এমন ভরা জোয়ারের সময়ই ১৯৬৩ সালে শুরু নির্মল মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাজীবন। ভারতের স্বাধীনতার থেকে মাত্র বারো বছরের বড় নির্মলকে খুলনার পৈত্রিক নিবাস ছেড়ে চলে আসতে হয় এই বাংলায়। শুরু হয় ঘাতপ্রতিঘাতে ভরা উদ্বাস্তু জীবন। অবশেষে ১৯৫২ সালে সরকারী বদান্যতায় পুনর্বাসন পেয়ে স্থায়ী আবাস তৈরি হয় চন্দননগরে। এমন ডামাডোলের মধ্যে পড়াশোনা নবম শ্রেণীর বেশি না এগোলেও ভেতরের আগুন কিন্তু প্রসারিত হতে থাকে ছবি আঁকা আর নাট্যচর্চার মধ্যে দিয়ে। অঙ্কনশিল্পী হিসেবেও তিনি যথেষ্ট কৃতি হতে পারতেন (পুস্তকটিতে সংযোজিত কিছু ছবি — বিশেষত পোট্রেটগুলি দেখলেই বোঝা যায়) কিন্তু অভিনয় বাসনার প্রাবল্যে ভেসে গিয়েছিল তার জীবন।
শুধু অভিনয় নয় নির্দেশনা থেকে আরম্ভ করে একটি সংগঠনের কর্ণধার হিসেবে নির্মল মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতি ছিল সর্বাত্মক। বহু যাত্রাদলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। চলার পথে পেয়েছেন অনেক মানুষ। এমনকি নারী সঙ্গও লাভ করেছেন অকৃপণভাবে। ফলে তার বিবাহিত তথা সংসার জীবন হয়ে উঠেছে কণ্টকাকীর্ণ। ধীরে তার কাছ থেকে সরে গেছে আপন সংসারের সুখ আর শান্তি।
আসলে যাত্রাশিল্পীদের সাংসারিক জীবন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুখের হয় না। রচনাকার নিজেও সে কথা জানতেন ভাল করেই। নিজের কথাতেই প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব। রচনার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে লেখকের হাহাকার। কিন্তু ২০৩ পৃষ্ঠায় যেভাবে নির্মল মুখোপাধ্যায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তা স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটু দীর্ঘ হলেও একেবারে যথাযথ সেই অংশটুকু তুলে ধরা যাক — ‘বাড়িতে এসে সবার মধ্যে থেকেও নিজেকে খুব একা মনে হতো, আমাকে সময় দেওয়ার কারো সময় নেই। আমার স্ত্রীর আমার প্রতি একবুক অভিমান। যদিও অভিমানের যথেষ্ট কারণও আছে। তবু মনে মনে চাইতাম, চেষ্টাও করেছি — ভাঙা মন আবার জোড়ার জন্য, কিন্তু পারিনি। …… কিন্তু ওকে দেখলে আমার খুব মানসিক কষ্ট হয় । একটা অপরাধবোধ আমাকে ঘিরে ধরে। আমার কাছে কৈফিয়ৎ চায়। আমি যন্ত্রণাকাতর অতৃপ্ত মনে বাস্তবের জীবনধর্মের আত্মপক্ষ সমর্থনে বলি, ও কেন আমার শিল্পীসত্তাকে বুঝতে চাইল না? আমার সংসার-সন্ন্যাসী যাযাবর জীবনকে সহানুভূতির চোখে দেখল না? অবুঝ, তবু ওকে ভালবাসি।’
আবার ২০৪ পৃষ্ঠায় লেখক বলছেন, ‘অন্যদিকে আমার স্ত্রী। এমনিতে সহজ সরল। কিন্তু অতিমাত্রায় জেদ। রাগলে ছোটো বড়ো জ্ঞান থাকে না। আমার বাইরের জীবন মেনে নিতে পারেনি (অধিকাংশ মেয়েরাই পারে না)। না পারার কারণে আমাদের দাম্পত্য জীবন বিষময় হয়ে গেল।’
আত্মজীবনীর শেষে এসে যে কথাগুলো নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেন রচয়িতা, তার উল্লেখ কিন্তু অনেক প্রসঙ্গেই ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। নির্মল মুখোপাধ্যায় যখন যাত্রা জগতের মধ্য গগনের সূর্য, যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা জুড়ে তার অসংখ্য ভক্ত তখনও নিজের স্ত্রীপুত্রের কাছে সামান্য আদর যত্নটুকু না পাওয়ার অতৃপ্তি তাকে বিধ্বস্ত করে গেছে মানসিকভাবে। অবশ্য এই পিছুটান উপেক্ষা করে দুরন্ত ঘোড়ার মতো তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন নিজস্ব অঙ্গনে। লিখেছেন পালাসফল নাটক, মুগ্ধ করেছেন অগণিত দর্শককে। রচনা করেছেন পালার গান। অধিনায়কের মতো সমাধান করেছেন দলের নানান সমস্যা।
এইভাবে ক্রমে নির্মল মুখোপাধ্যায় পৌঁছন যাত্রা জগতের উচ্চশিখরে। শুধু সরস্বতী নয় লক্ষ্মীর প্রসাদেও ভরে ওঠে তহবিল। দলের নিজস্ব বাস কেনা হয়। সহকর্মীদের নিয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলা। বাংলা ছাড়িয়ে আসর মাতাতে হাজির হয়েছেন বিহার অসম ত্রিপুরা আর উড়িষ্যায়। এমনই নানা ঝটিকাসফর আর সফরের পথে নানান সমস্যা, সংঘাত আর সমাধানের কাহিনি বলেছেন লেখক। বোঝা যায় তার যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের বেশি সময়টাই কেটেছে ঘরের বাইরে। দলবদ্ধভাবে এক আসর থেকে আর এক আসরে যাওয়ার পথে মোকাবিলা করতে হয়েছে ডাকাতদের সঙ্গে। বন্য জন্তু, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর ভূতের ভয় উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে হয়েছে যাত্রার আসরে। নানান প্রশাসনিক এবং অর্থকরী সমস্যা সামাল দিয়ে দলকে সজীব ও সচল রাখতে হয়েছে। এই সব কঠিন সমস্যায় কী করে দলের হাল ধরেছেন, কেমন করে আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন তারই বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে রচনাটির পাতায় পাতায়।
বোঝা যায় শুধু পালা রচনা, গান রচনা বা নির্দেশনাই নয়, নির্মল মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনের কর্ণধার হিসেবে সব ঝড়ঝাপ্টাই সামলাতে হয়েছে তাকে। প্রশংসা যেমন পেয়েছেন তেমনই বিদ্ধ হতে হয়েছে সমালোচনায়। বিশ্বাসঘাতকতার বিষে জর্জরিত হতে হয়েছে তাকে। পেয়েছেন অকৃপণ ভালোবাসা এবং বিদ্বেষ । দৈনন্দিন চলার পথে একজন সফল শিল্পীকে যেমন ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে যেতে হয়, রচনাকারের যাপনে পরপর দেখা দিয়েছে তেমনই দ্বন্দ্ব আর সংঘাত।
একদিকে যশ এবং অপনিন্দা আর তার পাশাপাশি সংকট এবং উচিত সমাধান সবই রচনাকার উল্লেখ করে গেছেন পরপর। কিন্তু অধিকাংশ আত্মজীবনীকে ভুগতে হয় যে আত্মসংকটে সেই গেরোয় মোক্ষম ফাঁসায় ফেঁসেছেন নির্মল মুখোপাধ্যায়। এই গেরো থেকে বেরিয়ে আসা অবশ্য সহজ নয়। একজন সফল মানুষকে তার জীবনীতে তো নিজের সাফল্যর কথাই বলতে হবে। জানাতে হবে যে দুএকটা সামান্য ভুল ভ্রান্তি ছাড়া তার জীবনচর্চায় সবটাই ঠিক। তিনি তো একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে উচ্চশিখরে উঠেছেন — কাজেই তাঁকে করতেই হবে আমিত্বের জয়গান। সুতরাং ঘুরেফিরে গড়ানো বল সেই আমিত্বের গর্তেই এসে পড়বে এবং সব সময়েই রচনাকারের উদ্দেশ্য থাকবে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত রাখা। বিখ্যাত চিত্রকর পরিতোষ সেনের মতো অকপট হতে পারেন আর কজন!
যদিও যাত্রাজীবনের অনেকগুলো গল্প বলার চাপে কিছুটা রসবিচ্যুত হয়েছে লেখকের গদ্যশৈলী। একজন সার্থক পালা রচনাকার ও গীতিকারের লেখনী যতটা ক্ষুরধার হওয়ার কথা, ততটা হয় নি। মনে হয় দীর্ঘ দিনের ফেলে আসা অসংখ্য ঘটনাক্রম সাজিয়ে তোলার চাপে কিছুটা এলোমেলো হয়েছে লেখকের কলম। সব মিলিয়ে ঘটনাবহুল তার জীবনযাত্রার কথা আমরা জানতে পারি ঠিকই, আরো জানতে পারি যাত্রাজগতের অন্দরমহলের কিছু কথা কিন্তু সমস্ত ঘটনার ওপরই ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি নির্মলকুমার মুখোপাধ্যায়ের তীব্র ছায়া। অধিকাংশ আত্মজীবনীই অবশ্য এই দোষে আক্রান্ত সেদিক থেকে তার ব্যতিক্রমী না হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
তবে এই পুস্তকটির থেকে সব চেয়ে মহার্ঘ যে উপহার পাওয়া গেছে তা হল যাত্রাজগতের আপাত নিষিদ্ধ কিছু গুহ্যকথা। নিজের সংসার ছেড়ে বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় বাইরে বাইরে থাকার কারণে এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেহেতু বেশি আবেগপ্রবণ হয় তাই পরস্পরকে আঁকড়ে ধরার একটা প্রবণতা থাকা খুব স্বাভাবিক। পারস্পরিক গভীর বন্ধুত্ব আর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সহজেই। সেই সম্পর্ক ক্রমে প্রসারিত হয় যৌনতার দিকে। গড়ে ওঠে অন্য এক সংসার। বাড়তে থাকে সামাজিক কুঞ্ঝটিকা। নির্মলকুমার মুখোপাধ্যায়ের জীবনেও এই দুই সংসারের টানা পোড়েন অব্যাহত ছিল গভীরভাবে এবং সেই সব আত্মসংকটের কথা উনি অকপটে তুলে ধরেছেন পাঠকদের কাছে। বোঝা যায় একজন স্রষ্টা হিসেবে যতটা আত্মসুখে ভরে উঠবে ওনার যাপন বলে ভেবেছিলেন, তা সফল হয় নি।
অবশ্য শিল্পীর জীবনে সবসময়ই ঘুরঘুর করে অতৃপ্তির ঘুনপোকা। না পারার বেদনা, পেরেও সার্থক না হয়ে ওঠার মনঃকষ্ট, সঙ্গের মানুষদের বিষম আচরণ সবসময়ই বিদ্ধ করে একজন স্রষ্টাকে। পাদপ্রদীপের আলোকবর্তিকা থেকে সরে আসা জীবনের নিস্তরঙ্গতা বিষন্ন অসহায় করে তোলে একজন শিল্পীকে। এমন সব চেনা দুঃখ চেনা সুখের সঙ্গে আরও এক অনভিপ্রেত বেদনার সম্মুখীন হতে হয়েছে নির্মলকুমারকে — তিনি চোখের সামনে দেখেছেন তার সাজানো বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে।
যখন লক্ষ্মী আর সরস্বতীর কৃপায় ধন্য নির্মলকুমার সেইসময় একটা হোটেল কিনেছিলেন পুরীতে। পরিচালনার দায়িত্ব দেন বড় ছেলেকে। কিন্তু ছেলের অবিমৃশ্যকারিতায় চুরমার হয়ে গিয়েছিল সব পরিকল্পনা। দেনায় জর্জরিত হয়ে অবশেষে বাধ্য হয়েছিলেন সে হোটেল বিক্রি করতে। প্রথম থেকেই নিজের দুই সন্তানের সঙ্গেও নির্মলকুমারের গড়ে ওঠে নি স্বাভাবিক সম্পর্ক । ক্রমে আরো চওড়া হয় ফাটল। চারপাশে ঘন হয়ে আসছিল অভিযোগ অভিমান আর বিশ্বাসঘাতকতার কুয়াশা। আর এরই পাশাপাশি গাঢ় হতে শুরু করল যাত্রা-জগতের অবক্ষয়। নতুন নতুন বিনোদনের আবহে মত্ত হয়ে উঠল গ্রামবাংলা। টিভি সিরিয়ালের দৌরাত্ম্যে যাত্রাপালার সামনে বন্ধ হল জনতার সিংদরজা।
পুস্তকটির প্রথমার্ধে আমরা জেনেছিলাম এক ক্ষমতাবান শিল্পীর সার্থক হয়ে ওঠার কাহিনি — জেনেছিলাম রোদ্দুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ার সংর্ঘষময় বিবরণ আর তারই পাশাপাশি দ্বিতীয়ার্ধে আমরা পেলাম ম্লান সন্ধ্যার বিষন্ন ছায়া। জানা গেল যাত্রাজগতের অন্দরমহলের কথা। পারস্পরিক দ্বেষ হিংসা যৌনতা আর ভালবাসার গল্প। নির্মলকুমার যেহেতু যাত্রা সমাজের ইতিহাস লিখতে বসেন নি তাই সবটাই পাওয়া গেল ভাসাভাসা। কিছু কিছু নাম এবং প্রসঙ্গ এসেছে একেবারে বিনা ভূমিকায়। একইভাবে রচনাকার হঠাৎ করেই চলে গেছেন প্রসঙ্গান্তরে। রস ঘন হতে হতে তাল কেটে যায়। যদিও যাত্রা জগতের বেশ কিছু ভোকাবুলারি জানা যায় — যেমন ‘মুখমিল করা’ (বসে সংলাপ বলা) বা ‘কিড়কিলি মাষ্টার’ (দর্শকদের হাততালি পাওয়া অভিনেতা) ‘দল উঠল’ (উত্তরবঙ্গে গেল) ‘নামলো’ (দক্ষিনবঙ্গে এল), দল ‘ছুটি’ অর্থাৎ পালা অভিনয় বন্ধ থাকবে অভিনেতারা পাওনা গন্ডা বুঝে বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু লেখক কেন বরাবরই দর্শক অর্থে ‘শ্রোতা’ কথাটি ব্যবহার করেছেন বোঝা গেল না।
গ্রন্থের প্রচ্ছদটি যথাযথ কিন্তু জ্যাকেটের ভেতরের প্রচ্ছদটি একেবারেই অভিনব। লাল মলাটের ওপর সোনালি হরফের নামাঙ্কন থেকে এক ফেলে আসা জীবনের পিছুটান পাওয়া যায়। মনে পড়তে পারে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বা রেডবুকের কথা। গ্রন্থের শেষে তিনটি প্রয়োজনীয় পরিশিষ্ট সংযোজিত হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে প্রভাতকুমার দাসের উপস্থিতি তখন বোঝা যায় কিন্তু তার সম্পাদনার বাঁধন আর একটু কড়া হলে সবদিক থেকেই সাধুবাদ দেওয়া যেত। এমন এক অভিজ্ঞ সম্পাদকের শ্যেনদৃষ্টি থেকে রস্টামের জায়গায় ‘রস্ট্রাম্প’ বা ডব্লিউ বি এফ সি-র জায়গায় ‘ডাব্লি এফ সি’ বাক্যটির বহু উল্লেখ কী করে ফস্কে গেল কে জানে।
যাত্রা আর সার্কাস দুনিয়ার অন্দরমহল সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আশানরূপ না হলেও সেই আকাঙ্খা অনেকটা পূর্ণ হল ‘আমার যাত্রাজীবন’ পাঠ করে।