• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • মান্টো منٹو : সাদাত হাসান মান্টো
    translated from Urdu to Bengali by মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: শুভময় রায়



    [তাঁর কলমের শক্তি সম্পর্কে সাদাত হাসান মান্টো অতি সচেতন ছিলেন। এই কারণেই বোধহয় ১৮ অগস্ট ১৯৫৪ এক স্টেনোগ্রাফারকে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় নিজের সমাধিলিপিটি নিজেই লিখে যান। অত্যন্ত রোমহর্ষক সেই পঙ্‌ক্তিগুলো অবশ্য লাহোরে তাঁর সমাধির ওপর স্মৃতিফলকে খোদাই করা হয়নি। মান্টোর পরিবার ভয় পেয়েছিল যে স্মরণলিপিতে ওই কথাগুলো লেখা হলে প্রাচীনপন্থী এবং মৌলবিরা ক্রুদ্ধ হবেন। মায়ের পরামর্শমত ৭৮৬ সংখ্যাটি দিয়ে শুরু করে নিজের প্রস্তাবিত সমাধিলিপিতে মান্টো লিখেছিলেন: ‘এখানে শুয়ে আছেন সাদাত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গেই কবরস্থ আছে ছোট গল্প লেখার সব শিল্প আর রহস্য... টন টন মাটির নিচে শুয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবছেন কে শ্রেষ্ঠ গল্পকার: আল্লাহ্‌ নাকি তিনি নিজে।’

    এ হেন লেখক যে একটি চিত্তাকর্ষক স্মারক রেখে যেতে চাইবেন, তা বলাই বাহুল্য। নিজের জন্য একটি স্মারক পুস্তকের পরিকল্পনাও সাদাত হাসান মান্টো করেছিলেন। ‘নাখুন কা কর্জ়’ ছিল প্রস্তাবিত বইয়ের নাম। সংকলনটিতে মান্টো ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের পর্যবেক্ষণ। হাফিজ় হোশিয়ারপুরি সেই বন্ধুদের একজন। মান্টো তাঁকে বলেছিলেন: ‘আমার ব্যক্তিত্বের উদ্ঘাটন হল সেই নখের ঋণ। আমার ইচ্ছে আমার বন্ধুরা সে ঋণ যত শীঘ্র সম্ভব শোধ করুন।’

    ‘নাখুন কা কর্জ়’ (আক্ষরিক অর্থে নখের ঋণ) শব্দবন্ধটি লেখক সৃষ্টি করেছিলেন প্রিয়তম কবি মির্জ়া গালিবের একটি শের স্মরণ করে। সেই শেরটিতে কবি গালিব বলেছেন একটা আধ-খোলা গিঁট তাঁর দুঃখের কারণ যা এক জোড়া তীক্ষ্ণ নখই কেবল খুলতে পারে। মান্টোর আশা ছিল বন্ধুদের পক্ষে তাঁর ব্যক্তিসত্তার গিঁটগুলোর উন্মোচন সম্ভব হবে। মান্টোর আকস্মিক মৃত্যুতে যে সব কাজ বাকি রয়ে গেল তার মধ্যে একটি হল ‘নাখুন কা কর্জ়’-এর প্রকাশ। তবে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে লেখক স্বয়ং নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করে লিখেছিলেন একটি মজার প্রবন্ধ। সে সংক্ষিপ্ত রচনাটিতে মান্টো নিজেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের গিঁটগুলো খোলার। সেটি এবার ‘পরবাস’ এর পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হল।

    ইন্টারনেটে মূল উর্দু রচনাটি পাবেন এখানে। ]


    মান্টো নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা আর বলা হয়ে গেছে। পক্ষে কম, বিপক্ষেই বেশি। সে সব রচনা পাঠ করলে বুদ্ধিমান পাঠকের পক্ষেও মান্টো সম্পর্কে কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো সম্ভব হবে না। আমি লিখতে বসেছি বটে, কিন্তু বুঝি যে মান্টো সম্পর্কে আমার ধারণা প্রকাশ করা কতটা কঠিন। তবে এক দিক থেকে দেখলে সহজও বটে, কারণ আমি মান্টোর কাছাকাছি পৌঁছোনোর সুযোগ পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী আমি মান্টোরই দোসর।

    এখন পর্যন্ত এই ব্যক্তি সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে তা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি এটুকু বুঝি যে সেই সব প্রবন্ধে যা লেখা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। কেউ কেউ শয়তান, আবার অন্য কেউ হয়ত ন্যাড়ামাথা দেবদূত বলে তাকে সম্বোধন করেছে। ...একটু দাঁড়ান!...আমি একটু দেখে নিই কমবখ্‌তটা এখানেই কোথাও দাঁড়িয়ে শুনছে কি না। ...না, না...ঠিক আছে। আমার মনে পড়েছে যে এটা তার মদ্যপান করার সময়। সন্ধ্যে ছটার পর তেতো শরবত খাওয়া তো তার অভ্যেস।

    আমরা জন্মেছিলাম এক সঙ্গে আর মনে হয় মরবও তাই। তবে এমনও হতে পারে যে সাদাত হাসান মরে গেল, কিন্তু মান্টো হয়ত মরল না। এই চিন্তাটা প্রায়ই আমাকে খুব দুঃখ দেয়। এই কারণে যে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বজায় রাখতে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। যদি সে বেঁচে থাকে আর আমি মরে যাই তা হলে ডিমের খোলটা তো পড়ে থাকবে, কিন্তু ভেতরের হলুদ আর সাদা অংশটা গায়েব হয়ে যাবে।

    আমি খুব বিস্তারিত বিবরণে যেতে চাই না। শুধু এটুকু আপনাদের সাফ বলে দিতে চাই যে মান্টোর মত ‘ওয়ান-টু’ আদমি আমি কখনও দেখিনি – যাদের যোগ করলে তিনজন হয়ে যেতে পারে। ত্রিভুজ সম্পর্কে তার জ্ঞান পর্যাপ্ত হলেও আমি জানি যে এখনও পর্যন্ত তার মধ্যে তিনের সম্মীলন ঘটেনি। এই ইঙ্গিতগুলো এমনই যে অত্যন্ত সংবেদনশীল পাঠক ছাড়া আর কেউ এর মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারবে না।

    এমনিতে তো মান্টোকে আমি তার জন্ম থেকেই চিনি। আমরা দুজনে এক সঙ্গে একই সময়ে ১১ মে ১৯১২ তারিখে জন্মেছিলাম। কিন্তু সে হামেশাই নিজেকে কচ্ছপ করে রাখতে চেয়েছে। যদি একবার মাথা আর গলা খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল তো আপনি লাখো চেষ্টা করলেও আর তাকে খুঁজে পাবেন না। তবে শেষমেশ আমি তো তার দ্বিতীয় সত্তা। আমি তার সব অঙ্গভঙ্গি আর ইশারার পাঠ নিয়ে রেখেছি।

    নিন, এবার আমি আপনাদের বলব যে গাধাটা ছোট গল্পের লেখক হল কেমন করে। সাহিত্যের সমালোচকরা খুব লম্বা-চওড়া প্রবন্ধ লেখেন। তাঁদের জ্ঞান প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। শোপেনহাওয়ার, ফ্রয়েড, হেগেল, নিটশে, মার্ক্সের উল্লেখ করেন। কিন্তু আসলে বাস্তব থেকে তাঁরা বহু ক্রোশ দূরেই থেকে যান।

    মান্টোর ছোট গল্প রচনা দুটি পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সংঘাতের পরিণাম। ওর পিতা – খোদার কৃপায় তিনি শান্তিতে থাকুন – খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন। আর ওর মা আবার ছিলেন খুবই নরম মনের মহিলা। এই দুই জাঁতাকলের ভেতরে চাপে পড়ে গমের দানা কেমন আকৃতি নিয়েছিল তা আপনারা নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নিতে পারবেন।

    এবারে ওর স্কুল জীবনের দিকে তাকানো যাক। খুব বুদ্ধিমান কিন্তু ভীষণ দুষ্টু ছেলে ছিল সে। তখন তার উচ্চতা খুব বেশি হলে সাড়ে তিন ফুট। বাপের শেষ সন্তান। বাপ-মায়ের ভালোবাসা তো সে পেয়েছিল। কিন্তু তার তিন দাদা – যারা বয়সে ওর থেকে অনেক বড় ছিল আর বিলেতে শিক্ষাগ্রহণ করছিল – তাদের সঙ্গে তার কখনই সাক্ষাতের সুযোগ ঘটেনি। বোধহয় এই কারণে যে তারা তার সৎভাই ছিল। তাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তার ছিল; সে চাইত যে ছোট ভাই হিসেবে সেই দাদাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হোক। সে সম্পর্ক তার ভাগ্যে তখন জুটল যখন সাহিত্যের দুনিয়া তাকে একজন খুব বড় গল্পকার হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে।

    আচ্ছা, তা হলে এবার তার ছোট গল্প লেখার শৈলী নিয়ে বলা যাক। সে একজন প্রথম শ্রেণির প্রতারক। ‘তামাশা’ শিরোনাম দিয়ে প্রথম যে গল্পটি লেখে তার বিষয় ছিল জালিয়ানওয়ালা বাগের গণহত্যা। কিন্তু গল্পটা সে নিজের নামে ছাপায়নি। শুধু এই কারণেই সে পুলিশের গ্রেফতারি এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। এর পরে তার অস্থির চপলমতি চিত্তে যেন একটা ঢেউ খেলে গেল। ইচ্ছে হল আরও পড়াশুনো করে। এখানে যা পাঠকের আগ্রহের উদ্রেক করতে পারে তা হল এই যে সে এনট্রান্স পরীক্ষায় দুবার ফেল করার পরে পাশ করেছিল, তাও থার্ড ডিভিশনে। আপনারা এটা শুনলেও আশ্চর্য হবেন যে সে উর্দু পেপারে পাশ করতে পারেনি।

    এখন লোকে যখন বলে যে সে উর্দুর একজন খুব বড় সাহিত্যিক, তখন আমার হাসি পায়। কারণ উর্দু সে এখনও জানে না। শব্দের পেছনে এমন ভাবে ধাওয়া করে যেন জাল নিয়ে কেউ মৌমাছির পেছনে ছুটছে। কিন্তু মৌমাছিরা কখনই তার জালে ধরা দেয় না। এই জন্যই তার লেখায় সুন্দর সব শব্দের অভাব। সে লাঠি ঘোরানো পছন্দ করে। কিন্তু এটা বলতেই হবে যে তার ঘাড়ে যত লাঠির ঘা পড়েছে, তা সে আনন্দের সঙ্গেই সয়েছে।

    সাধারণ বাগ্‌ধারা অনুযায়ী যাকে জাঠেদের লাঠিবাজি বলা হয়, তার লাঠিবাজি তেমন ছিল না। সে ছিল দক্ষ মুগুরবাজ। এমন একজন মানুষ যে সোজা রাস্তায় চলে না। বরং টান টান করে বাঁধা দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটে। লোকে ভাবে এই বুঝি পড়ে গেল...কিন্তু কমবখ্‌তটা আজ পর্যন্ত কখনও এমন পপাত ধরণীতলে হল না যে আর উঠতে না পারে। আমি জানি মরার সময়ও সে মানুষকে বলবে পড়ে যাওয়ার হতাশাকে খতম করার জন্যই সে পড়ে গেল।

    আমি তাকে অনেক বলেছি যে মান্টো একজন প্রথম সারির জালিয়াত। তার আরও প্রমাণ এই যে সে প্রায়ই বলে গল্প নিজেই নাকি তাকে খুঁজে বেড়ায়, সে গল্পের খোঁজে ছোটে না। এটা তো এক ধরনের জোচ্চুরি। কিন্তু আমি জানি যখন তাকে গল্প লিখতে হয়, তখন তার সেই অবস্থাই হয় যা মুরগির ডিম পাড়ার সময় হয়। তবে সে লুকিয়ে চুরিয়ে ডিম দেয় না। সকলের সামনে পাড়ে। দোস্ত ইয়ারেরা সব বসে আছে, তার ছোট ছোট তিনটে মেয়ে খুব কোলাহল জুড়েছে – আর সে তার নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে পা তুলে বসে ডিম পেড়ে যাচ্ছে। এই ডিমগুলোই পরে চুঁ চুঁ আওয়াজ করতে করতে গল্প হয়ে যায়। বিবি তাকে নিয়ে খুবই অনুতাপ করে। তাকে প্রায়ই গল্প লেখা ছেড়ে একটা দোকান খুলতে বলে। কিন্তু মান্টোর মনের মধ্যে যে দোকান খোলা আছে সেখানে তো যে কোনও মনিহারি দোকানের তুলনায় অনেক বেশি জিনিস সাজানো আছে। এই জন্য প্রায়ই সে ভাবে যে যদি কখনও স্টোর খোলে, তা হলে সেটা যেন কোল্ড স্টোরেজ না হয়ে যায়...যেখানে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা আর ধ্যানধারণা বরফের মত জমাট বেঁধে থাকবে।

    আমি লেখাটা লিখছি আর আমার ভয় হচ্ছে যে মান্টো আমার ওপর রেগে যাবে। তার আর সব কিছু বরদাস্ত করা যায়, কিন্তু রাগ মেনে নেওয়া যায় না। ক্রুদ্ধ হলে সে একদম শয়তানের মত আচরণ করে। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যই। তবে সেই কয়েক মিনিট একমাত্র আল্লাহ্‌ই আপনার আশ্রয়দাতা হতে পারেন।

    গল্প লেখার সময় সে নানারকম ভানভনিতা করতে থাকে। কিন্তু তার দোসর বলেই জানি যে সে সবই আসলে জোচ্চুরি। সে নিজেই একবার লিখেছিল যে তার পকেটে নাকি অসংখ্য ছোট গল্প পড়ে থাকে। তবে বাস্তব এর ঠিক বিপরীত। যখন তাকে সত্যিই গল্প লিখতে হয়, তখন সে রাত্তিরে বসে ভাববে...কিন্তু কিছুই ভেবে পাবে না। সকাল পাঁচটায় উঠে খবরের কাগজ থেকে কোনও গল্পের রস চুষে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হবে। তারপরে সে স্নানের ঘরে ঢুকবে। সেখানে তার বিশৃঙ্খল মাথাটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করবে যাতে আবার সেটা চিন্তাভাবনা করার উপযুক্ত হয়। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টাও বিফলে যাবে। এরপরে সে খিটখিট করতে করতে কোনও কারণ ছাড়াই বিবির সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দেবে। এতেও কাজ না হলে বাইরে পান আনতে বেরোবে। সে পান তার টেবিলের ওপর পড়ে থাকবে, কিন্তু গল্পের বিষয় তখনও তার মনে আসবে না। শেষমেশ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সে কলম বা পেন্সিল হাতে তুলে নিয়ে পাতার মাথায় ৭৮৬ সংখ্যাগুলো লিখবে। এটা লেখার পরে তার মাথায় যে ভাবনাই আসুক না কেন, তাই দিয়েই সে গল্প লেখা শুরু করে দেবে। ‘বাবু গোপীনাথ’, ‘টোবা টেক সিং’, ‘হতক’, ‘মাম্মি’, ‘মোজ়ইল’ ইত্যাদি সব ছোট গল্পই সে এই রকম জোচ্চুরি করেই শুরু করেছে।

    আজব ব্যাপার হল লোকে তাকে অধার্মিক আর অশালীন মানুষ বলে মনে করে। আমারও মনে হয় যে কিছুটা হলেও সে ওই পঙ্‌ক্তিভুক্ত। প্রায়শই সে অত্যন্ত গভীর বিষয় নিয়ে লেখার জন্য কলম ধরে এমন সব শব্দ ব্যবহার করে যা আপত্তিজনক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমি জানি যে যখনই সে কোনও বিষয়ে লিখতে বসে, প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতে ৭৮৬ অবশ্যই লিখবে যার অর্থ হল বিসমিল্লাহ্‌...অর্থাৎ আমি আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে শুরু করছি। বোঝা যাচ্ছে, এই ব্যক্তি যার ঈশ্বরে কোনও বিশ্বাস নেই, সে কাগুজে ধার্মিক বনে যায়। এ সেই ‘কাগজি মান্টো’ যাকে আপনারা 'কাগজি বাদাম' অর্থাৎ পাতলা খোসার কাঠবাদামের মত শুধু আঙুলের চাপেই ভেঙে ফেলতে পারেন। যদিও আসলে সে এমন একজন মানুষ যাকে লোহার হাতুড়ি দিয়েও ভাঙা যাবে না।


    এবারে মান্টোর ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করব। কয়েকটি অভিধার সাহায্যেই তাকে বর্ণনা করা যায়। সে চোর, সে মিথ্যেবাদী, সে শঠ, সে বাগ্‌বিস্তার করতে ভালোবাসে।

    সে প্রায়ই বিবির ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে তাঁর কাছ থেকে শত শত টাকা চুরি করেছে। কখনও যদি আট শো টাকা এনে দিয়েছে, তো নজর করে দেখে রেখেছে সে টাকা কোথায় রাখা হয়েছে। পরের দিন সেখান থেকে একটা সবুজ নোট গায়েব হয়ে গেছে। এই লোকসান যখন বেচারা বিবির নজরে এসেছে, তখন তিনি নিরীহ চাকরবাকরদের আচ্ছা করে বকুনি দিয়েছেন।

    এমনিতে তো মান্টোর সত্যবাদী হিসেবে খ্যাতি আছে। তবে আমি এ ব্যাপারে একমত নই। সে এক নম্বরের মিথ্যেবাদী। প্রথম দিকে তার এই মিথ্যে কথাগুলো বাড়ির ভেতরেই চলত। বোধহয় তাতে মান্টোর একটা বিশেষ ‘টাচ’ থাকত বলেই। কিন্তু পরের দিকে বিবি বুঝে ফেলেছিলেন যে মান্টো তাঁকে এখন পর্যন্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যা কিছু বলেছেন তার সবই মিথ্যে। মিথ্যে বলার ব্যাপারে মান্টোর পরিমিতি জ্ঞান থাকলেও, মুস্কিল হল এই যে তার ঘরের লোকেরা এটা ভাবতে শুরু করল যে তার সব কথাই মিথ্যে। মান্টোর মিথ্যেবাদিতা তখন হয়ে গেল কোনও মহিলার গালে সুরমা দিয়ে আঁকা তিলের মত।

    মান্টো অশিক্ষিত। এই কারণে যে সে কখনও মার্ক্স পড়েনি। ফ্রয়েডের কোনও বইও আজ পর্যন্ত সে খুলে দেখেনি। হেগেলের নামটাই সে শুধু জানে। হ্যাভলক এলিসেরও নামটাই শুধু শুনেছে। কিন্তু মজার কথা হল লোকেরা – আমি বলতে চাইছি সাহিত্যের সমালোচকরা – বলেন এই সব চিন্তাবিদের প্রভাব তার ওপর পড়েছে। যতদূর আমি জানি অন্য কারও চিন্তাভাবনা মান্টোকে কখনই প্রভাবিত করে না। তার মনে হয় যারা তাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে তারা সবাই বোকা। দুনিয়াটাকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা, নিজে নিজেই তাকে বুঝতে হয়। নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে তাই মান্টো সকলের বোঝার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। কখনওসখনও এমন উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলে যে আমার হাসি পায়। আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের বলতে পারি যে মান্টো – অশ্লীলতার জন্য যার বিরুদ্ধে অনেকবারই মামলা দায়ের করা হয়েছে – বড়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ। কিন্তু আমাকে এটাও বলতে হবে যে সে এমনই এক পাপোশ যে নিজের ওপরই সব সময় ঝাড়ু চালিয়ে চলেছে।


    [১] নিজের পারিবারিক নামটি নিয়ে তিনি মজা করে বলতেন ‘(ম)আন-টু’ অর্থাৎ এক আর দুই। বোঝাতে চাইতেন যে দুটি সত্তা সব সময় তাঁর মধ্যে কাজ করে। অনুসন্ধান চালাতেন তৃতীয় কারও জন্য।...অনুবাদক


    অলংকরণ (Artwork) : উইকিপেডিয়া
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments