উবার অর্ধেক পথও আসেনি এমন সময়ে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সাক্ষাৎ কনেরই নম্বর। অত্রি একটু চিন্তাতেই পড়ে গেল।
এই তো বেরলাম এরই মধ্যে আবার কি হল?
“কিরে, বিয়ের আগের রাতে এক্স-বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করছিস, বর জানতে পারলে কি বলবে?”
“বিয়েটা করলে তবে তো বর হবে।”
অত্রি মুচকি হাসে।
“মানে? তোর কি এখন ডাউট হচ্ছে?”
মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। সুরঞ্জনার গলা গাঢ় হয়ে আসে।
“যদি বলি ডাউট হচ্ছে? যদি বলি তোর বাইকটা নিয়ে চলে আয়, দু'জনে এই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাব?”
অত্রির বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সেই ষোল বছর বয়স থেকে দু'জনের মধ্যে এই খেলা চলছে। সুরঞ্জনা সাফ বলে দিয়েছিল, চার চাকাওয়ালা কাউকে পেলে তবেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু নিজের দু চাকাকে চার চাকা করার ধান্ধা অত্রির কোনদিনই ছিল না। তাদের জীবনের পথ শুরু থেকেই আলাদা। তাই মনের কথা মনে রেখে দেওয়াই ভালো। ভাঙবে না কেউই। কিন্তু মস্করা চলতে থাকে।
“সাহস থাকলে বলে দ্যাখ, এক্ষুনি বাইক নিয়ে তোর বাড়ির নীচে চলে আসব। কিন্তু তারপর সামলাতে পারবি তো?”
“তুই সত্যি আমার সঙ্গে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাবি? আজ অবধি আই লাভ ইউ বলার সাহস হল না, পালাবার সাহস হবে তোর?”
অত্রি ফোনটা অন্য কানে চালান করে দিল।
“তোকে আই লাভ ইউ কেন বলব? আমার কিছু স্ট্যান্ডার্ড আছে। একদম হট সুপারমডেল ছাড়া আমি ডেট করি না!”
“আর আমিও ভাঙা বাইকে উঠি না। চার চাকার গাড়ি আনতে পারলে কথা বলিস!”
অত্রি হেসে ওঠে। হাসে সুরঞ্জনাও। হাসির আড়ালেই অদৃশ্য কালিতে লেখা গল্প হারিয়ে যায়।
“ঘুমিয়ে পড়। কাল ভোরে তোদের কিসব আচারবিচার আছে না?”
“হ্যাঁ, শাঁখা-পলা পরে একদম বউ হয়ে যাব। এসে দেখিস। গুড নাইট।”
ফোনটা কাটার পর অত্রি গাড়ির সীটে মাথা হেলিয়ে 'হাস্যরসিক বন্ধু'র মুখোশটা খুলে রাখল। কাল সকালের আগে আর ওটার দরকার হবে না।
সুরঞ্জনা...
অত্রির জীবনের এক অসমাপ্ত অধ্যায়।
কারণ বাবার চাপ খেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে আর পাঁচজনের মতো চাকরি না খুঁজে অত্রি ঠিক করেছিল আর্টিস্ট হবে। ইনস্পিরেশন হাতের কাছেই ছিল – তারই কলেজের সিনিয়র প্রতীক মিশ্র ওরফে প্রতীকদা। আই বি এমের ভালো চাকরি ছেড়ে হঠাৎই এক সকালে ঠিক করলেন কবি হবেন। তারপর চলতে লাগল মদ-গাঁজা সেবন আর কাব্যচর্চা।
প্রতীকদার মতো অত্রি অবশ্য মদ-গাঁজা থেকে প্রেরণা নিতে পছন্দ করে না। তার প্রেরণারা আসে গভীর রাতে, যখন গোটা শহরটা ঘুমের চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকে। তখন পূর্ণিমার চাঁদের আলো সাদা মার্বেলের মতো তার মুখের উপর এসে পড়ে, আর বাগানে টুপ টুপ করে শিউলি ফুল ঝরার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়...
চাঁদের আলো অত্রিকে যে কত কথা বলে যায়...অত্রি পড়েছে কবি মীরের জীবনেও চাঁদের আলোর গভীর প্রভাব ছিল। অবশ্য তা বলে অত্রি মীরের মতো শিকল-বাঁধা হয়ে থাকতে চায় না।
শরতের সেইসব রাতে অত্রি ইজেলটা বার করে রং তুলি নিয়ে বসে। নিজের মনের ভাব ক্যানভাসে উজাড় করে দেয়। তা না হলে মনের মধ্যে কোথাও একটা খালি গর্ত থেকে যায়। বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে যায়।
“ধুর, ভালো লাগে না...এবার আত্মহত্যাই করব।”
ঝড়বৃষ্টির এক রাত। প্রতীকদার বাড়িতে আসর বসেছে। জাম্ব প্রশ্ন তুলেছিল, “আচ্ছা কেউ বলতে পার, আসলে আমি কে?”
জয়েন্টে একটা লম্বা টান দিয়ে আধবোজা চোখে প্রতীকদা বলছিলেন,
“পুছতে হ্যায় উও কে গালিব কউন হ্যায়। কোই বতলাও কে হম বতায়ে ক্যা..”
ওই প্রতীকদার ভাসাভাসা উত্তর শুনেই মাথা গরম করে অত্রি আত্মহত্যার কথাটা বলেছিল।
মিনিট খানেকের নিস্তব্ধতা। ধোঁয়ার চোটে সারা ঘরে নীলচে আভা। শেষে প্রতীকদা জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল -
“আত্মহত্যা বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছিস?”
“মানে?” অত্রি খিঁচিয়ে উঠেছিল। “হয় হাত কাটব নয় পাখা থেকে ঝুলে পড়ব নয় ইঁদুরের বিষ খাব... যা লোকজন করে থাকে তাই করব।”
“বেশ,” আরেক লম্বা টান। “তার মানে তুই বলছিস তোর শরীরটাকে মেরে দিলেই তোকে মেরে দেওয়া হল। শরীরের বাইরে তুই কোথাও নেই।”
“তো আবার আমি কোথায় আছি?”
“মানে কাল যদি একটা ভিন্ন গ্রহের জীব এসে তোর শরীরে বাসা করে তোর স্মৃতি, চিন্তা, প্রতিক্রিয়া সব পালটে দেয় তাহলেও তুই তুইই থাকবি, কারণ শরীরটা তোর। এটাই বলছিস তো?”
অত্রি ভুরু কুঁচকেছিল। এসব কি ধরনের ঘেঁটে দেওয়া প্রশ্ন? কেউ যদি অত্রির শরীরে ঢুকে সব খোলনলচে বদলে দেয় তবে অত্রি আর অত্রি কোথায় রইল?
“যত্তসব তোমার আজগুবি কথা!”
“আর তুই যদি বলিস যে তুই তোর মস্তিষ্ক, চিন্তা, স্মৃতি, প্রতিক্রিয়া – এইসব, তবে তো আত্মহত্যা করার জন্য তোকে ব্রেন সার্জারি করতে হবে। জাম্ব তুইও শোন, তোর প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।”
“হুঁ:!”
“নাকি তুই কিছু বিশ্বাস, স্বভাব, বৈশিষ্ট্য আর ব্যবহারের সমষ্টি? সে ক্ষেত্রে তুই মরে গেলেও সেই সব বিশ্বাস, স্বভাব, বৈশিষ্ট্য বা ব্যবহার পৃথিবীতে থেকেই যাবে। তাহলে তুই বুঝবি কি করে যে তুই সাক্সেসফুলি আত্মহত্যাটা করতে পেরেছিস?”
না:, প্রতীকদার সঙ্গে আলোচনা করাটাই বেকার। তবে কথাটা অত্রিকে ভাবিয়েছিল। সত্যিই তো, 'অত্রি' বলে যে সত্তাটা পৃথিবীতে ঘুরে বেরাচ্ছে তার অস্তিত্বের মূল কোথায়?
এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি এসে গেছে। উবারের ভাড়া চুকিয়ে 'ভালো ছেলে'র মুখোশ লাগিয়ে বাড়ি ঢুকে অত্রি দেখে মা-বাবা খেতে বসছে। সে-ও কথা না বাড়িয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসে পড়ল। রাতের মেনু রুটি আর ডাল, আর মাংসটা দেখে মনে হচ্ছে মা করেছে।
“মজা হল?”
মা খাবার বাড়তে বাড়তে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ ওই মজাই করুক,” বাবা ইদানীং অত্রির উপর সব সময়েই ক্ষেপে থাকে। “নিজের তো আর টোপর পরার সামর্থ্য হবে না কোনদিন, ওই লোকের বিয়েতেই নাচুক।”
“কেন সামর্থ্য হবে না?” মা প্রতিবাদ করে ওঠে। “একটা চাকরি জোগাড় করলেই হবে।”
“মা তুমি জান আমি সেটা করব না, এই নিয়ে তো কতবার কথা হয়েছে,” (মা কি সত্যিই অত্রিকে সাপোর্ট করছে না মা-বাবা দুজনে মিলে স্কিটটা আগে থেকে তৈরি করে রেখেছে?) “ওই সকাল ন'টা থেকে রাত দশটা অবধি চাকরি করা আমার পোষাবে না। ইট ইজ নট হু আই অ্যাম!”
“দেন হু আর ইউ, প্রে টেল আস।”
অত্রি কাঁধ ঝাঁকায়।
“আমিও এই কথাটাই ভেবে চলেছি। তোমার কাছে কোন জবাব আছে?” “আছে। কান খুলে শোন। তুমি হিমাংশু চ্যাটার্জি বলে এক প্রাক্তন সরকারি কর্মচারীর একমাত্র ছেলে। তোমার তিন কুলে টাটা বিড়লা আম্বানি বলে কেউ নেই। কাজেই নিজের অস্তিত্ব খোঁজার যে খেলাটা তুমি খেলছ সেটা শুধুই বিলাসিতা, যা করার মতো অবসর বা অবস্থান কোনটাই তোমার নেই।”
“মা শুরুতেই বলেছিল, ঋষি মুনিদের নামে ছেলের নাম না রাখতে, তোমরা শুনলে কই?”
(ঠাকুমা থেকে শুরু করে সিংহভাগ শ্বশুরবাড়ির লোক লোকান্তরে পাড়ি দিয়েছে তবুও মায়ের 'আমরা' আর 'তোমরা' যায় না।)
“আরে রাখো তোমার ঋষি আর মুনি!” বাবার কাছেও অ্যামিউনিশন রেডি। “আমাদের ব্যাচের দত্তাত্রেয়, ভার্গব বিদেশে বসে কোটিতে কামাচ্ছে, কপিলদেব বিশ্বকাপ নিয়ে এল, আর আমার ন্যাকা ছেলে দাড়ি লাগিয়ে হিমালয়ে যাচ্ছেন! যাই হোক, কাল বিয়েবাড়ি যাবে ভালো একটা শেরওয়ানি টেরওয়ানি পরে যেয়ো। আর ওই বাইক নিয়ে যেতে হবে না, আমি গাড়ি ভাড়া করে দেব।”
বাবার বকার থেকেও ভালোবাসাটা অত্রিকে আরো সংকুচিত করে দেয়। মনের মধ্যে অপরাধবোধ জমা হয়।
“নিজের গাড়িটা কিনতে পারলে আর ভাড়া গাড়ি করে যেতে হত না,” শেষ বাণটা মেরে বাবা মনের আনন্দে হাড় চিবোতে লাগল। অত্রি বুঝতে পারে না কি করবে। রাগ করে টেবিল থেকে উঠে যাওয়াই উচিত কিন্তু মাংসটা খুবই ভালো হয়েছে। শেষটায় সুরুত করে ঝোলটা চুমুক দিয়ে খেয়ে প্রতিবাদস্বরূপ বাবার মিনিট দেড়েক আগে অনাবশ্যক জোরে হাওয়াই চপ্পলের আওয়াজ করতে করতে উঠে গেল সে।
খেয়ে উঠে অত্রি ওদের ছোট্ট বারান্দাটায় চলে গেল। হয়তো খোলা হাওয়া পেলে মাথাটা একটু ছাড়বে। বাবার বলা কথাগুলো সমানে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আর রাগ হচ্ছে। বাবা-মা কেউ অত্রিকে বোঝে না। সবার জীবনে রুটি আর চিকেন জোগাড় করাটাই সব হয় না। তার বাইরে একটা বৃহত্তর অস্তিত্ব, জীবনের একটা উদ্দেশ্য বলেও কিছু থাকে। এই বয়সে এসেও যদি এরা সেটা না বোঝে তাহলে সেটা ভারি দুঃখের কথা।
না কি আজ অত্রির পালা আসছে বলে সে এত চিন্তা করছে? দু'দিন আগে অবধিও বাবা-মায়ের দেওয়া খাবার খাওয়ার সময়ে সে কি এত ভেবে দেখেছে? যারা সেই খাবার জোগাড় করে এনেছে সেই মানুষগুলো কারা, তাদের প্রকৃত পরিচয় কি, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে? প্লেটের উপর রুটি আর চিকেন এসে পড়লেই হল। সেটা কে দিচ্ছে তার মুখ, বা সেই মুখের পিছনে থাকা অনেকগুলো মুখ চিকেনের পিসের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে।
হয়তো অত্রি ভুলই করছে। নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ানোর চক্করে জীবনটাই হয়তো তার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আজকের সমাজে বাঁচতে গেলে হয়তো মাটির ভিতর শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোন দৃঢ় অস্তিত্ব খুঁজতে যাওয়াটাই বোকামি। চারিদিকে ভাসতে থাকা টুকরো টুকরো অস্তিত্বের খোলসগুলোর কোন একটা গায়ে জড়িয়ে নিলেই হল। তারপর দু'দিন বাদে সেটা ছেড়ে আরেকটা জড়িয়ে নাও। শুধু পরা আর ছাড়া, পরা আর ছাড়া। এই ভাবেই হয়তো জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে।
আচমকা কাঁধের উপর বাবার হাত এসে পড়াতে প্রায় কেঁপে উঠল অত্রি। নিজের মনের এত গভীরে ঢুকে গেছিল সে, যে বাবা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করতে পারেনি। এই জন্যেই, ছোটবেলায় শখ থাকলেও সে কোনদিনও ভালো গোয়েন্দা হতে পারত না।
“আমার কথাগুলো শুনে মন খারাপ হয়ে গেল?” বাবার গলা আবার মোলায়েম হয়ে গেছে। “তোর টাকায় ফুর্তি করার আশায় আমরা কথাগুলো বলিনি। আমার পেনসন আছে, তোর মায়ের পেনসন আছে। তুই এক পয়সা না দিলেও আমাদের দিব্যি চলে যাবে। বরং ইনভেস্টমেন্ট যা রেখে যাব তোর একার সারা জীবন চলে যাবে।”
ঠাকুমার বসার মোড়াটা আজও বারান্দার এক কোণে রাখা আছে। বাবা বসাতে সেটা মড়মড় করে প্রতিবাদ করে উঠল।
“আমি ভাবি তোর কথা। সারা জীবন চাকরি করবি না, বিয়ে করে সংসার করবি না, ছেলেপুলে হবে না, সেটা কেমন জীবন? ছবি কি চাকরি করে আঁকা যায় না? তোর ছবি কোথাও বিক্রি হবে কি না, তা থেকে টাকা পাবি কি না, তার তো কোন গ্যারান্টি নেই।”
আবার অত্রির রাগ হতে শুরু করেছে।
“না বিক্রি হলে না হবে, তা বলে যেটা করতে আমি মন থেকে কোন সায় পাই না সেটা করে জীবন নষ্ট করতে পারব না!”
“কোনটা করে জীবন নষ্ট হচ্ছে সেটা যত তারাতাড়ি বুঝতে পারবে তত তোমারই লাভ হবে।”
অত্রি আর কথা বাড়ায় না।
রাত দুটো বাজে।
বাবা অনেকক্ষণ শুতে চলে গেছে। 'বিদ্রোহী শিল্পী'র মুখোশটা আর পরে থাকার কোন মানে হয় না। বিছানায় শুয়ে অত্রি ভাবে, সত্যিই কি সে জেদ করে নিজের জীবনটা নষ্ট করছে? খেলার মাঠে ব্যাটিং করতে না নেমে সারা জীবন গ্যালারিতে বসে দর্শকের ভূমিকা পালন করার সিদ্ধান্ত কি ঠিক নয়? কিন্তু দেখ, যারা মাঠে খেলতে নেমেছে তাদের কত বর্মচর্ম পরে থাকতে হয়। ওই যে হেলমেট, ওই প্যাডিং, এই গার্ড ওই গার্ড...অত্রি খেলতেও নামছে না তাই ওর অত বর্ম-কবচেরও প্রয়োজন নেই। যেমনি আছে তেমনিভাবে ওর সবটুকু দিয়ে জীবনকে গ্রহণ করতে পারছে। তাহলে ঠিক কোনটা? আর কোনটাই বা ভুল?
বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে অত্রি। মার্চ মাস না পড়লেও গরম যথেষ্ট। কিন্তু সেটা ছাপিয়েও কি যেন একটা অস্বস্তি ওকে ঘুমতে দিচ্ছে না। কি যেন ওর সর্বাঙ্গ চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অস্তিত্বের সংকট ওকে ঘিরে ধরেছে, অসংখ্য মুখোশের মাঝখানে যেন ওর আসল চেহারাটাই হারিয়ে গেছে।
হঠাৎই চোখ পড়ে যায় ঘরের দেওয়ালে টাঙানো 'শরতের বাগান'এর দিকে। অত্রির আঁকা প্রথম ছবি। অত্রি তখন ক্লাস ইলেভেন-এ পড়ে। সেই প্রথম শরতের পূর্ণিমা তার কানে কানে কথা বলেছিল।
না!
না, অত্রি হারিয়ে যায়নি। সে আছে। সে ভুলভাল ঠিকানায় নিজেকে খুঁজে চলেছে। তার অস্তিত্ব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে – অসংখ্য ক্যানভাস আর তুলির টানে, তার আঁকা এক-একটা ছবির ভেতরে। বিক্রি হোক আর না-ই হোক, তার আঁকা ছবিগুলো তারই সত্তার বহিঃপ্রকাশ। অত্রির অস্তিত্বের মূল সেখানেই খুঁজতে হবে।
কি এক খেয়ালে ইজেলটা টেনে নিল অত্রি। তারপর দুর্বার গতিতে সাদা কাগজে রং ভরতে থাকল।
এক এক করে সব সংশয় দূরে চলে যায়। মা, বাবা, সুরঞ্জনা, প্রতীকদা – সবাই অলীক কল্পনা হয়ে যায়। রুটি আর মাংসের জগৎ মিথ্যে হয়ে গিয়ে দক্ষ তুলির টানে ক্যানভাসের উপর জেগে ওঠে এক নতুন অণুপৃথিবী। সেই পৃথিবী অত্রির নিয়মে চলে। সেই সময়ে মার্বেলের মতো সাদা চাঁদের আলোয় অত্রির মুখ গলে গিয়ে শুধুই এক স্রষ্টার মুখ পড়ে থাকে। ক্রমান্বয়ে সেই মুখে ফুটে ওঠে সৃষ্টিকর্তার অহংকার, উল্লাস, মমতা, করুণা।
নিজেরই সৃষ্টির মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকা সেই মুখে এক মুহূর্তের জন্য যেন বিশ্বস্রষ্টার আদল নেমে আসে।