• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • সুক্তো : উত্তম বিশ্বাস



    “ও তুষ্টি, ঘাটের জল দিয়েই সারবি সব?” তুষ্টি কলস কাঁখে সাঁকোর বাঁশ ধরে একটুখানি দাঁড়াবার চেষ্টা করল। শত হোক কন্যাদায় বলে কথা! অবজ্ঞা করে কী করে! তা নইলে সড়াৎ করে সরে যেত।

    আজ পরালীর নান্দিমুখ। কাল বিয়ে। তুষ্টির ছোট মেয়ে পরালী। সেই হিসেবে এটাই ওদের শেষ কাজ। চারু খুড়িমা নিজে থেকেই তুষ্টির কাঁখ থেকে ঘড়াটা সাঁকোর গুঁড়োয় নামিয়ে বলল, “বোস। ভেঙে পড়লে হবে? মেয়ে সন্তান কি ঘরে রাখার জিনিস মা? সব ভালো হবে-- একদম ভেবো না!” এমন কথার পালটা হিসাবে কান্নাই দিতে হয়! এটা বাংলাদেশের আবহমানের নিয়ম। তুষ্টিও কাঁদল। অভাবের সংসার। সবাইকে বলতে পারেনি। সেইজন্যে কুণ্ঠাও অনেক! চারু খুড়ির সাতকুলে কেউ নেই। আছে একটা পুতনি। চারুকে কেউ নিমন্ত্রণ করুক আর না করুক, পুতনিকে ধোয়া-কাচা জামাকাপড় পরিয়ে পাঠিয়ে দেয়। অবুঝ প্রাণ তো বিনে নেমন্তন্নয় খেলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পাঠালেও সে এখন আর যার-তার বাড়ি পাত পাড়ে না।

    এর মধ্যে তুষ্টিদের উঠোনে ঢোলক বেজে উঠল।

    চারু খুড়ি শুকনো মুখে শুকনো আলুনী খইয়ের হাসি উড়িয়ে দিল, “হ্যাদে ও লো, বাদ্যি বলেছিস? তাই বলি!”

    তুষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল। সে জলঘড়া নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

    এবার শাঁখের শব্দ আসছে। চারু খুড়ি এবার চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওলো শোন, শ্যাওলা সরিয়ে নিস। কাল ভোর ভোর আসিস। ঘাটে ঘোলা পড়বার আগে ফর্সা জল তুলে নিবি। ভাত ডাল যা রাঁধবি সব ধবধবে হবে।”

    সাঁকোর সম্মুখে সবে অন্ধকারের আভা পড়তে শুরু করেছে। তুষ্টি কথা বলছে না। সে সিঁদুর মাখানো ডাবুর নিয়ে সাবধানে পা ফেলছে। চারুও হাঁটছে। যেন কতকালের কথা পড়ে আছে। ধান ভানতে গীত লাগে। কে গাইবে কে জানে! এখন তো আবার গুঁড়ো হলুদে জল মিশিয়ে দায় সারে। কাঁচা হলুদে আচ্ছা করে মেয়েদের গা-গতর মেজে দিতে হয়। তা নইলে ওদের ভিতরের লাবণ্য খোলতাই হয় কি? সব বলা হল না। তুষ্টিও ব্যস্ত। চারু আরেক বার ডাকল, “তুষ্টি, শোন!” তুষ্টি একটুখানি থামল।

    চারু খুড়ি অভয় দিয়ে বলে উঠল, “আমি জানি, তুই খুড়িকে নেমন্তন্ন করতে পারিসনি বলে লজ্জা পাচ্ছিস! লজ্জার কী আছে মা? পারকতা বলেও তো একটা কথা আছে! সবার দেওয়াথুয়া হয়ে গেলে, এই কাঙালের জন্যে এট্টু সুক্তো দিয়ে যাস!”

    হ্যাঁ, লোকলজ্জার মাথা খেয়ে চেয়েই বসল চারু খুড়িমা। এই চাওয়াটুকু তার একপ্রকার হক্কের অধিকার। বিয়ে হোক অন্নপ্রাশন হোক, শান্তি স্বস্ত্যয়ন যাই হোক না কেন, কুটুম্বির পাতে সুক্তো রাখতেই হবে। এটা একপ্রকার নিয়ম। আর এর গন্ধ যতদূর ছড়াবে সে বাড়ির কর্তার সুখ্যাতি ততদূর প্রচারিত হবে। চারুর যখন খুব বেশি দাপট ছিল, ওকে চাখবার জন্যে নিয়ে যেত। উনুনের পাশে বসে বলে দিত, “করলার কুচি বেশি হয়ে গেছে! এই বাপু, এটা কি বাবুপাড়ার পোস্ত কাঁচকলার পায়েস করতে বলেছি? আরও টানাও। মাছের তেল কেন দাওনি? বেগুনগুলো বাদামি করে ভাজতে হতো! সামান্য শাক সজনে না দিলে সাজে?” সত্যিই তাই শুধু চারু কেন, একথা সকলেই জানে। চড়চড় করে তেল ছাড়বে। পাড়া ম-ম হবে। আত্মীয়স্বজনেরা খাবার জন্যে হাঁকুপাঁকু করবে। আহা! এমন একটা পদ যদি ঠিকঠাক পাতে ফেলা যায়, তবেই না বোঝা যাবে কার কত দম। তখন কার বাপ কত টাকা পণ দিল, অথবা বিছানা-বালিশ আদৌ দিল কি দিল না, এটা তখন আর কেউই মাথাই রাখে না। অতএব প্রথম পাতের এই অনন্য স্বাদের ব্যঞ্জনটি দিয়েই অতিথিকে আপ্যায়ন করতে হবে। আর এতেই ছোট-বড় সমস্ত রকম বিষয়ী বনেদিয়ানার তুল্যমূল্য বিচার হয়ে যাবে। আজ চারু ওইটাই চেয়ে বসল!

    আজ আলো কম। বিকেলে ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। কারেন্ট কবে আসবে কেউ জানে না। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারু দাওয়ায় বসে খেজুরপাতার চাটাই ভাঙতে ভাঙতে কানের আন্দাজে ঠাহর করে নিচ্ছে যুগলের বাড়িতে কতজন আত্মীয় ঢুকল। আজ কেউ আর চারুকাকি বলে সম্বোধন করছে না। সন্ধ্যা হলেই মঙ্গল মধুময় কেউ না কেউ ওর দাওয়ায় আসে। বিড়ি ধরিয়ে গল্পগুজব করে। আজ কারও দেখা নেই। অথচ চটিজুতোর আওয়াজ বলছে অন্য কথা! লম্ফের সলতেটা নখ দিয়ে টেনে শিখাটা বাড়িয়ে দিল চারু। কিন্তু না! কেউ বিড়ি ধরাতেও এল না। না আসুক। এতে চারুর কিচ্ছু যায় আসে না।

    এমন সময় সানাই বেজে ওঠে। সন্ন বলে, “শুনছ ঠাম্মি? পরালী পিসির বর এয়েচে!”

    হ্যাঁ তো! ঘুরে ঘুরে সানাই বাজছে। বড় বাড়ি তো, অনেক টাকা খরচ করে বেহাগ এনেছে। চারু কান পাতল। আহা! বাজছে যেন কান্নার মতো! চারুর বুকের মধ্যে মোচড় মেরে উঠল। আহা রে! হয়ত মেয়ের মায়ায় যুগলটা অজ্ঞান হয়ে গেছে! চারুর ইচ্ছে হয় ছুটে যেতে। এয়োতিরা কী যে করছে কে জানে। চারু উঠোনে নেমেও আবার চার পা পিছিয়ে আসে। এবার সে ওখান থেকেই আপনমনে বিড়বিড় করে ওঠে, “আত্মীয়রা কি সবাই এল? বৈঠক কেন বসে না এখনো? রান্না হয়ে গেছে সেই কোন বেলা থাকতে থাকতে! গরমের কাল। ভাত-জল থাকে? পচে যাবে না! চারু নিজের চোখে এখন সব দেখতে পাচ্ছে। পরালীর নাক অব্দি সিঁদুর ধেবড়ে আছে। যেন বিসর্জনের প্রতিমা! কুকুরগুলো কমলদের কল পাড়ে খুব কেঁইমেই করছে। হয়ত এঁটোপাতে খুব বেশি মাছ পড়ে আছে। চারু নিজের মনেই হিসহিস করে ওঠে, এত নষ্টতামি করার কী আছে বাপু! খাবি। পারলে আরেখান নিবি। নষ্ট করবি কেন রে! রাত বাড়ে। কেউ চারুখুড়ি বলে ডাকে না। দুয়েক বার কান্নার সাথে খ্যাকানির শব্দ এল। তারপর সব চুপ। হয়ত কেউ বারণ করছে। এত রাতে কাঁদতেও তো কষ্ট তাই না? চারু আবার ডাকে, “ও সন্ন, শুয়ে পড়লি?”

    সন্ন খিদে মাখা মুখখানা কাঁচুমাচু করে বলে, “সবাই চলে গেল ঠাম্মি? আলো সব নিভিয়ে দিচ্ছে যে বড়?”

    চারু চাটাই ভাঙানো ফেলে গাছের নিচে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়াল।

    হ্যাঁ, যুগলদের বাড়ির লোকজনের সবারই প্রায় খাওয়া হয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের ঘরে এখন কুটুম্বুদের শুতে দেবার জন্যে বালিশ-কাঁথা চেয়ে হাঁকাহাঁকি শোনা যাচ্ছে। চারু চাটাই বোনে। কাঁথাও কেচে রেখেছে মেলা। কাচতে হয়। কেউ যদি আগাম খবর পায় গ্রামে লোককুটুম ঢুকবে অমনি ঘাটে কাচাকাচির ধুম পড়ে যায়। আলোমাটি দিয়ে ঘর উঠোন নিকোয়। তারপর গড়ে গড়ে বিছেন পড়ে। পঞ্চাশ ষাট একশো যে যেখানে পারো শোও। কেউ বারণ করবে না। ভরপেট খাওয়ালে তো হবে না। শোবার জায়গাও দিতে হবে। আর এই দায়টুকু বহন করতে হয় চারুর মতো চালচুলোহীন পাড়াপ্রতিবেশীকেই।

    শেফালি অনেকগুলো ব্যটাছেলে নিয়ে যাচ্ছে। বোধহয় ওরা সবাই বরযাত্রী। চারুর ঘরে অনেকগুলো চাটাই। একবার ভাবল, শেফালিকে ডেকে চাটাইগুলো দেবে। পরক্ষণেই ভাবল, “চাটনা যখন পেতেছিস, চাপটা তুই নে!”

    চারু ঘরে এল। একটা টিনের তোরঙ্গ খুলে হাঁকল, “সন্ন, আলোটা উঁচু করে ধর।”

    সন্ন আলো উঁচু করে ধরল।

    চারু একে একে অনেকগুলো পুরোনো পেতল কাঁসা তোরঙ্গ থেকে টেনে টেনে বার করতে লাগল। সন্নর ঘুম পাচ্ছে খুব। এবার বেরিয়ে এল একটা লিস্টি। ঠিক যেন কেজো বাড়ির ফর্দের মতো। চারু বলল, “পড়। পারবি?”

    সন্ন ভাঙা ভাঙা বাংলায় পড়ছে,

    “রাখালের মা পিলসুজ।
    দময়ন্তী পিসি বালতি।
    হরেকেষ্ট গাড়ু।
    হরেন বিশ্বাস নগদে, টাকার অংকে একান্ন।
    গোবিন্দ কাঁসার গেলাস।
    মিহির মুখুজ্জে কোমরবিছে!”

    চারুর গাল রাঙা হয়ে উঠল! গায়ে কাঁটা দিল।

    একটা কোমরবিছে। যেটা কিনা চারু তার বউভাতের অনুষ্ঠানে পেয়েছিল। কে দিয়েছিল বিছেটা? যুগলের বাপ কুঞ্জলাল? নাকি জ্যাঠা মিহির? মনে নেই চারুর। বিছেটা আজও ঝকমক করছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক বার দেখল। সন্নর কপালে ধরল। কোমরে ধরল। হাতের তালুতে তুলে নাচিয়ে নাচিয়ে মাপল। সন্ন জিজ্ঞেস করল, “কত ভরি হবে?”

    “অনেক!”

    “বেচবে?”

    “কেন? আমার কাঠ কেনার পয়সা নেই বুঝি? সাঁকোর নিচে ফেলে দিস এমনিই উদ্ধার হয়ে যাব!” সন্ন এতসব বোঝে না। সে ঘুমে ঢুলে আসছে দেখে তোরঙ্গটার ঝাঁপ ফেলে তাড়াতাড়ি সন্নকে শুইয়ে দিল।

    পেট দলা করে শুয়ে আছে মেয়েটা! শুকনো মুখখানা আজ বড্ড মায়ামাখা মনে হল। ভিজে বাতাস হু-হু করে বইছে। তবু বুড়ির ঘুম আসে না। কুকুরগুলোও আর ডাকছে না। সন্ধ্যা থেকে খালিখালি এতটা কেরোসিন পুড়ল! এবার বুড়ি ল্যাম্ফোটা নিভিয়ে দিল! চোখ বুজলে চারু এখনও পরিষ্কার দেখতে পায়-- বৌভাতের রাতে একখান টিনের তোরঙ্গ কোলের কাছে নিয়ে বসে আছে চারু। সবাই আসছে, আর চারুর চিবুক উঁচু করে আশীব্বাদ করছে। আর খাবার আগে একখান করে জিনিস লগুতে করছে। যে যা দিচ্ছে, লিস্টিতে তাঁদের নাম লেখা হয়ে গেলে তোরঙ্গের খোলে ফেলে দিয়ে, চারু পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রণাম করছে!

    বুকের উপর কাগজখানি নিয়ে পড়ে আছে বুড়ি। শুধুমাত্র একখানা কাগজ ছাড়া আর কিছু না। কাঁসা পেতল যা ছিল সব সংসারের খিদে এসে কবেই সেসব খেয়ে গেছে! অক্ষত আছে শুধু শুভদিনের স্মৃতিটুকু।

    শখ করে ঘরে বউ আনল চারু। দুদিন আসতে না আসতে সেও চুলচেরা ভাগ পুষিয়ে নিয়ে ভেন্ন হল। চারু পণ করল ভাত দিস আর না দিস বিছেখান কিছুতেই পাবি না। একদিন চারু ঘরে কপাট না দিয়ে কাজে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে বউ তার তোরঙ্গ খুলে বিছে বার করে কাঁকালে গুঁজে উঠোনে কোট কেটে কিতকিত খেলছে। দেখে বুড়ির মাথা গেল জ্বলে! ছেলে আসতে না আসতে একখান কথা সাতখানা করে ছেলের কান ভারী করল।

    সেই রাত্রে তুমুল ঝগড়া।

    হঠাৎ দেখে আগুনের হল্কা। বুড়ি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “ও বক্কেশ্বর, এ কী সব্বনাশ করলি বাপ?”

    বক্কেশ্বর কোনও কথার জবাব দিল না। সে টিনের তোরঙ্গটা আর তার আড়াই বছরের সন্নকে ছুড়ে ফেলে দিল উঠোনে। বুড়ি আছাড় খেয়ে গিয়ে পড়ল। আর সেই সুযোগে বক্কেশ্বর বউকে আগুনের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিল। সেই যে বক্কেশ্বর নিরুদ্দেশ হল আর এল না!

    দমকা হাওয়া উঠেছে। ভিজে চোখের পাতায় হাওয়া লাগতেই চারু একটুখানি আরাম অনুভব করল। কতকাল হল মা ডাক শোনেনি চারু! এমন সময় শুনল, “খুড়ি, জাগা?”

    তুষ্টির গলা মনে হল! বুড়ি ঠেলে উঠল।

    “ও মরণ! তুই এত রাতে কেন মা?”

    “পাতিল নিয়ে এসো শিগগিরি!”

    বুড়ির চোখে এখন রংমশাল! ভাগে ভাগে খাবার এনেছে তুষ্টি! সুক্তো, মুড়িঘন্ট, বড় পাত্রে ভাত, মাছের ঝোল, চাটনি পায়েস সব সব! গন্ধে বুড়ির ঘর-বারান্দা একাকার হয়ে যাচ্ছে!

    বুড়ি তুষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “যুগল কনে? ওর একদলা দিয়েছিস?”

    তুষ্টির আর কাঁদবার সামর্থ্য নেই। সে আঁচলে আবেগ সামাল দিতে চেষ্টা করল, “রাত বেশি বাকি নেই। পাত্র নিয়ে এসো শিগগিরি!”

    “আ মরণ! এত পাতিল পাব কনে? কনে কোনটা গড়াগড়ি খাচ্চে তার ঠিক আছে?”

    তুষ্টি পাত্র রেখে চলে গেল।

    বুড়ি সন্নর গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল, “খাবি? ওঠ!”

    সন্ন দুয়েক বার মোচড় মারল। মুখ দিয়ে টকাস টকাস শব্দ করল। চারু বকুনি দিল, “হেঁই, কী চাবাচ্চিস? আমড়া নাকি আমলকি?” চারু জানে সন্নর যেদিন খুব খিদে পায়, সেদিন সে স্বপ্নের মধ্যে আম আমড়া খুঁজে বন্ধুদের সঙ্গে এডালে ওডালে দোল খায়!

    সকাল বেলা সাঁকোর মুখে একগাদা মানুষ। যুগলের মেয়ে-জামাই চলে যাচ্ছে। সন্ন তখনো ওঠেনি। ঢোলের আওয়াজ পেয়ে মানুষ ঘুমচোখে হাঁসের মতো দৌড়াচ্ছে। চারু তাড়াতাড়ি তোরঙ্গটা পাড়ল। কোমরবিছেটা আঁচলে কোনোমতে জড়িয়ে নিয়েই দৌড় দিল।

    কাপালিদের কালীমন্দির, হরনাথের দোলঘর সব জায়গায় প্রণাম করতে হবে। অনেকটা সময় লাগবে। এ গ্রামে বরযাত্রীদের তাড়াহুড়ো করতে মানা। মেয়ে-জামাইয়ের আগে আগে একজন আছে। ওর দায়িত্ব নতুন ধুতি বিছিয়ে দেওয়া। যাতে কনে যখন গড় হয়ে প্রণাম করবে, ওর শাড়ি কাপড়ে ময়লা না লাগে। গ্রামের আরও কত কাকা খুড়োর চোখ মুছিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে তবে আসতে হয়। নইলে মানুষ নিন্দে করবে না! বাপ বিদায় দিতে পারে। কিন্তু চাইলেই কি আর গাঁ গেয়াতি ছেড়ে আসা যায়?

    মেয়ে-জামাই দাঁড়াল এসে সাঁকোর মুখে। জজ্ঞুর বউ থালা বরবে। জজ্ঞুর বউ সুরী। সে সাঙ্ঘাতিক ভালো থালা বরতে পারে। ও নাকি বিয়ের আগে অষ্টক দলে নাচত। ওর নাচ দেখার জন্যে গ্রাম ঝুঁকে পড়েছে। ঢোলক বাজছে। সানাই বাজছে। উলুপির হরিষ আর থামে না। সে ডাকল, “এই সুরী আয়!”

    সুরী পেট চেপে বলল, “এই অবস্থায় ঠিক হবে নাকো!”

    এবার উলুপি কথার উকুন টিপে বলল, “উঁহু! পাঁচেই এই? তোর বরের বিয়েতে আমি নমেসে পেট নিয়েও নেচেছি!... মনে নেই?”

    বাঁশিওয়ালার ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে। এখন বাজছে, “একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি!” উলুপি উসখুস করে উঠল, “এই গান চলবে না। পালটাও।

    এবার বাজল, “বলি ও ননদী আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে/ ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে!” অমনি সাথে সাথে হল্লা!

    এখন কিলো দেড়েক ওজনের ভারী একখানা কাঁসার থালা সুরীর তালুর ওপরে চক্রের মতো ঘুরছে। সুরীর সে কী নাচ! যেন দমকা হাওয়া।

    বরপক্ষের লোকেরাও বড়মুখ করে বলে উঠছে, “ছোট্ট একখানা সাঁকো তার কী যেন এক ক্ষমতা। একেবারে সাতসমুদ্র মিলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে!”

    এ পক্ষও কমে যায় না। ওরাও অহংকার মাখিয়ে বুক উঁচু করে বলে যাচ্ছে, “এমনটাই এ গ্রামের পরম্পরা। সবাই তো আর অনুষ্ঠানবাড়ি যেতে পারে না। আমরা যারা ডাক পাইনে, তারা এখানে দাঁড়িয়েই আমাদের বারোয়ারি সম্পর্কগুলোকে নিজেদের মতো করে নবীকরণ করে নিই।”

    সুরীর হাত ঘুরে থালা এখন উলুপির হাতে। এমন সময় ঘটল এক বিপত্তি। থালা উড়ে গিয়ে পড়ল জলে। সবাই থ। সুরীর শাশুড়ি আজ ওকে আস্ত রাখবে না! কী হবে এখন? সুরী হাঁপাচ্ছে খুব। কাঁদতেও লজ্জা। অনেকেই বলল, “একখান থালা তো, নাবলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তাছাড়া বরণ সম্পন্ন হয়নি তো! সবাই আবদার করল কেউ একটু যেন তুলে দেয়। হদ্দ শ্যাওলা। কে নামবে? কেউ নামবে না। তুষ্টি করুণ চোখে একবার চারুর দিকে চাইল। সে চাউনিতে কী যেন এক মিনতি! “কাল শেষ রাতে অনেকটা খাবার দিয়ে গেছে তুষ্টি। মুখের ওপর না বলি কীকরে?” চারু ভাবল। এবার সে ঝাঁপ দিল।

    থালার সাথে কাদা উঠল। কাদা মাখামাখিও হল। বুড়ির জয়জয়কার! পরালীর শ্বশুরবাড়ির লোক বুড়িকে খুব প্রশংসা করল। তুষ্টি পরিচয় করিয়ে দিল, “এটা তোমার ঠাম্মা শাশুড়ি হয়!” জামাই প্রণাম করল।

    পরালী প্রণাম করতে এসে বুড়ির কাদামাখা বুকের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল।

    বুড়িও অনেক কাঁদল।

    সাঁকোর খুঁটি ধরে আত্মীয়রা আগে আগে পার হয়ে গেল। একসাথে অনেক জন ওঠা বারণ। এখন জামাই পার হচ্ছে। তারপরে মেয়ে।

    বুড়ি ডাকল, “ও সোনা শোন!”

    পরালী গুঁড়োর ওপর পা টিপে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    কোমরবিছেটা পরালীর কাঁকালে সবার সেক্ষেতে পরিয়ে দেবে। সবাইকে জানিয়ে দেবে বুড়ি নিঃস্ব নয়! কিন্তু বিছেটা কোথায় গেল? না কোত্থাও নেই। বুড়ি একে একে কাপড়ের সবটুকু খুলে ফেলল। বুঝল তার সর্বনাশ হয়ে গেছে! আঁচলের গিঁট শূন্য! সাঁকোর ওপর থেকে ফের ঝাঁপ দিল চারু।

    বিছেটা কনে হারিয়ে মরলাম রে! চারু হাঁউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

    অনেকেই উঠে আসতে বলল, “জল থিতুক। উঠে এসো।” বুড়ি উঠল না।

    এখন বেলা অনেক। তুষ্টি আবার ঘাটে এসেছে। ওর সাথে অনেক জা জাউলি। চারু চেয়ে চেয়ে দেখছে বিছে খুঁজতে নয়, ওরা এঁটো মাজতে এসেছে। ওরা মেয়েমদ্দ মিলে গত রাত্রের রান্নার কড়াইয়ের কালি ঘষে ঘষে তুলল।

    পচা বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সন্ন। রাতের ঢাকা খাবার পাত্রগুলো কোলে নিয়ে সে জানতে চাইল, “ঠাম্মি, ওরা পাতিলগুলো চাচ্ছে। দিয়ে দেব?”

    চারু সন্নর দিকে তাকাবার সময় পেল না। পাগলের মতো সে আঁচলে কাদা তুলে চালনির মতো করে চালতে লাগল!

    সন্ন বাসনগুলো নিয়ে জলের ধারে নেমে এল।

    খাবারগুলোর অবস্থা দেখে তুষ্টির একেবারে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হল। তুষ্টি রে রে করে উঠল, “কত অহংকার হয়েছে তোদের? এতগুলো খাবার এইভাবে নষ্ট করে কেউ?”

    একজন বলল, “ডালে তো ফ্যানা উঠে গেছে বউদি! এই বাসনে গন্ধ থাকবে অনেকদিন! এত দামি দামি জিনিসে ওদের মতো মানুষকে দাও কেন?”

    ওরা এবার পচা বাসি খাবারগুলো দূরে শ্যাওলার মধ্যে চেলে চেলে ফেলতে লাগল! চারুর কোলের কাছেও কালো কুচকুচে একদলা ভেসে এল। পচে গেলেও গন্ধটা কিন্তু এখনো সেই…

    বুকজলে দাঁড়িয়ে চারু এখন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে!



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments