• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • শেষ স্যালুট آخری سلیوٹ : সাদাত হাসান মান্টো
    translated from Urdu to Bengali by মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: শুভময় রায়



    [দেশভাগের পরে কাশ্মীরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাদাত হাসান মান্টো রচিত দুটি গল্পের একটি 'পরবাস'-এর আগের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গল্পটির অনুবাদ দেওয়া গেল এবার। যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বাল্য বন্ধু দুটি ভিন্ন পক্ষের হয়ে লড়তে বাধ্য হয়েছে। কেমন সে অনুভূতি?

    ভারত-পাকিস্তান দুটি ভিন্ন দেশ হয়ে যাওয়ার পরেই অক্টোবর ১৯৪৭-এ কাশ্মীর নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরনটা কেমন হবে তা তখনই আন্দাজ করতে পারছিলেন লেখক। কাশ্মীরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার চার বছরের মধ্যে তিনি লিখে ফেলেন এই গল্পটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে আসা মুসলমান, হিন্দু, শিখ সেপাইরা কয়েক বছরের মধ্যেই অন্য একটি রণক্ষেত্রে হয়ে গেল পরস্পরের প্রাণঘাতী শত্রু।

    মূল উর্দু গল্পটি নেওয়া হয়েছে নিউ দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত কুল্লিয়াত-এ-মান্টো'র প্রথম খণ্ড থেকে। ]


    কী আজব কাশ্মীরের এই লড়াইটা! ভাবলে সুবেদার রব নওয়াজ়ের মনে হয় তার মাথাটা যেন একটা বন্দুক যার ঘোড়াটা বিকল হয়ে গেছে।

    গত বড় যুদ্ধে অনেক রণাঙ্গনে সে লড়েছে। কীভাবে মারতে হয় আর মরতে হয় তা জানে। বাহাদুর আর সমঝদার সেপাই বলে ছোট-বড় অফিসাররা তাকে সম্মানের চোখে দেখত।

    প্ল্যাটুন কমান্ডার প্রায়ই কঠিন কাজের দায়িত্ব তারই ওপর সঁপতেন। সেও সে সব গুরুদায়িত্ব সামলাতে সফল হত। কিন্তু এই লড়াইটার ঢংই যে অদ্ভুত রকমের। মনে খুব উৎসাহ আর খুশি নিয়ে সে এসেছিল। খিদে-তেষ্টা ভুলে লক্ষ্য ছিল একটাই – দুশমনদের সাফাই। কিন্তু শত্রুপক্ষের সামনে পড়লে চেনা-পরিচিত মুখ নজরে আসত। কেউ কেউ এমনও থাকত যারা পুরোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু – এখন শত্রু হয়ে গেছে। এরা বিগত যুদ্ধে মিত্রপক্ষের শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করেছিল।

    সুবেদার রব নওয়াজ় ভাবত এসব স্বপ্ন নয় তো! শেষ বড় যুদ্ধের ঘোষণা, বাহিনীতে নাম লেখানো, উচ্চতা আর ছাতির মাপ দেওয়া, পি.টি., চাঁদমারি আর তারপর রণাঙ্গনে চলে যাওয়া। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে করতে করতে শেষমেশ যুদ্ধের সমাপ্তি। তারপরে একদম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা আর তার সঙ্গে এই কাশ্মীরের যুদ্ধ। ওপর তলায় কত কী হল! রব নওয়াজ় ভাবত যে যারা এই সব কারসাজি করেছে তারা ভেবেচিন্তেই করেছে। যাতে অন্যরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়, বুঝতে না পারে। না হলে এত জলদি এত বড় বিপ্লব কীভাবে ঘটতে পারে?

    এটুকু তো সুবেদার রব নওয়াজ়ের মাথায় ঢুকেছিল যে সে কাশ্মীর হাসিল করার জন্য লড়ছে। কাশ্মীর কেন দখল করতে হবে সেটাও সে বেশ বুঝতে পেরেছিল। পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। কিন্তু নিশানা স্থির করার সময় পরিচিত কারও মুখ নজরে এলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই যেত কেন লড়াই করছে। কোন্‌ লক্ষ্যে বন্দুক ধরেছে। আর সে মূলত এই কারণে তা ভুলে যেত – নিজেকে বার বার স্মরণ করাতে হত – যে এবার শুধু বেতন, এক টুকরো জমি বা পদকের জন্য সে লড়ছে না। নিজের দেশের জন্য লড়ছে। এ দেশ আগেও তারই দেশ ছিল। সে সেই এলাকার অধিবাসী যা আজ পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছে। এখন তাকে সেই সব স্বদেশীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে যারা এক সময় তার প্রতিবেশী ছিল, যেসব পরিবারের সঙ্গে তাদের বহু প্রজন্মের সম্পর্ক। কিন্তু এখন হঠাৎই তারা তার কাছে বিদেশি হয়ে গেছে, এমন দেশের লোক যার জলও সে যেন কোনও দিন খায়নি। আর তার সেই সব বন্ধুদের কাঁধে বন্দুক রেখে হুকুম করা হয়েছে – যাও, যেখানে তোমার ঘরের জন্য দু-আঁটি খড়ও বাছা হয়নি, যার হাওয়া আর জলের স্বাদও তুমি এখনও সেভাবে পাওনি, সেটাই তো এখন তোমার দেশ। যাও, সেই দেশের হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ো, সেই পাকিস্তান যার হৃদয়ের কেন্দ্রস্থলে তুমি জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে এসেছ।

    রব নওয়াজ় ভাবত এই একই হাল হয়েছে সেই সব মুসলমান ফৌজিদের যারা হিন্দুস্থান থেকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছে। সেখানে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।আর এখানে এসে তারা আর কিছু না পেলেও হাতে বন্দুক পেয়ে গেছে। সেই একই ওজনের, একই মার্কা আর ছাপের, একই রকম দেখতে বন্দুক।

    পেটের জন্য, পুরস্কার আর সম্মানের জন্য নিজেদের শত্রু ভেবে নিয়েছিল এমন মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগে তাদের লড়তে হত। এখন তো তারা নিজেরাই দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আগে সকলকে হিন্দুস্থানি ফৌজি বলে ডাকা হত। এখন একদল পাকিস্তানি, অন্যরা হিন্দুস্থানি। ওধারে হিন্দুস্থানে এমন ফৌজি ছিল যারা মুসলমান। তাদের কথা ভাবতে শুরু করলে রব নওয়াজ়ের মনে সব যেন গড়বড় হয়ে যেত। আর কাশ্মীরের কথা ভাবলে তো তার মাথাই কাজ করত না। পাকিস্তানি সেনারা কাশ্মীরের জন্য লড়ছে নাকি কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য? যদি তাদের কাশ্মীরি মুসলমানদের জন্যই লড়তে হয়, তা হলে হায়দরাবাদ আর জুনাগড়ের মুসলমানদের জন্যই বা তাদের লড়ানো হচ্ছে না কেন? আর যদি এই যুদ্ধ বিশুদ্ধ ইসলামি যুদ্ধ হয়, তা হলে পৃথিবীতে তো আরও ইসলামি দেশ আছে। তারাই বা এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না কেন?

    অনেক ভাবনা চিন্তার পর রব নওয়াজ় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোল যে ফৌজিদের এই সব জটিল বিষয় নিয়ে ভাবা একদম উচিত নয়। তারা মোটা বুদ্ধির মানুষ। বুদ্ধি কম হলেই ভালো সেপাই হওয়া যায়। তা সত্ত্বেও, প্রকৃতিগত কারণে সে মাঝে মাঝে এই সব ভাবতে বাধ্য হত। পরে এই সব কাজকর্মের কথা ভেবে ভীষণ হাসি পেলেও।

    কিষণ গঙ্গা নদীর ধার দিয়ে যে সড়কটি মুজফ্‌ফরাবাদ থেকে কিরণ পর্যন্ত গেছে, সেখানে কিছুদিন ধরে লড়াই চলছিল। এক অদ্ভুত লড়াই। রাতে কখনও সখনও আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজের বদলে বাছা-বাছা গালিগালাজের গুঞ্জরন উঠত।

    একবার সুবেদার রব নওয়াজ় প্ল্যাটুনের জওয়ানদের নিয়ে শত্রুপক্ষের দিকে তাক করে গুলি ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় দূরে খাতের নিচ থেকে গালিগালাজের আওয়াজ আসতে সে ঘাবড়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন পাঁচ ভূতে মিলে নাচছে আর অট্টহাস্য করছে। রব নওয়াজ় বিড়বিড় করল, ‘খিনজ়ির কে দুম, যত সব! হচ্ছেটা কী?

    এক জওয়ান চিৎকার করে গালি দিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল। তারপরে রব নওয়াজ়কে বলল ‘সুবেদার সাব, ওরা গালি দিচ্ছে। মায়ের ইয়ার সব!’

    গালি রব নওয়াজ়ের কানে পৌঁছোচ্ছিল – সে বুঝছিল যে তাদের প্ররোচিত করার জন্যই ওই সব গালাগাল দেওয়া হচ্ছে। মন চাইছিল এখুনি পাল্টা দেয়, কিন্তু একটু ভেবে মনে হল অমন করলে ভুল হবে। তাই সে শান্ত হয়েই রইল। কিছুক্ষণ তার জওয়ানরাও চুপ রইল। কিন্তু পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই ওদিক থেকে আবার ভেসে এল তারস্বরে গালি। রব নওয়াজ়ের পক্ষে এ ধরনের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। সে দু-তিনবার জওয়ানদের শান্ত থাকতে বললেও শত্রুপক্ষের গালিগালাজ এমনই অশ্রাব্য যে কোনও মানুষ তার উত্তর না দিয়ে থাকতে পারবে না।

    শত্রুপক্ষের সেনারা নজরের বাইরে ছিল। রাতে তো অন্ধকারই থাকে, কিন্তু দিনের বেলাতেও তাদের দেখা যেত না। শুধু তাদের গালির আওয়াজ নিচে পাহাড়ের ধাপ থেকে উঠে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। রব নওয়াজ়ের প্ল্যাটুনের জওয়ানরা সেই গালির জবাব দিলে মনে হত যেন সে আওয়াজ নিচের দিকে না গিয়ে ওপর দিকে উড়ে যাচ্ছে। এই হয়রানিতে বিরক্ত হয়ে সেপাইরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল।

    পাহাড়গুলোয় একটা আশ্চর্য ব্যাপার রব নওয়াজ়ের চোখে পড়েছিল। চড়াইয়ের দিকটা পাহাড়ি মহীরুহ আর চারাগাছে ভরে থাকত। কিন্তু উতরাই হত কাশ্মীরি বন্ধুদের মাথার মত ন্যাড়া। আবার কোনও পাহাড়ের চড়াই হয়ত গাছপালাহীন, অথচ উতরাইয়ের দিকে গাছের পর গাছ। লম্বা পাইন গাছের ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুচের মত পাতার ওপর ফৌজিদের বুট পিছলে যেত।

    যে পাহাড়ে সুবেদার রব নওয়াজ়ের প্ল্যাটুন ছিল তার উতরাইয়ের দিকটা গাছপালা আর ঝোপঝাড় থেকে মুক্ত। শত্রুপক্ষ ভয়ানক হামলা চালালেও সব জওয়ান তৈরি ছিল। গালিগালাজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা অস্থির হয়ে উঠেছিল। আক্রমণ হল, তা সফলও হল। দুজন জওয়ান মারা গেল, চার জন জখম হল। দুশমনদের তিন জন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিল। বাকীরা তাদের কিছু রসদ পেছনে ফেলে ভেগে পড়ল।

    সুবেদার রব নওয়াজ় আর তার জওয়ানদের আক্ষেপ শত্রুপক্ষের কাউকে তারা জীবন্ত পাকড়াও করতে পারেনি। তেমন কেউ তাদের হাতে পড়লে গালির উত্তর মুখোমুখি দিয়ে মজা লোটা যেত। কিন্তু এই ট্রেঞ্চটা দখল করার ফলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পাহাড় তাদের কব্জায় এল। সুবেদার রব নওয়াজ় ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ এই খবর প্ল্যাটুন কমান্ডার মেজর আসলামকে জানালে শৌর্যের জন্য তাকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

    প্রায় সব পাহাড়ের মাথায় জলের জন্য একটা পুকুর থাকত। এ পাহাড়েও এমন একটা পুকুর ছিল যা অন্যান্য পাহাড়ের তুলনায় বড়। তার জল ভারি পরিষ্কার আর স্বচ্ছ। কড়া শীতের মরসুম হলেও সকলেই স্নান করে নিল। ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে গেলেও কোনও পরোয়া নেই। সেনারা যখন স্নানে ব্যস্ত, তখন আবার গুলির আওয়াজ। সকলে উলঙ্গ অবস্থাতেই শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সুবেদার রব নওয়াজ় খান দূরবিন লাগিয়ে নিচে ঢালের দিকে নজর করে দেখলেও দুশমনরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা বোঝা গেল না। এরই মধ্যে আরও একবার ফায়ার হয়ে গেল। দূরে উতরাইতে একটা ছোট পাহাড়ের ঝোপের মধ্যে থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে তৎক্ষণাৎ নিজের জওয়ানদের গুলি চালানোর হুকুম দিয়ে দিল।

    এদিক থেকে ধড়াদ্ধড় ফায়ার চলল। জবাবে ওদিক থেকেও গুলি ছুটে এল। সুবেদার রব নওয়াজ় দূরবিন দিয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শত্রুর পজ়িশন বোঝার চেষ্টা করল। তারা বড়সড় কতগুলো পাথরের আড়ালে জায়গা নিয়েছে। কিন্তু সে সুরক্ষা দেওয়াল বড়ই ছোট। খুব অনেকক্ষণ তাদের পক্ষে সেখানে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব হবে না। একটু নড়াচড়া করলেই সুবেদারের ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে এসে যাবে।

    কিছুক্ষণ ফায়ারিং চলল। তারপরে রব নওয়াজ় জওয়ানদের আর গুলি নষ্ট না করার আদেশ দিল। শুধু শত্রুদের দিকে তাক করে থাকলেই চলবে। শত্রুপক্ষের কোনও সেপাই পাথরের দেওয়ালের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এদিক-ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করলেই তাকে উড়িয়ে দেওয়া হবে। এই হুকুম দেওয়ার পর নিজের উলঙ্গ শরীরের দিকে চেয়ে রব নওয়াজ় বলল ‘শুয়োরের লেজ! কাপড়জামা ছাড়া মানুষকে কী উজবুকের মতই না দেখায়!’

    দীর্ঘ বিরতির পর মাঝেমধ্যেই শত্রুপক্ষের দিক থেকে দুয়েকটা ফায়ার হয়েই চলল। কখনও সখনও এদিক থেকেও তার জবাব দেওয়া চলছিল। এই খেলা পুরো দুদিন জারি রইল। হঠাৎই বেশ তীব্র ঠাণ্ডা পড়েছে। এমন কড়া শীত যেন দিনের বেলাতেও রক্ত জমিয়ে দেয়। তাই সুবেদার নওয়াজ় চায়ের বিরতি ঘোষণা করে দিল। আগুনের ওপর কেতলি বসানোই থাকত। যখনই শীত জাঁকিয়ে পড়ত, গরম গরম পানীয় মিলত। তবে শত্রুদের ওপর সব সময় নজর রাখা হত। একজন হঠে গেলে আরেক জন দূরবিন হাতে তার জায়গা নেওয়ার জন্য তৈরি।

    পাহারাদার জওয়ান যখন জানাল যে পাথরের দেওয়ালের পেছনে কিছু গণ্ডগোল যেন নজরে আসছে, তখন হাড় হিম করা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জওয়ানের হাত থেকে দূরবিন নিয়ে সুবেদার রব নওয়াজ় গভীর মনোযোগে দেখল। কোনও নড়াচড়া নজরে না এলেও তখনই একটা জোরদার আওয়াজ শোনা গেল। যে আওয়াজ আশপাশের পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে কানে পৌঁছোল। রব নওয়াজ় তার মানে না বুঝলেও জবাবে একবার নিজের বন্দুকটা চালিয়ে দিল। ফায়ারের আওয়াজ মেলাতে না মেলাতেই ওদিক থেকে আবার আওয়াজ শোনা গেল। এবার কেউ যেন তাকে কিছু বলছে। রব নওয়াজ় চেঁচাল: ‘শুয়োরের লেজ! কী বলছিস্‌ বল?’

    দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। বোঝা গেল রব নওয়াজ়ের গলা শত্রুদের ট্রেঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে। কারণ সেখান থেকে কেউ বলে উঠল: ‘গালি না দে ভাই!' রব নওয়াজ় তাজ্জব হয়ে নিজের জওয়ানদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘ভাই....?' তারপরে মুখের সামনে হাত দুটি ভেঁপুর মত ধরে চেঁচাল: ‘ভাই হবে তোর মায়ের বাচ্চারা! এখানে যারা আছে তারা সব তোর মায়ের ইয়ার!'

    একদম ওপার থেকে যেন কোনও আহতের কণ্ঠস্বর ভেসে এল: 'রব নওয়াজ়!'

    সে কণ্ঠস্বর রব নওয়াজ়কে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। আওয়াজটা যেন আশপাশের পাহাড়ে মাথা কুটে চলল। 'রব নওয়াজ়.....রব নওয়াজ়' এর বিভিন্ন প্রতিধ্বনি শেষমেশ রক্ত জমিয়ে দেওয়া শীতল বাতাসের সঙ্গে মিশে কোথায় উড়ে চলে গেল।

    অনেকক্ষণ পরে রব নওয়াজ় মৃদুস্বরে বলল: ‘এটা কে?’ তারপরেই বিড়বিড় করে উঠল: ‘শুয়োরের লেজ!'

    সে এটুকু জানত যে টেটওয়ালের যুদ্ধক্ষেত্রের অধিকাংশ সেপাই ৬/৯ রেজিমেন্ট থেকে এসেছিল। সেও ওই রেজিমেন্টে ছিল। কিন্তু এ কার কণ্ঠস্বর? সে তো এমন অসংখ্য লোককে চেনে যারা এক সময় তার প্রিয় বন্ধু ছিল। কেউ কেউ এমনও ছিল যাদের সঙ্গে তার শত্রুতা ছিল ব্যক্তিগত কারণে। কিন্তু তার গালি শুনে কার এমন খারাপ লাগল যে এই রকম চিৎকার করে উঠল?

    দূরবিন লাগালেও পাহাড়ের দুলতে থাকা ইতস্তত ছড়ানো দাড়ির মধ্যে দিয়ে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। দুহাত ভেঁপুর মত ধরে রব নওয়াজ় আবার চিৎকার করল যাতে তার আওয়াজ ওদিকে পৌঁছোয় ‘ওদিকে কে? আমি রব নওয়াজ় বলছি....রব নওয়াজ়........রব নওয়াজ়...'

    এই ‘রব নওয়াজ়' নামটা কিছুক্ষণ পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে অনুরণিত হতে থাকল। রব নওয়াজ় বিড়বিড় করে উঠল: ‘শুয়োরের লেজ!' সঙ্গে সঙ্গেই ওদিক থেকে আওয়াজ জোরদার হল: ‘আমি........আমি রাম সিং!'

    নামটা শুনে রব নওয়াজ় এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যেন সে এক লাফে পাহাড় টপকে ওদিকে পৌঁছোতে চায়। প্রথমে আপন মনেই বলে উঠল: ‘রাম সিং!!' তারপরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার: 'রাম সিং....আবে রাম সিং.....শুয়োরের লেজ!'

    ‘শুয়োরের লেজের' প্রতিধ্বনি পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই রাম সিংয়ের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা গেল: ‘আবে কুমোরের পাছা!'

    রব নওয়াজ় মুখ দিয়ে হুশ হুশ শব্দ করল। সে হুকুম করার ভঙ্গিতে জওয়ানদের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল: ‘বাজে বকছে....শুয়োরের লেজ!' তারপরে রাম সিংয়ের উদ্দেশে বলল, ‘আওয়ে বাবা টাল কে কড়া পরসাদ ....আওয়ে খিনজ়ির কে ঝটকে!'

    রাম সিংয়ের অট্টহাসি শোনা গেল। রব নওয়াজ়ও জোরে হেসে উঠল। পাহাড়গুলো সে আওয়াজ খেলাচ্ছলে যেন এক অন্যের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিল। সুবেদার রব নওয়াজ়ের জওয়ানরা নীরব।

    হাসির পালা শেষ হলে ওদিক থেকে আবার রাম সিংয়ের গলা শোনা গেল: ‘দেখো ইয়ার, আমাকে এখন চা খেতে হবে।'

    রব নওয়াজ় বলল, ‘যাও, আয়েশ করো।'

    রাম সিং চেঁচিয়ে বলল: ‘আরে আয়েশ কীভাবে করব? আমাদের মাল তো সব ওদিকে পড়ে আছে।'

    রব নওয়াজ় জিগ্যেস করল, ‘কোন্‌ দিকে?'

    রাম সিংয়ের আওয়াজ এল: ‘ওদিকে, যেখানে তোমাদের গুলি আমাদের উড়িয়ে দিতে পারে।'

    রব নওয়াজ় হেসে ফেলল: ‘তাহলে তুমি কী চাইছ....শুয়োরের লেজ?'

    রাম সিং বলল, ‘আমাদের জিনিসগুলো আনতে দে।’

    ‘নিয়ে আয়,’ বলেই রব নওয়াজ় একবার নিজের জওয়ানদের দেখে নিল।

    রাম সিংয়ের গলায় উদ্বেগ: ‘তুই তো আমাদের উড়িয়ে দিবি, কুমোরের পাছা!’

    ‘বেশি বকিস না, সন্তোখ পুকুরের কচ্ছপ,’ রব নওয়াজ় যেন একটু বিরক্ত।

    রাম সিং হেসে ফেলল: ‘কসম খেয়ে বল মারবি না।’

    রব নওয়াজ় বলল: ‘কার কসম খাব?’

    রাম সিং: ‘যার ইচ্ছে হয় খা!’

    রব নওয়াজ় হাসে: ‘আবে যা, তোদের জিনিসপত্র আনিয়ে নে!'

    কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ রইল। যে জওয়ানের হাতে দূরবিন, সে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে রব নওয়াজ়ের দিকে চাইল। তাকে বন্দুক দাগার জন্য তৈরি হতে দেখে রব নওয়াজ় মানা করল: 'না....না!' তারপর সে নিজের দূরবিনটা নিয়ে দেখল। একটা লোক ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে পাথরের পেছন থেকে বেরোচ্ছে। কিছুটা দূরত্ব এইভাবে চলার পরে সে জোরে দৌড়তে দৌড়তে ভেগে গেল। কিছুটা দূরের ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। দুমিনিট পরেই তাকে হাতে কিছু মালপত্র নিয়ে ফিরতে দেখা গেল। এক পলকের জন্য দাঁড়াল। তারপরে দ্রুতগতিতে পাথরের আড়াল পেতে দৌড়োল। শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছেও গেল। লোকটা নজরের বাইরে যেতেই রব নওয়াজ় বন্দুক চালিয়ে দিল। গুলির আওয়াজের সঙ্গেই রব নওয়াজ়ের অট্টহাসি শোনা গেল। গুলির শব্দ আর হাসির অনুরণন চলল কিছুক্ষণ ধরে। তারপরেই রাম সিংয়ের আওয়াজ এল, ‘থ্যাংক ইউ!'

    রব নওয়াজ় ‘নো মেনশন' বলে জওয়ানদের দিকে তাকাল: ‘এক রাউন্ড হয়ে যাক।' যেন বিনোদনের জন্যই দুদিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হল। তারপরে আবার সব শান্ত। রব নওয়াজ় দূরবিন লাগিয়ে দেখল পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে চিৎকার করে উঠল, ‘চা তৈরি হল রাম সিং?’

    জবাব এল, ‘এখনই কোথায় আবে কুমোরের পাছা!’

    রব নওয়াজ় জাতে কুমোর। কেউ সে কথা বললে রাগে তার রক্ত টগবগ করে ফুটত। শুধু রাম সিং এটা বলে পার পেয়ে যেত, এতই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সে। একই গাঁয়ে তারা বড় হয়েছে। বয়সে মাত্র কয়েকদিনের ছোট বড়। তাদের বাপ-দাদাও একে অন্যের বন্ধু ছিলেন। প্রাইমারি পর্যন্ত একই স্কুলে পড়ে একই দিনে তারা ফৌজে ভর্তি হয়েছিল। বিগত বেশ কয়েকটা যুদ্ধে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে একসঙ্গে লড়াইও করেছে।

    তবু রব নওয়াজ়ের মনে হচ্ছিল যে সে তার জওয়ানদের চোখে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ‘শুয়োরের লেজ, এও কিছুতেই হাল ছাড়ে না।’ তারপরে রাম সিংয়ের উদ্দেশে বলল, ‘চুপ কর, আবে উকুন ধরা গাধা!’

    রাম সিংয়ের হাসি জোরদার হল। রব নওয়াজ়ের বন্দুক তাক করাই ছিল। নিছক মজা করার জন্যই যেন সে ট্রিগার টিপে দিল। তৎক্ষণাৎ গগনভেদী এক আর্ত চিৎকার। রব নওয়াজ় দূরবিন লাগিয়ে দেখল একটা লোক, না ওটা তো রাম সিং – পেট পাকড়ে পাথরের দেওয়ালের একটু বাইরে গুঁড়িশুঁড়ি মেরে এসেই লুটিয়ে পড়ল।

    রব নওয়াজ় ‘রাম সিং’ বলে তারস্বরে চিৎকার করেই এক লাফে খাড়া হয়ে গেল। সেই সময় ওদিক থেকেও তিন-চার রাউন্ড গুলি চলল। একটা গুলি রব নওয়াজ়ের ডান বাহু ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঢেকে মাটিতে শুয়ে পড়ল। এবার দুদিক থেকেই ফায়ার শুরু হয়ে গেল। ওদিক থেকে গুলি চললেও নিশানা ঠিক ছিল না। রব নওয়াজ় তার জওয়ানদের শত্রু শিবির আক্রমণ করার হুকুম দিয়ে দিল। তার তিন জওয়ান মারা গেলেও বাকিরা কোনও মতে অন্য পাহাড়টায় পৌঁছে গেল।

    রক্তে মাখামাখি হয়ে রাম সিং তখন পাথুরে জমির ওপর পড়ে আছে। গুলি তার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। রব নওয়াজ়কে দেখতে পেয়ে রাম সিংয়ের দৃষ্টি যেন উজ্জ্বল হল। হেসে বলল, ‘আবে, কুমোরের পাছা! তুই এটা কী করলি?’

    রাম সিংয়ের জখমের ব্যথা রব নওয়াজ় যেন নিজের পেটেই টের পাচ্ছে। তবু সে হেসে রাম সিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে হাঁটু গেড়ে রাম সিংয়ের বেল্টটা খোলার চেষ্টা করল। ‘শুয়োরের লেজ! তোমাকে কে বাইরে বেরোতে বলেছিল?’

    বেল্ট খোলার চেষ্টা করতেই রাম সিং যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। বেল্ট খুলতে দেখা গেল আঘাত অত্যন্ত গুরুতর। রাম সিং বন্ধুর হাত চেপে ধরে বলল, ‘আমি তো বাইরে বেরিয়েছিলাম তুই যাতে আমাকে দেখতে পাস – আর তুই – আবে রব নওয়াজ়কে পুত্তর – গুলি চালিয়ে দিলি?’

    রব নওয়াজ়ের গলা বুজে এল: ‘কসম খেয়ে বলছি, আমি তো এমনি মজা করেই বন্দুক চালিয়েছিলাম... আমি কেমন করে বুঝব যে তুই গাধা সিং বাইরে বেরোচ্ছিস? কী আফসোসই যে হচ্ছে!’

    রাম সিংয়ের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত তখন বেরিয়ে গেছে। রব নওয়াজ় আর তার সাথীদের এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে যেতে বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তো পুরো এক মশক রক্তই বেরিয়ে যেতে পারে। এতক্ষণ যে রাম সিং বেঁচে আছে সেটাই রব নওয়াজ়ের আশ্চর্য লাগল। রাম সিং যে বাঁচবে এমন আশা তার ছিল না। তাকে নাড়ানো-চাড়ানো ঠিক হবে না ভেবে রব নওয়াজ় ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্ল্যাটুন কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাল বন্ধু রাম সিং গুরুতর আহত, জলদি একজন ডাক্তার পাঠান।

    সেনাবাহিনীর ডাক্তারের সেই পাহাড়ে পৌঁছোনো, বিশেষত সময়ে পৌঁছোনো, একেবারেই অসম্ভব ছিল। রব নওয়াজ়ের মনে হয়েছিল রাম সিং আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মেহমান। তাসত্ত্বেও ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে সে রাম সিংকে হেসে বলল: ‘ডাক্তার আসছে, কোনও চিন্তা করিস না।’

    রাম সিং কিছু একটা ভাবতে ভাবতে দুর্বল স্বরে বলে উঠল, ‘তোরা আমার কটা জওয়ানকে মারলি তাই বল।’

    রব নওয়াজ়ের উত্তর, ‘শুধু একজন।’ রাম সিংয়ের আওয়াজ যেন আরও দুর্বল শোনাল, ‘তোদের কজন মরল?’

    রব নওয়াজ় এবার মিথ্যে বলল, ‘ছয়।’ বলেই নিজের জওয়ানদের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে ব্যঞ্জনা।

    ‘ছজন... ছজন...’ রাম সিং যেন এক এক জন মানুষকে মনে মনে গুনছে। ‘আমি জখম হওয়াতে আমার সেপাইরা তো খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল... কিন্তু আমি বলেছিলাম... খেলে যাও, নিজেদের আর দুশমনদের জান নিয়ে খেলে যাও...ছজন...ঠিক আছে!’ রাম সিং অতীতের আবছায়ার মধ্যে চলে গেল। ‘রব নওয়াজ়...তোমার কি সেদিনের কথা মনে আছে...?’ ফেলে আসা দিনগুলোর কথা তখন রাম সিংয়ের মনে পড়ছে। গ্রামের খেতখামারের গল্প, ইস্কুলের কাহিনী... ৬/৯ জাঠ রেজিমেন্টের দাস্তান! কমান্ডিং অফিসারদের গল্প আর বিদেশের অজানা মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের কিসসা। কত দিলচস্‌প কিসসার কথাই না তখন রাম সিংয়ের স্মরণে এল। হাসতে গিয়ে তার ব্যথা আরও বেড়ে গেলেও জখমের পরোয়া না করেই হাসতে হাসতে বলল, ‘আবে শুয়োরের নল! সেই ম্যাডামকে তোমার মনে আছে...?’

    রব নওয়াজ় জিগ্যেস করল, ‘কে?’

    রাম সিং বলে উঠল, ‘সেই যে....ইটালির.....আমরা যেন কী নাম রেখেছিলাম তার....মানুষখেকো আওরত ছিল কিন্তু!’

    রব নওয়াজ় তৎক্ষণাৎ সেই মহিলাকে মনে করতে পারল: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ...সেই ম্যাডাম মনিতা ফনিতো...পয়সা খতম, তামাশা খতম...তবে তোকে কখনওসখনও বেশ পছন্দ করত সেই মুসোলিনির বেটি!’

    রাম সিং জোরে হেসে উঠতেই জখমের জায়গা থেকে দলা পাকিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। রব নওয়াজ় কাজ চলার মত একটা পটি বাঁধলেও সেটা সরে গিয়েছিল। ব্যান্ডেজ আবার ঠিক করে বেঁধে সে রাম সিংকে বলল, ‘এবারে শান্ত হয়ে থাকো।’

    রাম সিংয়ের গায়ে তখন খুব জ্বর। শরীর অত্যন্ত গরম। কথা বলার শক্তি না থাকলেও সে বলে চলেছে। মাঝে মাঝে থেমে যেন বোঝার চেষ্টা করছে ট্যাঙ্কিতে আর কতটা পেট্রোল আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাম সিং ভুল বকতে শুরু করল। কিন্তু মাঝে মাঝে আবার তার হুঁশ ফিরে আসছে। তেমনি এক মুহূর্তে সে রব নওয়াজ়কে শুধোল: ‘ইয়ার, সত্যি বলো তো, তোমরা কি কাশ্মীর চাও?’

    রব নওয়াজ়ের গলায় আবেগ, ‘হ্যাঁ, রাম সিং!’

    রাম সিং মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘না, …এটা আমি মানতে পারলাম না। তোমাদের ভুল বোঝানো হয়েছে।’

    রব নওয়াজ় যেন বন্ধুর প্রত্যয় জাগানোর জন্য বলল, ‘তোমাদেরই ভুল বোঝানো হয়েছে...পবিত্র পয়গম্বর আর তাঁর পরিবারের কসম...’

    রাম সিং রব নওয়াজ়ের হাত ধরল: ‘ওই কসম খাস না...তুইই ঠিক...’ কিন্তু তার গলার স্বরে বোঝা গেল রব নওয়াজ়ের কসমের ওপর তার বিশ্বাস নেই।

    সূর্য ঢলার একটু আগে প্ল্যাটুন কমান্ডার মেজর আসলাম এসে পৌঁছোলেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সেপাই এলেও কোনও ডাক্তার ছিল না। রাম সিং তখন চেতন আর অচেতনের মধ্যে দুলছে। থেকে থেকে কিছু বিড়বিড় করছে। তবে সে আওয়াজ এতই ক্ষীণ যে কিছু বোঝা দায়। মেজর আসলামও ৬/৯ রেজিমেন্টে ছিলেন। রাম সিংকে খুব ভালোই চিনতেন। রব নওয়াজ়ের কাছ থেকে সব ঘটনা শোনার পর তিনি রাম সিংকে ডাকলেন: ‘রাম সিং...রাম সিং...’

    রাম সিং একবার চোখ খুলে মেজরকে দেখল। শরীরটা শক্ত করে শুয়ে শুয়েই দেহটাকে অ্যাটেনশন অবস্থায় রেখে সে স্যালুট ঠুকল। পরমুহূর্তেই আবার চোখ খুলে এক লহমার জন্য গভীর মনোযোগে মেজর আসলামকে নিরীক্ষণ করল। এবার স্যালুটের ভঙ্গিতে থাকা তার হাতটা শিথিল হয়ে কপাল থেকে একদম খসে পড়ল। সে তখন বিড়বিড় করছে, ‘কুছ নহিঁ আবে রাম সিয়াঁ...তুই শুয়োরের লেজ...ভুলেই গেছিস...যে এই লড়াই...এই যুদ্ধ...’

    রাম সিংয়ের কথাটা শেষ হল না। চোখ যখন বন্ধ হচ্ছে, তখন শেষবারের জন্য আধা-জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রব নওয়াজ়ের দিকে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল।


    [১] শুয়োরের লেজ
    [২] এক কোপে কাটা খিনজ়ির অর্থাৎ শূকরের মাংস; ইসলাম ধর্মে এই পদ্ধতিতে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ


    (৭ অক্টোবর ১৯৫১)

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments