যতদূর স্মরণ হয় ‘সাহিত্য পত্র’ পত্রিকায় আদিকালে আইরিশ কবি হিউ ম্যাকডার মিয়াড বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। সে প্রবন্ধের রচয়িতা রামকৃষ্ণ। আমার প্রয়াত বন্ধু অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এবং এই সময়’ নামে একটি কাগজ করতেন। সে কাগজে তাঁর দু-একটি টি লেখা পড়েই বুঝতে পারি এঁরা লেখালিখি চপল বা চাতুর্যপূর্ণ নয়, এ নিয়ে ভাববার দরকার আছে। বার দুয়েক তাঁর বাড়িতে, কয়েকবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোয়ারি স্টাফ রুমে গিয়েছি কথা বলতে। তারপর ফোনে কথা। শান্তিনিকেতন চলে যাবার পর যোগাযোগ কমে গেল। কিন্তু লেখার যোগ থেকে গেল। পেনশন বিভ্রাটে যখন আট নয় বছর ঘুরছি বিকাশ ভবনে তখন পেনশন- দুশ্চিন্তা তাঁকেও অস্থির করল। এক-দুবার বার কি তিন বার শান্তিনিকেতনে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তারপর কলকাতায় থিতু হবার পর হ্যারিসন রোডে ‘মানবমন’ পত্রিকার অফিসে বিকেলে দেখা, চিন্তা ও বইপত্রের বিনিময়। রোগজীর্ণ মানুষটির সঙ্গে কোবিদ পর্বের পর কয়েকবার ফোনে ওর লেখালিখির, নতুন বইপত্রের খবর নিতাম। ব্রহ্মাবান্ধব বিষয়ে কিছু বইপত্র ওকে যোগাড় করে দিয়েছি, কিছু বইপত্র উপহার দিয়েছি- এইসব। আমি খুব আলাপী লোক নই। তাই আক্ষেপ আছে। একদিন সকালে খবর পেলাম- খারাপ খবর। কয়েক দশকের যোগসূত্র ছিঁড়ে গেল। সে সব ব্যক্তিগত কথা থাক। বরং ওঁর লেখার সম্পর্কে কিছু কথা আমার অক্ষম লেখনীতে জানাই। উনি আমার থেকে কয়েকবছরের ছোট কিন্তু বিদ্যাবত্তায় অনেক অনেক বড়ো। এমনকি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে ওর মনোযোগ ও বিশ্লেষণ অবাক করে। কিছু কথা বলতেই হবে। সংকুচিত মন নিয়েই ওর লেখালিখি নিয়ে দু-চার কথা বলি।
প্রথমেই বলি- ‘কামারের এক ঘা’ বইটির কথা। ২০০৩ এ বইটি প্রথম বার হয়। তারপর অনেক সংস্করণ হয়েছে, কলেবরও বেড়েছে। বইটি সম্পর্কে লেখক গোড়াতেই বলে নেন- ‘স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র আর কলেজ পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখেই এগুলো লেখা। আরও বয়স্ক লোকজন পড়লে অবশ্যই আপত্তি নেই’। বইটিকে তিনি সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন- কামারের এক ঘা, নীতিবোধ, বনের মোষ তাড়াতে, ঘরের কথা, হা, রাম, ভারতের ঐতিহ্য, সত্য চরিত্র ও কাহিনী ব্যবহার করে শাস্ত্র থেকে রাজনীতি, অনেক বিষয়েই তিনি ছোট ছোট করে আলোচনা করেছেন, যুক্তি দিয়ে মনের সংস্কার দূর করতে চেষ্টা করেছেন। স্যাকরার টুকটাক নয়, কামারের এক ঘা দিয়েই তিনি উৎসুক ও আগ্রহী তরুণদের মনের দোলাচলতা, ময়লা দূর করতে চেয়েছেন। জ্ঞান দিয়ে নয়, উদাহরণ দিয়ে, তত্ত্ব না কপচে কথাবার্ত্তা দিয়ে আলো ফেলতে চেয়েছেন। শিক্ষা, সংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, লৌকিক ও অলৌকিক, বিকল্প জীবন দর্শন, প্রভৃতি নানা বিষয়ে ছোট ছোট আলোচনা করে মন্তব্য করতেন- ‘চাই কামারের এক ঘা’। জিজ্ঞাসু পরিবর্তন মুখী প্র্যিবাদী জীবনদর্শনই পারে সেই ঘা দিতে’। (পৃ. ৭২) দ্বিতীয়ত আসছে মানুষের প্রতি বিশ্বাস, জীবনে ক্ষমা, প্রবৃত্তি ও পরিবেশের, সমর্পণ এর বদলে সংযম, আত্মনির্ভরতা ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ। তৃতীয় অংশে আসছে বিসংবাদ, সাধ ও সাধ্য, দায়িত্ববোধ, খবরের সত্যি মিথ্যে, দিন আনতে হয় প্রভৃতি কথাবার্ত্তা রীতির মাধ্যমে ব্যক্ত।
৪র্থ পর্যায়ে- আসছে বাংলায় যুক্তিবাদ পরম্পরা, বিজ্ঞান ও মানবিকী সম্পর্ক কথা। ৫ম অধ্যায়ে- রাম প্রসঙ্গে, রাজনীতি প্রচ্ছন্ন কিভাবে, রামপ্রসঙ্গিত কালচারে। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি যুক্তি বাস্তব সংস্কার প্রভৃতির ভারতীয় ঐতিহ্য আলোচনা করেছেন গল্পচ্ছলে। সব শেষ অধ্যায়ে কলি যুগ ও বিজ্ঞান বিরোধিতার কৌশল কথা। লেখক প্রসঙ্গগুলিকে তথ্য, কাহিনী, উৎস প্রভৃতি দিয়ে হাজির করেন- ক) অতীত ধারণা বিষয়ক খ) সঠিক উপলব্ধিতে আরো শাণিত করার রসদ গ্রহণ। এ রকম পরিকল্পিত একটি বহুমাত্রিক বই স্বীকার করছি আমি আগে ওপরে আর পড়িনি। এই বইটি লেখকের পরবর্তী অনেক বইয়ের সন্ধান ও উপস্থাপনার ভিত্তি গড়ে দেয় আজ বুঝতে পারি।
‘মননের মূর্তি’ (২০১০) বইটি যদিও ‘আগে পরিকল্পনা করে লেখা’ হয়নি তবু এ বইতে তিনি আলোচ্য করেছেন না হলেও ‘প্রত্যেকেরই নিজস্ব মহিমা’ আছে। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তি জীবন নয় কর্মজীবনকেই তিনি সংক্ষেপে তুলে ধরতে চান। আর ‘অনুতাপহীন মার্কসবাদী লেনিনবাদী’। মার্কসবাদী লেনিনবাদী দৃষ্টি কোন থেকেই জগৎ ও ব্যক্তিত্বকে বিচার করতে চান, যা অন্য সব বইতে প্রচ্ছন্নভাবে লক্ষ্য করা যাবে। তাছাড়া বলে নেন- ‘প্রতিভাশালী ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে হয় তাঁর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে’। তাছাড়া বলা হয়- ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে মার্কসবাদ অস্বীকার করে না। লেখক রামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গির, রচনার চালিকাশক্তির পরিচয় পেতে সুবিধে হবে বলে এখানেই এ বইটির কথা তুললাম। আলোচ্য ব্যক্তিবর্গ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের, প্রাচীন ও নবীন পর্বের, যাদের চারজনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। এই মহান ব্যক্তিবর্গ হলেন-
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গেওর্গ লুকাচ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, এফ. আর লীভিস, জোসেফ নীডহাম, গোপাল হালদার, শিবরাম চক্রবর্ত্তী, দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পল সুইটি, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সূচিপত্রে নামোল্লেখের পর তাদের মুখ্য বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত। যেমন- ব্রহ্মবান্ধব (চির অশান্ত স্বাদেশিক, গ্রন্থশেষে এই চৌদ্দজনের জন্ম, মৃত্যু, উল্লেখ্য কর্ম, উল্লেখ্য রচনাদির উল্লেখ আছে, প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে বিস্তৃত টীকা আছে যা পাঠককে এঁদের কাজকর্ম আরও বিস্তারে জানতে উদ্দীপ্ত করবে। আর এই ‘গাইড বুক’ সূত্রে পাঠককে জানানো যায় রামকৃষ্ণ বড়ো কাজ করেছেন ব্রহ্মবান্ধব, ভূপেন্দ্রনাথ, রাহুল, কোসম্বী, দেবী প্রসাদ প্রসঙ্গে। অনেক পরে দেবীপ্রসাদের অগ্রন্থিত লেখা সম্পাদনার গুরু ও দায়িত্বও নিয়েছিলেন।
‘ভারতবিদ্যা ও মার্কসবাদ’ বইটি বেরিয়েছিল অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এর উদ্যোগে। নব্বই দশকের গোরায়, প্রথম তিনটি এবং পরে কোসম্বী সংক্রান্ত লেখাগুলি প্রথমে পত্রিকায় এবং পরে গ্রন্থস্থ হয়। স্পষ্টত: এই দুই মহানব ব্যক্তিত্বের মার্কসবাদী বিচার। কোসম্বী চর্চা- সঠিক চর্চা- বাঙলায় এ ছাড়া হয় নি।
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বিষয়ে পূর্বে কিছু কাজ হলেও স্পষ্টত: তাঁর অবদান ও বিচার নিয়ে রামকৃষ্ণবাবু ‘মানবমন’ পত্রিকায় অনেকগুলি প্রবন্ধ লেখেন। সেগুলি অবশ্য শান্তিনিকেতন ও ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিষয়ক। কিন্তু ব্রহ্মবান্ধবের বিচিত্র জীবনের সামগ্রিক পরিচয় আসে ২০১৭ র বইতে। বইটির প্রথম অংশে আছে- দুবার যাওয়া ও ফিরে আসা, স্বাদেশিকতা ও ধর্মানুরাগ, দু ধরিনের জীবন, ভারতে খৃষ্টায়ত্ব নিয়ে সংকট। দ্বিতীয় অংশে আলোচ্য- রবীন্দ্র ও ব্রহ্মবান্ধবের অদ্ভুত পথ চলা, পথ ভিন্নতা, যবনিকা। পরিশিষ্টে- ফিরিঙ্গি শব্দ নিয়ে খোঁজ, কসটানজো জিউসেপ্পে বেসচি এবং একটি চমৎকার পাঠ্যসূচি। এটি ইংরেজি বই। মনে পড়ে এ বইটি প্রকাশের পূর্বে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মাচর্যাশ্রম ও উপাধ্যায় মহাশয়ের সম্পর্ক নিয়ে কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট- এ আমি একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলাম। প্রভাতকুমার, প্রশান্ত পাল প্রভৃতির গ্রন্থে এ পর্বের যথাযথ ও বিস্তৃত আলোচনা ছিল না। রামকৃষ্ণের ‘মানবমন’ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলির ফটো কপি এনে দিয়েছিলেন অধ্যাপক নীলরতন সরকার। রবীন্দ্র নিষ্ঠ শ্রোতৃবৃন্দ এ বক্তৃতা মারফৎ ব্রহ্মবান্ধব বিষয়ে কিছু শুনতে ও জানতে উৎসুক হন। আজ কৃতজ্ঞচিত্তে এসব কথা স্মরণ করি।
অনির্বাণ অগ্নিশিখা, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত: ‘ইতিহাস বোধ ও রাষ্ট্রচিন্তা’ (১৯৯৬) বইটি ভূপেন্দর জীবনী নয়, বরং দুটি অবদানের কথা লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেঞ্জ। তা হল- ‘এ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তিনিই প্রথম শ্রেণী সংগ্রাম ও সমাজবাদের কথা তোলেন ১৯২৬-এ। দ্বিতীয়ত: প্রাচীন ভারতের সামাজিক ইতিহাস আলোচনার তিনিই প্রথম মার্কসবাদ প্রয়োগ করেন। প্রসঙ্গত: স্মরণীয় এ বইটির একটি সংশোধিত সংস্করণ আছে এবং ভূপেন্দ্রনাথের সাহিত্যে প্রগতি বইটি রামকৃষ্ণবাবু সম্পাদনা করে ভূমিকা সহ প্রকাশ করেন। ভূপেন্দ্ররা তিন পুরুষ বিয়ে করেন নি, বলতেন বিয়ে না করাটাই দেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দু বেলা খেতেন তাঁর গলির মোড়ে অমিয় হোটেল- এ, ১০ নং চেয়ার টেবিলে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য হোটেল ৯ এর পরেই ছিল ১১ নম্বর সিট। ‘কালধ্বনি’ পত্রিকায় দুটি বড়ো ৮টি অধ্যায়ে আলোচিত- জাতীয় বিপ্লববাদ ও ভূপেন্দ্রনাথ, বঙ্গভঙ্গ স্বদেশী ও বিপ্লববাদ, কমিউনিজম এর পথে, ভূপেন্দ্রনাথ ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন, তত্ত্ব ও-প্রয়োগের ঐক্য। বাঙলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভূপেন্দ্রনাথের স্থান, ভূপেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা। পরিশিষ্টে আছে ৬টি প্রসঙ্গ- ইতিহাসের স্রষ্টা ভূপেন্দ্রনাথ, অরবিন্দ ও ভূপেন্দ্রনাথ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রসঙ্গে গান্ধী, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী। বইটি উৎসর্গ করা হয় ভূপেন্দ্রনাথের শেষ জীবনের অন্যতম সঙ্গী পতিতপাবন দে-কে। ভূপেন্দ্রনাথ আজ বামপন্থী বাঙালীর কাছে বিস্মৃতপর্বের একজন। অথচ তাঁর জীবন এ কর্ম থেকে প্রেরণা নেবার অনেক কিছু আছে বলে মনে হয়।
বিদ্যাসাগর: নানান প্রসঙ্গ (২০১১) লেখা চলছিল নানান তাগিদে, শেষে বই হল ২০১১-তে। ভূমিকায় লেখক বলেন তাঁর কর্মজীবনের কয়েকটি দিককে এখানে তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজ চিন্তায় নানা সময়ে চর্চা, পুনর্বিচার, কাউন্টার করা ইত্যাদি শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন করে ৭০ দশকের পর থেকে। রামকৃষ্ণবাবু এ বইতে আলোচ্য করেছেন কয়েকটি, ‘বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়’ বইতেও আছে। প্রথম লেখাটিতেই (এ বইয়ের) প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেন- ‘তাঁর কাজের ক্ষেত্রও ছিল বহু ও বিচিত্র’। ‘মেট্রোপলিট্যান ইন্সটিটিউশন ছিল সাম্রাজ্যবাদী আত্ম(..?) বিরুদ্ধে প্রথম সফল স্বদেশী প্রতিবাদ’। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতিচর্চায় ‘আধুনিক বিদেশীয় ধারা’ বেছে নিয়ে ছিলেন বললে অবশ্য ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়। সরকারি ঘুষ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন ঘৃণাভরে। তিনিই শেষজীবনে আক্ষেপ করে ভক্তদের বলেছিলেন- ‘তোমাদের আর উপায় নাই, জঙ্গলে গিয়া পল্টন তৈয়ার কর’। বইটিতে, ছোট্ট বই, কিন্তু অনেক নতুন কথা আছে। ২য় প্রবন্ধে আলোচ্য করেন- ‘শাস্ত্র বনাম পরিবর্তন’ প্রসঙ্গে বাঙালি পুরানো পন্ডিতদের কথা তুলেছেন, পরিবর্তন মনস্কতার সৎসাহস দেখিয়েছেন। বিধবা- বিবাহ বিতর্ক প্রসঙ্গে তাঁর মৌলিকতা কোথায় তা দেখিয়ে দেব। প্রসঙ্গত: সমকালীন পন্ডিতি বিতর্ক (বিদ্যাসাগর কেন্দ্রিক) বিষয়ে ও কথা বলেন। সহবাস সম্মতি আইন নিয়েও তাঁর মতামত প্রণিধান যোগ্য। ৯ম প্রবন্ধে আসছে নব্যন্যায়ের বিরোধিতা প্রসঙ্গ যাতে বেদান্তচর্চা, শিক্ষা সংস্কার, দর্শনের পাঠ্যসূচি এবং লোকায়ত আলোচনার সূত্রপাত কথা আছে। উপ প্রসঙ্গ আলোচিত- সাংখ্য দর্শনের কোন অংশটি গ্রহনীয় জনশিক্ষা প্রচার ও সাম্রাজ্যবাদী ও রক্ষণশীল প্রাচ্য প্রসঙ্গ সংক্ষেপে তোলেন। ১২ নং প্রবন্ধের বিষয় বিদ্যাসাগর, পরমহংস, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্ক নির্ণয়। ইহ মনস্কতা ছিল তাঁর যাবতীয় কর্মের চালিকা শক্তি। অনিবার্য নি:সঙ্গতা ছিল তার জীবনে। জার্মান ভারতবিদদের চোখে বিদ্যাসাগর বিষয়টিও কৌতূহল মেটায়। বঙ্কিমের বিদ্যাসাগর বিরোধ ওঠে পৃ. ১৬৩-এ। এই বইটির প্রসঙ্গ অধ্যয়নে তিনি রীতিমত যোদ্ধার ভঙ্গি নেন, প্রয়োজনে ন্যায়চর্চাকারী পন্ডিতদেরও সাহায্য নেন। লক্ষণীয় তর্কে সর্বত্র সাহিত্য ও ধর্মকে আলাদা করতে চান (পৃ. ১৬৮)।
‘বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়’ (২০০৫) বইটির কথা এখানে তোলা থাক। বিদ্যাসাগরম, ব্রহ্মবান্ধব, শ্রী অরবিন্দ বিষয়ে কিছু নতুন কথা, পূর্বে আলোচিত বইগুলির মত এখানেও আছে ভূমিকায় লেখক বলে নেন ‘আত্মপরিচয়’ বিষয়ে বাঙালির সচেতনতা উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে। সমাজসংস্কার, শিক্ষা প্রসার চালু হয়ে যায়। উনিশ শতকের আগে বাঙালি সমাজ ছিল অ-রাজনৈতিক। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণবাবুর বক্তব্য তিনি ছিলেন অ-ধর্মীয় (secular) মনোভাব সম্পন্ন। শাস্ত্র ঘাঁটলেই তাঁর জীবন ও কর্মে ধর্মের বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না। শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর অধর্মীয়তা মিশনারীদের পছন্দ হয় নি। তাঁর পাঠ্য বইগুলিতে কোথাও ধর্মগ্রন্থ থেকে কোনো বাণী বা শ্লোক দেওয়া হয় নি, ধর্মনেতাকে ঠাঁই দেন নি। জাতীয় কংগ্রেস সম্প্ররকে তাঁর তাচ্ছিল্য ছিল। মাতৃভক্তি, দয়ামায়ার কীর্তন করে সেকিউলার সত্তাকে উপেক্ষা করা হয়। ব্রহ্মবান্ধব বিষয়ক রচনাটিও পূর্বোক্ত ব্রহ্মবান্ধব বিষয়ক বইয়ের পরিপূরক। অথচ পুনরাবৃত্তি নেই। আপসহীন জাতীয়তাবাদী ব্রহ্মবান্ধব ভারতের পূর্ণস্বাধীনতার দাবী প্রথম তোলেন, নীচুতলার মানুষ ও অন্ত:পুরিকারা জানতে পারে স্বদেশী ও স্বরাজের কথা। তাঁর প্রায়শ্চিত্ত (মৃত্যুর ২ মাস আগে) কোন মতে, ব্যবস্থা পত্র, প্রায়শ্চিত্তের পরিণাম কারণ, তাঁর হিন্দুত্ব, রাজনৈতিক প্রায়শ্চিত্ত আলোচিত। এ প্রবন্ধের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে সংস্কৃত পন্ডিতবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ অবাক করে। অরবিন্দর বাঙলা চর্চা প্রবন্ধে লেখক দেখান ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে জাতীয়তা তথা রাজনীতির যোগ অরবিন্দই প্রথম প্রতিষ্ঠা দেন। কাব্যরুচি বিষয়ে জানা যায় ধ্রুপদী গ্রীক লাতিন সংস্কৃত ছাড়া মালার্মে, বোদল্যার, ইয়েটস, লরেন্স পড়েন মনোযোগ দিয়ে। বঙ্কিমকে অরবিন্দ সাহিত্যিক হিসেবে নয়, জাতিগঠক হিসেবে গুরুত্ব দেন। বসুমতীর ভাষা, পাঁচকড়ির সরস টিপ্পনী তে আমোদ পেয়েছেন, ক্ষীরোদ প্রসাদের প্রতাপাদিত্য দেখে মুগ্ধ হন।
রামমোহন এর ৭টি কৃতিত্বের কথা বলেন আর একটি প্রবন্ধে। সেগুলি হল- গদ্যে বাংলা বিবিধ লেখার সূচনা, মেয়েদের প্রাচীন অধিকারের কথা, আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনে ভূমিকা, কয়েকটি উপনিষদের অনুবাদ (বাংলা ও ইংরেজি), বাক্স্বাধীনতার দাবী, ইংল্যান্ডে সাড়া ফেলে দেওয়া, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকার খবর রাখা, প্রভৃতি। তিনিই যথার্থ বিশ্বপথিক। অপর প্রবন্ধে জানান ভারতীয় রাজনীতিতে প্রলেতারিআত অরবিন্দ আনেন। ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশে পালাবদল সূচিত হয়। সমাজ সংস্কার ও স্বাধীনতার দাবীর বিতর্কে অরবিন্দের অংশগ্রহণ, বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে ফিরে এলে অন্যতম প্রধান সমালোচক ব্রহ্মবান্ধব, স্বদেশী যুগে রাজনীতির নিরিখে তিনটি দল- রাজভক্ত, নরমপন্থী, জাতীয়তাবাদী। আর একটি প্রবন্ধে দেখানো হয়- হিন্দু বাঙালির সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও গদ্যরচনার বিকাশও ঘটেছে একই সঙ্গে। রাজনীতি চর্চার প্রয়োজনেই বাঙলা গদ্যের একটা নতুন গণমুখী ধাঁচ গড়ে উঠল ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের হাতে। বঙ্কিম বাঙালীকে জোগান দিয়েছেন আত্মপ্রকাশের ভাষা। জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার এই স্বীকৃতি অরবিন্দই প্রথম দেন। ১৯০৬ এর আমেন টিলক ও কতিপয় নেতা এবং বাঙালীর মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব এবং অপূর্ব ঘোষ, সুন্দরী মোহন দাস, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ শেঠ প্রমুখ। তবে এ উৎসব হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বেড়ে যায়। মাদাম কামা বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে জানা যায় কামার ভাবনা- আগে স্বাধীনতা, পরে সমাজবাদ। ভারতের জাতীয় পতাকা নির্মাণ করেন কামা। এই প্রথম ভারতীয় জাতীয় পতাকা। ‘বাঙলা ভাষার ভূত ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২য় সংশোধিত (..?) থেকে। উনিশ শতকে ‘বাঙালি ভাষা’, ‘গৌড়ীয় ভাষা’ বা শুধুই ‘ভাষা’ বলা হত। ইংরেজিতে লেখার সময়েও রকমফের। অনেক লড়াই-এ আত্মপ্রতিষ্ঠা। স্বদেশী যুগে লিখিত বাঙলাকে আঘাত দেয় ব্রিটিশ সরকার। বাংলা, বাঙ্গালা, বাঙলা এ নিয়ে আলোচনা আছে। তবে বাঙলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কন্তু বাঙলা ভাষী মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কারণ আছে।
এক গুচ্ছ বই আছে যেগুলোকে আপাতত: সাহিত্যগত, সাহিত্যতত্ত্বগত আলোচনার বই বলতে পারি। ‘বঙ্কিমের মনন জগৎ’ (২০১৬) বইটিতে তিনি বঙ্কিমের প্রবন্ধ, বিশেষত: দর্শন ও ধর্মচিন্তা নিয়ে চারটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। গোঁড়া হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যাপারেই মতৈক্য ছিল না। যৌবনে বঙ্কিম ঘোরতর নাস্তিক, ১৮৭৮ নাগাদ তার দার্শনিক মত ঘুরে যায়- তখন- সাংখ্যবর্জন, বেদ প্রামাণ্যে অনাস্থা, ধর্ম ও দ্ররশনকে আলাদা করে দেখা। বহুগ্রাহিতা বঙ্কিমের মধ্যে বরাবরই ছিল। তাঁর নানা অসঙ্গতি। নাস্তিক থেকে আস্তিক। তবে মিল, কোঁত, স্পেনসর কেও একেবারে বর্জন করেন নি। হিন্দুধর্মের নব সংস্কার। দেশী বিলিতির গরমিল। ধর্মগুরু নন, রাজনৈতিক গুরু- ব্রহ্মবান্ধব, অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র পালের কাছে। বিজ্ঞান অনুরাগী অথচ ধর্মঅনুরাগী। ভারতীয় দর্শনের বৈদিক ধর্মে ভক্তি নাই। তার মতে- বেদ অপৌরুষের নয়। পৌরুষের। বেদের গৌরব লাঘব। ইংরেজ গীতা অনুবাদক দের প্রতি ঘোর অবজ্ঞা। বঙ্কিমের ঋষিত্ব- বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বঙ্কিমকে সামনে রেখেই তার উত্থান ও বিস্তার। আনন্দমঠের বঙ্কিম। বঙ্কিমের মহাভারত চর্চার মধ্যে নিষ্ফল প্রয়াস। প্রচেষ্টা বিচারের বিষয়নির্ভর পদ্ধতির কথা আলোচিত।
রবীন্দ্রনাথের ‘তিনসঙ্গী’ (২০১২) বইতে তিনি আলোচ্য করেন রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে লেখা রবিবার, শেষকথা, ল্যাবরেটরি গল্প তিনটি। চারটি প্রবন্ধ যাতে গল্প ত্রয়ীর ঐক্য, পুরাণের পুনর্ব্যবহার, শেষকথা গল্পের গ্রহণ বর্জন এবং পুরানের রূপান্তর- ‘পতিতা’ থেকে ‘ল্যাবরেটরি’। মিশের দিকগুলো হল- বিজ্ঞান ও কারিগরিবদ্যা তিনটি গল্পই প্রকট। ‘গাড়ি’ বহু ব্যবহৃত। ল্যাবরেটরি তে বিজ্ঞানময়তা। ভাষাতেও বিজ্ঞানের রূপক। তিনটি গল্পেই ফিরে ফিরে আসে ইউরোপ ও আমেরিকার কথা। অন্যদিকে- তিনটিতেই নারী পুরুষ সম্পর্ক। সর্বত্র- পরিণামহীনতা। প্রেম ও কর্মর দ্বন্দ্ব আছে গল্পেও। চমৎকার মৌলিক আলোচনা। ‘বিদায় ও অভিশাপ’ ও ‘শেষকথা’ র৯চনা দুটির তুললামুলক আলোচনা কালে মহাভারত আদিপর্বের (..?)- দেবযানী উপাখ্যানের উত্থাপন। প্রসঙ্গত: ‘পঞ্চভূত’ বইয়ের ‘নরনারী’ প্রবন্ধটির কথা ওঠে একাধিকবার। ‘ছোটো গল্প’ আর ‘শেষকথা’ এ দুই এর পাঠভেদের প্রকৃতি আলোচিত আর একটি নবন্ধে। অন্যত্র ‘ছোটো গল্প’ রচনাটির খসড়া ও মুদ্রিত রূপের তারতম্য ইত্যাদির কথা। দুইয়ের শব্দ ও বাক্যগত তফাত প্রচুর। আর একটি লেখায় শেষকথা ও ‘ছোটোগল্প’ দুটি রূপের বিচার। সর্বশেষ প্রবন্ধে ল্যাবরেটরি গল্পের ‘সোহিনী’ চরিত্রের বিশ্লেষণ- তা কেমন ব্যতিক্রমী। প্রাবন্ধিকের সিদ্ধান্ত রবীন্দ্রের দেশকাল সচেতন বাস্তবতার পরিণত প্রকাশ এ রচনায়।
‘ন্যারেটলজি: ছোটগল্প: ছোটদের গল্প (২০১৪) বইতে তিনটি প্রথমাংশে দেখান ন্যারেটলজির সীমাবদ্ধতা, ফাঁকি, ভবিষ্যৎ, দ্বিতীয় অংশে আসে ছোটো গল্প ও ছোটো গল্প, মুখচলতি গল্প, তার সঙ্গে ছোটোগল্পের ফারাক, লেখা গল্পের সূচনা, ছোটোগল্পের নানা রূপ, ছোটোগল্পে উপাখ্যান, তাতে ভাষার কাজ তার আবহ, চিঠিগল্প, ফাইল চালাচালির গল্প, ছোটোগল্পের সমাপ্তি, জোড়া সমাপ্তি, প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি। তৃতীয় অংশে- ছোটদের গল্পে ফ্ল্যাশব্যাক, সমাপতন, আমির জবানী, টাইপ চরিত্র, আপাত অবান্তরতা, স্কুলের গল্প, নাকাল নার্বশী, গল্পে মোচড় ও পরিণতি, গল্পে লেখকের মন্তব্য, ছোটদের গল্পে বড়োদের জগৎ। ছোট ছোট রচনা কিন্তু কিছু কথা, অনিবার্য উদাহরণ সহযোগে উপস্থাপন। ছোটোগল্প বিষয়ে নতুন সংযোজন, ন্যারেটলজি নিয়ে স্পষ্ট মন্তব্য।
রবীন্দ্র পরবর্তী ইনডিভিজুয়াল লেখক হিসেবে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন অন্তত: দু জনকে। তাঁরা হলেন- বিভূতিভূষণ ও পরশুরাম। প্রসঙ্গত: মনে পড়ে তারাশংকরের ‘অশনি সংকেত’ বিষয়ক আলোচনা। ‘বিভূতিভূষণ ও কথাসাহিত্য বাস্তববাদ’ (২০১৩) বইটির প্রথম অধ্যায় বিভূতি সাহিত্যে বাস্তবতা দেখানোর কিছু উদাহরণ ও আলোচনা। তিনি শুধুমাত্র স্বপ্নসর্বস্ব লেখক নন। ‘ক্ষুধা আর ক্ষুন্নিবৃত্তি থেকেই তো বিভূতিভূষণের সৃষ্টিয় সূচনা’। বিভূতি সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার অভিযোগ বিজ্ঞ মনে করলেও বিভূতিবাবু এক ভাষণে বলেন- ‘বাঙলা সাহিত্য ক্রমশ: সমাজ চেতনায় মুখর হয়ে উঠচে’। রহস্যবাদ, আত্মা ও পরলোকে অন্ধবিশ্বাস থাকলেও বিভূতি সাহিত্যে এমন কি ‘দেবখান’ উপন্যাসেও আর্নস্ট টলার, স্পেন এর গৃহযুদ্ধ, সোমালিস্ট এ কমিউনিস্টদের গণতন্ত্রের হয়ে লড়াই, কার্ল লিবনেখট এর শহীদ হওয়ার ঘটনা তাকে নাড়া দিয়েছিল জানা যায়। প্রকৃতি চেতনার আধিক্য থাকলেও প্রকৃতির অন্তর্গত মানুষ (আরণ্যক) তাঁর দৃষ্টিতে অবহেলিত নয়। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত বইদুটি লেখক ‘খিদে ও খাওয়ার পাঁচালি’ আখ্যা দিয়েছেন, উদাহরণ দিয়েছেন। ৩য় প্রবন্ধে আসে দুর্গা ও অপুর কাহিনীতেও বিয়ের সম্বন্ধ, জমি জরিপ, কাশীতে হরিহরের বেঁচে থাকার চেষ্টা, কথক ঠাকুরের ভূমিকা (কাশীতে), বাঙলার (…?) ব্রাহ্মণদের দুরবস্থা কাশীর কথক জীবনের নিখুঁত ছবি- এসব আছে। ৪র্থ অধ্যায়ে গুরুত্ব পায় পিতম কাঁসারির হাতের কাজ। ছোট্ট একটি ঘটনার মাধ্যমে নৈতিক সব ধরিয়ে দেন। ৫ম অধ্যায়ের বিষয়- আর্থিক, সামাজিক, সহাবস্থান, সর্বজয়া, হরিহর, দুর্গা, প্রভৃতি চরিত্র কেন্দ্র করে এই বাস্তবমুখী করে তোলে। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক বলেন মানুষের জন্ম থেকে বড়ো হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত কিভাবে পাশ্চাত্য এ রীতির রচনার থেকে পৃথক। ‘পথের পাঁচালী’ শুধু অপুর গল্প নয়, কলকাতা থেকে বহুদূরে গ্রামে ছেলেমেয়ে, গরিব বড় লোক, লেখাপড়া জানা না জানা মানুষের কথাও। ‘পথ’ ই পথের পাঁচালী বা ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে (…?) কাজ করে। ৭ম অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিভূতিভূষণ কোথায় পৃথক তার কথা / ৮ম অধ্যায়ে অশনি সংকেত উপন্যাসে লেখক লক্ষ্য কয়েক ইতিহাসের দিকচিহ্ন। তেতাল্লিশের মন্বন্তর ও বাংলা গ্রাম জীবন নিয়ে স্মরণীয় রচনা। বিভূতিবাবু মনে করতেন- যথার্থ কথাসাহিত্যিক সম সাময়িক সমাজ বা রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশকালান্তরিত জীবনের ছবি আঁকেন। ইছামতী, অশনি সংকেত, পথের পাঁচালী তুলনামূলকতায় আসে। দ্বিতীয়টিতে যেন (..?) আকারে দুর্গতিকথা। বিভূতি মনুষ্যটিতে শেষ (..?) কিছু তো মানতে পারেন না। পরিস্থিতির অনিবার্যতা ছাড়িয়ে ওপরে ওঠার প্রবল প্রয়াস তার উপন্যাসে, বক্তৃতায় স্পষ্ট। এ ছাড়া অশনি সংকেতে লক্ষ্য করেন- ছোটো ছোটো (…?), লোকায়ত শব্দ ব্যবহার, নিরলঙ্কার বর্ণনা। একমুখী আখ্যান প্রভৃতি। তবে লেখক চড়া গলায় কথা বলেন না। যুদ্ধের কথাও সব ভাসা ভাসা। ‘অশনি সংকেত’ বিষয়ে খ্যাত আলোচকদের বিরোধিতা করে তিনি অনেক ভাবনাযোগ্য কথা বলেন।
পরশুরামকে নিয়ে তিনি তিনটি বই লিখেছিলেন যথাক্রমে ২০১১, ২০১১, ২০১২ তে। প্রথম বইয়ের ভূমিকাতেই বলেন পরশুরাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকারদের একজন। তার প্রায় সব গল্পই হাসির, কিছু গল্পে আছে ব্যঙ্গ। এই হাসির গল্পের জন্যই তিনি বেশি গৌরব দাবি করেন। আছে গল্প রচনার আঙ্গিক নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষার জন্য বিষয়বস্তুকে কি করে সবচেয়ে সফলভাবে হাজির করা যায়। তাঁর প্লটিং অভিনব, অসামান্য। প্রথম বইতে আছে মহাবিদ্যা, ভুশন্ডীর মাঠে, লম্বকর্ণ, গুরুবিদ্যায়, মধ্যম (পুনর্মিলন), মহেশের মহাযাত্রা, তৃতীয় দ্যুতসভা, ভরতের ঝুমঝুমি, অক্রুর সংবাদ, রাজমহিষী, যযাতির জরা, জয়রাম জয়ন্তী। গল্পকারের কৃতিত্ব ত্রিমুখী- চরিত্রসৃষ্টি, ঘটনাবিন্যাস, ভাববস্তু। দ্বিতীয় বইটির গোড়াতেই বলেন- চরিত্রসৃষ্টিতেই তাঁর আসল দক্ষতা। বিভিন্ন বয়সীর প্রায় যাবতীয় টাইপ তাঁর গল্পে। তিনি বাস্তববাদী ধারার লেখক, এমনকি পৌরাণিক গল্পেও। ১৯২২-৬০ তাঁর গল্প এই কালসীমার। মধ্যবিত্তদের দ্রুত রূপবদল গল্পে। সামাজিক ইতিহাস রচনার রসদ যথেষ্ট। নতুন নতুন ধাঁচের দিকে। ব্যঙ্গরচনার হিসেবে মনোযোগে ঠক, জোচ্চোর, ধড়িবাজের দিকে। চরিত্র সৃষ্টি- টাইপ ও ব্যক্তি। প্রথম প্রকারেই ঝোঁক বেশী। শেষ দিকের গল্পে দেশের দুর্দশার কথা। সাহেব ঘেঁষাদের প্রতি বিদ্রূপ। দুটি ব্যক্তি চরিত্র- গল্প বলিয়ে চাটুজ্যে মশায় এবং মুক্তমতি বিনোদ উকিল বিশদ আলোচিত। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ চতুষ্পদ, পাখি নানা ভূমিকা নেয়। তৃতীয় বইটির ভূমিকায় রামকৃষ্ণবাবু বলেন ১৯৪৭র পর থেকে পরশুরামের সব গল্প মজাও বৈচিত্র্যে ভরপুর নয়। ছোট গল্পই তার জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসার বাহন। প্রখর যুক্তিবাদী। দুর্নীতির কারণ- ব্যক্তিমানুষ। (…?) প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ সংশয়। শেশঢে চিত্রকর (প্রাম তিনটি বইয়ের) যতীন্দ্রকুমার সেনের কীর্তির পরিচয়।
‘ওরে বর্ণচোরা ঠাকুর এল ইত্যাদি বিতর্ক’ (২০১০) বইটির নামটি বেশ মজার। ‘পলেমিক’ তাঁর প্রিয় বিষয়। সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কিছু বিতর্কে মতামত দিয়েছেন। এখানেঅ তাঁর কামারের এক ঘা দেবার ভালো মতো পরিচয় আছে। ‘ভাঙা আর নয়’, ‘দেশ ও কাল’: কয়েকটি নমুনা প্রসঙ্গে দেখান ষাটের দশক থেকে বাঙলা কথাসাহিত্য ‘বিষয়ের অভাবে’ ভুগছিল আর পরিবর্তমহীন একঘেয়েমি, কিছুটা অ্যাবিল দেশপ্রেম, একঘেয়েমি কাটাতে যৌনতা। ৫টি উপন্যাস বেছে নেন। আলোচনার মাধ্যমে কিছু মন্তব্য ভাবনা উদ্রেক করে। ক) আলাদা ধরনের গল্প লিখলেও ও সুনীল ও শীর্ষেন্দুর মনোজগৎ একই। খ) চরিত্র ছকবাধা গ) ব্যাপক জনসমাজের মধ্যে রেখে পাত্র পাত্রীদের বোঝার / দেখাবার চেষ্টা করেন না। ঘ) সমবেশ ‘গত’ দশবছরে তিন ধরনের কাহিনী লিখেছেন- ফর্মুলা মাফিক ভালোবাসার গল্প, যৌনতাকেন্দ্রিক গল্প, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার গল্প। হাল আমলের বাস্তবতাকে ধরবার চেষ্টাই করেন না। ঙ) অনন্বয় (সমাজ ও লেকঝক) দুই কিস্তিতে কিছু উপন্যাসের মূল্যায়ন। অন্ধ কমিউনিজম বিরোধিতা, জৈব প্রবৃত্তি আঁকড়ে থাকা হিংস্রতা, যৌনতা, অভিজ্ঞতার ছোট্ট গন্ডী, গৌরকিশোর, সন্তোষ প্রভৃতির উপন্যাসে। অপশব্দের প্রয়োগ। সাহিত্য বিক্রয়যোগ্য পণ্য, ইতিবাচক চরিত্র অভাব। কাহিনীর মধ্যে লেখকের কোনো statement নেই তাই চরিত্রাচিত্রণের ঐক্য নষ্ট- গৌর ও সন্তোষ এর লেখায়। গৌর ও সন্তষের মিল ঘটনা নির্বাচনে, রচনারীতিতে। স্থিতাবস্থার সাফাই, কমিউনিজম সম্পর্কে নানা স্টুপিড কথা। ২য় কিস্তিতে অসীম রায়, দেবেশ রায়, অমলেন্দু প্রভৃতির গল্প। ‘দায়বদ্ধ লেখকদের কাছে এ সময় ছিল সংকটের, সংশয়ের, উত্তরাধীন আত্মজিজ্ঞাসার। লুকাচ নির্ভর মন্তব্য- জোর দিতে হবে দার্শনিক ও নান্দনিক সমস্যার, নৈতিক দিকের ওপর। শিল্পকর্মের নৈতিক তাৎপর্য দরকার। ‘কোনো পার্টির আওতায় না থেকে ও আরাগঁর কথা ব্যবহৃত। ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, পেশাদারি দক্ষতা, ভেতর ও বাইরের থেকে দেখাক- দরকার দায়বদ্ধ লেখকদের। নতুনত্বের জন্য নতুনত্ব দরকার নেই। কমলকুমার মজুমদার প্রসঙ্গে লেখাটি দেবেশ রায় এর একটি প্রবন্ধের উত্তর। রামকৃষ্ণ বলেন- কমলের ভাষা প্রকাশিত ভাষা রীতি অস্বীকার। বিষয়বস্তুতে সর্বদা প্রাচীন নন, কিন্তু লেখার ঢঙ প্রাচীন। যুবসচেতন ভাবেই কালব্যত্যয় করে চলেন। বিষয়ের আধুনিকতা সবক্ষেত্রে নেই। সাজা বিদ্রোহী ‘এস্টাবালিশমেন্ট কাকে বলে’ প্রবন্ধে তিনি এ বিষয়ের ইতিহাস তুলী বলেন- এটি বলতে বোঝায় তারা পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থার রক্ষক বাহিনী। ভারতীয় এস্টাবালিশমেন্ট কিঞ্চিৎ আলাদা। সর্বভারতীয় এস্টাবালিশমেন্ট ‘স্বভাবে চরিত্রে’ সেটি খুবই আধুনিক’। আননদবাজারের মতো কাগজ প্রতি দশ বছর বা ঐরকম সময় অন্তর নতুন কিছু বলার লোক নয়। সেটা বযবসার প্রয়োজনে। অন্যদিকে আছে প্রাদেশিক এস্টাবালিশমেন্ট (নব কল্লোল) দুই এস্টাবালিশমেন্টের দ্বন্দ্ব আছে। আনন্দবাজার সব ধরনের সব বয়সের পাঠকের কারবার চালাতে চায়। মুরুব্বিআনার পুরো দায়ভাগ এস্টাবালিশমেন্টের হাতে। তবে সব দেশের এস্টাবালিশ একই কায়দায় চলে না। ব্যবসা জমানোর জন্য বিরোধী মতকে প্রশয় দেয়, উল্টো মত ছাপে, বামপন্থী বলে পরিচিত লোককে পুরস্কার দেয়। নিন্দা প্রশংসা সবেরই পিছবে স্বার্থ। এস্টাবালিশমেন্ট লাখ লাখ লোক নিয়ে পুঁজি ঢেলে ব্যবসা করে। পশ্চিমবঙ্গ এখনও পর্যন্ত ইউরোপের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ। ‘কোসম্বী নিয়ে বুজরুকী’ প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা পন্ডিতদের কোসম্বী জীবন ও তার লেখা যত্ন করে না দেখা, তাঁর মার্কসীয় প্রত্যয়কে ভুল বোঝা ও বোঝানো। অরুণ ঘোষের প্রবন্ধ সামনে রেখে পন্ডিতদের অজ্ঞতা ও অভিসন্ধির উদাহরণ দেওয়া হয়। একটি দুর্দান্ত প্রবন্ধ আছে ‘ওরে বর্ণচোরা ঠাকুর এল’ নামে- (..?) স্ট্রাকচারালিজম ও পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম বিষয়ে। সত্তরের দশকে এসবের প্রাদুর্ভাব ফরাসি দেশে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নব্য ভাষাতত্ত্ব, অযুক্তিবাদী দর্শন, নৃতত্ত্ব ও ফ্রয়েড উত্তর মনস্তত্ত্বের নানা শাখা। লেখক এ তত্ত্ব দুটির সামান্য পরিচয় দেন পরিহাসের সঙ্গে- সোশুর, স্ত্রাউস, লাকঁ, বার্ত, দেবিদা প্রসঙ্গে। উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে এই নব্য তত্ত্বদুটির অগ্রহণগত অনিবার্যতা তুলে ধরেন কারণ এঁরা মূল লেখককেই পাত্তা দেন না। তুচ্ছকে উচ্চ করার অপচেষ্টা বলে মনে করেন প্রাবন্ধিক। পরিষ্কার বলে দেন আধুনিকোত্তর মতবাদগুলি বস্তর ফাঁপা। একটি প্রবন্ধে হাইডেগার-কে ‘মার্কসবাদীদের’ স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে সুদীপ্ত কবিরাজ, রণহিৎ গুহ, দীপেন চক্রবর্ত্তী প্রভৃতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত: পাশ্চাত্যে এই প্রবণতার দিকতাও তুলে ধরা হয়। প্রসঙ্গত: নীটলে ও সামালোচ্য হন। স্ট্রাকচারালিস্টদের সঙ্গে ফ্যাশিস্তদের ‘পিরীত’ নিয়েও বলতে ছাড়েন নি।
আর একটি প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টত: বলেন পোস্ট মর্ডানিজম এই বষয়টি বলতে অনেক কিছুই বোঝাতে পারে। যে ৫/৬/৭টি এর অন্তর্গত তাদের কমন ফ্যাক্টর- যুক্তির বিরোধিতা। সুদীপ্ত কবিরাজ বা দীপেশ চক্রবর্তী ছাড়াও অনেক রামা শ্যামা এসব অপলাপ করে থাকেন। আধুনিকোত্তর তত্ত্বালোচনা কে তিনি স্পষ্টত: ‘উপদ্রব’ আখ্যা দেন। কিছু পরিভাষা তৈরি করা হয়- চমক সৃষ্টির জন্য। অন্যদিকে- মার্কসবাদ একটি পদ্ধতি; কাজের দিশারি। পূর্বোক্ত বিষয়গুলিতে আছে বিস্তর পরস্পর বিরোধিতা, মার্কসবাদ চর্চায় অসম্পূর্ণতা। চার্বাক চর্চা বিষয়ে অর্বাচীনের লেখার সমালোচনা করে লেখক বলেন এ বিষয়ে অন্তত: দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বই পড়া ভালো। মিথুনাচার ও ভারতীয় ভাস্কর্য বিষয়ে নারায়ণ সান্যালের একটি প্রবাদের জবাবে তিনি বলেন একমাত্র প্রবোধ চন্দ্রোদয় নাটক নয়, শুধু শাক্ততন্ত্রচারী নয় অন্যদের (বৈষ্ণব, গণেশ পূজক ইত্যাদি) মধ্যেও এই মিথুন মূর্তি আছে। কোনার্কের মিথুন মূর্তি সম্পর্কে দেবলা মিত্রের রচনাংশ- ও তুলে ধরেন।
বের্টল্ট ব্রেশট প্রয়োগের নন্দনতত্ত্ব (১৯৯৯) বইটি লেখা হয়েছে যারা ব্রেশট এর কিছু নাটক পড়েছেন, দেখেছেন, নন্দনতত্ত্ব ও দর্শনে খানিক আগ্রহ আছে তাদের জন্য। ব্রেশট এর নাটক নিয়ে কিছু আলোচনা বাংলায় হলে তাঁর নন্দনতত্ত্ব নিয়ে সবাই অনাগ্রহী। বইয়ের আলোচ্য ১১টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। পরিশিষ্টে আছে- ব্রেশট এর জীবন ও সমকাল এবং ব্রেশট এর নাটক ও কবিতা। রামকৃষ্ণবাবু নন্দনতত্ত্বের এলাকা সম্পর্কে কিছু কথা বলে চলে যান লুকাচ, ব্রেশট, আডোর্নোর নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায়। তারপর আসে ব্রেশটের নন্দনতত্ত্বের চার অঙ্গ ও তার ব্যাখ্যা, এরপর এপিক থিয়েটার কি, আরিস্টটলীয় থিয়েটর এর সঙ্গে তফাৎ। ব্রেশট এর মৌলিকতা এ ছাড়া ব্রেশট ও স্তানিস্লাভক্সির তফাৎ ইত্যাদি। রীতিমত আকর্ষণীয় বিষয় সন্দেহ নেই।
ক্লাসিক কেন চিরায়ত (২০০৯) চমৎকার একটি ছোট্ট বই। ক্লাসিক এর গুরুত্ব ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিষয়ও আছে এ বইতে। প্রাসঙ্গিকভাবে হুজুগ দেখে কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত হয়েই প্রথ্যম প্রবন্ধটি লেখা। লেখকের চিন্তাধারা অনুসরণ করে বলা যায় যা ক্লাসিক তা সমকালের গন্ডি পেরিয়ে উত্তর কালের মানুষের মনেও ভাব সঞ্চার করে। ‘আধুনিক ক্লাসিক’ কথাটিও চলিত। রোমান লেখক আউলুস আনু ১৬৫ খ্রী: তে ক্লাসিক কঠাটি বিশেষ অর্থে মেলে। নাগরিক- পঞ্চশ্রেণীর (সম্পত্তি বিচারে) ১ম শ্রেণী কর দিত, তারাই ক্লাসিকি। প্রথম বা দ্বিতীয় সারির ক্লাসিকের উদাহরণ ও দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ কথা- বর্তমানের আলোতেই অতীত কে চেনা, অতীতের জ্ঞান দিয়েই বর্তমানকে বোঝা। চিত্তের প্রসার, বোধের গভীরতা, রচনার গুণমান চেতনা মেলে এর থেকে। যেটুকু পড়া তাতে কখনও ধরতে হয় না। একই বই বারবার পড়া যায়, কেটে যায় বহু সংশয়, শান পড়ে অনুভবে। ক্লাসিক তাই চিরায়ত এবং সমকালীন। ক্লাসিকের মাহাত্ম্য ভাষার জাদুতে নয়, ভাবের গহনতায়। নিজেকে চেনা, নিজের চারধারের মানুষ ও পরিবেশকে জানা- এ দু কাজে পথ দেখায় ক্লাসিক। জীবনের কিছু সার সত্য ধরা আছে তাতে। সারা জীবন চড়াই উতরাই পার হতে ক্লাসিক হয় সুখদু:খের সাথি। এ ছাড়া আছে ঋগ্বেদ-এ খরা ও দুর্ভিক্ষ, বৌদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তায় সামাজিক চুক্তি মতবাদ, শূদ্রর মানবমর্যাদা, অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর একটি অনন্য দৃশ্য, সংস্কৃতয় সফোক্লেস- এর গ্রীক সুভাষিত, প্রাচীন ভারতে এপিক ঠিয়েটার দিল্লীশ্বেরা বা জগদীশ্বেরা বা, ইতিহাসের মার্কসীয় বিচার। (কৌসম্বী), হেমচন্দ্রের অভিধান চিন্তামণি- এই প্রবন্ধগুলি ক্লাসিকস পড়া এবং আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসায় সহায়দ কিভাবে তার কথা আছে।
‘খোলা চোখে খোলা মনে’ (২০১৭) রচনার বিষয়বস্তু বিবিধ ও বিচিত্র। কিছু লেখা সাহিত্য সংস্কৃতি বলেই এখানে রাখা যাক।
যোগ একটি- খোলা চোখে খোলে মনে দেখা। বস্তুত: এটাই তাঁর যাবতীয় রচনার অন্যতম মূলসূত্র। এর কিছু কিছু কথা বলা যাক। একটি প্রবন্ধে পরিমল গোস্বামীর কথা দিয়ে জানানো হয়- ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভিতর হঠাৎ বাংলাদেশের জনসাধারণের বইপড়ার ইচ্ছাটা খুব বেড়ে যায়। নতুন নতুন বই প্রকাশের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়। (বাঙালির পড়াশোনা সেকাল একাল) ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে আভহে অপর্ণার সঙ্গে অপুর আলাপ করিয়ে দেয় অপুর বন্ধু পুলু। বিভূতিবাবু সে প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি উদ্ধৃতি দেন। নীরদ চৌধুরীও উৎস বলতে পারেননি। রামকৃষ্ণর বন্ধু স্বরূপ রায় খোঁজাখুজি করে জানান এটি J.C Snaith এর একটি উপন্যাসের ১৪ নং পরিচ্ছেদে ব্যাপারটা আছে। এ উদ্ধৃতি ছিল তাৎপর্যময়। ব্রেশট এর একটি বই (উদ্বাস্তু সংলাপ) এর পূর্বলেখ-এ উড হাউস এর উদ্ধৃতি আছের যা ব্রেশট অনুবাদক ফ্রাঙ্ক জেলিনেক জানিয়ে দেন (নাৎসিদের তাড়নায় উদ্বাস্তু জীবনের সারসত্য) শেক্স পিয়র পড়া নিয়ে ব্র্যাডলি ও মিউওর এর মনস্কতার ভিন্নতার কথা আলোচ্য হয়ে ওঠে। অন্য একটি লেখায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত একটি কবিতার বিদেশী মূল (রেক্সফোর্ড রচিত An Oversight at make- up নির্ণয় করেন। অন্যত্র আছে ফরাসি বিপ্লব বন্দনার গান। কবিতাটির জ্যোতিরিন্দ্রঠাকুর এবং সত্ত্যেন দত্তের অনুবাদের তুলনামূলক আলোচনা আছে। প্রাবন্ধিক দেখান বিষ্ণু দে অনূদিত ইয়েটস অনুবাদ আনে ‘এক বিশেষ ধরনের তৃপ্তি’। মুল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্যে সমুজ্জ্বল লেখাটি। টেরি ঈগলটব, বিশিষ্ট সমালোচক, তার যুক্তিবাদের নানান ধারার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেন অপর একটি রচনায়। অক্ষয় কুমার দত্ত বিরচিত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় কে নতুন করে পড়ার পরিচয় রাখেন একটি লেখায়। ভারতীয় ইতিহাসে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় কোথায় তা নির্নিত অন্য লেখায়। ‘গীতা’র মূল্যায়ন বিষয়ক দুটি প্রবন্ধ আছে। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি সামনে রেখে দেব ও পুরূশকার মত দ্বৈধতার কথা একটি লেখায়। তথ্য জানার অধিকার যে সরকারী উদারতার আমরা তা নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপস্থাপিত।
বঙ্গভঙ্গ: স্বদেশী: বিপ্লববাদ (২০১৬) ছোট বড়ো মিলিয়ে বাংলা ইংরেজিতে ২০টি প্রবন্ধ আছে। রচনাগুলির সংযোগ সূত্র বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫), বিদেশী পণ্যবর্জন ও স্বদেশীর সপক্ষে প্রচার অভিযান। পাশাপাশি জাতীয় বিপ্লববাদী গুপ্ত সমিতির কথা। স্বদেশী আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাবের একটি দিক- বাঙলা গদ্যের গণতন্ত্রীকরণ, গদ্যে রাজনীতির রঙ লাগা। মোহনবাগানের আই. এফ. এ শিলড জয় (১৯১১) যা খেলার মাঠ পেরিয়ে জুড়ে গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল- পুণের ‘দ্য মারাঠা’ পত্রিকায় প্রকাশিত স্বদেশী আন্দোলনের অভিঘাত মহারাষ্ট্রে। সোনার বাঙ্গলা ইস্তাহার, জাতীয়তা ও পুর্নজাতীয়তা কথা। বয়কট নিয়ে বাঙালী বুর্জোয়া দের মত, রাষ্ট্র নেশন বা ভদ্রলোক নিয়ে টুকরো কথা। স্বদেশী আন্দোলন (বাঙলায়) ও তার পুর্নবিচারের লেখকের অভিমত। স্বদেশী গান রচনায় মুসলমান তাঁতিদের ভূমিকা। রবীন্দ্র ভাবনার দূরদর্শিতা সম্পর্কে সুমিত সরকার বা বন্দেমাতরম গান দিকগুলোর কিছু অনালোচিত কথা ব্যঙ্গ। সাভারকর এর চেতনায়, একদা ছিল দেশপ্রেম, পরে তার ভাবান্তকরণ ঘটে।
লেখকের দর্শন তত্ত্ব বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই আছে। এগুলোর যথার্থ পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তবু চেষ্টা করি।
দর্শনের বর্ণপরিচয় (১ম) এবং ‘দর্শন পড়ার ভূমিকা’- এই দুটি ছোট্ট বই যথাসম্ভব সহজ করে বলা হয়েছে। দর্শন (অর্থাৎ দেখা) জগৎ ও জীবনকে নানাভাবে দেখা যায়। একটা মত বেছে নিতে হয়। দৈব বিশ্বাসী বলে কিছু না বুঝেই জীবন কাটানো যায়। সচেতনভাবে সঠিক দর্শন নিয়ে চললে অযথা হতাশ হতে হয় না, সুবিধাবাদ আঁকড়ে থাকতে হয় না। দর্শন এক নয় অনেক। তবে মোটামুটি দুটি ভাগ- বইস্তুবাদী ও ভাববাদী। বস্তু আগে চেতনা পরে, এই ধারণা হল- বস্তুবাদ। বস্তু ছাড়া ও চেতনা থ্যাকতে পারে এর নাম- ভাববাদ। আর দুয়ের মাঝামাঝি থাকার ধরণও আছে। বস্তুবাদের মূল সহায়- বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি) দুয়ের জানার ক্ষেত্র আলাদা নয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার করা তথ্যই বস্তুবাদকে শক্তিশালী করে। ধর্মমতের সঙ্গে যুক্তি ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ধর্মমত মানা বা না মানার প্রধান ভিত হল বিশ্বাস। বিজ্ঞান ও দর্শনকে নতুন নতুন প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়, ধর্মের সে দায় নেই। দর্শন শুধু দার্শনিক বা দর্শন ছাত্রের নয়, প্রতেক মানুষের জান্তে অজান্তে কোনো না কোনো দর্শন থাকে।
অন্যত্র বলছেন দার্শনিকরা মোটামুটি তিন প্রকার- বস্তুবাদী, ভাববাদী, এ দুয়ের মধ্যপন্থী। কিংবা অজ্ঞেয়বাদী। দর্শন পড়ার দুটি উদ্দেশ্য- দার্শনিকরা কে কী বলছেন তা জানা এবং নিজ জীবনকে একটা নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে চালাতে হলে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিজ দার্শনিক মত গড়ে তোলা। ভাববাদের অনেক শিবির। ভাববাদের বিবর্তন নেই। বস্তুবাদের বিকাশের তিনটি ধারা- প্রাচীন বা আদি বস্তুবাদ, যান্ত্রিক বস্তুবাদ (১৪৮ শতক), দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর একটা হল- লোকায়ত, চার্বাক, বার্হস্পত্য। অঙ্ক হবে বিজ্ঞানের প্রধান হাতিয়ার। বিজ্ঞান যত এগোবে ততই দেখা যাবে আর এক তর্কবিদ্যা- বিশেষ থেকে সাধারণ-এ যাওয়ার পদ্ধতি। এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, কার্যকারণ বার করার উপায়। ডায়লেকটিকস এর মূল সূত্রগুলো হল- সব কিছুই পরিবর্তনশীল, পরিমাণের দিক থেকে পরিবর্তন হতে হতে গুণের দিকেও পরিবর্তন হয়। একই জিনিসের ভেতর দুটো উলটো জিনিস কাজ করে। তাছাড়া- এক খারিজ হয়ে অন্য কিছু আসে, তবে তার নতুন চেহারা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ- বিশ্বদৃষ্টি। মানুষ যেহেতু সব কিছুর মাপকাঠি, তাই মানুষের সব রকম উন্নতিই (আর্থিক, সামাজিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক) তার একমাত্র লক্ষ্য। ধর্ম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতেও পারে (৫০ মন্বন্তরে ধর্ম প্রতিষ্ঠানের লঙ্গর খানা) একটা নিরিখ ভাববার- বড়লোক গরিব ফারাক ক্রমেই বাড়বে। সামাজিক অত্যাচার চলবে, এর মধ্যে দুর্গতি মানুষের কিছু উপকারে করা যায়। এ জন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠানে যাওয়া। অন্যদিকে সমাজ সংসারের অনাচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ব্রাহ্মণ্যবাদের বাইরে চালু- অনেক ধর্মমত, এরা মানুষকে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়। তবে গুরু নির্ভরতা।
তক্কাতক্কি নিয়ে একটা পুস্তিকা আছে। প্রথমে দরকার কান্ডজ্ঞান। গোড়ার কথায় একমত না হলে তক্কাতক্কি বৃথা। (…?) দু প্র৫কার- আকার গত, বস্তুগত। তাছাড়া আসে একাধিক অর্থে শব্দ ব্যবহারের দোষ অথবা কু পরামর্শ, বা অজ্ঞতার সুযোগ নেওয়া, কিংবা আপ্তবাক্য আওড়ানো বা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলা বা জোর খাটানো।
‘চার্বাক চর্চা’ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কাজ (২০১০) যা তিনি ইংরেজিতেও লেখেন এবং এই গবেষণার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পান। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৯৫, অধ্যায় সংখ্যা ৩৩, রামকৃষ্ণবাবু বলেন এই চার্বাক দর্শন যাবতীয় ধর্মের (বৈদিক ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন) বিরুদ্ধে লড়াই। চার্বাকরা লৌকিক অনুসারী, তবে অনুমানকে মানতে রাজি। চার্বাকদের লাগামছাড়া ইহ সুখবাদী বলে দেখানো হয়। এটি খুব প্রাচীন দর্শন। খ্রিস্ট পূর্ব ৫ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ১০ শতকের মধ্যে অজিত কেশকম্বলী (প্রথম বস্তুবাদী) ছাড়াও আরও পাঁচজন বস্তুবাদী দার্শনিকের নাম মেলে। এ ছিল আপসহীন অধর্মীয় ইহলোক সর্বস্ব দর্শন। দর্শন পড়লে মোক্ষ লাভ হবে এমন কথা তারা মানতে রাজি হন নি। প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের উৎসগুলির একটি কালপক্তি ও বর্ণ অনুযায়ী নামপক্তী আছে। এ সম্পর্কে জানার সবচেয়ে পরিচিত উৎস সায়ন মাধব এর- সর্বদর্শন সংগ্রহ। এ বইটি নিজ উদ্যোগে সম্পাদনা করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শেষ অধ্যায় দীর্ঘকাল পাওয়া যায় নি। তর্জমার দায়িত্ব নেন বিদ্যাসাগরের অনুরোধে জয়নারায়ণ তর্ক পঞ্চানন। চার্বাকদর্শন অধ্যায়ের প্রথম বাঙলা অনুবাদক সত্যব্রত সামত্রমী। পুরোবইটির মূলসমেত বাঙলা তর্জমা বার করেন মহেশচন্দ্র পাল, যার প্রথম বিস্তৃত আলোচনা রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৭৪-এ), পরে বিধুশেখর ভট্টাচার্য শাস্ত্রী ভূপেন্দ্রনাথ দে, দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্য শাস্ত্রী, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, মামোরু নামাই, গোপিনাথ কবিরাজ, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ক্ষেত্রেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পিজ্জা গল্লি, সুঅ্যালি, তুচ্চি, ইতবা কবি, হিল্লো ব্রাস্ট, রুবেন, ফ্রাউ ডালন প্রমুখ (চার্বাক দর্শনের ৫টি লক্ষণ বলা আছে পৃ। ৫০-৫২ তে। যথা- ভূতবাদ (মাটি, জল, আগুন, বাতাস এ চারটিই একমাত্র বাস্তব) স্বভাববাদ- বস্তুর নিজ স্বভাবকেই জগতের বৈচিত্র্যের কারণ ধরা হয়। প্রত্যক্ষ- প্রাধান্যবাদ (জ্ঞানের উৎস প্রাণীদেহের বাইরের কোনো বস্তুর সঙ্গে কোনো প্রাণীর ইন্দ্রিয়ের সংযোগ থেকে আসে নিশ্চিত জ্ঞান- পুনর্জন্ম ও পরলোক এ অস্বীকার বেদকে আপ্রামান্য মনে না করা ইত্যাদি। একটি অধ্যায়ে দেখান- ঋণং কৃত্যা ঘৃতং পিবেৎ- এটি চার্বাক পন্থীদের কথাই নয়, অপপ্রচার।
রামকৃষ্ণবাবু বস্তুবাদ, মার্কসবাদ, মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলাদা ভাবে কয়েকটি বই লিখেছেন। সেগুলোর পরিচয় দান আমার পক্ষে অনেকটাই কঠিন। তবি চেষ্টা করব। বস্তুবাদ জিজ্ঞাসা (২০১৩) বইতে তিনি জানান বস্তুবাদ বা মেটিরিয়ালিজম একটি নির্দ্দিষ্ট দার্শনিক মত, প্রকৃতি ও মানব সমাজকে বঝার এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। সুখবাদ (হেডনিজম) বা ভোগবাদ (কমিউমারিজম) এর সঙ্গে তার যোগ নেই। বস্তুবাদ আদর্শ বাদ নয়, যার উলটো পিঠে ভাববাদ। বস্তুবাদ খ্রি পূ ছ-পাঁচ শতক থেকে গ্রীস ও ভারতে তার সূচনা। ইউরোপে নবজাগরণ ও দীপায়ন এর পর্বে বস্তুবাদী দর্শ্নের কয়েকটি রূপান্তর দেখা দেয়। এ ধারাতেই উনিশ শতকে আসে মার্কসবাদ। বস্তুবাদ ও ভাববাদের মতই নানান দার্শনিকের হাতে নানা যুগে নানা রূপ পেয়েছে। গোড়া থেকেই সেটি খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন হয়ে দেখা দেয় নি, নিরীশ্বর বাদ ও ‘পুরনো বস্তুবাদ’ এর অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিল না। আলোচ্য হয়েছে কয়েকটি বিষয়। যেমন- মার্কস নিজে কি বস্তুবাদী ছিলেন, মার্কসবাদকে শুধু বস্তুবাদ না বলে তার আগে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বিশেষণ যুক্ত করা কেন। তাছাড়া হেগেলের দ্বান্দ্বিক ও মার্কস এর দ্বান্দ্বিক কি এক? ফয়ের বাঘ থেকে মার্কস কীসে আলাদা। দশটি অধ্যায়ে আছে দর্শন ও রাজনীতি, বুর্জোয়া বনাম সর্বহারা, পুরোনো ও নতুন বস্তুবাদ ইত্যাদি।
‘মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব’ (২০১৫) বইতে বলা হয় মার্কসবাদ শুধুই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদ নয়, এটি বিশ্ব (..?)। শিল্পসাহিত্যে বিষয়েও তার বিশিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। মার্কসীয় তত্ত্ব থেকেই এর সূত্র বার করা যাবে। বিশ শতর্কে মার্কসবাদ ও শিল্প সাহিত্য তার তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। শিল্পসাহিত্য কি নিছকই বাস্তব এর অনুকরণ? তাহলে কল্পনার ভূমিকা কি? পাঠক, দর্শক, শ্রোতা কিভাবে সাড়া দেন এক একটি বিশেষ শিল্প কর্মে। কালে কালে তারা ফারাক হয় কেন? এসব স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা এখানে আলোচিত।
‘মার্কসবাদ জিজ্ঞাসা’ (২০১৬) বইতে আলোচ্য- মার্কসবাদ বলতে কী বোঝায়? কাস্ট, হেগেল এর মতো এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রণালী গড়ে তোলার লক্ষ্য কি ছিল মার্কস ও এঙ্গেলস-এর। অথবা তারা চাইছিলেন এমন পদ্ধতি যা দিয়ে মানবসমাজ ও প্রকৃতির গতিধারা অনুধাবন করা যাবে। এ প্রশ্নর খেই ধরে এখানে আসে মার্কসীয় পদ্ধতির তাত্ত্বিক ভিত্তি, ইতিহাসের স্বরূপ এসব প্রসঙ্গ। মানুষের পরিচয় শ্রেণী পূর্বে এবং শ্রেণীহীন সমাজে কি একই ছিল বা থাকবে। তরুণ মার্কস ও পরিণত মার্কস কি দুটি আলাদা সত্তা। মার্কসবাদ এর মূল প্রকৃতি আশাবাদী না, নৈরাশ্যবাদী? সুখবাদ কি তার অঙ্গ। এসব জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজা হয়। পনেরটি অধ্যায় এবং পর্যালোচনায় বিন্যস্ত একই। মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ২ তে ( ২০২০) বইতে আলোচ্য হলো কথা ও কাহিনী, আত্মগত কবিতা, কমেডি, ট্র্যাজেডি, অন্যান্য গদ্যরচনার কথা। মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রর অভিনয়ের কথা ও এসেছে। প্রতিটি শিল্পরূপের ঐতিহাসিক বিকাশ আর উপস্থাপনার বৈচিত্র অনুধাবনের চেষ্টা এই পর্বের বিশেষত্ব। সময়-এর এক নান্দনিক যাত্রা ও আছে, জোর পড়েছে তার ওপরে। উপসংহার বাদে ৫টি অধ্যায়, এছাড়া সময় এর নান্দনিক যাত্রা, সময় সমাজ সাহিত্য নিয়ে দুটো পরিশিষ্ট আছে।
এঙ্গেলস, দুশ বছর পেরিয়ে (২০২১) সাম্প্রতিক কালের বই যাতে এঙ্গেলস মূল্যায়নে অগ্রসর হয়েছেন। ভূমিকাতেই বলে নেন, মার্কসীয় বিশ্ববীকার সম্পূর্ণতা এসেছিল তাঁরই হাত দিয়ে। মানব সমাজের পাশাপাশি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগ তাঁর অক্ষয় কীর্তি। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে তাঁর বিচার সঠিক দিকনির্দেশ করে। আধুনিক বাস্তববাদী সাহিত্য সম্পর্কে দুটি সমালোচনা মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের ভিত গড়ে দিয়েছিল। মার্কস এর কয়েকটি রচনার মরণোত্তর পুনর্মুদ্রণে তাঁর ভূমিকাগুলি মার্কসচর্চায় সমৃদ্ধ করেছে। শেষে আছে এঙ্গেলস সম্পর্কে লেনিন এর মূল্যায়ন। ১৫টি লেখার এ সংকলন বাংলা মার্কসচর্চার উল্লেখ্য সংযোজন।
২০১৪ তে তিনি সুশোভনচন্দ্র সরকার স্মারক বক্তৃতা দেন- নাম ‘ইতিহাস: দর্শন: দর্শনের ইতিহাস’ মূল প্রসঙ্গ ভারতীয় ইতিহাসের কাল পর্ব। তাঁর বক্তব্য- ইউরোপের ইতিহাসের ত্রিপর্ব- দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা (যা সুশোভন সরকার ও মানতেন) ভারতের ক্ষেত্রে সুপ্রোযোজ্য নয়। অন্যদিকে উপনিবেশ-পূর্ব আর ঔপনিবেশিক (মার্কসবাদী ও অন্য মতের অনুযায়ী- এ বি ভাড়া করলেও বিভ্রান্তি থাকে- উপনিবেশ পূর্ব ভারত বলতে সিন্ধুসভ্যতা থেকে গ্লোগল আমল সবটাই ধরা হবে? রাষ্ট্রীয়- অর্থনৈতিক ইতিহাসের ব্যাপারে যে ভিত্তিতে পর্বভাগ, সেই এক ছাঁচে ইমারত এর কোনো দিকের ইতিহাস লেখা যায় না। তাছাড়া ভ্যারতীয় দর্শন প্রস্থানগুলির দুটি স্পষ্ট ভাগ (জ্ঞান আর বিশ্বাস) করা অনুচিত। কারণ দার্শনিকদের আবির্ভাব কোন সময়ে হয়েছিল সকলের ক্ষেত্রে তার নির্দ্দিষ্ট প্রমাণ নেই। কাল পরম্পরা দেখেই বিষয়ের ইতিহাস লিখতে হয়। প্রতিটি দর্শন প্রস্থানের উদ্ভব ও বিকাশ আর একই সঙ্গে অন্য দর্শন প্রস্থানগুলির সঙ্গে প্রতিটি প্রস্থানের সঙ্ঘাত ও (…?) সম্পর্ক- সে পথেই দর্শনের ইতিহাস রচনা করতে হবে। প্রসঙ্গত: ভারত বিদ্যাচর্চায় জার্মানদের অবদান এবং এবং পরে জাপানে ভারতীয় দর্শন ইতিহাস কথা ও আলোচ্য। জাপানী রচনাতেও পর্বভাগ আলাদা আলাদা, আর্য অনার্য ঈশ্বরবাদী নিরীশ্বর বাদী ধারণার ছায়াও কোথাও কোথাও পড়েছে। এবং- সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ইতিহাস বলে কিছু হয় না, আবার সাপেক্ষ ইতিহাস ও সব মতের মানুষের গ্রাহ্য হবে না। অন্যদিকে কোসম্বী ও ইরফান হাবিবের বিভাজন ভিন্ন ভিন্ন যদিও দুজনেই মার্কসবাদী।
দুটি প্রবন্ধ সংকলন বেরিয়েছে ২০১৫ ও ২০১৯-এ। প্রথমটির সাড়ে তিনটি অংশের নাম- বিপ্লবের ভূত ভবিষ্যৎ, ইতিহাসই আমাদের ডাক পাঠাবে, এবং নন্দনতত্ত্ব এবং বিবিধ। রামকৃষ্ণবাবু প্রথম বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন- এ বইতে সাহিত্য বিষয়ক রচনা থাকলেও দেশের দশের নানা সমস্যা, অতীত ও বর্তমানের অনেক রকমের ঘটন অঘটন আলোচনায় এসেছে। কখনো নানা বয়েসীদের আলাপ, কয়েকটি প্রশ্নের মোকাবেলা। বিপ্লবের অব্যাহত পালা, সমাজবাদীদের সংকট-এ অবিচলিত থাকা, মূর্তি ভাঙা ও গড়া, লেনিন লুকাচ কাল্পনিক সংলাপ, সার্জ-এর ছেলে, গ্রাহাম গ্রীন এর একটি বই, ব্রেশট নিয়ে আগ্রহ। রাজনীতি ঘেঁটে গেলে কি করণীয়, ইতিহাসের ডাক, রামায়ণ নিয়ে নব বিচার, আনন্দ প্রসঙ্গে আগাস্টিন ও রবীন্দ্রনাথ, বাংলা প্রবাদে বৌদ্ধ স্মৃতিচিহ্ন, লেখা ছাপায় দুর্ঘট- কতো কি বিষয় নিয়ে যে তিনি ভেবেছেন ভেবে বিস্মিত হতে হয়। দ্বিতীয় বইটিতে আছে পড়া লেখার কয়েকটি সমস্যা, ভোট ও সংস্কৃতি, সুকুমার রায়ের প্রপ্সঙ্গ, চার্বাক দর্শন, কবিতা ও তার অনুবাদ, ন্যায় নীতির কথা, এবং কোপার্নিকান, বিনয় ঘোষ, সাঁওতাল বিদ্রোহ ইত্যাদি। কী পড়ব, কেন পড়ব, কত পড়ব- এ তাঁর নিরন্তর আলোচ্য। দুটি বইতেই সিরিয়াস নেস, গল্প করা, ধিক্কার ও ঠাট্টা বা ব্যঙ্গ রচনাগুলিকে পাঠককে শাণিত করে, আনন্দ দেয়, সদাজাগ্রত রাখতে উদ্বুদ্ধ করে।
‘নিজের মুখোমুখি’ (২০০৫) কাল্পনিক যুবক ও প্রৌঢ়র কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কয়েকটি কথা- সমাজ মনস্কদের আত্ম সমীক্ষণের আয়না- বইটি। ভালো কাজে আসছে সংশয়, বিভ্রম, হতাশা, অসহায়তা। একাকীত্ব, বিশ্বস্ত, ব্যক্তিমঙ্গলের নষ্ট হতে থাকা, ক্রমান্বয় অবিসাদ- কেন? রাজনৈতিক সামাজিক নৈতিক পরিমন্ডলের দোষ- কি না? সূচিপত্রের কয়েকটি ভাববার মতো- আত্মশয়ন, যৌথতার অভাব- ব্যক্তি আর সমষ্টি- ব্যক্তির সততা, শ্রেণীচ্যূত হওয়া না হওয়া, সমালোচনা আত্মসমালোচনা, পর-এর জন্য কাজ, সমাজসেবা কি অবিপ্লবী কাজ, বুদ্ধিজীবী হওয়া না হওয়া, জীবনে অবসরের দরকার, অবসাদ রোগের সমস্যা। সামগ্রিক কথা।
তাঁর প্রতিটি বইয়ের ভূমিকায় তিনি তার পাঠক কারা হতে পারেন ঠিক করে নিয়েছেন, ‘বইটি’ কি নিয়ে তা যথাসম্ভব স্পষ্ট করতে দিতে চেয়েছেন। পান্ডিত্যের কসরৎ দেখাতে চান নি। তাঁর বিপুল রচনার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে / হবে তারা দেখবেন প্রয়োজনে তিনি বিস্ময়কর তথ্য, তত্ত্ব, বিশ্লেষণের পাণ্ডিত্যকে ব্যবহার করেছেন। বিষয় যাই হোক উপরোক্ত পদ্ধতিতে তিনি উৎসের তার সাল তারিখের পৃষ্ঠার উল্লেখ করেছেন যেটা অনেক পন্ডিতের লেখাতে মেলে না আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা, উত্তর ঔপনিবেশিকতা, সাংস্কৃতিক তত্ত্বায়ন প্রভৃতি হাল ফ্যাশনের তিনি ছিলেন তীব্র বিরোধী। এ সব পন্ডিতিবাজি যে আশির দশকে আমদানি সেকথা বারংবার বলেছেন। প্রাচ্য প্রতীচ্য তত্ত্ব তথ্যে ছিল তাঁর বিপুল দহিকার, যে অধিকারের সমতুল্য আলোচক চোখে পড়ে না। ডকুমেন্টশনের স্ততা অনেক পন্ডিতের নেই। আবার প্রচল কথা বা লোকশ্রুতি নির্ভরতা তিনি পছন্দ করেন না। ‘আমার লেখায় টিকা / সূত্রনির্দেশ / রচনাপঞ্জির বহগর বড্ড বেশী’। ধার পাশের পড়ুয়ারা বলে থাকেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তার কথা প্রতিটি সিদ্ধান্তের পিছনে কার্যকরী যা তিনি স্পষ্ট করে বলে দিতে চান। প্রাপ্ত তত্ত্ব ও তথ্যের পুনর্বিচার করেন আর বলেন- ‘কোনো বক্তব্যর প্রতিবাদ করতে গেলে সেটি সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়াশুনো করতে হয়। তার সবটা সেই মুহূর্তে কাজে লাগে না। কিন্তু নিজের ধারণা আগের চেয়ে পরিষ্কার হয়, পরে বেশ কাজে দেয়’। তাছাড়া প্রতিবাদী হওয়া মানে নেতিবাচক ভূমিকায় থাকা, কিন্তু তার থেকেই বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক কিছু করার ইচ্ছে জাগে’।
তাঁর বিপুল রচনাবলী উল্টেপাল্টে দেখলে বোঝা যায়- তত্ত্বে ও তথ্যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের তাঁর বিপুল অধিকার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের দিকে সমদৃষ্টি কার্যকরী দৃষ্টি সচরাচর দেখা যায় না।
যাবতীয় দুর্যোগের মধ্যে একদল আছেন যারা কতোটা প্রগতিমনস্ক দেখাতে চান, কতোটা মার্কসবাদ আয়ত্ত করেছেন তা জানাতে চান, কোনো একটা বামপন্থী পার্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাতার তলায় দাঁড়াতে চান। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তা করতে চান না। নানা সঙ্গত অসঙ্গইত কারণে লেখক যে একজন ‘মার্কসবাদী’ একথা চেপে রাখাটাই পছন্দ করেন। যেটুকু তাঁর লেখা পড়েছি তাতে তিনি অন্তত: ২ বার বলেন- তিনি একজন ‘অনুতাপহীন, আপসহীন, মার্কসবাদী। দুর্যোগের কয়েক দশকে অব্যাহত ছিল চর্চা তা লালিত সংস্কার, ভুলে যাওয়া বরেণ্য, সাহিত্য সংস্কৃতির ভ্রান্তি, দর্শন চর্চা। যারা রামকৃষ্ণের অনেকগুলি বই পড়েছেন তাদের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। তিনি অবিচলিত মার্কসবাদী, তবে পার্টিতন্ত্রী নন। তাঁর রচনারীতির অনেক বৈচিত্র্য আছে, অনেক টেকনিক আছে, পরিহাস ব্যঙ্গ, মজা আছে। তিনি আগ্রহী পাঠকের বন্ধু, প্রিয়জন, কাছের মানুষ। তাঁর লেখার মধ্যে দুরূহ বিষয় যেমন আলোচ্য হয়, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় ও সমান গুরুত্ব পায়। ইংরেজির সুখ্যাত অধ্যাপক হয়েও বাংলা বা অন্য সংস্কৃতির বিষয় নিয়ে মনোযোগ দেখিয়েছেন যথেষ্ট। তিনি পলেমিকস যোদ্ধা আর তার লেখায় অনেক অনেক অনেক মৌলিক কথাবার্ত্তা আছে। বাংলা এবং ইংরেজি দুটি ভাষাতেই লিখেছেন অজস্র। তার একাংশ মাত্র গ্রন্থর্ভুক্ত হয়েছে। অকৃতদার মানুষ্টি সকাল সন্ধে রাত্রে নিতান্ত সাধারণ জীবনে, কৃচ্ছ পালনে, ট্যুইনান বিহীন জীবন যাপনে পথ চলেছেন, আশার আলো ছড়াতে ছড়াতে পথ চলেছেন। এসব কথা ভাবলে রাগ হয়, চোখে জল আসে, নিজেদের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতায় নিরন্তর কুন্ঠিত হতে হয়।