বাবার কথামত রনি বা পুপুল কেউই খেলনা কেনার জন্যে বায়না করেনি যদিও দোকানে অনেক খেলনা আর বেশ অনেকগুলোই ওদের খুব পছন্দ কিন্তু বাবা যখন বলে দিয়েছেন তখন কথা না শুনলে তো আর কোনদিন দোকানে আসতে পারবে না তাই ওরা চুপ করেই থেকেছে। প্লুটোদার জন্যে খেলনা পছন্দ করে, প্যাক করে, দাম দিয়ে গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে চলল ওরা। পথে হঠাৎ গাড়ির আয়নায় বাবার চোখে পড়ল পিছনের সিটে বসা আট বছরের রনির হাতের খেলনাটার দিকে।
“ওটা কী রনি?”
“কিছু না, একটা খেলনা!”
“কোথা থেকে পেলে?”
রনির মাথা নিচু। পুপুলের বয়স পাঁচ। সে গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই সুযোগেই পকেট থেকে খেলনাটা বার করেছিল রনি।
বাবা আবার একই প্রশ্ন করতে উত্তরে রনি আস্তে আস্তে বলল, “খেলনার দোকানটা থেকে!”
“তুমি কী ওটার জন্যে পয়সা দিয়েছো?”
“নাহ!” বলে মাথা নাড়ল রনি।
“আর আমার তো মনে পড়ছে না আমি ওটার জন্যে পয়সা দিয়েছি বলে! তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে জানো?”
“এটার দাম তো মোটে পাঁচ টাকা!” রনি কাঁচুমাঁচু মুখ করে বলল।
“সে যত দামই হোক পয়সা না দিয়ে বা না বলে অন্যের জিনিস যখন নিয়েছ তখন সেটাকে কী বলে জানো তো?”
রনি তো ভয়ে কাঁটা, মাথা নিচু করে বলল, “চুরি!”
বাবা ওকে আর কিছু বললেন না। বাড়ি ফিরে সোজা ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, “তোমার একটা পয়সা জমানোর ভাঁড় আছে না?”
“হ্যাঁ, রাজা হাতি।”
“ওটাকে নিয়ে এসো। ওটার মধ্যে কত পয়সা জমেছে দেখো।”
রনি মন খারাপ করে রাজা হাতির পেট থেকে সব টাকা পয়সা বার করল। একটা বিশেষ পছন্দের জিনিস কেনার জন্যে পয়সাটা জমাচ্ছিল সে! গুনে দেখা গেল সতেরো টাকা মতন হয়েছে।
“চলো এবার আমার সঙ্গে!”
বাবা আবার রনিকে নিয়ে খেলনার দোকানে চললেন। বাড়িতে মা, ঠাকুমা সবাই জিজ্ঞেস করছিলেন কী হয়েছে কিন্তু বাবা কাউকে কিছু বললেন না।
গাড়িতে বসে বাবা বললেন, “খেলনাটা তো আর ফেরত দেওয়া যাবে না ওটার তো প্যাকেট-ট্যাকেট খুলে দিয়েছ এবার তাহলে তোমাকে ওটার দামটা দিতে হবে।”
রনির মুখ চুন, কানগুলো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ওকে আবার ওই দোকানটায় যেতে হবে?
দোকানের কাছে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই চাইছিল না রনি। বাবা এবার বকলেন, “যাও রনি! তুমি ভুল যখন করেছ তখন শাস্তি তো তোমায় পেতে হবে। আমি নাহয় দোকানটার দরজা পর্যন্ত যাচ্ছি তোমার সঙ্গে!”
কী আর করবে টাকাটা হাতে নিয়ে কাউন্টারে গেল রনি।
কাউন্টারের ভদ্রলোক মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী গো খোকাবাবু? কী চাই?”
“না, মানে ইয়ে...” আমতা আমতা করে রনি বলল, “আমি ভুল করে একটা খেলনা নিয়েছিলাম তাই তার দামটা দিতে চাই!”
“ভুল করে নিয়েছিলে মানে?”
“মানে একটু আগে যখন এসেছিলাম বাবার সঙ্গে প্লুটোদার জন্যে খেলনা কিনতে তখন কাউকে না বলে চুপি চুপি খেলনাটা নিয়েছিলাম কিন্তু বাবা আমাকে বকেছেন। বলেছেন ওই ভাবে নেওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে তাই দামটা আপনাকে দিয়ে সরি বলতে এসেছি,” লজ্জায় প্রায় মাটিতে মিশে যেতে যেতে রনি বলল।
কাউন্টারের ভদ্রলোক বেশ হকচকিয়ে গেলেন মনে হল ওর কথা শুনে। ওনার দোকানে এমনটা বোধহয় আগে কখনও হয়নি।
একটু ভেবে বলেন, “কী খেলনা ছিল বলতে পারবে? সেটা না দেখলে তো আবার দাম নিতে পারব না!”
ভদ্রলোকের স্বরটা খুবই নরম তাই রনির খারাপ লাগা ভাবটা কিছুটা কমল, “লাল মতন একটা প্যাকেটে...”
“কোথায় ছিল দেখাতে পারবে?”
“ওই তো ওই দিকের তাকটায়। এই যে, এই খেলনাটা।”
“আচ্ছা, এটার তো দাম বেশি নয়,” বলে ভদ্রলোক তাক থেকে একটা খেলনা নিয়ে দামটা দেখে রনির কাছ থেকে দামটা নিলেন।
“সরি, আর করব না এই রকম!” রনি লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল।
“ঠিক আছে! এই নাও রশিদ। তোমার বাবাকে বোলো আমি বলেছি উনি তোমাকে দাম দিতে আর সরি বলতে পাঠিয়ে খুব ভাল কাজ করেছেন। তুমি একদিন মানুষের মতন মানুষ হয়ে ওনার মুখ উজ্জ্বল করবে!”
বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। গাড়িতে বসে বাবাকে দোকানের ভদ্রলোকের কথাটা বলতে বাবা অদ্ভুত ধরা গলায় বললেন, “এটা মনে রেখো যে আমি তোমাকে লজ্জায় ফেলবার জন্যে বা অপমানিত হওয়ার জন্যে দামটা দিতে পাঠাইনি, রনি। আমি চেয়েছিলাম এই শিক্ষাটা তোমার পাওয়া উচিত যে অন্যের জিনিস তুমি দাম না দিয়ে বা না বলে কয়ে নিতে পারো না! সবাই যদি ওই রকম করে দোকান থেকে তুলে নেয় জিনিস তাহলে যার দোকান তার কী হবে ভাবো! যদি পাশের বাড়ির মেহুল রোজ এসে চুপি চুপি তোমার একটা করে খেলনা নিয়ে চলে যায় তাহলে?”
##
এতটা বলে থামলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রোফেসার রণেন্দ্র সেন। সীতানাথ শর্মা হাই স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে এসেছেন তিনি। প্রিন্সিপালের অনুরোধে দুটো কথা বলতে উঠে ওই গল্পটা বললেন তিনি। চশমা খুলে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলেন, “তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পারছ যে রনি আর কেউ নয় আমি নিজে! কিন্তু আমার গল্প এখানেই শেষ নয়! কাল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে দোকানে গিয়েছিলাম এবং আমার অজান্তে সে যে কখন একটা খেলনা টুক করে পকেটে পুরেছে আমি টেরই পাইনি। পরে দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম! কিন্তু একবারও ভাবতে হয়নি আমার কী করা উচিত। ছেলেকে তার জমানো পয়সা থেকে টাকা নিয়ে আবার দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি যে শিক্ষা পেয়েছিলাম সেও সেই শিক্ষাই পেয়েছে। আশা করছি আমার মত ওরও সারা জীবন মনে থাকবে ওই শিক্ষা। বই পড়ে পরীক্ষা দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি কিন্তু বাবার দেওয়া ওই অভিনব শিক্ষা সত্যিই আমাকে জীবনের পথে সব চেয়ে বেশি সাহায্য করেছে!”