গদখালির ঠিক উল্টোদিকে হল সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান দ্বীপ গোসাবা। অর্ণব বললেন, ‘এখানে হাসপাতাল ও পুলিশ স্টেশন ছাড়া হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলো আছে’। আমি জানতে চাই, ‘হ্যামিল্টন সাহেব কে’? মিষ্টি হেসে অর্ণব বলতে থাকেন স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের গল্প। ১৯০৩ সালে তেত্রিশ বছর বয়সী এক অর্থবান স্কটিশ ব্যবসায়ী সুন্দরবনে এসে সরকারের কাছ থেকে ৯০০০ একর জমি কিনে জমিদারী পত্তন করেছিলেন ও সেখানেই বাকী জীবন কাটিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ রাজের অবহেলিত প্রজাদের উন্নতি সাধন। তিনি গোসাবা, রাঙ্গাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া এই তিনটি দ্বীপের মানুষ নিয়ে তাঁর গ্রামোন্নয়ন ও সমবায় প্রকল্প শুরু করেন। তাঁর নানা প্রকল্পের মধ্যে একটি ছিল নদীর পাড় বরাবর উঁচু করে বাঁধ দেওয়া। সেইসব কর্মকাণ্ড নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে হ্যামিল্টন সাহেবের চিঠিতে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সারেং সুব্রতবাবু এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার অর্ণবের কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, ‘হ্যামিল্টন সাহেবের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে এসেছিলেন। অনেক পর্যটক গোসাবায় সাহেবের বাংলো দেখতে যান। আজও সুন্দরবনের মানুষ সাহেবকে খুব শ্রদ্ধা করে’।
তারপর, অর্ণব খুব গুছিয়ে সুন্দরবন সম্বন্ধে আমাদের নানা তথ্য দিলেন। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলনস্থলে যে বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে রয়েছে এই বিখ্যাত জঙ্গল যার নাম সুন্দরবন। সুন্দরবন ভারত ও বাংলাদেশে অবস্থিত UNESCO স্বীকৃত World heritage site। সেখানে রয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় বদ্বীপে অবস্থিত লবণাম্বু উদ্ভিদের জঙ্গল বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। জায়গাটির নাম তার জঙ্গলের রূপের জন্য নাকি সেখানে থাকা লবণাম্বু উদ্ভিদ সুঁদরি বা সুন্দরী গাছের নামানুসারে তা সঠিক ভাবে জানা যায়না। বদ্বীপ অঞ্চলটি জুড়ে রয়েছে অজস্র ছোট-বড় নদী ও খাঁড়ি আর তাদের মাঝে মাঝে জেগে আছে কতোগুলো দ্বীপ। সুন্দরবনের মোট ১০,০০০ স্কোয়ার কিমি অঞ্চলের ৫৭৩৬ স্কোয়ার কিমি রয়েছে বাংলাদেশে ও ৪২৬৪ স্কোয়ার কিমি আছে ভারতে। ভারতীয় অংশে ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪টি দ্বীপে মনুষ্যবসতি রয়েছে। জলের ধারে রয়েছে নানা ধরণের লবণাম্বু উদ্ভিদের বাস আর ভেতরের জঙ্গলে রয়েছে জলের লবণত্ব ও জমিতে থাকা খনিজ পদার্থের পার্থক্য অনুযায়ী অন্য নানা ধরণের গাছপালা। সেই ঘন জঙ্গলে বাস করে বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-সহ আরো নানা প্রাণী।
১৯৭৩ সালে ভারত সরকার সুন্দরবনে ব্যাঘ্র প্রকল্প শুরু করে। ১৯৮৭ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলকে মধ্যস্থলে রেখে তৈরী হয়েছে সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান। অর্ণবের কাছে আরো জানলাম যে পায়ের ছাপ দেখে বাঘ গণনার পুরনো পদ্ধতি খুব সঠিক ছিলনা। দু’শটি ক্যামেরা থেকে পাওয়া ছবি অনুযায়ী ২০১০ সালে সুন্দরবনে ৯৬ টি বাঘ ছিল। সম্প্রতি সাতশ’টি ক্যামেরার সাহায্যে যে গণনা হয়েছে তার ফলাফল সরকারীভাবে এখনও জানা যায়নি তবে বাঘের অসমর্থিত সংখ্যা হল ১৫০।
সুন্দরবন সত্যি সত্যি বিপদসংকুল জায়গা – তার জলে কুমীর ও ডাঙ্গায় বাঘ। এছাড়া, প্রাণীদের মধ্যে বড় বেড়ালের মতো বাঘরোল, চিতল হরিণ, বাঁদর, গোসাপ, নদীর শুশুক, ইত্যাদি রয়েছে। নানাধরণের (বিষাক্ত ও নির্বিষ) সাপ ছাড়া, Olive ridley turtle আর Batagur Basca নামে একরকম কচ্ছপও সেখানে পাওয়া যায়। জঙ্গলে বসবাসকারী কয়েকশ’ রকম পাখি ছাড়া পরিযায়ী পাখিও সেখানে আসে। আক্ষেপ করে অর্ণব বললেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তনে সমুদ্রের জল বাড়ছে আর তার ফলে বদ্বীপ অঞ্চলের জল বেশি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে সুন্দরবনের জঙ্গল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও অনেক প্রাণী লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে’।
আমাদের যাত্রা শেষ হল বেলা গড়িয়ে। জেটির রেলিং বিহীন সিঁড়ি দিয়ে নড়বড় করে ওপরে উঠে কাদা-জল বাঁচিয়ে মেঠো রাস্তায় হেঁটে গিয়ে রিসর্টে পৌঁছলাম। সেখানে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল এক অস্থায়ী ছাউনির তলায় বাঘের পিঠে আসীন সুসজ্জিতা এক দেবীমূর্তি ও তার পাশে লগুড়-হাতে এক পুরুষের মূর্তি। কোন দেবতার ‘থান’ তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
অর্ণবের কাছে যখন দেবীর পরিচয় জানতে চাইলাম, তিনি বেশ হেঁয়ালি করে বললেন, ‘আজকের সন্ধের অনুষ্ঠানে জানতে পারবেন, ম্যাডাম’। তারপর, তিনি রিসর্টে থাকা সুঁদরি, পলাশ, সুপুরি, রঙ্গন, নানারঙ্গের জবা, নয়নতারা, হাস্নুহানা, শিউলি ইত্যাদি গাছ ও ফুলের সঙ্গে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন। আমাদের ঘরের সামনে একজোড়া পুকুর তখন জলে টৈ-টম্বুর আর তাদের মাঝে থাকা রাস্তায় ঘন কাদার প্রলেপ। পুকুর পাড়ে নারকেল ও সুপুরি গাছের সারি। বাগানে কয়েকবার পায়চারী করতেই দেখা পেলাম মৌটুসি, ঘুঘু, দোয়েল ও টিয়ার ঝাঁকের।
দুপুরের রান্নার স্বাদ এতো ভাল লাগল যে ভাবলাম রাঁধুনির সঙ্গে আলাপ করবো। রান্নাঘর থেকে অবলীলায় গাওয়া যে মান্না দের গান ভেসে আসছে তা তিনিই গাইছেন জেনে তখন আর ওঁকে বিরক্ত করিনি। ভদ্রলোকের নাম হল দামু। সন্ধ্যেবেলা খাবার ঘরে একদম চোখ বুজে দরদী কণ্ঠে তিনি গাইছিলেন ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’। গানের শেষে আমি গিয়ে দামুর সঙ্গে আলাপ করলাম আর ওঁর রান্না ও গানের প্রশংসা করলাম। খুব খুশি হলেন উনি। বললেন, ‘কাল দুপুরে আপনাদের দাতনে মাছের টম্যাটো ফিশ খাওয়াবো’। ভারি স্বাদু ছিল সে পদটিও। পরে আমি যখন রেসিপি চাইতে গেলাম, দামু গুছিয়ে বলে গেলেন ‘গরম কড়াইতে আস্ত টম্যাটো সেঁকে নিয়ে মিক্সিতে ঘুরিয়ে নিন…’ ইত্যাদি। একদম নিপুণ বর্ণনা। শুনলাম যে উনি কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়াশুনো করেছিলেন; চোখের কিছু সমস্যা হওয়ায় সুন্দরবনে ফিরে আসেন। এখন চোখ ঠিক আছে কিন্তু স্ত্রী ওঁকে ছেড়ে চলে যাওয়া ইস্তক দামুর মন ভাল নেই। রিসর্টে রান্না করেন, হাসিমুখে অতিথিদের সঙ্গে গল্প করেন, গান করেন – এককথায়, ভালো থাকার চেষ্টা করেন।
গ্রামের পুজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছিল চটুল বাংলা গান; সুব্রতবাবুর কিশোর-পুত্র বান্টি (যে ওঁর সহকারীও) সেই গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল। রিসর্টে ফিরতে ফিরতে নেমে এল ঘন অন্ধকার, আকাশ তারায় ভরা, চারদিক নিস্তব্ধ। জেটির কর্দমাক্ত সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ চোখে পড়ল সামনের কলার ঝোপের পেছনে লক্ষ্মী পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র। থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য দেখে পা বাড়ালাম রিসর্টের দিকে।
অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে বুঝতে পেরে গিয়েছি যে রিসর্টে বনদেবীর ‘থান’ রয়েছে। একটু যাত্রার স্টাইলে সংলাপ বলে ও গান গেয়ে চরিত্ররা কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অভিনয়-গান-আবহ সঙ্গীত সবই খুব ভালো লাগল। প্রত্যেকের বেশবাসও যথাযথ তবে দক্ষিণ রায় যখন জঙ্গলির সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমার বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল তার ‘Nike’ লেখা পরিধেয়টির দিকে। আবার, ধনা মউলি কেন স্টেজে নাগরা পরে আছে তা আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। সব থেকে অবাক হচ্ছিলাম এই দেখে যে কাহিনীর চরিত্ররা যেহেতু নামাজ পড়ছে, আল্লার ‘দোয়া’ প্রার্থনা করছে অর্থাৎ তারা একেশ্বরবাদী মুসলমান তাহলে তাদের উপাস্য কী করে এক ‘দেবী’ হলেন।
অনুষ্ঠান শেষে আমরা অভিনেতাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। অল্প-বিস্তর সকলেই বললেন ওঁদের আর্থিক দুর্দশার কথা, পরপর সাইক্লোনে সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতির কাহিনী। জঙ্গলি-র চরিত্রে যিনি ছিলেন তাঁর নাম নৃপেন মণ্ডল ও তিনিই পরিচালক। পালাটি কার লেখা জানতে চাইলাম। উনি যা বললেন তাতে বুঝলাম যে মহম্মদ মুনশি ও মুনশি মহম্মদ খাতের নামের দুজন লেখকের লেখা বইতে এই কাহিনী আছে।
উদ্যোক্তা ও অভিনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম ‘বনবিবি’র জন্মের এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী। আল্লা রসুল এই দেবী ও তাঁর যমজ ভাই শাহ জঙ্গলিকে সৃষ্টি করে সুদূর মক্কা থেকে ‘ভাটির দেশ’ সুন্দরবনে পাঠিয়েছিলেন জঙ্গলের পশুপাখি ও সেখানকার মানুষদের রক্ষা করবার জন্য। দেবীর শত্রু হল ‘দক্ষিণ রায়’ যে বাঘের বেশে এসে মানুষের ক্ষতি করে। সুন্দরবনের ভারত অঞ্চলে দেবী লাল শাড়ি পরা ও তাঁর মাথায় মুকুট কিন্তু বাংলাদেশে তিনি পাজামা-কামিজ পরিহিতা ও তাঁর মাথায় থাকে টুপি। সুন্দরবনের মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে কাঠ, মধু, মোম, মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি সংগ্রহ করতে বিপদসংকুল জঙ্গলে প্রবেশ করবার আগে বনবিবির পুজো করে যাতে তিনি তাদের যেকোনো রকম বিপদ থেকে রক্ষা করেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উপাস্য এই বনবিবিকে দুই ধর্মের সমন্বয়কারী দেবতা বলে বর্ণনা করা হয় যাঁর পূজো অবশ্য সুন্দরবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এককালে বনবিবির পূজোর অঙ্গ ছিল ‘বনবিবির পালাগান’ কিন্তু আজকাল পুজো ছাড়া সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যও ‘বনবিবির উপাখ্যান’ অভিনীত হচ্ছে।
অভিনেতাদের প্রায় সকলের পদবী ‘মণ্ডল’, ধনা মউলির চরিত্রে যে লম্বা-চওড়া ভদ্রলোক অভিনয় করছিলেন একমাত্র তাঁর পদবী ‘মির্ধা’। তিনিও আর্থিক দুরবস্থার কথা বললেন কিন্তু তার কারণ শুধু সাইক্লোন নয়। কথা বলতে বলতে তিনি ডান পায়ের নাগরাটি খুলে ফেলতেই আমি তাঁর জুতো পরে স্টেজে ওঠার কারণটা বুঝে শিউরে উঠলাম – ওঁর পায়ের পাতার সামনের খানিকটা অংশ নেই। সাইক্লোনে জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্বামী-স্ত্রী মিলে কাঁকড়া ধরা শুরু করেছিলেন। একদিন কাদাজলে দাঁড়িয়ে কাঁকড়া ধরার সময় আচমকা এক কুমীর এসে তার পায়ে কামড় বসায়। অনেকক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন বটে কিন্তু পায়ের পাতার অনেকখানি ততোক্ষণে ক্ষত-বিক্ষত। জমি বিক্রি করে তিনমাস ধরে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করিয়ে এখন তিনি সুস্থ কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে নিঃস্ব। দুখের মা যিনি হয়েছিলেন তাঁর সঙ্গেও আলাপ হল। মহিলা বেশ হাসিখুশি; উনি একজন যাত্রাশিল্পী আর তাছাড়া স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি পোলট্রি চালান।
আমরা ছাড়া ঐ রিসর্টে ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা দুই মহিলা ছিলেন। তাঁরা দু’জন বন্ধু, নাম প্রিয়া ও সুমতি। সেদিন তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হল। মাতৃভাষা বাংলা না হলেও প্রিয়া অল্প-স্বল্প বাংলা বলছিলেন। ‘বাংলা কোথায় শিখলেন’? জানতে চাইলাম। প্রিয়া বললেন ‘কিছুদিন এক বাঙালি পরিবারের কাছাকাছি ছিলাম’। শুনলাম যে ওঁরা দুজনে বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ ও প্রিয়ার ইংরিজি ভাষায় লেখিকা হিসেবে সুখ্যাতি আছে। তিনি তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাসের একটি অংশের পাদপূরণ করবার উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে বেড়াতে এসেছেন।
দ্বিতীয়দিন সকালে জলখাবার সেরে সুব্রতবাবুর লঞ্চে সারাদিনের জন্য বেরোলাম। আমাদের সঙ্গী হলেন রিসর্টের আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক সুমিত। সুব্রতবাবুর সঙ্গে অনেক গল্প হল। উনি বেশ মজা করে বললেন, “জীবনে চুরি-জোচ্চুরি ছাড়া সবরকম কাজ করেছি। চারমাস আমি এই লঞ্চ নিয়ে ইন্ডিয়ান নেভির সঙ্গে সমুদ্রের ‘জল মাপার’ কাজ করেছি; আমার লঞ্চে কম্প্যুটার বসিয়েছিল। এছাড়া, চেন্নাইতে ছিলাম বেশ কিছুদিন”। উনি তরমুজের চাষও করতেন কিন্তু সাইক্লোন আয়লার পর জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ওঁর চাষ বন্ধ হয়ে যায়। সুব্রতবাবুর ছেলেটি স্কুলের পর আর পড়তে চায়না বলে উনি দুঃখ করছিলেন তবে ওঁর মেয়ে যে ক্যানিং-এর হস্টেল-এ থেকে কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ছে তা নিয়ে ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে গর্বিত।
একটি গ্রামের নদীর পাড়ে পরপর নৌকো সার দিয়ে রাখা আছে যাদের অনেকগুলোর মাথায় সোলার প্যানেল বসানো। সুব্রতবাবু বললেন যে ওটি জেলেদের গ্রাম আর নৌকোগুলো তাদেরই। আমাদের পাশ দিয়ে একটা বড় নৌকো গেল যাতে চারজন বৈঠা বাইছে ও একজন হাল ধরে আছে। শুনলাম ওটিও জেলেদের নৌকো তবে তারা ‘পারমিট’ করিয়ে বেশি মাছের আশায় দূরে কোথাও মাছ ধরতে যাচ্ছে; সঙ্গে বরফ আছে কারণ তারা ফিরবে চার-পাঁচদিন পর। আমাদের মতো পর্যটকদের লঞ্চও দেখছি; কাছাকাছি হলে তাদের হাত নাড়ছি। বাংলাদেশের একটি পণ্যবাহী জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল। একটি শৌখিন লঞ্চে জনা দশেক শ্বেতাঙ্গ পর্যটক ছিলেন। আবার, বড় এক নৌকোয় এক ভদ্রলোককে দেখলাম ইয়া লম্বা টেলিফোটো-লেন্স লাগানো ক্যামেরায় চোখ দিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছেন – যেন ধ্যান-মগ্ন এক ঋষি।
কিরণবাবু পাখি ও জন্তু দেখা বা দেখানোর ব্যাপারে তেমন দড় নন; উনি দেখানোর আগে আমরা নিজেরা দেখতে পাচ্ছি। তবে, উনি অনেক রকম গাছ চেনালেন - সুঁদরি, গেওয়া, গরান, হেতাল (সরু সরু সবুজ পাতার মধ্যে কতোগুলো হলদে পাতা থাকায় ঐ ঝোপে বাঘের লুকিয়ে থাকা সহজ হয়), কাঁকড়া গাছ (তার লাল ফুল দেখলে কাঁকড়া বলে ভুল হয়), কেওড়া, আরো কতো নাম। আর দেখলাম গোলপাতার গাছ যা বাড়ি ছাওয়ার কাজে লাগে কিন্তু এখন লুপ্ত হতে বসেছে। কোথাও দেখেছি নদীর এক পাড়ে গ্রাম ও অন্যদিকে জঙ্গল। বাঘ বা বন্য জন্তু আটকানোর জন্য জঙ্গলের ধারে ধারে নাইলনের নেট লাগানো রয়েছে যা আয়লার দাপটে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শুনলাম যে এতো সাবধানতা সত্ত্বেও অল্পদিন আগে বাঘ সাত কিমি জল সাঁতরে গিয়ে এক গ্রামে ঢুকে মানুষ মেরেছে। এছাড়া, নদী পাড় ভেঙে জঙ্গলকে গ্রাস করছে যে তেমন চিহ্নও দেখলাম।
কিরণবাবু বললেন যে ২০০৯ সালের আয়লার ফলে অনেক বুনো শুয়োর, হরিণ ইত্যাদি মারা গেছে বলে বাঘের খাবারে টান পড়েছে। অন্যদিকে, প্রশাসনের বারণ না শুনে মানুষ জঙ্গলের Core area-তে ঢুকে যাচ্ছে ও অনেক সময় বিপদের মুখে পড়ছে। অনেক খাঁড়ির মুখে বিপদের চিহ্ন দেওয়া রয়েছে অর্থাৎ সেখানে ঢোকা বারণ। সে বারণ যে লোকে শোনেনা তা নিজের চোখেই দেখলাম। নিষিদ্ধ এক সরু খাঁড়ি থেকে একটা জীর্ণ ও ছোট নৌকো বেরিয়ে এলো; তার তিনজন যাত্রীর মধ্যে এক মহিলাও আছে। সুমিত বললেন, ‘এরা কাঁকড়া ধরতে ঢুকেছিল’।
আধঘন্টা মতো চলেছি বোধহয়, জোরে হাওয়া দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। নদীর জলেও এলো চঞ্চলতা, বেশ ফুলে ফুলে উঠছে সে। আস্তে আস্তে লঞ্চ জঙ্গলের দিকে সরে গিয়ে ধীর গতিতে চলতে লাগল। মিনিট দশেক পরে বৃষ্টি থামতেই রোদ উঁকি দিল। গাছের পাতায় থাকা জল চকচক করছে। আমরা সুধন্যখালি খাঁড়িতে ঢুকলাম। গ্রামের সীমা একসময় শেষ হয়ে গেল। সেখানে জলের ধারে অনেক হেতল গাছ রয়েছে। খানিক পরে দেখি লম্বা সরু ঠোঁটওয়ালা একটা Eurasian Curlew আস্তে আস্তে কাদাজলের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
কোনো Observation tower-এ না গিয়ে আমরা নদী ও খাঁড়িতে থাকাই পছন্দ করেছি কারণ তাতে জঙ্গলের কাছাকাছি যাওয়া যায় ও পশুপাখি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কিছুক্ষণ চলার পর আবার দেখি আকাশে কালো মেঘ জমেছে। সুধন্যখালি থেকে বনবিবি ভারনি দিয়ে চলতে লাগলাম। খানিকক্ষণ বাদে পেলাম বিশাল চওড়া গাজিখালি নদী যার কথা আগের দিনের বনবিবির পালায় উল্লেখ ছিল। দুপুরে যখন খেতে বসেছি প্রবল বৃষ্টি এল, তার সঙ্গে যোগ দিল ঝোড়ো হাওয়া। মুহুর্তে চারপাশ অদৃশ্য হয়ে গেল, আবার লঞ্চের গতি গেল কমে। বিশাল নদীর বুকে বসে সেই পাগল করা বৃষ্টি দেখা যে কী অনবদ্য এক অভিজ্ঞতা তা লিখে বোঝানো মুশকিল।
বিকেলে যে খাঁড়ি দিয়ে চলছিলাম সেখানে জল খুব কম ছিল। ফলে, লঞ্চ যাতে আটকে না যায় সেই কথা মাথায় রেখে খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছিল। বান্টির হাতে স্টিয়ারিং দিয়ে সুব্রতবাবু সামনে থেকে ওকে নির্দেশ দিতে লাগলেন। লঞ্চের বাকীদের চোখমুখ বলে দিচ্ছিল যে তারা সকলে চিন্তিত। আলো বেশ কমে এসেছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি হল যে ঐ খাঁড়ি থেকে বিকেল পাঁচটার পর আমরা যদি বেরোই তাহলে বন দফতর গাইড ও লঞ্চকে জরিমানা করবে। দেরী একটু হল ও সেখান থেকে বেরোনোর মুখে বন দফতরের লঞ্চও দেখতে পেলাম কিন্তু সৌভাগ্যবশত তাতে তখন কোনো রক্ষী ছিলনা বলে আমরা বেঁচে গেলাম।
আমাদের দুদিনব্যাপী জলে-জঙ্গলে বেড়ানোর সময় যেসব নদী, খাল বা খাঁড়ি এলো তাদের সবার নাম শুনেছিলাম – বিদ্যেধরী, দুর্গদুয়ানি, সজনেখালি, পীরখালি, ইত্যাদি কতো নাম। তবে আমার কাছে তারা সবাই শুধু ‘নদী’ হয়েই রইল – বড় নদী বা ছোট নদী; কেউ তার বিস্তৃত বক্ষে বহন করে চলেছে বিশাল জলরাশি, কারো বা ক্ষীণতনু তবে তারা সকলেই সুন্দরী। সেই সব নদীর ধারে জঙ্গল রয়েছে, কখনও রয়েছে কোনো গ্রাম আর কখনও অন্য আরেকটি নদী যেন সই পাতাতে এসে আমাদের নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। সবুজের বাহারও বা কতোরকম – চোখ জুড়িয়ে যায় সেই সবুজের বৈচিত্র্য দেখলে। প্রকৃতির এমন রূপ দেখলে স্বভাবতই মুগ্ধ হতে হয়।
ফেরার পথে মনে হচ্ছিল যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ও সেখানকার মানুষজনের আদর-যত্নে আমি তো তাজা হয়ে ফিরছি কিন্তু সেখানে যাঁরা বাস করেন দারিদ্র্য-দুর্দশা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। সুন্দরবনের মানুষের কাছে বঙ্গোপসাগরে তৈরি সাইক্লোন তো অচেনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে পরপর আসা সাইক্লোনে তাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা অভূতপূর্ব। ওখানে যার সঙ্গে কথা বলেছি সেই বলেছে আম্ফানের থেকেও সাইক্লোন ইয়াস-এ তাদের বেশি ক্ষতি হয়েছে, অনিশ্চিত হয়েছে দ্বীপবাসীদের ভবিষ্যৎ। খবরে জেনেছি যে সুন্দরবনের নদীর পার কংক্রিট-এ বাঁধানোর জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছিল কিন্তু কাজটি সম্পন্ন হয়নি। ফলে, সাইক্লোনের সময় মাটির বাঁধ ভেঙে জল বসতিতে ঢুকে পড়ে জমি-বাড়ি ভাসিয়ে দিয়েছে। জমিতে নোনা জল ঢোকায় আগামী কয়েক বছর তা চাষের অযোগ্য হয়ে থাকবে, পুকুরগুলো নোনা জলে ভরে যাওয়ায় তাতে যে মাছ চাষ করা হয়েছিল সেইসব মাছ মরে গিয়েছে, বাড়িঘরের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়। ঐ পরিমাণ ক্ষতি সামাল দিতে যতোখানি আর্থিক অনুদান প্রয়োজন তা তো তারা পাচ্ছেনা। মনে পড়ল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘মানুষ বড় কাঁদছে’ – জানিনা ভবিষ্যতে কে ‘মানুষ হয়ে’ তাঁদের পাশে দাঁড়াবে!