সফল মানুষ তথা সফল নাগরিক তৈরি করার পিছনে শিক্ষাব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। অধুনা বাঙালি সমাজের ভিতর অবধি যে তিনটে অসুখ ঢুকে পড়েছে – নৈতিক অবক্ষয়, স্বাধীন চিন্তার অভাব এবং মেরুদণ্ডহীনতা – তার পিছনে এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা কী ভূমিকা পালন করছে, সেটা খতিয়ে দেখাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। একজন বাচ্চার জীবনে শিক্ষা মূলত দ্বিবিধ: পরিবার, পারিপার্শ্বিক, গুরুজন – অর্থাৎ সমাজ থেকে গ্রহণ করা শিক্ষা, আর পোশাকিভাবে স্কুলে গিয়ে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যসূচি থেকে গ্রহণ করা শিক্ষা। এই দু'ধরনের শিক্ষাই বাঙালি ছেলেমেয়েদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তাদের সফল ভবিষ্যৎ গড়তে কতটা সাহায্য করছে, তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। স্কুলের পাঠ্যসূচি কেন অবান্তর হয়ে পড়ছে, এবং সেখানে কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন সেই বিষয়েও কিছু মতামত দেওয়া হয়েছে। বিষয়টা গভীর এবং সামগ্রিক। কিন্তু এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে এর চেয়ে বিশদ আলোচনা, বা বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় বাংলা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা বিচার করা সম্ভব হল না। যেটুকু প্রাসঙ্গিক মনে হল বিদ্বৎসমাজের সামনে তুলে ধরলাম। উচিত মনে করলে তাঁরা আলোচনাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
প্রবন্ধটা যাঁরা সময় বের করে পড়ছেন তাঁরা বাংলা ভাষার সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত। তাই শিরোনামটা পড়েই হয়তো বিরক্ত হয়েছেন, বা ঠোঁট টিপে হেসেছেন। কবিগুরুর 'শিক্ষা' নামক প্রবন্ধগুচ্ছ কে না পড়েছে? কিন্তু তিনি শিক্ষাগুরু। তাঁর এই বিষয় নিয়ে লেখাটা মানায়। তা বলে যে কোন চুনোপুঁটি একই শিরোনাম দিয়ে লিখতে শুরু করবে?
তবু নামটা বদলাব না। চুনোপুঁটি হই আর যাই হই, কাউকে তো ভাবতে হবে। শিক্ষাগুরু চলে গেছেন আজ থেকে বিরাশি বছর আগে। তারপর থেকে গোটা বাংলায় শিক্ষা নিয়ে কতটা চিন্তাভাবনা হয়েছে তা তর্কসাপেক্ষ।
এই অবধি পড়ে আবার অনেকে ভাববেন, সমস্যাটা কী? শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন কেন পড়ল? এমনি করে যায় যদি দিন যাক না। তার উত্তরে একটা গল্প বলি। কিছুদিন আগে অটোয় বসেছিলাম। পিছনের সীট ভর্তি, সামনে একটা সীট খালি আছে। একজন গর্ভবতী মহিলা অটোর সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছেন, উঠবেন কি না বুঝতে পারছেন না। আমার পাশেই বছর পঞ্চান্নর এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। এবং বসেই রইলেন। নিজের সীট ছেড়ে সামনে গেলেন না। আমার তখন মনে হল, এঁর জায়গায় যদি এঁর আগের প্রজন্মের কেউ থাকতেন, তাঁদের শিক্ষা সহবৎ এই উদাসীনতার অনুমতি দিত না। হয়তো আশি বছর বয়সেও নিজের আসনটা ছেড়ে সামনের সীটে চলে যেতেন।
সত্যিটা হল, বাংলা আর সেই বাংলা নেই। ধুতি আর ধবধবে পাঞ্জাবি পরা সেই 'ভদ্রলোক বাঙালি' আজ আর নেই। তাঁরা ছিলেন সৎ এবং অল্পে সন্তুষ্ট। পরোপকারী। মিষ্টভাষী। কোন বিষয়ে এক্সপার্ট নন, অথচ সাহিত্যচর্চা থেকে রেডিও সারানো, সব বিষয়েই অল্প জ্ঞান ছিল। চিন্তাশীল এবং মননশীল, ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড।
এখনকার বাঙালির পরিচয় পাওয়া যায় অটোয় বসা ওই ভদ্রলোকের অনিচ্ছায়, বসের কল পাওয়ামাত্র (কাজে বিন্দুমাত্র অনুরাগ না থাকা সত্ত্বেও) শুধুমাত্র উপরওয়ালার ছড়ির ভয়ে রবিবার দুপুরে শার্ট গলিয়ে অফিসে ছোটা যুবক-যুবতীর কাপুরুষতায়, 'পথের পাঁচালী' উপহার দিলে “ও গড, অত বাংলা কে পড়বে” বলা তরুণ-তরুণীর নির্লজ্জ হাসিতে, অধ্যক্ষার হাতে চড় খেয়ে নির্বিকার থাকা শিক্ষিকার নীরবতায় (বেহালার এক নামী মহিলা কলেজের ঘটনা), আর বাংলার বিভিন্ন চ্যানেলে ছড়ানো নিম্ন মানের সস্তা বিনোদনে (টেলিভিশনের পর্দায় আমরা এর আগে তের পার্বণ, সেই সময় বা চরিত্রহীনের মতো ধারাবাহিক পেয়েছি, কিন্তু এখন নাকি 'কোয়ালিটি কনটেন্ট'-এর কোন দর্শক নেই)। বাঙালির অধঃপতন অনস্বীকার্য, এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ না করতে পারলে এই অধঃপতন চলতেই থাকবে। চিন্তাভাবনা করাটা তাই জরুরি।
আমাদের এক অধ্যাপক “শিক্ষা” গ্রন্থের “অসন্তোষের কারণ” প্রবন্ধটা পড়ানোর সময়ে বলেছিলেন, মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের শিক্ষিত করার জন্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল মুষ্টিমেয় করণিক তৈরি করা, যারা প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিদেশী সরকারের কায়েমি স্বার্থকে বজায় রেখে চলবে। সত্যি বলুন তো, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি এর থেকে আলাদা কিছু করতে পেরেছে? এবং সেই অসাফল্যের সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদেরই কিছু অদ্ভুত আচরণ।
একজন প্রকৃত মানুষ তথা সফল নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য প্রথমেই দরকার নিজের স্বাধীন চিন্তাভাবনা, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। কিন্তু এদেশে তা কী করে সম্ভব? পিতৃ দেবো ভব, মাতৃ দেবো ভব, আচার্য দেবো ভব। বাবা, মা, শিক্ষক/শিক্ষিকা এই তিন দেবতার ত্রিভুজ আক্রমণে অধিকাংশ বাচ্চার নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি (অথরিটি ফিগার) মনে করেন তাঁদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে যখন তখন বাচ্চাকে চড়, থাপ্পড় মারার বা অপমান, গালিগালাজ করার। আর সেসব অত্যাচার নিঃশব্দে হজম করে যাওয়াই 'গুড বয়' 'গুড গার্ল' এর আদর্শ লক্ষণ। ব্যতিক্রমী হলে, স্বাধীন চিন্তা, মতামত, ইচ্ছা অনিচ্ছা বেরিয়ে পড়লেই আরো পেটাও। ছোটবেলায় আমরা হাসাহাসি করতাম (রুচির অভাব ক্ষমা করবেন, ক্লাস সেভেন এইটে খুব একটা রুচিশীল কৌতুক চলে না) ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা তাঁর ছোটবেলায় মারা গেছিলেন। নইলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিইয়ে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে ঢুকিয়ে দিতেন, কবিতা লিখে আর নোবেল আনতে হোত না। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের স্বাধীন চিন্তা এমনকি মনুষ্যত্ববোধটুকুও নষ্ট করে দেওয়ার পর চাকরির জগতে যখন বস বা অধ্যক্ষা অধস্তন কর্মচারীর সঙ্গে কোন অন্যায় করেন, তখন যে তারা সেটা মাথা নীচু করে মেনে নেবে, বরং কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে সমর্থন করার বদলে সেই সুযোগে কর্তৃপক্ষকে আরো একটু তৈলমর্দন করে তার প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করবে, সে আর আশ্চর্য কী? প্রশ্নহীন আনুগত্য আর অপমান সহ্য করা ততদিনে যে তাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে শুধু তাই নয়, তাদের কাছে শ্লাঘনীয়ও বটে – ‘গুড বয়'/'গুড গার্ল' এর পরিচায়ক। পড়াশোনা করার পরেও শিক্ষিত আর ক'জন হতে পেরেছে?
এ কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে বাচ্চাদের জীবনে অনুশাসনের প্রয়োজনীয়তা নেই, বা তাদের উচ্ছৃঙ্খল হতে দিতে হবে। অবশ্যই মা বাবা, শিক্ষক শিক্ষিকারা অনুশাসন শেখাবেন, কিন্তু সেটা বাচ্চাদের মানুষের সম্মান দিয়েও করা যায়। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে তারা নিজের দোষের কারণে শাস্তি পাচ্ছে, সামনের জন তাদের থেকে বেশি বলশালী (আক্ষরিক এবং রূপক অর্থে) এই কারণে নয়। তাদের শেখানো যায় যে কাউকে অপমান করার অধিকার কারুর নেই, বা কারুর সাংবিধানিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া যায় না।
কিন্তু এটা হলেই তো মুশকিল। রকাফেলার বলেছিলেন, “I don’t want a nation of thinkers. I want a nation of workers.” সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি রাতারাতি চিনির বলদ থেকে দার্শনিক হয়ে ওঠে, নিজের ন্যায্য অধিকারগুলো চেয়ে বসে, তাতে সরকার থেকে শিল্পপতি কারুরই সুবিধা হবে না। কাজেই সেটা বন্ধ করার তালিম ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায়। এখানে আমাদের স্কুলগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
স্কুলে আমাদের অপ্রাসঙ্গিক বিষয় শেখানো হয় বেশি, আর প্রাসঙ্গিক বিষয় সিলেবাস থেকে বাদ চলে যায়। ইতিহাস আমরা সবাই পড়েছি। কিন্তু অশোক কোন সালে সম্রাট হয়েছিলেন, বা কলাম্বাস কতগুলো জাহাজ নিয়ে ভারত আবিষ্কার করতে বেরিয়েছিলেন, স্কুল ছাড়ার পরে সেই জ্ঞান আমার কোন কাজে লাগেনি। হলফ করে বলতে পারি ভবিষ্যতেও কোন কাজে লাগবে না। বরং 'বড়' হওয়ার পরে জেনে স্তম্ভিত হয়েছি, ইউরোপীয়রা আমেরিকায় পৌঁছে ওখানকার নেটিভ আমেরিকানদের কী হাল করেছিল, কী হারে এথনিক ক্লেন্সিং হয়েছিল, কতগুলো বাইসন শিকার করা হয়েছিল – অর্থাৎ বলবান বিদেশী গোষ্ঠী দেশের মাটিতে পা রাখার ফল কী হয়েছে। অথচ এসব কথা ইতিহাসের কোন পাঠ্য বইতে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে কীভাবে প্রাসঙ্গিক তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বরং কোন্ সামাজিক পরস্থিতিতে হিটলারের মতো স্বৈরাচারী নেতার উত্থান হয় এবং সমাজ কেন তাদের সমর্থন করে নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে আনে, সেই সন্ধান পেলে কিছু লাভ হতে পারে। মামাল্লাপুরমের স্থাপত্যশৈলীর ওপর লেখা টীকার খাতা সের দরে বিক্রি হয়ে গেছে (অবশ্যই, কারুর যদি সেই বিষয়ে পড়ার উৎসাহ থাকে তাহলে পরবর্তীকালে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া যেতেই পারে। আর শখের কৌতূহল মেটানোর জন্য ইন্টারনেট-গুগল তো আছেই)। কথিত যে ইতিহাস পড়ার প্রয়োজন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। পানিপতের যুদ্ধের নিখুঁত বিবরণ বা আকবরের মনসবদারী ব্যবস্থার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কেউ যদি কোন শিক্ষা পেয়ে থাকেন তাহলে কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন। পড়ার উৎসাহ রইল। এখন আবার শুনছি পুরো মুঘল ইতিহাসই নাকি সিলেবাস থেকে বাদ যাবে। নতুন কিছু নয় সেটা। মিশরের রানী হাটশেপসুটের সমস্ত চিহ্ন তাঁর সৎ ছেলে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। আরো অনেক রাজকাহিনীই বিরোধীপক্ষ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে বহুবার। ইতিহাস তবু নিজের পথ খুঁজে নেয়, আত্মপ্রকাশ করে যেখানে সেখানে, অপ্রত্যাশিতভাবে। এই কথাটাও কিন্তু স্কুলে শিখিনি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ইতিহাসকে যদি সালতারিখ আর তথ্যের প্রাচুর্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করে রাখা হয় তবে তা শুধুমাত্র মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসারই বিষয় হয়ে থাকবে। যদি ছাত্র ছাত্রীদের ইতিহাস থেকে জ্ঞানলাভ করানোর উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তথ্যের উপর জোর না দিয়ে তার আড়ালে থাকা তত্ত্ব (প্যাটার্ন) কে উজাগর করতে হবে, বিশিষ্টের মধ্যে অন্তর্লীন থাকা শাশ্বতকে তুলে ধরতে হবে।
ভাবতে পারেন ইতিহাসের ওপর রাগ আছে বলে এসব কথা বলছি। তাহলে ভূগোলের প্রসঙ্গে আসা যাক। পৃথিবীতে কত ধরনের মাটি বা প্রস্তর আছে, ভারতের কোন কোনায় কোন ধাতু পাওয়া যায়, কত মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, এসব খুঁটিয়ে জানা কি প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের পক্ষে অত্যন্ত আবশ্যক? মোটের উপর বিভিন্ন দেশ, তাদের রাজধানীর নাম, উল্লেখযোগ্য নদী পর্বতমালা ইত্যাদি, আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের নাম, অবস্থান, ভাষা, সেখানকার মানুষের জীবনশৈলি ইত্যাদি পড়ালেই ছাত্র ছাত্রীরা একটা কাজ চালানোর মতো ভৌগোলিক জ্ঞান পেয়ে যাবে না কি? আবার বলছি, যাদের কৃষিবিদ্যা বা ভূতত্ত্ব নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে, গবেষণা করার ইচ্ছে আছে, তারা স্কুল বা কলেজে স্পেশাল পেপার নিয়ে পড়তেই পারে। তাতে সমাজ উপকৃতই হবে।
আসলে সবরকম জ্ঞানই মূল্যবান, কোন বিষয়কেই ছোট করে দেখানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মানুষের পক্ষে স্বল্প জীবনে সবরকম বিষয় রপ্ত করা সম্ভব নয়। স্কুলের সিলেবাস এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে একটা প্রজন্ম চিন্তাশীল এবং প্রগতিশীল হয়, যারা ভবিষ্যতে সমাজের ভিত মজবুত করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যেসব বিষয়গুলো নিয়ে সকলেরই কিছু কিঞ্চিত জানা আবশ্যক সেগুলো স্কুলে শেখানো হচ্ছে না, এবং যে বিষয়গুলো পরবর্তীকালে মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষের কাজে লাগবে, সেগুলো খুব জোর দিয়ে পড়ানো হচ্ছে। বহু ছাত্রছাত্রী স্কুল কলেজের পাট চুকিয়ে শিল্পী, ব্যাংক ম্যানেজার, দোকানের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আর্টস বা কমার্স বিভাগের অধ্যাপক/পিকা ইত্যাদি বিভিন্ন জীবিকা অবলম্বন করবে। চার্লস বা বয়েল সাহেবের আইন না জানলেও তাদের কোন ক্ষতির আশংকা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ইনফোসিস বা টাটা কনসালটেনসির যে ইঞ্জিনিয়ারটি নীতিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান বা ভারতীয় সংবিধানের কিছুমাত্র না জেনে চাকরিতে ঢুকে গেল, সে ভবিষ্যতে কেমন নাগরিক হবে বা তার পরের প্রজন্মকে কী শিক্ষা দেবে সেকথা কেউ ভেবে দেখেছেন? এই কারণে আমার মতে স্কুলের সিলেবাস বদলে ষষ্ঠ শ্রেণির উপরে সব শিক্ষার্থীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান দেওয়া দরকার –
১. রাষ্ট্রবিজ্ঞান (পলিটিকাল সায়েন্স)। খুব গভীরে না গেলেও দেশ বিদেশের কর্মপন্থা, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা রাখতে গেলে এই বিষয়ে একটা প্রাথমিক জ্ঞান থাকা খুব জরুরি।
২. সমাজবিজ্ঞান (সোশিওলজি)। গভীর জ্ঞানের দরকার নেই কিন্তু সমাজ সম্পর্কে ধারণা, সে বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারা, ফেমিনিজম, দলিতগোষ্ঠীর চিন্তাধারা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান সকলের থাকা দরকার বলে মনে হয়।
৩. নীতিবিদ্যা (এথিকস) যা সঠিক মূল্যবোধ গঠন করার জন্য কিশোর বয়স থেকেই শেখা প্রয়োজন।
৪. ভারতীয় সংবিধান এবং আইনকানুনের একটা প্রাথমিক জ্ঞান, যাতে সবাই নিজের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে।
৫. দর্শনশাস্ত্রের (ফিলোসোফি) প্রাথমিক জ্ঞান যাতে কৈশোর থেকেই মানুষ ভাবতে শেখে, সত্যের বিভিন্ন দিক চিনতে শেখে।
৬. ভারতের প্রধান ধর্মগুলি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান। এটা কিন্তু অসাংবিধানিক নয়। আমাদের দেশ সেকুলার হলেও, সেই সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা হয়েছে 'ধর্মবর্জিত' হিসেবে নয়, বরং সব ধর্মকে সমান মান্যতা দান করা হিসেবে। আমরা যাকে বুঝি না, তার প্রতি অসহিষ্ণু হই। শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি সুন্দরভাবে, পক্ষপাতিত্ব না করে, সসম্মানে বিভিন্ন ধর্মের সার কথাটা তুলে ধরেন ছাত্র-ছাত্রীদের তাতে উপকার হবে বলেই মনে হয়। তাদের ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে না, ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হলেও চলবে। কিন্তু সমাজে ধর্মের অস্তিত্বকে তো অস্বীকার করা যায় না। তাই জ্ঞানটুকু থাকা প্রয়োজন।
এ ছাড়া পরিবেশ এবং পশুপাখিদের যত্ন ইত্যাদি বিষয়েও সামান্য জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিষয়গুলির পাঠ্যসূচি তৈরি করার জন্য বিশারদ এবং শিক্ষাবিদদের যৌথ পরামর্শ নেওয়া দরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে এইসব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া বা নম্বর দেওয়ার দরকার নেই। নাহলে ব্যাঙের ছাতার মতো 'মিলনদার কোচিং' জাতীয় আখড়া খুলে গিয়ে 'সাজেশান' এবং 'বাছাই প্রশ্নের' উত্তর বিলি করা শুরু হয়ে যাবে। তাতে এসব বিষয় শেখানোর উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে। বরং ক্লাসে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষক/শিক্ষিকারাই ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান জরিপ করে নিতে পারেন। এর পরিবর্তে ইতিহাস-ভূগোল বা বিজ্ঞান থেকে কিছুটা চাপও কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্নটা হল, সরকার এইসব বিষয়গুলো সিলেবাসের তালিকাভুক্ত করতে চাইবে কি? কারণ যে-কোন সরকারের শিরদাঁড়া যেসব ধনকুবের শিল্পপতিরা, তাঁরা ঘোষণা করেছেন, “I don’t want a nation of thinkers. I want a nation of workers.” (এই প্রবন্ধে কোন বিশেষ সরকারের দিকে নির্দেশ করা হচ্ছে না। যে কোন দেশের যে কোন সরকারের সঙ্গে শিল্পপতিদের আঁতাত চিরাচরিত সত্য। সরকার চালানোর জন্য এই মেলবন্ধন খানিকটা প্রয়োজনীয়ও বটে।)
বিষয়গুলো অর্থকরী নয়, তাই অভিভাবকদেরও এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা থাকবে বলে মনে হয় না। ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের উদাসীনতা থেকেই সেটা বোঝা যায়। “বাংলা পড়ে সময় নষ্ট করে কী হবে, সায়েন্সটা পড়!” কেউ মুখে বলেন, কেউ বলেন না। কিন্তু সন্তান যখন বলে “বাংলাটা আমার ঠিক আসে না,” (হিন্দিভাষীর কাছে শোনা “নহী আতা”র অনুবাদ) তখন তাঁদের গর্বিত মুখ দেখেই মনের ভাব বোঝা যায়। বিলেতে থাকা কোন ইংরেজকে কিন্তু এক অক্ষর ইংরেজি না পড়তে পারার জন্য এভাবে গর্বিত হতে দেখিনি।
ভাষাচর্চার তো এই হাল, অথচ হাতের লেখা নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। আবার প্রশ্ন তুলি, যাঁদের হাতের লেখা ভালো, মুক্ত ঝরছে, ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজ করা ছাড়া জীবনের কোন ক্ষেত্রে সেই গুণ কোন কাজে লাগাতে পেরেছেন কি? বরং প্রথম থেকে বাচ্চাদের কম্পিউটার ব্যবহার করালে টাইপিং স্পীড বাড়তে পারে, এক্সএল শীট নিয়ে কাজ করা সড়গড় হবে। সরকারি বা কম বেতনের স্কুলে টাকা দিয়ে অত কম্পিউটার আনা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু কোলকাতার নামীদামি স্কুলগুলো তো যথেষ্ট মাইনে নিচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাতিরে এটুকু ব্যবস্থা করা যায় না কি?
এত অবধি যাঁরা ধৈর্য ধরে পড়লেন, তাঁরা হয়তো ভাবছেন, লেখিকা সামান্য আইনজীবী। সমাজবিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদ কোনটাই নয়। তাহলে কীসের ভিত্তিতে এতগুলো কথা লিখে ফেলল? আসলে নিজের এবং অনেক ছাত্র ছাত্রীদের উপলব্ধির ভিত্তিতে কথাগুলো লেখা। সবার কাছে গ্রাহ্য না-ই হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে চিন্তাধারার একটা পরিবর্তন আনা যে দরকার সেটা অনস্বীকার্য। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ দিয়ে যদি সেটা শুরু হয়, হোক না। এখান থেকেই না হয় বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
শেষ করার আগে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষকে, বিশেষত দামি বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষদের কাছে একটা নিবেদন রাখছি। যদি এখনো না করে থাকেন, প্রত্যেক ছাত্র/ছাত্রীর জন্যে একটা আলাদা চেয়ারের ব্যবস্থা করুন – যেমন বিদেশে থাকে। আমার মনে আছে, ক্লাস এইট-নাইনে আমরা বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম। তিনজন মিলে একটা ক্ষুদ্র বেঞ্চে বসতে খুবই কষ্ট হত। তাছাড়া, অনেক অন্তর্মুখী বাচ্চারা অন্যের গা ঘেঁষে বসতে পছন্দ করে না। আলাদা বেঞ্চে বসলে ছোটবেলা থেকে পার্সোনাল স্পেসের ধারণাও তৈরি হবে। ব্যবসার চিন্তা ছেড়ে শিক্ষাদান নামক যে মহতী ব্রতে নেমেছেন, তা নিয়ে এবার একটু ভাবনাচিন্তা শুরু করুলে সবাই উপকৃত হবে।