেষের দিনগুলো যেন হালকা শীতে অক্টোবরের সূচনাকে আলিঙ্গন করছে। গ্রীষ্ম আর শীতের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়েছে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত পাতলা আর হালকা মেঘ এমন ভাবে ভেসে বেড়াত যেন কেউ সাদা বজরা নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে।
পাহাড়ি রণাঙ্গনের সম্মুখসারিতে দুপক্ষের সেনাদের দিনগুলো উৎকণ্ঠায় কাটছিল। তারা একটা ফয়সালার আশায় ছিল। একঘেয়েমিতে ভুগতে ভুগতে সেপাইরা একে অপরকে দু-চার লাইন কবিতাও শোনাত।
কেউ না শুনল তো নিজেদের মনেই গুনগুন করা। পাথুরে জমির ওপর কখনও উপুড়, কখনওবা চিৎ হয়ে তারা শুয়ে থাকত। হুকুম মিললে গোলাগুলিও চালিয়ে দিত।
দুদিকের ট্রেঞ্চই খুব সুরক্ষিত জায়গায়। গুলি খুব জোরে ধেয়ে এসে পাথরের ঢালে লেগে সেখানেই চিৎ হয়ে যেত। যে দুটি পাহাড়ে ট্রেঞ্চ ছিল, তাদের উচ্চতা প্রায় সমান। মাঝখানে সবুজ উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে মোটা সাপের মত ছোট পাহাড়ি নদী।
বায়ুসেনাদের হাওয়াই জাহাজ থেকে কোনও বিপদের আশঙ্কা ছিল না। কোনও পক্ষের কাছেই কামান ছিল না। তাই রাতে নির্ভয়ে আগুন জ্বালানো হত। সে আগুনের ধোঁয়া হাওয়ায় মিশে যেত। রাতগুলো একেবারে নিঃশব্দ হওয়ায় দুপক্ষের সেনারাই একে অপরের অট্টহাসির আওয়াজ পেত। কেউ উৎসাহভরে গান ধরলে সে আওয়াজ যেন রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিত। পুরোনো পড়া ঝালিয়ে নেওয়ার মত ধ্বনি-প্রতিধ্বনির অনুরণন চলত।
চা-পানের সময় শেষ হয়েছিল। পাথরের উনুনে পাইন গাছের কাঠকয়লা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। পরিষ্কার আকাশের নিচে বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ থাকলেও ফুলের সে সুগন্ধ নেই। রাতে যেন ফুলেরা তাদের আতরদান বন্ধ করে রেখেছে। পাইনের আঠা বা ফলের গন্ধ অবশ্য আছে। সে গন্ধ খুব যে খারাপ তাও নয়। সকলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল যে সামান্য ইশারা পেলেই তারা লড়াই আর মৃত্যুর জন্য তৈরি। পাহারার দায়িত্বে ছিল জমাদার হরনাম সিং স্বয়ং। তার রাস্কোপ ঘড়িতে দুটো বাজলে সে গন্ডা সিংকে জাগিয়ে পাহারায় বসাল। হরনামের শুয়ে পড়ার ইচ্ছে হলেও শোয়ার পরে মনে হল চোখ থেকে নিদ্রা ততটাই দূরে যতটা আকাশের তারাগুলো। সে তারাদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুয়ে আপন মনে গুন গুন করে গাইতে থাকল —
‘জুত্তি লেনি আ সিতারিয়াঁওয়ালি – সিতারিয়াঁওয়ালি — ওয়ে হরনাম সিংঘা’ (আমি নেব ঝলমলে তারা লাগানো জুতো – তারা লাগানো জুতো – ওহে হরনাম সিং)
হো ইয়ারা, ভাবেঁ তেরি মাহি ভিক্ যায়ে (তার জন্য তোমার মোষটা যদি বেচতে হয় তাও)
আকাশের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা তারা লাগানো জুতো যেন হরনাম সিংয়ের চোখে পড়ছে, সেগুলো ঝলমল করছে...
‘জুত্তি লে দুয়োঁ সিতারিয়াঁওয়ালি — সিতারিয়াঁওয়ালি — নি হরনাম কাউরে হোনা রে ভাবেঁ মেরি মাহিঁ ভিক্ যায়ে’
(আমি তোমায় দেব ঝলমলে তারা লাগানো জুতো, ও হরনাম কৌর, ও সুন্দরী যুবতী, যদি আমার মোষটা বেচতে হয় তাও)
হরনাম গাইতে গাইতে হাসে। ঘুম আসবে না ভেবে উঠে পড়ে। সকলকে জাগিয়ে দেয়। গানের মেয়েটার কথা ভেবে তার মনে যেন উথাল-পাথাল শুরু হয়েছে। মন তখন চাইছে উল্টোপাল্টা গল্পগুজব শুরু হোক যাতে গানের হরনাম কৌরকে নিয়ে একটু মজা লোটা যায়। কথাবার্তা শুরু হলেও গল্প যেন তেমন জমল না। বাহিনীর মধ্যে সকলের ছোট বান্তা সিংয়ের কণ্ঠটি সুরেলা। আর সকলে যখন হাই তুলছে আর হাসিমস্করা চালু রাখতে চাইছে, তখন বান্তা সিং একটু দূরে বসে তার মধুর গলায় ‘হির’-এর গান গাইতে শুরু করল:
‘হির আখিয়া যোগিয়া ঝুট বোলিঁ(হির বলে, ‘যোগী তুমি মিথ্যে বলছ, আহত প্রেমিককে কে শান্ত করবে? আমি অনেক খুঁজে ক্লান্ত, এমন কাউকে পাইনি যে পরলোক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। কাক তো বাজপাখির মুখ থেকে সারসকে কেড়ে নিয়েছে — বাজ কি চুপ করে আছে না বিলাপ করছে? যাদের জীবনটাই দুঃখে ভরা, তাদের সুখের গল্প শুনিয়ে কী লাভ?’)
কৌন রুঠরে ইয়ার মানাউনদাই
অ্যায়সা কোই না মিলা মাইঁ ঢুঁড় থক্কি
জিহ্রা গিয়াঁ নুঁ মোড় লিয়াউন্দাই
ইক্ বাজ্ তু্ কাং নে কুঞ্জ খোই
দেখা চুপ হ্যায় কে কর লাউনদাই
দিখাঁ ওয়ালিয়াঁ নুঁ গলাঁ সুখদিয়াঁ
নি কিস্সে জোড় জহান সুনাউন্দাই
কিছুক্ষণ পর হিরের এই বিলাপের উত্তরে রন্ঝার জবাব বান্তা সিং গেয়ে শোনাল —
‘জেরে বাজ্ তুঁ কাং নে কুঞ্জ খোই(যে বাজের কাছ থেকে সারস ছিনিয়ে নিল, সেই বাজ সবুর করতে করতে শেষ হয়ে গেল। আর একই হাল হল সেই ফকিরের যার সব ধনসম্পদ নষ্ট হয়েছিল। ভগবান আর রসুলকে সাক্ষী রেখে সত্যি বল — সঈদ ভারিস্ দুনিয়াকে পরিত্যাগ করেই তো ভারিস্ শাহ বনে গিয়েছিলেন।)
সবর শুকর কর বাজ্ ফনাহ্ হোয়া
ইনভিঁ হাল হ্যায় উস্ ফকির দানি
ধন-মাল গিয়া তে তবাহ্ হোয়া
করেঁ সিদক্ তে কম্ মালুম হোভে
তেরা রব রসুল গভাহ্ হোয়া
দুনিয়া ছড়্ উদাসিয়াঁ পহন্ লিতাঁ
সঈদ ভারিশোঁ হন ভারিস্ শাহ হোয়া’
বান্তা সিং যেমন হঠাৎই গাইতে শুরু করেছিল, তেমনি অকস্মাৎ থেমে গেল। ছাইরঙা পাহাড়গুলোও যেন দুঃখের বেশ পরে আছে। একটু পরে হরনাম সিং অদৃশ্য কিছুকে লক্ষ্য করে জোরে গালি দিয়েই শুয়ে পড়ল। অকস্মাৎ রাতের শেষ প্রহরের সেই উদাসী সময়ে কুকুরের ডাক। সবাই চমকে উঠল। আওয়াজটা খুব কাছ থেকেই এসেছে। সুবেদার হরনাম সিং উঠে বসে। ‘এই ঘেউ-ঘেউটা আবার কোত্থেকে চলে এল?’
ফের কুকুরের ডাক, এবারে যেন আরও কাছ থেকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই দূরের ঝোপে নড়াচড়ার আওয়াজ। বান্তা সিং উঠে সেদিকে এগিয়ে গেল। ফিরে এল লেজ নাড়তে থাকা দলছুট একটা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। হেসে বলল, ‘জমাদার সাব, আমি একে “হু কামস্” জিগ্যেস করায় বলল “আমি হলাম চপ্পড় ঝুন-ঝুন”!’
সকলেই হেসে উঠল। জমাদার হরনাম সিং কুকুরটাকে আদর করছে ‘এদিকে আয় চপ্পড় ঝুন-ঝুন।’ খাবার পাওয়া যাবে এই আশায় কুকুর তো লেজ নাড়াতে নাড়াতে হরনামের কাছে গিয়ে মাটিতে পাথর শুঁকছে। হরনাম থলে থেকে একটা বিস্কুট বার করে কুকুরটার দিকে ছুঁড়ে দিল। কুত্তা সেটা শুঁকে মুখে তুলতে যাবে, এমন সময় হরনাম তাড়াতাড়ি ঝুঁকে বিস্কুটটা তুলে নিল।
‘দাঁড়া, পাকিস্তানি নয় তো?’
সকলে আবার হেসে উঠল। সর্দার বান্তা সিং এগিয়ে গিয়ে কুকুরের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জমাদার হরনাম সিংয়ের উদ্দেশে বলল, ‘না, জমাদার সাহেব, চপ্পড় ঝুন-ঝুন হিন্দুস্থানি।’
জমাদার হরনাম সিং কুকুরটার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
‘প্রমাণ দেখাও।’
কুত্তা লেজ নাড়ে।
হরনাম এবার একটু জোরে হেসে উঠল। ‘এটা কোনও প্রমাণ হল? লেজ তো সব কুকুরই নাড়ায়!’
বান্তা সিং কুকুরের নড়তে থাকা লেজটা ধরে: ‘বেচারা শরণার্থী!’
এবারে জমাদার হরনাম বিস্কুট ছুঁড়তেই খপাৎ করে ধরে নিল কুকুরটা। এক জওয়ান বুটের ডগা দিয়ে মাটি খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ‘এখন কুকুরদেরও হিন্দুস্থানি বা পাকিস্তানি হতে হবে।’
জমাদার থলে থেকে আরেকটা বিস্কুট বার করে ছুঁড়ে দিল: ‘পাকিস্তানিদের মত পাকিস্তানি কুত্তাদেরও গুলি করে উড়িয়ে দেওয়া হবে।’
কেউ একজন জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘হিন্দুস্থান জ়িন্দাবাদ!’
কুকুরটা বিস্কুট নেওয়ার জন্য এগোলেও চিৎকারে ভয় পেয়ে পেছু হটল। তার লেজটা দুপায়ের মধ্যে ঢুকে গেছে।
জমাদার হরনাম সিং হেসে ফেলল: ‘নিজেদের স্লোগান শুনে ভয় পাচ্ছিস কেন চপ্পড় ঝুন-ঝুন?....খেয়ে নে, এই আরেকটা নে।’ থলে থেকে আরেকটা বিস্কুট বেরোল। কথায় কথায় ভোর হয়। সূর্য যখন সবে মুখ দেখানোর চেষ্টা করছে, তখনই চারিদিক আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেমন বোতাম টিপলেই সঙ্গে সঙ্গে বিজলি বাতির রোশনাই দেখা যায়, তেমনি দেখতে দেখতেই টেটওয়ালের সেই পাহাড়ি এলাকায় সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল। ওই এলাকায় অনেক দিন পর্যন্ত লড়াই চলেছিল। একেকটা পাহাড় রক্ষা করার জন্য ডজন ডজন জওয়ানের জান গেলেও কোনও পক্ষই নিজের জমি সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে যেন নিশ্চিত হতে পারছিল না। আজ এই পাহাড়টা মিত্রপক্ষের অধিকারে থাকলেও কালই হয়ত দুশমনেরা সেটা দখল করে নিল। পরশু হয়ত আবার সেটা মিত্রপক্ষের দখলে আসবে। তার পরের দিন সেটা যে আবার হারাতে হবে না তাই বা কে বলতে পারে?
হরনাম সিং দূরবীন লাগিয়ে আশপাশের এলাকা নিরীক্ষণে ব্যস্ত। সামনের পাহাড় থেকে ধোঁয়া উঠছে, অর্থাৎ চা তৈরি হচ্ছে, ওদিকেও নাস্তার প্রস্তুতি চলছে। আগুন জ্বালানো হচ্ছে। ওদিকের লোকেরাও নিশ্চয়ই এই পাহাড়ের ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছে।
নাস্তার সময় সব জওয়ানই কুকুরটাকে একটু একটু খাবার দেওয়ায় বেচারা পেট ভরে খেতে পেল। সকলেই কুকুরের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছিল। সবাই যেন তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে চায়। কুকুরটার আগমনে বেশ একটু সাড়া পড়ে গেছে। সকলেই তাকে ‘চপ্পড় ঝুন-ঝুন’ নামে ডাকছে আর আদর করছে।
সন্ধ্যের কাছাকাছি পাকিস্তানি শিবিরে সুবেদার হিম্মত খান বিশাল গোঁফজোড়ায় তা দিতে দিতে টেটওয়ালের মানচিত্রটা মন দিয়ে নিরীক্ষণ করছিল। সেই বিরাট গোঁফ নিয়ে কত গল্পই না শোনা যায়। ওয়্যারলেস্ অপারেটর তার পাশেই বসে প্ল্যাটুন কমান্ডারের কাছ থেকে নতুন নির্দেশ জেনে নিচ্ছে। তাদের অনতিদূরে হাতে বন্দুক নিয়ে একটা পাথরে ঠেস দিয়ে বসে বশির মৃদুস্বরে গুন গুন করছে।
‘চন্ কিত্থে গওয়াই আই রাত ওয়ে -- চন্ কিত্থে গওয়াই আই’
(সোনার চাঁদ আমার, তুমি রাত কোথায় কাটালে? বলো রাত কোথায় কাটালে?)
বশির মজা পেয়ে একটু উঁচু গলায় গান ধরতেই সুবেদার হিম্মত খান কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল: ‘আবে, তুই কোথায় ছিলি রাত ভর?’
বশির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে হিম্মত খানের দিকে তাকাতেই বুঝল যে কথাটা তার উদ্দেশে বলা হয়নি। আবার শোনা গেল, ‘বল বে?’
বশির দেখল কিছুটা দূরে সেই কুকুরটা বসে আছে যে কয়েক দিন আগে অনাহূত অতিথির মত এসে শিবিরেই থেকে গেছে। বশির হেসে কুত্তাটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘চন্ কুত্তে গওয়াই আই রাত ওয়ে -- চন্ কুত্তে গওয়াই আই?’
(সোনার চাঁদ কুকুর আমার, তুই সারা রাত কোথায় ছিলি?)
কুকুরটা এমন জোরে জোরে লেজ নাড়াচ্ছিল যে তার লেজটা যেন পাথুরে জমির ওপর ঝাড়ু দিচ্ছে। সুবেদার হিম্মত সিং একটা পাথর উঠিয়ে কুকুরটা দিকে তাক করে ছুঁড়ল: ‘শালা লেজ নাড়ানো ছাড়া আর কিছু পারে না।’
বশির আরও একবার মন দিয়ে কুকুরটাকে দেখল: ‘এটার গলায় ওটা কী?’ এই বলতে বলতেই আরেক জওয়ান তাড়াতাড়ি এসে কুকুরের গলা থেকে দড়িটা খুলে নিল। দড়ির সঙ্গে এক টুকরো পিচবোর্ড লাগানো। তাতে কিছু লেখা। সুবেদার হিম্মত খান পিচবোর্ডের টুকরোটা নিয়ে নিজের বাহিনীর সেনাদের জিগ্যেস করল, ‘ছেলেরা, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এটা পড়তে জানো?’
বশির এগিয়ে এসে পিচবোর্ডের টুকরোটা নিল: ‘হ্যাঁ, একটু-আধটু পড়তে পারি।’ তারপর সে বেশ কষ্ট করে বানান করতে করতে পড়ল,
‘চপ.....চপ্পড়....ঝুন.....ঝুন...চপ্পড় ঝুন-ঝুন....এর মানে কী?
সুবেদার হিম্মত খান তার বড় বড় ঐতিহাসিক গোঁফজোড়ায় জোর সে তা দিল: ‘এটা কোনও কোড ওয়ার্ড হবে।’ তারপরে আবার বশিরকে জিগ্যেস করল, ‘আর কিছু লেখা আছে না কি বশিরে?’
বশির তখন হরফ চেনার চেষ্টায় মগ্ন। বলল, ‘জি হাঁ.....ইয়ে......ইয়ে....হিন্দ্....হিন্দ্....এটা তো হিন্দুস্থানি কুত্তা!’
সুবেদার হিম্মত খান ভাবল, ‘এর মতলবটা কী? তুমি কী যেন পড়েছিলে...চপ্পড়?’
বশিরের উত্তর এল, ‘চপ্পড় ঝুন-ঝুন!’
এক জওয়ান বেশ বিজ্ঞের মতো বলল, ‘আসল কথাটা এর মধ্যেই বলা আছে।’
সুবেদার হিম্মত খানের মনে হল এ কথার যুক্তি আছে:'হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।'
পিচবোর্ডে লেখা পুরো কথাটা বশির আবার পড়ল: ‘চপ্পড় ঝুন-ঝুন। এটা হিন্দুস্থানি কুত্তা।’
সুবেদার হিম্মত খান নিজেই ওয়্যারলেস্ সেট নিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে প্ল্যাটুন কমান্ডারের সঙ্গে কুকুর নিয়ে আলোচনা সেরে নিল। সে কীভাবে এসেছিল, বেশ কয়েকদিন কেমন করে সেখানে থেকে গেল, তারপর নিজেই হারিয়ে গেল আর রাতভর তার পাত্তা পাওয়া গেল না। আর ফিরে আসতে দেখা গেল যে তার গলায় একটা দড়ি বাঁধা যার সঙ্গে একটা পিচবোর্ডের টুকরো লাগানো। সেখানে যে কথাগুলো লেখা আছে হিম্মত সিং বেশ কয়েকবার তা পড়ে প্ল্যাটুন কমান্ডারকে শোনালেও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেল না।
বশির আলাদা জায়গায় কুকুরটার পাশে বসে কখনও আদর, কখনও বা ভয় দেখিয়ে জানার চেষ্টা করছিল সে রাতে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। তার গলায় দড়ি আর পিচবোর্ডের টুকরোটাই বা কে বেঁধে দিল। কিন্তু কুকুরের কাছ থেকে কোনও সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেল না। বশিরের যে কোনও প্রশ্নের উত্তরেই কুকুরটা নির্বিকারভাবে লেজ নাড়িয়ে চলেছিল। শেষমেশ রেগে গিয়ে বশির কুকুরটাকে পাকড়ে সজোরে ঝাঁকিয়ে দিল। কুকুরটা ব্যথায় কুঁ-কুঁ করতে শুরু করল।
ওয়্যারলেস্ এর কাজ শেষ করে সুবেদার হিম্মত খান আবার কিছুক্ষণ খুব মনোযোগের সঙ্গে মানচিত্র নিরীক্ষণ করল। তারপর যেন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে এইভাবে উঠে দাঁড়িয়ে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট বশিরকে দিয়ে বলল: ‘বশিরে, এর ওপর গুরমুখীতে লেখ....ওই ইকড়ি-মিকড়ি হরফে লেখ.....’
বশির সিগারেটের প্যাকেটের পিচবোর্ডটা নিল। ‘কী লিখব, সুবেদার সাব?’
সুবেদার তখন গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবছে আর বলছে, ‘লেখ না.....শুধু লিখে দে।’
সুবেদার পকেট থেকে পেন্সিল বার করে বশিরকে দিয়ে বলল, ‘কী লেখা উচিত?’
বশির ঠোঁটে পেন্সিল লাগিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলল: ‘সপ্পড়....সুন....সুন’। অবিলম্বে সে মনস্থির করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল: ‘চপ্পড় ঝুন-ঝুনের জবাব সপ্পড় সুন-সুনই হতে পারে....সিংয়ের বাচ্চাদের এটা ভালোই মনে থাকবে!’
বশির পিচবোর্ডের ওপর পেন্সিলটা ধরল: ‘সপ্পড় সুন-সুন!’
‘ষোলো আনা....লেখ.....সপ্....সপ্পড় ...সুন...সুন!’ সুবেদার হিম্মত খান গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। ‘আরও লেখ....এটা পাকিস্তানি কুত্তা!’
সুবেদার হিম্মত খান পিচবোর্ডের টুকরোটা বশিরের হাত থেকে নিয়ে পেন্সিলটা দিয়ে তাতে একটা ফুটো করে দড়ি গলিয়ে কুকুরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘যা, এবার এটা তোর বেটাদের কাছে নিয়ে যা!’
সুবেদারের কথা শুনে সব জওয়ানই হেসে উঠল। সুবেদার কুত্তার গলায় দড়িটা বেঁধে দিল। কুত্তা লেজ নাড়িয়েই চলেছে। তাকে কিছু খেতে দিয়ে সুবেদার এবার আদেশ করে বলল, ‘দেখো বন্ধু, গদ্দারি কোরো না। মনে রাখবে বেইমানির সাজা হল মৃত্যু!’
কুকুরটা তখনও লেজ নাড়াচ্ছে। তার পেট ভরে খাওয়া শেষ হলে সুবেদার দড়ি ধরে কুত্তার মুখটা পাহাড়ের একমাত্র পাকদণ্ডির দিকে ঘুরিয়ে ধরে বলল: ‘যাও.....আমাদের চিঠিটা দুশমনদের কাছে পৌঁছে দাও। কিন্তু দেখো, ফিরে আসতে হবে। এটা তোমার অফিসারের হুকুম, বুঝলে?’
কুত্তা লেজ নাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে পাকদণ্ডি বেয়ে নামতে শুরু করল। পাকদণ্ডিটা নিচে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় গিয়ে নেমেছে। সুবেদার হিম্মত খান বন্দুক তুলে হাওয়ায় এক বার গুলি ছুঁড়ল। ফায়ার আর তার প্রতিধ্বনি ওদিকে হিন্দুস্থানি শিবির থেকে শোনা গেল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য হিন্দুস্থানি সেনাদের মালুম হল না। জমাদার হরনাম সিং কোনও কারণে খিটখিটে হয়ে পড়ছিল। গুলির আওয়াজে তার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সেও গুলি চালানোর হুকুম দিয়ে দিল। আধ ঘণ্টা ধরে উভয় শিবির থেকেই গোলাগুলি চলতে লাগল। অবিরাম গুলিবর্ষণে সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়লে হরনাম সিং ফায়ার বন্ধ করার আদেশ দিয়ে দাড়িতে চিরুনি চালাতে লাগল। দাড়ি আঁচড়ানো শেষ করে সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চুল জালবন্দি করে বান্তা সিংকে জিগ্যেস করল: ‘আরে বান্তা সিয়াঁ! চপ্পড় ঝুন-ঝুন গেল কোথায়?’
বান্তা সিং পাইন গাছের শুকনো কোঁড় নখ থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘কুকুরটার ঘি হজম হয়নি।’
হরনাম বান্তা সিংয়ের বাগধারার মানে বুঝল না: ‘আমরা তো ওকে ঘিয়ের কোনও খাবার খেতে দিইনি!’
এটা শুনে বান্তা খুব জোরে হেসে উঠে বলল, ‘আবে আনপড়! তোর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করাই বেকার।’
এরই মধ্যে পাহারায় থাকা যে সেপাই দূরবীন লাগিয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল, তার চিৎকার, ‘ওই যে, ও আসছে!’
সকলেই অবাক। জমাদার হরনাম সিং বলল, ‘কে?’
পাহারাদার সেপাই: ‘ওর কী নাম ছিল যেন? – চপ্পড় ঝুন-ঝুন।’
‘চপ্পড় ঝুন-ঝুন!’ হরনাম উঠে পড়ল। ‘কী করছে সে?’
পাহারাদার সেপাইয়ের জবাব এল, ‘এদিকে আসছে।’
জমাদার হরনাম সিং পাহারাদারের হাত থেকে দূরবীন নিয়ে একবার দেখল। ‘এদিকেই তো আসছে.....গলায় দড়িও বাঁধা আছে....কিন্তু ও তো ওদিক থেকে আসছে.....দুশমনদের শিবিরের দিক থেকে।’ কুত্তার মা-বাপ তুলে হরনাম তো যা মুখে আসে তাই বলল। তারপর বন্দুক উঠিয়ে তাক করে গুলি চালিয়ে দিল। কিন্তু নিশানা ভুল। গুলিটা কুত্তার অনতিদূরে পাথরকুচি উড়িয়ে মাটিতে গেঁথে গেল। কুকুরটাও ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অন্য শিবির থেকে সুবেদার হিম্মত খানও দূরবীন দিয়ে দেখল যে কুকুরটা পাকদণ্ডিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আরেকবার গুলি চলতেই কুত্তাটা ঘুরে উল্টো দিকে, অর্থাৎ হিম্মত খানের শিবিরের দিকে দে ছুট। হিম্মত খান চেঁচিয়ে বলল, ‘যারা বাহাদুর তার ভয় পায় না। চল্, ফিরে যা!’ এই বলে কুকুরটাকে ভয় দেখানোর জন্য সেও একবার ফায়ার করল। কুকুর আবার দাঁড়িয়ে গেল। ওদিক থেকে জমাদার হরনাম সিং আবার গুলি চালাল। এবার গুলিটা কুত্তার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে লাফ দিয়ে দুকান বার বার ঝাঁকাতে লাগল। এদিক থেকে সুবেদার হিম্মত খান দ্বিতীয় বার ফায়ার করলে গুলিটা কুকুরের সামনের পা দুটির মাঝখানে পাথরের মধ্যে বিঁধল। সে বিভ্রান্ত হয়ে তখন এক বার এদিক, আরেকবার ওদিকে দৌড়োচ্ছে। কুত্তাকে হতবুদ্ধি হতে দেখে হিম্মত খান আর হরনাম উভয়েই খুব মজা পাচ্ছিল। দুজনেই জোরে হেসে উঠল। কুকুরটা এবার জমাদার হরনাম সিংয়ের শিবিরের দিকে পালাল। এই দেখে রেগে গিয়ে হরনাম কড়া গালি দিতে দিতে ভালো করে দেখে নিশানা তাক করল। এবারে কুকুরের পায়ে গুলি লাগল। আকাশ বিদীর্ণ করে কুকুরের আর্ত চিৎকার শোনা গেল। সে আবার ঘুরে উল্টোদিকে দৌড় লাগাল। ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে হিম্মত খানের শিবিরের দিকে দৌড়তেই সেদিক থেকেও গুলি চলল। কিন্তু শুধু ভয় দেখানোর জন্য। হিম্মত খান গুলি চালাতে চালাতেই চিৎকার করে বলল, ‘বাহাদুররা আঘাতের পরোয়া করে না। নিজের জীবন বাজি রেখে খেলে যাও......যাও.....যাও!’
কুত্তা আবার গুলি চলায় ঘাবড়ে গিয়ে মোড় ঘুরল। তার একটা পা তখন একেবারে অচল। বাকি তিনটে পায়ের জোরে সে নিজেকে কোনও মতে ঘষটে টেনে নিয়ে উল্টোদিকে কয়েক পা এগোতেই এবার জমাদার হরনাম সিংয়ের তাক করা গুলি তাকে সেখানেই পেড়ে ফেলল।
সুবেদার হিম্মত খান আফসোস করতে করতে বলল: ‘ছি, ছি,….বেচারা শহীদ হয়ে গেল।’
জমাদার হরনাম তখন বন্দুকের গরম নলের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় করছে, ‘কুত্তার মতই মরল!’