• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • মরুতীর্থ : পীযূষ বন্দ্যোপাধায়



    শিবনাথ চট্টোপাধ্যায় আজ মাস দুই বসবাস করছেন কালী ডাক্তারের পরিত্যক্ত বাড়িতে। ধূ-ধূ মাঠের মধ্যে বাড়ি। গাছপালা বিশেষ নেই। ছাড়া-ছাড়া ভাবে কিছু পুরনো খেজুর গাছ আর দূরে দূরে অভ্রভেদী কয়েকটি তালগাছ বাদে, ছায়া দেবে – এমন আর কিছুই নেই। গোটা মাঠ জুড়ে অবাধ শূন্যতার সাম্রাজ্য, চোত-বৈশাখ মাসের রোদ সংহারক মূর্তি ধরে সেখানে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। কাণ্ডজ্ঞানহীন পাগল ছাড়া বেলা এগারোটার পরে মরু-সমান এই প্রান্তর কেউ পেরোতে চায় না। এই মাঠ যে কী নির্মম অনাত্মীয় তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে। কালী ডাক্তারের বাড়িটি যেন পোতাশ্রয় খুঁজে না-পাওয়া এক জাহাজ।

    বাড়িটিতে বসবাস করতে কেউই এ পর্যন্ত শিবনাথকে উৎসাহিত করেনি বা প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেনি বিন্দুমাত্র। শিবনাথ আত্মনির্ভরশীল হয়েই দু-মাস এখানে বসবাস করছেন ও এই সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছেন যে, এখানেই যখন তাঁকে থাকতে হবে তখন লৌকিক বা অলৌকিক সব অবস্থাকেই তিনি মান্য করবেন। কোনো দশাকেই অমিত্র ভাববেন না।

    বাড়িটি দোতলা। সারাদিন রোদে জর্জরিত হওয়ার ফলে ওপরের ঘরগুলির কোনোটিতেই বসবাস করা অসম্ভব আগুনের ভাঁটার মতো দাবদাহের কারণে। নীচে চারটি ঘর ও বাথরুম প্রভৃতি রয়েছে। উঠোন আগাগোড়া সিমেন্টে বাঁধানো ও মাঝে টিউওবয়েল বসানো। তার চতুষ্পার্শের বাঁধানো চাতাল প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মেরামত না করালে ঠান্ডার খোঁজে সেখানে সাপ আদি সরীসৃপের বসবাস হতে পারে। ইলেকট্রিকের তার বাড়ি অব্দি এসেছে এই মাত্র শিবনাথ দেখেছিলেন প্রথমাবধি। কিন্তু জল ও আলোর ব্যবস্থাকে তিনি অবমূল্যায়ন করেছিলেন আগাগোড়া। ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি যে জল ও বিদ্যুতের প্রবাহ এখনও অব্যাহত থাকতে পারে।

    হ্যারিকেনের কাচের খোজ করতে শিবনাথ একদিন গেলেন মাঠ পেরিয়ে গাঁয়ের ভেতরে। তখন তাঁর গাঁয়ে আসা আরো এক মাস পেরিয়ে তিন মাসে পড়েছে। নামোকুলির কাছে খেপি কালীর মন্দির। তার পিছন দিকেই শিবনাথের বাস্তুভিটে বন-জঙ্গলে ঢাকা পড়ে আছে। বোম্বেতে প্রচণ্ড কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও শিবনাথ একেকদিন তার বাস্তুর ছবি চলচ্চিত্রের মতো দেখতে পেতেন। বলা বাহুল্য, এমন ভগ্ন রূপ নয়। তিনি যে অবস্থায় শেষবার দেখে গিয়েছিলেন তাঁর জননীদেবীকে নিতে এসে – প্রায় চল্লিশ বছর আগে সেই চেহারা, সেইসব নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী। নিজেদের বাসস্থানটির স্থানাঙ্ক শিবনাথকে ভাবিত ও বিস্মিত করতো বরাবর। কারণ তাঁদের ভদ্রাসনের সামনের দিক জলজ্যান্ত লোকালয়ের মধ্যে পড়লেও ভিটের পশ্চাদভাগে আসা মাত্র দৃশ্যপট শুধু নয় তার সামাজিক তাৎপর্যও যেন বদলে যায়। দূর থেকে চোখে পড়ে মরুবৎ সেই মাঠ যেখানে শিবনাথের বর্তমান নিবাস। তখন কালী ডাক্তারের উক্ত বাড়িটি ছিল না সেখানে। যে হাওয়া উড়ে আসতো সেদিকের দিকচিহ্নহীনতা থেকে তার পরশে স্নায়ুর ভেতর প্রবিষ্ট সকল বিষয়চিন্তা, সংসারধর্ম পুরনো পলেস্তারার মতো শিথিল হয়ে যেতে চাইতো। একেবারে বালক বয়েসে অবশ্য শিবনাথের এই ধারার বোধ জাগ্রত হয়নি। কিন্তু শিবনাথ যখন বাইশ-তেইশ বছর বয়সে গ্রাম পরিত্যাগ করেন, তখন তার মনোজগৎ যেন এই ভাবের অনুসারী ছিল।

    কালীমন্দিরের চারপাশে বেশ উন্নতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। লোকালয় হয়েছে ঘন। বেশ কয়েকটি নতুন রংচং করা সুদৃশ্য বাড়ি উঠেছে দিগ্বিদিকে। একখানি দোকান বিবিধ দ্রব্যাদির। ছোটোখাটো বিপণিও আছে বেশ কয়েকটি।

    হ্যারিকেনের কাচ কিন্তু মিললো না কোনোখানেই। আজকাল গ্রামেও কেউ হ্যারিকেন ব্যবহার করে না।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে বোম্বের রাস্তাতেই কী ভেবে শিবনাথ এক প্যাকেট মোমবাতি কিনেছিলেন, তদ্দ্বারা এতদিন আলো পেলেন। হঠাৎ করে কালী ডাক্তারের বাড়িতে প্রবিষ্ট হয়ে শিবনাথকে আতান্তরে পড়তে হয়নি।

    সেদিনই, কালী ডাক্তারের ঘরে ফিরছেন, এমন সময় একটি লোকের সঙ্গে শিবনাথের পরিচয় হলো।

    লোকটি শিবনাথকে দ্রব্যাদি কেনা থেকেই লক্ষ করছে জানা গেল।

    পথিমধ্যে সে প্রথমে বলল, দাদা, কালীবাবুর ঘরে কারেন্ট আছে বলেই মনে হয়। তবে সহসা সুইচ ইত্যাদিতে হাত দিও না যেন। একটু দেখেশুনে নিতে হবে। তারপর সে বলল, দাদা, আমাকে চিনছো তুমি?

    লোকটির মাথায় আরোহী লতাগাছের আকর্ষের মতো ঘোরানো-প্যাঁচানো এক মাথা ঘন চুল। মুখমণ্ডল দাড়িতে ঢাকা। চুল-দাড়ি সমস্তই কৃষ্ণবর্ণ। স্বাস্থ্য ভাঙা। তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে আন্দাজ করা যায়। পরনে মলিন বস্ত্রাদি। পায়ে ছেঁড়া চপ্পল এক জোড়া।

    শিবনাথ তার সম্পর্কে কিছুই মনে করতে পারলেন না। সুতরাং নীরবতা পালন করলেন।

    লোকটি অতিশয় আন্তরিকভাবে বলল, তুমি কালী ডাক্তারের ঘর ছেড়ে এসে আমার ঘরে বসতি করো। আমার নাম নবকুমার ভট্টাচার্য। লোকটি হি-হি করে হাসতে হাসতে বলল, আমার বাবার নাম পঞ্চানন। তুমিই আমাকে স্বনাম ও পিতৃনাম লেখা শিখিয়েছিলে। প্রথমবার পিতৃনাম লিখতে গিয়ে মারাত্মক ভুল হয়ে যায়। পঞ্চাননের দুটো দন্ত্য ন পাশাপাশি লেখার বদলে লিখে ফেলি ওপর নিচে, যুক্তাক্ষর রূপে। হয়ে গেল, পঞ্চান্ন। তুমি বললে, ফিফটি ফাইভ। দাদা, তুমি আমি একই কুলির (পাড়ার) লোক, আমার ঘরও কালীমন্দিরের পিছনের গলিতে। গলির গরম অসহনীয় হতো যখন, কালীমন্দিরের ভোগঘরের ছাদে তুমি-আমি দু-জনে রাত্রিবাস করতাম। আমিই সে।

    নবকুমার নান্দীকারের মতো স্মৃতির পৃষ্ঠা পাঠ করায় শিবনাথের কিছু কিছু স্মরণে এল বটে, তবে সম্পূর্ণ নয়। তাঁর মনোজগতের অনেকটা জুড়ে আছে বোম্বের জীবন, আরব সাগরের জলের মতোই তা ঊর্মিমুখর, উচ্চাবচ; সেই তুলনায় নবকুমারের স্মৃতির রেখা যথেষ্ট সরল ও অভঙ্গুর। ঋজুরেখ আলোক রশ্মির মতো কোনো গভীর হারিয়ে যাওয়াকে ছুঁয়ে আসা সেই স্মৃতির পক্ষে হয়ত অনেক বেশি সহজসাধ্য। পরে অবশ্য শিবনাথ জানতে পারেন, তাঁর এই ধারণা কতো ভুল! নব তার শেকড় চিরতরে হারাতে দেয়নি এই একমাত্র তার মায়ার বাঁধনের জোর মাতৃভূমির সঙ্গে। এটুকু ছাড়া তার সংসারধর্ম বেশ আলগা। সে একজন পরিব্রাজক, যদিও গৃহধর্মের দৃষ্টিতে দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। এক মাস কিংবা এক বছর সে হয়ত অজ্ঞাতবাসে চলে গেল। তার ঠায়ঠিকানা কেউ জানলো না। নানা রকম শোনা গেল তার সম্পর্কে। যেমন, সুদূর এক শৈলচূড়ায় সে অবস্থান করছে ও তার বায়বীয় সূক্ষ্মদেহ যাতায়াত করছে গাঁয়ে। মেয়েকে দেখভাল করে যাচ্ছে সতত – ইত্যাদি। তারপর প্রাগুক্ত সময়সীমার (অর্থাৎ এক মাস বা এক বছর ইত্যাদি) পরে হয়ত দেখা যাচ্ছে নবকুমার চপ-পকোড়ির দোকান খুলেছে তার নিজের আঙিনায়। বিক্রিবাটা হচ্ছে ভালোই। কারণ নব জলের দামে খাবার বিক্রি করছে। ...

    সেসব বেশ কিছুদিন পরের কথা। সেদিন নব-র সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে ঘরে ফিরে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে নব-র কথা মনে পড়ায়, শিবনাথের হাত আলোর সুইচের কাছে অজান্তেই যে প্রত্যাশা জানালো – পাঁচ-সাতটা সুইচে তা ব্যর্থ হয়ে একটিতে তা পূর্ণ হয়ে গেল হঠাৎ। জ্বলে উঠলো আলো। অবশ্য দপদপ করতে লাগলো, এবং নিভেও গেল শেষে। তা হলেও শিবনাথের বুকে কিন্তু তেমনই একটি আলো প্রজ্জ্বলিত হয়েই রয়ে গেল। এরপর ঘটলো জলের ঘটনা। এটি যেন সম্পূর্ণ ভাবের ঘোরে ঘটিত। শিবনাথ যেন নতজানু হয়ে কলের কাছে প্রার্থনা জানালেন, হে ধাতব দেবতা, নির্দয় হয়ো না। কষ্ট লাঘব করো। তোমার করুণাধারা আমারও প্রাণে বইতে দাও। ...আসলে ব্যাপারটি এমনতরো ঘটেনি। আলোর ঘটনাটির পরেই শিবনাথের উচ্চাশা জাগে। একদিন মোবাইলে ফোন করার সময় আনমনে কলের হাতলে চাপ দেয়। ছরছর করে বেরিয়ে আসে লোহাচুর মেশানো নোংরা জল। তারপর যেন কোন এক লুক্কায়িত কুম্ভ থেকে স্বাদু স্বচ্ছ অমৃতধারা...

    এরপর একদিনের ঘটনা।

    শিবনাথের গ্যাস শেষ হয়ে গেল দুপুর বেলাতেই, ঢেঁড়শ ও লাল খাড়ির একটি তরকারি কড়াইয়ে অর্ধপক্ব অবস্থায়। ভাত হয়েছিল আগেই। আর কিছু না। সেই ভাতই খাওয়া গেল শুধু নুন দিয়ে। সেই সময় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সি এক মেয়ে চড়া রোদ্দুর মাথায় অতো বড়ো মাঠ পেরিয়ে এসেছে একটা কাগজি লেবু, মুসুরি-ভাতে আর বড়া ভাজা নিয়ে। ততক্ষণে আহারাদি শিবনাথের হয়ে গেছে, আর কিছু খাবেন না, সুতরাং মেয়েটিকে আনীত খাদ্যদ্রব্য ফেরৎ নিয়ে যেতে বললেন। তার আগে মেয়েটির পরিচয় নিলেন। জানা গেল নব তার বাবা। ওর মা ওর কাছে স্মরণাতীত। ওরই জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতাল থেকে জননী আর প্রত্যাবর্তন করেননি। অগত্যা বাপের ক্রোড়েই তার লালন। কিন্তু সে বেশিদিন নয়। দশ বছর বয়েস থেকে বাপের লালন ও নিয়ন্ত্রণ হেতু তাকেই মাতৃ সত্তা অর্জন করতে হয়েছে। কারণ বাপের ওই তো বায়বীয় দশা। আজ আছে, কাল হয়ত ব্রাহ্মমূহূর্তে উঠেই দেখা যাবে, নেই। মেঝের ওপর পুয়াল দিয়ে চাদর দিয়ে রচিত শয্যাটি ফাঁকা। টর্চটা জ্বলেই আছে। বালিশের কাছে বিড়ির বান্ডিল, দেশলাই। হঠাৎ দেখলে মনে হবে –

    মেয়েটি হঠাৎ কাঁদতে লাগলো। তাকে উদ্বিগ্ন মনে হলো।

    শিবনাথ বললেন, মা, তুমি তাকে আরো মাতৃস্নেহ দাও। আমি বলছি, এইভাবেই তার পরিবর্তন হবে।

    মেয়েটি কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে বলল, পরিবর্তন কিছু দরকার নেই। আমি চাই, বাবা শুধু কিছুটা অন্তত স্থির হয়ে বসুক সংসারে। নিজের বাবা বলে বলছি না, অমন মানুষ আপনি সচরাচর পাবেন না জেঠু। আমার স্বামী মৃত্যুর আগে অনেক সম্পত্তি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আমায়। শ্বশুর-শাশুড়িও তাতে আপত্তি করেননি। সেসব নিলে আমাদের দিনাতিপাত হতো সহজেই। চাইলে কিছু আমানতও হতো ওরই মধ্যে। বাবা কিন্তু রাজি হলো না। বললো, একটি প্রদীপ নিভে গেছে হঠাৎ, সেটি যদি সোনারও হয়, পরন্তু জানা যায়, আর কোনোদিন জ্বালানো যাবে না তার সলতেটিকে, তাহলে সেই অকেজো সোনা কার কী কাজে লাগে বলো! আমি দেখলাম, খুবই সত্যি কথা! আমার স্বামী নির্বিবাদী ভালো মানুষ ছিলেন। মৃত্যুকালে বয়েস হয়েছিল মাত্র চব্বিশ। বাবা আমাকে বলে যে, আমি আবার বিয়ে করতে পারি। সম্পত্তি গ্রহণও করতে পারি আমার প্রয়াত স্বামীর। বাবার অমত নেই। তবে তিনি নিজে তাঁর পুত্রবৎ জামাইয়ের স্মৃতির আমানতেই দিন কাটাবেন। অন্য কোনো ধন গ্রহণ করবেন না। মেয়েটি মুখ নামিয়ে বলল, জেঠু, আমার তো ছেলেপুলে হয়নি, কিন্তু ভেবে দেখি, পিতারূপী একটি বালক আমার মুখাপেক্ষী। আমি তাকে ছেড়ে অন্য সিদ্ধান্ত নিই কী করে!

    মেয়েটির কথা শুনে বোঝা গেল, মনে মনে সে বাবার চরিত্রটিকে সমর্থনই করে।

    তৎপরে মেয়েটি জানালো, ক-দিন নবকুমার শুধু শিবনাথের কথাই বলছে শয়নে-স্বপনে। নব এখন সততই অতীতচারী। হারানো সত্তার হাটে নব পায়চারি করতে করতে কুড়িয়ে পাচ্ছে বিবিধ মনোহারী দ্রব্য।

    মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, জেঠু?

    শিবনাথ বললেন, হ্যাঁ মা? এর প্রতি তিনি খুব আন্তরিকতা অনুভব করছেন তখন।

    মেয়েটি বলল, আমার জন্মের কতো আগে এই গাঁয়ে আপনার দিন কেটেছে। দিনের পরে দিন গেছে। জেঠু, আপনি আমার শ্রদ্ধা নেবেন।

    ব’লে সে টুপ করে শিবনাথের পদস্পর্শ করে।

    বেলা ডোবার সময় শিবনাথ কালী ডাক্তারের বৈঠকখানা-ঘরের জানলায় (ঘরটির অবস্থান ও মাঠের দিকের নিসর্গ উপভোগের জন্য দেওয়ালের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আকারের জানলাটি দেখে সহজেই বোঝা যায়, সেটি বৈঠকখানা ছাড়া অন্য কিছু নয়) দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার দুধ ফুটবে কিসে ইত্যাদি ভাবছেন, এমন সময় নব এলো ঘাড়ে ক’রে গ্যাসের এক সিলিন্ডার নিয়ে। মাঠ থেকে গাঁয়ের দূরত্ব – মাঠকে বৃত্তাকার ধরলে – ব্যাস বরাবর তা প্রায় আড়াই থেকে তিন কিমি-র মতো। এতোটা রাস্তা একজন মানুষ এসেছে একটা জগদ্দল বস্তু বয়ে নিয়ে; কেন? না, মনুষ্যবর্জিত হয়ে একজন বৃদ্ধ অবস্থান করছেন এই দূরবর্তী স্থানে, তিনি হঠাৎ আতান্তরে পড়েছেন এখানে, এমতাবস্থায় তাঁর সহযোগী হতে অপর একজন মানবের ক্লেশ স্বীকার করাই মানব সভ্যতার অলিখিত, কিন্তু অনিবার্য শর্ত। নব ঠিক এই কথা ভাবলো কিনা জানা যায় না। অন্তত এরকম তো সে ভাবতেই পারতো শিবনাথ সম্পর্কে তার এই উপচিকীর্ষার বিপরীত যুক্তি হিসেবে, যে, যতোদিন কর্মক্ষম ছিলে, রঙিন জগতে অবস্থান করছিলে ততোদিন তো মনেও পড়েনি যে ত্রিভুবনে মৌতোড় নামে একটা জনপদ কোথাও আছে! ক-টা বেকার যুবকের অন্ন সংস্থানের বন্দোবস্ত করে ছিলে তৎকালে! এখন যখন কর্মে অক্ষম হয়েছো, অবসর নিয়েছো – অর্থাৎ ডালপালা শুকোচ্ছে, ফুলফলের পতন ঘটছে তখন শিকড়ের কথা ভেবে মন উতলা হয়েছে বলছো বা সেইরকম ভাব দেখাচ্ছো! সুতরাং তোমার সহযোগী হওয়া আমার কর্তব্য নয়, করুণা – ইত্যাদি।

    ভার বহন করে নিয়ে এলো নব, তার ন্যুব্জ পিঠে শিরদাঁড়াটি শৈলশিরার মতো উঁচু হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শিবনাথও রইলেন লজ্জাবনত হয়ে।

    শিবনাথ বললেন, নব, তুই যে আমাকে গ্যাস দিলি, তোরা রাঁধবি কিসে!

    নব সগর্বে বলল, আমাদের কাঠ-ঘুঁটে আছে।

    শিবনাথ বললেন, ওরে গ্যাস থাকতে কাঠ-ঘুঁটের ভরসা করবি কেন? তাছাড়া গ্যাসের দাম তো সৃষ্টিছাড়া!

    নব বলল, আজ্ঞে না দাদা, এটা সরকারি যোজনার বিনা মূল্যের বস্তু। পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে এলো তো, এ এখন পাওয়া যাবে এক বছরের মতো। অচিরেই ভোটের ঘন্টা বাজবে। অর্থাৎ ভোটের নির্ঘন্ট জানা যাবে।

    –আহা, রান্না না করিস, দোকানের কাজে তো লাগাবি রে বাবা!

    –দণ্ডবৎ করি দাদা, কাঠ-ঘুঁটেকে অপনীত করে গ্যাস যদি আরাধ্য হয়, আমার চপগুলিও রেগে যাবে। কিছুতেই আর আগের মতো ফুলতে চাইবে না।

    একদিন সন্ধ্যায় দীপাধার প্রজ্জ্বলিত করে শিবনাথ গেলেন নব-র চপের দোকানে।

    দু-একজন খদ্দেরের যাওয়া-আসা দেখা গেল।

    একটা অগভীর কড়ায় অবিন্যস্ত ঝোপঝাড়ের মতো ঝুরো পকোড়ি তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ ডান হাতের পাঁচ আঙুলেই বেসন-গোলা মাখিয়ে আঙুলগুলি নব উনুনে অবস্থিত কড়ার গরম তেলের সামনে আপন খেয়ালখুশিতে নাড়ছে। দেখে মনে হলো, নব যেন তানপুরার তন্ত্র নাড়ছে সুর প্রাপ্তির আশায়।

    শিবনাথ খুবই আপ্যায়িত হলো নব কর্তৃক। অন্য খদ্দেরা উপেক্ষিত হতে লাগলো। নব-র তাতে পরোয়া নেই।

    শিবনাথের রা পেয়ে নব-র সেই মেয়ে বেরিয়ে এলো। তার হাতে সেদ্ধ আলু-মাখা লেগে। ও যে চপের মশলা তৈরি করছিল বোঝা যায়।

    নব মেয়েটিকে বলল, হ্যাঁ রে রুমি, আজ চপ-পর্বটা বাদ দিলে হতো না? ওঃ, কতকাল পরে যে দাদাকে পেলাম! যেন দিব্যচক্ষু দিয়ে দেখছি। দাদা, তুমি বোম্বের কোথায় থাকতে?

    তুই বোম্বে গিয়েছিস, নব?

    পাকচক্রে গিয়ে পড়েছিলাম দাদা। তাই তো শুধালাম। তবে বেশি কিছু জানা নেই। ঠিকানাহীন ও নির্বান্ধব অবস্থায় কাটিয়ে এসেছিলাম, কয়েকদিন ছিলাম আঠারো-উনিশ বছর আগে গিয়ে। অভিজ্ঞতা যৎকিঞ্চিৎ।

    শিবনাথ চোখ মুদিত করে বললেন, আঠারো উনিশ বছর বললি? আমি তখন থাকতাম বোম্বের শহরতলিতে। অমন দৈত্যাকার শহরে সপরিবারে থাকার খরচ টানা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। কুর্লা স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথে থাকতাম। মোট বাইশ বছর সেখানে অতিবাহিত করি। তারপর –

    কথার অর্ধপথে বিস্ময়াচ্ছন্নভাবে নব বলে উঠলো, অ্যাঁ সে কী কথা! কুর্লা স্টেশনে আমি যে সেইসময় অন্তত এক হপ্তা ধরে রোজ একটি গাছের নিচে গিয়ে উদ্দেশ্যহীন দাঁড়িয়ে থাকি বিকেল বেলা। কী গাছ আর মনে পড়ে না, তথাপি একটি গাছের অবয়ব, প্রাণচঞ্চল অপরাহ্ণ আজও ভূমিশয্যায় শুয়ে শুয়ে চাক্ষুষ দেখতে পাই।

    শিবনাথও অবাক হয়ে বললেন, ওরে নব, এ কী কথা শোনালি তুই! আমার প্রাণাধিক প্রিয় গাঁয়ের লোক নিঃসঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আমারই দৈনন্দিন গতায়াতের পথিপার্শ্বে, আর আমি তার সম্পর্কে নিস্পন্দ রয়ে গেলাম! কোনো প্রাকৃতিক কারণও কাজ করলো না আমাকে তোর বিষয়ে অবগত করানোর? বা, অতীন্দ্রিয় অনুভূতি?

    দু-জনেরই যেন কাঁদতে বাকি। উভয়ের পক্ষেই চোখের জল আটকে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বলে সত্যিই যদি কিছু থাকে, সেদিন তার মুখ ফিরিয়ে থাকাকে দুজনেরই ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছে হলো প্রবলভাবে।

    এমতাবস্থায়, রুমি এলো চা নিয়ে। বিস্কুট ও মুড়ি নিয়ে। সমবেত কয়েকজন ক্রেতার আশাভঙ্গ করে চপ-পর্যায় সেদিনের মতো রুমিই বাতিল করে দিলো।

    শিবনাথ রুমিকে বললেন, মা, এতোটা যে আলু মাখলি চপের জন্য, সেটা নষ্ট হবে যে! এমন অবাঞ্ছিত ব্যাপার প্রায়শই যে সংঘটিত হয় তা আর বলে দিতে হবে না মা! মা, তোকে কি অঘটনঘটনপটিয়সী বলবো আমি?

    রুমি বাচ্চা মেয়ের মতো বলল, জেঠু, তুমি আমায় বকছো কেন? এই মশলা-মাখা আলু দিয়েই আজ দারুণ একটা তরকারি বানাবো। তোমার সুগার নেই তো? (ইতিমধ্যেই উভয়ের মধ্যে ‘তুমি’ ও ‘তুই’ সম্বোধন প্রচলিত হয়েছে।)

    শিবনাথ মাঝে মাঝেই নব-র দোকান তথা ঘরে যান। রুমি ছুটে আসে। চা ও খাদ্য দেয়। বাপ-মেয়ের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে শিবনাথ যে মৌতাত লাভ করেন তার তুল্য ভাবের খেলা কোনো অধ্যাত্ম-দর্শনেও আছে বলে মনে হয় না। থাকলেও এর অমৃত-প্রতিম অনুভূতি তার চেয়ে কোনো অংশেই ন্যূন নয়। একটাই যা অস্বস্তির কারণ। সেটি এই যেঃ শিবনাথ এলে ক্রেতারা যথেষ্ট মনোযোগ পায় না। সেটা তবু মানা যায়। কিন্তু খরিদ্দারের পয়সা দিয়ে কেনা খাদ্যের দ্রব্যগুণ বিকৃত বা বিস্বাদ হয়ে গেলে?

    ইতিমধ্যে উভয়পক্ষের পরস্পরের সম্পর্কে অনেক কথা জানা হয়ে গেছে। শিবনাথ পরিচিত হয়েছেন কার্তিক নামের এক যুবার সঙ্গেও। তার বয়স কুড়ি-বাইশ বছর। সে রুমির কনিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ বন্ধু। তাকে দেখে তরুণ রাজকুমার শাক্যসিংহের কথা মনেপড়ে, তখনো যিনি তথাগত হননি। কার্তিক নামের এই ছেলেটি কিন্তু আজন্ম অভাব দেখছে। এই বয়সেই তার শোক-সন্তাপেরও যেন শেষ নেই। শাক্যসিংহ-পর্যায়েই তার আচরণ জিতেন্দ্রিয়ের মতো। অনুপপত্তির কথা সে উচ্চারণও করে না, যে রুমি তাকে আত্মবৎ মনে করে সেই তার কাছেও ওর যাচ্‌ঞা নেই কিছুই। রুমির ভয় হয় ছেলেটি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে শুনে। এই বয়সি ছেলেরাই রাজনীতির প্রথম পছন্দ। রুমিকে সে মান্য করে। তার অনুশাসন শোনে। কিন্তু রাজনীতি ছাড়তে পারে না।

    নব একদিন দোকান ফাঁকা পেয়ে শিবনাথকে বলল, দাদা, তুমি তো রাগের বশে গাঁয়ে চলে এসেছো। প্রত্যাগমন করবেই না আর? তোমার ছেলে-মেয়েও তোমাকে ফিরিয়ে নিতে আসবে না?

    শিবনাথ বললেন, আমি ঠিক ক্ষুব্ধ হয়ে আসিনি রে নব। আমি অবসর নেওয়ার পরে গ্রামের মায়া আমার স্নায়ু ধরে টানাটানি শুরু করে – ব্যাপারটা এমনও ঘটেনি। গ্রামে ফেরা আমার অবসরকালীন ভাবনা নয়। বরং আমি একদিন না একদিন চলে গেলে কোথায় যেতে পারি তা আমার পরিবারে বহুকাল ধরে প্রচলিত। আমার স্ত্রীও তা জেনেই চক্ষু বুজেছেন। চরম মুহূর্তের প্রাক্কালে পুত্রকন্যা অবশ্যই দড়ি টানাটানি শুরু করে। একটা স্নায়ুযুদ্ধও হয়। কিন্তু যখন দড়ি ছিঁড়ে গেল আকস্মিকতার আঘাত ওদের সহ্য করতে হলো না। কারণ, যা ঘটবেই তার জন্য মানুষের মানসিক প্রস্তুতি থাকে। ওরা তেমন উদ্বিগ্ন হলো না। পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ – চাকরি করা লোক সবাই, দেরি লাগছে সমস্ত গুছিয়ে এখানে এসে বাপের মনোভাবের অচলায়তন ভাঙতে। অভিমানী ছেলে আমাকে একটিও ফোন করেনি। কিন্তু একাধিকবার আমার মোবাইলে ফোন এসেছে পুত্রবধূ ও কন্যার। ওখান থেকেই আমার ফোনটি রিচার্জ করিয়ে দিচ্ছেন ওই দুই স্নেহশীলা। ওরা যে আত্মীয় পরিজন কুটুম্ব আদি সহ এখানে আসবেই সে তো জানা কথাই রে নব। তবে আমি আর ফিরতে পারবো না। এই মায়া কাটানো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য।

    শিবনাথের এই আত্মবিশ্বাসকে কি নশ্বর ছেলেমানুষী বলে ভেবে বসলো নাকি নব আর রুমি? কারণ শিবনাথের ওই কথার অন্তে নবকে কেন জানি দুঃখিত মনে হলো। রুমিকে যেন ম্লান লাগলো। চা খেয়ে রাখা কাপ-ডিস তুলতে তুলতে রুমির হাতে যেন ঠুং ঠাং দুঃখ বাজতে লাগলো কোন এক অচিন রাগিণীর সুরে।

    এমন সময় কালী ডাক্তারের প্রসঙ্গ এসে গেল কথায় কথায়। নবদের পিতা-কন্যা মারফৎ জানা গেল, কালী ডাক্তারের দুই পুত্র পিতার জীবদ্দশাতেই – কালী ডাক্তার তখন দয়া করে লীলা সংবরণ করেছেন, প্রবল জেদের কণ্ঠহারটি ফেলেছেন খুলে – সেই সুযোগে পুত্রদ্বয় গ্রামে তাদের ভূসম্পত্তি সব একযোগে বিক্রি করে যে যার কর্মস্থলে চলে গেল, কিন্তু বাড়িটি খালি করার সময় বলে গেল, সেই আবাস গাঁয়ের যে-কেউ ব্যবহার করতে পারে, তারা ফিরেও তাকাতে আসবে না। বড়ো আশ্চর্যের কথা, বাড়িটিতে সেই তখন থেকেই শূন্যতার অভিশাপ লেগেই রইলো, কেউ গেল না থাকতে। কোনো অলৌকিক ভীতিজনিত কারণ যে নয়, তাও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কারণ, অধ্যাত্ম ও আধিভৌতিক সংক্রান্ত সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদীও তো কম নেই এই বৃহৎ গ্রামে। একটি রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সকল সদস্যই আবার নাস্তিক। শিবনাথ নিজ অভিজ্ঞতা যুক্ত করে জানালেন, এমনকী দুরাত্মা-দুষ্কৃতিরও উপদ্রবও এ পর্যন্ত তিনি প্রত্যক্ষ করেননি। এমন সর্ববাদীসম্মতভাবে কালী ডাক্তারের পুত্রদের ঘোষণা ব্যর্থ হলো কেন? নব বলল, হয়ত প্রত্যেকের কারণ আলাদা। হয়ত-বা প্রত্যেকটি হেতুও আলাদা আলাদা। এতোটা গভীরে যেও না শিবনাথদা। হতে পারে, হয়ত মর্মভেদী কিছু উঠে এলো এতদ্দ্বারা।

    সেই রাতে শুয়ে শুয়ে, অরন্তুদ, অপ্রিয় কিছুর বদলে শিবনাথের শুধু কালী ডাক্তারের কথাই মনে হতে লাগলো।

    কী আশা নিয়েই না কালী ডাক্তার এসেছিলেন গাঁয়ে থাকতে! গাঁয়ের প্রতি তীব্র টান ছিল। তবে তুঘলকি চরিত্রেরও কিছুটা ছিলেন। এমন ফাঁকা মাঠে বাড়ি করা তাঁর উচিত হয়নি। বাড়ি যে বছরে সাত-আট মাস রোদ্দুরে পুড়বে এই দূরদর্শিতার অভাব তাঁর মতো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। গোটা ছাদ ঢেকে একটি পুরু খড়ের চালা তাঁকে নির্মাণ করতে হয়েছিল; সেই চালা ঝড়ে উড়ে যায় বা বর্ষার প্রাক্কালে সেটি স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই খুলে ফেলতে হয় – নইলে খড় পচবে। পুত্রদের কর্মস্থল – দিল্লি ও কানপুর থেকে পুত্রবধূদের প্রায় জোর করে তুলে এনে এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পুত্ররা ওখানেই থাকে। মাঝে মাঝে আসে। আরামের জীবন ছেড়ে তরুণী পুত্রবধূরা এখানে এসে যেন তপ্ত কটাহে পড়ে গেলেন ও মনঃকষ্ট চেপে রেখে জীবন কাটাতে লাগলেন। এ কালী ডাক্তারের প্রবল অনাচার শুধু নয়, যৎপরোনাস্তি অমানবিকতাও বটে।... আবার, খানিক পরেই জ্যোৎস্নায় মাঠ ভেসে যাওয়া দেখে, কালী ডাক্তারের অপরিণামদর্শিতার সমালোচনা থেকে মন সরে গেল শিবনাথের। অন্তর থেকে একটা অতীন্দ্রিয় সাড়া না পেলে অর্থ, আরাম, বিনোদনের দুনিয়ায় থেকেও মানুষ এমন ত্যাগের নিমিত্ত পাগল হয়ে যায় কখনো? হ্যাঁ, ত্যাগ তো নিশ্চয়। কোথায় ভারতবর্ষের রাজধানীর বৈভব, সেখানে কালী ডাক্তারের ভূতপূর্ব কর্মযোগের বর্ণচ্ছটা, আর কোথায় এই নাম-না-জানা গ্রামে জীবনের এই সরলীকরণ। অর্থ-বিত্ত থাকতেও এখানে অকিঞ্চন হয়ে থাকতে হয় বাধ্য হয়ে। কিন্তু এ হলো অপরাপর বৈষয়িক ও স্থূল লোকের ভাবনার প্রতিফলন। কালী ডাক্তারের দিক দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রাণাধিক প্রিয় জন্মভূমির সান্নিধ্যে, দিগ্ববলয় অব্দি প্রসারিত মাঠের মর্মস্থলে এই হলো তাঁর সাধনক্ষেত্র, তাঁর পরম ধর্ম ও ব্রহ্ম লাভের স্থল। আবার উপরিউক্ত সব লোকের চোখে, সংসার ধর্ম পালনেরও জায়গা।

    আরো একদিন তেমনি বিনিদ্র রাত্রিতে শিবনাথের মনে হলো, শরীর আকস্মিক স্বেদসিক্ত হয়ে যাচ্ছে। শিবনাথ নিঃসঙ্গ মানুষ, তাঁর নিকটজন বলতে এখানে নব ও তার মেয়ে – তাদের আত্মীয়তাও অনন্ত আড়াই কিমি দূরবর্তী, বিপদে সহসা কোনো খবরই পাঠানো যাবে না; তৎসত্ত্বেও শিবনাথ কিন্তু ভয় পেলেন না এই অবস্থায়। তাঁর স্থির বিশ্বাস জন্মালো, এ কোনো অসুখ নয়, এ এক সুদূর অনুভূতির উত্তাপ। কালচক্রের ঘূর্ণনের ফলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ কালিকাপ্রসাদবাবুর প্রভাব (প্রভাসও বলতে পারো – শিবনাথ স্বগতোক্তি দ্বারা নিজেকে বললেন – অত্যুজ্জ্বল এক প্রভাস) পারিবারিক জীবন থেকে ঘোচাতে যে ক্রান্তিকাল তাঁর সংসারে ছড়িয়ে পড়েছিল একদিন, এ যেন তারই আতপ। বহু রাত্রিতে নির্ঘুম বিশ্লেষণের পরে আজকের রাত্রিটিতে উপনীত হয়ে শিবনাথের মনে হলো, কালীবাবু হয়ত একসময় নিজ পরাজয় মনে মনে মেনে নিয়ে স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূদের চূড়ান্ত উদারতা দেখাতেও প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ততোদিনে সেই বদান্যতা তারা ঘাড় ধরে আদায় করে নিয়েছে। এইরূপ অধীনতামূলক উদারতা দেখানোর ক্ষেত্রেও কালীবাবু সম্ববত বিলম্ব করে ফেলেছিলেন, সুতরাং তাঁর অস্মিতা এতদ্দ্বারা পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। শিবনাথের নিজের বেলায় কী হতে চলেছে তা আজই জানা যায় না। হয়ত তাঁরও সংশোধন তাঁর পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ একদিন চাপ দিয়েই আদায় করবে। এরকম মনে হওয়ার কারণ – রাত নিঃশেষ হয়ে যেতে যেতে নবোদিত কিছু অনুভূতির উঠে আসা। ইতিমধ্যেই পূর্বাকাশে তৈরি হয়েছে আলোর পটভূমি। কালীবাবুর বিনোদনের সেই জানলা অতি কষ্টে ধরে রেখেছে ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রাক-পলায়ন ক্ষণটিকে। গাছপালাহীন এই মাঠে পাখির কাকলিও শোনা যায় না। শিবনাথের হঠাৎই মনে হলো, সুদূর এক মরুতীর্থে এসে তিনি নিরবচ্ছিন্ন পরম শান্তির কোলে এসে নয় – পরম শান্তির কবলে পড়েছেন। অচিরেই আত্মীয়, বিনোদন ও বান্ধব-তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাবে। ... ব্রাহ্মমুহূর্ত কেটে যেতেই শিবনাথ কিন্তু মনস্তাপ-পীড়িত হলেনঃ যে পরম শান্তি মহামানবের অভীষ্ট, যা ব্রহ্মেরই উপাদান বলে কথিত – জন্মগত অধিকারে জন্মভূমির কাছে এসে তার কিছুটা স্বরূপ অবলীলায় লাভ করেছেন বলেই কি শিবনাথ তাকে অকিঞ্চিৎকর ও অপ্রীতিকর ভাবছেন – এবং জীবনের দুর্বল বন্ধন ও স্থূল বিনোদনগুলিকে বড়ো করে দেখছেন?

    দু-তিনদিন মনখারাপ রইলো নিরবচ্ছিন্ন। শিবনাথের কোথাও বেরোতে বা রান্নাবান্না করতেও ইচ্ছে হলো না এই ক-দিন। যা হোক কিছু মুখে দিলেন।

    তিন দিন পরে নবকুমার আর রুমি, বাপ-বেটি মাঠ পেরিয়ে শিবনাথের আশ্রয়ে এসে হাজির।

    রুমিকে প্রথমত কিছুটা চিন্তিত লাগলো; তারপর শিবনাথের অসুখ ও অমঙ্গল বিষয়ে দুশ্চিন্তা দূর হওয়ায় পূর্ববৎ তার মুখে ফিরে এলো স্নিগ্নতা।

    রুমি শিবনাথকে নিয়ে যেতে এসেছে শিবনাথের ভিটেয় বেড়াতে। নবকেও নিয়ে এসেছে ধ’রে। তিন জনে বেড়াবে। বিকেলে বেড়াবার খুব শখ রুমির। (কার্তিককেও সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, রুমি বললে আসতোই, কিন্তু এই মৃদুভাষী ছেলেটাকেও আজকাল চাঞ্চল্য তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। বকুনি দিয়ে দু’মিনিট বসিয়ে রাখলেও ওর কষ্টকর আপোষ দেখে রুমির নিজেরই মায়া হয়। রুমির মনে আছে, পাঁচ বছর আগে, গত পঞ্চায়েত ভোটেও কার্তিক ছিল এক কিশোর। নাকের নিচে গোঁফের কৃষ্ণবর্ণ পটভূমি সবে তৈরি হচ্ছে। কণ্ঠস্বর ভাঙছে। আত্মমগ্ন। কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। একমাত্র রুমি ছাড়া আর কারো সুখ-দুঃখে পরোয়া নেই। সেদিন ভোটের সঙ্গে তার চাঞ্চল্যের কোনো সম্পর্কই ছিল না। কোনটা কোন ভোট তাও সে জানতো না।...) রুমি অসংখ্যবার শাক তুলতে যায় শিবনাথের বাস্তুর ওদিকে। শিবনাথও সেখানে সপ্তাহে একবার যাবেনই। এরকম ব্যবচ্ছিন্ন বিহারের বদলে, রুমির মনে হয়েছে, তিনজনে একসঙ্গে ভ্রমণ ভালো। তার সঙ্গের দু-জন মানুষ এমনই, যারা, চল্লিশ বছর আগের একরকমের জীবন উচ্চাশাহীন আশুতোষ গ্রামবাসীদের সঙ্গে যৎসামান্য কিছু আনন্দের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন। সেই অতিবাহনের মধ্যে যে ত্যাগের স্বাক্ষর তারা রেখে গেছেন তা-ই যেন আগ্নেয় অক্ষরে স্বপ্রভ হয়ে এতোদিন বাদে তাঁদের ওপর মোহমায়া বিস্তার করছে। এর রোমাঞ্চ হয়ত রুমির রোমকূপে ঠিকঠাকভাবে প্রবেশ করবে না বা এর প্রভাব তার শরীরে বিশেষ একটি হরমোনের গতি বৃদ্ধিও করবে না, তবু, একটি মানুষ তাঁর ভিটেমাটির, তাঁর বাল্যকালের ধ্বসংস্তূপ থেকে দুঃখের মতো হয়ে যাওয়া রুক্ষ আনন্দকে চিনে নিতে ছুটে যাবে, পশ্চাতে যাবে, আনন্দমার্গী হয়ে, তাঁরই আত্মবৎ অপর মানুষ – এই দেখে রুমির হৃদয়ে সিঞ্চিত হবে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কয়েকটি ফোঁটা যা অমর্ত্যলোকের বৃষ্টির মতোই পূত-পবিত্র। রুমি এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়বে না।

    আকাশের একটি কোনায় যেন বিশেষভাবে উজ্জ্বল খানিকটা আলো। ভিটের গাছপালার গোড়া ও আগাছায় কিন্তু আবছা অন্ধকার ইতিমধ্যেই পাকাপোক্ত। একটা অভ্রভেদী বাঁশঝাড় রয়েছে কাছেই, হরেক রকম পাখির সমাবর্তন অনুষ্ঠান চলছে জায়গাটায়। শিবনাথরা তিনজনে সেখানে একেবারে তুচ্ছ ও কোণঠাসা হয়ে গেছেন।

    শিবনাথ একসময় তাঁর কাজের জায়গা থেকে যখন এমনি সন্ধ্যায় বা পড়ন্ত বেলায় কুর্লা স্টেশনে এসে নামতেন, মাঝে মাঝে দেখতেন, কত পাখি বসে আছে ওভারহেড তারের গায়ে গায়ে। আর তাদের চেয়ে বহু ঊর্ধ্বতন হয়ে অন্তিম বায়ুস্তরে উড়ছে সমুদ্রের দিক থেকে চলে আসা কয়েকটি সি-গাল (seagull) পাখি। সি-গালগুলিকে সচরাচর দেখা যেতো না, কিন্তু হঠাৎ যদি চোখে পড়তো – মনে হতো তাদের ওড়ার মধ্যে কেমন যেন বিচলিত ভাব – হয়ত বা অনিচ্ছায় সংসার সান্নিধ্যে চলে আসার দরুণ; down to earth হওয়ার ইচ্ছে একেবারে নেই।

    কথা হচ্ছিল যৎসামান্য। রুমি চা ও মুড়ি এনেছে সঙ্গে। শালপাতায় দিলো বাবা ও জেঠুকে। আহার্যের প্রতি কারোই মন নেই। শুধু চুপচাপ বসে থাকা। শিবনাথের মনে পড়লো তাঁর তেরো-চোদ্দ বছর বয়সে এই গাঁয়ে সন্ধ্যার পরে কিছুই আর করার থাকতো না যখন – মাতৃদেবী বলতেন, যা, পেচ্ছাব করে আয় – অর্থাৎ যখন জেগে থাকার প্রয়োজন সেদিনের মতো ফুরিয়ে যেতো নির্বিবাদে – তখন, স্বেচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায়, মাতৃ-কথিত সেই জলভার লাঘব করতে এসে ঠিক এমনি সময় শিবনাথ আকাশের দিকে মাঝে মাঝে টর্চের আলো ছুঁড়ে দিতেন। ঠাকুর্দার আমলের তিন সেল বিশিষ্ট এভারেডি কোম্পানির বড়োদের হাতের প্রায় এক হাত লম্বা টর্চ – তারই উচ্চাকাঙ্ক্ষী আলো; সেই আলোক সম্পর্কে শিবনাথের কিশোর কল্পনায় যে ধারণা তৈরি হতো তা হলোএই রকমঃ ওই আলোর দ্বারা এক বাষ্পাচ্ছাদিত তাৎক্ষণিক ও সরলরৈখিক পথে চন্দ্র ও গ্রহ-নক্ষত্র আদি প্রত্যেকটি মহাজাগতিক সদস্যের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটছে; এবং গোটা পৃথিবীর এই একটি মাত্র স্থান যেখানে এই একমাত্র মানুষের উপস্থিতি তারা টের পাচ্ছে। স্বাতী অরুন্ধতী ও রেবতী – এই নাম মাত্র শোনা ত্রয়ীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের অমর্ত্য এক অভিপ্রায় জেগে উঠতো প্রায়শই তৎকালে। আশ্চর্য, ওই তিন নক্ষত্রই নারী নাম-ধারিণী!

    শিবনাথই একসময় বললেন, আমার মা-কে তোর মনে আছে নব? আমি কয়লা আনতে যেতাম রাত আড়াইটায় উঠে। গাঁয়ের অনেকেই যেতো। কর্মসংস্থান আর কিছু ছিল না। একমাত্র কয়লা থেকেই কাঁচা পয়সা আসতো কিছু। কয়লার চাহিদা ছিল খুব। আমার বয়স তখন চোদ্দ কি পনেরো। আমি যেতাম তোর কাকা অশোক আর বাহাদুর গরাইয়ের ভরসায়। বেআইনি কয়লা ঝাড়খণ্ডের। দামোদরের ওপারে যেতে হতো। এরকম অভিযাত্রীদের মৃত্যুসংবাদ রটে যেতো সঙ্গত কারণেই। কারণ পুলিশের হাঙ্গামা ছিল। আর ছিল, অনরবত কয়লা তুলে নেওয়ার দরুণ অতলস্পর্শী খাদ। আমার মা সেইসব দিনগুলোতে মনে মনে বিপর্যস্ত থাকতো। আমার বাবা নেই তখনই।

    একটু থেমে শিবনাথ বলেন, রুমি, আরেকটু কাছে এসে বোস মা। আমার মা-র অর্থশাস্ত্রটি কী রকম ছিল শোন্‌। শুনলে তোর হাসিও পাবে, করুণাও হবে। বোম্বেতে আমি কাজ পাওয়ার পরেও মা এখানে মুড়ি ভেজে ও তা বিক্রি করে দিন কাটাতো। মা-কে নিয়ে যেতে আসি আর বারে বারে, আশাহত হয়ে ফিরে যাই। কিছুতেই অমন দৈত্যাকার মহানগরীর মাঝে যাবে না। এখানে মা শাকান্ন খেতো নিত্যদিন। সুখাদ্য কোথাও পেলেও পরিহার করতো। যুক্তি এই যেঃ পলান্ন বা পরমান্নের মতো খাবার ওষ্ঠে ছোঁয়ালেই ওষ্ঠ দুটির তপস্যা নষ্ট হয়ে যাবে। তারা আর যোগিনী থাকতে চাইবে না। বিনোদিনী হতে চাইবে। এইসব করে, আমার প্রবাসের খরচের উপশম ঘটাচ্ছে মা, এই ছিল মা-র ধারণা। গাঁয়ে তার ব্যয়ভার কিছুমাত্র নেই। ছেঁড়া ময়লা কাপড় পরলেও লোকে কটাক্ষ করবে না। আমার আলয়ে মা গিয়েছিলেন প্রায় মৃত্যুকালীন দশায়। তখনও মা-র এই প্রতিজ্ঞা আর ওরকম জীবন যাপন অটুট ছিল।

    কথায় কথায় একসময় অনুভূত হতে লাগলো অন্ধকারে ফোটা ফুলের লাজুক গন্ধ ও স্ফূটাস্ফূট নানা নিশাচর শব্দের সক্রিয়তা ও স্বকীয়তা।

    রুমি একটি কারুকার্য করা থলে এনেছে সঙ্গে। তাতে ছিল খাবার ও চায়ের সরজ্ঞাম। চা সে এখানেই করেছে শুষ্ক পাতা জ্বেলে। থলে থেকে কী কয়েকটি জিনিস হাতে নিয়ে রুমি হঠাৎ উঠে গেল ভগ্ন দেওয়ালের এক তেকোনা কুলুঙ্গির কাছে। আবার এসে একটি-দুটি অজ্ঞাত জিনিস নিয়ে গেল।

    চায়ের জন্য প্রজ্জ্বলিত পাতার আগুন ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এমন সময় ফস করে হঠাৎ আবার জ্বলে উঠলো আলো। কী ব্যাপার? না, রুমি সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বেলে কুলুঙ্গিতে রেখেছে। রুমির মৃদু ঘামে-ভেজা মুখ গর্জন তেল-মাখা প্রতিমার মুখমণ্ডলের মতো চিকচিক করছে প্রদীপের হিরন্ময় আলোয়। দৃষ্টি স্থির। ঠোঁট দুটি সামান্য নড়ছে। কী অপূর্ব অভূতপূর্ব যে লাগছে রুমিকে! কিছুমাত্র আভরণ ভূষিতা না হয়েও – ওরা ভালো নাম সালঙ্কারা – স্বত-ই যেন সার্থক হয়ে উঠেছে – তার নিজেরই দাক্ষিণ্যে এবং দৈবীরূপের চমৎকারে। শিবনাথ মনে মনে আরত্রিক করতে লাগলেন, এই অবহেলিত তমোময় বাস্তুর ওপর ঝরে পড়া এই অতি বাস্তব ঐশী করুণাকে। প্রদীপের শিখার নিষ্কম্প তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ কুলুঙ্গির শীর্ষকোণটিকে স্পর্শ করেছে। শিবনাথ একবার ভাবলেন, ধুৎ! সব স্বপ্ন। তিনি বোম্বের বাড়িতেই অবস্থান করছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন সন্ধ্যার প্রাক্কালেই। তবু অসময়ের অনৈতিক নিদ্রাকে মার্জনা করে হর্ষবর্ধন নামের সার্থকনামা কোনো পরম পু্রুষ যেন শিবনাথকে দয়া করে দিয়েছেন এই সুখস্বপ্নের আনন্দলহরী।

    এবার একটি শঙ্খও বেজে উঠলো। শাঁখের মুখচ্ছিদ্রটি হাতের তালুতে ঠুকে রুমি আরো একবার সেটি বাজাতে চেষ্টা করছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলি গৃহকোণ থেকে ধ্বনিত হলো আরো কয়েকটি শাঁখ। ...

    একদিন শিবনাথের একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো যা আগে কখনো হয়নি।

    মধ্যাহ্নে শিবনাথ একদিন মাঠ পেরোচ্ছেন। দাবদাহ চরমে। শিবনাথের একেকবার মনে হলো, তিনি আকাশে হাঁটছেন, মাটি পায়ের তলায়। বা, আকাশটাই যেন ভূমির একটি প্রতিরূপ। রোদ্দুরের মধ্যে একযোগে এতোটা শূন্যতা দেখার জন্যেই এইসব হচ্ছে – শিবনাথ এই যুক্তি দিলেন নিজেকে এরকম বিভ্রমের।

    মাঠ পেরোতে তখনো পঁচিশ শতাংশ বাকি এমন সময় দেখলেন খুব কাছেই একটা তালাও বা ওই রকমের বড়ো জলাশয়। কোমর-দোলানো নৃত্যশীলার প্রতিমূর্তির মতো একটা বক্র খেজুর গাছের ছায়া জলের মধ্যে কাঁপছে। শিবনাথের তৃষ্ণা ও অবগাহন-ইচ্ছা জেগে উঠলো প্রবলভাবে।

    দশ-বারো পা এগিয়েই কিন্তু স্বতোৎসারিত যুক্তির প্রভাবে ভুল ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ। শিবনাথ আশাহত হয়ে ভেঙে পড়লেন। ও হলো মরীচিকা। একধরনের মায়াবিনী যোগিনীই বলা যায়।

    কেটে গেল আরো কয়েকটি মাস। শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাত অনেক। শিবনাথ বিনিদ্র বসে আছেন কালী ডাক্তারের বিনোদিনী জানলায়। বর্ষা-মাসের দুর্লভ জ্যোৎস্না। একেবারে প্রত্যক্ষ, মেঘের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত নয়। বৃষ্টি এবার মানুষকে হতাশ করেছে। দিনের বেলা অপূর্ব ময়ূরকণ্ঠী আকাশ। রাত্রে অত্যুজ্জ্বল তারকা-সমাবেশ। শুক্ল তিথিতে উজাড় করা চন্দ্রাতপ। এমনকী অন্ধকারটি পর্যন্ত স্নিগ্ধ, বুকে চাপ-সৃষ্টিকারী বর্ষাকালের জগদ্দল অন্ধকার নয়। আকাশ ও প্রকৃতির এই রূপে কিছুটা অনৈতিকতা আছে সত্য – কারণ তাতে বর্ষার অধিকার খর্ব হয়েছে ও প্রকটিত হয়েছে বর্ষার বঞ্চনা, মানুষের দুর্ভোগ – তাহলেও, শিবনাথের বেশ লাগছে এই নৈসর্গিক শোভা। সুন্দর যে সবসময় সত্য মানবে তার কী মানে! সে অনেকখানি স্বশাসিত।

    ইতিমধ্যে একটি ঘটনা ঘটে গেছে। নতুন কিছু নয় অবশ্য। পুনরাবৃত্তির পুনরাবৃত্তি। নব নেই। অন্তর্হিত।

    দিন পনেরো আগের কথা। সকাল বেলা একদিন রুমি আসে মাঠ পেরিয়ে শিবনাথের কাছে। মুখ ম্লান। তবু শিবনাথের আরোগ্যের খবর নিলো প্রথমেই। কারণ এর আগে শিবনাথ কিছুদিন সামান্য রোগভোগ করেন। কিঞ্চিৎ অম্লশূল হয়। এবং মাঝে মাঝে মাথা ঘোরা। রুমি তাকে নিজে সাইকেলে বসিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে শিবনাথ ভর্তি থাকেন দু’দিন। রুমিও থাকে। একটি ফাঁকা বেডে রাত্রে শোয়। রোগির জন্য সে মশারি নিয়েছে, পরন্তু নিজের জন্য নেয়নি। সারারাত মশা তাড়িয়েছে। ঘুমোয়নি দু’রাত্রি একফোঁটাও। তার পরিযায়ী বাপ বা বহির্মুখী কার্তিককে সে কখনো নিজের মতো করে আদর-যত্ন করার সুযোগ পায়নি। এই জেঠুও আদর-যত্ন এড়িয়ে চলে। এবার সুযোগ পেয়ে রুমি তার সেবাব্রত মনের সুখে সার্থক করেছে। হাসপাতাল-পর্বের পরও নিত্যদিন সে নিজে আসে শিবনাথের কাছে একবেলা। আরেক বেলা কার্তিককে পাঠায় । মশলা-বর্জিত আহার্য রেঁধে দিয়ে যায়। নব তখনই পলাতক। রুমি শিবনাথকে তখন কিছু জানায়নি। তাঁর আরোগ্য পর্যন্ত অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করে। রুমি সহজে কাঁদে না। সেদিন দীর্ঘক্ষণ কাঁদলো শিবনাথের বুকে মাথা রেখে।

    শিবনাথ বললেন, এবারও তোকে কিছু বলে যায়নি?

    রুমি নঞর্থক মাথা নাড়লো।

    শিবনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কেন সে নিজের মেয়েকে এমন আতান্তরে ফেলে!

    রুমির মুখে জানা গেল, নব এবার জ্বলন্ত টর্চ বা বিড়ি-দেশলাই ফেলে যায়নি বটে, কিন্তু তার চেয়েও মহার্ঘ একটি বস্তু – তার বহু অভিযাত্রার সঙ্গী অমিত্রসূদন ত্রিভঙ্গ লাঠিটি নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। অনেকবার অনেক দুর্বৃত্তকে দমন করা গেছে তা দিয়ে। তার মধ্যে মানুষ ছাড়াও, শ্বাপদ-সরীসৃপও আছে। তাছাড়া যষ্টিটির গাত্র গা মার্জনা করে যে গুঁড়ো পাওয়া যায় তার কিছু দ্রব্যগুণ আছে। পেটের অসুখ নিরাময় করে। নব-রও উদরাময়ের ধাত। পথিমধ্যে হঠাৎ পরিচিত পুরনো অসুখে পড়লেও তাকে আকাশ-পাতাল হাতড়াতে হবে। রুমি তাই এবার দারুণ আশঙ্কায় আছে।

    শিবনাথ বললেন, কতদিনে ফিরতে পারে? যদি দণ্ডটির টানে এবার তাড়াতাড়ি আসে?

    রুমি বলল, জানি না। চোখ মুছে বলল, তুমি এখন খাবে কিছু?

    রুমি দুর্দশা হয়ে গেল বড্ড। দোকান উঠে গেছে। কার্তিক সাহায্য করতে চাইলেও তার উড়ো-উড়ো মনই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড়ো বাধা। একা মেয়ের পক্ষে বিপণি চালানোও সম্ভব নয় এইসব গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে এই সময়ে। তার অন্যতম কারণটিও শিবনাথের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল অচিরেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আর দেরি নেই। এবারই বরং কিছুটা বিলম্ব হয়েছে অন্যবারের চেয়ে। তার আগেই উপদ্রব ও অশান্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে-সেখানে চিত্রবিচিত্রিত কেতন, যুক্তকরে জনতাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকারী দিব্যকান্তি নেতানেত্রীর বহুবর্ণ ছবির ও গ্রামে গ্রামে বিপ্লব ও অর্থচিন্তার নাগপাশ-মুক্তি বিষয়ে তাদের অমৃতবাণীর বিজ্ঞাপন – ইত্যাদি আজকাল প্রায়শই শিবনাথের নয়নপথগামী হওয়ায় তাঁর বোধগম্য হয়, এখানে আজকাল অনেকগুলি দল। তন্মধ্যে দুটি পার্টি নিদারুণ প্রভাবশালী। ভোটের আগে ও যে-কোনো একটি দল বিজয়বৈজয়ন্তী গলায় পরার পরে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির বারুদ-গন্ধই এখানকার ঘটমান বর্তমান ও ভবিতব্য। মানুষ নিধনও অবশ্যম্ভাবী। প্রায়শই কোনো না কোনো ভোট লেগেই আছে। কিছু নির্বাচনের নামই শোনেননি শিবনাথ। যেমন সমবায় সমিতির ভোট। প্রত্যেকটি ভোটই প্রাণহরা।

    চা-তেলেভাজার দোকানগুলিই প্রধান আড্ডাস্থল দলগুলির। সেখান থেকেই সাধারণত শুরু হয় বচসা। রুমিদের দোকান সুন্দরী তরুণী দ্বারা চালিত বলে এখানে আকর্ষণ বেশি। নব থাকলেও দোকান চালাতো না এই অবস্থায়। শিবনাথ রুমিকে অর্থ সাহায্যের চেষ্টা করেছেন। রুমি চরম অপমানিত বোধ করেছে। কেঁদেছে। শিবনাথের সঙ্গে বিচ্ছেদ রচনা করেছে দু-চারদিন।

    জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে শিবনাথ ভাবছেন নানা কথা। রুমির কথাই প্রধানত। যেমন – রাময়ণের উল্টো করে ভাবলেন – ভিক্ষুবেশে লঙ্কেশ সীতাকে চুরি করলেন। তার বদলে, অজ্ঞাতকুলশীল সাধু সেজে তিনি যদি রুমিকে গিয়ে কিছু টাকা-পয়সা সাহায্য করে আসেন? এর কিয়ৎক্ষণ পরে অন্য অন্য প্রসঙ্গে আরূঢ় হয়ে ভাবজগতের আকাশ-পাতাল ঘুরে এসে শিবনাথ হঠাৎ উদ্ধার করলেন কালী ডাক্তারের বাড়ি এতোকাল ফাঁকা পড়ে থাকার অজ্ঞাত তিমিরাচ্ছন্ন – সামান্য – -কিন্তু সুদূর অভিঘাত সৃষ্টিকারী কারণটিকে। এখানে নৈমিত্তিক নর-সংহার, আতঙ্ক, অব্যবস্থা; কে থাকবে এই গাঁয়ে – উপায়ান্তর না থাকায় যাদের স্থিতি এখানে বাধ্যতামূলক – একমাত্র তারা ছাড়া?অবশ্য অনন্যোপায় না হয়েও মানুষ যেখানে স্বাভিলাষে বসবাস করে সেখানেও কি মানব সভ্যতা সহজ সরল ও একমুখী নাকি? তা হয় না। বরং সেখানেও বিপণন থেকে বিসংবাদ সবই অপরিহার্য হয়ে যায়। এই হলো নিরুপায়দের একমাত্র সান্ত্বনা।

    আরেক রাত্রে দীর্ঘ লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে দূর দুর্গম মানসিক যাত্রার শেষে শিবনাথ আবিষ্কার করলেন নিজের একটি নতুন ব্যাধি। সেই রোগের নাম রাখলেন, ‘কালী ডাক্তার-সিনড্রোম’! অর্থাৎ তিনিও তাঁর আবেগের অন্তরালে ও স্বোপার্জিত সমস্ত কিছুকে পরিত্যাজ্য ভেবে চলে আসার মধ্যে ধীরে ধীরে কালক্রমিক নঞর্থক উপাদান খুঁজে পাচ্ছেন, যা, কালী ডাক্তার ইতিমধ্যেই পেয়েছেন বা লোক-পরম্পরায় তাঁদের মতো অনেকেই পেয়ে থাকেন। কালিকাপ্রসাদবাবুর আখ্যান থেকে শিবনাথের একটি কথা আজ উজ্জ্বলভাবে মনে হলো। প্রায় যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই, গ্রামজীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় একটি অখণ্ড জীবন কসমোপলিটান শহরে কাটিয়ে তিনি এবং কালিকাপ্রসাদ উভয়েই যখন একদিন না একদিন অবস্থান বদলালেন তখন তাঁদের উভয়ের মধ্যে অস্থিরতার একটি আত্মীয়তা আছে তা অস্বীকার করা যায় না। এর ফলশ্রুতিতে আবার কোনোদিন তাঁদের একটি নতুন অবস্থানের যে জন্ম হবে না তারও ঠিক কিছু নেই। কালীবাবুর ক্ষেত্রে চাক্ষুষ তাই হয়েছে। গ্রামের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বা নিঃস্ব হয়ে আবার পূর্বতন লীলাভূমিতেই ফিরে গেছেন। এই যে ‘পূর্বতন লীলাভূমি’, এটি কিন্তু তথাকথিত ব্যাপার। এবং সেখানে দ্বিরাগমনকে জীবনচক্রের ঘূর্ণন বলা যায় না কোনোভাবেই। কারণ ফিরে যাওয়ার পরে, আগের ধরিত্রীর মৃন্ময় রূপ যতোই এক থাক – মানসিকতার বিচারে সেই প্রত্যাবর্তন ঘটে সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়। ফাঁসির আসামীর ফাঁসি রদ হয়ে সে যদি সংসারে-সীমান্তে ফেরে, তার চেয়ে বরং মরার পরে তার স্মৃতি হয়ে ফেরাটাই আগের মানুষটার সঠিক ফিরে আসা; কারণ মরে গেলে আর কিছু পাল্টাবে না সবাই জানে, কিন্তু এমন জ্যান্ত যে ফেরে সে মানসিকতার অনেক পরিবর্তন নিয়ে ফেরে। মানুষের অস্তিত্ব তো শুধু বস্তুগত নয় তার চিন্ময় অবস্থাটাও একটা অবস্থান। এই হিসেবে, এত সব কিছুর পরে কালী ডাক্তার কোনোভাবেই তাঁর ছেড়ে আসা কর্মতীর্থে ফিরে যেতে পারেননি। আবার, চিত্তের অবস্থানটা বড়ো ব্যাপার বলেই তো নবকুমার যতোই বিশ্ব-পথিক হোক না কেন, রুমি যতোই এখানে বিষণ্ণতার বিষবাষ্পে কষ্ট পাক না কেন, এই অজ্ঞাত অসহায় নিঃস্ব জনপদটির প্রতি তাদের ভালোবাসা – ভালোবাসার স্থির ও বিশ্বাসযোগ্য রূপ।

    বৃষ্টিশূন্য শ্রাবণ মাসের শেষ লগ্নে এসে কালী ডাক্তার-প্রতিষ্ঠিত অঙ্গনের নলকূপটি কালগ্রাসে পতিত হলো। শিবনাথের আলয়ে জলের আর অন্য সংস্থান নেই। কলটিই ছিল ভরসা। এখন পানীয় জল পেতেও তাকে মাঠ পেরোতে হবে।

    ডালডা রাখার দুটি গ্যালন নিয়ে শিবনাথ বেরোলেন। উদ্দেশ্যঃ জল ভর্তি করে কারো সাইকেলে পাত্র দুটি বহন করে নিয়ে আসা।

    এদিন পুনরায় তাঁর মরীচিকা দর্শন ঘটলো।

    আগে কোনোদিন রুমিকে এই কথা জানাননি। সেদিন সায়াহ্নে কী ভেবে রুমিকে বললেন ব্যাপারখানি। রুমির একটু সন্দেহ হলো। সে-ও ওই মাঠে কখনো কখনো এই ধরনের ব্যাপার দেখেছে বটে – যেমন, শুকনো বালির ওপর ঝিলমিল করছে খানিকটা স্বচ্ছ জল ইত্যাদি – কিন্তু শিবনাথের মতো এমন অতিরেক দেখেনি কোনোদিন।

    রুমির মুখের ভাব দেখে শিবনাথ দুঃখিত হলেন। রুমি বুঝি ভেবেছে, ঘটনাটির ঘনঘটা জেঠুর অতিরজ্ঞনের ফল।

    পরদিনই তিনি রুমিকে হাত ধরে জোর করে নিয়ে গেলেন।

    সেদিন কিছু দেখা গেল না।

    শিবনাথের অস্বস্তি কাটছে না। কেন যেন কিঞ্চিৎ রেগে আছেন তিনি সর্বক্ষণ।

    দু-তিনদিন পরে আবার একদিন জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন রুমিকে। সেদিন পূর্বস্থানেই দেখা গেল মরীচিকা। শিবনাথ যেন মহার্ঘ শান্তি খুঁজে পেলেন একটা করাল দুশ্চিন্তার রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে। এই দু-তিনদিন শিবনাথের সকল স্নায়ু যেন অতন্দ্র ও উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিল। অদ্য, এই ঘটনাটির অন্তে সমুদায় স্নায়ু-রজ্জু একযোগে নেতিয়ে পড়লো। ভীষণ ক্লান্ত লাগলো শিবনাথকে। রুমির বুক মুচড়ে উঠলো।

    সে সান্ত্বনার সুরে বলল, জানো জেঠু, মনে হচ্ছে, সত্যিই যেন দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী প্রফুল্ল যে লাগছে আজকে। আসবে দু-জনে মাঝে মাঝে ভ্রমণে এই অলীক দীঘির কাছে?

    শিবনাথ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অনেক পরে আচ্ছন্নের মতো বললেন, জলের অলৌকিক অবান্তর ছবি, তবু কী অপূর্ব! কী নয়নাভিরাম!

    রুমিরও মুখ দেখে মনে হলো, সে খুবই পুলকিত। গ্রামে এতোকাল বলার মতো বেড়াবার কোনো জায়গা ছিল না, আজ, এই নিমিত্তমাত্র দৃষ্টিভ্রমের মধ্য দিয়ে সে এক অচ্ছোদ সরোবর দেখার দৃষ্টিসুখ লাভ করলো। আসবে বইকি রুমি এই সরোবরের কাছে সবান্ধবে বেড়াতে। (রুমির ইচ্ছে, কার্তিকের জন্য রুমি কোনোদিন একটি দামি মোবাইল কিনবে। এখানে ঘুরতে এসে মোবাইলের ক্যামেরায় রুমির নানা বিভঙ্গের ছবি কার্তিক তুলে দেবে। আচ্ছা, এই সরোবরকে সরোবর বা এর জলকে জল মনে হবে ক্যামেরায়?)

    কিছুদিন শিবনাথের কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো। তারপর কেটেও গেল সেই ভাবসমাধি। তৎপশ্চাৎ আবার একদিন তিনি পড়লেন মরীচিকার সমীপে। ইতিপূর্বে, গুমোট রাতে (প্রতিটি রাত্রিই গুমোট। স্নিগ্ধ রাতের কথা যেন মনেই পড়ে না।) যেমন তাঁর বিনিদ্র অবস্থায় বসে বসে ভাবা অভ্যাস, তদনুসারে মরীচিকার কথাও অনেক ভেবেছেন। তাঁর দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে, গ্রামে থাকতে এসে কালীবাবুর অনুরূপ তিনিও আশাহত হওয়ার ফলেই যে আদ্যাশক্তি প্রকৃতি, বা, শিবনাথের মুখে আজও উচ্ছ্বিষ্ট হয়নি বর্ণনার অতীত যে সচ্চিদানন্দের স্বরূপ – তিনি – ভুয়ো প্রতীকী দৃশ্য দ্বারা শিবনাথের মনকে আশার ছলনায় প্রলুব্ধ হওয়া থেকে প্রতিহত করছেন – তা কিন্তু নয়। এই মরীচিকা অন্তঃসারশূন্য হলেও তা অরূপ তো নয়। তার সৌন্দর্যও ভুয়ো নয়। বরং তার অপূর্ব, অতীন্দ্রিয় শোভাও দু-চোখ ভরে দেখা যায়! যেন কোন এক অজানা দূর অব্দি বিস্তৃত এক সমুদ্রের সঙ্গে তার অন্তর্গত জলাশয়টির যোগাযোগ রয়েছে। পাড় ধরে হেঁটে গেলে যেন পৌঁছে যাওয়া যায়, সেই অমর্ত্যলোকে যেখানে গ্লানির ভাণ্ড থেকে সবটুকু উল্টে পড়ে মিশে গেছে দিকচিহ্নহীন শান্তির পারাবারে। এই সৌন্দর্য একান্নবর্তী, এতে সবার সমান ভাগ। নৈরাশ্যের অন্ধকারে বসে আছে যে তার যেমন, আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রেখেছে যে তারও তেমনি। কোনো ভেদ নেই।

    রুমিকে মরীচিকা দেখানোর পরে শিবনাথের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে গেছে।

    সেদিন অনেকটা কাছে গেলেন। নৃত্যপটিয়সীর বিভঙ্গে সেই খেজুর গাছ। গাছটির কাঁটাওয়ালা ডালে ডালে ছোটো ছোটো পাখি লাফালাফি করছে। সমস্ত নিয়েই গাছটির প্রতিবিম্ব কাঁপছে অবাস্তব জলে। এবং মরীচিকার মধ্যেও বিম্বিত পাখিগুলির স্ফূর্তি দেখা যাচ্ছে।

    ইতিমধ্যে গ্রামের অভ্যন্তরে নর-সংহার ঘটে গেল। এ বছরের প্রথম হত্যাকাণ্ড। একটি কুড়ি-বাইশ বছরের যুবকের মৃতদেহ পড়ে ছিল তপ্ত ধুলোর ওপর। প্রকাশ্য দিবালোকের দৃশ্য, সুতরাং প্রথমেই যারা ছেলেটিকে দূর থেকে দেখতে পেয়েছে তারা ওকে একেবারে মৃত নয়, ওর কিছুটা জীবদ্দশা দেখতে পেয়েছে। সে যে কার্তিক তাতে সন্দেহ ছিল না কারো। সে ছটফট করছিল, তার ফলে ওর চারপাশে উড়ছিল ধুলো। সে হাওয়া চাইছিল প্রচুর। কেন চাইছিল কে যেন তার ব্যাখ্যা করলো পরে। তা হলো এইঃ মানুষের প্রশ্বাসও তো হাওয়াই। এতো হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল তবু সূক্ষ্ম একটু হাওয়াকে সে আর প্রশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারছিল না, যা তার চতুষ্পার্শ্বের পূর্ণ মাত্রায় জীবিতরা, এমনকী কীট-কৃমির মতো উপেক্ষিত জীবও অনায়াসেই পারছিল। এরই নাম কালগ্রাস। ছেলেটির জলতেষ্টা পেয়েছিল খুব। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য। হয়ত জলতেষ্টাও নয়। জীবনতৃষ্ণা। কারো সীমাবদ্ধ হাত তা মেটাতে পারবে না। ছেলেটি সব জেনেবুঝেই চোখ বুজলো। …

    এরপর একদিন কথা হচ্ছে শিবনাথের ঘরে বসে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরে। শিবনাথের এখানেই রান্না হয়েছে আজ বাছা বাছা কয়েকটি সুখাদ্য। রন্ধনশিল্পী রুমি নিজেই। কার্তিক তাকে রান্নায় যা সহযোগিতা করেছে তা না করলেই বোধহয় ভালো হতো। তাতেই বেলা হয়ে গেছে অনেকটা। খেতে প্রায় আড়াইটে বাজে।

    খাওয়া-দাওয়ার পরে বিশ্রামের সময়টিতে শিবনাথ ও কার্তিকের উদ্দেশে রুমি বললো, একে তো রুদ্ধশ্বাস আবহ। ভালো লাগে না কিছুই। তারপর বেরোনোও হয় না বহুদিন। চলো না একটু বেড়িয়ে আসি বেলা থাকতে থাকতে সেই দীঘির কাছাকাছি। তিনজনে গেলে ভয় নেই। কার্তিক আমার ও জেঠুর মাঝে হাঁটবে। হ্যাঁ রে ভাই(বন্দী কার্তিককে বললো), তোর মতন ছেলে ঘরে বসে আছে এতোদিন নিরুপায় হয়ে, নিষ্ক্রান্ত হতে মন চাইছে, কিন্তু দিদির কাছে অবদমিত; একঘেয়ে লাগছে বল্‌?

    কার্তিক বলল, দিদি, তা তো লাগছেই সাংঘাতিকভাবে। কিন্তু রোদ মাথায় যাবো?

    রুমি বলল, আসল রোদ তো আলোকবর্ষ দূরে তৈরি হচ্ছে। মাথায় আবার কোথায়! চল।

    জেঠুকে যেতে বলতে গিয়ে দেখলো তিনি তন্দ্রালু হয়ে বসে আছেন চেয়ারে। নাসিক গর্জন হচ্ছে। অগত্যা দু-জনে গেল।

    কার্তিককে কয়েকদিন আগেই নিজের ঘরে এনে নজরবন্দী রেখেছিল রুমি। এই ক’দিন তাকে কোত্থাও বেরোতে দেয়নি। যে ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছে সে গাঁয়েরই ছেলে। ... কেটে গেছে এক পক্ষকালের অধিক। রুমির মন এখনো থেকে থেকে বৃষ্টি-ভেজা চড়াই পাখির মতো কেঁপে উঠছে। কার্তিকেরও বিপন্নতা আছে রুমি বুঝতে পেরেছে। প্রাণ হারানো ছেলেটি ছিল কার্তিকের বন্ধু। কার্তিকের বিপন্নতা ও ওই মৃত্যুর মধ্যেও কোথায় যেন একটা আত্মীয়তা আছে।

    এতদসত্ত্বেও সেদিন দেখা গেল না মরীচিকা।

    দু-দিন পর আবার ধরলো রুমি কার্তিককে, চল। যেতেই হবে।

    সেদিন দর্শন হলো সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের। তবে আগের জায়গায় নয়। পুবের দীঘি পশ্চিমে এসে গেছে। কার্তিক সম্যক রূপেই কখনো কখনো এই দৃশ্য আগে দেখেছে। কিন্তু আজ রুমি দিদির উপস্থিতিতে তার মনে হলো, এটা একটা অসাধারণ দ্বীপরাষ্ট্র। এখানে হিংসা মানে, অলীক। অলীক মানে, কূলকিনারাহীন উদারতা, স্বচ্ছতা। ওই যে দেখা যায় সাগরের জল, তার মতো।

    রুমি একদিন শিবনাথের কাছে এলো। পরনে ময়লা শাড়ি। চুলে জট। বলল, জেঠু, আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন করেছিলেন শ্বশুরমশায় আর শ্বশ্রুমাতা দু-জনেই। ওঁদের গ্রাম স্থিতিশীল ও শান্ত। বুড়োবুড়ির আর কেউ নেই। আমার স্বামীই ছিলেন তাঁদের একমাত্র বংশপ্রদীপ। যে ক-দিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেঁচে আছেন, আমার সান্নিধ্য চান প্রাণভরে। আমি স্বাধীনভাবে থাকবো, ওঁরা বাধা দেবেন না, এই কথা কতবার যে বলেছেন! জেঠু, তুমি আমার সঙ্গে যাবে? কার্তিককেও প্ররোচনা বা প্রলোভন দিয়ে সরিয়ে নিতে হবে এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে। থাকবে তুমি ওখানে অনির্দিষ্ট কাল? বাবা ফিরে এলে সংবাদ পেয়ে যাবে ঠিক।

    শিবনাথ একবার ভাবলেন, সম্মতি জানাবেন। রুমি থাকলে, নব থাকলে তবেই এই গ্রাম বৃন্দাবন। নচেৎ তমোময় অরণ্য।

    পরক্ষণে মনে পড়লো, প্রাণাধিক প্রিয় জন্মভূমিকে তমসাবৃত মনে হলো কেন? সুতরাং এটি ‘কালী-ডাক্তার সিনড্রোম’। অমনি সম্মতি থেকে পশ্চাদপসরণ করলেন। তারপর শিবনাথ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন, তিনি অসম্মতি জানালেও রুমি কি তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে তার পুরনো শ্বশুরবাড়ি? ...

    একদিন দেখেন, সত্যিকার খেজুর গাছটির সব আসল পাখি উড়ে গেছে। কিন্তু মরীচিকায় উদ্ধৃত তাদের প্রতিবিম্বগুলি তেমনই স্ফূর্তিতে আছে। শিবনাথ চিন্তায় আকুল হ’য়ে ঘরে ফিরলেন। আসল পাখিগুলি না হয় খুঁটে খাবে কিছু না কিছু, কিন্তু প্রতিবিম্বের ওরা আহার্য পাবে কোথায়? জলও তো নেই। জলের নামে যা দেখা যায়, তা জলের প্রতিচ্ছবি পর্যন্ত নয়। তা তপ্ত ধুলোর কম্পমান তাপ-প্রবাহ।

    পরদিনই শিবনাথ কিছু দানা ও একটি পাত্রে জল এনে ওদের দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই বাস্তবতা ওদের অতি বাস্তব জগতে কিছুতেই পৌঁছে দেওয়া গেল না।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments