• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প : সংগ্রামী লাহিড়ী



    "দূর হ', দূর হ' আমার চোখের সামনে থেকে, মুখ দেখতে চাই না তোর। খরগোশকুলের কলঙ্ক! কোন আক্কেলে আবার ফিরে এসেছিস গর্তে? লম্বা লম্বা কান দুলিয়ে? লজ্জাঘেন্না কিছু নেই তোর?"

    বাবা রাগে গরগর করতে করতে হাঁপাচ্ছিল। চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। নাকের ফুটো বড় বড় হয়ে গেছে। ভুরু কোঁচকানো। সামনের পা দুটো দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে, পারলে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলের ওপর। পারছে না তার কারণ মা পিছন থেকে লেজটা টেনে ধরে আছে। জানে তো, রেগে গেলে বাবার জ্ঞান থাকে না।

    আজ অবশ্য রাগের যথেষ্ট কারণ আছে।

    দৌড়ের একটা প্রতিযোগিতায় ইভানকে পাঠিয়েছিল বাবা।

    ইভান একজন তরুণ খরগোশ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ।

    লম্বা শীতকাল সবে বিদায় নিয়েছে। শীতকালটায় ইভান আর তার বাবা-মা একসঙ্গেই থাকে। চেরিগাছের গায়ে একটা বড়োসড়ো গর্ত আছে। বুনো ঝোপের ডালপালায় ঢাকা। বেশ নিরাপদ আশ্রয়। খাবার খুঁজতে বাইরে যেতে হয় অবশ্য। তবে বেশি কিছু জোটে না। ঘাস তো পুরু বরফের তলায়। তাই হয়তো একটু ওক গাছের শুকনো ডালপালা চিবোলো, কিংবা পড়ে থাকা কিছু ভুট্টার দানা। গাছের ছালও শীতের মেনুতে থাকে। শীতকালে আরো একটা জিনিসের ওপর ভরসা করতে হয়। আদ্ধেক হজম হওয়া খাবারদাবার যখন শরীর থেকে পুপ, মানে বিষ্ঠা হয়ে বেরিয়ে আসে, সেটা খেয়ে নিলেও পুষ্টির দরকারটা মেটে। এ কথা অবশ্য তারা খরগোশরা পাঁচকান করে না। গোপনেই রাখে। তবে জ্ঞানী কচ্ছপদের কাছ থেকে লুকোনো শক্ত। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে সব খবর রাখে ওরা।

    শীতকালে কচ্ছপরা মাটির তলার গর্তে শীতঘুমে চলে যায়। হাইবারনেশন। খাবার খায়ই না বলতে গেলে। খরগোশদের তো আর শীতঘুম নেই! হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও পেটে দেবার রসদ খুঁজতে হয়। তাই পুষ্টিকর কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। সে হলোই বা নিজের পুপ!

    মার্চের শেষের দিকে সেদিন রোদ্দুরের খুব তেজ। উষ্ণতায় ভরে আছে চারদিক। আড়মোড়া ভেঙে গর্ত থেকে উঁকি মারল বুড়ো কচ্ছপ। বেরোবার সময় হয়েছে। চারদিকটা একটু জরিপ করে নেওয়া দরকার। এমনি বরাত, চোখ পড়ে গেল সটান বাবার ওপর। বাবা তখন গোপন ডায়েট নিয়ে ব্যস্ত। পেট থেকে বেরিয়ে আসা আধ-হজম হওয়া খাবার ভিটামিন বি তে ভর্তি। তাছাড়াও আরো কত পুষ্টিগুণ! খেয়ে নিলেই নিশ্চিন্দি!

    দেখেশুনে বুড়ো কচ্ছপ নাক সিঁটকে সরে গিয়েছিল। " ম্যাগো, নিঘিন্নে!" বলেও ফেলেছিল বোধহয়।

    "কী বললে খুড়ো? আরেকবার বলো দেখি?" পুপ ফেলে বাবা তেড়ে আসে, "আমরা নিঘিন্নে? তাও আবার শুনতে হবে তোমার মত খোলায় ঢাকা অদ্ভুতুড়ে জীবের কাছে? ওই তো চেহারা, ড্যাবাড্যাবা চোখ, গলা দেখা যায় কি যায় না, লেজখানা দেখলে তো হাসি চাপা দায়, সে কিনা আবার খরগোশদের জাত তুলে কথা বলে?"

    “বলব না তো কী? আমরা হলাম জ্ঞানী, বুদ্ধিমান। আমাদের সঙ্গে কার তুলনা?”

    কথায় কথা বাড়ে, ঝগড়া জমে ওঠে।

    "আমার মত ছুটতে পারবে তুমি?" বাবা চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে।

    বুড়ো কচ্ছপ একটুও টলে না, "আলবাত পারব!" ঘাড় শক্ত করে একদৃষ্টে খরগোশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    বাবার মত অভিজ্ঞ খরগোশও এবার একটু ভেবড়ে যায়, "ঠিক হ্যায়, কম্পিটিশন হোক তাহলে। দেখি তোমার কতখানি দৌড়!"

    তাই এই প্রতিযোগিতা। এক পক্ষকাল বাদে। এপ্রিল মাস পড়ে গেছে, দিন আর একটু লম্বা হয়েছে। চেরিফুল ফুটতে শুরু করেছে। হাওয়ায় বসন্তের সুগন্ধ। এরই মাঝে এক অভিনব রেস দেখার জন্যে বনের সব প্রাণীরা ভিড় করে এসেছে। খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতা।

    "কে জিতবে সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?" ফিসফাস চলছে।

    বাবা নিজে যায়নি। ইভানকে পাঠিয়ে দিয়েছে, "যা, গিয়ে বুড়োর থোঁতামুখ ভোঁতা করে দিয়ে আয়। এতবড় অপমান!"

    সেও এসেছে নিশ্চিন্ত মনে, হেলতে দুলতে। কড়ে আঙুলটি নাড়ালেই জিতবে।

    রাস্তায় দেখল সুন্দর একটা বেগুনি ঝুড়িতে সাজানো লাল টুকটুকে গাজর আর কচি লেটুসের পাতা। জিভে জল এল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মালিকানার দাবীদার কেউ নেই। পরমানন্দে কচকচ চিবোলো। বেশ ভালোমত একটা ব্রেকফাস্ট সেরে চলেছে রেসের মাঠের দিকে। যতই বলুক না কেন, গুটিগুটি পায়ে হেঁটে কচ্ছপ কখনো তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে?

    তারপরেই সেই অঘটন। খানিক রাস্তা গিয়েই হাই উঠতে শুরু করল। চোখ যেন আর খুলে রাখতে পারছে না। চেরি আর পিচফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখের পাতাদুটো পাথরের মত ভারী। রাস্তাতেই বসে পড়ল ইভান। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই।

    ঘুম ভেঙে উঠে দেখে চারপাশে অনেকগুলো অবাক-হওয়া মুখ। শেয়াল, কাঠবিড়ালি, সজারু - সবাই তাকিয়ে আছে তারই দিকে!

    তিড়িং করে উঠে বসেছে, আরে, তার দৌড়োবার কথা ছিল না? ঘুমিয়ে পড়ল কী করে?

    দূরে তাকিয়ে দেখে কচ্ছপ সীমানায় পৌঁছে গেছে, প্রতিযোগিতায় সে-ই জয়ী। মাতামাতি চলছে তাকে নিয়ে।

    হতভম্ব হয়ে ইভান ভ্যাবলার মত খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হয়। সদ্য ঘুম ভেঙে তখনো যেন সে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।

    তারপর বাবার এই তর্জনগর্জন।

    খুব দুঃখ হয় ইভানের। লম্বা কানদুটো ঝুলে পড়ে। আস্তে আস্তে পিছন ফিরে হাঁটতে থাকে জঙ্গলের দিকে। মায়ের চোখদুটো ব্যথায় ভিজে আসে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ছেলের চলে যাওয়া পথের দিকে।

    জঙ্গলে ঢুকে ইভান চলতেই থাকে আর চলতেই থাকে। এক দিন নাকি অনেক দিন, এক মাস নাকি অনেক মাস কেটে যায়। একদিন দেখতে পায় জঙ্গলের সামনে এক বাঁধাকপির ক্ষেত। টুসটুসে সবুজ পাতায় মোড়া নধর বাঁধাকপি দেখে মন উথালপাথাল। কতদিন ক্ষেত থেকে তুলে আনা টাটকা বাঁধাকপি খায়নি সে! মা নিয়ে এসে তাকে আদর করে খেতে দিত। বুকটা একমুহূর্তের জন্যে হলেও মুচড়ে ওঠে।

    সাতপাঁচ না ভেবে ঢুকে পড়েছে ক্ষেতে, বাঁধাকপির পাতা খাচ্ছে একমনে।

    হঠাৎ শোনে আকাশে আওয়াজ। শনশন, সাঁইসাঁই। ঈশান কোণ থেকে ঝাঁটায় চড়ে আসছে বাবাইয়াগা ডাইনি। শনের নুড়ি চুল উড়ছে হাওয়ায়। লম্বা টিয়াপাখি নাক এসে নেমেছে প্রায় ঠোঁটের ওপর। মাথায় বাঁকা টুপি, হাতে সবসময়ের সঙ্গী বার্চ গাছের একখানা শুকনো ডাল।

    ঝাঁটা থেকে লাফ দিয়ে নেমেই বলে, "কে রে ও? কাকে দেখি? অতিথ এল নাকি আমার বাড়ি?"

    ইভান খরগোশ সাহস করে এগোয়, "আমি গো দিদিমা, তোমার খরগোশ নাতি। খোঁজখবর নিতে এলুম। অমন লম্বা শীতকাল গেল, বুড়ো মানুষ একলাটি থাকো, তা ঠিকঠাক ছিলে তো?"

    "খবর নিতে এলি বুঝি?" বাবাইয়াগা ফিচেল হাসে। "তা বেশ, বেশ। থাক আমার কাছে কটাদিন। সেবাযত্ন কর আমায়। নিজেও ভালোমন্দ খা। গাবলু-গুবলুটি হয়ে ফেরত যাসখ'ন।"

    বলতে বলতে হাতে তালি বাজায়, "চলে আয় রে আমার সাধের ঘরখানি, খুলে দে দরজা, মালকিন এল ঘরে!"

    ও মা, জঙ্গলের ভেতর থেকে চারখানা লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এল নড়বড়ে এক ঘর। সর্বাঙ্গে তার খুলির গয়না। মানুষের মাথা আছে, তাদের মত পশুপাখির মাথাও ঢের আছে। বনের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো সে ঘর, ইভানের চোখের সামনে খুলে গেল তার ঝাঁটার কাঠির দরজা। ঘরে ঢুকল বাবাইয়াগা, তার পিছে পিছে ইভান। ধড়াচুড়ো ছেড়ে ডাইনি আরাম করে বসেছে কেদারায়। কেদারার হাতলদুটো সাদা রঙের, হাড় দিয়ে তৈরী। হেলান দেওয়ার জন্যে রয়েছে মানুষের পিঠের লম্বা শিরদাঁড়া। ব্যাপারস্যাপার দেখে ইভান খরগোশের তো গা ছমছম। কিন্তু উপায় নেই এখন এখানেই মানিয়েগুছিয়ে থাকতে হবে । মনকে শক্ত করে নেয় সে।

    "ডিনার খাবে তো দিদিমা?" শুধোয় ইভান। ভয়ে ভয়ে। বাবাইয়াগা কেমন খাবার খায় কে জানে! তারা খরগোশরা তো শাকসব্জি-লেটুসপাতা কচকচ চিবিয়েই খুশি!

    নাঃ, বেঁচে গেছে। বাবাইয়াগা হাসে আর ডান হাত দোলায়। ছাদ থেকে ঝুলতে ঝুলতে হাজির হয় বিরাট স্যুপ ভর্তি কড়াই। বাঁ হাত দোলায়, জানলা দিয়ে উড়ে আসে ফল আর সবজি ভরা বাস্কেট। দেখেশুনে ইভানের চোখ গোলগোল, সুড়ুৎ করে জিভের জল টানে সে।

    বাবাইয়াগার দয়ার শরীর, বলে, "চেয়ে চেয়ে দেখছিস কী? নে, খা। খেয়েদেয়ে গায়ে জোর হলে তবেই তো আমার পা টিপতে পারবি!"

    "পা টিপে দেব? দিদিমা?" ইভান একপায়ে খাড়া। মনের মত কাজ। লাফিয়ে লাফিয়ে পায়ে ব্যথা হলে মায়ের পা তো সে-ই টিপে দিয়েছে এতকাল! কে জানে, তাকে ছেড়ে কেমন আছে মা!

    মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে বাবাইয়াগার পা টেপে সে। ডাইনি ঘুমিয়ে পড়লে নিজেও একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না চোখে। জেগে জেগে আকাশ পাতাল ভাবে, কেন সেদিন চোখে এমন রাজ্যের ঘুম ছেয়ে এল, পথের ধারেই ঘুমিয়ে পড়ল সে, এমনি সে মরণ-ঘুম! আর আজ দেখ! ঘুম পালিয়েছে তাকে ছেড়ে।

    বাবাইয়াগার চারপেয়ে চলন্ত বাড়িতে থাকে ইভান। ডাইনির সেবা করে, ঘরদোর পরিষ্কার রাখে, বাগানের মাটি খুঁড়ে সার-জল দেয়। লকলকিয়ে ওঠে লেটুসপাতা, মাটির আদর মেখে শুয়ে থাকে রাঙা আলু। দিনে কাজ করে আর রাতে জেগে জেগে কড়িকাঠ গোনে। এমনি করে কেটে যায় একদিন নাকি অনেক দিন, এক মাস নাকি অনেক মাস, এক বছর নাকি অনেক বছর - কে জানে!

    ডাইনির চোখ এড়ায় না কিছুই।

    "চোখ লাল কেন রে তোর?" শুধোয় বাবাইয়াগা।

    "খরগোশদের চোখ তো লালই হয় গো দিদিমা!" হাসে ইভান।

    "উঁহু, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। রাতে জেগে জেগে এপাশ ওপাশ করিস। টের পাই না ভেবেছিস? ঘুমোস না কেন?"

    ইভান মাথা নিচু করে। লম্বা লম্বা কান মাটিতে ঠেকে যায়। কী বলবে সে? কেমন করেই বা বলবে এক কচ্ছপের সঙ্গে সে দৌড়ে পারেনি?

    বাবাইয়াগা মুচকি হাসে। মনের কথা পড়ে নিয়েছে। পা দোলাতে দোলাতে বলে, "জানি, জানি, তোর মনে কীসের অসুখ!"

    ইভান এমন চমকে ওঠে যে হাত থেকে কফির কাপ প্রায় পড়ে যায় আর কী!

    কফি করতে শিখে নিয়েছে সে। বাবাইয়াগা ইভানের তৈরী কফি খেতে ভালোবাসে।

    কোনোমতে সামলে নিয়ে কাপটা রাখে পাশের টুলে। নিজে বসেছে মাটিতে।

    "জানো তুমি? কী জানো গো দিদিমা?"

    "বলি শোন, বুড়ো কচ্ছপ আমার কাছে এসেছিল। বলল কত দুঃখের কথা!"

    ইভানের মুখে আর কথা সরে না! বলে কী দিদিমা!

    বাবাইয়াগা বলে চলে, "ওরা একটু আস্তেসুস্থে চলাফেরা করে তো, তাই নিয়ে সবাই ওদের হ্যাটা করে। আর তোদের খরগোশদের তো কথাই নেই। লাফিয়ে বেড়াস এখানে ওখানে। কচ্ছপকে দেখলেই বিরক্তি - এই সামনে থেকে সর বলছি এক্ষুনি, গুটিগুটি হাঁটার জায়গা নয় এটা, রাস্তা আটকাবি না, যেতে দে আমায়। কী, বলিস না তোরা এসব?"

    ইভান ঘাড় কাত করে। সে-ও তো কম কথা শোনায়নি! লাফিয়ে কচ্ছপের পিঠের ওপর দিয়ে চলে গেছে। ইচ্ছে করেই নখটা নিচু করে রেখেছে, যাতে শক্ত খোলাটা একটু আঁচড়ে যায়।

    "তাই যখন আমার কাছে এসে কেঁদে পড়ল, একটা বুদ্ধি বাতলে দিলাম।"

    "তুমি? বুদ্ধি দিলে কচ্ছপকে?" ইভান হাঁ।

    "হ্যাঁ রে, বাঁধাকপি আর লেটুসের পাতায় ঘুমের ওষুধ স্প্রে করতে আমিই বলেছি। ওষুধও তো নিয়ে গেল আমার থেকেই।" বাবাইয়াগা এক চোখ বুজে মিটিমিটি হাসছে।

    "আর সেই পাতা খেয়েই আমি..." ইভান নিজের মনেই বিড়বিড় করে।

    "কিন্তু কাজটা তো অন্যায় হল দিদিমা?" চোখ তুলে তাকিয়েছে বাবাইয়াগার দিকে, "দুনিয়াশুদ্ধ লোক জানল কচ্ছপ জিতেছে তার পরিশ্রমের জোরে। খরগোশ আলসে, কুঁড়ে, কাজ শেষ হবার আগেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে! এটা কি ঠিক হল? গোটা জাতের বদনাম..."

    কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দেয় বাবাইয়াগা, "একটু অন্যায় তো বটেই, ওষুধ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লড়া যায় না। কিন্তু তোদেরও যে একটু শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল।"

    বলতে বলতেই হাতে তালি বাজিয়েছে, "ও আমার সাধের ঘরখানি, খুলে দে দরজা, অতিথ দাঁড়িয়ে বাইরে।"

    গোল চোখ আরও গোলগোল করে ইভান দেখে দরজা দিয়ে ঢুকছে বুড়ো কচ্ছপ, তার ছেলেপুলে নাতিনাতনিদের সঙ্গে। পিছে পিছে ইভানের বাবা-মা, কাকা-জ্যাঠা, আরো সব পাড়াপড়শি। ও মা! সবাই একসঙ্গে কোত্থেকে এল!

    "আমিই ডাক পাঠিয়েছি।" বাবাইয়াগা হাসে, "দুই দলই অন্যায় করেছিস, তার সাজাও পেয়েছিস। এবার মিলমিশ করে নে দেখি।"

    বুড়ো কচ্ছপই প্রথমে এগিয়ে আসে, "ইভান, হেরে যাবার পর তোর মুখটা দেখে সেদিন আমার বড় কষ্ট হয়েছিল রে, হাজার হলেও তুই তো আমার নাতির বয়েস, ঠিক কি না?"

    পিছন থেকে কচ্ছপের দল সরু সরু লম্বা লম্বা ঘাড় দুলিয়ে সায় দেয়, "ঠিক! ঠিক!"

    ইভানের বাবার চোখে জল, জড়িয়ে ধরেছে বুড়ো কচ্ছপের গলা, "অমন করে আমি সেদিন তোমায় যা-তা গালি দিলাম, তুমি একটা বয়েসে বড়, মান্যিমান ব্যক্তি, তোমার কাছে আমার লজ্জার শেষ নেই। ক্ষমা করো।"

    বুড়ো কচ্ছপের চোখ চিকচিক, "তোরা সব আমার ছেলের মত, তোদের ওপর কি রাগ করা যায়? এই দেখ, কী উপহার এনেছি সবার জন্যে।"

    কী? কী? সব্বাই কৌতূহলে তাকিয়েছে।

    সার সার কচ্ছপের পেটের তলা থেকে বেরোচ্ছে রংবেরঙের ডিম। চিত্রবিচিত্র করা। কী তাদের বাহার, কী তাদের রূপ।

    বুড়ো কচ্ছপ বলে, "এগুলো এখন তোদের। নিজেরা ডিম পাড়তে পারিস না তো কী হয়েছে, এপ্রিল মাসে ইস্টারের দিন সব কাচ্চাবাচ্চাদের কাছে ঝুড়িভর্তি এই ডিম নিয়ে তোরা হাজির হবি। ইস্টার বানির ডিমই আনবে নতুন জীবনের খবর, শীতের শেষে বসন্তের বার্তা।"

    খরগোশরা এ ওর দিকে তাকায়। তাকায় আর চোখের জল মোছে।

    বাবাইয়াগা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল আর হাসছিল। এবার হাতের বার্চ গাছের শুকনো ডালখানা ঘুরিয়ে বলে, "জাদু দেখা তো আমার গাছের ডাল, এই ডিম ফুটে ইচ্ছেমত ছানা হয় যেন, যে যেমনটি চায়, ঠিক তেমনটি ছানা।"

    তারপর থেকে এপ্রিল মাসে এলেই লম্বা কানওয়ালা ইস্টার বানিরা ঝুড়িভর্তি রংবেরঙের ডিম নিয়ে রেডি হয়ে যায়। দুনিয়ার সব বাচ্চারা বেরিয়ে পড়ে বাগানে, ঘরে, খামারবাড়িতে লুকিয়ে রাখা ডিম খুঁজতে। পাখিরা সে ডিম নিয়ে যায় বাসায়। তা থেকে বেরোয় ছোট্ট ছোট্ট পাখির ছানা। সবাই মিলে একসঙ্গে গান গায়, "হ্যাপি ইস্টার!" সদ্যফোটা বসন্তের চেরিফুল সে গানের সঙ্গে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তাল দেয়। কচ্ছপরা খোলার ফাঁক দিয়ে মুখটি অল্প বার করে দেখে আর হাসে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments