শিল্পের এলাকায় সংকীর্ণতার গণ্ডি তাঁর পছন্দ নয়, তিনি বদ্ধদশা ভাঙতে চাইছিলেন। বিনোদবিহারীর মতো, রামকিঙ্করের মতো তরুণ শিল্পীরা নতুন আলোর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি তাঁর নিজের ভেতরেও চলছিল এক আয়োজন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে মীরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘চিত্রবিদ্যা তো আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হত তাহলে একবার দেখাতুম আমি কি করতে পারতুম’। রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ক্ষেত্রে খুব একটা আকস্মিকতা ছিল না। কারণ জানা যায়, ‘সন্ধ্যাসংগীত’এর কবিতা রচনার পাশাপাশি খুব নিষ্ঠা ভরে কিছু স্কেচ করেছিলেন। ১৮৮০-৮৬ এর মধ্যে এরকম ৭টি স্কেচ রয়েছে ইন্দ্রকিশোর কেজরিওয়ালের সংগ্রহে। সুতরাং এই চর্চা ধারাবাহিকভাবে এগোয়নি ঠিক কথা, কিন্তু রেখায় রেখায় রূপবৈচিত্র্য ফোটানোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন নিজের অন্তরে। চিত্রকলায় বাঁধাধরা শিক্ষা না থাকায় রবীন্দ্রনাথ প্রথমে সাদৃশ্য-নির্ভর, বাস্তব ঘেঁষা রূপ সৃষ্টির দিকে যাননি, হাতের লেখায় ক্যালিগ্রাফিক নির্ভর বিমূর্ত, অবিচ্ছিন্ন রূপকলার দিকে ঝুঁকেছিলেন। ক্যালিগ্রাফিই (Calligraphy) রবীন্দ্রনাথের ছবির আঙ্গিকের প্রাথমিক উৎস। ক্যালিগ্রাফিক অলংকরণ এবং ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে সম্পর্কহীন ত্রিমাত্রিক রূপ—এই দুটি পৃথক আঙ্গিক ‘পূরবী’র পাণ্ডুলিপিতে একই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে।
শিল্পতাত্ত্বিক সত্যজিৎ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের ছবির গভীর পর্যালোচনা করেছেন এই গ্রন্থে। গ্রন্থটি সমৃদ্ধ হয়েছে ছটি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি নিবন্ধে। তাঁর প্রয়াণের পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় বিজলি সরকারের সুসম্পাদনায়। প্রবল অনুসন্ধিৎসায় অধ্যাপক সত্যজিৎ চৌধুরী চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথের অবদানকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন নিবন্ধে ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাস থেকে উনিশ-বিশ শতকের শিল্পীদের চিত্রশৈলীর বা চিত্রনির্মাণের অভিমুখগুলি বিশ্লেষণ করতে করতে তিনি পৌঁছে যান স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত রবীন্দ্রচিত্রকলার অন্দরমহলে। আমাদের ছবির ইতিহাসের দিক থেকে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের কাজের তাৎপর্য বিবেচনার দায়িত্ব রয়ে যায়—চিত্রকলায় ভারতীয় আধুনিকতার বিকাশে তাঁর ভূমিকা বোঝার দায়িত্ব।
সত্যজিৎ চৌধুরী বাংলা শিল্পসমালোচনার জগতে অত্যন্ত কৃতবিদ্য। তাঁর ‘অবনীন্দ্র নন্দনতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ এবং ‘নন্দলাল’ দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্র-চিত্রকলা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলির পরবর্তী মূল্যায়ন বিধৃত আছে ‘শিল্পকৃতি কথা পুস্তকে’। নানান দৃষ্টিকোণের নিরিখে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিল্পকলা, শিল্প আন্দোলন, শিল্প প্রণোদনার অভিমুখকে মেধাবী বিচারে সমান্তরে এনে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেয়েছেন। গভীর পর্যবেক্ষণে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্র-চিত্রের নানা দিক। উল্লেখনীয় রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি প্রসঙ্গ- সত্যজিৎ চৌধুরী বলেছেন, আত্মপ্রতিকৃতিতে কোথাও কৌতুকপ্রফুল্লতা, আনন্দবোধের উজ্জ্বলতা বা সন্তসুলভ ধ্যানী প্রকৃতি দেখতে পাই না। চলতি অর্থে তিনি সুন্দরও নন আত্মপ্রতিকৃতিতে। নিজের মুখের মূল আদলটির আভাস-মাত্র বজায় রেখে ভাঙচুর করেছেন নানাভাবে। প্রায় সব কটি আত্মপ্রতিকৃতিতে চাহনি এমন ব্যথাহত কেন? মনে হয়, এ ব্যথাহত দৃষ্টিতে সমকালীন ঐতিহাসিক দুর্যোগের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়, মানুষের সকল সুকৃতি ধ্বস্ত হয়ে যেতে দেখেছিলেন। মানুষের বিবেকের অভিভাবক, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও ঘনায়মান সেই সাংঘাতিক সংকট প্রতিরোধের আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে কোনো ব্যক্তিগত সংকট নয়, সেদিনের বাস্তব বিভীষিকারই ছাপ রয়ে গেছে। অশোক মিত্রের মতো কলাসমালোচকও রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে সুন্দর-অসুন্দরের ধাঁধায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেন অসুন্দরের সাধনা করছিলেন। অশোক মিত্রের মনে হয়েছিল, কবিগুরুর এ ধরণের ছবি আঁকা সম্ভব হয়েছিল এই কারণেই যে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন গ্রামবাংলার দারিদ্র্যপীড়িত, দুঃখকষ্টে জর্জরিত মানুষের জীবন। দেখেছিলেন মানুষেরই হাতে নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি। এসব দেখে তিনি বেদনাহত হয়েছেন, আর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। এসবেরই অভিঘাতে কলমের আঁচড়ে কিংবা তুলির ডগায় তাঁর চিত্তদুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্র চিত্রকলার একটি বিশেষ দিক হল নিসর্গ চিত্র। আলোচ্য গ্রন্থটিতে ‘নিসর্গ-চিত্র’ শীর্ষক একটি পৃথক অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে এবং সত্যজিৎ চৌধুরী বিস্তৃত আলোচনায় তুলে এনেছেন নিসর্গ চিত্রের প্রেক্ষাপট। বিশ্বপ্রকৃতি রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে আশৈশব আবিষ্ট করত সে কথা আমাদের সকলেরই জানা। কবিতায়-গানে-গদ্যরচনায়-চিঠিপত্রে—তাঁর যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে নিসর্গ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। নিসর্গের ডাক তাঁকে উতল করে। তাঁর সংবেদন, তাঁর উপলব্ধি আকার পায় প্রকৃতির আশ্রয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ তাঁর চিত্রকলায় প্রকৃতির দিকে তাকাবেন না, প্রকৃতিকে ব্যবহার করবেন না— সে তো একান্তই অভাবিত। পদ্মাতীরের ঘনপুঞ্জিত সবুজের সমারোহ, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, ভগ্নপ্রায় চর আর স্বয়ং পদ্মা রবীন্দ্রনাথের উত্তরকালের ছবিতে ঘুরে ফিরে এসেছে। এরকম নিসর্গ দৃশ্যের ছবির সংখ্যা প্রায় কয়েকশো হবে।
না মেনে উপায় নেই, চিত্রবিষয় হিশেবে প্রকৃতিকে আমরা বুঝতে শিখেছি পাশ্চাত্যের ছবির অভিজ্ঞতায়। নিসর্গ চিত্রের গৌরবে পশ্চিমি আধুনিক চিত্রের ইতিহাসে ইংল্যান্ডের মর্যাদা সুবিদিত। ১৯১২ থেকে ১৯১৯ এই সময়সীমায় রবীন্দ্রনাথ সাত বার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন এবং তাঁর এই দীর্ঘ ভ্রমণপথে কোনো মিউজিয়াম, শিল্পীর স্টুডিও বা শিল্প সংগ্রহ নেই যা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তরুণ রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে থাকার সময় টার্নারের ল্যান্ডস্কেপ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। টার্নারের ছবিতে নানা প্রহরের আলো ধরার নিপুণতায় মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ কি তাঁর চিত্রভাষায় আলোর গুরুত্ব সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের হাতে যে অনন্যসাধারণ নিসর্গ চিত্রের জন্ম হল তার একটা বড় অংশে আলোর স্থাপনা নিয়ে অতি বিচিত্র পরীক্ষার নজির আছে। শুধু নিসর্গ-চিত্রে নয়, আলোর সংস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সব ছবিতেই পরীক্ষার ঝোঁক দেখা যায়। রঙ চাপাবার সময়ে তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে কাগজের অংশবিশেষ অলাঞ্ছিত রেখে দিতেন। এই অলাঞ্ছিত অংশ কখনও উজ্জ্বল রেখা হয়ে বস্তুর বা অবয়বের ঘের তীক্ষ্ণভাবে প্রকাশ করে। কখনও হাইলাইটের কাজ করে। এ পরীক্ষাটা নিসর্গ-চিত্রে খুব জমজমাট হয়ে এল। প্রায়ই তিনি পটের সামনেটাতেই গাঢ় রঙে গাছপালা আঁকতেন। ফলে ছবির মধ্যে আলোটা আড়ালে পড়ে। গাছপালার আকৃতির ফাঁক দিয়ে বিচ্ছুরিত আলো দর্শকের চোখে ধাক্কা দেয়। এই কলারীতিতে দুটি বৈশিষ্ট্য ফোটে ছবিতে। সামনের দৃশ্যবস্তু ঘনত্বগুণসম্পন্ন, সলিড (solid) হয়ে ওঠে, সে মূর্ততায় প্রায় ত্রিমাত্রিক মায়া তৈরি হয়। অন্যদিকে পশ্চাৎপটে আলো হয়ে ওঠে যেন জমাট স্পর্শন সংবেত্যতাময়। শিল্পী পরিতোষ সেন বলেছেন, ‘... প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিগুলো বেশির ভাগই আঁকা হয়েছে ঊষা কিংবা গোধূলির আলোয় এবং যার দরুণ এসব ছবির মেজাজে এসেছে ইংরাজিতে যাকে বলে ‘’brooding melancholy’’. অবশ্য এই মেলানকলি শুধুমাত্র এসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যেই প্রকাশ পায়নি, কবির অন্যান্য ছবিতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিসর্গ-চিত্রে চিন-জাপানের কীর্তির কথা। জাপানের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের গুরু কাকু জো ওকাকুরা তেনশিন ১৯০২ সালের শুরুতে কলকাতায় আসেন এবং তিনিই এখানকার জিজ্ঞাসুদের জাপানের শিল্প ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করান। শুধু তাই নয়, জাপানের করণকৌশলের সঙ্গে এখানকার শিল্পীদের, বিশেষ করে অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথদের হাতে-কলমে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে তেনশিন তাঁর দুই প্রধান ছাত্র তাইকান ও হিশিদাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ এঁদের কাছে জাপানি কালি তুলির কাজের আঙ্গিক এবং ওয়াশের কাজ যত্ন করে শিখেছিলেন। এছাড়া ইংরেজ শিক্ষক চার্লস পামারের কাছে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের জলরঙের কাজ শিখেছিলেন। ফলে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নিসর্গ-চিত্র রচনার দুটি ধারা থেকে অবনীন্দ্রনাথ প্রয়োজনমতো দীক্ষা আহরণ করে ভারতীয় চিত্রে নিসর্গ বিষয়ের পত্তন ও প্রতিষ্ঠা করে দিল।
অবনীন্দ্রনাথের কাজের গতি-প্রকৃতি একেবারেই পাশে বসে লক্ষ্য করছিলেন দাদা গগনেন্দ্রনাথ। শিল্পকলায় একটা নতুন জাগরণ গড়ে তোলার আয়োজনে তাঁর ভূমিকাও তখন সকলের কাছে মান্য ছিল। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের পথে গগনেন্দ্রনাথ এগোলেন না। তাঁর পরীক্ষা চলল ভিন্ন পথে। আখ্যানবস্তুর দৃষ্টান্ত রচনার দিকে না গিয়ে তিনি সন্নিহিত নাগরিক বাস্তবতা থেকে ছবির বিষয় নিলেন। সেই সময়ের শিল্পকাজে গগনেন্দ্রনাথই নাগরিক নিসর্গ প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ-চিত্রের প্রসঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে নন্দলাল বসুর শিল্পশিক্ষা। কারণ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ শিল্পশিক্ষার নতুন আয়োজনে নন্দলালকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ মনে করেছিলেন। কারণ নন্দলালই তাঁর ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছিলেন প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। প্রকৃতিকে নকল করা নয়, তাকে হুবহু এঁকে ফেলা নয়, অনুকরণ করাও নয় - নন্দলাল গুরুত্ব দিতেন পর্যবেক্ষণকে। তাও আবার সারাদিন ধরে, বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন আলো-আঁধারির পরিবেশে তাকে পর্যবেক্ষণ করা। নন্দলালের ছবির বিষয় বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। কিন্তু তাঁর সব পর্বের কাজের একটা বড়ো অংশ নিসর্গ চিত্র। সুতরাং বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ চিত্রের আলোচনায় অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ এবং নন্দলালের কাজের পরিপ্রেক্ষিত নিতেই হবে। এছাড়া আমরা জানি, ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ক্রমবর্ধমান কাটাকুটির মধ্যে থেকেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একজন শিল্পীর অব্যর্থ অভ্যুদয় প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন। এ ধরণের কাজের মধ্যে প্রকৃতির কোনো মোটিফ আসেনি। কিন্তু কিছু পরে কালিকলমে নিসর্গ চিত্র এঁকেছেন। ধরে ধরে পাছপালা, পাতা আঁকেননি, কলমের নিবের দ্রুত টানে গাছটির আকৃতি তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছেন। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটির সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ চিত্রে গাছপালার প্রাণধর্ম সবল, সতেজ ও অভিব্যক্তিময়, কিন্তু কোনো গাছকে নির্দিষ্ট নামে পরিচিত করা যায় না, যেমন তাঁর ছবিতে জন্তু-জানোয়ারও নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এই বিশেষ চিত্রনীতি রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপ থেকে আহরণ করেছিলেন। একথা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘য়ুরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে।... আধুনিক কলারসজ্ঞ বলছেন, আদিকালের মানুষ তাঁর অশিক্ষিতপটুত্বে বিরলরেখায় যেরকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তর ভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই। মানুষ বারবার শিশু হয়ে জন্মায় বলেই সত্যের সংস্কারবর্জিত সরল রূপের আদর্শ চিরন্তন হয়ে আছে, আর্টকেও তেমনি শিশুজন্ম নিয়ে অতি অলংকারের বন্ধনপাশ থেকে বারেবারে মুক্তি পেতে হবে’।
য়ুরোপীয় চিত্রকলায় আধুনিকতার সূত্রপাত থেকে তাঁর সময় পর্যন্ত বিকাশ বিবর্তনের খুঁটিনাটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অবগত ছিলেন। যাকে ‘পাঠ’ নেওয়া বলে অর্থাৎ কেতাবী শিক্ষা—ছবির ক্ষেত্রে সেই পাঠ রবীন্দ্রনাথের নেওয়া হয়নি। ছবির জগতে তিনি স্বশিক্ষিত। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণের সময় প্রখ্যাত সব গ্যালারি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ চিত্রে তাঁর সেই অভিজ্ঞতা অনিবার্যভাবেই প্রভাব ফেলেছে।
আমরা জানি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ব্যবস্থাপনায় বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল গ্যালারিতে, উদ্বোধনের তারিখটি ছিল ২ মে, ১৯৩০। এবং এটাও ঠিক, প্যারিসে প্রদর্শনীর আগে এ দেশের মানুষ জানতেনই না বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু ছবিও আঁকেন। এজন্য রবীন্দ্রনাথের মর্মবেদনা ছিল বৈ কি! তাই তাঁর উচ্চারণ, এ এক ‘আবৃত দৃষ্টির দেশ’। এখানে কি কেউ তাঁর সৃষ্টির তাৎপর্য বুঝবে! এই সংশয়ে রবীন্দ্রনাথ এক সময়ে ভাবেন, তাঁর আঁকা ছবি য়ুরোপে থেকে যাওয়াই ভালো। রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে লিখলেন, ‘আর যাই হোক আমার ছবি দেশে ফিরতে দেবো না’। ১৩/৬/১৯৩১-এ দিলীপ কুমার রায়কে জানালেন, ‘এই ভাষা পশ্চিম ভালো বোঝে, পশ্চিমকেই উৎসর্গ করলুম। পূর্ব সীমায় সে থাকবে অবগুণ্ঠিত—আমার এই বিধান। আমার ছবি ও গান সমুদ্রের দুই তীরে দুই নীড়ে ভিন্ন বাসায় থাকবে’। এখন প্রশ্ন ওঠে, ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথ যখন শিল্পী হিসেবে য়ুরোপ ও আমেরিকায় দ্ব্যর্থহীন ভাবে অভিনন্দিত, তখন তো এ দেশে শিল্পচর্চার জোয়ার—গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে পুরোদমে কাজ চলছে, ক্ষীতীন্দ্রনাথ মজুমদার ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট-এ নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্র তৈরি করছেন, নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতনে কলাভবনকে একটা সুশৃঙ্খল শিক্ষাকেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছেন, সঙ্গে আছেন অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথ। বোম্বাই-এ, মাদ্রাজে, লখনউ-এ শিল্পশিক্ষা এবং শিল্পচর্চা বেশ সংগঠিত। ১৯২৮ থেকেই মুকুল দে ছাত্রদের পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দুই ধারার শিল্পের সঙ্গেই পরিচিত করার ব্যবস্থা করছেন, সেক্ষেত্রে সত্তর অতিক্রান্ত রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চা বিষয়ে মানুষের উদাসীনতা স্বাভাবিক ছিল না। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের দুঃখ ও অভিমান তো ছিলই। প্রিয়জনের কাছে লেখা নানা চিঠিপত্রে তার প্রকাশ ঘটেছে। এবং এটাও সত্যি বিদেশে প্রদর্শনী হবার আগে দেশে একমাত্র শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছবির একটি প্রদর্শনী হয় ১০ অক্টোবর, ১৯২৮। একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে, কলাভবন আর কবির নিবাস উত্তরায়ণে একই সময়ে চিত্রশিল্পের যে দুই ধারা বইছিল তার মধ্যে কি কোনো যোগাযোগ ছিল না? কলাভবনে ছাত্রছাত্রীদের কাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবি কি কলাভবনের শিক্ষক এবং ছাত্রদের আদৌ টানত? তৎকালীন কিছু বর্ষীয়ান শিল্পীদের কথা থেকে বোঝা যায় সেইসময় কলাভবনে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা দেখাবার কোনো ব্যবস্থাই করা হত না। নিজেদের আগ্রহে ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথের ছবি মাঝে মধ্যে দেখতেন। কখনও-সখনও নন্দলাল গুরুদেবের ছবি গোছগাছ করে রেখে আসার জন্যে কলাভবনে ছেলেদের পাঠাতেন। তখনই রবীন্দ্রনাথের সদ্য আঁকা ছবি ছাত্ররা হাতে ধরে দেখার সুযোগ পেত। সে দেখা কি কোনো গভীর ছাপ ফেলত ছাত্রদের মনে? এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর মেলে না।
শিল্পশিক্ষার বাঁধা ধাপগুলি রবীন্দ্রনাথ অতিক্রম করেননি। ফলে রেখা, রঙ ও আঙ্গিক কোনো নিয়মই তাঁর ছবি থেকে বার করা শক্ত। বলা যেতে পারে, আধুনিক ভারতীয় ছবির এলাকায় রবীন্দ্রনাথ এক ব্যতিক্রমী স্বৈর-রাজ্য পত্তন করেছিলেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ছবির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কোনো পরম্পরাকে স্বীকার করেননি’। চিত্রনীতির নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছবি ফেলা যায় না বলেই, তার ভেতর থেকে ছাত্রদের নেবার মতো কোনো নির্দেশ নন্দলালদের মতো শিক্ষকদের পক্ষে দেওয়া বাস্তবিকই কঠিন ছিল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মূল্যবান বই ‘আধুনিক শিল্পশিক্ষা’য় কলাভবনের শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা থাকলেও, রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রভাবের কথা একবারও আসেনি। চিত্রনীতি শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথের ছবি কাজে লাগানো যাবে না জেনেও নন্দলাল কখনও ছাত্রদের রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখতে নিষেধ করতেন না। কারণ নন্দলাল বুঝতেন রবীন্দ্রনাথের ছবি যথার্থ শিল্পদৃষ্টি খুলে দিতে পারে এবং তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রচণ্ড শক্তি সম্পর্কে খোলাখুলি মন্তব্য করেছেন, ‘গুরুদেবের ছবির পাশে আমার ছবি রেখে দেখি টিম টিম করে, নির্জীব যেন, প্রাণহীন’। নন্দলাল যখন রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তখন যামিনী রায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথের সব ছবি সমানভাবে উতরোয়নি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যামিনী রায়ের ঘনিষ্ঠতা অনেক গভীর হলেও, রবীন্দ্রনাথের অসফল ছবির ত্রুটি কোথায় এবং কেন এমন ঘটছে যামিনী রায় তার যথাযথ ব্যাখ্যা দেন। তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) শিল্প-ইতিহাসের মধ্যবর্তী স্তরগুলি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা নেই। তবুও রবীন্দ্রনাথ বড় আশ্চর্যজনকভাবে অনিবার্য পতন এড়াতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে যামিনী রায় বলেন, ‘তাঁর এই অভিজ্ঞতার অভাব ঢাকা পড়ার একমাত্র ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই তাঁর কল্পনার অসামান্য ছন্দোময় শক্তিতে’। ত্রুটি ঘটে তখনই যখন রবীন্দ্রনাথ রিয়ালিস্টিক ছবির নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করে শুদ্ধ রূপের প্রবল অভিব্যক্তি চিত্রস্থ করতে গিয়েও হটাৎ ‘নাক বা চোখের টান দিতে গিয়ে রিয়ালিস্টিক আঁচড় দিয়ে বসলেন’। আবার এই যামিনী রায়ই বলেন, কোনো বস্তুরূপ বা মানব অবয়ব রবীন্দ্রনাথের ছবিতে যেভাবে সত্তাবান হয়ে ওঠে তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাটা অসামান্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেন, যখন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আঁকা মানুষ যখন দেখি তখন মনে হয় না সেটা এখনই নেতিয়ে পড়বে, মনে হয় না হাওয়ায় দুলছে যেন। স্পষ্ট দেখি মানুষটার ওজন আছে, সতেজ শিরদাঁড়া আছে। .... আমার মতে গত দুশো বছর ধরে, রাজপুত আমল থেকে আজ পর্যন্ত, আমাদের দেশের ছবিতে যে অভাব বেড়ে চলেছিল, রবীন্দ্রনাথ সেই অভাবের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে চান, ছবির জন্য খোঁজেন সতেজ শিরদাঁড়া’।
বস্তুত, নিজেদের সৃষ্টির কাজে নন্দলাল বসু, মুকুল দে, অসিতকুমার হালদার বা ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মা — এঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের ছবি থেকে বিষয় বা আঙ্গিক কোনো কিছুই নেননি। এমনকি রামকিঙ্কর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন কেমন করে রবীন্দ্রনাথ ফ্রেমের মধ্যে রীতি ভাঙার লড়াই চালাচ্ছেন। এই লড়াইতে প্রাণিত হয়েই রামকিঙ্কর নিজের ছবিতে গড়া এবং আবার ভেঙে গড়ার অবিরল পরীক্ষায় এত সাহস পেতেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায়মতো চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে, ছাপা ছবির কাজে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারী।
বস্তুত চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের সমগোত্রীয় কোনো শিল্পী এদেশে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। পাণ্ডুলিপির চিত্রাঙ্কন থেকে ক্রমে তাঁর ছবি অভাবনীয় চিত্রভাষ সূচিত করেছিল। এমনকি পরবর্তীকালের ক্যালকাটা গ্রুপ কিংবা আরও সাম্প্রতিককালের চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোর, শানু লাহিড়ী, বিকাশ ভট্টাচার্য, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীদের ওপর রবীন্দ্রনাথের ছবির সরাসরি প্রভাব স্পষ্ট নয়। সত্যজিৎ চৌধুরী অবশ্য নানাকারণে বারংবার বিকল্প আধুনিকতার সন্ধানী দুই শিল্পীকে রবীন্দ্রনাথের সমান্তরে রাখতে চেয়েছেন—একজন যামিনী রায়, অন্যজন অমৃতা শেরগিল। পাশাপাশি এ কথাটাও তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, য়ুরোপের মহাশিল্পীদের কাজ এবং সমকালীন শিল্পআন্দোলনগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন, তৎসত্বেও তাঁকে কোনো বিশেষ ঘরানার শিল্পীর অভিধায় ভূষিত করা চলে না।
‘শিল্পকলায় নবজাগরণ এবং রবীন্দ্রনাথ’ এই অধ্যায়ে সত্যজিৎ চৌধুরীর মূল্যবান পর্যবেক্ষণকে মান্যতা দিতেই হয়। ইংরেজ শাসনের প্রভাবে যখন এদেশের সমস্ত স্তরে উদ্ভট সাহেবিয়ানা প্রকট, তখন সাংস্কৃতিক চেতনার দাসত্ব মোচনের আন্দোলন জাগিয়ে তুলেছিলেন আনন্দ কুমারস্বামী, অরবিন্দ ঘোষ, সিস্টার নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ। ১৮৯৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ হয়ে আসেন আরনেস্ট বেনফিল্ড হ্যাভেল। একজন ইংরেজ হয়েও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষের কলা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিনষ্ট করে এদেশের ওপরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চাপানো অনুচিত। ১৯০২ সালে ভারতে এলেন জাপানের শিল্পগুরু কাকুজো ওকাকুরা তেনশিন। নিবেদিতার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথদের যোগাযোগ এবং মতবিনিময়ে শিল্পকলায় পাশ্চাত্য প্রভাব প্রতিরোধের আন্দোলন জমাট হয়ে ওঠে। এদেশেই ওকাকুরা লিখলেন ‘Ideals of the East’. এ বইয়ের প্রথম বাক্য ‘এশিয়া ইজ ওয়ান’ তখনকার ভারতীয় কলা-সংস্কৃতির জগতে এই ভাবনা মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। এই বীজমন্ত্র আশ্রয় করেই অবনীন্দ্রনাথ ভারতশিল্পে নবজাগরণ ঘটালেন। আরনেস্ট বেনফিল্ড হ্যাভেল অবনীন্দ্রনাথকে ১৯০৫ সালে আর্ট স্কুলের উপাধ্যক্ষ করে আনলেন। তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জোয়ারে সারা বাংলা উত্তাল। এরকম পরিস্থিতিতে অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলে একদল প্রতিভাবান তরুণ শিল্পীদের ভারতীয় শিল্পশৈলী পুনরুজ্জীবনের দীক্ষা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠভাবেই নতুন এইসব শিল্পীদের কাজের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করতেন। ইংরেজ প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট। ভারত শিল্প নিয়ে ইংরেজদের উৎসাহ রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। নিজেকে জড়ানওনি। তাঁর বারবারই মনে হয়েছিল শিল্প হয়ে উঠবে এক প্রাণবন্ত অরণ্য। তার জায়গায় কেয়ারি করা বাগান! এই ক্ষোভেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গড়ে তুলতেন ‘বিচিত্রাসভা’। বহু তোড়জোড় করে শুরু হলেও ‘বিচিত্রা’ চলেছিল মাত্র বছর দেড়েক। রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কোলকাতা কেন্দ্রিক নতুন শিল্প আন্দোলন প্রসারিত হওয়ার সম্ভবনা নেই। সেজন্যই তিনি পত্তন করেছিলেন ‘কলাভবন’ (১৯১৯)। ‘কলাভবন’ পত্তনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল শিল্পে প্রসারতার জন্যে একটা মুক্ত হাওয়া ও শিল্প সহায়ক একটা পরিবেশ তৈরি করা। এই কাজে তিনি টানলেন নন্দলালকে কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পী হিশেবে সমকালীন তরুণ শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র নন্দলালই সব থেকে প্রতিভাবান। শিল্পচর্চায় আমাদের আত্মতৃপ্তির ঘোর ভাঙাবার জন্য তিনি কলাভবনে য়ুরোপীয় শিল্পের ইতিহাস পড়াবার ব্যবস্থা করলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে স্টেলা ক্রামরিশকে কলাভবনে এনেছিলেন। এসেছিলেন ফরাসি শিল্পী আঁদ্রে কারপেল, বিশিষ্ট ভাস্কর মিসেস মিলওয়ার্ড। শিল্পভাষার সাবলম্বনে অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ এবং এঁদের অনুগামী শিল্পীদের হাতে ভালো কাজ হয়নি এমন নয়। কিন্তু শিল্পমুক্তির, শিল্পভাষাকে বিষয়মহিমার অবলম্বন থেকে মুক্ত করার আধুনিকতর চেতনা সেই সৃজনপর্বে তেমন গুরুত্ব পায়নি। এই দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আমাদের ছবির বিকাশে একটা বড় বাঁক এসেছিল এবং তৃতীয় দশকের শেষদিকে তিনি নিজেই ছবি আঁকায় নিবিষ্ট হন। যে নতুন ধারণা, যে শিল্পভাষা তিনি সঞ্চার করতে চাইছিলেন, নিজের কাজে তার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে তুললেন। এটা মানতেই হবে আমাদের দেশে শিল্পে নবজাগরণের ঝিমিয়ে পড়া দশাটাকে ধাক্কা দিতে চেয়ে একদিন ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর হাতের কাজে ভারতীয় শিল্পের বিকাশে একটি বড় উত্তরণ পর্ব সূচিত হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের শৈলীর অন্ধ অনুকরণে অসাড় হয়ে আসা আমাদের কলাসংস্কৃতির জগতে বড় রকমের অভিঘাত আসে প্রথমে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজে, এবং কিছু পরে রবীন্দ্রনাথের কাজে। একটি কথা মনে আসা স্বাভাবিক—দেশের শিল্পকলার বিকাশে রবীন্দ্রনাথের ছবির কি কোনো প্রভাব পড়েছিল? একালের অগ্রগণ্য শিল্পী গণেশ পাইনের অভিজ্ঞতায় দেশের চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথের ছবির কোনো প্রভাব সরাসরি আসেনি আদৌ। সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রভাব পড়েছে গভীরতর। তাঁর কাজের দৃষ্টান্তে অবশ্যই আমাদের তরুণ শিল্পীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আর্ট স্কুল বা ওরিয়েন্টাল সোসাইটি এমনকি কলাভবনের ক্লাসে যে শিক্ষা তাঁরা পাচ্ছিলেন সেটাই কখনও চূড়ান্ত নয়। এর বাইরে গিয়ে জগৎ ও জীবনের সামনে খোলা চোখে দাঁড়ালে শিল্পীর পুরুষার্থ ভিন্ন মাত্রায় উত্তীর্ণ হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের কাজ থেকে এই ধাক্কাটা পেলেন—যার ফল শিল্পচৈতন্যে অভ্যাসিক জড়ত্ব এবং হাতের কাজে প্রথাগত শিল্পশিক্ষার আড়ষ্টতার অবসান। যাকে বলা যায় শিল্পমুক্তির পথে পা বাড়াবার সামর্থ্য ও সাহস।
কিন্তু দেশের শিল্প সংস্কৃতির জগতে রবীন্দ্রনাথের ছবিরও সমালোচনা হয়েছে, অনেকে মন্তব্য করেছেন—ছবি আঁকাটা তাঁর বুড়ো বয়েসের খেয়াল। সারা জীবন সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, গান লিখেছেন, নাটক লিখেছেন; শেষটায় সত্তর বছর বয়েসে এসে ছবিও আঁকলেন। এ যেন আকস্মিক খেয়ালের কাজ, চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে প্রায় উপেক্ষাই করেছেন। অনেকে বলেছেন তাঁর ছবিতে অ্যানাটমির অভাব, দুর্বল ড্রইং। এমনও বলা হত, উনি তো দেশলাই বাক্স আঁকতেও পারবেন না, ছবি আঁকবেন কি করে! অবশ্য এসব সমালোচনার যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন যামিনী রায়। বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছবিকে শ্রদ্ধা করি তার শক্তির জন্য, ছন্দের জন্য, তার মধ্যে বৃহৎ রূপবোধের যে আভাস পাই তার জন্য।......আমার কিন্তু মনে হয় আজকালকার কোনো ছবিতে অ্যানাটমির বোধ যদি সত্যিই থাকে, তাহলে শুধু এই ধরণের ছবিতে আছে, ছবির পক্ষে অ্যানাটমির তাৎপর্য কতটুকু? তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের ছবিতে যে শিরদাঁড়ার অভাব ছিল রবীন্দ্রনাথ তা ঘোচালেন। ১৯৩০-এ প্যারিসের পিগাল গ্যালারিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীতে সেখানকার শিল্পীদের প্রশংসায় নিজের ছবি নিয়ে যে কুণ্ঠা ও সংশয় ছিল তা তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন। বিদেশী বন্ধু রটেনস্টাইন-কে লিখলেন, ‘আমাদের আত্মতৃপ্ত ও গতিহীন ভারতীয় শিল্পের এলাকায় আমি যথেচ্ছাচারী নির্মম হানাদারের মতো সব তছনছ করছি। আমার হতভম্ব স্বদেশবাসী আমার ছবি সম্পর্কে কি মতামত দেবে বুঝে উঠতেই পারছে না’। বোঝা যায় নিজের মধ্যে জেগেছে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। য়ুরোপে রবীন্দ্রনাথের ছবির ব্যাপক সমাদরে এদেশে চৈতন্যোদয় হয়েছিল খানিকটা। এদেশের শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ অনুভব করেছিলেন, আমাদের ছবির জগতে তাঁর কাজে একটা বড় রকমের বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন প্রায় আড়াই হাজারের ওপর। তার তিন ভাগের মধ্যে দু ভাগই নারী-পুরুষ মুখের অবয়ব। এসব মুখের ছবি আমাদের মুগ্ধ করে না, বরং ভাবিয়ে তোলে। নারীমুখগুলি বেশির ভাগই অত্যন্ত বিষণ্ণ। চোখের দৃষ্টি যেন প্রশ্নে ভরা। তীক্ষ্ণ এবং প্রতিবাদী। রবীন্দ্রনাথের ছবির জগৎটি প্রকৃতপক্ষে বিষাদ-উদ্বেগ-বিভীষিকাময়। রবীন্দ্রনাথ কেন আঁকলেন এধরনের ছবি? এ প্রেক্ষিতে সত্যজিৎ চৌধুরী স্মরণ করিয়েছেন, ১৯৩০-৪০ সময়কাল পৃথিবীর ইতিহাসে বড় দুঃসময়। পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান। যার পরিণতি ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। য়ুরোপে তখন সুস্থ মানবিক পরিবেশ বিপন্ন। বিধ্বস্ত। পরাধীন ভারতবর্ষ এ যুদ্ধে সরাসরি কোনো পক্ষ না নিলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ থেকে বাঁচেনি। আতঙ্কিত বিশ্ববাসী তখন এক সর্বাত্মক ভয়াল ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। এই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নিজেদের কাজে প্রতিরোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। সে সময়ে খোদ জার্মানিতে জেগে উঠেছিল এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপ ভ্রমণের সময় জার্মানির এই অভিব্যক্তিময় শিল্পীদের কাজ খুব মন দিয়ে দেখেছিলেন। এঁদের কাজে ফুটে উঠেছিল সভ্যতার সেই সংকটকালের অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি। পরিস্থিতির প্রতিকূল চাপে মানুষ যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে। এইসব প্রতিবাদী শিল্পীদের কাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাজের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ভাবা যেতেই পারে, যেসব শিল্পীরা বিশ্বময় প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরই সহযোগী। তাঁরই কাজে ভারতীয় আধুনিক শিল্প বিশ্বের বড় পটের সঙ্গে যুক্ত হল। এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা যায়, পৃথিবীর সব বড় শিল্পীরা নিজের প্রতিকৃতিতে হুবহু নিজের মুখ ফুটিয়ে তোলেননি। তাঁর দর্শন বা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা প্রকাশের আধার হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের মুখখানিকে। রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতির সংখ্যা প্রায় পনেরো-ষোলোটি। সব আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন ঈষৎ বিকৃত করে। সে মুখে প্রসন্নতা নেই। কোথাও বিস্ময়, কোথাও ব্যথিত কাতরতা কিংবা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। সমকালীন পরিস্থিতি প্রকাশের জন্যই নিজের মুখের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বদলে বদলে নিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতেই বাংলার বুকে নেমে আসে মহামন্বন্তর। পথে-ঘাটে মৃতদেহের স্তূপ শিল্পী বিবেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জাগায়। রূঢ় বাস্তবের সামনে দাঁড়ালেন আমাদের শিল্পীরা। জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর তাঁদের চিত্রকলায়, ছাপাই ছবিতে, ভাস্কর্যে তুলে আনলেন নিরন্ন, দুর্গত মানুষের ছবি। ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলার শিল্পীরা এক প্রতিবাদী কলা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন সেদিন। মন্বন্তরের পরেই আসে বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কোটি কোটি মানুষ ছিন্নমূল হয়ে গেল। বাংলার মানুষ আশ্রয়চ্যুত, জীবিকাচ্যুত। সমকালীন শক্তিমান শিল্পীদের শিল্পকৃতির জগৎ কেমন উল্লাসহীন ও বিমর্ষ। আসে না তাঁদের হাতে স্বাভাবিক অবয়ব, আসে বিকৃত, বিকল অবয়ব। তাঁদের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে না উজ্জ্বল রং, ফুটে ওঠে কালো বা কৃষ্ণনীল পট, বা পোড়া বাদামী রং। মনে রাখতে হবে, সংকটাপন্ন মানবতাকে আমাদের ছবিতে প্রথম তীব্রভাবে প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ভারতীয় শিল্পকলার মানচিত্রে রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার পুরোধা পুরুষ। তিনি দেশ-বিদেশ থেকে নিয়েছেন অনেক আবার বর্জন করেছেন প্রভূততর। তাঁর সৃজন প্রতিভা এগিয়েছে ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর সংশয় ও কুণ্ঠার কথা বললেও কার্যত কলম ও তুলি চালিয়েছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে। দেশ-বিদেশের বহু শিল্পী, শিল্পরসিক ও সমালোচকদের কণ্ঠে শোনা গেছে তাঁর ছবির প্রশংসা। তাই, শুধু আমাদের দেশীয় শিল্পের জগতে নয়, বিশ্বশিল্প জগতেও তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। বহুবর্ণ এবং সাদা-কালো ছবি এ গ্রন্থের অনন্য সম্পদ। বেশ কিছু পুনরাবৃত্তি মনকে পীড়া দেয়। এতদসত্বেও, ভারতীয় চিত্রকলার বিকাশে রবীন্দ্রনাথের ছবির তাৎপর্য বুঝতে এ গ্রন্থ তুলনাহীন।