— এই কথাগুলো দিয়েই শুরু হয়েছিলো আমাদের সম্পর্ক। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। আর সেই সম্পর্ক যে কতটা গভীর হয়ে গিয়েছিলো তা শুধু আমি আর সুবর্ণই জানতাম।
সুবর্ণ মানে সুবর্ণ মুখোপাধ্যায়। এখনকার বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। যে নামটা সত্যিই আজ সার্থক। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রম্যরচনা যাই লিখেছেন তাই সোনা হয়ে গেছে। অন্তত প্রকাশকের ঘরে। অজস্র পুরস্কার আর মানপত্র ঠাসা হয়ে আছে তার পড়ার ঘরে। খ্যাতির এমন শীর্ষে উঠে গেছেন তিনি যে কেউ তাঁর সামান্য সংস্পর্শ পেলে ধন্য হয়। আর এই মানুষটাই আমার সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচটা বছর ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। সেই সময় একটা দিনও যায় নি যে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটেনি। কিন্তু হঠাৎই একদিন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল।
সেটা ছিল এক সরস্বতী পুজোর দিন। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধের দিকে আরো বাড়ল। বেশ রাতের দিকে সুবর্ণ এসেছিল। সম্পূর্ণ মদ্যপ অবস্থায়। সুবর্ণের এই পানের অভ্যাস বহুকালের। আর সেটা আমি জেনেছিলাম আমাদের সম্পর্কের গোড়া থেকেই। তাই ওর মাতাল হয়ে রাতে ফেরাটা আমার কাছে কোনো নতুন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু যে ব্যবহারটা ও করেছিল ওই রাতে সেই অপমান আর কষ্টটা আমি কখনো ভুলতে পারিনি। আর তার জন্য ওকে কোনোদিন ক্ষমাও করতে পারিনি।
সুবর্ণ তার দুহাতে আমায় আছড়ে ফেলে বলেছিল — ‘কি দিয়েছ তুমি আমায়? কি দিয়েছ এতকাল ধরে?’ আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেছিলাম। সুবর্ণ বলে যেতে লাগল — ‘পাঁচ পাঁচটা বছর আমি আমার জীবনের সমস্তটা দিয়েছিলাম তোমায় — আমার জীবনের সবচেয়ে দামি সময়টা। কোনোদিকে তাকাইনি — দিনরাত এক করে তোমাকে নিয়েই থেকেছি। বুঝিনি কিভাবে কতো কিছু আমার অজান্তেই ভেসে চলে গেছে আমার জীবন থেকে বরাবরের মতো। মা চলে গেল — ভাইটা নিখোঁজ হয়ে গেল — একের পর এক চাকরির সুযোগ চলে গেল — চরম অভাবে রাতের পর রাত কিছু পেটে পড়তো না — তাও আমি তোমাকে নিয়েই কাটিয়েছি সেইসব রাতগুলো। নিঃশব্দে আমার সব কিছু শুষে নিচ্ছিলে তুমি ডাইনির মতো — নিঃস্ব করে দিচ্ছিলে তুমি আমায় আমার অজ্ঞাতসারে। আর পাওনা বলতে কিছু লোকের হেনস্থা আর উপহাস। কিন্তু এমনকি হওয়ার ছিল আমার জীবনে?
'আমি তো রীতিমতো ভালো ছাত্র ছিলাম। সবাই জানতো আমার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। আমার নিজেরও আত্মবিশ্বাস ছিল — নিষ্ঠার কোনো অভাব ছিল না — অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতাম — কিন্তু কি হলো? কি হলো আমার? কারণ তুমি। তুমিই ছারখার করে দিলে আমার জীবনটা। এইবার দয়া করে মুক্তি দাও আমায় — দূর হও আমার জীবন থেকে’ — একটানা কথাগুলো বলে ভীষণ ভাবে হাঁফাতে লাগল সুবর্ণ।
আমি উপুড় হয়ে পড়েছিলাম ওর খাটের কোণায়। ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে ও চলে গিয়েছিল বারান্দায়। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
তারপর হঠাৎ ও ঘরে ফিরে এল। আমার দিকে এগিয়ে এল হাতের লাইটারটা জ্বালিয়ে। একটা অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো — ‘আজই তোকে শেষ করে দেব — তুই ছাই হয়ে গেলে আমার শান্তি হবে। আমি নতুন করে বাঁচতে পারবো।’
আমি ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলাম। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়ের ঝাপটা দিলো। ঘরের দরজার পাল্লাটা বিকট আওয়াজ করে আছড়ে পড়লো। জানলার কাঁচগুলো ভেঙে পড়লো ঝনঝন করে। লাইটারের শিখাটা নিভে গেলো ওই ভয়ংকর ঝড় আর বৃষ্টির ঝাপটায়। সুবর্ণ টাল খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। অন্ধকার — একটা নিরেট অন্ধকার ঘিরে ধরলো আমায়।
ওই অন্ধকারেই ভাবছিলাম — যে কথাগুলো বললো সুবর্ণ — তা কিন্তু খুব মিথ্যে নয়। ওর যুবক বয়সের মাঝপথেই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুরু হলো। হঠাৎই। শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে। এরপর থেকে যত দিন যাচ্ছিল তত ও যেন আমায় পাগলের মতো আঁকড়ে ধরছিলো। আর আমিও ক্রমশ উন্মাদের মতো চেপে বসছিলাম ওর ঘাড়ের উপর। এইভাবে আমার পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছিলাম অনেকদিন ধরে। আমি সারাক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতাম সুবর্ণের জন্য। জানতাম দিনের কিংবা রাতের কোনো একটা সময়ে সে আসবেই আমার কাছে। আর ও সত্যিই আসতো। আমাকে ওর নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়ার জন্য। ওর সেই অসামান্য নিষ্ঠায়। আমিও নিতান্তই স্বার্থপরের মতো পুরোপুরিভাবেই চাইতাম ওকে। কোনোদিনও ভাবিনি সেই মানুষটার নিজস্ব সুখদুঃখের কথা। আমার বাইরে যে তার একটা জীবন থাকতে পারে তার কথা। আমি যেন নিজের অজান্তেই শুষে নিচ্ছিলাম ওর সমস্ত জীবনীশক্তি। এইসময়টায় যেন ভূতে পাওয়া মানুষের মতো আমায় নিয়ে থাকতো সুবর্ণ। সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে — যত্ন দিয়ে — আর ওর যথাসাধ্য সামর্থ্য দিয়ে আমায় নিয়ে পড়ে থাকতো ও। আর আমি ভাবতাম ওর এই এত যত্ন এত নিষ্ঠা আর ভালোবাসা আমায় কোনোদিনও ছেড়ে যাবে না।
তারপর এলো সেই রাত। সেই জ্যোৎস্নারাত। দোলপূর্ণিমা। বাইরে আকাশে বিরাট চাঁদের আলোর বন্যা। আর সেই আলোতেই এলো আমার অন্তিমপর্ব। এইসময় টপটপ করে সুবর্ণর চোখের জল পড়ছিল আমার শরীরে। আমি চমকে উঠেছিলাম সেই উত্তপ্ত জলের স্পর্শে। আমাকে হতবাক করে দিয়ে সুবর্ণ বলেছিল — ‘শেষ হয়ে গেলো। এইখানেই শেষ হয়ে গেলো।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম — ‘কি শেষ হয়ে গেল?’ ও কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলেছিল — ‘এইসব এত কথা — এত দিনের সম্পর্ক।’ আমি কোনোক্রমে বলতে পেরেছিলাম — ‘কেন? সব কিছু একেবারে শেষ হয়ে যাবে কেন? কিছুই কি আর থাকবে আমাদের?’ ও একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল — ‘সেটা সময় বলে দেবে।’ এরপর একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছিল ও নিঃশব্দে। শেষ সিগারেটের আগুনটা নিভে যাওয়ার পর যে অন্ধকার এলো সেটাই হয়তো প্রাপ্য ছিলো আমার।
আমাকে নিয়ে ওর প্রত্যাশা ছিলো আকাশছোঁয়া। অথচ বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও আসে নি। আর এটা ছিলো ওর কাছে একটা বিরাট আঘাত। সেইসময় সুবর্ণ আমার সামনে এসে চুপটি করে বসে থাকতো। কিন্তু আমাকে ছুঁতোও না কখনো। মাঝরাতে ঘরের আলো নিভে গেলে ভাবতাম আর কি কখনো ওর স্পর্শ পাবো না আমি?
এরপর থেকেই সবকিছু যেন যেন খুব দ্রুত বদলাতে থাকলো। দেখতাম সুবর্ণ ওর লেখার টেবিলে রাতের পর রাত ধরে লিখে যাচ্ছে একমনে। দেখতে পেলাম ওর ক্রমশ নামডাক হচ্ছে। উপার্জনও হচ্ছে। ওর জনপ্রিয়তা যেন হু-হু করে বাড়তে থাকলো। লোকে বলতে লাগলো ওর নাকি সোনার কলম। গল্প উপন্যাস কবিতা যাই লেখে তাই যেন সোনার মতোই ঝলমল করে। তখন ওর চারিপাশে নিত্যনতুন মানুষের ভিড়। সব ভক্ত আর গুণগ্রাহীর দল। এবং মাঝে মাঝেই নতুন নতুন নারীসঙ্গ। সবকিছুই দূর থেকে দেখতাম আমি। আর অনেক উঁচুতে উঠে গেছে বলে আমাকে ওর আর চোখেই পড়তো না।
তখন আমি প্রতিমুহূর্তে চোখের জল ফেলতে ফেলতে অভিসম্পাত দিতাম সুবর্ণকে। মনে মনে বলতাম চুরমার হয়ে যাক ওর সব কিছু। জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাক ওর সব সুনাম। মুখ থুবড়ে পড়ুক ওই উঁচু জায়গাটা থেকে। কিন্তু আমার ওই চোখের জলে আর অভিশাপে কিচ্ছু হয়নি ওর। সাফল্যের এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় ও উঠে গেছে অনায়াসে। এইভাবেই ও হয়ে গেল এখনকার বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে সফল সাহিত্যিক।
কিন্তু এরপরেই এলো সেইদিনটা। যেদিন ওকে এই ঘরে ঢুকতে হলো মাথা নীচু করে। চরম অপমানের বোঝা নিয়ে। আর সেই অপমান একটা নয়। বেশ কয়েকটা। এবং মারাত্মক ধরনের।
সুবর্ণ নাকি কোনো বিদেশি লেখকের লেখা থেকে একটি লেখা হুবহু নকল করে ছেপেছে কোনো পত্রিকায়। সে নাকি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন লেখককে অন্যায্যভাবে বিশেষ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। এমনকি একজন তরুণী লেখিকাকে জোর করে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করেছে। কথাগুলো নিজেই বলেছিল সুবর্ণ। নিজের মনেই। উন্মাদের মতো। একা ঘরে। মাঝরাতে। আকন্ঠ মদ খেতে খেতে। তারপর হঠাৎই লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
আমি ঘরের কোণে থেকে দেখলাম সবটাই। মনে হলো এইবার সত্যিই পড়ে গেছে সুবর্ণ। অনেক উঁচু থেকে। মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে নীচে। আমার কি তৃপ্তি হচ্ছিলো ওকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখে? আমি কি শান্তি পেয়েছিলাম তখন? জানি না। আমার দুচোখ বেয়ে কি অজান্তেই জল নেমে এসেছিল তখন? কে জানে। কিন্তু একটা জিনিস জানতে পারলাম কয়েকদিনের মধ্যেই। জানলাম পরিস্থিতিতে মানুষ কেমন বদলে যায়।
পরের দিনটাও সুবর্ণ পড়ে রইলো ওই হতচৈতন্যের মতো। তারপর মাঝরাতে আমার কাছে এলো। আমায় স্পর্শ করলো ওর হাতের কাঁপাকাঁপা আঙুলগুলো দিয়ে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম এও কি সম্ভব? ও আবার আমায় দেখতে থাকলো আগের মতো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমি খালি ভাবছিলাম — একি সত্যি? আমি অতীত হয়ে গেছিলাম ওর জীবনে। আবার ওর দুহাতের মধ্যে এলাম আমি। ওর বিছানায়। সেই মাঝরাতে। এত বছর বাদে।
‘আমি নাকি শঠ — আমি নাকি ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বজনপোষণ করি — আমার স্তাবকদের পুরস্কার পাইয়ে দি — অল্পবয়সী মেয়েদের সুযোগ দিয়ে তাদের শ্লীলতাহানি করি।’
‘আমি নাকি শেষ হয়ে গেছি? আমি নাকি এক লেখা লিখে চলেছি গত দশ বছর ধরে? আমি নাকি অন্যের লেখা টুকে ছেপে দিচ্ছি? কাগজের বাজারী লেখা লিখে নাম কিনেছি? আমার লেখায় কোনো চিন্তাভাবনার লেশমাত্র নেই — পড়াশোনা নেই — গবেষণা নেই — একটা লেখাতেও — আমি মরলে পরে আমার সব লেখা নাকি নর্দমার জলে ভেসে যাবে —’
‘এর সব উত্তর ছুঁড়ে দেবো তোদের মুখে — এইবার — এইবার—’
— বলতে বলতে থরথর করে কাঁপছিল আর ভীষণভাবে হাঁফাচ্ছিল সুবর্ণ। তারপর সেই কাঁপা কাঁপা হাতে আমায় ধরে বললো — ‘তুমি — হ্যাঁ তুমিই দেবে এই সবকিছুর উত্তর — একদিন যখন সুবর্ণ মূখোপাধ্যায়কে কেউ চিনতো না জানতো না সেদিন অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে হয়েছিল তোমায় নিয়ে — আজ কিন্তু দিন বদলে গেছে — আজ কিন্তু আমি বাংলাসাহিত্যের সবার উপরে — তাই যারা সেখানে পৌঁছোতে পারবে না জেনে হিংসে করে নখদাঁত বের করে আমার দিকে তেড়ে আসছে — তাদের উত্তর দেবে তুমিই — কারণ তুমিই আমার সমস্ত।’ — কথাটা শেষ না করেই সুবর্ণ পড়ে গেলো আমার সামনে। তারপর স্থির হয়ে গেল একেবারে।
সুবর্ণ তুমি এখন একেবারে স্থির হয়ে গেছো — আর কি ঠাণ্ডা — তোমায় বরাবর অস্থির দেখেছি — বরাবর তোমার উত্তাপ পেয়েছি — আর এখন তুমি আমায় দেখাচ্ছো কত স্থির হয়ে যেতে পারো, তাই না? কতোটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারো, তাই তো?
কিন্তু কেন এমনটা হলো? কেউ জানবে না আসল কথাটা। শুধু আমি ছাড়া। কারণ আমিই তোমায় খুন করেছি। না না কোনো বিষ মেশানো খাবার দিয়ে নয়। হঠাৎ পিছন থেকে ফাঁস লাগিয়ে নয়। ইচ্ছে। ইচ্ছে। শুধু তীরের ফলার মতো একটা মারাত্মক ধারালো ইচ্ছে দিয়ে আমি তোমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি তোমাকে সবচেয়ে কাছের করে পেয়েছিলাম। তাই সহ্য করতে পারতাম না তোমার আমার থেকে এইভাবে দূরে সরিয়ে রেখে ক্রমশ এত খ্যাতি এত প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা। আমি প্রতি মুহূর্তে চাইতাম তোমার পতন হোক। যাতে তুমি আবার ফিরে আসো আমার কাছে। আগের মতো। আসলে আমার তো তোমাকে ছাড়া কেউ নেই। অবাক হয়ে দেখতাম তোমাকে ঘিরে কতো মানুষজন। তাই প্রতিমুহূর্তে চাইতাম দূর হোক ওরা সবাই — তুমি আবার আমার কাছে এসো - আমায় ধরো তোমার দুহাতে — আগের মতো। না হলে তুমি শেষ হয়ে যাও আমার সামনেই।
আমার ইচ্ছাশক্তির জোরটা দেখো। কিভাবে যা চেয়েছিলাম তার প্রতিটিই হুবহু ঘটলো। তুমি এলে আমার সামনে। চুরমার হয়ে। আমাকে আবার আগের মতো দুহাতে ধরলে। তারপর পড়ে গেলে আমার সামনেই। এমনভাবে যে আর কখনো কোত্থাও যেতে পারবে না — কিন্তু — কিন্তু তাতো নয় — খানিকবাদেই তো সকাল হবে — একেএকে সবাই আসবে এইঘরে — এইঘর ভরে যাবে লোকে লোকে — তোমার অসংখ্য ভক্তরা — কাগজপত্রিকার লোকেরা — আরো কত বিখ্যাতজন আসবে — আর ওরা তোমাকে নিয়ে চলে যাবে বরাবরের মতো — আমার কাছ থেকে —
তাহলে আমাকেও নিয়ে যাক ওরা তোমার সঙ্গে — ছাই হয়ে মিশে যাই তোমার সঙ্গে — এটাই আমার শেষ চাওয়া —
কিন্তু আমি জানি — তা হবে না কখনো — আর তার কারণটা আমিই — আমার সেই সর্বনাশা ইচ্ছে — আমার খুব গোপন মারাত্মক ইচ্ছে ছিলো যে তোমার সঙ্গে আমার নামটাও থাকুক চিরকাল — তোমার সঙ্গে জুড়ে — সেই ইচ্ছের কি ভয়ানক জোর দ্যাখো —
ওরা আমায় দেখতে পাবে তোমার পাশেই — এইভাবে তোমার জীবনের সবচেয়ে নিভৃত বিষয়টি চলে আসবে সবার সামনে — তুমি ছাই হয়ে যাবে — কিন্তু আমায় তুমি ছাই হতে দিলে না কিছুতেই — তোমার শেষ ইচ্ছেটা আমার গোপন ইচ্ছের সঙ্গে কি ভয়ংকরভাবে এক হয়ে গেলো —
তোমার কথাটা ফলবে — তাই আমি ছাই হবো না গো — বরং সবার চোখের সামনে আসবো —
প্রকাশিত হবো –
--আমি - সুবর্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাসের অন্ধকারে পড়ে থাকা পান্ডুলিপি- ' হে মাধবী'
কথাগুলি লেখা ছিলো এই উপন্যাসটির ভূমিকায়। উপন্যাসটি প্রকাশের পরেই সেটি সুবর্ণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ লেখা বলে স্বীকৃত হয়েছিল।