• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • বাঁদরের ঘা بندر کا گھاؤ : হাজরহ মসরুর
    translated from Urdu to Bengali by মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: শুভময় রায়



    [হাজরহ মসরুরের জন্ম ১৭ জানুয়ারি ১৯২৯-এ, অবিভক্ত ভারতের পুরোনো লখনউয়ে। দেশভাগের পরে তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। তাঁর বড়দি খাদিজা মাস্তুর, ছোট ভাই খালিদ আহমদ, মা বেগম আনোয়ার জাহাঁ সকলেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খাদিজা আর হাজরহ উর্দু কথাসাহিত্যের ‘ব্রন্টি সিস্টার্স’ নামে খ্যাত। দুই বোন প্রায় একই সঙ্গে লেখা শুরু করলেও তাঁদের রচনাশৈলী এবং বিষয়বস্তু ভিন্ন। খাদিজা ছোট গল্পের সঙ্গে দুটো উপন্যাস লিখলেও একটি নাটক ছাড়া হাজরহ মূলত ছোট গল্পের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন।

    দুদেশেই ‘তরক্কি পসন্দ মুসন্নিফিন’ অর্থাৎ প্রগতিবাদী লেখক সংঘের সদস্য এই লেখিকার প্রথম দিকের ছোট গল্পে উপমহাদেশের মুসলমান পরিবারের মহিলাদের জীবনের তিক্ত এবং রূঢ় বাস্তবতার নির্মম প্রতিফলন ইসমত চুঘতাইয়ের রচনাকে মনে করিয়ে দেয়।

    বান্দর কা ঘাও শিরোনামের মূল উর্দু গল্পটি লাহোরের মকবুল অ্যাকাডেমি থেকে ১৯৯১-এ প্রকাশিত গল্প সংকলন সব আফসানে মেরে থেকে সংগৃহীত।]


    সে নতুন বউয়ের মত বারান্দার ছেঁড়াখোঁড়া খাটিয়াটার ওপর গুঁড়িশুঁড়ি মেরে পড়ে ছিল। গ্রীষ্মের ভরা দুপুর, তার ওপর নাছোড়বান্দা জ্বর। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কামরার দরজা বন্ধ করে ঘরের সব লোক আরাম করছে। হাসিমস্করা আর গল্পসল্পে সময় কাটাচ্ছে। কয়েক বার তারও ইচ্ছে হল সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ভয় ছিল কোথাও তাকে দেখা গেলেই কঠোর তিরস্কারের বোতলটা খুলে যাবে। তাই প্রখর রোদ আর তীব্র জ্বর সত্ত্বেও, সে এই একটুখানি নিরিবিলিকে আশীর্বাদ বলে মেনে নিল।

    রোদের যেমন তেজ, তেমনি প্রবল জ্বর। হাড়মজ্জা যেন গলে যাচ্ছে আর তার মধ্যে শরীরের সব তন্তুগুলো ভাজা ভাজা হচ্ছে। ধনুকের মত বাঁকা পাঁজরগুলোকে যেন কোনও মজবুত হাত ঝাড়ুর খড়ের মত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। সেই অদ্ভুত অনুভূতি থেকে তার কাশি এল। এমনই কাশি যেন কেউ কাঠের খালি বাক্স নিয়ে ধপধপিয়ে বাজাচ্ছে। কাশতে কাশতে গলার কাছে কী একটা উঠে এল। আর সে শুয়ে শুয়েই খাটিয়ার দুয়েকটা আলগা দড়ি সরিয়ে সেটা থুক্‌ করে ফেলল। জমাট এক দলা রক্ত চপ্‌ শব্দ করে মেঝেতে পড়ল। রক্ত দেখে কিছু ভেবে ফেলার আগেই বাঁদরদের খো-খো আওয়াজে সে একদম স্থবির হয়ে গেল। বাঁদরদের তার ভীষণ ভয়। অগত্যা ঘাড় না ঘুরিয়ে শুধু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সে সেদিকে চেয়ে দেখল।

    হায় আল্লাহ্‌.....শুকনো ফাটা ঠোঁট থেকে আওয়াজটা বেরোতেই যেন জ্বালার অনুভূতিটা আরও বেড়ে গেল। ওফ্‌...ফো! কত বাঁদর যে বাবুর্চিখানার পেছনের নিম গাছ থেকে ছাদের ওপর ধপাধপ উলটো-সিধে লাফ দিয়ে পড়ছে। মনটা প্রাণপণে চাইছিল এক ছুটে পালিয়ে কামরার মধ্যে ঢুকে পড়তে। কিন্তু ভয় – একটু নড়াচড়া করলেই যদি এই সব বাঁদরগুলো একসঙ্গে এসে তার ঘাড়ে পড়ে?

    শ্যাওলা ধরে কালো হয়ে যাওয়া নিচু পাঁচিলের ওপর বসে একটা রুগ্ন বাঁদর ঘ্যানঘ্যান করছিল। আশপাশে বেশ কয়েকটা মোটাসোটা বাঁদর ধারালো নখ দিয়ে তার পিঠের ঘন কালো ঘা-টা চুলকোচ্ছে। বাঁদরটার ওই ভয়ঙ্কর ঘা-টা দেখে তার কাঁপুনি এল। অন্য বাঁদরগুলো জখমের পরিচর্যায় মগ্ন। এই যদি একজন হাত দিয়ে ক্ষতটা খুঁচিয়ে দিচ্ছে তো আরেক জন দাঁত বার করে চোখের পাতায় চাঁটি মেরে ওই একই কাজ শুরু করে দিচ্ছে – অর্থাৎ একটি আহত বাঁদর আর হাজার খানেক শল্য চিকিৎসক! আর সেই রুগ্ন, দুর্বল বাঁদরটা ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মাথা ঝুঁকিয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল এই মরে কী সেই মরে! কমবখ্‌তটা পালাচ্ছে না কেন? এই ভাবে আঘাতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে জান দেবে না কি? নির্বোধ জানোয়ার। তা সত্ত্বেও দুর্ভাগা বাঁদরটার অসহায়তা দেখে তার দয়া হল।

    মন চাইছিল ওই বাঁদরটিকে পিছু-নেওয়া বাঁদরের দলের হাত থেকে বাঁচায় যারা আসলে সহানুভূতি প্রদর্শনের অছিলায় তামাশা দেখতে এসেছে। কিন্তু... কিন্তু হঠাৎই যেন একটা মজবুত হাত তার পাঁজরগুলোকে চেপে ধরেছে। কাশিতে বুক থেকে গলা পর্যন্ত খুসখুস করে উঠল। মুখের ভেতরটা যেন বেশ কয়েকটা পানের পিকে ভরে গেল। সে ঘাবড়ে গিয়ে থুতু ফেলল। হি-ই-ই...উজ্জ্বল লাল, তাজা রক্ত! হাত-পা শিথিল হয়ে এল। আর সে কাঠের কুচিতে ভরে থাকা খাটিয়ায় দপদপ করতে থাকা মাথাটা রগড়াতে শুরু করল।

    বাঁদরেরা যখন বাইরে আওয়াজ করছে তখন ঘরের লোকেরা কী করছে? তারা তার নিজেকে আলাদা করে রাখার এই অভ্যেস নিয়ে আলোচনা করছে। সে বেজার মুখে হাত-পায়ের জট ছাড়ানোর জন্য আড়মোড়া ভাঙল, হাত দুটি বুকের ওপর রাখল। বাড়ির লোকের বিড়বিড়ানি আর বাঁদরদের খ্যা-খ্যা আওয়াজ তার কানে যেন গরম লোহার শিকের মত বিঁধছে। বাঁদর আর তার ঘরের মানুষদের মধ্যে কী অদ্ভুত মিল! সারা শরীরের শিরাগুলো যেন দপদপ করছে। হঠাৎই মনে হচ্ছিল কেউ যেন বলে দিয়েছে তুইও ওই দুর্বল, রুগ্ন বাঁদরটার মত যে জেনেবুঝে প্রাণঘাতী একটা রোগের বলি হচ্ছে। আর – যেন তা প্রমাণ করার জন্যই – জ্বরের ঘোরে কয়েক যুগ আগের ছবি মনের আয়নায় ভেসে উঠল।

    ‘তেইশ-চব্বিশের ডাগর ...... এখন তো চোখে লাগে,’ মা একটু হতাশ হয়ে দুশ্চিন্তায় বলে ফেলতেন। আর সে বুঝত অবিবাহিত থাকাটা কী পাহাড় প্রমাণ বোঝা! পরিবারের সমবয়স্ক মেয়েরা, এমনকী ছোটদেরও কত বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে। কারও কারও তো চার-পাঁচটা করে বাচ্চাও হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার স্বামীদের নজরে পুরোনো ফুটো-ফাটা মালের মত গণ্য হওয়ায় বাপের বাড়িতে পড়ে থেকে থেকে তাবিজ আর পির সাহেবদের মন্ত্রতন্ত্রের সাহায্যে পুরোনো ছেঁড়াখোঁড়া যৌবন রিফু করার চেষ্টা করে চলেছে। একমাত্র সেই কে জানে কেন এমন ভাগ্য নিয়ে এসেছে – এ অনন্য বেরি ফলের গাছে কেউ আর ঢিল ছোঁড়ার কষ্টটা করল না। দেখতে শুনতে তো খারাপ ছিল না। খুবই গুণী আর শান্তশিষ্ট মেয়ে। তাসত্ত্বেও কোথাও তার শাদীর বন্দোবস্তই হচ্ছিল না যে!

    তবে একথাটাও সত্যি সে আর তার মা ছাড়া আর কারও তেমন চিন্তাভাবনাও ছিল না। বাপ একটা ছিল বটে কিন্তু বসে বসে সারাদিন হুঁকো টানা আর দুবছরে একবার বংশবৃদ্ধি করার গৌরব অর্জন করা ছাড়া তৃতীয় কোনও কাজ তাঁর ছিল না। বড় ভাই নিজের ধান্দায় থাকত। আজ ধোপানির সঙ্গে প্রেম তো কাল মেথরানির জন্য পাগল। আর এসব যে লুকিয়ে চুরিয়ে করত, তাও নয়। খোলাখুলি সোমত্ত বোনটার সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা, অশ্লীল কথা বলা আর ঠিক বা বেঠিক জায়গায় হাত দিয়ে চুলকোনোর ব্যাপারে তার কোনও দ্বিধা ছিল না।

    তা বেঁচে থাকার পরিস্থিতি তো ছিল এমনই। মা সাংসারিক কাজকর্মের বোঝার নিচে মেয়ের ভরপুর যৌবনকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তোবা! একটা সময় আসে যখন কুলো আর তার ভার ধরে রাখতে পারে না। কখনও নিশ্চয়ই উনুনের ওপর ডাল রান্না দেখেছেন! আর এটাও অবশ্যই দেখেছেন যে যখন ডাল ফুটতে শুরু করে তখন হাঁড়ির ওপর নজর রাখা যাঁর দায়িত্ব তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়ির ঢাকনাটা খুলে দেন। তাতে উছলে পড়ার ভয় কমে যায়, তাই না? আর যদি ঢাকনাটা সরাতে ভুল হয়ে যায়? তা হলে ফুটতে থাকা তরল নিজেই ঢাকনা সরিয়ে নিজের রাস্তা করে নেয়। কী? ভুল বললাম? হ্যাঁ, তো তার জীবনেও ফুটতে থাকার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। শালীনতার চাপে যে চোখগুলো সব সময় নামানো থাকত, তারাই যেন কিছু খুঁজে পেতে এদিক ওদিক চাইতে শুরু করল। এমনিতে তো পাশের বাড়িটা বেশ অনেকদিন পর্যন্ত খালিই পড়ে ছিল। পরে শোনা গেল কোনও এক ছাত্র এসে সেখানে থাকছে।

    ব্যস, আর কী? পৃথিবীর পেটের মধ্যে থাকা অস্থির লাভা ফেটে বেরোনোর জন্য জমির সেই ফাটলটা খুঁজে নিল। বাড়ির কাজকর্ম করতে করতে তার নজর এবার একটা দরজার ওপর গিয়ে পড়ত। আর সেই যে দরজা, তার পেছনে পায়চারি করছে এমন কেউ নিশ্চয়ই ছিল। কাজে ভুলোমনের জন্য মা বকুনি দিলেও সে আওয়াজ তার কানে ঢুকত না। কানের পর্দা যেন অপরিচিত কোনও কণ্ঠস্বর শোনার জন্য উদগ্রীব। ঘরে বাপ-মা নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত থাকলে সে কল্পনায় দেওয়ালের ওপারের কারও আলিঙ্গনে আবদ্ধ হত। লাভা যেটুকু ছিল.....তা তার হৃদয়ের অভ্যন্তরকে উদ্বেল করার জন্য ছিল।

    ‘ছাদে যাচ্ছিস কেন?’ দাদা যেন বেশ একজন বিখ্যাত মনোবিদ। সে তার হাতের রঙিন ভেজা দোপাট্টা নিংড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বলত, ‘দোপাট্টা শুকোতে যাচ্ছি।’ ক্ষুধার্তের সামনে থেকে থালা সরিয়ে নেবে আর তার রাগ হবে না?

    ‘কেন এখানে রোদ নেই যে তোকে ওপরে যেতে হচ্ছে?’ বড় ভাই যেন নিজের মানসম্মান সম্পর্কে অতি সচেতন এমন কারও মত হাবভাব নিয়ে রাগত চোখে তাকাল। তারপরে একটা রদ্দিমার্কা সিগারেট ধরাল। সে দোপাট্টা খাটের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বসে বসে গজগজ করে চলল। দাদা তখন খুশি হয়ে গুনগুন করে গান ধরেছে.....’আমার চোখে চোখ রেখে....হে সুন্দরী নয়না.....’ আর সে রেগে গিয়ে মনে মনে দাদাকে অভিসম্পাত করে চলেছে।

    এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়। তার শখ পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মত কেউ সেখানে নেই। ওফ্‌...ফো! কতদিন ধরে তার ইচ্ছে ওই ফুটোটা দিয়ে একবার দেখে! এবারে সুযোগ পেয়ে জলদি নিজের চোখ দুটো সেই ছোট্ট ফুটোটায় লাগাল। একটু পরেই একটা ফর্সা মুখ সামনে এল, আবার হুট বলতেই সরে গেল। এক ঝলক, শুধুই এক ঝলক। তাতেই সে যেন আরও অধীর হয়ে উঠল। যদি আরও একবার সামনে আসে!.....তার চোখ তখনও সেই ছিদ্রটাতেই আটকে আছে। কমবখ্‌ত ফুটোটা তো এমন জায়গায় যে না তো পুরো বসে দেখা যাবে, না পুরো দাঁড়িয়ে! সে নতজানু হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে দেখতে থাকে। দুহাত হাঁটুর ওপর, চোখ ফুটোটায় লাগানো, আর কান কামরার দরজায়। ঝুঁকে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা হয়ে গেল। হাত দুটো যেন ঝিনঝিন করছে। কয়েকবার তো চোখের পাতার ঘষায় ফুটো থেকে ধুলো বেরিয়ে চোখে ঢুকে গেল। কিন্তু সে সেই ছিদ্রের সঙ্গে আটকে রইল। আর কত অদ্ভুত মনোবাঞ্ছা তার হৃদয়ে এসে জুড়ে গেল। এক দিন, দুদিন, তিন দিন ... মাসের পর মাস – তার চোখের দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে গোটা শরীরটাও যেন সেই ফুটো দিয়ে ওপারে চলে যেতে চায়। যদিও জানে সেটা অসম্ভব।

    ‘আম্মা!’ তার ছোট ভাই ধমাদ্ধম আওয়াজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। ‘শালা আমার ঘুড়িটা কেটে দিয়েছে!’

    ‘কে কাটল বেটা?’ আম্মা তো হতবাক। গতকালই তো তিনি ছেলের জন্য চার পয়সার ঘুড়ি আনিয়ে দিয়েছেন। আর সেটাকেও কেটে দিল?

    ‘ওই যে ওদিকে থাকে। বলছিল বাড়ির ছাদ থেকে ঘুড়ি উড়িও না, নিচে পড়ে যাবে।’ ভাই রাগে পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারে।

    ‘তো খারাপ কী বলেছে?’ সে আটা মাখা থামিয়ে বলেছিল।

    ‘চল্‌ তো, চুপ করে বোস,’ মা বকুনি দিলেন। ‘কোথাকার কে এসেছে পরামর্শ দিতে! বাচ্চা ছাদে ঘুড়ি ওড়াবে না তো কি তার মাইয়ার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে ওড়াবে? হ্যাঁ, তো বেটা, সে ঘুড়ি কেন কেটে দিল?’

    ‘আমি বলেছিলাম মানা করার তুমি কে? আরও বেশি করে ওড়াব ঘুড়ি। এটা কী তোমার সম্পত্তি নাকি? ব্যস, এই শুনে মোটা দড়ি দিয়ে ঘুড়িটা কেটে দিল।’

    সাহেবজাদা এই বলে আশকারা পেয়ে দু-চারটে ভারি ভারি গালি দিয়ে দিল।

    তার গায়ে যেন কেউ লঙ্কার গুঁড়ো ছেটাল। প্রাণ চাইছিল আটা মাখা ছেড়ে উঠে দু-তিনটে সপাটে কষিয়ে দেয়। আর এই আম্মা? বেটাকে মানাও করল না! ওই একরত্তি ছেলে, তার মুখে এই রকম খিস্তি! সে তো এত বড় হয়ে গেছে, তাও একবার যখন রাগে ঘরের সাধারণ খারাপ কথা তার মুখ থেকে বেরিয়েছিল, তখন আম্মা বাঁকনল নিয়ে তাকে মারতে উঠেছিলেন, কিন্তু....

    ‘হায়, হায়.....জোর করে অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় যে মানুষ তার গুষ্টির পিণ্ডি! তো বেটা, সে যখন ছাদে থাকবে না তখন ঘুড়ি ওড়াবি। ওই সব ছোটলোকদের থেকে দূরে থাকাই ভালো.....তোর আব্বা কিন্তু খুব কড়া লোক। যদি একবার এটা শুনতে পায় তো সকলের বিপদ!’

    তারপরে আবার বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাই হোক, সে দেখা যাবে।’

    সে কি এই কারণেই এতদিন ধরে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে? এই ভেবে যে একদিন প্রতিবেশী সেই মানুষটাকে তার সামনে কেউ গালি দেবে?

    ‘সে যখন থাকবে না বলে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?’ ভাই চেঁচায়। ‘সে তো সন্ধ্যে থেকেই ওখানে থাকে। খাটফাটও তো সেখানেই লাগিয়ে রেখেছে। বোধহয় ওখানেই শোয়। খোদার ইচ্ছেয় লোকটা যেন মরে – তার জানাজ়া যেন আমি দেখতে পাই......’ ভাই তো এই সব শাপশাপান্ত করে নিজের মন শান্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দিদি নিজের মনেই হাসছিল। যেন ওই গালিগালাজ তাকে স্পর্শই করছে না। সত্যি বলতে কী সে তখন অন্য একটা কথা ভাবছিল। খুব মজার একটা কথা।

    'খাঁচার পাখি উড়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।'

    রাতে মা খাটে শোওয়ার পরেই চাবির গোছা কোমর থেকে খুলে দিয়ে বললেন, 'নে এটা। ভাঁড়ার ঘরের তালাটা খুলে সিঁড়ির দরজায় লাগিয়ে দিস। আজ তো বাচ্চাদের ঘুড়ি কেটে দিয়েছে, কাল না সারা ঘরই খালি করে দেয় ওই শয়তানটা!' তারপরে আম্মা তাঁর উজ্জ্বল ঘড়ার মত পেটের আবরণ সরিয়ে আরাম করে পা দুটো খাটের ওপর ছড়িয়ে দিলেন।

    এই ভাবে আম্মা তো নিজের ঘরের সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তার মনে ছিল অন্য ভাবনা। সে ভাঁড়ার ঘরের তালা খুলতে খুলতে ভাবছিল, ‘দুটো ছাদ তো লাগানো। আজ না হয় তাকে সেই সব কথা বলেই ফেলি যা হুঁশ হওয়ার পর থেকে আমার মনের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করছে।’ সে সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। কিন্তু সিঁড়ির চাবিটা গোছা থেকে গায়েব হয়ে গেল, তার জায়গা হল তাকিয়ার তলায়।

    পুলিশ চৌকি থেকে ঘণ্টার ঢং ঢং জানাল দুটো বাজে। ঘরের সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে বালিশের তলা থেকে চাবিটা বার করে খালি পায়ে উঠে দাঁড়াল। এক ঝলক ভিজে হাওয়া যেন তার যৌবনকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। কেউ শুয়ে শুয়েই পা নাড়াল। সে পা টিপে টিপে জলের কলসি রাখার টুলটার কাছে পৌঁছোল। কিছুক্ষণ তারার আলোয় সবার মুখগুলো দেখল। কেউ জেগে উঠছে না তো? তারপরে নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশব্দে তালা খুলে ফেলল। এবারে দরজা খোলার অভিযান শুরু করতে হবে। দরজাটা কিন্তু কোনও ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ না করেই এমন সাগ্রহে খুলে গেল যেন ক্ষুধার্ত ভিখারিনী কয়েকটা টাকার লোভে শবদেহ তছনছ করছে।

    হৃৎপিণ্ডটা কী জোরেই না লাফাচ্ছে! যেন এবার সেটা পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। সিঁড়ির ঘন অন্ধকারে জ্বলতে থাকা চোখের সামনে সেই সব তারাগুলো তখন নাচছিল যাদের সারা সন্ধ্যে ধরে সে গুনেছিল। কপালের শিরাগুলোও উত্তেজনায় ধকধক করছে। তার ওপরে আছে মশার ভনভন। কী মুস্কিলের মধ্যে সিঁড়ির অর্ধেক ধাপ যে উঠল সেই জানে। শরীরটা যেন পাহাড়ের মত ভারি। আকাঙ্ক্ষা, ভয় আর আঁধার। দম বন্ধ হয়ে তার মাথা ঘুরছে; চোখের সামনে যেন রঙবেরঙের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

    ধপাস্‌...ধপ্‌...!...জোয়ান যুবতী একটা বলের মত সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে তার বাপের খাটের পায়ায় গিয়ে ধাক্কা খেল।

    হায়...হায়...হো...হায়...চোর...আল্লাহ্‌...চিৎকার শুনে তার চোখের সামনে থেকে রঙবেরঙের ছোপগুলো সরে গেল। লণ্ঠনের আলোটা বাড়িয়ে দেওয়া হল।

    ‘হায়, হায়, তুই!!’ মা দুটো হাত তাঁর কাঁপতে থাকা বুকের ওপর রাখলেন। ‘আমি তো আগেই জানতাম এই রান্ডিটাকে দিয়ে কিছু হবে না। তুই মরে গেলি না কেন?’ মা বেচারা তো মূর্ছা গেলেন।

    ‘জবাই করব এটাকে....কেউ যেন আমাকে না থামায়.....এই বলে দিলাম। ধিঙ্গি মেয়েটা ওপর থেকে নেমে এল।’ সম্মান হারানোর ভয়ে বাপের অবস্থা তো সঙ্গিন। কিন্তু শাবাশ দিতে হয় যে রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও তিনি নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। আরে হাঁ, মহল্লার আর কেউ যদি শুনে ফেলে তো? ...তো?...

    বড় ভাই বোধহয় নতুন প্রেমিকার স্বপ্ন দেখতে দেখতে নড়ে উঠল। তার অবস্থা তো বর্ণনার অতীত। তাছাড়াও সে কতবার আভাসে-ইঙ্গিতে বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ‘দেখো, এটা একটা কুয়ো। কোনও বোনের উচিত নয় এর মধ্যে লাফ দিয়ে পড়া।’ কিন্তু তাতেও মানলি না যখন তো এই নে...ব্যস্‌, তার বিনুনিটা পাকড়ে ঝটকা দিয়ে তার শরীরটাকে চারদিকে ঘোরাতে শুরু করল। বাবার নীতিবোধ তো ভেতরে ভেতরে ফুঁসলে উঠছিল। কিন্তু এবার যখন এত সহজ উপায় চোখের সামনে দেখলেন, তখন তিনিও জুটে গেলেন। মা বারো বারের জন্য গর্ভবতী হওয়ায় এই মেহনত এড়িয়ে গেলেন। তবে যত রকমের বিশেষ গালি তাঁর মনে আসছিল, তার সবই প্রয়োগ করে চলছিলেন। সে যাই হোক – ব্যথা যত তীব্রই হোক না কেন, তার তো চিৎকার করার অনুমতি নেই। উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলে মানুষ ভীতু হয়ে যায়, আর কাপুরুষরাই দুনিয়াকে ভয় পায়। অপরাধী এই বিচারকদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার হিম্মত তার ছিল না।

    ঘটনার পরে অনেক মাস পেরিয়েছে। সে বুঝতে পারত যেখানে তার বড় ভাইয়ের বেয়াড়াপনাকে ‘বড় হয়ে উঠছে, এ বয়েসটাই তো এরকম’ বলে ভুলে যাওয়া হত, তার মহাপাপকেও একদিন সেইভাবে ভুলে যাওয়া হবে। কিন্তু সে এমন এক পাগলি যে আওরতদের সম্মান যে কতটুকু তা ভুলে গিয়েছিল। মহিলারা তো কাঠের পুতুল যার দড়িটা আছে সমাজের ক্ষতবিক্ষত হাতে। কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত সেই হাত যখন চুলকোয়, তখন দড়িতে টান পড়ে কাঠের পুতুলেরা নাচে। কিন্তু যদি এই কাঠের পুতুলে প্রাণ আসে আর সে আপন মর্জি অনুযায়ী কাজ শুরু করে, তা হলে সমাজের মৃত পচা শরীরটা কার প্রতি আগ্রহ দেখাবে? সে ভাবছিল যেমন ঘরের মানুষেরা তার যৌবনের প্রয়োজনগুলোর ব্যাপারে বধির হয়ে থাকে, তেমনি হয়ত তারা এই ঘটনাটা ভুলে যাবে, তাদের ভুলগুলোও স্বীকার করে নেবে। কিন্তু এটা তো ছিল শুধু তারই ভাবনা। নীতিনিষ্ঠ অভিভাবকদের নজরে তার জীবনে কলঙ্কের যে দাগ লেগে গেল, তা আর কখনও মুছবে না।

    ‘বদমাশ,’ তার বদমাশ ভাইটা একটু কিছু হলেই বলে উঠত।

    ‘আরে...,’ তার মা তাকে মুখ নামিয়ে রাখতে দেখলেই এক নিঃশ্বাসে কড়া গালিগালাজ শুনিয়ে দিতেন। একটা মামুলি কেটে ছড়ে যাওয়াকে বারংবার বিষাক্ত নখ দিয়ে খোঁচানো হচ্ছিল। এতটাই যে সেই ছড়ে যাওয়া জায়গাটায় দেখা দিল দগদগে ঘা। এমন ঘা যা ভেতরে ভেতরে পচতে শুরু করে, বিষ ছড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতেও সেই বিষাক্ত নখের মালিকদের শান্তি নেই।

    'এখানে পড়ে আছিস কেন? হতভাগীটা তো সব সময় জ্বরে ভোগে। তার ওপরে এই তীব্র গরম আর রোদ! কিন্তু আমি জানি সকলের সঙ্গে বসে মন দেবে কী করে? সবাই তো গল্পগুজব করবে, কিন্তু আমাদের লেডি তো আনমনা হয়ে বসে থাকবে।' মা কাশতে কাশতে লোটা নিয়ে পায়খানায় গিয়ে ঢুকলেন।

    সে ক্লান্ত হয়ে পা মুড়ল। রান্নাঘরের ছাদে গুণ্ডা বাঁদরের দল জখম বাঁদরটার আঘাতের চিকিৎসা তাদের নিজেদের বুদ্ধিতে করে চলেছে। তার বুকের ব্যথাটা আবার আড়মোড়া ভাঙছে। গলা থেকে বুক পর্যন্ত চিনচিন করছে। হাড়গুলো গলে গিয়ে ভেতরটা যেন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।

    ‘আল্লাহ্‌!’ সে চিৎকার করে কেঁদে উঠে নীল আকাশের দিকে চাইল। আকাশটা যেন পৃথিবীকে একটা ঢাকনার মত ঘিরে আছে। তার নজরটা অনেকক্ষণ ঢাকনার অপর পারটাকে ঠাহর করার চেষ্টা করল। মনে হত সেখানে হয়ত ন্যায় আর সহানুভূতির সেই জগতটার দেখা মিললেও মিলতে পারে।

    কিন্তু তার মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি কোনও কাজে এল না। ক্লান্তিতে মনে হল আল্লাহ্‌ মিয়াঁ নিজের দুনিয়াটা আকাশ দিয়ে ঢেকে রেখেই সন্তুষ্ট আছেন। ঠিক যেমন সে একদিন বাটিতে পড়ে থাকা ডাল ঢেকে রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারপরে গোটা একটা দুপুর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন বাটির ডালটার কথা মনে পড়েছিল, ততক্ষণে ডাল তো পচে গেঁজে উঠেছে।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments