ধান ভানতে গিয়ে কিছুটা শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেল। ফিরে আসা যাক হেঁশেলে বা হাঁড়িশালে। এখানেই প্রশ্ন ওঠা সম্ভব রান্নাঘরে কি শুধু হাঁড়িই থাকে? সেটা অবশ্যই নয়। রান্নার জন্যে রয়েছে হাজারো সরঞ্জাম। হাঁড়ি তো আছেই—আকার ও আকৃতিভেদে তাদের নানা নাম – তোলো হাঁড়ি, তিজেল হাঁড়ি ইত্যাদি। তার বাইরে রন্ধনপাত্র হিসাবে আছে কড়া বা কড়াই, ডেকচি, বোগনো, গামলা, সস প্যান, ফ্রাইং প্যান, চাটু বা তাওয়া, এবং বর্তমান সময়ে অনিবার্যভাবে প্রেসার কুকার। রান্নাঘরের অন্যান্য সরঞ্জামের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর ক্লাসিক রান্নার বই ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’-এ। সেগুলো হলঃ ‘ঝাঁটা, ধামা, চুপড়ি, শিল ও নোড়া, বঁটি, ছুরি, তুন্দুর, চালুনি, ছাঁকনি, পাখা, বিড়া, হাতা, বেড়ি, খুন্তি, চিমটা, ডালঘুটুনি, ঝাঁঝরি, পিঁড়া, নুন রাখিবার পাত্র, তেলের বাটি, ঝালমশলার থালা, কাঠ কাটিবার জন্য কুড়ুল ও দা, লেতা (ন্যাতা), হাত ও বাসন মুছিবার জন্য গামছা কি ঝাড়ন, উনান খোঁচাইয়া ছাই ফেলিবার জন্য লোহার শিক কি ভাঙা বেড়ি।‘ এখনকার গ্যাস বার্নার শোভিত রান্নাঘরে কাঠ কাটার জন্যে কুড়ুল বা দা এবং উনানের আঁচ জোরদার করার জন্যে পাখার হাওয়া, কিংবা ছাই খোঁচানোর জন্যে লোহার শিক নিতান্তই অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। প্যাকেটে উপলব্ধ গুঁড়ো মশলার কল্যাণে শিল নোড়ারও একই পরিণতি। এমনকি বাঙালির খাওয়াদাওয়ার প্রধান পদ ভাত আর ডাল রান্না করার জন্যে যে হাঁড়ি ছিল অত্যাবশ্যক – আর যে কারণে রান্নাঘরের নাম হাঁড়িশাল—সেই হাঁড়িকে স্থানচ্যুত করে মৌরসি পাট্টা নিয়েছে প্রেসার কুকার। আধুনিক সরঞ্জাম হিসাবে যোগ হয়েছে--অন্তত সম্পন্ন সংসারে—মিক্সার গ্রাইন্ডার, ওটিজি, মাইক্রোওয়েভ আভেন, ইন্ডাকশন হিটার। হায় ধামা চুপড়ি, তোমাদের দিন গিয়াছে, এখন রান্নাঘরে শোভমান প্লাস্টিকের বোল (bowl) প্ল্যাস্টিকের বাস্কেট!
কিন্তু সরঞ্জাম তো উপলক্ষ্য, আসল লক্ষ্য হল বিভিন্ন পদের রান্না। বাঙালির সনাতন ঐতিহ্য মাটিতে বসে পাত পেড়ে খাওয়া, এবং সেই পাত ছিল আক্ষরিক অর্থে পাতা – কলাপাতা, শালপাতা, পদ্মপাতা। মধ্যযুগীয় প্রাকৃত পৈঙ্গলের কবি ভোজনসুখের বর্ণনা দিয়েছেন—
ওগ্গরা ভত্তা রম্ভমপত্তা গাইক ঘিত্তা দুদ্ধ সজুত্তা,অর্থাৎ, কলার পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, দুধ সহযোগে। মৌরলা মাছের তরকারি আর নালতে শাক – স্ত্রী পরিবেশন করে, পুণ্যবান খায়। লক্ষণীয়, সুচারু পরিবেশনও ভোজনসুখের আবশ্যিক অঙ্গ। তারপর আঙ্গিক বদলেছে। পাতার জায়গায় এসেছে থালা – যদিও পাত নামটা রয়ে গেছে। রয়ে গেছে সেই থালায় ভাত বেড়ে তার একপাশে কিংবা আলাদা করে বাটিতে ব্যঞ্জন সাজিয়ে দেবার ঐতিহ্য। সম্পন্ন বাঙালি পঞ্চব্যঞ্জনের কমে তৃপ্ত হয় নি। তাই গৃহিণীদের ব্যাপৃত হতে হয়েছে ব্যঞ্জনে বৈচিত্র্য আনতে—যার ফলে আবির্ভাব সিদ্ধ-ভাতে, ভাজাভুজি, শুকতো, ডাল, চচ্চড়ি, ঘণ্ট, ডালনা, ঝাল-ঝোল আর অম্বলের। বাঙালির হেঁশেলের এইসব ফসল আজও আপামর বাঙালির রসনাকে পরিতৃপ্ত করে চলেছে।
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কন্তা খাই পুণ্যবত্তা।
প্রথম পাতে গরম ভাতের সঙ্গে সিদ্ধ বা ভাতে খাওয়া প্রশস্ত। ‘ভাতে’ আর কিছুই নয়, সবজিকে আলাদাভাবে সিদ্ধ না করে ভাতের সাথে সিদ্ধ করা। ভাতের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে তার স্বাদ বাড়ে। আলু, কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ, উচ্ছে, করলা, মানকচু, ওল এই সব কিছুরই ভাতে হয়, এমনকি ন্যাকড়ায় বেঁধে মসূর ডালও। এই সব ভাতে সাহেবদের boiled vegetable-এর মতো শুধু নুন ছড়িয়ে খাওয়ার জন্যে নয়। সেগুলোকে মাখতে হবে নুন লংকা আর সরষের তেলের সাথে। আলুভাতেকে নানাস্বাদী করে তোলা যায় তার সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ, ভাজা পেঁয়াজ, ভাজা বড়ি, ধনেপাতার কুচি, ভাজা নিমপাতা, কুমড়ো বা করলা সিদ্ধ, আর আমিষগন্ধী করতে হলে সিদ্ধ ডিম কিংবা কুচো চিংড়ি ভাজা। সিদ্ধর জায়গায় বেগুন পোড়াও চলে প্রথম পাতে। কথিত আছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন পোড়া কেন গোড়াতেই খাবেন। গোপাল ভাঁড় জবাব দিয়েছিলেন ‘পোড়ার মুখে সব ভালো।’
শুক্তো বাঙালির হেঁশেলের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এর উপাদান আলু, বেগুন, রাঙালু, মুলো, কাঁচকলা, উচ্ছে বা করলা, কচু আর সজনে ডাঁটা। সব ফালি ফালি করে কেটে একটু ভেজে নিয়ে গুঁড়ো ভাজা মশলা সহযোগে রান্না হয় শুক্তো। কেউ কেউ এতে থানকুনি পাতা যোগ করার পক্ষপাতী। নামিয়ে আনার পর উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নারকেল কুরো। পূর্ব বাংলায় শুক্তোর ধারণা অন্যরকম – সেটা হল লাউ, কাঁচকলা, শশা জাতীয় সবজিকে ডুমো ডুমো করে কেটে রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে রান্না হালকা এক পদ।
ভাতে ডাল মেখে ভাজাভুজি বা তরকারি দিয়ে খাওয়াটাই রেওয়াজ। এটা অবশ্য ডালের ঝোল, চণ্ডীমঙ্গলে বা চৈতন্যচরিতামৃতে যার উল্লেখ ডাল সূপ নামে। সূপের আদি অর্থ রন্ধন-- যার থেকে রন্ধনকারীর নাম সূপকার। রন্ধননিপুণ ভীম অজ্ঞাতবাসকালে বল্লব ছদ্মনামে বিরাটরাজের ভবনে সূপকার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। বাঙালির হেঁশেলে সবচেয়ে সমাদৃত ডাল মসূর আর মুগ। আর আছে কলাই বা বিউলি, ছোলা বা বুট, অড়হর, খেসারি। শুধু জলে সিদ্ধ করে ছেড়ে দেওয়া নয়—এদের প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট ফোড়ন আছে, আর আছে কোনটাতে ঘি কোনটাতে পেঁয়াজ কোনটাতে লাউ পেঁপে গাজর বা নারকেল টুকরো করে কেটে মেশানো। মসূর ডালে কাঁচা আম বা চালতা দিয়ে হয় টকের ডাল, মুগ ডালে ভাজা উচ্ছে আর লাউ বা চালকুমড়ো মিশিয়ে তিতার ডাল। কলাইয়ের ডালের সঙ্গে আলু অথবা ঝিঙেপোস্ত রাঢ় অঞ্চলের প্রিয় খাদ্য, তবে তা অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। দুঃখ শুধু এই যে পোস্ততে আগের স্বাদ নেই আর এর দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
নদীনালা খালবিলের দেশ পূর্ববঙ্গে ডালের চাষ সীমিত, সেখানে ভাতের সহযোগী নানাবিধ মাছ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশে গিয়ে একটি বালককে কী খেয়েছে প্রশ্ন করায় সে উত্তর দিয়েছিল দুরকমের মাছ দিয়ে ভাত। ডাল ছিল কিনা জানতে চাওয়ায় সে অবাক হয়ে বলেছিল ডাইল তো বড়োলোকেরা খায়। খাওদাওয়ার শেষে কলাই ডাল চুমুক দিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ আছে ঢাকা অঞ্চলে। ডালের প্রসঙ্গে একটা গল্পের উল্লেখ করা যায়। মেয়ে দেখতে এসে পাত্রপক্ষের অভিভাবক কিশোরী মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, অতিথি এসেছে কিন্তু বাড়িতে আছে শুধু চাল আর ডাল, অতিথি সৎকার সে করবে কী ভাবে? একটুও অপ্রতিভ না হয়ে মেয়েটি বলল, ভাত তো হবেই আর তার সঙ্গে ডালভাতে, ডালের সূপ, ডাল বেটে তার বড়া, এবং একটু তেঁতুল দিয়ে সেই বড়ার অম্বল। ডালে ভাতে খিচুড়ি অবশ্যই করা যেত, এবং সেটা হয়তো কম সমাদৃত হত না।
চচ্চড়ি বাঙালির এক গৃহস্থপোষ ব্যঞ্জন, এবং তা অতি উপাদেয়। এটির উপাদান নানান সবজি আর শাক – আলু, বেগুন, মুলো, কুমড়ো, বরবটি, শিম, বাঁধাকপির পাতা, লাউশাক, পুঁইশাক, কাটোয়ার ডাঁটা। খেয়াল রাখতে হয় রান্নার সময় সবজিগুলো যেন গলে না যায় এবং তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। চচ্চড়ি হবে মাখামাখা। ফোড়নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – সেটি হল পাঁচফোড়ন। মশলার কোন বাহুল্য নেই—শুধু একটু সরষে বাটা। ঈষৎ শুকিয়ে যাওয়া অথবা বুড়ো সবজির প্রকৃষ্ট সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্র হল চচ্চড়ি। তা বলে তাজা সবজি দিয়ে চচ্চড়ি রান্নায় কোন বাধানিষেধ নেই। চচ্চড়ির জগতে বাটি-চচ্চড়ি একটু অন্য জাতের – ফোড়নের কোন বালাই নেই, লম্বা লম্বা করে কাটা আলু অথবা আলু আর কুমড়ো ফুল একটু সরষে বাটা সরষের তেল আর কাঁচা লংকা মেখে সামান্য জল দিয়ে বাটিতে করে অল্প আঁচে সিদ্ধ করে নেওয়া। স্বাদে অপূর্ব। আলু চচ্চড়িও অন্য জাতের। এখানে শুধুই আলু – ডুমো ডুমো করে কাটা, ফোড়ন কালো জিরে। পছন্দমতো একটু রসালো অথবা শুকনো। এটা ঠিক ভাতের ব্যঞ্জন নয়, গরম লুচি বা পরোটার সঙ্গে এর অনবদ্য মেলবন্ধন, যেমনটা আলুর দমের। তবে আলুর দম একটু রাজসিক রান্না—তেল আর মশলার ব্যাপারে কার্পণ্য চলে না।
বাংলা খাবারে চচ্চড়ির পরে আসে ঘণ্ট। ঘণ্টের অর্থ ঘাঁটাঘাঁটা, অর্থাৎ চচ্চড়ির মতো শুকনো নয়—একটু থকথকে । নানা সবজি আর শাকের মিশ্রণে তৈরি হয় ঘণ্ট। আবার একক সবজিতে রান্না করা যায় ঘণ্ট—যেমন, লাউ ঘণ্ট। প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিধানঃ
নামেতে যেমন ঘণ্ট কাজেও তাহাই।এই নির্দেশকে পুরোপুরি মান্যতা দিতে পারেন না আজকের গৃহিণীরা – একটু্ শর্টকার্ট করতেই হয়। তবু যখন লাউঘণ্টতে যোগ করা হয় ভাজা কুচো চিংড়ি, সেই লাউ চিংড়ি স্বাদে গন্ধে এক অপূর্ব মাত্রা পায়। এর ঐতিহ্য সেই গোপাল ভাঁড়ের আমল থেকে –এখন তা হেঁশেলের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে অভিজাত ভোজনশালাগুলোতেও। ঘণ্টের জগতে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে চাপড়া বা চাপড়ি ঘণ্ট, যার ঘরানা মূলত বারেন্দ্র – উত্তরবঙ্গীয়। এর উপাদান শশা আর ঝিঙে – কুচিকুচি করে কাটা । মেথি ফোড়ন দিয়ে সবজিগুলোকে সিদ্ধ করে তার উপর আধগুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খেসারি বা মটর ডালের ‘চাপড়া’, যেটি তৈরি করা হয় তাওয়ার উপর ঘি বা তেল ছড়িয়ে বাটা ডাল হাতের চাপড় দিয়ে চাকার মতো করে এপিঠ-ওপিঠ সেঁকে নিয়ে।
ঘণ্ট রাঁধিতে অনেক মশলা চাই।
ফোড়নের মশলা তেজপাতা হিং জিরা
ভুলনাকো দিতে তাতে আদা এক গিরা।
দুধ চিনি আরো জিরা মরিচবাটা,
সাঁতলাবে শেষে ঘিয়ে, করো ঘাঁটাঘাঁটা।
ঘণ্টর সহযোগী অথবা বিকল্প হিসাবে পরিবেশিত হয় ডালনা। প্রায় সব সবজি দিয়েই তৈরি হয় ডালনা। আলু পটোলের ডালনাই বেশি প্রচলিত । তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, এঁচোড়, ওল, কচু, মানকচু, পাকা শশা, ফুলকপির ডালনাও। নাম উহ্য থাকলেও আলু এইসব ডালনার অপরিহার্য অঙ্গ। ঘণ্ট যেমন ঘাঁটা ঘাঁটা, ডালনা তেমন নয়—একটু ঝোলের মধ্যে সবজিদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। ডালনার সংসারে ছানার ডালনা বনেদি। জল-ঝরানো ছানাকে চৌকো বা চ্যাপটা আকারে কেটে তেল বা ঘিয়ে ভেজে নিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর সহযোগে রান্না হয় ছানার ডালনা। এরই প্রায় সমগোত্রীয় ধোঁকার ডালনা। ছানার জায়গায় মটর ডাল আর ছোলার ডাল বাটা। চৌকো আকৃতির ভাজা টুকরোগুলোকে ছানার টুকরো বলে ভ্রম হয় বলেই কি এর নাম ধোঁকা? সে যাই হোক, ছানার ডালনা আর ধোঁকার ডালনা তাদের নিজস্ব মহিমায় বিরাজমান।
বাঙালির হেঁশেলের একটি বিশেষ পদ হল দোলমা। এখানেও প্রথমে আসে পটোলের নাম। পটোলের একটা দিকের মুখের বোঁটা কেটে কাঁটা দিয়ে ভিতরের বিচিগুলো বার করে নিয়ে তার মধ্যে পুর ভরে হালকা করে ভেজে রসারসা করে রান্না করা হয় দোলমা। ভাজার আগে অবশ্যই কাটা মুখ বন্ধ করতে হবে ময়দার লেই দিয়ে কিংবা সরু কাঠি গুঁজে। কীসের পুর? সুকুমার রায়ের ‘মাছ পটোলের দোলমা ভালো’ স্মর্তব্য । মাংসের কিমাও চলে। নিরামিষ রাঁধতে হলে ছানাকে দানা দানা করে ভেজে মশলা মিশিয়ে তৈরি হয় পুর। তার সঙ্গে দু একটা কিসমিস। করলা বেগুনেরও দোলমা হয়। সেক্ষেত্রে বিচি বা ভিতরের শাঁস বার করতে হবে এই সব সবজির পেট চিরে। ভাজবার আগে কাটা পেট সেলাই করতে হবে সরু সরু কাঠি ঢুকিয়ে অথবা স্রেফ সুতো দিয়ে জড়িয়ে।
শেষ পাতে অম্বল বা চাটনি না থাকলে খাওয়া সম্পূর্ণ হয় না। অম্বল এসেছে ‘অম্ল’ থেকে, যার অর্থ টক। তাই অম্বল রাঁধা হয় কাঁচা আম, কাঁচা তেঁতুল, আমড়া, চালতা ইত্যাদি টক স্বাদের ফল দিয়ে। তা বলে সবজিরা অম্বলের দলে ব্রাত্য নয়। আলু, রাঙালু, মুলো, বেগুন, কুমড়ো আর ডালের বড়ি মিশিয়ে অতি উপাদেয় অম্বল তৈরি হয়। বলা বাহুল্য, টক স্বাদ আনার জন্যে তাতে দিতে হবে পাকা তেঁতুল অথবা পাকা তেঁতুলের মাড়ি। সাধারণত অম্বলে মিষ্টি দিতে হয় না। চাটনিতে পেতে হবে টক আর মিষ্টি দুইয়েরই স্বাদ। অতি মিষ্টি কাঁচা পেঁপের ‘প্লাস্টিক’ চাটনিতে তাই রান্নার শেষে মেশাতে হয় পাতিলেবুর রস।
রান্না-জগতে বাঙালির অবদান কী এই প্রশ্ন তুলে সৈয়দ মুজতবা আলি নিজেই তার উত্তর দিয়েছিলেন – -মাছ, ছানা এবং বাঙালি বিধবার নিরামিষ রান্না। নিরামিষ রান্নার এতশত পদ আর তাদের স্বাদবৈচিত্র্য হয়তো ভারতের অন্য কোন প্রদেশে মিলবে না। বিভিন্ন পদ রান্নার জন্যে ঠিকমতো আকার আকৃতিতে আনাজপাতি কাটা থেকে শুরু করে ফোড়ন ও মশলার যথাযথ নির্বাচন ও প্রয়োগ এই স্বাদবৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে। চচ্চড়িতে ঝাল আর অম্বলেতে ঘি যে চলে না এটা হেঁশেলের গৃহিণীদের প্রথম পাঠ। তারপর তাঁদের হাতে যে সব ব্যঞ্জন প্রস্তুত হয়ে আসে সেগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ – খাবার সময় নুন গোলমরিচ সস সেগুলোতে আলাদা করে মেশাতে হয় না। মুজতবা সাহেব জানিয়েছেন, কোন এক ফরাসি রাজা খেতে বসে তরকারিতে একটু নুন মেখেছিলেন বলে তাঁর শেফ আত্মহত্যা করেছিলেন। এই গল্প না-পড়েও হেঁশেলের গৃহিণীরা ব্যঞ্জনে নুন ঝাল টক মিষ্টির পরিমাণে সাধারণত ভুল করেন না।
নিরামিষ থেকে এবার আমিষে আসা যাক। বলা হয়, মাছে ভাতে বাঙালি। নদীনালা-পুকুরের দেশে সেটাই স্বাভাবিক। চুনো মাছ থেকে রুই কাতলা শোল বোয়াল মাগুর চিংড়ি পাবদা ট্যংরা পারশে গুরজালি – মাছেদের মধ্যে কত না বৈচিত্র্য, আর বাঙালির হেঁশেলে তাদের সদ্গতি ভাজা থেকে শুরু করে ঝোলে ঝালে অম্বলে। মশলার তারতম্য স্বাদে আনে ভিন্নতা। গোটা কালোজিরে কাঁচা লংকা দিয়ে হালকা ঝোলের স্বাদ একরকম, কালোজিরে বেটে দিলে তার স্বাদ ভিন্নতর, ধনে জিরে আদা দিয়ে আর একরকম। মাছের ঝোলে আলু পটোল বেগুন বড়ি বেশ খাটে। আর তাছাড়া আছে পেঁয়াজ দই দিয়ে দই মাছ, পেঁয়াজ গরম মশলা দিয়ে মাছের কালিয়া। সরষে বাটা দিয়ে একটু মাখামাখা ঝোলই হল মাছের ঝাল, আর সরষে বাটা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে তাওয়ার উপর এপিঠ ওপিঠ সেঁকে নিয়ে হয় মাছের পাতুরি। মুজতবা সাহেবের মন্তব্য: ‘মাছের সঙ্গে সরষে যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথার সঙ্গে সুরের মিল’।
মাছেদের রাজত্বে ইলিশ মাছ মহারাজা। এ শুধু ‘ছাওয়াল কান্দানে মাছ রান্ধুনি পাগল মাছ’ নয়, এই মাছের জন্যে তামাম বাঙালি পাগল। বেগুন অথবা কুমড়ো দিয়ে হালকা ঝোলই হোক অথবা সরষে কাঁচা লংকা দিয়ে ভাপা ইলিশ – এদের স্বাদ লা-জবাব। সরষে দিয়ে ভাপা চিংড়ির স্বাদও অনবদ্য। তাছাড়া নারকেলের দুধ আর গরম মশলা দিয়ে রান্না চিংড়ি মাছের মালাই কারি কিছু কম যায় না। মোহনবাগান ইস্ট বেঙ্গলের খেলা হলে ঘটি বাঙালের মধ্যে চিংড়ি আর ইলিশ নিয়ে তরজা শুরু হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় এই পদগুলো পাতে পড়লে দু পক্ষই তরজা ভুলে যায়।
বাঙালি কোন কালেই ঘোরতর মাংসাশী নয়। তার কারণ মাংসের মহার্ঘতা। পূজাপার্বণ উপলক্ষ্য করে অথবা সপ্তাহে একদিন মাংস খাওয়ার ঐতিহ্য বাঙালির অনেকদিনের । সেটা আদা পেঁয়াজ দিয়ে রান্না মাংসের টানা ঝোল, আর তার মধ্যে আধখানা করে কাটা আলুর টুকরো। কোর্মা, দোপেঁয়াজা, কষা মাংসের মতো পোশাকি পদ এসেছে পরে। মাংস বলতে পাঁঠা বা খাসির মাংস। হিন্দু বাঙালির জন্যে গোরুর মাংস আর মুরগি ছিল নিষিদ্ধ মাংস। শুয়োরের মাংসও তাই। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ডিরোজিয়ো শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যেরা এগুলো খেয়ে বিধিভঙ্গের প্রয়াস নিয়েছিলেন, কিন্তু তা সামাজিক মান্যতা পায় নি। বরং তাঁদের জনগণের বিদ্রূপ শুনতে হয়েছিলঃ
ফস করে ঢুকে পড়ি চাচার দোকানেদু শতাব্দী পেরিয়ে এসে চিকেন এখন বাঙালির নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্য। ইয়ং বেঙ্গলরা দেখলে কী বলতেন?
খাই বিশুদ্ধ পক্ষী,
ঘরে ফিরে এসে গীতা নিয়ে বসি
বাবা বলে ছেলে লক্ষ্মী।
গ্রন্থ সহায়তাঃ
১) আমিষ ও নিরামিষ আহার – প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী (আনন্দ পাবলিশার্স), ২০১৯
২) সৈয়দ মুজতবা আলি রচনাবলী; (খণ্ড ১, ২) (মিত্র ও ঘোষ), ১৪১৭