• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • রূপকথা : শাম্ভবী ঘোষ



    ।।১।।

    ঘন পাতার আড়ালে মিশে, ধকধকে সবুজ চোখজোড়া মেলে জঙ্গলের সীমানার দিকে তাকিয়ে ছিল নেকড়ে। আকাশছোঁয়া গাছ আর লতাগুল্মের শ্যামল বেড়াজাল পাতলা হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে দূরের বসতিটার পারে। শীর্ণ একটা পায়ে-চলা পথ সীমান্তের ওই পরিত্যক্ত ডেরাটার কাছে গিয়ে থমকে গেছে, যেন প্রকাণ্ড, নিশ্চল একটা সাপ। সেই পথের উপরেই চোখ পেতে দাঁড়িয়ে আছে নেকড়ে। থেকে থেকেই তীব্র জিঘাংসায় কড়মড় করে উঠেছে তার শ্বদন্তগুলো। আজকের পরিণামে রক্ত অবশ্যম্ভাবী। কোনো এক নীচ দু-পেয়ের ঘাড়ে দাঁত বিঁধিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেবে সে।

    বেশ কিছুদিন হল, অরণ্যের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বনের জগৎ ওই দু-পেয়েগুলোর মতো সংকীর্ণ নয়। তার ব্যাপ্তি বিরাট, বৈচিত্রময় তার অধিবাসীদের জীবন। এখানে জীববৈচিত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে মেনে চলতে হয় অনেক নিয়ম—অধিবাসীগোষ্ঠীদের সঙ্গবদ্ধ করতে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন শৃঙ্খলার। প্রকৃতির ছন্দেই বেঁধে নিতে হয় নিজের গতি। লক্ষাধিক বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা প্রকৃতিবিশ্বের অমোঘ নিয়মকে লঙ্ঘন করতে একবারের জন্যেও বুক কাঁপেনি দু-পেয়েদের। অথচ, সৃষ্টির প্রথম প্রহরে তারাও ছিল বন্যপ্রাণ। জঙ্গলের রীতি উপেক্ষা করবার মতো প্রবৃত্তি কিংবা সাহস গজায়নি তখনও। কিন্তু ক্রমেই জঙ্গলের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরতে সরতে একসময় বৃত্তের বাইরেই ছিটকে পড়ল তারা—তৈরি করল তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন। প্রকৃতিকে টেক্কা দিয়ে নিজেদের স্বেচ্ছাচারের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইল মূর্খগুলো।

    প্রথম প্রথম জঙ্গলের অধিবাসীরা খানিক করুণাই করত তাদের। যারা চরম হঠকারিতার বশে মাতৃক্রোড় থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে, তারা অনুকম্পার পাত্র ছাড়া আর কী? তার উপর, দু-পেয়েগুলোর অসহায়, সংক্ষিপ্ত, রোগজর্জরিত জীবনের ধারা যে দেখত, যত বড় পাষণ্ডই হোক না কেন, তার দয়া হতই। বনের বাইরে বেরিয়ে যাবার পর তাদের দাঁত, নখ, দৃষ্টি ক্রমশই দুর্বল হয়ে গেল। বিপুলা পৃথিবীর তাপ, হিম, জল, বায়ুর প্রকোপে পাকা শস্যের মতোই ঝরে পড়তে লাগল তারা। সেই কারণেই হয়তো, তাদের সদাত্রস্ত মনের অন্ধকার থেকে জন্ম নিল নানান আজগুবি, অলীক বিশ্বাস এবং কুসংস্কার। দৃশ্যমান এই গ্রহের মূর্ত জীবনকে অগ্রাহ্য করে তারা অবাস্তবের রাজ্যে বিচরণ করতে লাগল।

    কিন্তু সকলেরই একদিন ভাগ্য ফেরে। কালের নির্মম যাত্রাপথে যে প্রাণীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিল যে অরণ্যজগৎ, তারাই এক সময় সেই হতভাগ্য, নগণ্য প্রাণীকূলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখল। ধীরে, অতি ধীরে, দ্বিপদীরা অগ্রসর হতে লাগল তাদের নির্মিত জীবনযাপনের পথে। যে প্রকৃতি তাদের কাছে আতঙ্ক ছিল, সেই এখন হয়ে উঠল চরম শত্রু। এতদিন ইঁদুরের মতো গহ্বরে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করত, কিন্তু এবার এক ভয়ংকর সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল তারা। বনাঞ্চল ধ্বংস করে তৈরি করতে লাগল বন থেকেই লুণ্ঠিত উপকরণ দিয়ে তৈরি উদ্ধত ইমারত, বিচিত্রদর্শন সব কলকব্জা আর মারণাস্ত্র। বনের যে-সব অধিবাসীদের কাছে একদিন যারা সহজ শিকার ছিল, তারাই আজ তাদের খাদকদের নির্বিচারে, নিষ্প্রয়োজনে বধ করতে লাগল। বন্যেরা স্তম্ভিত আতঙ্কে দেখল, পৃথিবীর বুকে তাদের এককালীন বিস্তৃত বাসভূমি দু-পেয়েদের নিরন্তর আঘাতে শামুকের মতো গুটিয়ে আসছে ক্রমশঃ। যে সব আদিম অরণ্যে এই কীটানুকীটের দল দিনের আলোয় অবধি পা দিতে সাহস করত না, তারাই কিনা স্থল-জল-বায়ুপথে তাদের নিরালা গৃহকোণ তছ্‌নছ্‌ করে দিচ্ছে! এবং এত করেও ধর্ষকাম মিটবার কোনো লক্ষণ নেই।

    দু-পেয়েদের হাতে অরণ্যকুলের লাঞ্ছনার কথা ভাবতে ভাবতে নেকড়ের উষ্ণ রক্ত টগ্‌বগিয়ে উঠছিল। শাবককাল থেকেই এ বিষয়ে অনেক ভেবেছে। সময় থাকতে ওই বিধ্বংসী কীটের গুষ্টিকে নির্মূল করে দেওয়া হয়নি কেন? সৃষ্টির প্রাচীনতম যুগ থেকে আজ অবধি কত সহস্রাব্দই তো বয়ে গেছে—তার তুলনায় দ্বিপদ-প্রজাতির আয়ু কতটুকু! মাত্র কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এমন কি ঘটে গেল, যে তার ভয়ে অসীম অরণ্যও এখন কম্পমান? উত্তর পায়নি নেকড়ে। শুধু দেখেছে, দু-পেয়েদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবার চেষ্টা করলেই তা সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে তার অগ্রজেরা। একবার ক্ষুব্ধ হয়ে এক গোষ্ঠী-সদস্যকে বলে ফেলেছিল, “আমাদের নখের বল কি এতই ক্ষীণ যে ওই পরজীবীগুলোর ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়? এই বীরত্বের জোরেই বুঝি আমরা অরণ্যাভিজাত্যের অহংকারে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই?”

    সদস্যটি প্রাচীন না হলেও, তার অগ্রজ। তার পীতাভ চোখে প্রচ্ছন্ন করুণা দেখে আরও বিচলিত হয়েছিল নেকড়ে। তাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে সেই বৃকসদস্য বলেছিল, “শ্বদন্ত যখন আরও দৃঢ় হবে, সেদিন বুঝবে, দু-পেয়েরা তোমার পৌরুষের কদর করে না। শৃগালের চেয়ে শতগুণ ধূর্ত, বহুরূপীর চেয়ে সহস্রগুণ বর্ণচোরা ওই শঠ প্রাণীদের কবলে পড়ে স্বয়ং মা প্রকৃতিও বন্দী হয়েছেন। বিস্তৃত এই বিশ্বলোকের সমগ্র বনানী দখল করেছে যে প্রজাতি, তাদের কেবল বাহুবলে পরাস্ত করবে একা তুমি? হাসালে, শাবক! বিবর্তনের দুর্লঙ্ঘ্য পাকে আজ তারা আমাদের বহু ঊর্ধ্বে। তবু প্রকৃতি মায়ের অসীম দয়ায় দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতাদের মতো আমাদের প্রত্যক্ষভাবে দু-পেয়েদের দাস হতে হয়নি এখনও। আমাদের চারণভূমি ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে আসছে, তবুও সেই পরিসরের মধ্যে আমরা মুক্ত। যে কালচক্র আজ ওই শয়তানদের বিজয়সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই আবার তাদের ভূলুণ্ঠিত করতেও দ্বিধা করবে না। কিন্তু সেই মহাজাগতিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবার অধিকার আমাদের নেই। আমরা সীমাবদ্ধ জীব, সীমার অবমাননা করা আমাদের পক্ষে মহাপাপ।”

    নেকড়ে আর কথা বাড়ায়নি। নিজের গোষ্ঠীর কাছে আর অভিযোগ করতেও যায়নি। করে লাভ নেই কিছু। সে বুঝতে পেরেছিল অরণ্যবাসীদের মানসিকতা। ছোটবেলা থেকে যে সন্দেহ তার মনে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়েছিল, সেদিনের ওই সামান্য ক’টা কথায় তা যেন বিশ্বাসের মহীরুহে পরিণত হল। তারা দু-পেয়েদের সঙ্গে কি করে যুঝবে? লড়াই করবার প্রথম শর্তই হল জয়ের অভিলাষ। প্রতিপক্ষ যতই সাধারণ বা দুর্বল হোক না কেন, ময়দানে নামার আগেই যদি নতি স্বীকার করে নেওয়া যায়, তাহলে সেই অবশ্যম্ভাবী পরাজয় রুখবে কোন ঈশ্বর? মহাকাল কখনোই দুর্বলের সহায় হয় না। রণক্ষেত্রে জিততে গেলে কি শুধু সততার নির্মল আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকলে চলে? যারা হারে, চাতুরিকে দুয়ো দেয় তারাই। ওই দলে সে নিজে অন্তত নাম লেখাবে না।

    ।।২।।

    সংকল্প তো কবেই তৈরি হয়েছিল। অপেক্ষা ছিল শুধুমাত্র একটা সুযোগের। মাহেন্দ্রক্ষণে হাতেখড়ি হলেই শুরু হবে নেকড়ের দীর্ঘ, কঠিন পথ। প্রথমটা হয়তো একলাই এই মহান ব্রতের ব্রতী হবে সে, কিন্তু ক্রমশই অরণ্যবাসীদের পাশে পাবে, এই প্রত্যয় তার ছিল। এতদিনে সেই মুহূর্ত এসে উপস্থিত। কিছুদিন যাবৎ একটা দু-পেয়ের কু’নজর পড়েছে তাদের পরম শান্তির শ্যামল গহনে। এতদিন ওরা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকত না। বনের সীমানাকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে দেওয়ার বেশি কিছু করবার সাহস দেখায়নি কেউই। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, একটা দু-পেয়ে নাকি একেবারে বনের মাঝখানে পাকাপাকিভাবে আস্তানা গেড়েছে! খবরটা কানে এলেও, প্রথমটা অত গা করেনি নেকড়ে। কিন্তু এর কয়েকদিন পরেই, বৃকসমাজের নিস্তরঙ্গ জীবনে বিভীষিকার ছায়া ঘনিয়ে এল। যে প্রজাতির গোষ্ঠীকে অরণ্যের সমস্ত অধিবাসী সমীহ করে চলত, তাদেরই ত্রস্ত হাহাকারে ভরে উঠল বাতাস। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে গোষ্ঠীর শাবকেরা এক এক করে যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যেতে লাগল। অরণ্যাবাসীদের কেউ তাদের সন্ধান দিতে পারে না। অষ্টপ্রহরের টহল শুরু হল, ডেরা থেকে শাবকদের বেরোনো বন্ধ করে দেওয়া হল। তার ফলস্বরূপ যা ঘটল, তা প্রত্যক্ষ করে কেঁপে উঠল সমগ্র জীবকূলের হৃদয়।

    বৃকসমাজের নারীদের আর্তচিৎকারে চমকে উঠল এক সান্ধ্য চরাচর। ডেরা থেকে সভয়ে বেরিয়ে এসে উঁকি দিতেই রক্ত হিম হয়ে গেল সকলের। অরণ্যের গভীরে—যার অদূরেই বনস্পতির ভীড় মিলিয়ে গিয়েছে একটুকরো ফাঁকা জমির প্রান্তে—পড়ে আছে একটা পচা-গলা শব। দেহটা যে নেকড়ের গোষ্ঠীরই কারুর, আকৃতি দেখে অনুমান করা যায়। কিন্তু সমাজের কোন সদস্যটি যে প্রাণ দিয়েছে, তা আর বোঝবার উপায় নেই। শরীর থেকে সমস্ত চামড়াটা নিঁখুতভাবে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে; মাথাটা অদৃশ্য।

    এতক্ষণ যেন শ্বাস রোধ করে ছিল সমগ্র অরণ্য। এমন সময়ে বৃকসমাজের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য উত্তর দিকে নির্দেশ করে কম্পিতস্বরে বলল, “দেখেছ?”

    সকলে দেখল, অরণ্যের অনাবৃত হৃদয়স্থল সেই ফাঁকা জমিটার আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে শ্বেতাভ ধোঁয়া। সীমান্তের গাছপালাগুলো জায়গাটাকে আড়াল করে রেখেছিল বটে, কিন্তু ওই সুনিয়ন্ত্রিত, ঊর্ধ্বগামী ধোঁয়া যে কিসের ইঙ্গিত তা বুঝতে কারুরই বাকি রইল না। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের আবির্ভাব হয়েছে তাদের পবিত্র চারণভূমিতে। মাতৃজঠরেই মড়কের বীজ বপন করে গিয়েছে মহাকাল।

    তার পর থেকে বনের গভীরে কেউ ভুলেও পদার্পণ করে না। যে অধিবাসীদের ডেরা ওই চত্বরের কাছাকাছি ছিল, তারাও অন্যত্র ঘর বাঁধল। দিবারাত্রি নির্বিশেষে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতে লাগল সকলে। তাতে অবশ্য খুব লাভ হল না। কাতারে কাতারে না হলেও, প্রায় রোজই একটি-দুটি করে অরণ্যবাসী, বিশেষত বৃকসমাজের সদস্য অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। কারুর কারুর অবশিষ্ট শবদেহ পাওয়া গেল, অধিকাংশেরই গেল না। মাত্র কয়েক প্রহরের ব্যবধানে এতকালের নিরাপদ আশ্রয় নরককুণ্ড হয়ে উঠল।

    নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করেছে নেকড়ে। অরণ্যবাসীদের অকালমৃত, ছিন্নভিন্ন শবদেহ দেখে যত না আতঙ্কিত হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি জ্বলেছে নিষ্ফল ক্রোধের আগুনে। না, দু-পেয়েটার উপর নয়। যারা নরকের জীব, তাদের প্রতি আর নতুন করে ক্রোধ বা ঘৃণা জন্মাবে কি করে? এই আক্রোশ অরণ্যবাসীদের উপর, বিশেষত তার অগ্রজদের উপর। একটা দন্তনখরবিহীন ইতর প্রাণীর এতই ক্ষমতা যে তার এই যথেচ্ছ হত্যালীলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না অরণ্য? এতই দুর্বল তারা? এতটাই কাপুরুষ?

    তার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেকড়ে। এই অরণ্যে বৃকসমাজের অবস্থান খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে। অন্যায়ের প্রতিকার করবার দায় তাদের উপরেই বর্তায়। বিশেষ করে, আক্রমণ যখন তাদের উপরেই কেন্দ্রীভুত। কিন্তু সমাজ যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে, তাহলে সমষ্টির বাইরে গিয়ে যা করবার নেকড়েকেই করতে হবে। তবে হঠকারিতার বশে কিছু করে ফেলা ঠিক হবে না। তার গোষ্ঠীভুক্তদের বীভৎস শবদেহ দেখে একটা ভ্রম ভেঙে গিয়েছে। বাহুবলে যতই খর্ব হোক, শত্রুকে ধ্বংস করবার এমন সব কৌশল দু-পেয়েদের আয়ত্তে, যে তাদের পরাজিত করতে শুধুমাত্র দেহের শক্তি যথেষ্ট নয়। অন্য পথে হারাতে হবে তাদের। ধূর্তের বিরুদ্ধে কি সৎভাবে জেতা যায়? নেকড়েও পারবে না। এই ইতর জীবগুলোকে মারতে হলে তাদের স্বভাব বুঝতে হবে, জেনে নিতে হবে তাদের দিনযাপনের খুঁটিনাটি। তারা যেমন অকস্মাৎ আঘাত করেছে বৃকসমাজকে, সেও তেমনিই অতর্কিতে মৃত্যুবাণ হানবে ওদের বুকে।

    এই ক’দিন জঙ্গলবাসী ওই দু-পেয়েটাকে নেকড়ে শত্রুভাবে সাধনা করেছে বলা যায়। না, তার ডেরার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি। শুধু অরণ্যবাসীদের শবদেহ থেকে চিনে নিয়েছে তার বিজাতীয় গন্ধ। তারপর বনের প্রশস্ত পথের আপাদমস্তক টহল দিয়ে জেনেছে তার গতিবিধি। দু-পেয়েটা যে মহা ধড়িবাজ তাতে সন্দেহ নেই। অষ্টপ্রহর পাহারা সত্ত্বেও কি করে যেন সকলের অলক্ষ্যে বিচরণ করছে। শুধুমাত্র অরণ্যের উপাদানে তার অন্নসংস্থান হবে না, এ কথা নেকড়ে জানে। অরণ্যের প্রান্তে দু-পেয়েদের যে বড় বসতি আছে, সেখান থেকেই সব উপাদান সংগ্রহ করে নিশ্চয়ই; তা করুক। ওই চলাচলের পথে একদিন দেখা হবেই। নেকড়ে অপেক্ষা করবে। ওর হাতে সময়ের অভাব নেই।

    ।।৩।।

    ভেবেছিল, আজও বুঝি বিফল হবে। শীতের ক্ষণস্থায়ী বেলা পড়ে আসছে ক্রমশই। পশ্চিম আকাশ লাল করে থমকে আছে সূর্য। এখনই অন্ধকার নামবে। দু-পেয়েরা রাত্রিকালে বেরোয় না, সে খবর নেকড়ে রাখে। অবসন্ন একটা শ্বাস ফেলে অরণ্যে ফিরতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে থমকে দাঁড়াল। গ্রামের ওই আঁকাবাঁকা পথে ও কার অবয়ব ফুটে উঠেছে? নেকড়ে চকিতে তার পেশী টানটান করে দাঁড়াল। এতদিনে কি অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে? বৃকসমাজের রক্তের মতোই লাল আবরণে মোড়া, লম্বা কালো কেশরের এই দ্বিপদীই কি সেই নৃশংস হত্যাকারী? ঠাহর করে দেখে একটু অবাকই হয় নেকড়ে। মনে হচ্ছে দু-পেয়েটা মাদী। মাথায় বেশ ছোট; শাবক না হলেও প্রাপ্তবয়স্ক হতে বোধহয় দেরি আছে এখনও। সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে দিগন্তে। বনস্পতির গাঢ় ছায়া ক্রমশই দীর্ঘায়িত। শেষ অপরাহ্নের সেই আলো এসে পড়েছে দু-পেয়েটার মুখে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত চোখদুটো দেখে কেমন যেন এক অনুভূতি জাগে মনে। অস্থিরভাবে বাতাস শোঁকে নেকড়ে। অচেনা গন্ধ—বৃকসমাজের হত্যাকারী এ নয়। তাহলে কে এই দু-পেয়েটা? কি উদ্দেশ্যে এই সান্ধ্য প্রহরে অরণ্যের দিকে আসছে? হাতে ঝোলানো জিনিসটা কী? জঙ্গলের ভিতরের সেই খুনীটার জন্য উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে না তো? তার মুখটা ভাল করে নিরীক্ষণ করে নেকড়ে। কই, তেমন হিংস্র তো দেখাচ্ছে না একে? বরং টলটলে চোখদুটো দেখে খরগোসের মতোই নিরীহ মনে হয়। ক্ষণিকের জন্য ধাঁধায় পড়ে যায় সে, আর তার মধ্যেই দু-পেয়েটা ঢুকে পড়ে অরণ্যের ভিতর। মন্থর তার গতি, নিশ্চিন্ত ভাব। নেকড়ের উপস্থিতি সে যে টের পায়নি, তা স্পষ্ট। নেকড়ে দ্রুত চিন্তা করে নেয়। চাইলে এই মুহূর্তেই দু-পেয়েটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করতে পারে। কিন্তু তাতে গায়ের ঝাল মেটানোর অতিরিক্ত কোনো সমাধান হবে না। তার চেয়ে এর পিছু নিলে হয়তো কিছু তথ্য মিলতে পারে। আত্মপ্রকাশ না করলেই হল। ইন্দ্রিয়গত কোনো ক্ষমতাই যে দু-পেয়েটার নেই, তা সে ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে। এর কাছ থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা কম। নেকড়ে সন্তর্পণে সেই রক্তাবৃত দ্বিপদীর অনুসরণ করতে লাগল।

    নেকড়ে দেখল, তার অনুমান নির্ভুল। দু-পেয়েটা অরণ্যের কেন্দ্রস্থলের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে ক্রমশ। সন্দেহ নেই, ভিতরের ওই হত্যাকারীর সঙ্গে অরণ্যের বাইরের বসতির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে সে। এই দু-পেয়ের পিছু ধরে ওই খুনীর ডেরায় গিয়ে পড়লে মুশকিল হবে। যত বলবানই হোক, এক সঙ্গে দুই দ্বিপদীর মোকাবিলা করতে যাওয়াটা বড্ড বেশি ঝুঁকির কাজ। তার চেয়ে যদি এক এক করে…

    শানিত দাঁতের সারিগুলো বার করে একবার নিঃশব্দ হাসল নেকড়ে। শাঠ্যের কথা কি যেন বলেছিল তার সতীর্থ? এবারে দেখা যাক দু-পেয়েগুলোর কূটবুদ্ধির দৌড়।

    এতক্ষণে অরণ্য জুড়ে আঁধার নেমে এসেছে। দু-পেয়েটা মাথার উপরেও সেই লাল খোলস টেনে দিয়েছে। এবং, নেকড়েকে চমকে দিয়ে তার হাতে ধরা বিচিত্রদর্শন জিনিসটার ভিতর থেকে বার করে এনেছে একটি আলোর গোলোক। দ্বিপদ প্রজাতি যে আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এ কথা সেই শাবককাল থেকেই শুনে আসছিল সে; আজ স্বচক্ষে দেখল। জমাট বাঁধা জলের মতো স্বচ্ছ এক আবরণের ভিতর তিরতির করছে একটি মাত্র আগুনের শিখা। এ আগুন বশীকৃত, নিরীহ—তবু তার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে দু-পেয়েটার সামনের পথ।

    এতক্ষণে একটু থমকাল নেকড়ে। ভয় না হলেও, মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব টের পেল। যে জীব আগুনের পায়ে বেড়ি পরাতে পারে, তাদের সঙ্গে একা একা লড়তে যাওয়া কি আদৌ বুদ্ধির কাজ? বৃক প্রজাতির বল যতই থাক, তারা প্রকৃতির গণ্ডি লঙ্ঘন করবার দুঃসাহস দেখায়নি কখনোও। পঞ্চভূতকে কোটরবন্দী করে তাদের দিয়ে খাটানো, এমন পাপ যে স্বপ্নেরও অগোচর!

    একবার মনে হল, ফিরে গিয়ে কয়েকজন গোষ্ঠীরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে আসে। কিন্তু পিছনে তাকিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল নেকড়ে। এতদূর এসে ফিরে যাওয়া বোকামি। যতক্ষণে তাদের নিয়ে পৌঁছবে, ততক্ষণ কি দু-পেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে? সবচেয়ে বড় কথা, গোষ্ঠীরক্ষীরা বৃকশাবকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। তাদেরকে এই বিপদসঙ্কুল জায়গায় টেনে আনার অর্থ সমগ্র বৃকসমাজকে বিপদে ফেলা। চোয়াল শক্ত করল নেকড়ে। যা করবার, তাকেই করতে হবে।

    এতক্ষণে আরও গভীরে ঢুকে গেছে দু-পেয়েটা। পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছে, তা বেশ স্পষ্ট। গতি আরও মন্থর হয়েছে তার, সেই সঙ্গে আগুনের শিখাটা কী যেন জাদুতে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। হঠাৎ একটা প্রাচীন, সুবিশাল গাছের নীচে ঝুঁকে পড়ল দু-পেয়েটা। আলোর গোলোকটা নামিয়ে রাখল তার পাশে। কি ব্যাপার? ওই গাছের তলায় কী খুঁজছে প্রাণীটা? আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা ভাল ঠাহর হচ্ছিল না নেকড়ের। এগিয়ে আসতেই অসাবধানে পায়ের তলায় একটা শুকনো ডাল মড়্‌মড়্‌ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে পিছনে তাকাল দু-পেয়েটা। এবং তখনই নেকড়ে টের পেল, তাড়াহুড়োয় আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দু-পেয়েটার দুর্বল চোখের সামনেও সে এখন দৃশ্যমান। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। হৃৎপিণ্ডটা একবার লাফিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল নেকড়ে। শেষ একটা এসপার-ওসপারের জন্যে প্রস্তুত হয়ে পেশি শক্ত করে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াল।

    কয়েক মুহূর্ত, নাকি কয়েক যুগ? যে ভীষণ আক্রমণের আশঙ্কায় স্নায়ুতন্ত্রে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল, তা তো এখনও এসে আছড়ে পড়ল না! নেকড়ে অবাক হয়ে দেখল, দু-পেয়েটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমন কোনো গূঢ় তত্ত্ব তার দৃষ্টিতে ঝিলিক দিচ্ছে, যা বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। মাথার ভিতর কেমন ঝিম্‌ ধরে যাচ্ছিল। আর ঠিক তখনই দু-পেয়েটা খুব সহজ গলায় ডাকল, “কে গো?”

    কি বলবে বুঝতে পারছিল না নেকড়ে। এতক্ষণে গাছের তলায় নজর দিয়ে দেখতে পায়, গুঁড়ির গায়ে গজিয়েছে অগুন্‌তি গোল গোল ছত্রাক। দু-পেয়েটার হাতের মুঠো থেকেও কয়েকটা উঁকি মারছে। সেগুলো তার অন্য হাতে ঝোলানো জিনিসটার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার গাছের দিকে ফিরে বলল, “রাতের বেলা ব্যাঙের ছাতা তুললে তার স্বাদ ভাল হয়।”

    সন্তর্পণে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল নেকড়ে। বেশি কাছে ঘেঁষল না অবশ্য। ওই আগুনের গোলাটাকে বিশ্বাস নেই। তবে তার থেকেও বেশি বিভ্রান্ত করছে দু-পেয়েটার আচরণ। নিষ্ঠুর খুনেরা কি হত্যা করবার আগে তাদের শিকারদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নেয়? দু-পেয়েটার তো তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই! ছত্রাকের গোছা ছিঁড়তে ছিঁড়তে আপন মনে বক্‌বক্‌ করে যাচ্ছে। তাকে জরিপ করতে করতেই নেকড়ে শুনল, তার দিকে ধেয়ে আসা প্রশ্ন, “তুমি কে, বললে না তো ভাই?”

    “আমি… আমি বৃকসমাজের প্রাণী।”

    “ও, তা বেশ। আমি লালী। বনের বাইরের ওই গাঁয়ে থাকি।”

    এবারে একটু কৌতুহল হল নেকড়ের। সে সতর্কভাবে প্রশ্ন করে, “তাহলে এখানে কেন এসেছ?”

    লালী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আর বলো কেন ভাই। আমার বর কাঠ কাটে কিনা, তাই বনের মাঝে একটা বাড়ি করেছে। রাত হয়ে গেলে ওইখানেই থেকে যায়। কিন্তু দিন দুয়েক হল, তার বড় অসুখ। ওই বাড়ির মধ্যে একলাই পড়ে আছে। এত জ্বর যে, উঠে বসতেও পারছে না। তাই আমি গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে রয়েছি। আজ গাঁয়ে গিয়েছিলাম খাবার কিনতে। ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেল, তবে সঙ্গে লণ্ঠন আছে, তাই ভাবনা নেই। এখানে ব্যাঙের ছাতাগুলো দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার বর বড় ভালবাসে — অসুখের মুখে তৃপ্তি করে খেতে পারবে। আর ক’খানা পেলে খুব ভাল হত, কিন্তু এখানে আর তো দেখছি না। এগুলোই ঝুড়িতে ভরে নিয়ে যাই।”

    লালীর এতগুলো কথার অনেক কিছুর অর্থই বুঝতে পারছিল না নেকড়ে। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে জরুরি কথাটার সারমর্ম উদ্ধার করতে আর বাকি নেই ওর। যে কোনো কারণেই হোক, বৃকসমাজের হত্যাকারী ওই দু-পেয়েটা সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনে তার ডেরা থেকে বেরোতেই পারেনি। সেইজন্যেই বোধহয় তার হত্যালীলায় সামান্য ছেদ পড়েছে। লালীর কথা শুনে মনে হয়, খুনীটা অন্তত সাময়িকভাবে চলচ্ছক্তিহীন। অর্থাৎ, এ হল একেবারে সুবর্ণ সুযোগ!

    পলকের মধ্যে তার পরের পদক্ষেপ ছকে নিয়ে নেকড়ে সরল গলায় বলে, “ওই ছাতাগুলো আরও চাই তোমার? আমি এক জায়গায় একসঙ্গে অনেকগুলো দেখেছি, গাছের তলায় থোকা থোকা গজিয়ে আছে।”

    লালী উৎসুক হয়ে বলে, “ওমা, তাই নাকি! কোথায় গো?”

    নেকড়ে পশ্চিম দিকে নির্দেশ করে বলল, “ওদিকে সোজা চলে যাও, খুব দূরে নয়। পাঁচশো পায়ের কম।”

    ইতিমধ্যে সবকটি ছত্রাক তুলে ঝুড়িতে ভরে ফেলেছিল লালী। এবারে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে বরং একবার ঘুরেই যাই। সকালে আর ব্যাঙের ছাতার স্বাদ এক রকম থাকে না। অনেক ধন্যবাদ, ভাই!”

    ঝুড়ি আর লণ্ঠন হাতে বনের পশ্চিমমুখো পথে দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায় লালী। সঙ্গে সঙ্গে নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করে নেকড়ে। একটু অপরাধ বোধ যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু কাজ হাসিল করতে হলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিরীহ লালীকে দিকভ্রান্ত করে দিয়ে হত্যাকারীর ডেরায় নেকড়েই আগে পৌঁছাবে। নির্বিঘ্নে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে আবার ফিরে যাবে তার স্বাভাবিক অরণ্যজীবনে। লালীকে সে মারবে না। দু-পেয়ে হলেও, তার ব্যবহার ছিল সহৃদয়। সে কি আদৌ জানে তার দু-পেয়ে জুড়ির ভয়ংকর কার্যকলাপের কথা? মনে তো হয় না। যদি জানত, তাহলে এত সহজভাবে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারত না। সে যাইহোক, লালী তার লক্ষ্য নয়। যে এতদিন ধরে বৃকসমাজের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তার ভবলীলা সাঙ্গ করে তবেই নেকড়ের শান্তি।

    এতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে নেকড়ে। অরণ্যের হৃদয়স্থলের সেই ছোট জমিটার মাথার উপর বিশাল রুপোলি চাঁদ উঠেছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মধ্যে খুনীর ডেরাটা একটা কুৎসিত দৈত্যের মতো মাথা তুলে আছে। ডেরাটার মাঝে মাঝে কয়েকটা ফাঁক, সেখান থেকে হলুদ রঙের আলো ঠিকরোচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটা ফাঁকের মধ্যে মাথা গলাতে গিয়েই ধাক্কা খেল নেকড়ে। কি এক অদৃশ্য আবরণে ঢাকা; ঠিক যেমন লালীর হাতের লণ্ঠনের আগুনটা ঢাকা ছিল। তাহলে কি ভিতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই? ডেরার চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখল, কিন্তু কোথাও কোনো প্রবেশপথ তো দূর, একটা ফাটল অবধি নজরে পড়ল না। অথচ সেই দু-পেয়েটা যে ভিতরেই আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেকড়ে তার শব্দ, গন্ধ দুইই পাচ্ছে। কিন্তু ডেরায় ঢুকবে কি করে? অধৈর্যভাবে উপরে তাকাল সে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল, ডেরার মাথায় যে লম্বা হাতের মতো একটা কিছু বের করা আছে, তার থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে বাষ্প।

    উত্তেজিত নেকড়ে তৎক্ষণাৎ একটা প্রকাণ্ড লাফে ডেরাটার উঁচু একটা খাঁজ ধরে ফেলল। তারপর হাঁচোড়পাঁচড় করে উঠে এল মাথার উপর। ঠিকই আন্দাজ করেছিল—ওই হাতলটার মুখে একটা গহ্বর। ভিতরে উঁকি দিলে অনেক নীচে কিসের যেন আলো দেখা যায়। নেকড়ের মুখে উষ্ণ হাওয়ার ঝাপটার সঙ্গে অচেনা একটা গন্ধ নাকে এল। ভারি লোভনীয় গন্ধ। ভিতরে শিকার ছাড়াও, আর কী অপেক্ষা করে আছে, কে জানে!

    হয়তো সেই অপ্রত্যাশিত সুগন্ধের কারণেই তার এতক্ষণের সতর্কতা ভুলে গেল নেকড়ে। গহ্বরটার কিনারে উঠে সেই স্বল্পালোকিত সুড়ঙ্গটার ভিতর ঝাঁপ দিল সে—এবং পরক্ষণেই গগনবিদারী আর্তনাদ করে উঠল। সুড়ঙ্গের ঠিক নীচে রয়েছে একটা ফুটন্ত জলের কুণ্ড। নিমেষের মধ্যে ঝলসে গেল তার সর্বাঙ্গ। আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে দেখল, তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে লক্‌লকে আগুনের শিখা।

    ।।৪।।

    দরজা খুলতেই লালী জিজ্ঞেস করল, “কি গো, নেকড়েটাকে ধরতে পারলে?”

    “যাঃ বাবা, ওটাকে তুমি পাঠিয়েছিলে বুঝি?”

    দরজা ছেড়ে ব্যাজার মুখে ঘরের ভিতর এগোয় কাঠুরে। গায়ের লাল পশমের কোটটা খুলে আংটায় টাঙিয়ে রাখছিল লালী। বরের কথা শুনে উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করে, “কেন, কি হয়েছে?”

    “কি আবার হবে? মহা সেয়ানা জানোয়ার! বাড়ির দরজা-জানলা খোলা না পেয়ে চিমনি দিয়ে ঢুকে সোজা এসে পড়েছে মাংসের ঝোলের হাঁড়িতে! বেশি কাঠ খরচ হবে বলে ওটাকে চুল্লীর উপরেই বসিয়েছিলাম। এমন জানলে মোটেই ওখানে রাখতাম না। রাতের খাওয়া মাটি হল। তবু যা হোক, হাঁড়ির ভিতর পড়েছিল। আগুনে পড়লে হয়েছিল আর কি! চামড়া পুড়ে কয়লা হয়ে যেত, লাভের মধ্যে আমাকে গোটা চুল্লীটা ধুয়ে মুছে সাফ করতে হত।”

    লালী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “উঃ, কম ধড়িবাজ ওই নেকড়ে! জঙ্গলে ঢোকার মুখ থেকে ব্যাটা পিছু নিয়েছিল। যাক, তবু তো চামড়াটা নষ্ট হয়নি। এই নিয়ে ক’খানা হল?”

    “হবে, কুড়ি-পঁচিশ। আর দু-তিনটে মারতে পারলেই এবারকার মতো কাজ হাসিল।”

    খুশি মনে রান্নাঘরে গিয়ে ঝুড়ি উপুড় করে দেয় লালী। আর বেশিদিন বনে-বাদাড়ে কাটাতে হবে না। এ বছর শহর থেকে অনেকগুলো ফার-কোটের বায়না এসেছে। এমনিতে শেয়াল বা খরগোসের চামড়ায় দিব্যি কাজ চলে যায়, কিন্তু এবারকার খদ্দের আবার সৌখিন লোক। বিশেষ করে বলে দিয়েছে, তার নেকড়ের লোমই চাই। আর মাত্র কয়েকটা দিন; তারপরেই বাড়ি ফিরে পুরো দমে কাজ শুরু করতে পারবে লালী। কাজ ভাল হলে পরের বছর বিক্রি আরও বাড়বে। এই করতে করতেই অনেক বড়লোক হয়ে যাবে ওরা। গতরের কাজ ছেড়ে ব্যবসা ধরবে কাঠুরে। তারপর দুজনে শহরে চলে যাবে; সেখানে আর পাঁচজন মান্যি লোকেদের মতো জুড়িগাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াবে। একটা আনন্দের শ্বাস ফেলে লালী ডাক দেয়, “রাতের খাওয়ার জন্যে ভেবো না গো, আজ এক ঝুড়ি ব্যাঙের ছাতা কুড়িয়েছি!”


    অনুপ্রেরণা: গ্রীম্‌ ব্রাদার্স-এর গল্প, ‘লিট্‌ল রেড রাইডিং হুড’।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments