• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পিরামিড ও মামি : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    স্টেপ পিরামিড

    পিরামিড আর মামি আমাদের সবার পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই কত গল্প পড়েছি, ছবি দেখেছি, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার একটা ধারণা আমাদের সবার মনে গাঁথা রয়ে গেছে। কিন্তু সশরীরে পিরামিড-এর সম্মুখীন হওয়া বা হাতের কাছে একটা আস্ত মামি দেখা বিশেষ সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার কপালে সেটা ঘটেছিল ’৯৭ সালে। ‘আরব বসন্তের’ বছর দশেক আগে। সেসময় এখানে-ওখানে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের খবর পড়েছিলাম কিন্তু বড়সড় কোন হাঙ্গামা তখনো শুরু হয়নি। সেবার কোনো কনফারেনস বা মীটিং ছিলনা, একেবারেই নিছক ভ্রমণ। আমার এক আমেরিকান বান্ধবী লেসলি আনেকদিন ধরে মিশরে যাবার প্ল্যান করছিল, আমরা স্বামী-স্ত্রীও তার সঙ্গে জুটে গেলাম।


    কায়রো
    প্রথমে অবশ্যই নামতে হল কায়রোয়। আফ্রিকার বৃহত্তম ও প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর কায়রো। পাশেই বয়ে চলেছে বিখ্যাত নীলনদ। অপর পাড়ে দূরে পিরামিডের আবছা আভাস দেখা যায়। দুহাজার বছর আগে কায়রো ছিল একটা ছোট্ট গাঁ, রোমানদের দখলে। তারপর ক্রিশ্চান, এবং তারো পরে, এখন ১৪০০ বছর ধরে মুসলমানদের দখলে। সারা শহরে অসংখ্য ঐতিহাসিক মসজিদ, গির্জা ও ইহুদী সিনাগগ ছড়ানো। ১১০০ সালে প্রতিরক্ষার জন্য সম্রাট সালাদিন পুরনো শহরটি দেয়াল ঘিরে দুর্গ তৈরি করেন। এখন সেটা সিটাডেল নামে খ্যাত।


    সিটাডেল, পুরোনো শহর, কায়রো
    অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের শহরের মতই আজকের কায়রো গাড়িঘোড়া, ধূলোধোঁয়া, লোকজনে ভর্তি। রাস্তাঘাটও খানাখন্দে ভরা। (অন্তত এইদেশে রাস্তাঘাট ভালো হওয়া উচিত ছিল, তাই না? এদেরই পূর্বপুরুষরা তো পিরামিড বানিয়েছিলেন যা পাঁচহাজার বছর পরে এখনো অটুট।)

    পিরামিডগুলি কায়রো শহরের বাইরে, নীলনদীর পশ্চিম পাড়ে গিজা নামক একটি মরুভূমির শহরে। দূরে কায়রো থেকে ছবির মতই মনে হয় কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে—ওরেব্বাস! আমি অনেক দেশে ঘুরেছি কিন্তু এই প্রথম আমি মানুষের কোন সৃষ্টির সামনে একেবারে অবাক, স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম! এতবার ছবিতে দেখা ও বইয়ে পড়া সত্ত্বেও। চীনের প্রাচীর, ইনকাদের মাচুপিচু, ভারতে তাজমহল –পিরামিডের সামনে কিছুই লাগেনা। কি করে এরা বানিয়েছিল এই বিশাল অথচ নিখুঁত সৃষ্টি? কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ইঞ্জিনীয়ারিং ডিগ্রী ছাড়াই?


    পিরামিড
    ধূধূ মরুভূমির মধ্যে তিনটি সুউচ্চ পিরামিড, সবথেকে বড়টি ফারাও (সম্রাট) খুফু-র সমাধিস্থল, প্রায় পাঁচহাজার বছর আগে তৈরি, পাঁচশ ফুটেরও বেশী উচ্চতা, পৃথিবীর বিশালতম সমাধি। বিরাট বিরাট পাথরের চাই কেটে নিখুঁত ভাবে বসানো, ওপরে একসময় মোলায়েম করে লাইমস্টোন-এর প্রলেপ দেওয়া ছিল এখন সেটা মরুভূমির ধুলোহাওয়ায় একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, শুধু চুড়োর কাছে একটু অবশিষ্ট দেখা যায়।

    মাটি থেকে একটু উঁচুতে পিরামিডের গায়ে একটা ছোট্ট দরজা। টুরিস্টরা সেটা দিয়ে পিরামিডের ভেতরে সুড়ঙ্গে ঢুকতে পারেন। সমাধিকক্ষ পর্যন্ত যাওয়া যায় কিন্তু ভীষণ সরু রাস্তা এবং একেক জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। ক্লস্ট্রোফোবিয়া থাকলে না যাওয়াই ভালো। ভেতরে কিন্তু এখন আর দেখার কিছুই নেই। হাজার বছর ধরে চোরের দল সোনাদানা, ফারাও-র মামি সব লুটপাট করে নিয়েছে। ঐ সুড়ঙ্গটার নামই ‘চোরের সুড়ঙ্গ’।

    পাশের মাঝারি সাইজের পিরামিডটি খুফু’র ছেলে ফারাও খাফ্রে-র সমাধি। এবং তার পাশে সবথেকে ছোট পিরামিডটি খাফ্রের ছেলে ফারাও মেনকওরে-র সমাধি। এদুটোয় ঢোকার বন্দোবস্ত নেই। এই তিন সম্রাট এখন থেকে চার-পাঁচহাজার বছর আগে চুটিয়ে রাজত্ব করে গেছেন। তখন কোথায় ছিল ভারত, কোথায়ই বা ইয়োরোপ আর আমেরিকা!


    ভ্যালি অফ কিংস
    পিরামিডের আশেপাশে টুরিস্টদের ভিড় ও তার সঙ্গে উট, ঘোড়া ও গাধার দল—টুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য। আগে থেকেই দরদাম করে নেবেন নইলে হয়তো উট থেকে নামতেই দেবেনা। ভারতের মতই মিশরেও সব কেনাকাটায় বেশ দরদস্তুর করতে হয়। নইলে বোকা টুরিস্ট ভেবে ঠকিয়ে দেয়।


    স্ফিংক্‌স
    পিরামিডের চত্বরে অতন্দ্র প্রহরী স্ফিঙ্কস। মানুষের মাথা ও সিংহের শরীর। হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। পিরামিডের চত্বরে ঢোকার আগে যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে সেই বিখ্যাত প্রশ্ন—'কে একই ভাষায় কথা বলে কিন্তু হাঁটে কখনো চারপায়ে, কখনো দুই, কখনো বা তিন?’ (উত্তর—মানুষ) স্ফিংক্সের নাকটা ভাঙা—শোনা যায় নেপোলিয়নের সৈন্যরা ওর ওপর বন্দুক প্র্যাকটিস করতো।

    তিন পিরামিড থেকে একটু দূরে স্টেপ পিরামিড, যেটা সবথেকে পুরনো। ফারাও যোষার (Djoser) ৪৭০০ বছর আগে তৈরি করেছিলেন। ধাপে ধাপে ছয়টা সিঁড়ি, দেখেই বোঝা যায় এই ভাবেই আসল পিরামিড তৈরির সূচনা হয়েছিল। এটা নেহাতই হাত মক্সো করার জন্য, ভেতরে কারুর সমাধি নেই।


    হাতসেপসুতের মন্দির

    পিরামিড দেখার পর আমরা উত্তর থেকে দক্ষিণে নদীযাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই প্লেনে কায়রো থেকে লাক্সর। এখানে আছে মরুভূমির পাহাড়ের গুহায় শতশত কবরস্থান। এঁরা পরের যুগের বিখ্যাত রাজারাজড়া—সেটি, রামসেস, নেফ্রেতিতি, হাতসেপসুত থেকে তুতেনখামেন পর্যন্ত—ভ্যালি অফ কিংস আর ভ্যালি অফ কুইনস-এ সমাধিস্থ। প্রতিটি গুহার দরজায় নম্বর দেওয়া, ছোট্ট একটু ইতিহাস ও সামনে দাঁড়ানো বন্দুকধারী পাহারাদার। অনেকগুলোই হাজার বছর আগে লুটপাট হয়ে গেছে, কোনো কোনোটায় দেয়ালে আঁকা দেবদেবীর রঙিন প্রতিমূর্তি ও হায়ারগ্লিফিক্সে লেখা এখনো ঝকমকে, কোনোটা খুব সাদামাটা, হয়তো সে রাজার বিশেষ নামডাক ছিলনা। আসল মামি ও সোনাদানা এখন কোনো গুহাতেই নেই, সব মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। সবগুলো একদিনে দেখা যায়না, হয়তো এক মাসেও না।

    রামসেসের সমাধিকক্ষ

    লাক্সরে আরও আছে, করনাকের বিখ্যাত রামসেস-এর মন্দির (এদেশে মন্দির শুধু দেবদেবীর জন্য নয়, ফারাও-দের জন্যেও, তাঁরাও দেবদেবীদেরই অংশ ছিলেন।) ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বের দ্বিতীয় রামসেস মিশরের ইতিহাসে সবথেকে বিখ্যাত, প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট। প্রায় পঁচাত্তর বছর রাজত্ব করেছেন, প্রতিবেশী ও দূরদূরান্তের রাজাদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছেন, সেই সময় মিশরের প্রভাব পারস্য থেকে সারা উত্তর আফ্রিকায়, সেদেশের স্বর্ণযুগ যাকে বলে। এখনও সারা দেশে রামসেসের নাম ছড়ানো। রামসেস বোধহয় এখনো মিশরে সবথেকে জনপ্রিয় নাম।


    হায়ারোগ্লিফিক্স লেখা, লাক্সর

    লাক্সরের মন্দিরটি বিশাল, দেয়ালে লেখা রামসেস-এর কীর্তিকাহিনী (আহা, যদি হায়ারগ্লিফিক্স পড়তে জানতাম!) রামসেসের সমাধিগুহা ভ্যালি অফ কিংস-এ, কিন্তু তাঁর অমূল্য মামিটি মিউজিয়ামে রাখা। শোনা যায় মামিটি আবিষ্কারের সময় বিজ্ঞানীরা ভালো করে পরীক্ষার জন্য প্যারিস-এ পাঠান। ফরাসী সরকার বিনা পাসপোর্টে কোনো নাগরিক-কে আসতে দেবেনা, তাই রামসেস-এর মামির ছবি তুলে নামধাম দিয়ে রীতিমতো একটা পাসপোর্ট বানানো হয়। তবেই না ফারাও ফ্রান্সে ঢোকার অনুমতি পান।

    ভ্যালি অফ কিংস-এর আরেক প্রসিদ্ধ বাসিন্দা ফারাও তুতেনখামেন বা কিং টাট। রামসেসের তুলনায় ইনি একেবারেই চুনোপুঁটি। কোন যুদ্ধে জেতেননি বা রাজ্য দখল করেননি। মাত্র ন’বছর রাজত্ব করে অকালমৃত হন। তাঁর নামডাক শুরু হয় ১৯২২ সালে, যখন হাওয়ার্ড কার্টার প্রথম এঁর সমাধিটি আবিষ্কার করেন। এটিই একমাত্র রাজকীয় কবর যা আগে কখনো লুটপাট হয়নি। তাই এর এতো নামডাক। নানারকম দুর্মূল্য কফিন, মামি, মণিমুক্তা, সোনাদানা, আসবাবপত্র, ইত্যাদি এখন সবই অবশ্য মিউজিয়ামে। দেয়ালে যথারীতি দেবদেবতার ছবি আঁকা—গরুর শিঙওয়ালা আইসিস, শেয়ালের মাথাওয়ালা পরকালের ভয়ানক দেবতা অনুবিস, হাতে ওজনপাল্লায় মৃত রাজার হৃৎপিণ্ডটি ওজন করছেন, রাজার পাপপুণ্যের হিসেব নিতে। এই কবরটি অভিশপ্ত বলেও অনেক গুজব ও গল্প আছে। খননকারীদের অনেকেই নাকি নানা ব্যাধি ও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিলেন।

    ভ্যালি অফ কুইনস-এর প্রধান বাসিন্দা রানী হাতশেপসুত। তাঁর মন্দিরটি আলাদা, পাথরের গায়ে খোদাই করা, ১৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বে তৈরি কিন্তু বেশ আধুনিক স্টাইল বলে মনে হয়। ইনি ছিলেন দ্বিতীয় মহিলা-ফারাও, খুব প্রতালশালিনী, পুরুষের পোশাকে সেজে দরবার করতেন।

    আমরা ফিরে আসার হপ্তাখানেক পরেই টেররিস্ট আক্রমণে ঐ মন্দিরের চত্বরে কয়েকজন টুরিস্ট মারা যান। আরব-বসন্তের পূর্বাভাস।


    নীলনদ ও সাহারা

    নীলনদে নৌকাসফরে লাক্সর থেকে দক্ষিণে আসওয়ান বাঁধ পর্যন্ত যেতে তিন-চার দিন লাগে। পথে দুইদিকে অনেক দ্রষ্টব্য ছড়ানো। ছোটোবড়ো মন্দির বা সমাধির ধ্বংসাবশেষ। নদীর পাড় ঘেঁষে প্যাপাইরাসের ঝাড়—এই দিয়ে প্রাচীন মিশরে লেখার কাগজ বানানো হতো, সেইসব ‘বই’ এখনো মজবুত। প্যাপাইরাসের পর এক চিলতে সবুজ, উর্বর চাষের জমি, তারও পরে ধূধূ মরুভূমি পশ্চিমে সাহারার সঙ্গে মিশে গেছে। মাথার ওপরে মেঘহীন, দূষনহীন নীল আকাশ, এতো উজ্জ্বল নীল আমি আর কোথাও দেখিনি।


    জাহাজে খাওয়ার আয়োজন

    স্টিমারে আমোদপ্রমোদ ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালো। যাবতীয় মধ্যপ্রাচ্যের খাবার—দোলমা, নান, ভেড়ার মাংসের কাবাব—ফলাও আয়োজন। একদিন ফ্যান্সি ড্রেস উপলক্ষে আমরা সবাই মিশরীয় ঢোলা গালাবিয়া পরে যোগ দিয়েছিলাম। মিশরীয় যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নাকি লেসলিকে আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী বলে মনে করেছিলেন—আমেরিকান শো-ওয়াইফ যাকে বলে। আমরা এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম।

    নদীর তীরে ‘কম ওম্বো’ নামক এক বিরাট মন্দির দেখেছিলাম। এটা গ্রীক-রোমান সময়ে তৈরি, অন্যান্য পিরামিড ও মন্দিরের ইত্যাদির তুলনায় অনেক নতুন। নীল নদের কুমির-দেবতা সোবেক-এর উদ্দেশে নির্মিত। নদীতে জ্যান্ত কুমীর দেবতা দেখার সৌভাগ্য কিন্তু হলনা।


    রামসেস ও নেফ্রেতারি, আবু সিম্বেল

    লাক্সর থেকে ১১০ মাইল দক্ষিণে, মিশর ও সুদান-এর সীমান্তে আসওয়ান বাঁধে আমাদের শেষ স্টপ। এটাকে upper nile বলে, কিন্তু আসলে এটা নদীর দক্ষিণ প্রান্ত। এই বাঁধ প্রেসিডেন্ট নাসের-এর জমানায় তৈরি, মরুভূমিতে চাষবাসের জল যোগানোর জন্য। কিন্তু বাঁধের জলে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বে তৈরি ফারাও রামসেস-এর বিখ্যাত মন্দির আবু সিম্বেল ডুবে যায়। তাকে উদ্ধার করতে পুরো মন্দিরটি টুকরো টুকরো করে কেটে আরও উঁচুতে উঠিয়ে আবার প্রতিটি টুকরো নিপুণভাবে জোড়া দিয়ে পাহাড়ের গায়ে এমন ভাবে পুননির্মাণ করেছে যে দেখে বিশ্বাস হয়না। ৬৬ ফুট উঁচু সিংহাসনে বসা রামসেসে-এর বিশাল মূর্তি, পাশে অপেক্ষাকৃত ছোটো রানী নেফ্রেতারি। সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে দেখতে দেখতে ঘাড়ব্যাথা হয়ে যায়।


    ক্লিওপেটরা, টলেমী ও শিশু সিজার, দেন্দেরা

    আবু সিম্বেল থেকে আবার উত্তরে ফেরা। পথে পশ্চিম তীরে ‘দেন্দেরা’ নামক একটি জায়গা দেখার ইচ্ছে ছিল। এটাও রোমান আমলে (ভাবুন জুলিয়াস সিজার, মার্ক অ্যান্টনি ও ক্লিওপেঁটরার সময়কার) তৈরি আকাশের দেবতা হাথোর-এর মন্দির। এখানে ক্লিওপেঁটরার একমাত্র সমসাময়িক --কাল্পনিক নয়, এলিজাবেথ টেলরের অভিনীতও নয়,-- একেবারে সত্যি তাঁর জীবন্ত সময়ে খোদাই করা ছবি আছে। আমি গাইডদের ধরাধরি করছিলাম কিন্তু ওরা নানারকম বাহানা দিয়ে আমাকে কাটিয়ে দিচ্ছিল। শেষে একেবারে চেপে ধরতে একজন মরিয়া হয়ে বলে ফেললো, “ওখানে ভীষণ গরম!” আমি তো বিস্ময়ে অবাক। এ আবার কীরকম অজুহাত! মরুভূমির দেশ, গরম তো সর্বত্রই। আরও পেড়াপেড়িতে রাজী হল কিন্তু শর্ত সঙ্গে মিলিটারি এসকর্ট নিতে হবে। এবার বুঝলাম ঐ গাঁয়ে কাছাকাছি নিশ্চয়ই টেররিসটদের ঘাঁটি বা কিছু। তবে তা-ই সই। একটা জীপে চারপাঁচজন বন্দুকধারী সেপাই চলল আমাদের সঙ্গে। ওদের কিন্তু আমাদের মতো মন্দির-টন্দির ঘোরার ইচ্ছা ছিলনা। আমাদের একা ছেড়ে দিয়ে ওরা একটা চায়ের দোকানে আড্ডা জমালো, হাতের বন্দুকগুলি সব এককোণে পড়ে রইল। দেখে মনে হল যদি টেররিস্টরা চড়াও হয়, এরা উঠে বন্দুক তোলার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। ভাগ্যি ভালো, সেরকম কিছুই হলনা। আমরাও ঠিকঠাক স্টিমারে ফিরে এলাম।

    নীলসফর সেরে লাক্সর হয়ে আবার কায়রোয় ফেরা। সেখানে বিখ্যাত বাজার ‘খান আল খলিলি’ (১৩০০ সালে পত্তন) দেখার ও কিছু স্যুভেনির কেনাকাটার প্ল্যান। জায়গাটা দিল্লীর চাঁদনি চকের মত, গলিঘুঁজি, ভুলভুলাইয়ায় ভর্তি, শুধু আয়তনে শতগুণ বিরাট। হাতে বোনা কার্পেট থেকে ক্লিওপেঁটরার প্রিয় সুগন্ধী, শ্বেতপাথরের আইসিস মূর্তি থেকে সোনার পাতে হায়ারোগ্লিফিক্সে আপনার নাম লেখা—সবরকম জিনিশ এখানে পাওয়া যায়। তবে ভারতের মতই এরাও ভীষণ দরদাম করতে ভালবাসে, আপ্যায়ন করে বসায়, চা-কফি খাওয়ায়, সঙ্গে গালগল্প—“তোমরা মিশরীয় নও? এতো ভালো দর করতে শিখলে কোথায়? সত্যিই তোমার পরিবারে কেউ মিশরীয় নয়?” সঙ্গে আমার বান্ধবীকে দেখে কেউ মন্তব্য করেন “আপনার তো দুই স্ত্রী। নিশ্চয়ই অনেক রোজগার। আপনার আর দরদাম করার কি দরকার?”

    কায়রোয় বিখ্যাত ন্যাশনাল মিউজিয়াম অবশ্যই দ্রষ্টব্য। গত দু’তিনশ বছর ধরে সারা দেশে খোঁড়াখুঁড়ির ফসল সব এখানেই মজুদ। আগের দিনে বেশির ভাগ ভালো ভালো জিনিশগুলো ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা আমেরিকার মিউজিয়ামে চলে যেত। এখন আইনের কড়াকড়িতে সেসব বন্ধ হয়েছে। এইখানেই কার্টারের আবিষ্কৃত তুতেনখামেনের সমাধিগুহা থেকে তোলা সব সোনাদানা, মহামূল্য আসবাবপত্র, কফিন, সোনায় আঁকা মূর্তি, সোনার সিংহাসন এমনকি সোনা বাঁধানো চটিজুতো পর্যন্ত সংরক্ষিত। অনেক ঐতিহাসিক হায়ারোগ্লিফ, পাথর ও অ্যালাবাস্টার-এর মূর্তিও এখানেই দেখা যায়।

    মিউজিয়ামের একটা বিভাগে শুধু বিখ্যাত রাজা ও রানীদের মামিগুলি রাখা। এই জায়গাটা এয়ার কনডিশনড, বাষ্পানুকূল ও আরও বেশি কড়া প্রহরা। এখানে কাঁচের শো-কেসে সম্রাট রামসেস, সেতি ও আরও দশবারোজনের মামি দেখতে পাবেন, তবে ফোটো তোলা মানা। এঁরা সবাই চার-পাঁচ হাজার বছর বয়েসী, কিন্তু মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এখনো অটুট নিখুঁত। মুখ, মাথা, হাত-পায়ের চামড়া শুকনো চিমসে কিন্তু এখনো সহজেই চেনা যায়। একেকজন মহিলার চুলের সাজও দেখার মতো।

    কি করে এসব সম্ভব হয়েছিল? একটু বিশদ করে বলি? প্রথমে, মৃত্যুর পর পুরোহিত ও সাঙ্গোপাঙ্গরা দেহটি চিরে ভিতরের যকৃৎ, ফুসফুস, প্লীহা, ও অন্ত্রনালী বার করে শরীরটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করত। শুধু হৃৎপিণ্ডটি বুকে রেখে দিত যাতে দেবতা অনুবিস সেটাকে ওজন করে পাপপুণ্যের বিচার করতে পারেন। অন্যান্য অঙ্গগুলি হাঁড়ি বা সরায় আলাদা রেখে দিত। মগজ বার করার জন্য মাথাটা না কেটে নাকের ভেতর দিয়ে লম্বা শলা ঢুকিয়ে সুনিপুণ কৌশলে ঘিলুটা বার করে ফেলতো। তারপর দেহটা নুনজলে চুবিয়ে রাখতো যাতে ভেতরের জলীয় পদার্থটা একেবারে বেরিয়ে যায়। এরপর নানারকম রাসায়নিক পদার্থে লেপে, লম্বা লিনেন কাপড়ের পট্টি দিয়ে সমস্ত শরীর মুড়ে দিত। এই হল মামি। সবশেষে গয়নাগাঁটি দিয়ে সাজিয়ে কফিনে শয়ান দেহটি কবরস্থ করা হতো। মরুভূমির শুকনো গরম আবহাওয়ায় দেহটি সহজেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুধু চামড়া ও হাড়সর্বস্ব দেহটি একেবারে গন্ধহীন, কোনরকম পচনও ধরেনা। কফিনের সঙ্গে তাঁদের নামধাম, ইতিহাস ও কীর্তিকাহিনী লেখা থেকে সহজেই জানা যায় কার সমাধি।

    এতসব ‘মামি’ জ্ঞানলাভের পর লেসলি ও আমি ঠিক করেছিলাম যে যাওয়ার আগে, মিউজিয়ামের সামনে দুটো থাম জড়িয়ে আমরা উচ্চৈঃস্বরে কাঁদবো “I want my mummy” বলে। করেওছিলাম। আমার স্বামী তো লজ্জায় অধোবদন। বন্দুকধারী প্রহরীরা কিন্তু শুধু মুচকি হাসলো। ওদের হয়তো এসব ছেলেমানুষি অনেক দেখা আছে।


    গালাবিয়া পরিহিত বন্দুকধারী প্রহরী

    হাসি, গল্প, ইতিহাস সব মিলিয়ে আমার মিশরভ্রমণ একটি অন্যতম স্মৃতি হয়ে থাকবে।



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments