অংকের স্যারের কথা শুনে ক্লাসের পেছনের সারি থেকে হাসির রোল উঠল।
--চুপ চুপ। স্যার গর্জে উঠলেন। --ওর তো কিছু একটায় ভালো-লাগা আছে। তোরা তো কোন কর্মের না। সারাদিন শুধু টো-টো করে ঘুরে বেড়াস। চুপ করে অংক কর।
সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস চুপ হয়ে গেল।
অমলের গাছের ওপর ভালোবাসা দেখে অংকের স্যার ওকে অমলতাস বলে ডাকেন। তাতে অমলের এতটুকুনি রাগ হয় না, বরং ভালই লাগে। কী সুন্দর হলদে ফুলে ভরে থাকে অমলতাস। সোনালি হলদে রং অমলের ভীষণ প্রিয়। তার ওপর অমলতাস নামটার সঙ্গে ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দাদুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিছুটা আনন্দ; অনেকটা বেদনা।
গ্রীষ্মের দুপুরে অমলতাসের ফুলগুলো আকাশে হলুদ আভা ছড়িয়ে দেয়। চারদিকটা কেমন উজ্জ্বল লাগে তখন! অমলের মনে হয় দাদু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। সেই হাসি ওকে অভয় দেয়। সাহস জোগায়।
অমলদের বাড়িটা মফঃস্বল শহরে। শহর আর গ্রাম দুটোর আস্বাদই এই শহরগুলোতে পাওয়া যায়। ওদের বাড়ির পেছনে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে একটা বাগান। ওখানে আছে একটা বিশাল পুকুর আর ছোট-বড় প্রচুর গাছ। ওর দাদু খুব যত্ন করে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। ফল গাছ, ফুল গাছ-- কী নেই বাগানে! সারা বছর ধরে কোন-না-কোন গাছে ফল ধরছে বা ফুল ফুটছে। অমলের মনটা তাই সবসময় আনন্দে ভরে থাকে।
অমল যখন সবে হাঁটতে শিখেছে তখন থেকে ওর দাদু সকাল-বিকেল ওকে নিয়ে বাগানে বেড়াতেন। ফল ফুল পাতা পাখি চেনাতেন। তারপর যখন হাইস্কুলে ভর্তি হল তখন থেকে শুরু হল প্রকৃত চেনা। দাদু বলতেন—দাদুভাই, গাছকে ভালবাসতে শেখো। তুমি অল্প ভালবাসলে গাছ তোমাকে শতগুণ ফিরিয়ে দেবে। মানুষের প্রকৃত বন্ধু হল গাছ। তুমি তো জান, প্রাণীমাত্রেই শ্বাসপ্রশ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ করে আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছ বাতাসে অক্সিজেন ভরে ভরে দেয়। শুধু তাই নয়, গাছ বাতাস থেকে ওর খাবার বানানোর জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে নেয়।
--গাছ খাবার বানায়! অমল অবাক।
--হুঁ। বানায় তো। এই যে তুমি ফল খাও সব্জি খাও। এ সবই তো গাছ নিজে বানায়। তাহলে গাছ কী খায়? আমরা যা খাই তা সবই উদ্বৃত্ত। এ সবই তুমি বড় হলে বিজ্ঞানের বইতে পড়বে।
দাদু অমলকে নিয়ে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলতেন, দাদুভাই, কান পাতো। গাছের আওয়াজ শুনতে পাবে।
--কিছু শুনতে পাচ্ছি না তো!
--ধীরে ধীরে পাবে। প্রাণের শব্দ। গাছকে ভালবাসলে এই শব্দ শোনা যায়। সবাই এই শব্দ শুনতে পায় না, আর পেলেও মানে বোঝে না।
প্রাণের শব্দ! কথাটা অমলের মনে একটা ঢেউ তোলে।
--দাদু, গাছেদের কী প্রাণ আছে?
--অবশ্যই। গাছেদের যে প্রাণ আছে তা আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস প্রমাণ করে গেছেন।
--দাদু, আমরা, মানে আমাদের যাদের প্রাণ আছে সবাই তো চলে ফিরে বেড়াতে পারি; কিন্তু গাছ তো পারে না।
দাদু বলেন, আমার মনে হয়, গাছ যেহেতু মাটি থেকে জল শুষে নিয়ে খাবার বানায় তাই প্রকৃতির এই ব্যবস্থা।
অমল সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ওর মনে হোল এ যেন আরেকটা জগতের দরজা তার সামনে একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। অনেক, অনেক কিছু ওকে জানতে হবে। সবচেয়ে আগে জানতে হবে গাছেদের ভাষা।
স্কুলের পড়ার সাথে সাথে চলল এ আর এক অনুশীলন। হৃদয় দিয়ে পড়া। একদিন সত্যিই অমল গাছেদের ভাষা আন্দাজ করতে পারল। তারপর বুঝতেও লাগল। এতে অমলের এত আনন্দ হল যা কিছুতেই হয় না। সবচাইতে কাছের বন্ধুর ভাষা এখন সে বুঝতে পারছে!
একদিন দাদু জিজ্ঞেস করলেন, দাদুভাই, গাছের কথা কিছু বুঝতে পারছ? রোজ দেখছি তুমি গাছের গায়ে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।
--হুঁ। গাছ আমাকে অনেক কিছু বলে।
--আমাকেও একটু শোনাও।
--তারা আমাকে ঋতু চেনায়। প্রতিটা ঋতুর আগে তারা যেভাবে প্রস্তুতি নেয় সেই ব্যাপারেও বলে। দাদু, গাছ অনেক পরিশ্রম করে। আমরা তো বাজারে গিয়ে খাবার কিনে নিয়ে চলে আসি। কিন্তু গাছের তো সেই উপায় নেই। দাদুভাই, এই যে আমরা বাজারে গিয়ে খাবার কিনি সেটাও গাছ থেকে পাওয়া। আমরা যে মাংস খাই তাও পরোক্ষভাবে গাছ থেকেই পাওয়া।
অমল বলেই চলে, জানো দাদু, ওদের অনেক কষ্ট। পরিবেশ দূষণ ওদের পরিশ্রম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা প্রাণীদের ওপর দূষণের প্রভাব দেখে খুব চিন্তিত। একদিন আমাকে বলছিল চড়াই পাখির কথা। টুনটুনি পাখির কথা। ওদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। টুনটুনি আর ছোট ছোট গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায় না। চড়াই আর আকাশের দিকে মুখ তুলে বাগানের ধুলোমাটিতে চান করে না। দাদু কেন এমন হয়?
--দূষণের খারাপ প্রভাব! এই পাখিরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে পারছে না।
--দাদু দূষণ কেন হয়?
--অনেক কারণে হয়। কল কারাখানার থেকে দূষণ ছড়ায়। মোবাইলের ওয়েভ থেকে দূষণ ছড়ায়। বড় হতে হতে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সব জানতে পারবে।
অমল নিজের মনে বলে, আমাকে জানতে হবে। কেন দূষণ? কেন গাছেদের এত কষ্ট? এরকম অনেক কিছু।
অমল লক্ষ করেছে ক’দিন ধরে দাদু আর হেঁটে চলে বেড়াতে পারেন না। বাগানে যাবার মত শক্তিও নেই।
অমলের মনে খুব কষ্ট হয় দাদুর জন্যে। যখন বেশি কষ্ট হয় গাছেদের সাথে তা ভাগ করে নেয়।
তারা সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অমল বলে, দাদু, তোমার কী হয়েছে?
--বয়স হয়েছে দাদুভাই। বয়স হয়েছে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষয় হচ্ছে। তাই চলতে কষ্ট হয়।
অমলের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে। কারণ দাদুর সমস্যার সমাধান ওর জানা নেই।
অমল একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরের লোকজনেরা ছোটাছুটি করছে। দাদুর খাটের পাশে চেয়ারে ডাক্তার বসে আছেন। অমল চিনতে পেরেছে উনি গোরার বাবা। দুটো বাড়ি পরেই থাকেন। বাবা, মা, কাকু, কাকিমা সবাই দাদুর খাটের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। দাদুর চোখ বোজা।
অমল দেখতে পেল, ডাক্তারের এক হাত দাদুর বাঁ-হাতে টিপে কী জানি খুঁজছে। একটু পরই দাদুর হাতটা বুকের ওপর রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি দুঃখিত। আমার কিছুই করার নেই। উনি চিরস্থায়ী ঘুমের দেশে চলে গিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অমল হতভম্ব। চিরস্থায়ী ঘুমের দেশ মানে? দাদু কি তাহলে কোনদিন ঘুম থেকে উঠবে না? অমলের ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। সেটা বুকের ভেতর না মাথার ভেতর ও ঠিক বুঝতে পারল না।
কিছুক্ষণ পর সবাই যখন একটু চুপ করে বসে আছে তখন অমলের বাবা বললেন, বাবাকে একটু বাগানে নিয়ে যাই। ওটাই তো ছিল ওঁর প্রাণের জায়গা। এবার অমলের দিকে তাকিয়ে জিজেস করলেন, দাদুর কোন গাছটা সবচেয়ে প্রিয় ছিল অমল?
--সব গাছই।
--না... মানে কোন গাছের নীচে বেশিক্ষণ বসতে বা দাঁড়াতেন?
অমল ঝট করে জবাব দিল, অমলতাস।
তখন সবাই মিলে দাদুকে বয়ে নিয়ে অমলতাসের নীচে কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখল। অমল দেখল গাছেরা কী ভাবে কষ্ট প্রকাশ করছে। পাতা নুইয়ে সবাই শোক প্রকাশ করল ওরা।
সন্ধ্যের পর সবাই যখন শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরে এল তখন অমলের বুকটা হু-হু করে উঠল। সবাই এল, শুধু দাদু ছাড়া। কেন জানি অমল এক দৌড়ে দাদুর ঘরে চলে গেল। শূন্য বিছানাটা ওর মনটাকে আরো শূন্য করে দিল। ও তখন এক দৌড়ে বারান্দায় চলে এল, ও মূর্তির মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎই ও চাপা সুরে গোমরানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। মনে হোল শব্দটা বাগানের দিক থেকেই আসছে। অমল এক দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখল শব্দটা অমলতাস থেকে আসছে। অমলেরও জমে থাকা কান্না যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল। দু হাত দিয়ে দু চোখ চেপেও যখন কান্না আটকাতে পারল না তখন হঠাৎই অমলতাসকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
দাদু যেন দুজনকে এভাবে একই গ্রন্থিতে চিরকালের জন্যে বেঁধে দিয়ে গেলেন।