সমীক আর শ্রেয়া দুজনেই নবম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের দুজনের দেখা কেমিস্ট্রি টিউশানে, যেখান থেকে তাদের নিজেদের কেমিস্ট্রি বৃদ্ধি পায়। যা আজ ‘reaction’এর ফলে প্রেমের রূপ নিয়েছে।
শ্রেয়া মনস্থির করে নেয় যে পুজোর প্রথম দিনটা সে সমীকের সাথেই কাটাবে। সমীক যখন রাজি হল, সে তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে গিয়ে তার মিষ্টি গলায় বলে— ‘মা, ও মা, ষষ্ঠী বিকেলে আমি কি সমীকের সাথে ঠাকুর দেখতে যাব? বেশি না, কাছাকাছি কয়েকটা।’ মাকে শ্রেয়া সব বলে, সমীকের ব্যাপারটাও মা বুঝে গেছেন, কিন্তু তিনি এর আগে মেয়েকে কখনো। কোনোদিন একা ছাড়েননি। তাঁর একটু ভয় করে। সমীককে সে আগে এক ঝলক দেখেছিলেন, ভালো ভাবে কোনোদিনও কথা না বললেও, মেয়ের মুখ থেকে যা শুনেছেন, তাতে তিনি বুঝেছেন যে ছেলেটা মন্দ নয়। তাও তিনি শ্রেয়াকে বলেন— ‘আজ তো সবে মহালয়া, ষষ্ঠী তো দেরি আছে, আমি দেখছি।’ শ্রেয়া এই কথা শুনে বাচ্চাদের মতো ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করে, আর যেই নিজের মুখটা ফুলিয়ে বসলো। মা তাড়াতাড়ি বললেন— ‘আচ্ছা সোনা আমার, যাস, যাস।’
শ্রেয়ার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সে তাড়াতাড়ি সমীককে লেখে— ‘আমি যাচ্ছি! মা রাজি হয়ে গেছে, অই দিকে কি খবর?’
সমীক এর আগে কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে পুজোর সময় কী, জীবনেও বেরোয়নি। ছোটোবেলা থেকেই কিছু ‘সিলেক্টেড’ বন্ধু ছাড়া, সমীক তেমন কারুর সাথে মিশতে পছন্দ করে না। এমনকি মাকেও মনের কথা খুলে বলতে পারে না সে। কিন্তু একজন আছে, যাকে সমীক সব সময় সব কিছু বলে, তার দাদা। বয়েসে সমীকের চেয়ে বছর তিনেকের বড়ো। দাদার কাছে যায় সমীক, সব কিছু বলে তাকে। দাদা বলে— ‘দেখ আমার মনে হয় তোর মাকে সব বলা উচিত। আমার বিশ্বাস, মা কিছু বলবে না। যা গিয়ে সত্যি কথাটা বল।’
মা শ্রেয়ার ছবি আগে দেখেছে, মেয়েটাকে খুব পছন্দও তার। সমীক মায়ের কাছে যায়, সবটা বলে, ওদের যাওয়ার ব্যাপারটা, সব। শুধু বলে না যে শ্রেয়া তার কাছে বন্ধুর চেয়ে আরেকটু বেশি কিছু। মা, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বলে— ‘আচ্ছা যেতে দেব, কিন্তু ৯.৩০ র মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে, আর বেশি কিছু নয়।’
সমীক উত্তেজনা আটকাতে না পেরে মাকে চুমু খায় আর তাড়াতাড়ি শ্রেয়াকে রিপ্লাই ব্যাক করে— ‘মা যেতে বলেছে! মিটিং টাইম ৬.০০।’
মা মর্তে এসেছেন আজ ছয় দিন হল। ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’র জায়েগা নিয়েছে ষষ্ঠীর আমুদে ঢাক। ঘুম ভেঙে যায় সমীকের। বাইরে ঢাকের আওয়াজের সাথে এখন তালে তাল মেলাচ্ছে পাড়ার পুরোহিতের মন্ত্র। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সে। সকালে তার প্ল্যান নর্থ কোলকাতা যাওয়ার। খেয়ে—দেয়ে বন্ধুদের সাথে বেরোনোর আগে শ্রেয়াকে একটা মেসেগ করে সে— ‘সেই পুরোনো জায়গা তো?’ ওই দিক থেকে কিচ্ছুক্ষণ পরে রিপ্লাই আসে— ‘হ্যাঁ সেই জায়গা, সেই মোড়টা।’
এই প্যান্ডেল থেকে সেই প্যান্ডেল, নর্থ কোলকাতার অলি—গলি চষে বেরায় সমীকরা, শুধু খেয়াল থাকে না, বাঁ হাতের হাত ঘড়িটার দিকে। চোখ পড়তেই সমীক লক্ষ্য করে সময়টা, পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। শ্রেয়াকে তো সে বলেছিল ৬টায় দেখা করবে...
সমীক বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে যে তারা কেউ, তার সাথে ফিরবে কি না, সবাই না করে দেওয়ায়, সমীক একটা হলুদ ট্যাক্সিকে হাত দাখিয়ে উঠে পড়ে।
সব দিনের মতো তো আর আজকের দিন নয়। আজ হচ্ছে ষষ্ঠী। কেউ হয়তো কাজের থেকে কোলকাতায় ছুটিতে এসেছে, কেউ হয়তো কলেজের সেমিস্টার শেষ করেছে আর ফিরে এসেছে কোলকাতায়, একটাই কারণ— ‘দুর্গা পুজো’। তাই সেন্টিমেন্টাল বাঙালি আজ পুজোর প্রথম দিনে বেরবে না, এমন কি হয়? তাই এক বিশাল জ্যামে ফেসে যায় সমীক। অই দিকে সময় চলে যাচ্ছে, সাড়ে পাঁচটা, পাঁচটা চল্লিশ। এই তো আবার গাড়ি ছেড়েছে। ওই দিকে, শ্রেয়া তৈরি, সাদা একটা কুর্তি পড়েছে সে। আয়নায় নিজেকে দেখে, মনে মনে সে বলে— ‘উফফ! কী মিষ্টি লাগছে রে তোকে।’ সত্যিই কী মিষ্টি লাগছিল মেয়েটাকে।
সমীক’কে একটা ফোন করে সে—
—‘আমি আসছি পাঁচ মিনিটে।’
—‘আমি না ফেঁসে গেছি।’
—‘মানে?’
—‘এখানে সাঙ্ঘাতিক জ্যাম।’
—‘তুই তাড়াহুড়ো করিস না, আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।’
—‘২০ মিনিটে আসছি।’
বেশ কিছুক্ষন পর, মাকে নিয়ে সিঁথির মোড়ের মুখটায় দাড়ায়ে শ্রেয়া। মা হালকা হেঁসে জিজ্ঞেস করেন— ‘প্রথম বেরোনোতেই দেরি?’ হঠাৎ শ্রেয়া বলে— ‘এই তো আসছে...’
দূর থেকে পুজোর ভিড়ের মধ্যে, ঠিক শ্রেয়ার চোখ পড়ে একটা কালো পোলো, আর ক্রিম প্যান্ট পড়া একটা ছেলের দিকে— সমীক।
মায়ের সামনেই উত্তেজনা না আটকাতে পেরে শ্রেয়া জড়িয়ে ধরে সমীককে। মা একটু মুচকি হাসেন। সমীককে তিনি বলেন—‘মেয়েকে কিন্তু প্রথমবার একা ছাড়ছি পুজোর দিনে, ফিরিয়ে এনো।’ সমীক বলে— ‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না, ৯টার মধ্যে বাড়ি দিয়ে যাব।’
‘তাহলে তোরা সাবধানে জাস...আমি আসছি...।’
মা চলে যাওয়ার পর, সমীকের কাছে আসে শ্রেয়া, সেই পুজোর কোলাহল, মাইকে বাজা রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকের চিৎকার ছাপিয়ে একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর সমীকের কানে আসে— ‘কী রে, হাতটা ধরবি না?’