• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • ঈশ্বরের গতিপথ : দিবাকর ভট্টাচার্য



    এ ঘটনাটা কবেকার কে জানে। ঘটনাটা আদৌ ঘটেছিল কিনা তাই বা কে বলতে পারে। যদি আমরা ধরেই নি যে ঘটনাটা ঘটেছিল তাহলে—

    তাহলে দেখতে পাবো — একটি জনশূন্য প্রান্তর। সেখানে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি প্রকাণ্ড গাছ। একটি গাছের তলায় পড়ে আছে একটি কাঠের বিরাট চেয়ার। একটি লোক এসে দাঁড়ালো ওই চেয়ারটির সামনে। নানা দিক থেকে দেখতে থাকলো সেটিকে। এরপর পকেট থেকে রুমালের মতো একটুকরো কাপড় বের করে খুব যত্ন করে মুছলো গোটা চেয়ারটাকে। তারপর চেয়ারটাকে তুলে নিল তার কাঁধে। সেই তোলা দেখে মনে হল চেয়ারটা যথেষ্ট ভারী। এবার সে চেয়ারটাকে কাঁধে নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল যেন খুব তাড়া আছে তার। যেন ওই চেয়ারটাকে যত শীগগির সম্ভব পৌঁছে দিতে হবে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায়।

    ঠিক এইসময় দেখা গেল কেউ একজন দূরের একটা গাছের আড়াল থেকে এই ঘটনাটা দেখেই কোথায় যেন লুকিয়ে গেল।

    এরপর চারিদিক আবার নিস্তব্ধ নির্জন হয়ে পড়ে রইল। কতক্ষণ কে জানে। ফের দেখা গেল সেই লোকটিকে। কাঁধে চেয়ার নিয়ে চলেছে। কিন্তু আগের মতো হনহন করে নয়। বরং মেপে মেপে পা ফেলে ফেলে। সামনের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। যেন সামনের দিকের কোনো একটা জায়গা ঠাহর করার চেষ্টা করছে সে।

    আরো ভালো করে লক্ষ্য করে বোঝা গেলো লোকটির মুখচোখে যথেষ্ট ক্লান্তির ছাপ। বয়সটাও যেন বেড়ে গিয়েছে অনেকটা। আর জায়গাটাও পুরোপুরি বদলে গিয়ে হয়ে গেছে এক পাথুরে টিলায় ঘেরা নিস্তব্ধ অঞ্চল। কিন্তু সেই আগের মতোই জনমানবশূন্য। লোকটি চলেছে যেন এই নির্জনতাকেই সঙ্গী করে। ঠিক আগের মতোই।

    এমন সময় দেখা গেল আরেকটি ব্যক্তি কোত্থেকে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। ভালো করে খেয়াল করে বোঝা গেল যে এই লোকটিই সেইজন যাকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

    এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করল — "কোথায় যাচ্ছো এই চেয়ারটাকে ঘাড়ে নিয়ে?" প্রথম ব্যক্তিটি উত্তর দিল — "একটা জায়গা আছে - সেখানে গিয়ে এই চেয়ারটা আমায় রেখে আসতে হবে।" এবার দ্বিতীয় ব্যক্তিটি বলল — "কেন? তোমাকেই রেখে আসতে হবে কেন?" প্রথম ব্যক্তিটি উত্তর দিলো — "কারণ এটা আমাকেই করতে বলা হয়েছে।" দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এবার প্রশ্ন করল — "কে বলেছে?" প্রথম ব্যক্তিটি এবার খুব গম্ভীরভাবে উত্তর দিল — "আমার বাবা।"

    দ্বিতীয় ব্যক্তি — "ঠিক বুঝলাম না তো।"

    প্রথম ব্যক্তি — "আমার বাবা চলে যাওয়ার সময়ে আমায় বলেছিলেন এই চেয়ারটার কথা। বলেছিলেন এটিকে যেন আমি যত্ন করে রেখে দিয়ে আসি সেই নির্দিষ্ট জায়গাটিতে।"

    দ্বিতীয় ব্যক্তি — "তা সেই জায়গাটা কোথায়?"

    প্রথম ব্যক্তি — "সেটার বিশদ বর্ণনা উনি দিয়ে গিয়েছিলেন — আর সেই মতোই তো যাচ্ছি" — বলে একটু থেমে বলল — "কিন্তু এখনো পৌঁছতে পারিনি তা তো দেখতেই পাচ্ছো।"

    দ্বিতীয় ব্যক্তি — "তা এভাবে কতদিন ধরে হাঁটছো তুমি?"

    প্রথম ব্যক্তি (একটু ম্লান হেসে খুব আস্তে করে বলতে থাকলো) — "সে কি আর হিসেব রেখেছি — অনেকদিন হল তো বটেই — আসলে জায়গাটা ঠিক কোথায় তো জানি না — কিন্তু সেটা এই পথেই আমি নিশ্চিত — কারণ বাবা বলে গিয়েছিল।”

    দ্বিতীয় ব্যক্তি — “কি বলে গিয়েছিলো?"

    প্রথম ব্যক্তি — “এই পথেই পড়বে — একটা সবুজ টিলা — আর তার গা বেয়ে নামছে একটা ছোট ঝর্ণা — আর সেই ঝর্ণাটা এসে মিশেছে পাশের একটা ছোট নদীর সঙ্গে — আর সেই নদীটার ধারে —"

    দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এইবার বলে উঠলো —"বুঝেছি - বুঝেছি - আর বলতে হবে না - কিন্তু -"

    "কিন্তু কি?" — খুব উদ্বিগ্নস্বরে প্রশ্ন করল প্রথম ব্যক্তিটি।

    দ্বিতীয় ব্যক্তিটি শান্তকন্ঠে উত্তর দিল — "তুমি তো সেই জায়গাটা পার হয়ে এসেছো অনেক আগেই।"

    প্রথম ব্যক্তিটি যেন আঁতকে উঠে বলল —"সে কি!"

    দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এইবার খুব ধীরে আর আস্তে করে বলল — "হ্যাঁ - আসলে এই চেয়ারটার ভার নিয়ে চলা তো মুখের কথা নয় - তাই চলতে চলতে তুমি খেয়ালই করো নি যে ওই জায়গাটা পার হয়ে গেছে কখন।"

    প্রথম ব্যক্তিটি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল কথাগুলো শুনে। যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তার ওই অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলল — "যাক গে। এখন তো আর কিছু করার নেই। তাই এই নিয়ে তুমি আর ভেবো এখন। বরং এবারে একটু বসো। এখানেই। এই চেয়ারটার উপর। একঠু জিরিয়ে নাও। তারপর ধীরেসুস্থে ফিরে যাও যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে।"

    প্রথম ব্যক্তিটি কোনোক্রমে বলতে পারল — "অসম্ভব।" সে এবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল দূরে পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট একসারি টিলা। তার পিছনে কিছু গাছের মাথা। সামনের পাহাড়ি রাস্তায় পড়ে আছে অজস্র রঙিন নুড়িপাথর। এবার যেন সে নিজেই নিজেকে বলে উঠল — "আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।" দ্বিতীয় লোকটি জিজ্ঞাসা করলো — "কি বিশ্বাস হচ্ছে না?" প্রথম লোকটি দূরের দিকে তাকিয়ে বলল — "তোমার এই কথাগুলো।"

    এইবার দ্বিতীয় লোকটি প্রথম লোকটির মুখের দিকে, তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে খুব এক আশ্চর্যকন্ঠে বলে উঠলো — "তাকিয়ে দেখো দূরের সব কিছু — তোমার চারিপাশের সবকিছু — তারপর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে —"

    চেয়ার-বওয়া লোকটি দূরের টিলাগুলোর দিকে আরেকবার তাকালো — দেখতে পেল দিনশেষের আবছায়া যেন ঘন হয়ে আসছে ওই টিলাগুলোর মাথায় — দূরের গাছগুলো ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ওই জমাট বাঁধতে থাকা অন্ধকারে — পাশে তাকিয়ে দ্বিতীয় লোকটিকে এইবার কিছু বলতে গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখলো যে ওই লোকটি আর সেখানে নেই। মানে কোত্থাও নেই। যেমন হঠাৎ করে এসেছিল তেমনই হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে কোথায় কে জানে।

    চারিদিক দ্রুত অন্ধকারে ঢেকে গেল। লোকটি চেয়ারটিকে পাশে রেখে মাথা নীচু করে বসে রইল একটা মাটির স্তূপের মতো। এক পাহাড়প্রমাণ ক্লান্তির চাপে সে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা নিজেও বুঝতে পারলো না। ঠান্ডা হাওয়ার ধারালো ঢেউয়ে ঘুম ভেঙে গেল তার। দেখতে পেল দূরের টিলাগুলোর মাঝে স্থির হয়ে আছে একটা প্রকাণ্ড চাঁদ। যার আলো ছড়িয়ে পড়ছে টিলাগুলোর চূড়ায়। দূরের গাছের মাথাগুলো ঝলমল করছিল সেই আলোয়। সব মিলিয়ে চারিদিক একটা আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছিল তার।

    সে অবাক হয়ে দেখছিল তার চারপাশ — যা সে কখনো এভাবে দেখেনি আগে। ঘাড় নীচু করে মুখ গুঁজে ওই চেয়ারটা বইতে গিয়ে পথের আশপাশের কিছুই সে খেয়াল করতো না কখনো — শুধু ভাবতো কখন সে পৌঁছতে পারবে সেই জায়গাটায় যেখানে রেখে আসতে হবে এই চেয়ারটা — তার বাবার কথামতো। কথাটা মনে হতেই সে এবার চেয়ারটার দিকে আরেকবার তাকালো। দেখলো ওই পূর্ণিমার আলোয় চেয়ারটাকে যেন সিংহাসনের মতো দেখতে লাগছে।

    চারিদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার তার চোখদুটো বুজে গিয়েছিল বিরাট ক্লান্তিতে। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গিয়েছিল সে। কত সব এলোমেলো স্বপ্ন ভেসে আসছিল ওই ঘুমের অতলে তার হিসেব নেই। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হল যেন তার বাবার হাত। খুব আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মুখে। তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল তার। তাকিয়ে দেখলো সকাল হয়ে গেছে। চারিদিক নরম আলোয় ভরা। আর তার মুখে এসে পড়ছে অনেক উঁচু থেকে খসে যাওয়া অজস্র শুকনো গাছের পাতা।

    তার চোখের সামনেই ভোরের সেই নরম রোদ ক্রমশ চড়া হয়ে যেতে লাগল। চারিদিকের টিলাগুলো সেই রোদে ঝলমল করতে লাগল। তার মনে হল — নাহ্। এই ভাবে বসে থাকাটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না, কোনো কারণ নেই, ওই হুট করে এসে পড়া লোকটার কথা বিশ্বাস করার। এমনকি লোকটা কি আদৌ এসেছিল নাকি পুরোটাই তার মনের বিভ্রম সেটাও ভাবছিল সে। এইসব ভাবতে ভাবতে সে উঠে পড়ল। আবার কাঁধে তুলে নিল সেই চেয়ারটা। আবার চলতে শুরু করল আগের মতো। ওই পাহাড়ি পথ দিয়ে।

    এইভাবে সে আবার কতকাল চলল তার লক্ষ্যের সেই ঝর্ণাঝরা উপত্যকার দিকে তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু সে চলতেই থাকলো। আর চলতেই থাকলো। সেই ঝর্ণা বা সেই উপত্যকার দেখা মিলল না কোত্থাও। কিন্তু সে থামল না আর কোত্থাও একটি বারের জন্যেও। খুব ধীরে ধীরে তার নুয়ে পড়া শরীরটাকে নিয়ে আর সেই চেয়ারটাকে ওই শরীরের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো বয়ে নিয়ে চলছিল সে। হঠাৎ দেখতে পেল কেউ যেন এসে দাঁড়াল তার সামনে। তারপর তার খুব কাছে এগিয়ে এসে তার দুকাঁধে হাত রেখে বলল আস্তে করে বলল — "পেলে না তো? এখনো পেলে না তো সেই জায়গাটার সন্ধান?"

    চেয়ার-বওয়া লোকটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল — "তুমি?" হঠাৎ এসে হাজির-হওয়া লোকটি বলল — "হ্যাঁ আমি। আমার সঙ্গেই তোমার দেখা হয়েছিল বহুকাল আগে।" চেয়ার-বওয়া লোকটি এবার যেন খুব কষ্ট করে তার ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখদুটি কুঁচকে অন্য লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল — "তাহলে তুমিই সেই লোক যে আমায় বলেছিল--"

    কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অন্য লোকটি বলে উঠল —"হ্যাঁ আমিই তো বলেছিলাম যে তুমি অনেক আগেই ছাড়িয়ে এসেছো যে জায়গাটায় তোমার যাওয়ার কথা ছিল। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো নি। তাই সকাল হতেই ফের শুরু করেছিলে তোমার এই পথচলা।"

    নুয়ে-পড়া লোকটি খুব ক্লান্তস্বরে বলল — "হ্যাঁ — তোমার কথাগুলো বিশ্বাস করিনি তখন — আজও করিনা—"

    "কেন?" — প্রশ্ন করল অন্য লোকটি।

    "কারণ আমি বিশ্বাস করি আমার বোধকে আমার অন্তরকে — তাই — চলি ভাই।"

    অন্য ব্যক্তিটি এবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকন্ঠে জিজ্ঞাসা করল — "তাহলে তুমি যাবেই?"

    "অবশ্যই।"— বলল নুয়ে-পড়া লোকটি। তারপর একটু থেমে একই রকম ক্লান্তস্বরে বলল — "কিন্তু তুমি কে বলো তো? এইভাবে আমার পিছু পিছু আসছো বারবার।"

    অন্য লোকটি বলল — "এটাই যে আমার কাজ। কারো বিশ্বাসের পিছু পিছু যাওয়া।"

    "তাহলে হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমার বাবার কথা — চলে যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিলেন আমায় — তাই ওটা আমায় রেখে আসতেই হবে সেই টিলার গায়ের ঝর্ণার ধারে — নদীর পাড়টিতে — দেরি হয়ে যাচ্ছে মিছিমিছি—" বলে সামনের দিকে এগোতে গিয়েই একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সেই নুয়ে-পড়া লোকটা । আর তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল পাশের গভীর খাদের নীচে। তার পিঠের চেয়ারটা ছিটকে পড়ে রইলো একটু দূরের পাথুরে জমিতে।

    অন্য লোকটি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই জায়গাটির দিকে যেখান থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল সেই লোকটি। মাথা নীচু করে কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল সেই জায়গাটিতে। তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল জমিতে পড়ে থাকা চেয়ারটির দিকে। তারপর চেয়ারটিকে খুব যত্ন করে বসিয়ে দিল সেই রুক্ষ জমির উপর।

    এইবার আবার অপেক্ষা করতে হবে তাকে। কারণ আবার কেউ আসবে। আগের লোকটির মতো। দুহাতে তুলে নেবে এই চেয়ারটিকে তার কাঁধে। তারপর চলতে থাকবে চেয়ারটিকে পিঠে নিয়ে। চেয়ারটিকে রেখে আসতে কোনো এক ঝর্ণা-ঝরা টিলার পাশে। এক গভীর বিশ্বাসে।

    আর অন্য ব্যক্তিটিকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে সেই পরবর্তী লোকটির জন্য। অলক্ষ্যে ওই অপারবিশ্বাসী লোকটির যাত্রাপথের অনুগামী হওয়ার জন্য।

    কারণ সেটিই যে ওই ব্যক্তির অর্থাৎ ঈশ্বরের গতিপথ।



    অলংকরণ (Artwork) : রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments