• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • একটুখানি নেপাল : রবিন পাল


    মাছাপুছারে শৃঙ্গ

    নেপাল যাবার ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। কিন্তু বার্দ্ধক্যজনিত সমস্যা, হার্ট সংক্রান্ত সমস্যা, উপযুক্ত সঙ্গীসাথীর অভাবে সেটা হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের আদ্যন্ত সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায় নেপাল যাত্রা কার্যকরী হল ২০২২ এর অক্টোবরের প্রারম্ভে। তবে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ, সাধ্য, সামর্থ অনুযায়ী।

    প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচারে নেপাল সারা পৃথিবীর সমৃদ্ধতম স্থানগুলির অন্যতম, যার ভৌগোলিক অবস্থান অসামান্য। এই দেশটির স্থানগত উচ্চতা ৬০ মি. থেকে ৮,৮৪৮ মি. (মাউন্ট এভারেস্ট) পর্যন্ত। আর পর্বতমালা গড়পড়তা ১৫০ কি.মি.-র মধ্যে, আবহাওয়া সাবট্রপিকাল থেকে আর্কটিক। এখানে বিদ্যমান অবিশ্বাস্য ইকো সিস্টেম এর বৈচিত্র্য, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত সমূহ, আর বন্যপ্রাণীর অবস্থান, গর্জনশীল নদী সমূহ, জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, তুষার আচ্ছাদিত উপত্যকা। হিমালয় পর্বতমালা ২৪০০ কি. মি. দীর্ঘ, ২০০-৩০০ কি. মি. প্রশস্ত; যা স্পর্শ করে আছে নেপাল, তিব্বত, পাকিস্তান। নেপাল হিমালয়ে প্রায় আটটার মতো ৮০০০ মি. উচ্চতাবিশিষ্ট পর্বত আছে যার একটি মাউন্ট এভারেস্ট। নেপাল তার দেশের দরজা বিদেশবাসীর জন্য খুলে দেয় ১৯৫০-এ, তারপর থেকে শৃঙ্গ আরোহণে আগ্রহ বাড়ে। বিশেষজ্ঞ TORU NAKANO হিমালয় অঞ্চলকে ৯টি ভাগে বিভক্ত করে দেখেছেন। আমরা ট্রেকার, ক্লাইম্বার কিছুই নই। ফলে আমাদের গতায়াত পরিধি অনেক সীমাবদ্ধ।

    নেপালে মিত্র সম্প্রদায়ের (ইন্ডো এরিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, টিবেটান গোষ্ঠী) বাস। উচ্চতার তারতম্যে মানুষের অবস্থান। শতকরা ৮০ ভাগ জায়গা পার্বত্য। চাষীদের মধ্যে আছে - ব্রাহ্মণ, ছেত্রী, থারু, যারা নীচু জায়গার বাসিন্দা। পূর্ব নেপালের চাষবাসকারীদের অংশ - রাই লিম্বু গোষ্ঠীর। মধ্য নেপালে আছে - তামাং, গুরুং, মগর গোষ্ঠীর মানুষ। চাষ মুখ্যত রাগি (cereal grain), মিলেট, বার্লি। গুরুং এবং মগররা জল তোলে মহিষ বা ভেড়ার সাহায্যে। উচ্চ পার্বত্যে থাকে শেরপা-রা যারা তিব্বতী বংশ উদ্ভূত। এখানে চাষের জমি কম, আলু ও গম (buck wheat) চাষ হয়। পালিত ইয়াক ও ছাগলরা মাল বহন করে। তাছাড়া তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য। পুরোনো কাল থেকে নেপালী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে কাঠমান্ডু অববাহিকায়। থাকালিরা ব্যবসায়ী, কালী গন্ডকীতে বাস। ধর্ম ও প্রথা স্থান বিশেষে ভিন্ন। নিম্নভূমিতে হিন্দু উচ্চভূমিতে তিব্বতি লামার প্রভাব। তবে হিন্দু ও তিব্বতি ছাড়াও অন্য নানা ধর্ম সংস্কৃতি, নানা পার্বণ দেখা যায়। নববর্ষ / নববর্ষা (এপ্রিলে) (নতুন বছর এপ্রিল থেকে), বৈশাখ পূর্ণিমা (পূর্ণিমা এপ্রিল, মে) বুনগাদিও উৎসব (মার্চ এপ্রিল), রাজার জন্মদিন (২৮ ডিসেম্বর) দাসাঁই (সেপ্টেম্বর, অক্টোবর), ইন্দ্রযাত্রা (আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ৮ দিন), তিহার (কাককে অর্ঘ দিয়ে শুরু।) তারপর কুকুর। চাঁদ উঠলে গরু ও সমৃদ্ধিদেবী পূজা। শিবরাত্রি, ঘোদা যাত্রা (অশ্ব উৎসব) ত্রিভুবন জয়ন্তী (১৮ ফেব্রুয়ারী), মহেন্দ্র জয়ন্তী (রাজা মহেন্দ্র জন্ম উপলক্ষে রাস্তা ঘাট সাজানো, বিশাল প্যারেড)।

    নেপাল যাত্রায়, বিশেষত ট্রেকিং-এ নেপালী, হিন্দি, ব্রাহ্মণ ও ছেত্রীদের ভাষার মিশাল। স্কুলে চলিত- নেপালী ও নেওয়ার শেরপা। শেরপারা পর্বত আরোহীদের সংস্পর্শে ইংরেজি শিখে নেয়। কিছু ভাষাগত নমুনা - নমস্তে (সুপ্রভাত), রামরো আরাম হেস (শুভরাত্রি), ভেত্না পাওডা, জিয়াদাই খুশী চ্ছু (কেমন আছেন), রামরো দিন হাগি (এটি কি সুন্দর আবহাওয়া নয়), চেমাস গার্নোস (মাপ করবেন), কো? (কে আপান), ইয়াহা কো সুভা নাম কে হো? (আপনার নাম কি?), ঠিক চ্ছা (খুব ভালো), স্বাগত চ্ছা (স্বাগত) ইত্যাদি।

    এইখানে বলা যাক নেপাল বহুকালই ছিল স্বাধীন ও গৌরবী ইতিহাসের ধারক। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ যখন জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন তার আগে কাঠমান্ডু উপত্যকা শাসন করত মাল্লা রাজারা। শিল্প সংস্কৃতি চর্চায় এই রাজাদের ভূমিকা ছিল বিপুল। ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দে শাহ বংশধররা ঐক্যবদ্ধ নেপালের সিংহাসনে আরোহণ করেন। নেপালে আধুনিকতা এবং নতুন গণতন্ত্রী সংবিধান চালু হয় ৯ নভেম্বর, ১৯৯০ তে। শার্ক-এর দক্ষিণ এশীয় অংশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। নেপালের এলাকা- ১৪৭,১৮১ বর্গ কিমি, যার উত্তরে চীন এবং দক্ষিণে ভারত। রাজধানী- কাঠমান্ডু, জনসংখ্যা ২৩১১ মিলিয়ন। এদেশে আছে ১০১টি ethnic গোষ্ঠী, ৯২টি কথ্য ভাষা। টাকা প্রচলিত তবে ভারতীয় টাকার সঙ্গে তারতম্য আছে। বিমান পথে নেপালের সঙ্গে বহুদেশের যোগাযোগ আছে। যদি পথ দিয়ে ঢুকতে হয় তাহলে ৭টি পথ আছে- কাঁকরভিটা, বীরগঞ্জ, বেলহিরা, ভৈরা হাওয়া, নেপালগঞ্জ, মহেন্দ্র নগর। ডোমেস্টিক এয়ার লাইনসও আছে।

    কাঠমান্ডু উপত্যকার দুধারে আছে পবিত্র নদী – বাগমতি ও বিষ্ণুমতি। বাগমতি নদীর দক্ষিণে আছে পাটন – যা মন্দিরময় প্রাচীন শহর। পূবদিকে ৬ মাইল দূরে ভাদগাঁও বা ভক্তপুর – যেখানে শত শত গৃহস্থবাড়ি, মন্দির। এসব জায়গায় একদা রাজ পরিবারের লোকরা বাস করত। এখানে যে সব মন্দির তার বাইরেটা কাঠের খোদাইতে সজ্জিত। আছে বিরাট বিরাট সাদা ভিতের স্তূপ, শতশত বৌদ্ধ চৈত্য, ছোটো ছোটো মন্দির, অলঙ্কৃত খিলান, মন্দিরে এক একটি বিগ্রহ। সব মিলিয়ে এক সুসমন্বিত মোজেরিক।

    আমরা হাওড়া থেকে মথুরা এক্সপ্রেসে চেপে রক্সৌল পৌঁছাই। সেখান থেকে গাড়িতে চেপে যাই আঞ্চলিক বিমানবন্দরে (সিমারা এয়ারপোর্ট, বীরগঞ্জ) সেখান থেকে কাঠমান্ডু – গাড়ি চেপে হোটেলে। বিমান ব্যবহৃত হল অনেকটা সময় বাঁচানোর জন্য। হোটেল নেপালালয় এর বৈশিষ্ট্য মনে রাখার মতো। প্রবেশ পথেই বুদ্ধমূর্তি, অব্যাহত ধূপধূনা দেওয়া হয়। রিসেপশনে আছে অনেকগুলি দেওয়াল ঘড়ি যা পৃথিবীর অনেকগুলি দেশের সময় সূচিত করছে। বিভিন্ন দেশের সময় এভাবে জানা যায়। প্রবেশপথে মূল্যবান পাথর খচিত হার, লকেট – বিক্রির জন্য। লাউঞ্জে আমাদের আটজনের দলের বড়োদের ‘খাদান’ (সিল্ক নির্মিত স্কার্ফ) দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। তারপর লিফটে করে নির্দিষ্ট ঘরে ছড়িয়ে পড়া। ঘরের বাইরে ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা। ঘরের ভিতর পরিষ্কার বিছানা, রাতের জন্য লেপ। বসার বিস্তারী সোফা, যা চা ও আহারাদির জন্য ব্যবহৃত হত। আর দুতী বৈশিষ্ট্য ছিল এখানে – প্রথমত রুফটপ রেস্তোঁরা, সেখানে ও সংলগ্ন একটু উঁচু বসার ব্যবস্থা। এ রেস্তোঁরা থেকে তিন পাশের সুউচ্চ স্থানগুলি, শৃঙ্গগুলি দেখা যায়। আমার ভার্টিগো থাকায় ওঠার জন্য সিঁড়িতে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। দ্বিতীয়ত এখানে বেশ কয়েকটি হোটেলেই ঘরভাড়ার সঙ্গে দিন ও রাতের খাওয়া এবং সকালের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হত। খাবারে আলুর পরোটা, ওমলেট বা ডিমসেদ্ধ, মাখন ও জ্যাম, কলা, কখনও কিছু ভাজা। তবে এ হোটেলে বা অন্যত্র মাছ পাইনি। শহরে নানাস্থানে নানা প্রকার মাংসের প্রিপারেশান মিলত। আমর যে অঞ্চলটায় ছিলাম সেখানে উপহার সামগ্রীর, ব্যবহারযোগ্য পোশাক ও অন্যান্য কিছুর আকর্ষণীয় আয়োজন ছিল। তবে নবমী ও দশমীর দুদিনই অধিকাংশ দোকান বন্ধ থাকায় কারো কারো মনে নৈরাশ্য দেখা দিয়েছিল।


    পাটান দরবার

    পরের দিন প্রথমে আমরা যাই পাটন দরবার। এটি ৫ কি. মি. দূরে অবস্থিত একটা প্রাচীন শহর, যা ললিতপুর নামে খ্যাত। ফাইন আর্টসের জায়গা। এখানে আছে অনেক হিন্দু মন্দির এবং কিছু বৌদ্ধ মনুমেন্ট। হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলিত নিদর্শন। এখানে দেখেছি পাটন দরবার স্কোয়ার, পাটন যাদুঘর, কৃষ্ণ মন্দির, মহাবৌদ্ধ, হীরন্য বর্ণ মহাবীর, কুম্ভেশ্বর, জগৎনারায়ণ মন্দির, রুদ্র বর্ন মহাবীর, অশোক চিহ্নিত একাধিক স্তূপ, অচ্ছেশ্বর মহাবিহার, মচ্ছেন্দ্রনাথ ও মীননাথের মন্দির, চিড়িয়াখানা এবং পাটন শিল্প কেন্দ্র। স্থাপত্য সৌন্দর্যের ছড়ানো ভূমিতে একটা বসার জায়গায় বসে বসে সৌন্দর্য সম্ভার এবং মানুষ মানুষীর গতায়াত, ছবি তোলাতুলি দেখতে ভালো লাগছিল। অথচ কোনো গোলমাল নেই।

    এখান থেকে বিকেলে চলে যাই পশুপতিনাথ মন্দির দর্শনে। অনেকটা জায়গা জুড়ে মন্দির ও প্রাঙ্গন। বহুদেশের হিন্দু ভক্ত সমাগমে মন্দির মুখরিত। মূল মন্দির পশুপতিনাথের, কিন্তু তাকে প্রদক্ষিণ করে আরো অনেক অনেক দেব দেবী ছোট ছোট মন্দির। পশুপতিনাথের ঠিক সামনে আছে তামা নির্মিত এক অতিকায় ষাঁড়ের মূর্তি যা মানুষকে মুগ্ধ না করে পারে না।


    কাঠমন্ডু-তে পশুপতিনাথ-এর মন্দির

    পাশেই বাগমতী নদী বয়ে চলছে। অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ ‘মৃগস্থলী অঞ্চলে পশুপতিনাথের মন্দির। অশোক কন্যা চারুমতী নির্মিত। শিবচতুদর্শী কাহিনী এই পশুপতিনাথকে জড়িয়ে। মন্দির চূড়া তামার, তার ওপর সোনার পালিশ, দরজাগুলো রৌপ্যমণ্ডিত। প্রবেশপথে তামার নন্দী। বেদীতে শিবলঙ্গের ওপর চতুর্মুখ পঞ্চানন মূর্তি। ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম এই পঞ্চশক্তির প্রতীক পঞ্চানন। ইনি নেপালের রাজবংশের দেবতা, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। বাগমতীর অপর তীরে গুর্হ্যেশ্বরীর মন্দির যা ৫২ পীঠের একটি। ভেতরে কোনো মূর্তি নেই, কেবল এক কুণ্ড। অন্য দিকে একটি সিঁড়ি যা গিয়েছে গোরক্ষনাথ মন্দির। খৃ. ৮ম শতকের আগে এটি বৌদ্ধ তীর্থস্থান ছিল। মন্দির গঠন শৈলী প্যাগোডা ধর্মী। কেউ কেউ বলেন মন্দিরটি শঙ্করাচার্য স্থাপিত খৃ. ৭৮৮ তে।

    কাঠমান্ডুতে দ্রষ্টব্য- হনুমান ধোকা (পুরোনো রাজবাড়ি) প্রবেশ পথেই কালভৈরব মন্দির, তারপর কুমারী মন্দির, তাছাড়া স্বয়ম্ভু নাথের মন্দির, ৭ কি. মি. দূরে বোধিনাথের মন্দির, ৮ কি. মি. দূরে বুধনীলকন্ঠ মন্দির। আছে দক্ষিণকালী মন্দির।

    টুরিষ্টদের আকৃষ্ট করার নানা দোকান যাতে পাওয়া যাবে খুখুরী (সৈন্যদের ব্যবহারযোগ্য ড্যাগার), নানা মুখোশ, নেপালী টুপি, কার্পেট, জ্যাকেট, মূল্যবান পাথর প্রভৃতি।


    ভক্ত পুর দরবার

    এরপর আমরা যাই ভক্তপুর দর্শনে। এই স্থানটি চার বর্গমাইল ব্যাপী। স্থানটি ভক্তদের নামে চিহ্নিত, এখনও রয়েছে তার মধ্যযুগীয় আকর্ষণ, লোকে আসে এখানের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক সৃষ্টির নৈপুণ্য দেখতে। মল্ল রাজাদের অতীত গৌরব ধরা পড়ে দরবার চত্বরে। পটারি এবং waving প্রসিদ্ধ শিল্পকর্ম। স্থানটি কাঠখোদাই, ঐতিহ্যপূর্ণ টুপি ইত্যাদির জন্য খ্যাত। দেখার বিষয়- দরবার স্কোয়ার, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, ন্যায়টাপোলা মন্দির, ভৈরবনাথ মন্দির, দত্তাত্রেয় মন্দির, দত্তাত্রেয় স্কোয়ার। প্রবল বৃষ্টির কারণে আমার পক্ষে জায়গাটা ভালো করে দেখা হয়নি। একাধিক মিউজিয়াম, অল্প দেখেছি ভিজে ভিজে।


    নাগারকোট

    পরের দিন চলে যাই সুউচ্চ নাগরকোট অঞ্চলে (৭২০০ ফুট) যে হোটেলটিতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তা অতি উত্তম, উপরের অনেকগুলো ঘরই কাচের (উত্তর দিকে) যা দিয়ে সকালে বিভিন্ন শৃঙ্গ ও সূর্যোদয় লোকে মুগ্ধ হয়ে দেখেন ঘন্টার পর ঘন্টা। মুগ্ধ হয়েছি এভারেস্ট, লোৎসে, মানাসলু, চো-ইউ, ল্যাংট্যাং দেখে। মেঘ, আলো, দৃশ্যকে নানা অলৌকিকতায় মণ্ডিত করে। উপভোগ ধ্যান নির্ভর।


    পোখরা থেকে দেখা লামজুং হিমাল

    এবার আমাদের যাত্রা পোখরা-র দিকে। এটি একটি জনপ্রিয় ও সুখ্যাত টুরিস্ট স্থল। চীনা লেখিকা Han Suyin তাঁর ‘The Mountain in young’ বইটির পটভূমি করেছেন এই স্থানটিকে (Bongsor Valley) ভৌগলিক ভাবে নেপালের কেন্দ্র অঞ্চল, অন্নপূর্ণা সন্নিহিত অঞ্চল আবিষ্কার করা যায়। অন্নপূর্ণা স্যাংচুয়ারি, ছাড়া মুস্তাং, দোল্পা, জুমলা, ঘুগু অঞ্চলের রারা হ্রদ পর্যন্ত যাওয়া চলে। খুব কাছ থেকে দেখা যায় অন্নপূর্ণা (৮০৯১ মি.) সংলগ্ন শৃঙ্গগুলি ৫০ কি. মি.-র মধ্যে। মচ্ছপুচ্ছারে (৬৯৯৪ মি.) দাঁড়িয়ে খাড়া, মাত্র ৩০ কি. মি. দূরে। দিগন্তে আছে ১৪০ কি. মি. দূরে ধৌলাগিরি (৮১৬৭ মি.), হিমলচুল্লি (৭৮৯৩ মি.)। হোটেল ছাদ থেকে দেখেছি অন্নপূর্ণা দক্ষিণ, হিমচুল্লি, অন্নপূর্ণা ১,২,৩,৪ লামজুং হিমাল- আর সবই যেন আমাদের কাছাকাছি অনুভব করি।


    ফেওয়া লেক

    পোখরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯০০ মি. উঁচুতে, গাছপালা ভর্তি, বৃষ্টিপ্রবণ। নানা প্রকার গাছ- কলা, কাকতি চান, সরষের খেত। অঞ্চলগুলির মধ্যে দিয়ে সেতী নদী। ছুটি কাটানোর চমৎকৃতি, ছোটখাট অ্যাডভেঞ্চার করা যায়। এখানে দুই সংস্কৃতি- তরাই অঞ্চলে হিন্দু জাতের এবং লামা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি। গুরুং, মগর, ব্রাহ্মণ, ছেত্রী জাতের বাস-- জীবনশৈলী এক প্রকার, তবে নানা ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতির পটভূমি। গভীরতম গর্জ - কালী গণ্ডকী গর্জ। ৮টি হ্রদের অন্যতম ফেওয়া হ্রদ, এছাড়া রূপা ও বেগনাস। মচ্ছপুছারের ক্ষুরধার শৃঙ্গের ফেওয়া হ্রদে প্রতিফলন দেখার মতো। নৌকা বাওয়া প্রিয় বিনোদন। দ্বীপে বরাহী মন্দির হ্রদের মাঝে। জেলেরা লোককে নিয়ে যায়। মহেন্দ্র গুহা প্রাচীন, স্থানীয়রা দেবদেবীর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে। অনতিদূরে গুরুংদের দক্ষিণী সম্প্রদায়ের বাস সিকলিস-এ। এখানে ঝাংকৃ (পুরোহিত) লামা (বৌদ্ধ পুরোহিত) বিয়ে, মৃত্যু, প্রভৃতিতে চালনা করে। ১৯৮০ তে বৃটেনের প্রিন্স চার্লস পরিদর্শনে আসায় (কালিকাস্থান, সিয়াগলুং) রূপা এবং বেগনাস হ্রদ (পূর্বাঞ্চল) আসায় ‘রয়াল ট্রেক’ খ্যাতি। সায়ংকোট, দুর্গপ্রতিম অঞ্চল, নৌদান্দা ও হর্পন উপত্যকার খ্যাতি, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে অন্নপূর্ণা ধৌলাগিরি, মচ্ছপুছরে দর্শন আনন্দের। এর চারপর টেকিং অঞ্চল হিসেবে খ্যাত। একসময় বিস্তর বন্যপ্রাণী ছিল। কাঠমান্ডু থেকে আঞ্চলিক উড়ান ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত বাস সার্ভিসও আছে। আমরা গাড়ি নিয়ে পাড়ি দিই। পথিমধ্যে ধ্বসের প্রভাবে রাস্তা হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক। ফলে পোখরা পৌঁছাতে ৬/৭ ঘন্টা দেরি হয়ে যায়। তাতে দুশ্চিন্তা ও কিছু কিছু অসুবিধা হয়েছিল। আমরা উঠেছিলাম Splendid View হোটেলে। এখানে লিফট, ডাইনিং, রুফ টপ পর্বত দর্শনের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সর্বোপরি এধারে চমৎকার কেনাকাটার দোকান, নানাপ্রকার খাওয়ার দোকান আমাদের ও অন্যান্যদের আগ্রহ বাড়িয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পোখরা যে ইতিমধ্যেই এমন সুসংস্কৃত হয়ে উঠেছে তা আমার ধারণায় ছিল না। পোখরাতে রৌদ্রের প্রখরতা ছিল, কিন্তু রাস্তাঘাটে হাঁটতে বা গাড়িতে যাতায়াতে আনন্দ পেয়েছি।

    ফেওয়া লেক

    এখান থেকে গাড়িতে করে আমরা যাই চিত্ওয়ান। শব্দটির অর্থ - জঙ্গলের অন্তর্দেশ। এখানে আছে জাঙ্গল সাফারি, হাতির পিঠে বা জিপে। আমরা জিপই নিয়েছি। গাইড ছিল। হাতি দেখেছি বিস্তর, দূর থেকে হ্রদের কুমীর দেখা। তবে গন্ডার-ও আছে। হাত্তিবাং থেকে চমৎকার পার্বত্য দৃশ্য দেখা যায়। আছে রাপ্তী নদী। আমাদের বিনোদনের জন্য নাচগান দেখার ব্যবস্থা ছিল। সেটি থরু উপজাতির নাচগান উচ্চকিত অনুষ্ঠান স্থানীয় লোককে বিস্তর আনন্দ দেয়। এ অঞ্চলে প্যারাগ্লাইডিং, র‍্যাফটিং, বার্ড ওয়াচিং এর ব্যবস্থা আছে।

    আমাদের গ্রুপ সে সবের সুযোগ নিতে পারে নি। চিতওয়ান ন্যাশানাল পার্ক বিখ্যাত অঞ্চল যেখানে ৬০০ প্রকার উদ্ভিদ আছে। গন্ডার, বাঘ, ডলফিন, ঘড়িয়াল আছে। ৪৩ প্রকার বড়ো স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫২৬ প্রকার পাখি, ১৫০ প্রকার প্রজাপতি, ৪৯ প্রকার কুমীর আছে। তবে সময় ও ধৈর্যের অভাবে এসব শুধুমাত্র জনশ্রুতি হয়েই রইল।

    এখান থেকে ঘুম জড়ানো চোখে অল্প প্রাতরাশের উপকরণ নিয়ে আমরা যখন জঙ্গলআলয় ত্যাগ করি তখন বেশ ভালো লাগছিল। রকসৌল যাবার এই পথটা ভারী সুন্দর, কারণ শহরের বাড়িঘর, যানবাহন কম। এ সব দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে থামতে থামতে একসময় পৌঁছে গেলাম রকসৌল। সকাল দশটায় ট্রেন। কিছু অপেক্ষা কিছু বিভ্রম এবং প্রত্যাবর্তন শুরু। মন ছিল আনন্দ ও বেদনায় পরিপূর্ণ। তবে এ কথা বুঝেছি নেপাল নামক ভূখণ্ডের খুব সামান্যই দেখা হল। পড়ে রইল বিরাট বিপুল অনাস্বাদিত ভূখণ্ড। আমাদের অনেকেরই, বিশেষত আমার শরীর ছিল ছিল দীর্ঘ পথের, বন্ধুর পথের পক্ষে অনেকটাই প্রতিকূল। আমার পুত্র ও সঙ্গী-সাথীদের নিরন্তর সতর্কতায় ও সুপরিকল্পনায় ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল আনন্দদায়ক। এ বয়সে এতদূর পরিক্রমা করতে পারব তা ভাবতে পারি নি।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ আদিত্য পাল
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments