সংকলনগ্রন্থটিতে মোট বারোটি লেখা রয়েছে। যাঁরা লিখছেন তাঁরা প্রত্যেকেই স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত—তাঁরা পেশায় ও নেশায় অধ্যাপক, গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, দর্শনবিদ, মানবীবিদ্যাচিন্তক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যাভিনয় শিল্পী, খেলোয়াড়, পুরোহিত। এই বই এমন সব অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে যা আদতে সমাজের নানান পরিসরে মেয়েদের লড়াই ও কর্তৃত্ব স্থাপনের যাপনবৃত্তকেই তুলে ধরে। টুকরো টুকরো কথা জুড়ে একটা গোটা সমাজ-ছবি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। অনেক সময়েই এই লেখাগুলির লেখক কোনও একজন হলেও অভিজ্ঞতার সাযুজ্যে তা হয়ে ওঠে আরও পাঁচজনের কথা।
‘একতারাটির একটি তারে’ যে জীবনগান দর্শনের কৃতি অধ্যাপক শেফালী মৈত্রের সরস গদ্যে উঠে এসেছে তার অনেকগুলি পরত রয়েছে। নারীবাদী অধ্যয়ন কীভাবে তাঁর যাপনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায় এই লেখা তার চমৎকার দৃষ্টান্ত হতে পারে। গোটা লেখাটি শেষ করে মনে হয় একজন ব্যক্তির শিক্ষা-কর্ম-গৃহীজীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিটি বাঁকবদল আশ্চর্যভাবে তাঁর সিমন দ্য বোভোয়া পাঠের সঙ্গে মিলে যায়। লেখকের জীবনে লক্ষ্ণৌ পর্বের নানান ঘটনা পাঠকমনে বিস্ময় জাগায়। অন্যদিকে তাঁর লেখায় দুরূহকে মোকাবিলা করবার যে চেষ্টা আমরা দেখি এবং তাঁর কথায় মায়ের চারিত্রিক দৃঢ়তার নানান প্রমাণ পাই তাতে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না মেয়ে মায়েরই উত্তরাধিকার বহন করছে।
অবিভক্ত কমুনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং পার্টির মেয়েদের পত্রিকা ‘ঘরে বাইরে’-র সহসম্পাদক উমা গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অর্থে ‘কোনও মেয়েবেলা ছিল না’। এই লেখায় তিনি এক ‘নতুন ধারার গার্হস্থ্য’ জীবনের কথা বলেছেন যেখানে মেয়েরা (বোলানদের মায়েরা) পারিবারিক সঞ্চিত সম্পদ হারিয়ে বাইরে বেরোতে বাধ্য হচ্ছেন, সমস্ত রক্ষণশীলতা, রান্নাঘর, জাতিভেদ যা কিছু মেয়েদের পিছনে টানে, এক ঝটকায় সেসব কিছুকে সরিয়ে খিদের মুখোমুখি হচ্ছেন, কাজ খুঁজে সংসারের হাল ধরছেন। ১৯৪৮-এ পার্টির বেআইনি ঘোষণা থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড, ফ্যাসিস্ট বিরোধী মঞ্চ থেকে রুশ বিপ্লব, ১৯৬২-এর যুদ্ধ থেকে ১৯৬৪-এর পার্টি ভাগ—এই রাজনৈতিক ইতিহাস অভিজ্ঞতার পরতে পরতে বোলান নিজের রাজনৈতিক অবস্থানটিকেও স্পষ্ট করেছেন।
অধ্যাপক-শিক্ষাবিদ গোপা দত্ত ভৌমিক ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ শুরু করেছেন তাঁর পূর্বমাতৃকাদের কথা দিয়ে। এই লেখা তিন-প্রজন্মের অন্দর-সদরের টানাপোড়েনের সাক্ষী। লেখক সাতটি পর্বে তাঁর জীবনের যে খণ্ডচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে একটি অদৃশ্য সুতো জীবন অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করেছে, সচেতন পাঠক তা টের পাবেন। যে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে তাঁর মা-ঠাকুমা লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন লেখককে সেই ধরনের কোনও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি—একথা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের তরী একসঙ্গে বয়ে নিয়ে চলার কঠিন পরিস্থিতি। এই লেখার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাবার কিছু অনভিপ্রেত প্রতিবন্ধকতা এবং প্রত্যাশিত সাফল্য।
শুক্লা ঘোষের লেখাটি তাঁর বিজ্ঞান-যাপনের কথা তুলে ধরে। বিজ্ঞানচর্চা তাঁর অর্থকরী পেশা মাত্র নয়, তিনি বিজ্ঞানের জন্য বাঁচেন। তাঁর নিবন্ধ থেকে একথা স্পষ্ট তাঁর পূর্ব প্রজন্মের মেয়েরা বিজ্ঞানচর্চাকে জীবনযাপনের অঙ্গ করে তোলার ক্ষেত্রে কী ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর চলার পথও যে সবসময় মসৃণ ছিল তা নয়, তবুও তিনি মনে করেন বিজ্ঞান গবেষণায় মেয়েদের এগিয়ে আসা কতটা দরকারি, নিজে আজও সেই গবেষণা জীবন উপভোগ করে চলেছেন।
মনোবিদ সুবর্ণা সেনের লেখাটির চলন এই সংকলনের বাকি লেখাগুলির থেকে আলাদা। তিনি নিজের কথা সেই অর্থে লেখেননি, লিখেছেন অন্যের মনের কথা। তবে লেখাটি পড়ার পর মনে হয় এই অন্যের কথা বলার মধ্য দিয়েই সুবর্ণা নিজেকে চিনিয়েছেন। কোভিড পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে এই লেখার গুরুত্ব অনেক বেশি। সামাজিক ও সাংসারিক পরিসরে মেয়েদের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষত চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের মধ্যে যে-ধরনের 'psychosomatic disorder' লক্ষ করা যায়—তাকে মোকাবিলা করবার, তা নিয়ে ভাববার পরিসর তৈরি করে দেয় লেখাটি।
দেবশ্রী ঘোষ মূলত গবেষণা জীবনকেই তাঁর নাতিদীর্ঘ লেখার মূল উপজীব্য করে তুলেছেন। তিনি তাত্ত্বিক রসায়নের চর্চা করেন। দেশে-বিদেশে একজন বিজ্ঞান গবেষককে কর্মক্ষেত্রে যে ওঠা-পড়ার সম্মুখীন হতে হয় দেবশ্রীও সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন, নিজের লক্ষ্য পূরণে অবিচল থেকেছেন। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানাচ্ছেন সাফল্য অর্জন করতে মেয়েদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় যা বাস্তবিকক্ষেত্রে বেশ কঠিন।
অর্থনীতির অধ্যাপক স্বাতী ঘোষ চার সদস্যের পরিবারকথা (চার প্রজন্মের তিনজন মেয়ে ও তাঁদের একজনের ছোট ছেলে) শুনিয়েছেন, যদিও শেষ অবধি লেখাটি পরিবার কথায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর পরিচিত বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের ‘ঘর’ ও ‘বার’ সামলানোর নানান অভিজ্ঞতা আসলে চারপাশের মানুষজনকে চেনার একটি উপায়ও বটে। ‘বাসা’ কথাটির মধ্যেই ‘বদল’-এর ইঙ্গিতটুকু থেকে যায়, আর যখন সেই ‘বাসা’ হয় ‘পুরুষ অভিভাবকহীন’ তার কথা লিখতে গেলে অনেক প্রসঙ্গই চলে আসে।
নন্দিনী ভৌমিক তাঁর লেখায় একদিকে চার প্রজন্মের কথা লিখেছেন, অন্যদিকে এই লেখা থেকে নন্দিনীর অধ্যাপনা জীবন, অভিনয় জীবন এবং পৌরোহিত্যের কাজের অভিজ্ঞতার কথাও পাব। শহরের নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখার পরেও রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে ওঠার নানা শর্ত তাঁর জীবনযাত্রাকে কিছু দূর নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে এসব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে তাঁর শ্বশুরবাড়ির ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিয়মের নিয়ন্ত্রণ’ ও তাকে জয় করবার অদম্য প্রাণশক্তির প্রকাশ্য উপস্থিতি। বর্তমানে সামাজিক গণমাধ্যম তাঁর পৌরোহিত্য (‘মহিলা পুরোহিত’ কথাটি এই সূত্রেই চালু হয়েছে, যদিও এই অভিধাটি বিবেচক পাঠকমাত্র বিচার করে গ্রহণ বা বর্জন করবেন) প্রসঙ্গে নানান ইতিবাচক খবরাখবর প্রকাশ করেছে। এর সূত্রপাত অনেক আগেই; সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গভেদে পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়া এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কাজটি যে যথেষ্ট কঠিন তা এই লেখা পড়ে আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
বিজয়লক্ষ্মী বর্মণের কাছে নাটক-যাপন ও জীবনযাপন সমার্থক। তাঁর পূর্বমাতৃকারা কেউ তেমন লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। তিনি নিজে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তাঁর মায়ের উৎসাহে। শ্বশুরবাড়িতে মূলত তাঁর স্বামীর তত্ত্বাবধানে মঞ্চাভিনয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ, যদিও মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া হয়েছিল পারিপার্শ্বিক কারণে। তবে থিয়েটারের প্রতি আশ্চর্য টান তাঁকে চলার পথের নানান প্রতিকূলতাকে জয় করতে শিখিয়েছে।
অনেক না-পাওয়া, অনেক নিরাশা, জীবনযুদ্ধে নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হওয়ার পরেও যে কাজ করে যেতে হয়, মানসিকভাবে সমর্থ হতে হয়, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়, সর্বোপরি আশাকে টিঁকিয়ে রাখতে হয়—এই নাছোড় মানসিকতা গবেষক এবং সাহিত্যিক স্বাতী গুহের লেখার প্রাণ। নানান কাজের অভিজ্ঞতা ও পারিবারিক পরিস্থিতি তাঁকে প্রকৃত অর্থেই স্বাবলম্বী করে তুলেছে। চলার পথে যাঁদের নিঃশর্ত সহায়তা তিনি পেয়েছেন, এই লেখার অনেকটা জুড়ে তাঁরাও রয়েছেন।
এই সংকলনের যে লেখাটি পড়ে মনে হয়েছে এই বইয়ের নামে যে মেয়েরা আছেন তাঁদের মধ্যে সবচাইতে লড়াকু বোধহয় তিনিই যিনি ‘মেয়েবেলা’-র দাবিদাওয়াকে তুচ্ছ করে, প্রবল পরিশ্রম ও অদম্য সাহসিকতায় ভর করে খেলোয়াড় জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন—কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার। এই সংকলন গ্রন্থে অধ্যাপক-গবেষকদের পাল্লা ভারী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা অভিনয় শিল্পীরাও অবশ্য রয়েছেন। তবে অনেকাংশেই ব্যতিক্রমী একজন খেলোয়াড়ের তৈরি হয়ে ওঠার ইতিহাস ‘খেলাই জীবন’ যা শেষ হচ্ছে এই শপথ নিয়ে—ফুটবল কুন্তলাকে অনেক কিছু দিয়েছে, যতদিন বাঁচবেন ফুটবলের জন্য কর্তব্য পালন করবেন, তাঁর আজন্ম ঋণ এই ফুটবলের কাছেই। ফুটবল নিয়ে, বাঙালির ফুটবল খেলা নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে; অনেক বইপত্রও লেখা হয়েছে। ফুটবলারকে (অবশ্যই পুরুষ) নিয়ে বায়োপিক তৈরি হয়েছে, তবে এই সবকিছুর কেন্দ্রে সক্রিয় থেকেছে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ। বাঙালি মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে, তাঁদের লড়াই নিয়ে আরও কাজ হোক—এই লেখাটি পড়ার পরে একজন পাঠক হিসেবে এইটুকুই চাওয়া।
এই সংকলনের শেষ লেখাটি এই বইয়ের সবচেয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ। কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার নকশালবাড়ি’-কে আমরা সামাজিক দলিল হিসেবে পড়তে পারি। সম্পাদক যথার্থভাবে জানাচ্ছেন, এই লেখাটির চলন বাকি লেখাগুলির থেকে খানিক আলাদা, কথা বলার ধরতাইটা না-ভেঙেই লেখাটি এগিয়েছে। কৃষ্ণার রাজনীতির জীবন ও কারাবাস-জীবন একটি বিশেষ সময়ের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আস্থা-অনাস্থা, গ্রহণ-প্রত্যাখ্যান ও প্রাপ্তি-বঞ্চনার ইতিবৃত্তকে তুলে ধরে। এই আত্মকথার সংকলন মেয়েদের ঘর-বারের লড়াই, সম্পর্কের নানান সুর-বেসুর, কর্মজীবনের আনুকূল্য-প্রতিকূলতার সাক্ষী—এটিই এই বইয়ের সবচাইতে জোরের দিক। এই সংকলনের ত্রুটির দিক যদি কিছু থাকে, তা স্বয়ং সম্পাদকই বইয়ের শুরুতে জানিয়েছেন। তাঁর এই বইভাবনাকে কুর্ণিশ জানাই।