• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • প্রযুক্তির বিশ্বকাপ : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়



    প্রায় এক মাসের ফুটবল মহাযজ্ঞের পরে ২০২২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর যবনিকা পতন হল কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার। ফলাফল আমাদের কারও অজানা নয়।

    অনেক মহাতারকার ছিল এটাই শেষ বিশ্বকাপ, তাঁদের ক্রীড়াশৈলী বহু বছর ধরে আমাদের মুগ্ধ করে এসেছে, কালের নিয়মে এই খেলোয়াড়দের আর বিশ্বকাপের আঙিনায় দেখা যাবে না। সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য উঠে এসেছেন এক ঝাঁক নতুন তারকা। বিদায়ী নক্ষত্রদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে, ফুটবল গ্যালাক্সির নতুন তারকাদের আমরা জানিয়েছি সাদর আহ্বান। কিন্তু বিশ্বকাপের ফলাফল বিশ্লেষণ, ধুরন্ধর ফুটবল ম্যানেজারদের মগজাস্ত্র অথবা ফুটবলারদের ব্যক্তিগত ও দলগত ক্রীড়ানৈপুণ্যর চু্লচেরা ময়নাতদন্ত এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। মরুভূমির বুকে অনুষ্ঠিত এই রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজনে প্রযুক্তির অভিনব প্রয়োগকে তুলে ধরাই এই নিবন্ধের লক্ষ্য।


    উদ্বোধনী ম্যাচের কথা দিয়েই শুরু করা যাক।

    নভেম্বরের ২০ তারিখ, শুরু হয়েছিল বহু প্রতীক্ষিত কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল, আর বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষে সারা বিশ্বের ফুটবল অনুরাগীরা তখন সবে মাত্র চোখ রেখেছেন সংগঠক দেশ কাতার এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের মধ্যে প্রতিযোগিতার প্রারম্ভিক ম্যাচে। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে ইকুয়েডরের অধিনায়ক ভ্যালেন্সিয়ার হেড করা বল জড়িয়ে গেল কাতারের জালে, অনেকের টিভি তখনও গরম হয়নি। কিন্তু, এ কী!

    ভিডিয়ো অ্যাসিসট্যান্ট রেফারি বলছেন অফসাইডের জন্য গোল বাতিল, তখনও ইকুয়েডর ফুটবলারদের গোল সেলিব্রেশন শেষ হয়নি। সারা বিশ্বের দর্শকদের তো চক্ষু চড়কগাছ, নিশ্চিত গোলকে কী করে অফসাইডের জন্য বাতিল করা হল! দর্শকাসনে এক ইকুয়েডর সমর্থক তো পুরোটাই টাকার খেলা ইঙ্গিত করে এক কাতারী সমর্থকের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু, আমরা রিপ্লেতে

    কী দেখলাম? অফসাইডের সিদ্ধান্ত একশো শতাংশ ঠিক।

    অফসাইড রুলের কচকচিতে না ঢুকে দেখা যাক, কোন প্রযুক্তির দৌলতে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এ কাজ, সম্ভব হল।


    সংবেদনশীল ম্যাচ বল :

    বিশ্বকাপের অফিসিয়াল ম্যাচ বল প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাডিডাস, এই বিশ্বকাপের জন্য এক অভিনব সেন্সর সকার বল প্রস্তুত করেছিল। তারা ফুটবলের অভ্যন্তরে একটি মোশন সেন্সর ডিভাইস যুক্ত করেছে। এই অতি সংবেদনশীল প্রযুক্তি, কোনও খেলোয়াড় বল স্পর্শ করলেই, প্রতি সেকেন্ডে তার ৫০০টি ফ্রেম সংরক্ষণ করেছে এবং VAR (Video assistant referee) কন্ট্রোল রুমে তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করে গেছে। আমরা প্রায়শই দেখতে পাই, মাঠের বাইরে বল দূরে চলে গেলে, বিশেষ করে লক্ষ্যভ্রষ্ট শট গ্যালারিতে চলে গেলে দ্রুত অন্য একটি বল টাচলাইন থেকে মাঠে পাঠিয়ে খেলা পুনরায় শুরু করা হয়; এই প্রযুক্তির মাহাত্ম্যে, খেলার মাঝে বল পরিবর্তন হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগের বলের তথ্য নূতন বলে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। বিশ্বকাপে ব্যবহৃত এই বিশেষ ফুটবলকে মোবাইল ফোনের মতনই চার্জ করার ব্যবস্থা ছিল।

    বিশ্বকাপে ব্যবহৃত আটটি স্টেডিয়ামের প্রতিটির ছাদের ভিতর দিকে বসানো হয়েছিল ১০০ ভাগ সিঙ্ক্রোনাইজড ১২টি মাল্টিট্র্যাকিং ক্যামেরা। বলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে এই এক ডজন ক্যামেরা, ২৯টি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার তথ্য পাঠিয়ে মাঠে খেলোয়াড়দের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছে। ফলে, কোনও ফুটবলার সামান্যতম অফসাইড হলে, সেই তথ্য তৎক্ষণাৎ একটি সংকেতের মাধ্যমে ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির গোচরে চলে এসেছে এবং তার মাধ্যমে চলে গেছে খেলা পরিচালনা করার দায়িত্বে মাঠে থাকা রেফারির কাছে। প্রযুক্তি এবং ম্যাচ অফিসিয়ালদের মেলবন্ধনে এই প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম, ‘সেমি অটোমেটেড টেকনোলজি’।

    গত বছরের আরব কাপ ফুটবল এবং বিশ্ব ক্লাব কাপ ফুটবলে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করার পরেই, ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে অনুরূপ প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

    অনেকে অভিযোগ করেছিলেন যে অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা রেফারির স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেবে। ২০০২-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের দায়িত্বে থাকা কিংবদন্তি ইটালিয়ান রেফারি কলিনা’কে নিশ্চয়ই পাঠক ভোলেননি, তিনিই এখন ফিফার চিফ অফ রেফারিজ। কলিনা কিন্তু এই ধারণাকে নস্যাৎ করে বলেছেন, প্রযুক্তির সাহায্যর পরেও রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকবে। ফাউল বা হ্যান্ডবলের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ রেফারির এক্তিয়ারভুক্ত। প্রযুক্তির কাজ হচ্ছে, যদি খেলায় কোনও সন্দেহজনক পরিস্থিতি খালি চোখে ঠিকভাবে বোঝা সম্ভব না হয়, তবে রেফারিকে তুলনামূলক নিখুঁত ভিডিয়ো প্রদর্শন করে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা। শেষ সিদ্ধান্ত কিন্তু রেফারির হাতে।

    প্রযুক্তির সমালোচকরা ইংলিশ প্রিমিয়র লিগের একটি ম্যাচের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছেন, সেই ম্যাচে অ্যাস্টন ভিলা ক্লাবের গোলরক্ষক, Orjan Nyland, নিজের গোলে বল ঢুকিয়ে দিলেও হক-আই টেকনোলজি সেটা ধরতে পারেনি।

    এই সমালোচকদের জবাব দিতে গিয়ে কলিনা বলেছেন, একটা ভুলের জন্য প্রযুক্তিকে বর্জন করা যায় না। আমি প্রযুক্তির সাহায্যে নেওয়া অসংখ্য ঠিক সিদ্ধান্তের উল্লেখ করতে পারি। সেমি-অটোমেটেড টেকনোলজির সাহায্যে নির্ভুল ভাবে অফসাইডের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে।

    তেমনই, গোল লাইন প্রযুক্তির সাহায্যে বল, কয়েক মিলিমিটার গোল লাইন পেরিয়ে গেলেও সেটা বুঝতে অসুবিধা হবে না।

    পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ২০১০-এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মিডফিল্ডার ফ্র্যাঙ্ক ল্যামপার্ডের জার্মানির বিরুদ্ধে করা অবধারিত গোলটি কী ভাবে বাতিল হয়ে গেছিল! ওই গোল বাতিল না হলে হয়তো খেলার ফলাফল অন্যরকম হত এবং ইংল্যান্ডকে সেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হত না। ২০১৪-এর ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ফিফা যে গোল লাইন প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তার পিছনে অন্যতম কারণ ল্যাম্পার্ডের করা তার পূর্ববর্তী বিশ্বকাপের বাতিল হয়ে যাওয়া সেই গোল।



    কলিনা আরও বলেন, কেউ যদি ভাবেন এই প্রযুক্তির সাহায্যে রেফারি ৪-৫ সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন তবে ভুল হবে, তবে ৭০ সেকেন্ডের বদলে ২০-২৫ সেকেন্ডে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে।

    আমরা কিন্তু বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে কলিনা’র বক্তব্যের যথার্থ প্রতিফলন দেখেছি, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি টানা ছ’বছর ফিফার বর্ষসেরা রেফারি কলিনা’র থেকে এ বিষয়ে কথা বলবার উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ পাওয়াও সম্ভব নয়।

    গ্রুপ লিগের দু’টি খেলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

    সি গ্রুপে অনুষ্ঠিত আর্জেন্টিনা বনাম সৌদি আরব ম্যাচে, প্রথমার্ধের ২২, ২৮ ও ৩৫ মিনিটে, আর্জেন্টিনার করা তিন তিনটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে গেছে। তিনটির মধ্যে দু’টি গোল লাইন্সম্যানের পতাকা উত্তোলনে এবং একটি ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সিদ্ধান্তে নাকচ হয়ে যায় এবং তা নিয়ে বিতর্কের কোনও কারণ ঘটেনি। অর্থাৎ প্রযুক্তি এবং মাঠে উপস্থিত ম্যাচ অফিসিয়ালদের সিদ্ধান্তের মেলবন্ধন ঘটেছে।



    আবার এইচ গ্রপের পর্তুগাল বনাম উরুগুয়ে ম্যাচে, পর্তুগিজ মিডফিল্ডার ব্রুনো ফার্নান্ডেজ তার দলের অধিনায়ক ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর উদ্দেশে উঁচু করে বল বাড়ালে, সেটি সরাসরি উরুগুয়ের জালে জড়িয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল বল রোনাল্ডোর মাথা স্পর্শ করে গোলে ঢুকেছে, রোনাল্ডো নিজেও সেরকম ভেবেছিলেন এবং গোলটি তার করা বলে দাবি করেছিলেন, আমরা কিন্তু দেখলাম গোলটি প্রথমে রোনাল্ডোর নামে দেখানো হলেও, অল্প সময়ের ব্যবধানে তা সংশোধন করে ব্রুনো ফার্নান্ডেজের নাম গোলদাতা হিসেবে নথিভুক্ত করা হল। ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি জানিয়ে দেন, বল রোনাল্ডোর মাথায় লাগেনি। বল প্রস্তুতকারক সংস্থাও জানিয়েছে, বলের অভ্যন্তরীণ সেন্সরের দেওয়া তথ্য অনুসারে বল রোনাল্ডোর মাথা ছুঁয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ম্যাচের ফলাফলে এর কোনও প্রভাব না পড়লেও, সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে গোল্ডেন বুট জেতার দৌড়ে নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ছিল।

    কাতার বিশ্বকাপে প্রায় প্রত্যেক খেলায় ৮-১০ মিনিটের দীর্ঘ অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ হওয়া দর্শকদের ভ্রুকুঞ্চনের কারণ ঘটেছে, কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ফিফা রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যান, পিয়ার্লিগি কলিনা একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক এবং অবহিত করে বলেছিলেন, খেলায় একটি গোল হলে, তার সেলিব্রেশনে সাধারণত এক থেকে দেড় মিনিট সময় নষ্ট হয়ে যায়। একটি ম্যাচে তিনটি গোল হলে, মোটামুটি পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট হতে পারে। ফিফা এই সময় নষ্ট বরদাস্ত করবে না। তা ছাড়া VAR-এর প্রয়োগ, খেলোয়াড় পরিবর্তন এবং মাঠে আহত খেলোয়াড়ের শুশ্রূষায় নষ্ট সময়ও হিসেবে ধরতে হবে। ফিফা একটি ম্যাচের নির্ধারিত সক্রিয় নব্বই মিনিট পুরো খেলাতে বদ্ধপরিকর এবং সেই কারণে দীর্ঘ ইনজ্যুরি টাইম খেলানো দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

    ২০১৮-এর রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু হয়েছিল, সেটাই কাতার বিশ্বকাপে এসে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল।


    দর্শক সুরক্ষায় প্রযুক্তি :

    কাতারে, শুধু খেলার মাঠেই প্রযুক্তির ব্যবহার তাক লাগিয়ে দেয়নি, দর্শক নিরাপত্তায় এবং যেকোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে আটটি স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে থাকা ১৫,০০০ ক্যামেরার সাহায্যে দর্শক-সমর্থকদের উপর মাঠে এবং মাঠের বাইরে নজর রাখা হয়েছিল। ৮০,০০০-এর বেশি আসন বিশিষ্ট লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বকাপ ফাইনাল। এই স্টেডিয়ামে সমর্থকদের চিহ্নিত করতে মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।



    সর্বোপরি অ্যালগরিদম বা সুনির্দিষ্ট তথ্যসমূহের সমন্বয়ে স্টেডিয়ামে কোনওরকম পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বা দাঙ্গাহাঙ্গামা প্রতিরোধে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার একটি ফুটবল ম্যাচে দর্শক-পুলিশ সংঘর্ষে ১৩০ জনের মৃত্যুর হৃদয়বিদারক ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি একেবারেই কাম্য নয়, তাই এই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে।


    তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি :

    কাতারের তাপমাত্রা ছিল ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের পথে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা।

    তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আয়োজকরা, ড. কুল নামে খ্যাত কাতারী অধ্যাপক, সাউদ আব্দুলআজিজ আব্দুল ঘানির উদ্ভাবিত অ্যাডভান্সড কুলিং সিস্টেমের সাহায্য নিয়েছিলেন। এই প্রযুক্তিতে ৫০০টি নলের মাধ্যমে স্টেডিয়ামে ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি অংশে সম পরিমাণে ছড়িয়ে দেওয়া এবং রিসাইকেল পদ্ধতিতে সেই হাওয়া বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই পদ্ধতিতে স্টেডিয়ামের তাপমাত্রা শুধু ২৩-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে তাই নয়, এই প্রযুক্তি স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে বাতাসের গুণগত মান বৃদ্ধিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। ডাস্ট ফিল্টার, odour filter-এর মাধ্যমে পরিশ্রুত এই বাতাসের মান দর্শকদের স্বস্তি দিয়েছে এবং ফুটবলারদের শারীরিক সক্ষমতার শীর্ষে উঠে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে খেলতে সাহায্য করেছে।

    প্রযুক্তি হয়তো সব সমস্যার পূর্ণ সমাধান করতে সক্ষম হয়নি, কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

    তা সত্ত্বেও অধিকাংশ সমস্যার সমাধানকে প্রযুক্তি সংশয়াতীতভাবে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু আমরা যেন প্রযুক্তি ও বৈভবের বর্ণোজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় কাতার বিশ্বকাপ যজ্ঞের আয়োজনে ৬৭৫১ জন অভিবাসী শ্রমিকের বলিদানের কথা ভুলে না যাই।

    ২০১১-২০২০ সালের মধ্যে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নতুন সাতটি স্টেডিয়াম, রাস্তাঘাট, হোটেল, এয়ারপোর্ট, নতুন শহর তৈরির বিপুল কর্মযজ্ঞে প্রতি সপ্তাহে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এই পাঁচটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একাধিক অভিবাসী শ্রমিক মারা পড়েছেন। বস্তুত ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন কাতারের জনগণ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব লাভের আনন্দে উৎসবে মেতে উঠেছিল, ঠিক তার অব্যবহিত পর থেকেই সূচনা হয়েছিল প্রত্যেক সপ্তাহে অভিবাসী শ্রমিকদের এই অমানবিক মৃত্যু মিছিল। ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার অভিবাসী মৃত শ্রমিকদের সংখ্যা যথাক্রমে ২৭১১, ১৬৪১, ১০১৮, ৮২৪, ৫৫৭ জন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অভিবাসী শ্রমিকেরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। প্রিয়জন হারানোর মানসিক যন্ত্রণার কথা ছেড়েই দিলাম। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা চতুর্গুণ তো বটেই, আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।

    মনে রাখতে হবে এই পরিসংখ্যান কিন্তু অসম্পূর্ণ। ফিলিপাইন্স, কেনিয়া এবং অন্যান্য কিছু দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর হিসেব পাওয়া যায়নি। ২০২০-এর শেষের কয়েক মাসের হিসেবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কাতারের প্রচণ্ড গরম বহু শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। শ্রমিক সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল অপর্যাপ্ত।

    বহু মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ৮০% ভারতীয় এবং ৪৮% নেপালী শ্রমিকের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালানো হয়েছে।

    THE GUARDIAN-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘Most deaths of Indian and Nepali migrant workers in Qatar were reported as ‘natural deaths’, often attributed to sudden and unexplained heart or respiratory failure.’



    দা গার্ডিয়ানের রিসার্চ টিমের বক্তব্য অনুসারে, কাতারী কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট অসংলগ্ন এবং অস্বচ্ছ।


    ভবিষ্যতে এমন প্রযুক্তি আসুক, যাতে করে প্রতিটি শ্রমিকের জীবন সুরক্ষিত থাকবে। বিজ্ঞানের সেই অগ্রগতির প্রতি আমাদের নজর থাকবে। আর শুধু প্রযুক্তি বোধহয় সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য যথেষ্ট নয়, এক্ষেত্রেও প্রযুক্তি এবং কল্যাণকামী মানুষকে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। চার বছর বাদে পরবর্তী বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসতে চলেছে যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মেক্সিকোয়। আবার দুরন্ত ফুটবলে শিহরিত হবেন সারা বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ, কিন্তু তা যেন কোনও অসহায় শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে সংগঠিত না হয়, শ্রমিকের কর্মসংস্থান তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটাক, চোখের জলে সেই খুশির অপমৃত্যু যাতে না হয়, তার দায়িত্ব আয়োজক দেশগুলোকে এবং বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফাকে অবশ্যই বহন করতে হবে।


    তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি স্পোর্ট, ইএসপিএন, আল জাজিরা,

    দা গার্ডিয়ান



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments