• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • গভীর গোপন : তানিয়া দত্ত ঘোষ



    --এ জীবনে একটাই মৃদু দুঃখ থেকে গেল গো।

    ফেসবুকের ওয়াল থেকে চোখ না সরিয়ে অলি বলে ওঠে।

    এ কথার কোন উত্তর হয় না, শুধু বাকিটা শোনার অপেক্ষা করা ছাড়া। সুতনু শুধু চোখ তুলে তাকালো তাই।

    -- আমার ছোটবেলার ক্রাশের সাথে একবার কথা বলা হলো না।

    -- সে কী! সে তো শুনেছি, তোমার দাদার বন্ধু ছিল। কোনদিন কথা বলোনি? ধুর, হতেই পারে না।

    -- না না বলেছি, তবে খুব সাধারণ কথা। বিশ্বাস করো। কোনদিন বলা হয় নি যে ওই বয়সে তাকে দেখলে আমার বুকের মধ্যে একটা কেমন যেন গুড়গুড় করতো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত।

    -- কি কেলেঙ্কারি! তুমি কি সেই কথাটা তাকে এই মধ্য বয়সে এসে এখন বলতে চাও নাকি?

    -- নাঃ! সে তো আর ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই বুঝলে হে।

    -- নেই কেন? বললেই বলা হয়ে যায়।

    সুতনু ফিক করে একটু হাসে।

    --ফেসবুকে খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না।

    -- তবে খুব সাবধান অলি, আমি যতদূর জানি ভদ্রলোকের গৃহিণীটি কিন্তু ডাকসাইটে। বিপদে না পড়ে যাও।

    -- পালে হাওয়াও দেবে, আবার ভয়ও দেখাবে। পেয়েছোটা কি?

    কথায় কথায়, আড্ডা, খুনসুটিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। রোজ রাতে, খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে, অলি বারান্দায় এসে বসে কিছুক্ষণ। আজ সরস্বতী পুজোর আগের রাত, প্রতি বছরই প্রায় এই সময়টাতে অলির মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।

    সুতনুকে বলা হয় না, বলতে ইচ্ছে করে না আসলে, একটা চিঠি কিন্তু এসেছিল। ডাকে নয়, পড়ার ঘরের জানালা গলিয়ে ফেলে যাওয়া। হালকা হলুদ আর গোলাপি মাখানো চিঠির কাগজ।

    "তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে,
    আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে..."
    কোন নাম লেখা ছিল না তাতে। কপাল ভালো অলির, মায়ের হাতে পড়েনি চিঠিটা। তবে পাড়ার ক্লাবে, আড্ডায় জীবনানন্দ কে আবৃত্তি করতো, জীবনানন্দের কবিতা কে পাগলের মতো ভালোবাসতো, সেটা অলি জানতো।

    সে দিনটাও ছিল সরস্বতী পুজোর আগের দিন। শীতশেষের হাল্কা ঠান্ডা আর হাওয়ায় বসন্তের গন্ধ। সন্ধ্যা বেলা, পাড়ার মণ্ডপসজ্জার কাজ প্রায় শেষের মুখে। অলি আর অলির প্রাণের বন্ধু বনি দুটো চেয়ার নিয়ে বসে তাই দেখছে। উল্টো দিকে দাদার বন্ধুর দলের সবাই এক এক করে জড়ো হচ্ছে। আজ সবাই মণ্ডপে রাত কাটাবে। ধড়াস করে উঠলো ভিতরটা। সেও এসে দাঁড়ালো ওই দলে। চোখে চোখ পড়লো একবার।

    বনি উঠে পড়লো খানিক পরে। কি একটা জিনিস আনতে বাড়ি ছুটলো।

    -- তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু।

    -- নিজেও বাড়িতে যাও, একটা গরম কিছু পরে এসো।

    হঠাৎই পেছন থেকে আসা তার গলার স্বরে চমকে ফিরে তাকায় অলি।

    গায়ের ওপর এসে পড়ে একটা হালকা চাদর।

    -- চাদর ছাড়া বারান্দায় বিভোর হয়ে বসে আছো, ঠান্ডা লাগবে তো? তারপর সারাদিন হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করবে।

    সুতনুর কথায় অলি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে তাকায় সুতনুর দিকে। কোন উত্তর দেয় না কথার, চাদরটা জড়িয়ে আর একটু গুটিসুটি হয়ে বসে।

    সেদিন উঠে বাড়ি যেতে হয়নি, বনি সেই মুহূর্তেই ফিরে আসে দুজনের জন্য দুটো পাতলা সুতির চাদর নিয়ে।

    -- কি হয়েছে রে তোর? তোর পিছনে কে দাঁড়িয়ে ছিল রে? তোর সাথে কথা বলছিল। আমি আসতে আসতেই ওদিকে চলে গেল।

    -- কিছু হয়নি। ধুর্। আরে কেউ না।

    আরো কিছুক্ষণ হয়তো জেরা চলতো। কিন্তু কাবেরীদি আলপনার তোড়জোড় করার জন্য ডাক দেওয়ায় অলি নিস্তার পেয়ে যায়। যেতে যেতে চোরা চোখে একবার তাকায়। আর ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখে যে দাদার প্রায় সব বন্ধুর নজর তার দিকে, এবং প্রত্যেকের মুখে মিটিমিটি হাসি। এর একটাই মানে। দাদার বন্ধুরা সবাই তার দুর্বলতার কথা বুঝে গেছে। কিভাবে? অলির পা থেকে মাথা অব্দি একটা রাগ চাড়া দেয়। কিছুক্ষণ আগের সেই আবেগের তাল যেন কেটে যায় এক ধাক্কায়। এ কেমন ছেলে? তার গভীর গোপন দুর্বলতাকে এমন ভাবে হাটের মাঝে এনে ফেললো! অলি আর পিছন ফিরে তাকায় না। শরীর খারাপ লাগছে বলে সোজা বাড়ি চলে যায়।

    --শোবে না? আর কতক্ষণ?

    সুতনু ডাক দেয় ঘরের ভিতর থেকে।

    -- আসছি। আর একটু বসি না প্লীজ। ঘুম আসবে না এখন শুলে।

    -- আমি ঘুমোলাম। গুড নাইট।

    -- গুউউড নাইট। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই যাচ্ছি।

    কেন যে বার বার ঘুরে ফিরে মনে পড়ে সেদিনের কথা!

    সরস্বতী পুজোর সকালে ঘুম ভাঙতে সেই খারাপ লাগাটা কোথায় যেন উবে গেল। মনে রয়ে গেল শুধু -- আমার সকল গান তোমারে লক্ষ্য করে...

    মায়ের বাসন্তী রঙের শাড়িতে সেদিন যেন অলি অনন্যা। প্রাণে বেজে চলেছে কাল সন্ধ্যার সেই সামান্য কটা কথা। একটা আনন্দের ফল্গুধারা যেন বয়ে চলেছে ভিতরে। আজকের এই মনটা যেন আর নিত্যদিনের একঘেয়ে মনের কোটরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। অলি আজ সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক। কথায় কথায় হাসছে বেশি, কথা বলছে বেশি। সেজেগুজে গলির মোড়ে আসতেই পুজো প্যান্ডেল, চোখে চোখ। অন্যের চোখে মুগ্ধতা বোঝার মত পরিণত মন এখন হয়ে গেছে অলির। বুঝতে পারে ওই দৃষ্টির মানে। লজ্জা পায় সে। তাড়াতাড়ি বন্ধুদের সাথে সাথে চলতে থাকে। পিছন ফিরে আর তাকাতে সাহস পায় না।

    ঘটনাটা ঘটলো দুপুর বেলা। অলি স্কুল থেকে ফিরছিল একাই। বনি নেই সাথে। সে গেছে তার দাদা-দিদিদের সাথে সিনেমায়। হঠাৎ দেখে দূর থেকে দাদার বন্ধুদের একদল, জনা ছয়েক সাইকেলে করে আসছে। খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু দলের ভিতর সে আছে এবং নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে আসা প্রত্যেকে হঠাৎ যেন চুপ করে গেল তার পাশ দিয়ে যাবার সময়। অলির মনে পড়ে গেল গতকালের খারাপ লাগার কারণটা, সবাই সবটা জানে।

    -- অলি, একটু শুনবে?

    থমকে যায় অলি। পিছন থেকে কে ডাক দিল। কিন্তু এটা কার গলা? ঘুরে তাকায় অলি। সাইকেল নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে দূরে, আর দাদার অন্য এক বন্ধু আর একটু সামনে এগিয়ে এসে ডাকছে তাকে।

    বাকিদের সবার মুখে যেন কৌতুক। তার মুখেও কি কৌতুকের ভাব? রাগ হলো। তাকাতে ইচ্ছেই করলো না আর অলির।

    -- আমাকে বলছো?

    -- হ্যাঁ। একটু শুনবে?

    সাইকেল নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে দাদার এই অন্য বন্ধুটি।

    -- কি হয়েছে? বলো?

    সকালের সেই আনন্দময় প্রাণে এখন কাঠিন্যের পরশ।

    -- তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো।

    অলির তীব্র দৃষ্টি দেখেই সবেগে হাত পা নেড়ে বলতে থাকে,

    --না না, আমার না আমার না। ওই যে ওর…

    পুরো কথাটা শেষ করতে দিল না তাকে অলি,

    --তাহলে যার কথা সেই বললে ভালো হতো না কি। আর তাছাড়া তোমাদের মতো কারো সঙ্গে আমার তো কোন রকম কথা থাকার কথাই না।

    বলার ভঙ্গির তাচ্ছিল্যে, অলির ভিতর সযত্নে সঞ্চিত দম্ভ, রূপের, গুণের, শিক্ষার সবটা যেন বেরিয়ে আসে।

    --না তুমি চিঠির কোন উত্তর তো দিলে না!

    --কিসের চিঠি? কার চিঠি? ও ওই গোলাপি কাগজে জীবনানন্দ দাশ? ওটা তো আমার মায়ের কাছে রাখা আছে।

    রাগের মাথায় মিথ্যে বলতেও বাধলো না অলির। --মা রেখে দিয়েছে যত্ন করে, তোমাদের মধ্যে কার হাতের লেখা ওটা যাচাই করবে বলে। যাবে কিছুদিনের মধ্যেই সবার বাবা মায়ের কাছে। রেডি থেকো।

    আর একটাও কথা না বলে ঘুরে বাড়ির পথ ধরে অলি।

    দাদার সেই বন্ধু সে বছরই কোলকাতার বাইরে, পুনেতে পড়তে চলে গিয়েছিল। কথা যা কিছু না বলাই থেকে গিয়েছিল।

    অলি আশ্চর্য হয়ে ভাবে, কেন প্রত্যেকবার এমন হয়? সে কি তবে অসুখী? একেবারেই না। সুতনুর মতো বন্ধু তার স্বামী। দুই কৃতী সন্তান তাদের। চুলের রুপোলি রেখার সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তবুও প্রতি সরস্বতী পুজোয় মনে ঠিক পড়বেই, কেন যে সেদিন অমন দুর্ব্যবহার করলো সে নিজে। ভাবতেই যেন একরাশ লজ্জা এখনো ঘিরে ধরে। নাহয় নিজের কথা সেই ছেলে নিজে বলতে পারেনি সরাসরি। উপেক্ষিত হবার ভয়ে হয়তো বা। নাহয় বন্ধুদের কাছে নিজের গোপন কথা ভাগ করে নিয়েছিল, তাও হয় তো মানসিকভাবে নিজেকে খানিক প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে। সেও তো তখন বাচ্চাই, আঠেরো বছর বয়স, জীবনানন্দে ডুবে থাকা এক যুবক। চোখ বন্ধ করলে এখনো যেন শুনতে পায় অলি, তার আবৃত্তি—

    সুরঞ্জনা অইখানে যেও নাকো তুমি,
    বোল নাকো কথা অই যুবকের সাথে।

    অনেক রাত হলো। শুক্লপক্ষ। চাঁদ উঠতে আজ দেরি করেছে, কিন্তু পরে উঠেও সারা আকাশ ভাসিয়ে দিয়েছে জ্যোৎস্নায়। উঠে পড়ে অলি। ধীরে ধীরে নিজের শোবার ঘরের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। সুতনু ঘুমোচ্ছে পরম নিশ্চিন্ততায়। অথচ অলির মন আজ আর এখানে নেই। এই ঘরে নেই, এই বিছানায় নেই।

    "কোনো এক মানুষীর মনে
    কোনো এক মানুষের তরে
    যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে
    নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
    কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।"

    ঘুমের মধ্যে সুতনু কাশে। সুতনুর গায়ের সরে যাওয়া চাদরটা টেনে দেয় অলি। চুপ করে শুয়ে পড়ে পাশে, আলতো করে একটা হাত রাখে সুতনুর বুকে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments