যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদবিগ্নতা, তিনি সুধীরচন্দ্র কর। তিনি ছিলেন কবির রচনার প্রতিলিপিকর ও অনুলেখক। তাঁকে বলা হয় রবিলিপিকর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা কুমিল্লায়, ১৯২৬ সালে, একটি অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথ সভাপতি আর সুধীরচন্দ্র গেয়েছিলেন রবিবাবুরই গান— ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!’ এর পরই রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতনে এসে যোগ দেন কবির কর্মী হিসেবে। সুধীর কর জানাচ্ছেন—“সেদিন বুধবার। মন্দিরের উপাসনা সেরে পাশেই কুটিরের বারান্দায় কবি বিশ্রাম করছিলেন। সামনের পথ পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, কবি ডাকলেন। বললেন—আমার ওখানে তোমাকে থাকতে হবে। কাল থেকে এসো। অমিয়র কাছে (অমিয় চক্রবর্তী) কাজ বুঝে নিয়ো। কবির খাসদপ্তরের কাজ।” তাঁর ওপর কবির নির্ভরতার প্রমাণ এই পঙক্তিগুলো—
সুধীর যখন কর্ম করেন সু-ধীর করক্ষেপে
ধৈর্যহারা কবি যান যে ক্ষেপে।
রেগেমেগে কানুরামকে বলেন—“সুধীর কর-কে
বোলাও জলদি করকে।”
মাথা চুলকে বাঙাল যখন সামনে এসে দাঁড়ায়
তখন তাহার মুখের ভাবটা উষ্মা তাঁহার তাড়ায়।
রবিজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, তারপর তিনি হয়ে ওঠেন কবির ‘খাস মুন্সী’। কবিজীবনের শেষ ১৪ বছর তিনি কাটিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। গীতবিতান-এর তিনটি খণ্ডের কালানুক্রমিক ও বর্ণনাক্রমিক সূচি তাঁরই হাতে তৈরি হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে থাকার ফলে সুধীর কর কবিজীবনের শেষ বছরগুলোতে কবিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর এই দেখাই ‘কবিকথা’ গ্রন্থের বিষয়। তাঁর স্মৃতিচারণা একান্ত তাঁরই অভিজ্ঞতাজাত। আর আমরা জানতে পারি ব্যক্তিমানুষ হিসেবে অন্য এক, অনন্য এক রবীন্দ্রনাথকে। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন কবির লেখার টেবিলটি কেমন ছিল—“ব্রাহ্মধর্ম, উপনিষদ-সংগ্রহ, ডাক্তারি-বই, চিঠির প্যাড, গোটাকয়েক ফাউন্টেন পেন, দুচারখানা অটোগ্রাফের খাতা, ছবি আঁকার রং-এর শিশি, তুলির গোছা—লেখার টেবিলের এই ছিল স্থায়ী উপকরণ।” নিয়মিত লেখা ছাড়াও ছিল অবসরে পড়া, নয় ছবি আঁকা, নয় সুর বসিয়ে গান শেখানো, অভিনয়ের মহড়া, দেখাসাক্ষাৎ, আলাপ আলোচনা ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থের প্রতিটি প্রুফ নিজে দেখতেন। শুধু একটি গ্রন্থ, ‘গল্পস্বল্প’, যা বেরিয়েছিল মৃত্যুর বছর, অসুস্থতার জন্য প্রুফ দেখতে পারেননি। বইটি ছাপা হলে কবিকে এক কপি দেওয়া হয়েছে, তিনি আগাগোড়া পড়ে একটি কবিতার লাইনে দেখলেন ছন্দের গোলমাল। একটি শব্দ কবিই বদলেছিলেন, আগের শব্দটি ছন্দে ঠিক হলেও অর্থের দিক থেকে উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু যে শব্দটি নতুন বসানো হয়েছিল তাতে মাত্রা গেছে বেড়ে। কবিকে বারবার বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবে ওই শব্দটিকেই রাখা হয়েছিল। ছন্দের ভুল চোখে পড়ল কবির। তিনি বললেন--“লোকে বলবে বুড়ো বয়সে মাথার ঠিক নেই, ছন্দ রাখতে পারেনি। তোমাদের জন্য শেষটা এই অপবাদ নিতে হবে?” শেষ পাতাটি আবার ছাপতে হল।
কবির দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছেন লেখক। খাদ্যদ্রব্যের তালিকাটি খুবই বিস্তৃত। এ ছাড়া তিনি জানিয়েছেন কী কী পত্রিকা তিনি নিয়মিত পড়তেন। আর পড়তেন অজস্র বই। — “বিশ্বভারতী গ্রন্থভবনে খুঁজলে অনেক বই বেরবে, যার পাশে পাশে কবির হাতের অজস্র মন্তব্য আছে পেনসিলে লেখা। কী ধরনের কার বই তিনি পড়েছেন তার একটা বিবরণ এই করে আজও পাওয়া যেতে পারে।” খাওয়া, বাড়ি বদলানো, ঘর সাজানো ইত্যাদি কত দিকেই না কবির নজর থাকত তা বলে শেষ করা যাবে না। এগুলোকে কবির খেয়ালও বলা যেতে পারে। প্রসাধনী বলতে ছিল শুধু ওডিকোলন। সুধীর কর আমাদের জানিয়েছেন যে শান্তিনিকেতনকে উপজীব্য করে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা ছিল কবির। বৈচিত্রের সমাবেশে তৈরি ছিল আশ্রম—নানা দেশের নানা শ্রেণির মানুষ এখানে এসেছেন, কত মনস্তত্ত্বের খেলায় গড়ে উঠেছে এখানকার জীবন, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে প্রকৃতি। এমনকি, যোগাযোগ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড রচনারও তাগিদ ছিল কবির মনে। কিন্তু লেখার সুযোগ করে উঠতে পারেননি।
আমরা আগেই বলেছি লেখক ছিলেন কবির অনুলেখক ও লিপিকর, অর্থাৎ তিনি কবির হাতে লেখা রচনার কপি করে রাখতেন। একবার নবপর্যায় ‘সন্দেশ' পত্রিকায় কবির ‘পক্ষীমানব’ কবিতাটি পাঠানো হলে দেখা গেল যে কবিতাটি পত্রিকার প্রথম পাতাতেই হাতের লেখা ব্লক করে ছাপানো হয়েছে। কবির নামসহ গোটাটাই সুধীর করের হাতের লেখা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভেবে ভুল করে ছাপা হয়েছে।
গীতবিতান-এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল কবির নির্দেশিত শৃঙ্খলা মেনে। এতে কালানুক্রমিক ও বর্ণনাক্রমিক দুটি সূচি যথাক্রমে গ্রন্থের প্রথমে ও শেষে রাখা হয়েছিল। দায়িত্বে ছিলেন সুধীর কর। কবি যখন কোনও সূচি থেকেই নিজের প্রয়োজনের গানটি খুঁজে পেতেন না, ডাক পড়ত তাঁর। বলতেন—“জবড়জং একটা সিন্দুক বানিয়েছ। মাথামুণ্ডু কিছু খুঁজে পাওয়ার জো নেই। বের করে দাও, দেখি কোথায় পাও তুমি। নিশ্চয় এটা বইয়ে বাদ গেছে।" বুক কাঁপত সুধীরচন্দ্রের, কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রতিবারই গানটি বের করে দিয়ে উদ্ধার পেতেন। সমস্যা হত এই কারণে যে কোন শব্দ দিয়ে গানটি শুরু হয়েছে তা পাঠান্তরের জন্য বদলে যেত সময় সময়। তাই কবির অসুবিধে হত খুঁজে পেতে।
আর একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করেছেন সুধীরচন্দ্র। রচনার সঙ্গে ভুল তারিখ লিখে ফেললে তিনি কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। আর কবি নাকি একবার মজা করে বলেছিলেন—“একেবারে সবই ঠিকঠাক করে রেখে গেলে পরবর্তী প্রভাতকুমারদের দলের (‘রবীন্দ্রজীবনী’কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মশায়কে উদ্দেশ করে বলা) দিন কাটবে কী করে? আমি তো এখনই দেখছি হাট কীরকম জমে উঠেছে... কত গবেষণা, কত প্রবন্ধনিবন্ধ, পুঁথিপত্র, কত তর্কবিতর্কের ছড়াছড়ি!” তাঁকে ঘিরে এত যে গবেষণা চলবে তা সব আন্দাজ করতে না পারার অবশ্যই কোনও কারণ ছিল না।
সুধীরচন্দ্র রবীন্দ্রগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তিনি কবির বানান সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি জানতেন যে রবীন্দ্রনাথ অন্ত্র অর্থে ‘নাড়ী’ লিখতেন, আবার অভিমতের সঙ্গে পার্থক্য রাখার জন্য ‘মতো’। ‘সাথে’ শব্দটির গদ্যে ব্যবহার তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। ঙ ও গ এর যুক্ত অক্ষরের পরিবর্তে কবি লিখতেন ‘রঙিন’, যাদু কেটে লিখতেন ‘জাদু’, ‘ভেতর’ নয়, লিখতেন ‘ভিতর’।
কেমন ছিলেন ‘মনিব রবীন্দ্রনাথ’? খুবই চিত্তাকর্ষক এই অংশটি। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পর হিন্দুস্তানি পরিচারক মহাদেব দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে—“বড়বাবু নেই, সব খালি খালি লাগছে।” লেখক প্রশ্ন করেন—“গুরুদেব তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন, মহাদেব? খুব বকতেন? রাগ করতেন?” “বকবেন না আবার! একটু দোষ করেও কি সরবার জো ছিল!... ভয় করত। তবু কত গল্প করতাম তাঁর কাছে বসে—নিজেদের গল্প, ঘরের কথা। বড়বাবু লিখতেন আর শুনতেন। খোঁজখবর রাখতেন। শীতের দিনে বাইরে শুতে দিতেন না, বলতেন ঠাণ্ডা লাগবে। পাশের ছোট ঘরটাতে শুতে যেতাম, রাত্রিবেলা চুপি চুপি এসে দেখে যেতেন কেমন করে শুলাম, গায়ে কম্বল দিয়েছি কি না। গরমের দিনে শুতাম বাইরের বারান্দায়।... রাত তিনটেয় উঠতেন বড়বাবু, বাইরে বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসে থাকতেন। কোনওদিন আমরা দরজাজুড়ে শুয়ে থাকলে ঘরে জানলা খুলে বসে থাকতেন, তবু ডাকতেন না, ডিঙিয়ে যেতেন না। পরে শুধু বলতেন, জায়গা রেখে শুতে পারিস না?”
একটি মজার গল্প শুনিয়েছে মহাদেব। কবি এক রাতে ঘুমিয়েছিলেন, তারপর তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি মহাদেবকে ডেকে গম্ভীর মুখে বলেন—“শোন! চাঁদটাকে ঢেকে দে তো। ঘুম হচ্ছে না।” দূরে গাছের মাথায় চাঁদ। মহাদেব ভেবে পায় না সে কীভাবে চাঁদটাকে ঢেকে দেবে। গুরুদেব এবার হেসে বললেন—“পারবি নে? আচ্ছা এক কাজ কর।–ওই জানলাটা বন্ধ কর তো!” মহাদেব জানলা বন্ধ করতেই ঘর অন্ধকার। কবি বলেন—“কী রে, হল এবার? চাঁদ ঢাকা পড়ল?” এবার মহাদেবও হাসে।
আর একটি ঘটনার উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করব। প্রসঙ্গ কলকাতায় ‘অরূপ রতন’ নাটকের অভিনয়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কিছুদিন আগের কথা। তিনি নিজেও নামবেন অদৃশ্য রাজা ও ঠাকুরদার ভূমিকায়। শান্তিনিকেতনে মহড়া চলছে। কবি সন্তুষ্ট হচ্ছেন না বইয়ের পুরোনো কপিতে। তাই কাটাছেঁড়া চলছে। অনেক জায়গা নতুন করে লিখছেন। এদিকে অভিনয়ের সময় এগিয়ে এসেছে। কবির খেয়াল হল যে এত নতুন অংশ যুক্ত হয়েছে নাটকে যে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপানো দরকার। কিন্তু সময় খুব কম। এদিকে নতুন প্রুফ আসছে, আর কবি তাতে আরও নতুন অংশ যোগ করছেন। এইভাবে ছ’সাতবার প্রুফ দেখার পর হাতে একদমই সময় নেই বই ছাপানোর। একদিন বললেন—“যে করেই হোক আজ সন্ধের মধ্যে বই চাই-ই”। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বই ছাপানো সম্ভব হবে না। তাই কোনার্কের বারান্দায় মহড়ার সময় তিনি বলেন—“জানি, হবে না বই ছাপা—তবু বাহাদুরি! এখন কোথায় রইল সে, কী করে হয় রিহার্শেল! সব কাজ মাটি।”
শান্তিনিকেতন প্রেসকর্মীদের তৎপরতায় সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই বই ছাপা হয়ে গেছিল। কবি তাঁর কথা শেষ করামাত্র সুধীরচন্দ্র পিছন দিক থেকে গিয়ে এক কপি বই কবির হাতে তুলে দেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এটা নতুন বই। কিন্তু ভিতরটা খুলেই বুঝতে পারেন এটিই নতুন সংস্করণ। চোখমুখের সামান্য রূপান্তর না ঘটিয়ে তিনি তুলে নেন তাঁর ফাউন্টেন পেন। সুধীরচন্দ্রকে ডাকেন কাছে। তিনি ভাবতে থাকেন আবার কোনও ভুল থেকে গেল নাকি? কবি হাসি মুখে বইটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলেন—“এ বই তো তোমারই।” তিনি দেখলেন যেখানে ছাপা ছিল নাট্যকারের নাম, সেটি কেটে তিনি লিখে দিয়েছেন—‘শ্রী সুধীরচন্দ্র কর’। এই হলেন রবীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রনাথকে কে চেনাতেন যদি না তাঁর কথা লিখে যেতেন সুধীরচন্দ্র কর ‘কবিকথা’য়!