• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • খোলা আকাশ: মঙ্গোলিয়া : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    জাতীয় পোশাকে মঙ্গোলিয়ান


    জ্যামিতির সরল রেখার মত সরু সোজা রাস্তা চলে গেছে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মাথার ওপর খোলা আকাশ। দু’পাশে খাঁ খাঁ মরুভূমি, পাটকিলে রঙের শুকনো অনুর্বর মাটি। পাথর, বালি আর কাঁকরে ভর্তি। রাস্তার ধারে নেই কোনো নিশানা, সাইনবোর্ড, গাছ পালা বা মানুষের বসতির চিহ্ন।

    আচমকা ড্রাইভার রাস্তা থেকে নেমে, বাঁদিকে ঘুরে সোজা চলল মরুভূমির মধ্য দিয়ে। চারদিকে শুধু দিকচিহ্নহীন শুকনো বালি। এইদিকেই নাকি কয়েক ঘণ্টা দূরে আমাদের ক্যাম্প। কি করে ড্রাইভার সেটা চিনল? মরুভূমির অনেক রহস্যের মত এটাও আমার অজানা।

    পরে ওর সীমিত ইংরেজিতে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। মরুভূমির লোকেদের একটা সহজাত দিকনির্ণয়ের জ্ঞান থাকে। চারদিকে তাকিয়ে দূরত্ব আন্দাজ করতে পারে। আর সূর্য বা তারার সাহায্যে দিক ঠিক করে। অনেকটা পরিযায়ী পাখিদের মতই। জিপিএস, কম্পাস ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ওসব ওদের খুবই কম ব্যবহার করতে দেখেছি।

    মঙ্গোলিয়ায় এসেছি দিনতিনেক হল। ছোট্ট দেশ, রাশিয়া আর চীন দুই দৈত্যের মাঝখানে চিঁড়েচ্যাপটা। এটা আউটার মঙ্গোলিয়া। ইনার মঙ্গোলিয়া অনেক আগেই তিব্বতের মতো চীনের দখলে চলে গেছে। রাজধানী উলানবাটার-এর (Ulanbataar) চিঙ্গিস (চেঙ্গিস নয়!) খান এয়ারপোর্টে নামলাম। নাম দেখেই মনে পড়ে যায় ইতিহাসের পাতায় মঙ্গোলদের সাম্রাজ্য বিজয়ের কীর্তি। তেরো’শ শতাব্দীতে বীর চিঙ্গিস খান এই ছোট্ট দেশটির সীমানা পূবে জাপানের তীর থেকে পশ্চিমে পোল্যান্ড পর্যন্ত বাড়িয়েছিলেন। তাঁরই উত্তরাধিকারীরা চীনের বিরাট সাম্রাজ্য অধিকার করেন আর দক্ষিণে পারস্যে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন যারা ভারতে আমাদেরই পূর্বপুরুষ। ইতিহাস চিঙ্গিস খানের সৈন্যবাহিনীকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়েছে, অথচ ‘বর্বরতায়’ এদেরই সমান কিন্তু অনেক ছোট সাম্রাজ্যের অধিকারী আলেকজান্দারকে ‘দি গ্রেট’ বলে সম্মানিত করা হয়েছে! কিরকম পরিহাস বলুন তো! খতিয়ে দেখলে অন্যান্য সৈন্যদের তুলনায় মঙ্গোল ‘বর্বর’রা অনেক ভদ্র ও সংযত ছিল। চেঙ্গিস খান সব ধর্ম সমান দেখতেন। কখনো কোনো বিজিত রাজ্যের ধার্মিক সংস্থান নষ্ট করেননি। যুদ্ধে সৈন্য মেরেছেন ঠিকই কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে কারুর ক্ষতি করেননি। একথা অন্য কোনও বিজেতা সম্পর্কে বলা যায় কি?


    চেঙ্গিস খানের মূর্তি

    এই সবের জন্যই চেঙ্গিস খান এদেশের জাতীয় পিতা। তিনি সত্যিই জাতির পিতা! শোনা যায় তাঁর নাকি একশোরও বেশি ছেলেমেয়ে ছিল। এদেশের প্রত্যেকের শরীরে (আমাদের উত্তর ভারতীয়দেরও হয়তো) চিঙ্গিস খানের রক্ত বইছে। সম্প্রতি রাজধানী উলানবাটার (মঙ্গোলরা ছোট্ট করে বলে ইউবি বা UB) থেকে ঘন্টাখানেক দূরে চিঙ্গিস খানের একটি বিরাট ১৩০ ফুট উঁচু পুরো স্টেনলেস স্টিল দিয়ে বানানো স্ট্যাচু তৈরী করা হয়েছে। খোলা আকাশের নীচে রোদ্দুরে ঝকমক করে। সঙ্গে আছে একটা ছোট মিউজিয়াম আর স্যুভেনির দোকান। ভেতরে লিফট আর সিঁড়ি দিয়ে চিঙ্গিস খানের ঘোড়ার মাথা পর্যন্ত চড়া যায়। (ছবিতে ঘোড়ার মাথার ওপর ছোট্ট ফুটকি দেখুন)।

    এয়ারপোর্টে নেমে কাস্টমসের ফর্ম ভরতে গিয়ে আরেক সারপ্রাইজ- (মঙ্গোলিয়া এরকম নানা সারপ্রাইজে ভরা)। ফর্মের লেখাটা মঙ্গোলীয় বা চাইনিজ অক্ষরে নয়, রাশিয়ান সিরিলিক (cyrilic) অক্ষরে। কেন জানি আমার ধারণা ছিল যে চীন ও মঙ্গোলিয়ার সংস্কৃতি ঐতিহাসিক ভাবে—চেঙ্গিস খানের সময় থেকে—জড়িত। কিন্তু মিং সম্রাটদের সময় সম্পর্কে চিড় খায় আর মঙ্গোলরা রাশিয়ার দিকে ঝোঁকে। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পর মঙ্গোলিয়ায় গণতন্ত্রের শুরু হয়েছে কিন্তু বন্ধুত্বটা এখনও রয়ে গেছে। স্কুলে এখনো রাশিয়ান শেখায়। ট্যুরিজম, খাবার, ব্যবসা, যাতায়াত সবকিছুতেই রাশিয়ার প্রভাব চীনের থেকে বেশি। এমনকি খাবার টেবিলেও স্যুপ স্যালাডের সঙ্গে ছুরি কাঁটা মজুত, চপস্টিকের চিহ্নও নেই! এটাও আমাকে খুব অবাক করেছিল।

    গবি (গোবি নয়!)মরুভূমি যাত্রার আগে তিনদিন ইউবি ও আশেপাশের কিছু জায়গাগুলো দেখলাম। মঙ্গোলিয়ার চল্লিশ শতাংশ লোক ইউবি শহর বা শহরতলীতে থাকেন। শহরের বাইরে দেশটা জনবিরল। আর একেবারে খোলা আকাশের দেশ। খাড়াই-উতরাই স্টেপ (steppe) মালভূমি। সবুজ ঘাসে ঢাকা কিন্তু বড় গাছপালা একেবারেই নেই। তাই শনশনে হাওয়া চলছে সর্বদা। শহরের মধ্য দিয়ে ছোট্ট টুল (Tuul) নদী বয়ে চলেছে, তারই পাশেপাশে কয়েকটা পত্রমোচী গাছ দেখলাম, ব্যস।

    শহরটা আধুনিক, প্রচুর ঝকমকে দোকানপাটে ভরা কিন্তু মরুভূমির ধুলো আর গাড়ির ধোঁয়ায় ভর্তি। রাস্তাঘাটে ভীষণ যানজট, কিন্তু শহরের বাইরে রাস্তা একেবারে সুনসান। আজকাল রাশিয়ার থেকেও দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সিনেমা, টিভি ও গানের জন্য। হলিউড বলিউড সব ছেড়ে সবাই k-pop আর k-drama নিয়ে পড়েছে। অল্পবয়সীরা সব কোরিয়ান আর্টিস্টদের ফ্যান। পাড়ায় পাড়ায় কোরিয়ান রেস্টরান্ট আর কোরিয়ান ভাষা শিখবার স্কুল গজিয়ে উঠেছে। কোরিয়ান টুরিস্টদের সংখ্যাও বেশ বেড়েছে।


    রাজধানী উলানবাটার বা ইউবি

    উঁচু গাছ না থাকলেও উঁচু, আকাশচুম্বী বহুতল বাড়ীতে শহরটা ভরতি। এরই ছোট ছোটো পায়রার খুপরিতে সাধারণ শহুরে মঙ্গোলদের বাস। এদেরই পূর্বপুরুষরা খোলা আকাশের নীচে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়াতেন। ভাবলেই কষ্ট হয়। বাড়তি জনসংখ্যার বাসস্থান জোগাতে সরকার শহরতলীতে আরও বহুতল ফ্ল্যাট বানাচ্ছেন। একতলা বাড়ি আর দেখাই যায়না। আমি শুধু একটাই দেখেছিলাম—সেটা মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্টের বাড়ী!


    ঘের-এর ঘর

    তাই শহুরে মঙ্গোলরা সুযোগ পেলেই বাইরে ছোটেন একটু খোলা আকাশ আর তাজা বাতাসের খোঁজে। পাহাড়, মরুভূমি, জঙ্গল যেখানেই হোক একটা ঘের (গোল তাঁবু) খাটিয়ে ফেলেন। মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে এরা ঘের খাটাতে ও তুলে ফেলতে পারেন। এই ঘের (gher) গুলি মঙ্গোলিয়ানদের যাযাবর প্রকৃতির প্রতীক। ইউবির বাইরে ঘন্টাখানেক দূরে পাহাড়ের গায়ে পাইন জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প বানানো হয়েছে। তাঁবুর বদলে এখানে সব ঘের। পরিবার সুদ্ধু সবাই উইকএন্ড কাটাতে আসেন, বাচ্চারা খোলা হাওয়ায় ছোটাছুটি করে নেয়।


    ঘের-এর অভ্যন্তরে

    মরুভূমির মধ্যেও আমরা যেখানেই গেছি, টুরিস্ট ক্যাম্পে ঘরের জায়গায় ঘের পেয়েছি। এগুলি বেশ বড়সড়, গোল তাঁবু, দেয়াল আর ছাত ভেড়ার উল দিয়ে ঠাসা, শীতের সময় তাঁবু গরম রাখে। মেঝেয় পুরু উলের কার্পেট। তাঁবুর ঠিক মাঝখানে একটা উনুন বা ফায়ারপ্লেস, তার লম্বা চিমনীটা ছাতের মাথা ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে থাকে, যাতে ধোঁয়াটা একেবারে বাইরে বেরিয়ে যায়। উনুনের আশেপাশে রান্না, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি আর দেয়াল ঘেঁষে দুতিনটে খাট—মোটা উলের লেপ, তোশক সমেত। মরুভূমিতে রাত্তিরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে আর খোলা জায়গা বলে কনকনে হাওয়া। এক রাত্রি কিছু কাঠকুটো নিয়ে আমরা উনুনটা জ্বালিয়েছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো তাঁবুটা এমন গরম হয়ে উঠলো যে সারারাত দরজা খুলে রাখতে হয়েছিল। ঘেরগুলোর ভেতরে ও বাইরে নানা রঙের কারুকার্য করা—মঙ্গোলিয় প্রথায় মঙ্গলের চিহ্ন। ঘের-এ একটাই দরজা এবং সেটা বড়জোড় চার সাড়ে চার ফুট উঁচু। তাই সবাইকে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়, এভাবে ঘের-এর মালিককে শ্রদ্ধাও জানানো হয়। অবশ্য এটা মনে না রাখলে মাথায় ঠোক্কর খেতে হবে।

    ক্যাম্পগুলো শুধু গরমকালে খোলা থাকে। মাঝখানে দুটো পাকা বিল্ডিং—একটায় কিচেন আর খাওয়ার ঘর এবং অন্যটা বাথরুম ও শাওয়ার। চারপাশে দু’তিন ডজন ঘের-এর ঘেরাও। বাথরুমগুলি মোটামুটি চলনসই, কিন্তু বাইরে যতই ঠাণ্ডা পড়ুক, গরম জল পাবেননা। আর রাত্তিরে বাথরুম যেতে হলে অন্ধকারে, উঁচুনিচু মাটিতে ঠোক্কর খেতে হবে। এদেশে বুড়োমানুষ বা প্রতিবন্ধী লোকেদের জন্য বিশেষ সুযোগসুবিধে নেই। বয়স্ক মঙ্গোলীয়দের বাইরে বড় একটা দেখাই যায়না। আমার বয়সী একজনকেও আমি দেখিনি।

    ইউবি-তে দুদিন কাটিয়ে আমরা গবি সফরে বেরোলাম। সঙ্গে গাইড নামি ও চালক দাম্বা (এগুলি এদের ডাকনাম, ভালোনামগুলো ভীষণ লম্বা ও কঠিন উচ্চারণ।) দুজনেই খুব মিশুকে, উৎসাহী আর আড্ডাবাজ। নামি বেশ ভালো ইংরাজি বলতে পারে। দুবছর আমেরিকায় পড়াশোনা করেছিলো। দাম্বা অতটা চোস্ত নয় কিন্তু গাড়ি চালাবার ও দিকনির্ণয়ের ব্যাপারে ওর মতো এক্সপার্ট আমি কাউকে দেখিনি। রাস্তা এবড়োখেবড়ো, উঁচুনিচু, ঢিপি আর গর্তে ভর্তি। সারাদিন এরকম রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতেখেতে শরীরের হাড়গোড় সব আলগা হয়ে গেছে মনে হয়। এরকম রাস্তায় পুরো মন দিয়ে চালানো দরকার। দাম্বা কিন্তু একেবারে নির্বিকার, একহাতে স্টিয়ারিং আর অন্য হাতে চিপস বা জুস, সারাক্ষণ নামির সঙ্গে হাসিগল্প চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ কোথাও এতটুকু ঠোক্কর না খেয়ে। আর ওর দিকনির্ণয়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে তো আগেই বলেছি। একেবারে ম্যাজিক!


    নামি ও দাম্বার সঙ্গে বাজ ও আইরাগ

    আমাদের গাড়িটা ছিল শক্তপোক্ত ফোরহুইল, তাতে এক্সট্রা পেট্রোল, তেল, জল, খাওয়ার জল, স্ন্যাক্স, কম্বল, ফার্স্ট এইড, ম্যাপ ,ব্যাটারি ইত্যাদি ভরা হল। মরুভূমিতে এসব পাওয়া মুশকিল। তাই সবকিছু আগে থেকে হিসেব করে নিতে হয়। সেইসঙ্গে আমরা নিলাম কয়েক বোতল বিয়ার ও মঙ্গোলিয়ানদের প্রিয় ড্রিঙ্ক—আয়রাগ—ঘোড়ার দুধ গেঁজিয়ে তৈরি। খেতে মন্দ নয়, কোনো গন্ধ-টন্ধ নেই। স্বাদটা ঘোলের সঙ্গে অ্যালকোহল মেশালে যেমন হয় আর কি।

    এই প্রসঙ্গে মঙ্গোলিয়ার খাবার সম্বন্ধে কিছু বলি—আগেই বলেছি রাশিয়ার প্রভাব আমায় একটু হতাশ করেছিলো—আমি চীনা খাবারের ভীষণ ভক্ত।ক্যাম্পে অনেক রাশিয়ান টুরিস্টদের জন্য রোজ স্যুপ, স্যালাড, বিফ বা ভেড়ার মাংস বানাত। তবে একট মঙ্গোলীয় খাবার আমার খুব ভাল লেগেছিল। এটা মো-মো-র মতন, ভেতরে মশলাদার মাটনের পুর, এরা বলে বাজ (buuz), সাইজে কিন্তু মোমো-র তিনগুণ! দুটো খেলেই পেট ভরে যায়। আইরাগের সঙ্গে দারুণ জমে।

    গবি ভ্রমণ আমার মরুভূমি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছিল। সাধারণত মরুভূমি বলতে আমি সাহারার মতো প্রাণীহীন, শুকনো, বালির সমুদ্র কল্পনা করি। আর গবি তো সাহারার মতই সীমাহীন অজানা দুর্গম বিপজ্জনক জায়গা। আসলে কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়। হ্যাঁ, দুর্গম অজানা জায়গা অনেক আছে কিন্তু এখানে সেখানে মরুভূমি বেশ সুগম, সবুজ মরুদ্যান আর চারদিকে কত শত পাখির সমারোহ! এটাই আমায় সবথেকে বেশি অবাক করেছিলো—গবি এখানে লোকেদের প্রিয় জায়গা। ছুটিছাটা কাটাতে লোকেরা মরুভূমিতে আসে, ঘের খাটিয়ে আরাম করে, ঘোড়ায় চড়া, হাইকিং, বালিয়াড়িতে চড়া, রাত্রে তারা দেখা...আমোদের কত উপাদান মরুভূমিতে। আর এতো পশুপাখি মরুভূমিতে দেখা যায় কে জানতো? I LOVE GOBI এখানে পপুলার স্লোগান।


    স্টেপ ঈগল, মাটিতে বসে

    একটা বড় হাইওয়ে মরুভূমির মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত। খালি রাস্তা, কদাচিৎ দু’একটা চীনা ট্রাক। দুপাশে মরুভূমিতে ঝাঁকেঝাঁকে মেটে রঙের তিতির জাতীয় পাখি, খুব নজর না করলে দেখাই যায়না। তাদের শিকার করতে বিরাট বাজপাখি, স্টেপ ঈগল, গোল্ডেন ঈগল, উঁচু গাছের অভাবে মাটির ওপরেই বাসা বেঁধেছে। তাদের ফেলাছড়া খাবারের সৎকার করতে হাজির আরও বিরাট শকুনের দল। সব মিলিয়ে পাখির হাট। একজায়গায় দেখলাম এক ঝাঁক ড্যামসেল সারস। এরাই শীতকালে হিমালয় পেরিয়ে উত্তর ভারতের জলাজঙ্গলে কাটিয়ে আসে। এদের আমি করবেট থেকে কাজিরঙ্গা পর্যন্ত সব জায়গায় দেখেছি। প্রথম দিনেই নামি আর দাম্বাকেও পাখির নেশায় ধরল। আমার পাখির বই, দূরবীন, ক্যামেরা চটপট ওদের দখলে চলে গেল।

    মরুভূমিতে তিতিরের ঝাঁক

    আপাতদৃষ্টিতে সবুজের লেশও নেই কিন্তু একটু তাকালেই মাটিতে চাপচাপ পাটকিলে রঙের ঘাস দেখা যায়। এগুলি মঙ্গোলিয়ার জাতীয় পশু ব্যাকট্রিয়ান উটের প্রধান খাদ্য। এরা ঘন চকোলেট রঙের লোমশ পশু, পিঠে দুই কুঁজ। মাঝখানে দিব্যি আরাম করে বসা যায়। ভারতীয় এক কুঁজো উটের থেকে অনেক সহজ।

    মরুভূমির মধ্যেও কখনো সখনো যাযাবরদের সাদা ঘের দেখা যায়। সারা বছর এরা ভেড়া ছাগল চরিয়ে বেড়ায় আর উল, চামড়া, মাংস, দুধ বিক্রি করে বেশ উপার্জন করে। গ্রাম্য মঙ্গোলিয়ানদের এটাই প্রধান পেশা। অনেকেই উট, ইয়াক আর ঘোড়ার ব্যাবসাও করেন। শ’খানেক ভেড়ার দল যখন রাস্তা পার হয়, সব গাড়ি থামতে বাধ্য। রাস্তায় এদের পার হবার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। সেখানে কোন গাড়ি ধাক্কা মারলে চালকের কড়া জরিমানা। কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে গাড়ি-পশুর দুর্ঘটনায় পশুর মালিককেই খেসারত দিতে হয়।


    উট চলেছে মুখটি তুলে

    উট ছাড়াও মঙ্গোলিয়ানদের প্রিয় প্রাণী হল ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়া মঙ্গোলিয়ানদের কল্পনাই করা যায়না। শহরের বাইরে প্রত্যেকের বোধহয় নিজস্ব ঘোড়া আছে। ছোটরা হাঁটতে শেখার আগেই ঘোড়ায় চড়তে শেখে। মঙ্গোলিয়ার বিখ্যাত ঘোড়া Przelwalski’s horse. স্থানীয় নাম টাকি (Takhi). এটা এক আদিমতম ঘোড়া। পৃথিবীর আর সব ঘোড়া এদের থেকেই উদ্ভূত। এরা আজকাল খুব বিরল। শুধু একদল বুনো ঘোড়া হুস্তাই ন্যাশনাল পার্কে দেখা যায়। সুন্দর ধূসর-বাদামী রং। মরুভূমিতে আসার আগে একদিন ঐ পার্কে গেছিলাম। নামেই পার্ক, একটিও বড় গাছ নেই। শুধু মাইলের পর মাইল ঘাসঢাকা, ঢেউখেলানো steppe মালভূমি। টাকি ছাড়াও এখানে আছে বিরাট শিংওয়ালা হরিণ, নেকড়েবাঘ আর নানা জাতের পাখি। টাকি এদের ভীষণ প্রিয়। আমিও আমাদের গাড়িটার নাম দিয়েছিলাম ‘টাকি’।

    টাকি ঘোড়া ও হরিণ

    গবিতে আমরা চারদিন কাটিয়েছিলাম। রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিতাম। দুপুরে ক্যাম্পে পৌঁছতাম, তারপর লাঞ্চ সেরে চারদিকে বেড়ানো, দেখাটেখা সেরে সন্ধ্যায় ফিরে এসে ডিনার ও আইরাগ সহযোগে সূর্যাস্ত দর্শন এবং আড্ডা, তারপর যে যার ঘের-এ ঘুম। কয়েকটা উল্লেখযোগ্য জায়গার বিবরণ দিলাম। প্রথমদিন বায়ানযাগ (Bayanzag) গেলাম, যেখানে ১৯২২ সালে রয় চ্যাপম্যান অ্যান্ডারসন প্রথম ডাইনোসরের ডিম (ফসিল) আবিষ্কার করেন। সেই থেকে ডাইনোসর আর আধুনিক পাখির বিবর্তন সম্পর্কে ধারণার শুরু। এখানে এশিয়ার প্রথম ডাইনোসরের হাড়গোড়ও পাওয়া গেছে। এসবই অবশ্য এখন ইউবি-র মিউজিয়াম-এ সংরক্ষিত। জায়গাটা উঁচু, লাল টুকটুকে রঙের পাহাড়ে ভরতি। তাই নাম ফ্লেমিং ক্লিফ (Flaming Cliff)। সূর্যাস্তের সময় আরও সুন্দর রং ধরে।


    ফ্লেমিং ক্লিফ-- ডাইনোসরের রাজ্য

    মরুভূমি বলতেই অবশ্য সমতল জায়গা নয়। এখানে সেখানে বিরাট উঁচু পাহাড় ও গভীর খাদ। দক্ষিণ গবিতে আলতাই পর্বতমালার কিছু জায়গায় এইরকম গভীর গিরিবর্ত্ম (canyon) আছে । একটির নাম লামেরগয়ের ভ্যালি, যেখানে দিনের বেলাও সূর্যের আলো পৌঁছয়না। গত শীতের বরফ এখনো গলেনি। এখানে পাহাড়ের ওপর লামেরগয়ের নামক এক জাতির বিরাট শকুন দেখলাম, এরা খুব উঁচু থেকে পাথরের ওপর বড় বড় হাড়গোড় ফেলে ভাঙে আর তারপর ভেতরের মজ্জাটা খেয়ে নেয়। পাহাড়ের ভেতর যাবার সুবিধার জন্য ক্যানিয়নের মুখে স্থানীয় লোকেরা ঘোড়া বা গাধা ভাড়া দেয়।


    বুদ্ধ মন্দির

    তেরো শ’ শতাব্দী থেকে মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধধর্মের শুরু। মাঝখানে কম্যুনিজমের সময় ধর্মে ভাঁটা পড়েছিল, ইদানীং আবার উৎসাহ বেড়েছে। ইউবি থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরে Erden zog নামক একটি বুদ্ধ মন্দির দেখলাম। ১৫৮৬ সালে তৈরি। মন্দিরের চাতালে আছে ১০৮টি স্তূপ। পাশে Korkhorin গ্রামটা চেঙ্গিস খানের সময়কার। টুরিস্টদের জন্য একটা ক্যাম্পও আছে। মন্দিরে বেশ ভিড়, অনেক অল্পবয়সীও আছে। কিছু সদ্য বিবাহিতের দল দেখলাম আশীর্বাদ নিতে এসেছে। জাতীয় পোশাক পরিহিত লামা পুরোহিতও আছেন। ভেতরে দেখে মনে হল একেবারে তিব্বতীয় বৌদ্ধদের মত। ওম মণি পদ্মে হুম আঁকা। আশ্চর্যের কিছু নেই। চারপাশের বাতাবরণও ঠিক তিব্বতের মতই। অনেক ছোটোবড়ো মন্দির বা তাদের ভগ্নাংশ শহরে ও মরুভূমিতে ছড়ানো। গণতান্ত্রিক মঙ্গোলিয়ায় এগুলোর সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে, তারসঙ্গে ট্যুরিজমেরও উন্নতি চলছে।

    বৌদ্ধধর্মেরও আগে, চেঙ্গিস খানের সময় থেকে এক পুরনো শামান ধর্ম বা Tengerism চলে আসছে।এখনো অনেকে এই ধর্মে বিশ্বাসী। এঁরা মাথার ওপর খোলা আকাশকে প্রধান দেবতা মনে করেন এবং অন্য ধর্মের ওপর যথেষ্ট সহনশীল। মরুভূমিতে এবং খোলা steppe-এ একটা ছোট পাথরের ঢিপির ওপর রঙিন কাপড় জড়ানো একটা লাঠি পোঁতা। ব্যাস, এই হল এঁদের মন্দির। শুভ কাজের আগে এখানে এঁরা আকাশ-ভগবানের উদ্দেশে প্রার্থনা করেন।


    আকাশ দেবতার পূজার স্থান

    মরুভূমি হলে মরুদ্যান বা ওয়েসিস-ও থাকা চাই, তাই না? সাহারার পর গবিই পৃথিবীর সব থেকে বড়ো মরুভূমি। এখানেও ছোটোবড়ো মরুদ্যান। কোনো কোনোটার কাছে ছোটখাটো শহর বা গাঁও আছে। এরকমই একটা জায়গায় আমাদের ঘের ক্যাম্প। পাশে একটা ছোট্ট নামহীন ঝর্না, তার উৎপত্তি বা সমাপ্তি কোথায় কেউ জানেনা। কিন্তু তার দুপাশে সবুজের কি সমারোহ! শুধু একটু জলের ছোঁয়াতেই মরুভূমির রূপ একেবারে বদলে যায়। রুক্ষ, বালি কাঁকর আর কাঁটাঝোপের বদলে হাঁটু উঁচু লম্বা ঘাস, নানা রঙের জংলি ফুল, আর তার ওপর মৌমাছি, প্রজাপতি আর ফড়িঙের ঝাঁক। সবাই যেন শীতের আগে যত পারে চেটেপুটে নিচ্ছে। অবশ্যই আমার প্রিয় পাখিরাও মজুত। সুন্দর পায়ে চলা রাস্তা এঁকেবেঁকে ঝর্নার পাশ দিয়ে চলে গেছে। এখানে ওখানে ঘাসের ওপর পিকনিকের জায়গা, কোথাও বা ছাউনি দেওয়া টেবিল ও বেঞ্চ, সেখানে বসে আরামসে আইরাগের সদব্যাবহার করা যায়। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, মরুদ্যানের ঠিক গা ঘেঁষেই একটা বিরাট পর্বতসমান বালিয়াড়ি, বা dune—Khongorin Els. প্রায় ৬৫০ ফুট (২০০ মিটার)উঁচু আর দৈর্ঘ্যে শ’খানেক মাইল। বেঞ্চে বসে বালির ওপর উৎসাহী ছেলেমেয়েদের খেলা দেখা যায়। বালির ওপর চড়া বরফে চড়ার মতই শক্ত। তবে ঠাণ্ডা নয়। বালির ওপর গড়াগড়ি করে নেমে আসা যায়। গরমও নয়, বালিতে বসে পিকনিক করা যায়। বিপজ্জনক দুর্গম মরুভূমি হিসেবে গবির ধারণাটা একেবারেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল এখানে এসে।


    পাশাপাশি মরূদ্যান ও বালিয়াড়ি

    গত দুই শতকে, গণতান্ত্রিক রাজত্বে গবি মরুভূমি ক্রমেই জনপ্রিয় ও টুরিষ্টপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ক্যাম্প, ঘের ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা। তবে গাইড ছাড়া চলাফেরা মুশকিল। মঙ্গোলিয়ান আর রাশিয়ান ছাড়া কোনো ভাষা চলেনা, চাইনিজও নয়। দেশটি কিন্তু বেশ অতিথিবৎসল, আপাতত শান্ত, বেড়াবার—ও পাখি দেখার—পক্ষে ‘অতি উত্তম’। পায়ে জোর থাকলে মরুভূমিতে হাইকিং-এর প্রচুর সুযোগ পাবেন, তাছাড়া ঘোড়ায় চড়া, উটে চড়া ইত্যাদি তো আছেই। কেনাকাটার মধ্যে পশমিনা উল (এক বিশেষ ধরণের ছাগলের গলার নীচে নরম লোম চিরুনি আঁচড়িয়ে বের করে, কামানো বা কাটা কখনওই নয়) ও উটের উলের জামাকাপড় এখানে খুব ভালো কোয়ালিটি আর দামও কম। বেশির ভাগ টুরিস্ট জুন থেকে অগষ্টের মধ্যে যান। আবহাওয়া সুন্দর আর অনেক পালাপার্বণও থাকে ঐসময়। কিন্তু ভিড়ও হয় খুব, তাই আমি কোভিড এড়াতে ইচ্ছা করেই ঐ সময় যাইনি। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল মঙ্গোলিয়া দর্শনের। বুড়োবয়সে একটু কষ্টসাধ্য, কিন্তু দেখলাম ও শিখলাম কতকিছু। অনেক পুরনো ধারণা মুছে জমালাম নতুন অভিজ্ঞতা। ভ্রমণের এই-ই তো পাওনা।

    ভ্রমণকাল—সেপ্টেম্বর ২০২২



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)