• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • আর জন্মের ঘর – বদলে যাওয়া সময়ের দলিল : পাপিয়া ভট্টাচার্য

    আর জন্মের ঘর — মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়; আরশিনগর, কলকাতা; প্রচ্ছদ— সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ- বইমেলা ২০২০







    যেখানেই যাবো ভাবি /সেখানেই ঘরবাড়ি মানুষের স্বদেশ সাজানো। /অথচ কেন যে ঘরছাড়া /চোখের আড়ালে আমি ছিন্নমূল! /এইটুকু, গৃহস্থালী মানুষের মুখ, /মৃত্যুর দুপারে জন্ম /এই তো স্বদেশ।
                                                               (স্বদেশেই, কবি- সুকুমার রঞ্জন ঘোষ)
    ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারতবাসী পেল মুক্তির স্বাদ, সঙ্গে বিষাদ এবং বিভাজন। কোনো প্রাকৃতিক কারণে নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে ভারতবর্ষের বুক ফালা ফালা করে এল স্বাধীনতা। এ ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যে মানুষগুলো ভিটেমাটি হারিয়ে, ছিন্নমূল হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে চলেছে, এ পৃথিবীর মানচিত্রে সেই নতুন ইহুদিদের কোনোদিন কোনো জায়গা ছিল না। ইতিহাস তাদের জীবন সংগ্রামের কোনো গল্প লেখেনি কখনো। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর সবচেয়ে বড় যে জনসমষ্টির জীবন তছনছ করে দিয়েছিল, সে জাতির নাম বাঙালি। নিজ ভূমে পরবাসী পদ্মাপারের মানুষগুলো ঘর ছেড়ে বেঘর হয়ে পাড়ি দেয় গঙ্গা পারে, ভবিষ্যতের সন্ধানে, একটুকরো মাটির খোঁজে।

    শুধুমাত্র ধর্মপরিচয় সম্বল করে আসা মানুষগুলোর ঠাঁই হয় শিয়ালদা ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, ফুড কর্পোরেশনের গুদামঘর কিংবা কোনো ক্যাম্পে। তুলনায় শিক্ষিত এবং সঙ্গতিসম্পন্নরা আশ্রয় নিলেন জবরদখলের জমিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আত্মীয় হবার সুবাদে কিছু দরিদ্র পরিবারও এদের আশপাশে থাকার সুযোগ পেল। কলকাতা সন্নিহিত বিভিন্ন বিস্তৃত ফাঁকা জমিতে মাটির মেঝে, ছিটেবেড়ার দেওয়াল আর টালির ছাউনি দিয়ে তৈরি হল সারি সারি মাথা গোঁজার আশ্রয়। যার পোশাকি নাম কলোনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে শিকড় ছিঁড়ে আসা মানুষগুলো যাদের পরিচয় ছিল ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম একদিন তারাই একে অপরের আত্মীয় হল। পরিচয় হল উদ্বাস্তু।

    'আনন্দগড়' এরকমই একটা উদ্বাস্তু কলোনি। লেখিকা মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে কৈশোর পরিক্রমণ এবং স্মৃতি রোমন্থনের ফসল 'আর জন্মের ঘর' উপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপট। মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিজয়গড় কলোনিতে। কলোনি জীবন এবং উদ্বাস্তু আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তার বেড়ে ওঠা। গল্পের প্রধান চরিত্র কুশির মধ্যে সম্ভবত তিনি নিজেকেই আঁকতে চেয়েছেন। তাই উপন্যাসটিকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বললে কিছু ভুল বলা হবে না। তবে কোনো এক জায়গায় লেখিকা নিজেই বলেছেন, ''বানিয়ে বলার ক্ষমতা নেই, যা দেখেছি, যা মনের পটে আঁকা ছিল তাকেই প্রকাশ করেছি। নিজে মেয়ে বলে একটি ছোট মেয়ে কুশিকে বেছে নিয়েছি। লিখতে লিখতে বুঝেছি যে আমার কুশি আসলে অনেক কুশির সম্মিলিত রূপ।" (উক্তিটি 'আরশিনগর' পত্রিকার মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণ সংখ্যায় প্রকাশিত নন্দিতা বসুর লেখা 'ভিন্ন গোত্রের মেয়েপাঁচালি' প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত।)

    গোটা আনন্দগড় কলোনি ছিল এক বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের মতো। গালাগালি আর গলাগলি ছিল তাদের নিত্যদিনের দিন গুজরানের মূলমন্ত্র। সেখানেই একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে কুশির জন্ম। মা, ঠাকুমা আর পিসিমা — এই ত্রিমাত্রিক ভালোবাসা, আদর এবং অনুশাসনে কুশির বেড়ে ওঠা। সময়টা সত্তরের দশক। কোলকাতা তখন নকশালী জ্বরে কাঁপছে। বিশেষ করে এই সমস্ত উদ্বাস্তু কলোনিগুলোকেই তখন নকশাল আন্দোলনের আঁতুড়ঘর বলে মনে করা হত। আনন্দগড়ও এর বাইরে ছিল না। প্রতিটা রাত উদযাপিত হত পুলিশের বাঁশি, গুলির শব্দ আর কোনো মায়ের কোল খালি করা কান্নার আওয়াজে। পাশাপাশি বয়ে চলল কুশির শৈশব, লেখাপড়া, আর ভাই-বোনের সাথে খুনসুটি। মা আর ঠাকুমার নিত্য কলহ সেই দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেল। সংবেদনশীলতায় কুশি তার সমবয়স্ক যে কোনো মেয়েকেই পিছনে ফেলে দিতে পারে। অনাথ স্বজনহারা মধ্যবয়স্ক সাধুচরণকে সে মাতৃস্নেহে আগলে রাখে। কাজের মাসি অমূল্যর মায়ের মা হয়ে ওঠে। আর বুড়ো অন্ধ ভিখারি যখন কুশিকে বাবা বলে ডাকে, তখন তাকে হাত ধরে বাড়িতে এনে জল বাতাসা খাওয়ায়। কলোনির প্রতিটা বাড়িতেই কুশির অবাধ বিচরণ। প্রতিটা চরিত্রের সঙ্গেই তার ভালোবাসার সম্পর্ক। এ হেন কুশি শুধু নিজের মায়ের কাছেই 'ধিঙ্গি', 'পাড়াটোলানি'।

    সময়ের স্রোতে বয়ে চলা জীবন একদিন কৈশোরে পা রাখল। কুশির শরীরী পরিবর্তন জানান দিয়ে গেল, সে নারীত্বের পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। তার এই এগিয়ে চলার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াল তারই কাছের মানুষ অমু-কাকু। অঙ্ক শেখানোর অছিলায় কুশিকে প্রায় প্রতিদিন যৌন হেনস্থার শিকার হতে হল অযাচিত ভাবে। এ ঘটনা এক লহমায় কুশির মনের বয়স অনেকটা বাড়িয়ে দিল। এদিকে কুশির সাথে সাথেই বয়স বেড়ে চলল আনন্দগড় কলোনির। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর হল রাজনৈতিক পালাবদল। বদলে গেল কলোনির আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ। নতুন ভবিষ্যতের আশায়, নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে শাসকের ছত্রছায়ায় উদ্বাস্তু মানুষগুলোর ভিড় বাড়তে লাগল ক্রমশ। অন্যদিকে নতুন শাসক শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখালেও, কলোনির ছিটেবেড়ার দেওয়াল আর কোঠাবাড়ির মধ্যে কোনো ব্যবধানই ঘুচল না। ঘটনা ছাড়া জীবন হয় না। মরিচঝাঁপি গণহত্যার ঘটনা আবার নতুন করে ঝড় বয়ে নিয়ে এল উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জীবনে।

    দিন যায়। আনন্দগড় কলোনির বুক চিরে তখন নগরায়ণের জোয়ার। পাশাপাশি থাকা মানুষগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ফিকে হতে হতে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। ফিকে হয়ে যাওয়া সম্পর্কের জের কুশির বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যেও। চিরকাল কর্তব্যপরায়ণ বাবা আর অত্যন্ত ভালোবাসার মানুষ পিসির মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ ষোড়শী কুশিকে ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব সংকটের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করায়। বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই সমাজ এগিয়ে চলে। সে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ হোক বা পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এখানে কিছুটা অনুঘটকের কাজ করে। 'আর জন্মের ঘর' উপন্যাসটিতে সেই বদলে যাওয়া সময়ের চালচিত্র অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্ণিত। এই জায়গায় হঠাৎ করেই কাহিনীতে দাঁড়ি টানলেন লেখিকা। কিন্তু কেন? উপন্যাসটির রচনাকাল দু-হাজার বারো থেকে দু-হাজার উনিশ, এই দীর্ঘ সাত বছর। কিন্তু উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্র দু-বছরের মধ্যেই দুরারোগ্য রোগে দু-হাজার বাইশের সাতাশে মার্চ লেখিকা মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন। বেঁচে থাকলে হয়তো এর পরবর্তী অংশ নিয়ে তিনি আবার পাঠকের সামনে হাজির হতেন। স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে, সময়ের সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে লেখিকা যা দেখেছেন তাই গল্পাকারে পরিবেশন করেছেন। কিন্তু এখানেই কি শেষ, নাকি শুরু, তা বিচারের ভার সম্ভবত তিনি পাঠকের ওপরেই দিয়ে গেলেন ।


    নারীবাদ এ গল্পের বিষয়বস্তু না হলেও, প্রতিটা নারীচরিত্রই আপন আভায় উদ্ভাসিত। এদের মধ্যে প্রধান চরিত্র কুশি ছাড়া, কুশির ঠাকুমা, মা এবং রঙমালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি পুরুষ চরিত্রগুলো নারী চরিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে কোথাও একটু কোণঠাসা। কুশির ঠাকুমা প্রথাগত শিক্ষা পাননি কোনোদিন। ছিলেন স্বশিক্ষিত। নিজের দাম্পত্য জীবনে ছিলেন চরম অসুখী। তাঁর রোজকার জীবনে বইয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। পড়তে ভালোবাসতেন। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল লক্ষণীয়। তাই তিনিই সত্তরের দশকের এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে লাঞ্ছিত মেয়েদের প্রসঙ্গে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে চড় কষিয়ে বলতে পারেন, "যারা যুদ্ধ কইরা স্বাধীনতা আনলো সবাই তাগোই মনে রাখবো জানি, এই ফুলের মতন মাইয়্যাগুলারে কি মনে রাখব? শহীদ যদি কইতেই হয় তবে এই শতে শতে হাজারে হাজারে মাইয়্যাগুলার কথাও তো মনে রাখন লাগে। বাইরে দিয়া দেখলে ভাববা আছে, বাঁইচ্যা আছে, আসলে নাই, অর ভিতরের মানুষটা খুন হইয়া গেছে বর্বর সেনাগো অত্যাচারে। মাইয়্যাগো ত্যাগ মনে না রাখলে বুঝবা জীবনটারে অর্ধেক মনে রাখছ।" (পৃ-৬২)

    অনটনের সংসারে পরিবারের ঢাল হয়ে দাঁড়ায় যে মানুষটা, আলুসিদ্ধর সঙ্গে পেঁয়াজ মেখে তাতে একটা ডিম ভেঙে দিয়ে বড়া ভেজে বাড়ির মানুষগুলোর মুখে ভাত তুলে দেয় যে মানুষটা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তার অবদানও নেহাত কম নয়। আদ্যোপান্ত একজন ভালো মানুষ। কুশির মধ্যে যে ভালো গুণগুলো আছে সেগুলো সম্ভবত এই মানুষটার থেকেই উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত। তিনি আর কেউ নন, কুশির মা। কুশির জীবন এবং এই উপন্যাসের অনেকাংশ জুড়ে থাকলেও, সাদামাটা চরিত্রের কারণে অন্যান্য নারী চরিত্রদের ছাপিয়ে যেতে পারেননি। পরিশেষে প্রতিবেশী বৃদ্ধা রঙমালার কথা। একা থাকতে ভালোবাসেন। বৃদ্ধ বয়সেও অবলম্বনের প্রয়োজন বোধ করেন না। অত্যন্ত আশাবাদী একজন মানুষ। নাতনির বয়সী কুশিই তাঁর একমাত্র সখী। যার কাছে তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন নিজের জীবনের সমস্ত প্রেম-অপ্রেমের গল্প। আবার ঘরবাড়ি, জমিজমা ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে বলতে পারেন, "এই দ্যাশে আইসা মাইয়্যারা যতখানি ল্যাখা-পড়ার সুযোগ পাইল, দ্যাশে থাকলে তা পাইত? আমরা ভাবতে পারতাম যে, মাইয়্যায় পুরুষের মতো অফিস-কাছারিতে কাম করব? ছাড়ছি অনেক তবে পাইছি তার থিকাও বড় কিছু।" ( পৃ-১০৯) এর থেকে ইতিবাচক বোধ হয় আর কিছু হতে পারে না।

    শুধুমাত্র গল্প এবং গল্পে বর্ণিত চরিত্র নয়, এই গল্পের সিংহভাগ জুড়ে আছে ভাষার ব্যবহার। যা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়পত্র। ভাষা হয়তো একটাই কিন্তু তার ভিন্ন ভিন্ন রূপে বাঁধা পড়ে যায় কোনো বিশেষ সময় বা স্থান। সেরকমই বরিশালি বাংলা এ গল্পের অলঙ্কার। যে ভাষায় লেখা সংলাপ মন ছুঁয়ে যায়। আবার কখনো কমিক্যাল রিলিফও দিয়ে যায়। এ ভাষার প্রতি লেখিকার টান এবং দক্ষতা দুইই প্রকাশ পেয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। লেখিকার কৃতিত্বের পাশাপাশি সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদের প্রশংসা করতেই হয়।

    'আর জন্মের ঘর' নিছকই কোনো গল্প নয়। এ গল্প নিত্যদিনের সংসার যাপনের টুকরো টুকরো ছবি। কিছু সাদা-কালো, কিছু রঙিন। ভালোলাগা আর না-লাগায় ভরা জীবনের কিছু মুহূর্ত মাত্র। মুহূর্তগুলো বদলে যায় জীবনে। আর সেই জীবন থেকেই শুরু হয় একটা গল্প। এ গল্প জীবনের, এ গল্প যুদ্ধের। এ গল্প ব্যবধানের, এ গল্প দূরত্বের। ছিয়াত্তর বছরের ইতিহাসে সে দূরত্ব কিছুটা কমলেও ব্যবচ্ছেদের ক্ষত বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়েই রয়ে গেল।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments