• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • দা লাস্ট সোনাটা : সম্বিৎ বসু



    ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের কথা। অ্যামেরিকায় থাকি। অফিসের কাজে ইউরোপ যাচ্ছিলাম। কিঞ্চিৎ আগে স্যান ফ্র্যানসিসকো থেকে হিথরো পৌঁছেছি। জুরিখের ফ্লাইট ধরব। আমার এয়ারপোর্টে আগে পৌঁছতে বেশ লাগে। পোড়-খাওয়া ট্র্যাভেলার হয়ে যাইনি বলেই বোধহয়। আগে পৌঁছে, চেক-ইন করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে নিই। তারপরে সাধারণত কোন একটা বারের বাইরে পাতা চেয়ার-টেবিলে পানীয় নিয়ে বসে জনস্রোত দেখি। চমৎকার লাগে। লোক দেখতে দেখতে অনেকরকম খেলা মনে মনে খেলা যায়। এবারও তাই বসেছিলাম। ভালই ভিড় আছে দোকানে আর এয়ারপোর্টে। স্রোতের মতন লোক চলেছে গেটের দিকে। কেউ ধীরে, কেউ হনহন করে, কেউ ফোনে কথা বলছে। কেউ যাচ্ছে পরিবার নিয়ে। দুজন খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। একটা বড় দল গেল, অধিকাংশই কিশোর। কখনও দুজন পুরুষ আর নারী হেঁটে গেল, হয়ত গোমড়া মুখে। এয়ারপোর্টের কর্মী কোন বয়স্কর হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্রোতের অধিকাংশই সাহেব। কালো লোকও আছে। বাদামীর সংখ্যা কম। আর তখনই দেখলাম ভদ্রলোককে। পেছন ফিরে বার থেকে পানীয় নিচ্ছিলেন। গায়ে হাল্কা খয়েরি রঙের টুইডের জ্যাকেট, প্রায় একই রঙের প্যান্ট। সরু রিমের চশমা। খুবই সৌম্য ও সুদর্শন চেহারা। বয়েস পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ হবে। ব্যাকব্রাশ করা সোনালি চুলে রূপোলি ঝিলিক।

    ড্রিংক নিয়ে ইতিউতি চাইছিলেন ফাঁকা টেবিলের সন্ধানে। নেই। তারপর আমাকে একা দেখে আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন, "মে আই?" "অবশ্যই অবশ্যই।" ভদ্রলোকের হাতে স্বচ্ছ একটা ড্রিঙ্ক। কিছুটা কৈফিয়তের সুরেই বললেন, "আজ খুব ভিড়। সাধারণত এই জায়গাটা ফাঁকাই থাকে।" ভদ্রলোক সুইস। কথাপ্রসঙ্গে নিজেই বললেন। ঝরঝরে ইংরিজি বললেও হাল্কা একটা একটা ইউরোপিয়ান টান আছে। তবে সে টান ফ্রেঞ্চ, না সুইস না কোথাকার - সে বোঝার মতন এলেম আমার নেই। নাম স্তেফান ফেবার। দেখে মনে হয় ধনী লোক। কোটের কাট, হাতের ঘড়ি, পায়ের জুতো সবই মনে হয় দামী। মানে খুব দামী। যাবেন বললেন জিনিভা। আমি জুরিখ পৌঁছব আজ, বেসপতিবার। পরের তিন দিন ইচ্ছে আছে জুরিখের আশপাশটা ঘুরে দেখব। শুনেছি খুব সুন্দর শহর। স্তেফানবাবুকে বললাম সে কথা। বললেন, "সবচেয়ে ভাল হবে যদি একটা কনডাক্টেড টুর নিয়ে নিন। হাতে সময় থাকলে নিজে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা সবথেকে ভাল। কিন্তু তিন দিনে আর কতই বা দেখবেন। তার চেয়ে কনডাক্টেড টুর নিয়ে নিন। প্রথম দিন অনেক কিছু দেখা হয়ে যাবে। তার মধ্যে কোন কোন জায়গা যদি বিশেষ ভাল লাগে, দ্বিতীয় আর তৃতীয় দিন সেখানে বেশি সময় কাটাতে পারেন। আমি নতুন কোথাও গেলে সাধারণত তাই করি।" স্তেফানবাবু প্রায়ই অ্যামেরিকা যান - তবে প্রধানত নিউ ইয়র্ক আর শিকাগো। এ কথা সে কথার মধ্যে উঠে গিয়ে নিজের জন্যে একটা আর আমার জন্যে একটা ড্রিঙ্ক নিয়ে এলেন। আমি 'আবার আপনি কেন আমার জন্যে ...' এই সব ভদ্রতার জবাবে বললেন, পরেরটা আপনার অ্যাকাউন্টে।

    - বার কাউন্টারে কী বলাবলি করছে জানেন? আইসল্যান্ডে অগ্ন্যুৎপাতের জন্যে যে ছাই উড়ে আসছে, তার জন্যে নাকি প্লেন ছাড়তে দেরি করবে।

    সে কথা ঠিক। পুরো আকাশ ঘোলাটে হয়ে আছে। তবে লন্ডনের আকাশ ঘোলাটে হয়ে থাকার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। স্যান ফ্র্যানসিসকোর ফ্লাইটেও এই নিয়ে কথা হচ্ছিল যে ফ্লাইটের রাস্তা বদল হয়ে যাবে কিনা। শেষ অব্দি সেরকম কিছু হয়নি। এ ফ্লাইট লেট হলে অবশ্য আমার খুব অসুবিধে হবে না। আজ রাত্তিরে পৌঁছলেই হল। নইলে অবশ্য সাইট-সিইঙের ভাগে কম পড়ে যাবে।

    আমরা যেখানে বসেছিলাম তার সামনেই ছিল দুটো বড় মনিটর। প্লেন অ্যারাইভাল আর ডিপারচার ইনফরমেশনের বোর্ড। আমরা এসব কথা বলছি আর দেখছি অ্যারাইভাল আর ডিপারচারের সময়গুলো ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। আমার ফ্লাইটের যদিও অনেকটাই দেরি, ভাবছিলাম আমার ফ্লাইটও পিছিয়ে গেল কিনা দেখে আসি। সেই সঙ্গে স্তেফানেরও। আমাদের একই এয়ারলাইন, সুইস এয়ার। স্তেফানের ফ্লাইট আমার ফ্লাইটের মিনিট পনেরো আগে। কাজেই তাঁরও হাতে সময় আছে। উঠছি-উঠব করতে করতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। অ্যারাইভাল আর ডিপারচারের টাইমগুলো সব একসঙ্গে পাল্টে গেল। কী লেখা হল অত দূর থেকে পড়তে পারছিলাম না, কিন্তু সব লেখাগুলোই এক মনে হল। এর একটাই মানে হয়। সব ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেল। স্তেফান 'এই কেলো করেছে' টাইপের কী একটা বলে লাফিয়ে উঠে পড়লেন। সঙ্গে আমিও। ছুট লাগালাম সুইস এয়ারের কাউন্টারে। শুধু আমরাই নয়। পুরো এয়ারপোর্টই ছুটছে নিজের নিজের এয়ারলাইনের কাউন্টারে। কাউন্টারে পৌঁছতে পৌঁছতে সেখানে দেখি প্রচুর ভিড় জমে গেছে। আমারা ইতি-উতি খোঁচা মেরে যা বুঝলাম যে আইসল্যান্ডের অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ইউকে-ই শুধু নয় পুরো কন্টিনেন্টাল ইউরোপই বিমান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত করে দিয়েছে। 'দা ইওরোপিয়ান এয়ারস্পেস হ্যাজ বীন ক্লোজড ফর দা কমার্শিয়াল ফ্লাইটস টিল ফারদার নোটিস'। বলে কী রে!

    স্তেফান আমার আস্তিনে টান দিলেন। "চলে আসুন। এখানে থেকে কিছু হবে না। আমাকে কালকের মধ্যে জিনিভা পৌঁছতেই হবে। এয়ারস্পেস ছ'ঘন্টার জন্যে বন্ধ হলেও, খোলার পরে এয়ার ট্রাফিক স্বাভাবিক হতে অন্তত আরও দুদিন লাগবে। অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে।" আমি ধন্দে পড়লাম। অন্য কোন ব্যবস্থা? ট্রেন? স্তেফান বললেন, "এখন যে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই খুব রাশ হবে।" আমি ভাবছি একটা গাড়ি ভাড়া করে নেব। তাও এক্ষুনি না গেলে পাব না। আপনি আমার সঙ্গে ইচ্ছে হলে আসতে পারেন। আপনাকে জিনিভা থেকে জুরিখের বাসে বা ট্রেনে তুলে দেব।" স্তেফান হাঁটতে শুরু করেছেন। সঙ্গে আমিও। জিগেস করলাম, "এখান থেকে জিনিভা কতক্ষণ লাগবে গাড়িতে?" এমনিতে বারো-চোদ্দ ঘন্টা লাগার কথা। আজ ঘন্টা আষ্টেক চালিয়ে পথে কোথাও রাত কাটিয়ে সকাল-সকাল আবার শুরু করলে কাল দুপুর নাগাদ স্বচ্ছন্দে জিনিভা পৌঁছে যাব। এখন দেখার বিষয় যে গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।"

    স্তেফান দেখলাম করিতকর্মা লোক। গাড়ির কাউন্টারে সটান ঢুকে গেলেন। দূর থেকে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে কী সব বোঝাচ্ছেন। এদিকে ভিড় জমতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে লাইন থেকে কিউ হয়ে শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াল বাংলার ঋ ছাড়া আর কোন বর্ণ দিয়ে তাকে বোঝানো যায় না। অবশেষে স্তেফান বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফিরে এলেন। স্তেফানের নাকি রেন্টাল কোম্পানির একেবারে টপ টিয়ার মেম্বারশিপ আছে, প্ল্যাটিনাম-টাম ছাড়িয়েও অন্য কিছু। সে দিয়েও আজ কিছু হচ্ছিল না। শেষ অব্দি কীভাবে যেন ম্যানেজ হয়েছে। স্তেফান ছুট লাগালেন পার্কিঙে। আমি তার সঙ্গে।

    গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনর সময়েও বিরাট লাইন। হিথরো থেকে ডোভার প্রায় একশো মাইল রাস্তা, গাড়িতে ঘন্টা দেড়-দুইয়ের বেশি সময় লাগার কথা নয়। লাগল প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। সেখানে থেকে ইউরোটানেল ধরে ইংলিশ চ্যানেলের তলা দিয়ে ক্যালেতে গিয়ে ফ্রান্সে ঢোকা। ক্যালে থেকে ইমিগ্রেশন করে বেরোতে বেরোতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। কফিটফি খেয়ে, একটু হাত-পা মেলেই আবার ড্রাইভিং। এবার গাড়ি চলল সাঁই সাঁই করে। ঠিক হয়েছে রাত কাটাব লঁ বলে একটা ছোট শহরে। সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছে যাব। স্তেফান দেখলাম এসব জায়গার হাল-হকিকত সম্বন্ধে খুবই ওয়াকিবহাল। ইংরিজি ছাড়াও গড়গড় করে বলতে পারেন ফ্রেঞ্চ আর জার্মান। লঁ-তে থ্রি কোর্স ডিনার করে ট্রেন স্টেশনের উল্টোদিকে একটা হোটেলে উঠলাম।

    পরদিন সকালে সাতটায় লবিতে এসে দেখি স্তেফান রেডি হয়ে অপেক্ষা করছেন। একটা কফি আর ক্রসোঁর রসদ নিয়ে গাড়িতে বসলাম। স্তেফান বললেন আমরা যাচ্ছি লে লক্‌ল বলে একটা শহরে। সেখানেই স্তেফানের পৈত্রিক আবাস। জিনিভার থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা উত্তরে, জুরা মাউন্টেনে। যা গল্প বললেন তা শুধু চিত্তাকর্ষকই নয়, এমন লোকের সঙ্গে যে আমার কোনদিন আলাপ হবে ভাবতেই পারিনি। স্তেফান ফেবারদের সাত পুরুষের ঘড়ির ব্যবসা। যেখানে ওঁদের পৈতৃক বাসস্থান সে জায়গাটাকে সুইটজারল্যান্ডের ওয়াচ ভ্যালি বলে। দক্ষিণে জিনিভা থেকে উত্তরে ব্যাসেল - ফ্রান্স সীমান্ত ধরে জুরা মাউন্টেনের এই প্রায় আড়াইশো মাইল অঞ্চল সুইস ঘড়িশিল্পের আঁতুড়ঘর। স্তেফান বললেন, "রিস্ট-ওয়াচের উৎপত্তির গল্পটা জানেন তো? আগে ইউরোপিয়ান পুরুষদের মধ্যে খুব গয়না পরার চল ছিল। তার মধ্যে সুইস পুরুষরাও ছিলেন। যা হয়, ধনীদের মধ্যে গয়না পরার রেষারেষি অসম্ভব বেড়ে গেছিল। জাঁ ক্যালভিন বলে এক সমাজ-সংস্কারক ১৫৪১ সাল নাগাদ ফরমান দিলেন যে পুরুষদের গয়না পরা আর চলবে না। স্যাকরা আর মণিকারদের তো মাথায় হাত পড়ে গেল। এক ধাক্কায় অন্তত আর্দ্ধেক ব্যবসা গায়েব। তো তখন তারাই রিস্টওয়াচের উদ্ভাবন করলেন। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। এটা ১৫০০ শতাব্দীর ঘটনা। সে সময় থেকেই জিনিভাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের জুরা মাউন্টেন অঞ্চল জুড়ে ওয়াচমেকিং ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে।"

    আমার যা মনে হচ্ছিল তা বলেই ফেললাম, "আপনি কি এই ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করেন?" স্তেফান হাসলেন, "আমাদের সাত পুরুষের ঘড়ির ব্যবসা। প্যাটেক ফিলিপের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।" প্যাটেক ফিলিপের নাম কে না শুনেছে। বিশ্বের অন্যতম নামী ও দামি ঘড়ির কোম্পানি।

    - প্যাটেক ফিলিপ কোম্পানির শুরু আর আমাদের কোম্পানির শুরু প্রায় একই সময়ে - ১৮৪০। তবে আমাদের কোম্পানির নাম আপনি শুনবেন না। আমরা খুব কম ঘড়ি তৈরি করি। যা করি সব ছোট ব্যাচে প্রাইভেট অর্ডারে। গেল প্রায় দেড়শ বছর আমাদের মূল ব্যবসা অন্য ঘড়ি কোম্পানির জন্যে মুভমেন্ট তৈরি করা। আমরা প্রায় দেড়শ ছোটবড় ঘড়ির কোম্পানিকে মুভমেন্ট সাপ্লাই করি। মুভমেন্ট সাপ্লাইতে আমরাই সুইটজারল্যান্ডে এক নম্বর, বিশ্বে প্রথম পাঁচে। একটা অ্যামেরিকান আর দু-তিনটে জাপানি কোম্পানি আমাদের থেকে এগিয়ে।

    - সাত পুরুষ ধরে একটা পরিবারেই এত বড় একটা ব্যবসা, সেটা খুবই আশ্চর্যের।

    - সুইস অনেক ব্যবসাতেই দেখবেন এই রকম ব্যবস্থা। অ্যামেরিকান বা ব্রিটিশ ম্যানেজমেন্ট স্টাইল ওল্ড স্কুল ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো কোনদিনই নিজের করে নেয়নি। আমাদের পরিবারে অবশ্য কুদরতেরও খেল আছে।

    - কীরকম?

    - আমার যে পূর্বপুরুষ ব্যবসা শুরু করেছিলেন তাঁর নাম ছিল অলব্রেখট। অলব্রেখট ফেবার। তাঁর থেকে শুরু করে আজ অব্দি প্রত্যেক প্রজন্মে ছেলে জন্মেছে একটিমাত্র। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। মেয়ে অনেক হয়েছে। আমারই এক বোন আছে। কিন্তু ফেবার পদবিতে প্রতি প্রজন্মে ছেলে একজনই। ফলে কোম্পানির মালিকানায় অনেক ভাগ হয়েছে - মেয়েরা, সেখান থেকে তাদের পরিবার - সবাই শেয়ার পেয়েছে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট রয়ে গেছে আমাদেরই হাতে। তবে ম্যানেজমেন্টে মেয়েদের দিক থেকেও অনেকে আছেন। আমাদের লিডারশিপ টিমের সবাই কোন-না-কোনভাবে সম্পর্কিত।

    শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। শুধু ব্যবসার বহর শুনেই নয় - সে তো আছেই - কিন্তু এরকম একটা বিরাট ইন্ডাস্ট্রির পরিবারতন্ত্রের কথা শুনে। স্বভাবতই প্রশ্ন এল মনে, "আপনারও কি এক ছেলে?" স্তেফান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

    - একই ছেলে। বেঁচে থাকলে আজ কুড়ি বছর বয়েস হত। কনসার্ট পিয়ানিস্ট হত। এগারো-বারো বছর বয়েস থেকে পাবলিক রিসাইটাল করত। আমার বোন জিনিভা ফিলহার্মোনিকের সেকেন্ড ভায়োলিনিস্ট হয়েছিল। সে বলে এরিকের মতন পিয়ানিস্টের সঙ্গে সে আগে কখনও বাজায়নি।

    বেশ কিছুক্ষণ নীরবে গাড়ি চলল। বুঝতে পারছিলাম না স্তেফানকে ছেলে সম্বন্ধে প্রশ্নটা করে ঠিক করেছি কিনা। বেশ একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল অজান্তেই। রেডিওতে একটা ফ্রেঞ্চ স্টেশন চলছিল। খবরের স্টেশন মনে হল। অনেকবার আইসল্যান্ড শব্দটা শুনলাম যেন। তা ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। রাস্তাটাও বেশ নির্জন। খুব বেশি গাড়ি নেই - আপ-ডাউন কোনদিকেই। কিছুক্ষণ পরে স্তেফানই কথা বললেন।

    - মাসকুলার ডিসট্রফি নিয়ে জন্মেছিল। অল্পবয়েসেই ধরা পড়েছিল। আমাদের সত্যি বলতে পয়সার অভাব নেই। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। চিকিৎসায় ভালই ছিল। ডাক্তাররা বলেছিল ম্যানেজ করে অনেক বছর চলবে। তদ্দিনে হয়ত স্টেমসেলের কোন চিকিৎসা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু পনেরো বছরের জন্মদিনের দিন থেকে হঠাৎ ডিজেনারেট করল। ষোল পূর্ণ করার আগেই সব শেষ। চার বছর আগে।

    এর পরে আর সেরকম গল্প জমল না। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে একটা ছোট শহরে কফি খেতে থামলাম। কফির পরে যাত্রা শুরু করে দেখলাম স্তেফান অনেকটা সহজ হয়েছেন। এমনি সাধারণ কথাবার্তা হল। লন্ডনে একটা ফ্ল্যাট আছে। কাজে-কর্মে যেহেতু প্রায়ই লন্ডন আসতে হত, সেজন্যে ফ্ল্যাট থাকলে সুবিধে। ছেলে চলে যাবার পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই লন্ডনে চলে গেছিলেন। পৈতৃক হাভেলিতে পুত্রহারা মা-র দমবন্ধ হয়ে যেত। তাই তিনি লন্ডনেই থাকেন। স্তেফান মাঝেমধ্যে কাজেকর্মে জিনিভায় আসেন। পৈতৃক বাড়ির দেখভাল করে একজন পুরনো বাটলার। বাড়ির অধিকাংশই বন্ধ থাকে। একটা অংশ বাসযোগ্য করে রাখা হয় বছরভর, কারণ স্তেফান প্রায়ই যাওয়া-আসা করেন। সময়ে সময়ে কোন বিশেষ ক্লায়েন্টদেরও নিয়ে আসেন, বাড়িতেই থাকতে দেন।

    স্থির হল, যাবার পথে জিনিভা একটু ঘুরে যাব। কারণ পরে আর সুযোগ হবে না। এত কাছেই যখন এসেছি জিনিভা লেক দেখে যাই। স্তেফানের বাড়িতে রাত্রিবাস। সকালে স্তেফান আমাকে বার্ন শহরের বাস স্টেশনে নাবিয়ে দেবেন। সেখান থেকে বাসে করে জুরিখ চলে যাব। বললেন,"বাসে যান। ট্রেনের তুলনায় বাস ছাড়েও ঘন ঘন, আর সস্তাও পড়বে। লং ডিস্ট্যান্স হলে ট্রেন বলতাম, অনেক আরামদায়ক। কিন্তু এটা দু ঘন্টাও লাগবে না।"

    জিনিভা লেক ঘুরে, সেখানেই একটা দামি রেস্তোঁরায় চমৎকার সুইস ডিনার করে স্তেফানের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আরেকবার হতবাক হলাম। অন্ধকারে ভাল দেখা না গেলেও, বুঝতে পারলাম এ পুরনো দিনের ক্যাসল টাইপের বিশাল বাড়ি। পাথরের তৈরি। সামনে মস্ত জমি। পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা উঠে সদর দরজা। আমরা অবশ্য সদর নয়, পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকলাম। একটা ছোট ফ্ল্যাটের মতন অংশ। সামনে ফয়ার - একদিকে একটা করিডোর চলে গেছে - সেখানে স্তেফানের ঘর, রান্নাঘর, প্যান্ট্রি ইত্যদি। অন্য একটা করিডোরে দুটো ঘর। তার একটায় আমি থাকব। আর একটা দিক, যেটা মূল বাড়ির সঙ্গে সংযোগ - সেখানে একটা বিরাট ঘর - বোধহয় অন্তত শতখানেক লোক অনায়াসে ধরতে পারে। স্তেফান জানালেন, সেটা পার্লার রুম। কোন এক সময়ে পরিবারের নিজস্ব চেম্বার অর্কেস্ট্রা ছিল, তারা এখানে পারফর্ম করত। এখন সে ঘরে গোটা তিনেক পিয়ানো আর বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র রাখা। বিরাট বিরাট জানলা, লম্বা ভারী পর্দা ঝুলছে।

    খুবই ক্লান্ত ছিলাম। স্তেফান বললেন, "আজ আমার ছেলের চতুর্থ মৃত্যুদিন। আমি আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকব। আপনি শুয়ে পড়ুন। সকালে তাড়া নেই। যখন খুশি উঠবেন। ঘরে কফি আর সামান্য ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে। তৈরি হয়ে ধীরেসুস্থে বেরোলেই হবে। সারাদিনই ঘন্টায় ঘন্টায় বার্ন থেকে জুরিখের বাস যায়।"


    মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। হাল্কা পিয়ানোর শব্দ আসছে। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত আড়াইটে। আমি শব্দ না করে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখলাম পার্লার রুমের দরজা আধ-ভেজান, ভেতর কিন্তু অন্ধকার। সেই ঘর থেকেই পিয়ানোর শব্দ আসছে। বুঝলাম এক শোকসন্তপ্ত পিতা তার পুত্রশোক ভুলতে সঙ্গীতকে আশ্রয় করেছেন। এও বুঝলাম এ পরিবারের রক্তে সঙ্গীত। রেকর্ডে ছাড়া এরকম পিয়ানো বাজান শুনিনি। কিছুক্ষণ শুনে হঠাৎ খেয়াল হল আমার বোধহয় এভাবে আড়ি পেতে বাজনা শোনা ঠিক হচ্ছে না। হয়ত খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি ঘরে ফিরে এলাম।

    পরের দিন ঘুম ভেঙেছে দেরিতে। ঘরেই কফি আর ক্রয়সোঁ রাখা ছিল। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে দেখি স্তেফান রেডি। আমাকে দেখে বললেন, "আমি খবর নিয়েছি। এখন বেরোলে স্টেশনে পৌঁছনর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আপনি বাস পেয়ে যাবেন।" আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সাধারণ টুকিটাকি কথা হল অঞ্চলটা নিয়ে। অসম্ভব সুন্দর জায়গা। চতুর্দিকে তুষারাবৃত আল্পস। শীতের আমেজ এখনও আছে, কিন্তু বসন্ত আসছে বোঝা যাচ্ছে। যদিও আকাশ বেশ ঘোলাটে। আইসল্যান্ডের এফেক্ট। বেশ কিছুটা যাবার পরে আমি স্তেফানকে বললাম, "আপনাকে একটা কথা আমার জানানো উচিত।" আগের রাতের ঘটনাটা আমি বললাম। "গর্হিত কিছু না হলেও, আপনার একান্ত ব্যক্তিগত এক শোকের প্রকাশে আমি রবাহুতর মতন চলে গেছিলাম বলে খুব দুঃখিত।" স্তেফান কিছু বললেন না।

    স্টেশনে পৌঁছে একেবারে গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্তেফান গাড়ি থেকে বেরোলেন। আমি তাঁকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। আমার জন্যে যা করলেন এই দুদিন, কোন ভাষা দিয়েই তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় না। আমি শেষ গুডবাই বলে চলে আসার আগে স্তেফান আমার হাতটা চেপে ধরলেন। "আশা করি আপনি কিছু মনে করেননি। কী জানেন, এরিক চলে যাবার পরে আমার স্ত্রী এমা সিভিয়ার ডিপ্রেশনে চলে গেছে। এখন সে ইনস্টিটিউশনালাইজড। মানে হাসপাতালই তার দীর্ঘস্থায়ী আবাস। মাঝে মাঝে মনে হয় আমারও যেন বাস্তব আর কল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কি কোনদিন এরিক ছিল? শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে থাকত, হাসত, খেলত, বাজাত সেটাই কেমন এখন অলীক মনে হয়। যতদিন এরিকের সামর্থ্য ছিল, শনিবার রাতে আমাদের পারিবারিক মজলিশ বসত পার্লার রুমে। আমার বোন আসত ওর পরিবার নিয়ে মাঝে মাঝে। অন্য আত্মীয়রাও আসত। খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো আর তার সঙ্গে এরিকের বাজনা। যেদিন আমার বোন তার সঙ্গত করত, সেদিন পুরো মিউজিকাল ব্লিস। এরিক সবসময় বাজনা শেষ করত বেঠোফেনের শেষ লেখা সোনাটা দিয়ে। এই বাজনাটা তার খুব প্রিয় ছিল - দা লাস্ট সোনাটা। ওটা বাজলেই বুঝতাম এরিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের মজলিশ ভেঙে যেত।

    "আমি বছরে এইদিন আসি, শুধু এই বাজনাটা বাজাবার জন্যে। এটাই আমাদের তিনজনের শেষ যোগসূত্র। মনে করতে ভাল লাগে, এই বাজনা যখন বাজাই - এমা আর এরিক যেন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।"

    আমাকে স্তম্ভিত করে রেখে স্তেফান চলে গেলেন।


    আমি সেদিন বাস মিস করেছিলাম।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments