ফিরে এসেছি দিন সাতেক হ’ল আর সব সফরের পর যে কাজের পাহাড় থাকে তাই ভাঙছি। জামা কাপড় কাচা, ইস্ত্রিতে দেওয়া, তোলা গোছানো। কিন্তু সবের ফাঁকে টুকরো টুকরো ছবি মন ভরিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যে বেলা শাঁখ বাজাতে গিয়ে শুনছি গোবিন্দ জীউয়ের মন্দিরে মৃদংগ, বিশাল জোড়া শাঁখ, মঞ্জীরা, রাম করতাল সমৃদ্ধ আরতি অর্চনা। ভক্ত বাদকদের আদুড় গা, মাথায় মণিপু্রি ঢং-এ সাদা পাগড়ি, পরনে সাদা ধুতি। বেলা চারটেয় যথারীতি স্বাস্থ্যোদ্ধারে হাঁটতে বেরিয়ে যেন ইমা কেইথলে ঘুরছি, এটা কিনছি, ওটা দেখছি; হয়ত বা শুধু শুধুই পাক মারছি। বেলা এগারোটা, বারোটা—সব মহিলারই এটা সংসার চালানোর পিক আওয়ার—আমার হাত চলছে, মনে মনে থাক থাক পাহাড়ের স্তর ঘেরা পথে চলেছি হয়তো বা মইরাং নয়তো পূর্ব মণিপুরের দিকে আরো অজানা কিছুর খোঁজে।
তাহলে? তাহলে দিন এক থেকেই শুরু করি। মাত্র দেড় ঘণ্টার ফ্লাইট, ঝুটঝামেলাহীন। হোটেলে গিয়ে ভাবলাম আধবেলা খানিক ঘুরে নিই। গেলাম মার্বেল বাঁধানো গোবিন্দ জীউর মন্দির। তিন দুয়ারী মন্দিরে তিন ধরনের বিগ্রহ দেখা যায় নাট মন্দির থেকে। প্রথম ঘরে বলরাম শ্রীকৃষ্ণ, মধ্যিখানে রাই শ্যাম, তার পাশের ঘরে জগন্নাথ, বলরাম সুভদ্রা। এ তো গেল মন্দিরের কথা। যখন খুশি যেদিন খুশি দেখা যায়। তবে সেদিন ছিল গোষ্ঠ অষ্টমী--মণিপুরীরা কৃষ্ণের ভক্ত। দেখলাম ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কৃষ্ণ ও তাঁর সখা সেজে মন্দির প্রাঙ্গণে বকাসুর বধে মেতেছে। এমন বর্ণাঢ্য ব্যাপার অনেকদিন দেখিনি। শিশুদের সাজ কী নিখুঁত! দলে দলে সত্যি যেন অসংখ্য কৃষ্ণ তাঁর সখাদের নিয়ে বৃন্দাবনের বনে গোচারণরত।
আমাদের সেদিনের যাত্রাপথে জাপানী ওয়ার মেমোরিয়ালও দেখার ছিল। তবে মইরাং-এর পর আমাদের মন টেনেছে লোক্ তাক লেক। পাহাড় ঘেরা সুদূর দিগন্ত ছোঁয়া এই জলাধার। তার মাঝে মাঝে ভাসমান দ্বীপ। যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের ঘন সবুজ, জলের নীল,আর দ্বীপের হাল্কা সবুজের মাঝে মেছুয়াদের বসতি আর ছোট ছোট ডিঙ্গিতে জাল ফেলতে উদ্যত মেছোরা।
কল্পনা মাখানো মাইথোলজি আর জীবনের রসদ থেকে তৈরি ইতিহাস--এই দুয়ের মেল নিয়ে কালাংগা ফোর্ট। গলফ কারে ফোর্ট ঘুরে দেখতে দেখতে অন্য এক মাত্রায় যেন পৌঁছে গেলাম। তবে ইতিহাস ও কিংবদন্তীর জন্য খানিক প্রস্তুতই ছিলাম। যা অবাক করে দিল তার সবটাই ওই উনিশ-কুড়ি বছরের গাইড মেয়ে। নাম নোবিনা। কলেজে পাঠরতা। পার্ট টাইমার হিসাবে কখনোসখনো গাইডের কাজ করে। দুভাবে ফোর্ট ঘুরে দেখা যায়। এক অল্প সময়ে গাইড ছাড়া ঘুরে দেখা বা গাইড নিয়ে সব বুঝে নেওয়া। আমরা পরেরটাই বেছে ছিলাম। যখন পৌঁছালাম দেখলাম বিশাল গেটের একটু পরেই গাছের ছায়ায় সার দিয়ে গলফ কার, আর ছোট একটি এক কামরার বাড়ির বারান্দায় জিন্স শার্ট পরিহিতা, এক আধুনিকা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত। সামনে স্ট্যান্ডে পিতলের থালায় সামান্য ফুল, ছোট ঘটে জল আর ধূপবাতি। পূজা শেষ হ’লে জানলাম ওই মেয়েই আমাদের গাইড। নোবিনা। কৌতূহলী মানুষ আমি, জিজ্ঞাসা করেই বসলাম ওর ইতিবৃত্ত, আর কীসের পূজা ও করছিল। জানলাম ও ওদের ইষ্টদেবতাকে এইভাবেই প্রতি সকালে স্মরণ করে। প্রার্থনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই সত্যি। যা অবাক করেছিল তা আধুনিকতা ও পরম্পরার মেলবন্ধন। জিন্সের সাথে হাঁটু গেড়ে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ মেলাতে পারিনি। কোলকাতা ফিরে চেষ্টা করেছিলাম ওইভাবে সকাল সকাল প্রার্থনা করে বাকি সব কাজে মাততে-–হয়নি। রামধনু রং দৈনন্দিনের তীব্র আলোয় মিলিয়ে গেছে।
ইতিহাস, কিংবদন্তী, প্রকৃতি আমাদের ঘিরেই ছিল, তবে মনশ্চক্ষে যা ফাঁকে ফাঁকে আজ ভেসে উঠছে তা মণিপুরীদের দৈনন্দিন-- কোথাও গ্রামের মেঠো পথে এক ঝাঁক হাঁসুছানা যেন ঝিলিক দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল, ছবি তোলা গেল না। তিলক ফোঁটা-কাটা প্রৌঢ়া ইমা দোকানি এক গোছা কণ্ঠিমালা হাতে আমাদের সাথে ছবি তুলেছিলেন, তাও যেন আবার দেখতে পেলাম। ইমা কাইথলেই ফানেক সেলাই রত মেশিন পেড়ে বসে থাকা নাকে চশমা ঝুলে পড়া বৃদ্ধাও যেন টুক করেই দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেলেন। সেখানেই এক সম্ভ্রান্ত মণিপুরী পরিবারের সাথে ছবি উঠেছিল, তাদের ফানেক চাদর পরার কায়দা ভারি ভাল লেগেছিল-- দেখলাম যেন ওরা হাসছে। মুখে হলুদ তিলক মাটি মাখা মেয়েদের প্লাস্টিকের কলসি নিয়ে স্নানে যাওয়া, সেও যেন রেলগাড়ি থেকে দেখা দ্রুত ছবির মত বেরিয়ে গেল। --এটাই বোধহয় স্বাভাবিক—ইতিহাস, কিংবদন্তী চিরকালের, কিন্তু চলমান নয়। যেকোনো দেশের দৈনন্দিন কিন্তু সদা প্রবহমান ধারার মত। মুঠোয় ধরা যায় না, বইয়ের পাতায় গুছিয়ে তুলে রাখার মতও কিছু নেই তাতে, কিন্তু তার আর্কষণ প্রবল।
যা বেশি ভাল লাগে তা যেন বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। আমাদের তিন দিনের ইম্ফল ট্রিপটাও তাই চোখের নিমেষে কেটে গেল। যা দেখার সবই দেখেছিলাম তবু কী যেন না দেখা রয়ে গেল, কী যেন অধরা রয়ে গেল।