শশাঙ্ক দেখল অনিরুদ্ধর বাড়ির সামনে একটা ছোটখাটো জটলা। ভিড়ের বাইরে দুটো মোটরবাইক ট্যারচা করে দাঁড় করানো। পাড়ার মাতব্বর গোছের ছেলেরা গলা তুলে চেঁচামেচি করছে। একটা মেয়ের গলার আওয়াজও শুনতে পেল যেন। যেমন হয়, পথচলতি কিছু উড়ো খই লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়ে গেছে। মজাটা কী বোঝার জন্য শশাঙ্ক ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখল একটা কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে ফুটপাথে উবু হয়ে বসে কান্নাকাটি করছে। অনিরুদ্ধর বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। শশাঙ্কর মনে হল মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছে। সন্ধের আবছায়ায় ঠিকমত চিনতে পারল না। পরনের জামাকাপড়ে ধুলো লাগা। কাঁধের কাছে জামা খানিকটা ছেঁড়া, অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কী বলছে অর্ধেক কথা বোঝা যাচ্ছে না।
শশাঙ্ক হপ্তা তিনেক ছিল না শহরে। কুয়ারি পাস ট্রেক সেরে ফেরার সময় হৃষীকেশের একটা আশ্রমে আস্তানা গেড়েছিল দু’-চার দিনের জন্যে। আজই ফিরেছে। অনিরুদ্ধর কাছ থেকে ব্ল্যাকিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল। ট্রেকিং-এ যাবার সময় ছেড়ে গিয়েছিল। ব্ল্যাকি অনিরুদ্ধর কাছে ভাল থাকে। শশাঙ্ক একাবোকা মানুষ, পিছটান নেই, ইচ্ছে হলেই পিঠে ব্যাগপ্যাক বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। যখনই কোথাও যায়, ব্ল্যাকিকে অনিরুদ্ধর কাছে ছেড়ে যায়। অনিরুদ্ধ একসময় বিএসএফের ডগ ট্রেনিং সেন্টারে পোস্টেড ছিল। পরে অবশ্য ওয়াঘা বর্ডারে চলে যায়। তার পরেও যেন কোথায় কোথায়...। বছর দুয়েক হল অবসর নিয়ে বাড়িতে বসা। শশাঙ্ক ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার সোডিয়াম ভেপারের আলোগুলো একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে। মেয়েটার মুখের ওপর আলো পড়তেই চিনতে পারল। সেই মেয়েটা। যেদিন ব্ল্যাকিকে অনিরুদ্ধর বাড়ি ছাড়তে এসেছিল সেদিন দেখেছিল।
একটা সর্দার গোছের ছেলে কর্কশ গলায় খেঁকিয়ে উঠল, “কেবল কাঁদলেই হবে? কী হয়েছে বলবি তো?”
মেয়েটা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে অন্য একটা ছেলে ফুট কাটল, “কী আর হবে? বাড়িতে বৌ নেই, একা পেয়ে আধবুড়ো ঢ্যামনাটা হাত-ফাত চালিয়েছে, আর কী?” বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে অনিরুদ্ধর বাড়ির বন্ধ দরজার দিকে ইশারা করল।
মেয়েটা মুহূর্তের জন্যে কান্না থামাল। ভিড় করে থাকা লোকগুলো গলা উটের মত লম্বা হয়ে গেল, মেয়েটা কী বলে শোনার জন্য। মফস্সলের মানুষের গলার স্থিতিস্থাপকতা শশাঙ্ক আগেও দেখেছে, আশ্চর্য হল না। এমন মুখরোচক গল্প শহরে রোজ-রোজ তৈরি হয় না। সোডিয়াম ভেপারের গুঁড়ো পড়ে লোকগুলোর চোখ চকচক করছে। আগ্রহে উত্তেজনায় মুখ হাঁ হয়ে দাঁত বেরিয়ে গেছে, কালো-কালো মাড়ি দেখা যাচ্ছে। প্রথম ছেলেটা জেরা করার মত করে বলল, “ঠিক করে বল, লোকটা তোর গায়ে হাত দিয়েছে?”
ডিসেম্বরের শুরু, শীত এখনো তেমন পড়েনি। তাও মেয়েটা একবার কেঁপে উঠল। তারপর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মাথা নিচু করল। ভিড়ের মধ্যে একটা চাপা রাগ আর অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল। একটি সাবধানি গলা বলল, “চাঁদুদা, কোনো ইনজুরি-টিনজুরি হয়নি তো? সমর ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। একবার দেখিয়ে নিই। পরে পুলিস কেস হলে...”
ডাক্তার পুলিশ ইত্যাদির কথা শুনে মেয়েটা আবার কাঁদার তোড়জোড় শুরু করল। চাঁদু মানে চন্দন নামের ছেলেটা মনে হয় এ পাড়ার স্বনির্বাচিত নেতা। সে বলল, “ডাক্তার-ফাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কী হবে? এ তো পরিষ্কার দেখাই যাচ্ছে...,” কী দেখা যাচ্ছে সে সম্বন্ধে কেউ খুব একটা নিশ্চিত না হলেও দুটো বিষয়ে সকলেই মোটামুটি একমত হল। এক, এটা একটা ভদ্রলোকের পাড়া। এ পাড়ায় মা-বোনেরা নিরঙ্কুশ নিরাপত্তায় বসবাস করে। এইসব নষ্টামি এখানে হরগিজ বরদাস্ত করা যায় না। দুই, এই ধরণের লম্পটদের উচিত শিক্ষা দেওয়া আবশ্যিক সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এ পুলিশে-টুলিশের কাজ নয়... তাছাড়া পাড়ার ছেলেরা আছে কী করতে? তাদেরও তো একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে!
চন্দন মেয়েটাকে বলল, “চল্ আমাদের সঙ্গে। বাঞ্চোতটার হাত ভেঙে দেব...”
ভিড়টা মিছিল করে অনিরুদ্ধর বাড়ির দিকে এগোল। শশাঙ্ক সরে দাঁড়াল। একবার ভাবল পুলিশের এমার্জেন্সি নম্বরে একটা ফোন করে। কিন্তু ঘটনার সত্যাসত্য না জেনে ফোন করাটা সমীচীন হবে কিনা বুঝতে পারল না। পুলিস এলে অন্য ধরণের ঝামেলা হবার আশঙ্কা আছে। অনিরুদ্ধ আদৌ বাড়িতে আছে কিনা তাও শশাঙ্কর জানা নেই। আসার আগে ফোন করেছিল। অনিরুদ্ধর ফোন স্যুইচ অফ দেখিয়েছিল। ভিড়টা অনিরুদ্ধর বাড়ির গ্রীলের গেটের সামনে এসে থামল। চন্দন দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা কলিং বেলটার ওপর হাত রাখল।
সদর দরজার ওপরে একটা আলো জ্বলে উঠল। বাইরে গ্রীলের সেফটি ডোর, ভিতরে কাঠের পাল্লা। কাঠের পাল্লার দরজাটা খুলে মুখ বাড়িয়ে অনিরুদ্ধ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইরে অন্তত দশ পনেরো জন লোক রাগে ফুঁসছে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। দূর থেকে অনিরুদ্ধর চোখেমুখে আতঙ্ক দেখতে পেল শশাঙ্ক। তার মনে হল পুলিশকে ফোন না করে ভুল করেছে। মারমুখী জনতা অনিরুদ্ধকে ছিঁড়ে খাবে। জনতা কোনও যুক্তি-তর্ক করে না, ওজর-অজুহাত শোনে না। তারা চোখে কালো কাপড় বেঁধে মারে।
ভিড়টা গ্রীলের গেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অনেকগুলো শক্ত হাত গ্রীল ধরে ঝাঁকাচ্ছে। পুরোন লোহার গেটটা ঝনঝন শব্দ করে কেঁপে উঠল। কিছু একটা উপায় করা দরকার। শশাঙ্ক পকেট থেকে মোবাইল বার করছিল। তার আগেই দেখল ভিড়টা আচমকা পিছু হটে আসছে। একটা গোলমাল, সমবেত ভয়ার্ত চিৎকার। সামনের লোকগুলো পিছনের লোকেদের ঠেলা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে পিছনে আসতে চেষ্টা করছে। কয়েকজন টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। কিছু লোক তাদের মাড়িয়ে গেল। ভাবল না কিছুক্ষণ আগেও তারা জিগ্রি দোস্ত ছিল।
এই ব্যাপারটাও মনে হয় জনতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। পালাবার সময় দিকশূন্য হয়ে ছোটে। তাকিয়ে দেখে না কার শরীরের ওপর পা রেখে যাচ্ছে। কিন্তু এদের হল কী? শশাঙ্ক নজর করে দেখল অনিরুদ্ধর গ্রীলের দরজায় সামনের দুটো পা তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মিশকালো প্রাণী। থাবা আর বুকের রঙ হালকা বাদামী। ধনুকের ছিলার মত টানটান শরীর। মাথায় প্রায় মানুষ-সমান। হিংস্র চোয়ালের আড়াল থেকে ক্যানাইন দাঁত বেরিয়ে এসেছে। সন্ধের আলো আঁধারিতে তার চোখ জ্বলছে। শশাঙ্কর চিনতে অসুবিধে হল না। সাড়ে চার বছরের জার্মান শেফার্ড, ব্ল্যাকি... তার জিনের নিচে পুঁতে রাখা অবিমিশ্র বিশ্বস্ততায় ভর দিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। সৎ প্রভুকে আড়াল করে নিঃশ্বাসের নিচে গজরাচ্ছে। তাকে উপেক্ষা করে গ্রীল ছোঁয় কার সাধ্য?
২
হেঁটে হেঁটে গলাটা শুকিয়ে উঠেছে। রাস্তাটা যেখানে নদীর ঘাট থেকে সিঁড়ি ভেঙে উঠে চট করে ঘিঞ্জি শহরে ঢুকে পড়ে, তার মোড়েই বশির মিয়াঁর চায়ের ঝুপড়ি। সামনে ধুলোর মধ্যে আম কাঠের বেঞ্চ পাতা। সেখানে গিয়ে বসি, পা ছাড়াই। ভোর বেলার নদী থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। খস খসে গলায় বলি – এই, একটা চা, এদিকে...। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি সানমাইকা-চটা টেবিলে ঠক করে কাঁচের গ্লাস নামিয়ে রেখে যায়। ছেলেটাকে আগে দেখিনি, মনে হয় বশির মিঁয়ার নতুন রিক্রুট। গ্লাসের মধ্যে ঝুপড়ির ভিতরের অন্ধকারের থেকেও কালো ক্বাথ। ছেলেটা বিরক্ত মুখে বলে - দুধ নাই, বিড়েলে মুখ দিছে। এক চুমুক দিয়ে দেখি হাকুচ তেঁতো। তাও গিলি, বরং নিজেকে জোর করে গেলাই। অর্ধেকের বেশি পেরে উঠি না।
আবার কাল ভোরবেলা আসব। আলো ফোটার আগে। আজকের পায়ের দাগের ওপর পা ফেলে। প্রাত্যহিক হাঁটাহাঁটি সেরে এই বেঞ্চে এসে বসব। শুকনো গলায় চায়ের অর্ডার করব। দুধ না দিক এরা লিকার চায়ে এক টুকরো বাসি লেবু তো ফেলে দিতে পারে। চট করে বাদামীর গাঢ়ত্ব কমে গিয়ে টলটল করবে তরল। আর আমি মুগ্ধ হয়ে আলোর বিকল্প দেখব। অন্ধকার দেখে-দেখে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। যদিও এখন আমি অন্ধকারকে আসবাবের মত ঠেলে সরাতে পারি। একা ঘরে অন্ধকারের মত ভারী বস্তু ঠেলাঠেলি করা সহজ নয়। তাছাড়া যতই চেষ্টা করো, তাকে কত দূর সরানো সম্ভব? ঘরের এক দেওয়াল থেকে অন্য দেওয়াল পর্যন্ত! তারপরই অন্ধকার বুকের ওপর চেপে বসবে। প্রেতিনীর মত খলখল করে হাসবে। আর তার গভীর থেকে উঠে আসবে মুখের মিছিল। দু-একটা মুখ বারবার ফিরে আসে। চোখ বন্ধ করে রাখলে জোর করে চোখের পিছনে এসে বসে থাকে। ঘুমের সময় কেউ যদি একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ঘুম আসে নাকি?
চা ছেড়ে রেখে এই সব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে অনিরুদ্ধ ফিরে যায়। রোদ চড়া হচ্ছে, দিনের বেলা ভয় নেই। রোজকার মত দু’খানা দরজার লক খুলে ঘরে ঢোকে। এক তলার বসার ঘরের জানলার পাশেই একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ। রথের মেলা থেকে কলমের চারা কিনে এনে পুঁতেছিল শ্যামলী। বছর সাত-আট আগে। সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ঝাঁকড়া পাতার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আলোর টুকরো মেঝের ওপর এসে পড়েছে। গাছটার ডালপালা বাউন্ডারি ওয়ালের ইট খসিয়ে দিচ্ছে। পাঁচিলের বাইরে একটা বারোয়ারী মালিকানার পুকুর। কোর্ট কাছারিতে ঝুলে আছে বলে এখনও বেঁচেবর্তে আছে। মাটি ফেলে বুজিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির পত্তন হয়নি। পুকুরের জলে ধাক্কা খেয়ে ঘরের ছাদেও আলোর নক্সা-বাহার। আলো আমার আলো... শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে খানিকটা আলো টেনে নেয় অনিরুদ্ধ। হাঁটতে যাবার জুতো খুলে রেখে তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকে হালকা হয়। প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা শুরু হয়েছে, যদিও এখনও নিয়ন্ত্রন-সাধ্য। চোখে মুখে জল দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিনের দুধ-কলা-কর্নফ্লেক্সের ব্রেকফাস্ট বোলের সঙ্গে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে জুত করে বসে। রকমারি খবরে পাতা ওলটায়।
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। অনিরুদ্ধ উঠে গিয়ে ভিতরের দরজাটা খুলল। গ্রীলের বাইরে একটা কম বয়সী সুশ্রী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিরুদ্ধকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “শ্যামলীদি আছেন? আমায় আসতে বলেছিলেন...”
শ্যামলী দশ দিন হল শিকাগো গেছে, নাতি সামলাতে। ফিরবে মাস তিনেক পরে। ছেলের মা, মেয়ের মা পালা করে সদ্যজাত শিশুটিকে লালন করবে, ছেলে-বৌ এই শর্তে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। অনিরুদ্ধর কাছে খবর পেয়ে মেয়েটা নিরাশ হল। রোদের তাপে মেয়েটা ঘামছে। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরা, কাঁধ থেকে যে হাত-ব্যাগটা ঝুলছে সেটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভারী। মেয়েটা সম্ভবত হাবিজাবি কিছু বেচতে এসেছে। হাতের রুমাল দিয়ে ঠোঁটের ওপরের ঘাম মুছে বলল, “কাকু একটু জল খাওয়াবেন, প্লিজ?”
অনিরুদ্ধ গ্রীলের দরজাটা না খুলেই ফিরে যাচ্ছিল। মেয়েটার জন্যে জল আনতে। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে জলের গ্লাস বাড়িয়ে দেওয়া যায়। পিছন ফিরতে গিয়ে দেখল ব্ল্যাকির চেন হাতে ধরে শশাঙ্ক এসে দাঁড়িয়েছে। শশাঙ্ক বলেছিল বটে ব্ল্যাকিকে আজ ছেড়ে যাবে। মন বদলে গ্রীলের দরজাটার তালা খুলল অনিরুদ্ধ। শশাঙ্ক ব্ল্যাকিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। অনিরুদ্ধ মেয়েটাকেও ডাকল। বলল, ভিতরে এসে বসতে। মেয়েটা ব্ল্যাকিকে দেখে ভয় পাচ্ছিল। ভিতরে এল না। বাইরে থেকে জল খেয়ে চলে গেল।
৩
ভিড়টা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। চন্দন তার দলবল নিয়ে মোটরবাইকে চেপে চলে গেছে। যাবার আগে শাসিয়ে গেছে, তারা ছেড়ে দেবে না। অনিরুদ্ধ কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ভাল কাজ করেনি। সময় বুঝে তারা এই হেনস্থা করার বদলা নেবে। মেয়েটা অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল। তার বয়স কম, সে বুঝতে পারেনি সাধারণত প্রতিটি মজার একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য থাকে। তারপর তা জোলো হয়ে যায়। তাছাড়া এই মজাটা হঠাৎ মাঝপথে থেমে যাওয়ায় ভিড়ের লোকজন নিতান্তই নিরাশ হয়েছে। সবাই যে যার মত চলে যাচ্ছে দেখে মেয়েটা ক্যাবলার মত বলল, “আমি এখন কী করব?”
কেউ তাকে উত্তর করলো না। শেষবারের মত তার নগ্ন কাঁধের দিকে তাকিয়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে পা চালাল। শশাঙ্ক দেখল মেয়েটা একা একা গিয়ে রাস্তার ধারে নিচু ইঁট বার করা পাঁচিলের ওপর বসল। মুখের মধ্যে সারা রাজ্যের ঘাম আর ক্লান্তি। শশাঙ্ক বুঝতে পারছিল না এই অবস্থায় তার কী করা উচিত। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে নাটক করছে। এমনিতেও দর্শক ছাড়া নাটক করা মুশকিল। মেয়েটা আপাতত নিজের হাতের পাতার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শশাঙ্ক নিজের গালে হাত বোলাল। কদিন দাড়ি-টাড়ি কাটা হয়নি। খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি বেরিয়েছে। তাছাড়া মেয়েটা তাকে দেখেছে মুহূর্তের জন্য। মনে হয় না চিনতে পারবে।
শশাঙ্ক এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার পাশে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “বাড়ি কোথায় তোমার?”
মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল। দু’-চোখে ভয় আর সন্দেহ। এই অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। শশাঙ্ক নিজের গায়ের আলোয়ানটা খুলে তার দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটা মৃদু আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত হাত বাড়িয়ে নিল। গায়ে জড়িয়ে বসল। চোখমুখ দেখে মনে হল কতকটা স্বস্তি পেল। এতক্ষণ যেন বে-আবরু হয়ে ছিল। সবাই জরীপ করছিল ঠিক কতটা লাঞ্ছিত হয়েছে। শশাঙ্ক তার দিকে তখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, “ভদ্রেশ্বর… ফিরতে হবে, নইলে মা চিন্তা করবে…”
শশাঙ্ক বলল, “একটা রিক্সা ডেকে দেব? স্টেশন তো অনেকটা রাস্তা…”
মেয়েটা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল, “না না, আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব…,” বোঝা গেল রিক্সা ভাড়ায় পয়সা খরচ করতে চায় না সে। শশাঙ্ক বলল, “ঠিক আছে, হেঁটেই চল। আমি স্টেশনের দিকেই যাব। তোমার আপত্তি না থাকলে, খানিকটা এগিয়ে দিতে পারি।”
মেয়েটা কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল। হিম পড়তে শুরু করলে মফস্সল শহরে রাত নামে তাড়াতাড়ি। রাস্তায় সাইকেল, রিক্সা, লোক চলাচল কমে আসছিল। শশাঙ্কর জানতে ইচ্ছা করছিল ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল। অথচ সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। মেয়েটা নিজের থেকেই বলল, “মানুষ যে কী করে এমন জানোয়ার হয়ে যায়!”
শশাঙ্ক কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। অনিরুদ্ধ তার স্কুলের বন্ধু। তবে মাঝে অনেকগুলো বছর তার সঙ্গে কোনও সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। এদিক-ওদিক পোস্টিং-এর খবর পেত। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে দেখা হয়ে যেত। এই পর্যন্তই। রিটায়ারমেন্টের পর অনিরুদ্ধ পাকাপাকি শহরে ফিরে এসেছে। পৈতৃক বাড়িটিকে সারিয়ে-সুরিয়ে বসবাস শুরু করেছে। শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল, “ওই বাড়িতে গিয়েছিলে কেন?”
মেয়েটা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “কোন বাড়ি… ওহ, শ্যামলীদির বাড়ি? শ্যামলীদি বলেছিলেন একটা কাজের সন্ধান দেবেন। গিয়ে শুনলুম শ্যামলীদি আমেরিকায়। শ্যামলীদির হাজব্যান্ড একদিন ফোন করে বললেন, সন্ধের দিকে গেলে শ্যামলীদির সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেবেন। তখন নাকি আমেরিকায় সকাল…”
“কথা হয়েছিল?”
“নাহ, কোথায় আর হল? ফোন পাওয়া যাচ্ছিল না। কুকুরটা খুব চেঁচাচ্ছিল। উনি বললেন, কুকুরটাকে খেতে দিয়ে আসি। আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গেলেন। আমি একাই ছিলাম… আচমকা পিছন থেকে…” মেয়েটা শিউরে উঠল।
শশাঙ্ক বলল, “থাক, আর বলতে হবে না… ”
কোনও কারণ ছাড়া ব্ল্যাকি সাধারণত চেঁচায় না। তার খাবার সময়ও মোটামুটি বাঁধা। অবশ্য ইদানীং একটু অস্থির হয়েছে। অনিরুদ্ধ বলছিল মেটিং করানো দরকার। মেয়েটা বলল, “হাত ছাড়িয়ে দৌড় লাগাই, পিছন ফিরে দেখিনি। হাতের নখ লেগে...”
শশাঙ্কর মনে হল না মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। তার চোখেমুখে এখনো আতঙ্ক লেগে আছে। শশাঙ্কর বাড়ি এসে গিয়েছিল। সে বলল, “আমি সামনে বাঁদিকের গলিতে ঢুকব। তুমি সাবধানে যেও।”
মেয়েটা ঘাড় নেড়ে এগোল।
শশাঙ্ক বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে অনিরুদ্ধকে ফোন করল। অনিরুদ্ধ সাড়া দিল এবার, বলল, “ফিরেছিস? কবে ফিরলি?”
শশাঙ্ক বলল না তার বাড়ির দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছে। বলল, “আর ক’দিন ব্ল্যাকিকে তোর কাছে রাখতে পারবি?”
আসলে শশাঙ্ক ভয় পাচ্ছিল চন্দনরা উপদ্রব করতে পারে। ব্ল্যাকি সঙ্গে থাকলে সাহস করবে না। যতই হোক ছোটবেলার বন্ধু। অনিরুদ্ধ যেন একটু ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে।”
৪
ব্ল্যাকি এমনিতে বেশ শান্তশিষ্ট। ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট নেই। দুধওলা কাগজওলাদেরও চিনে গেছে। তাদের দেখে কিছু বলে না। অনিরুদ্ধ বাইরে বেরোলে দরজার কাছে তার ফেরার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। দরজা খুলে ঢুকলে পা জড়িয়ে ধরে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ছায়ার মত নিঃশব্দে তার গায়ে-গায়ে লেগে থাকে। অনিরুদ্ধর এক-এক সময় মনে হয় ব্ল্যাকি তার শরীরের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। রাত্তিরে তারা দুজনে মিলে অন্ধকার ঠেলে। কখনো অন্ধকার পেরে ওঠে না, হেরে যায়। কোনও কোনও রাতে অবশ্য উলটোটাও ঘটে। যেমন হঠাৎই দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা একটি বালিকার যন্ত্রণা-বিদ্ধ মুখ ভেসে ওঠে, ভুস করে। নয়-নয় করেও বছর চার-পাঁচ হয়ে গেল। এখনও ঢেউয়ের আঘাতে অল্প-অল্প দোলে। মেয়েটার বাবা মিলিটারি ব্যারাকের কুক ছিল। রক্ষীদের লুকিয়ে মেয়ে-বৌয়ের জন্যে খাবার নিয়ে যেত। খবর এসেছিল মেয়েটা সন্ত্রাসী। আতঙ্কবাদের কোনো নিম্নতম বয়ঃসীমা নেই। যাদের ওপর আতঙ্ক দমন করার দায়, তারাও তেমন বয়স-টয়সের ধার ধারে না। তিনটি জলপাই রঙের পোশাক মেয়েটির রক্ত দেখার জন্য তার শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। তাদের চোখের জায়গায় ঘন অন্ধকার। মুখ চিনতে পারে না অনিরুদ্ধ। কেবল সাদা-সাদা দাঁত দেখতে পায়।
অন্ধকার জিতে গেলে ব্ল্যাকি খুব বিরক্ত হয়। আঁচড়ে কামড়ে অন্ধকারের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা করে। যেন অন্ধকারের অস্থি-মেদ-মজ্জা আছে, একদলা অন্ধকার দাঁতে ছিঁড়ে নিয়ে কড়মড় করে চিবোয়। পরের দিনটা চিড়চিড়ে হয়ে থাকে। এমনিতে সারাদিন বাড়িতে আছে কিনা বোঝা যায় না। একমাত্র মেয়েটা এলে ব্ল্যাকি খুব বিরক্ত করে। তেড়ে যায়। তাকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। মেয়েটা, সময়-অসময় নেই এসে কলিং বেল বাজায়। কী কুক্ষণে অনিরুদ্ধ বলেছিল শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলে জানাবে। প্রথম দিন সন্ধেবেলা শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলে রেখে দেবার সময় মনে করে বলেও ছিল, ও হ্যাঁ, তুমি কাকে কী কাজ দেবে বলেছিলে, সেই মেয়েটি এসেছিল। শ্যামলী নাতিকে নিয়ে ব্যস্ত। মনেই করতে পারলো না। জিজ্ঞেস করল – কার কথা বলছ? অনিরুদ্ধ বোঝাতে পারলো না। মেয়েটার নাম জেনে নিতে ভুলে গিয়েছিল। পরের বার এলে জেনেছিল – সুশীলা।
দু’-দিন পরে সুশীলা আবার এল, শ্যামলী কী বলেছে জানতে। অনিরুদ্ধ একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে রেখেছিল। সেটা গ্রীলের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দিল। বলল, শ্যামলী এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে। মেয়েটাকে ভিতরে ডাকলে ব্ল্যাকিকে চেনে বাঁধতে হয়। ব্ল্যাকি চেনে বাঁধা থাকতে বিশেষ পছন্দ করে না। সুশীলা ইতস্তত করে বলল, “ভিতরে আসতে পারি একটু? বাথরুমে যাওয়া দরকার ছিল।”
অনিরুদ্ধ কী বলবে? মফস্সল শহরে এমনিতেই পাব্লিক টয়লেট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মেয়েদের টয়লেটগুলো বিশেষ করে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে থাকে। ব্ল্যাকিকে চেনে বেঁধে রেখে এসে ডাকল, “এসো।”
সুশীলা হাতের ব্যাগটা নিয়েই বাথরুমে ঢুকল। অনিরুদ্ধ বুঝল, দরকারটা নিতান্তই জরুরী ছিল। ব্ল্যাকি সুশীলাকে দেখে চিৎকার করতে শুরু করেছিল। অনিরুদ্ধর কথাতেও থামছিল না। মেয়েটা বাথরুম থেকে চুল-টুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে বেরোল। গায়ের রঙ মাজা-মাজা হলেও দেখতে শুনতে মন্দ নয়। যৌবনের একটা নিজস্ব চটক থাকেই। সেটাই অনিরুদ্ধর চোখে লাগল। চলে যাবার পর অনিরুদ্ধ ব্ল্যাকির চেন খুলে দিল। ব্ল্যাকি তড়বড় করে গিয়ে সদর দরজা আঁচড়াতে লাগল। সাধারণত সে এমন করে না। সুশীলাকে তার কেন এত অপছন্দ অনিরুদ্ধর মাথায় ঢুকল না।
সেদিন স্নান করার সময় অনিরুদ্ধ শ্যাম্পুর বটলটা খুঁজে পেল না। যত দূর মনে পড়ল বটলটা ক্যাবিনেটের মধ্যেই রাখা ছিল। শ্যামলী চলে যাবার পর, বাড়িতে শ্যাম্পু খুঁজে পাচ্ছিল না। শ্যামলী কোথায় গুছিয়ে তুলে রেখে গেছে তার হদিস না পেয়ে নতুন একটা বটল কিনে এনেছিল। একদিনই মাত্র ব্যবহার করেছে। স্নান করে বেরিয়ে অন্য বাথরুমেও খুঁজল, ভুল করে যদি রেখে থাকে, পেল না। সুশীলা শ্যাম্পুর বটল ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যাবে এটা বিশ্বাস করতে অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু শ্যাম্পুর বটলটা হারিয়ে যাবার আর কোনো ব্যাখ্যা পেল না।
সেদিন রাত্তিরে অনিরুদ্ধ আর ব্ল্যাকি মানে ব্ল্যাকি আর অনিরুদ্ধ বিনিদ্র রাত্রি কাটাল। হয়তো দুজনেই সুশীলাকে বিশ্বাস করতে চাইছিল। অথচ পারছিল না। অবিশ্বাস তাদের গলা টিপে ধরছিল। চোখ বুজলেই মনে হচ্ছিল জলের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সুশীলা ক’দিন পরে আবার এল। বলল, ভদ্রলোক ওই ঠিকানায় থাকেন না এখন। জানতে চাইল ওঁর ফোন নম্বর পাওয়া যাবে কিনা। সকালের আলোয় তার ভাসা-ভাসা চোখ দেখে মনে হল না তার মধ্যে কোনও কপটতা আছে। অনিরুদ্ধ বলল জেনে রাখবে। সব থেকে ভাল হয় যদি সুশীলা কোনওদিন সন্ধেবেলা আসে। তাহলে সরাসরি শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলে নিতে পারবে।
সুশীলা যেদিন ফোন করে সন্ধেবেলা আসতে চাইল সেদিন সকাল থেকেই অনিরুদ্ধর গা গসগস করছিল। থার্মোমিটার চড়িয়ে দেখল একশ এক ডিগ্রী জ্বর। মাথা ভার, গলার কাছে ব্যথা, চোখ জ্বালাজ্বালা করছে। অনিরুদ্ধ খানিকটা অনিচ্ছা নিয়েই সুশীলাকে আসতে বলল। সুশীলা যখন এল অনিরুদ্ধ চা খাচ্ছে। ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রেখেছিল। জিজ্ঞেস করল, সুশীলা খাবে কিনা। সুশীলা আজ ঠোঁটে সামান্য রঙ লাগিয়েছে। কপালে বিন্দি, চুল পিছন দিকে টেনে পনিটেল করে বাঁধা। বুলবুলির লেজের মত পনিটেল নাচিয়ে বলল, খাবে। অনিরুদ্ধ কাপ নিয়ে আসার জন্য কিচেনে গেল।
ব্ল্যাকি যথারীতি চিৎকার জুড়েছিল। আচমকা তার চিৎকার থেমে গেল। অনিরুদ্ধর সন্দেহ হল। হাতের কাপ কিচেন প্ল্যাটফর্মের ওপর নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এসে দেখল – সর্বনাশ। ব্ল্যাকি চেন ছিঁড়ে ফেলেছে। লিভিং রুম থেকে একটা আর্ত চিৎকার এল। অনিরুদ্ধ জোর পায়ে লিভিং রুমে পৌঁছে দেখল বুক কেসের সামনে সুশীলা দাঁড়িয়ে। ব্ল্যাকি তার কাঁধের ওপর পা তুলে দিয়েছে। সুশীলার মুখের সামনে তার খোলা মুখ, লালা ঝরছে। অনিরুদ্ধ বলল, “ব্ল্যাকি, গো...,” ব্ল্যাকি একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল, নড়ল না। অনিরুদ্ধ কাছে গিয়ে তাকে দু’-হাতে টেনে সরাল। মেয়েটা ছাড়া পেয়েই দৌড়ল। ব্ল্যাকিকে শান্ত করতে করতে অনিরুদ্ধর চোখে পড়ল, বুক কেসের নিচের ড্রয়ারটা খোলা। ওইখানে দরকারি কাগজপত্র, ওয়ালেট ইত্যাদি থাকে। অনিরুদ্ধ চেক করে দেখল সব ঠিকঠাক আছে, যেমন থাকে। ভাগ্যিস!
৫
আজকাল ভোরবেলা নদীর ধারে হাঁটতে যাবার সময়ও ব্ল্যাকি সঙ্গ ছাড়ে না। অনিরুদ্ধ পিছন ফিরে তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু জানে ব্ল্যাকি আছে। নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করছে। বশির মিয়াঁর চায়ের ঝুপড়িকে পাশ কাটিয়ে অনিরুদ্ধ নদীর দিকে নেমে যায়। পলি মাটিতে মখমলের মত ঘাস জন্মেছে। অনিরুদ্ধর মনে হয় ঘাস-জন্ম ভাল। মাথার মধ্যে অহেতুক স্মৃতি-তন্তু বয়ে বেড়াবার দায় নেই। হাঁটতে-হাঁটতে মনে হয় শুধু ব্ল্যাকি নয় আরও কেউ তার পিছনে পিছনে আসছে। তাদের সাবধানে ফেলতে থাকা ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পায়। দিন দুই হয়ে গেল, ছেলেগুলো সামনে আসছে না। অনিরুদ্ধ জানে চন্দন ও তার দলবল। গা করে না। এদের সামনে আসার সাহস নেই। যদি সাহস জুটিয়ে কোনদিন সামনে আসে দেখা যাবে। শ্যামলী ফোনে জিজ্ঞেস করছিল সুশীলার কাজের ব্যাপারে। সুশীলা আর ফিরে আসেনি। অনিরুদ্ধ নিশ্চিন্ত হয়েছে। ব্ল্যাকিও।
বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। অনিরুদ্ধর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সপ্তাহ খানেক পরে চন্দনরা সামনে এসে দাঁড়াল। তিনটে ছেলে, চোয়াড়ে মুখ, চোখে ভয়জনিত সতর্কতা। দেখে মনে হল তৈরি হয়ে এসেছে। অনিরুদ্ধ থেমে পড়ল। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। এ সময় খুব কম মানুষই নদীর ধারে হাঁটতে আসে। চেঁচিয়ে ডাকলে কারো সাড়া পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কেউ শুনতে পেলেও হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। কে আর উটকো ঝামেলা নিতে চায়?
অনিরুদ্ধ স্বভাবমত দ্রুত পজিশন নিচ্ছিল। আচমকা তার কাঁধের ওপর দিয়ে একটা কালো বিদ্যুৎ লাফ দিল। আপৎকালে জার্মান শেফার্ড মালিকের হুকুমের তোয়াক্কা করে না। মাঝখানের ছেলেটা মাটিতে ছিটকে পড়ল। তার শরীরের ওপর ব্ল্যাকি ঝুঁকে পড়েছে। সে দুহাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। অনিরুদ্ধ জানে লাভ নেই, অবধারিতভাবে ছেলেটার গলার নলিতে ব্ল্যাকির দাঁত বসে যাবে। বাঁ-দিকের ছেলেটা ব্ল্যাকির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার হাতে একটা লোহার রড। ব্ল্যাকি ঘাড় ফেরাল বটে, কিন্তু ছেলেটা সময় পেয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ বুঝল লাফ দেবার সময় পেলেও আঘাতটা ব্ল্যাকি এড়াতে পারবে না।
কিছু করার নেই। এই মুহূর্তে ব্ল্যাকিকে সে সাহায্য করতে পারবে না। চন্দন শরীরের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার হাতে ছুরি ঝলসে উঠতে দেখল অনিরুদ্ধ। অস্ত্র সমেত হাতটা উঠছে। অনিরুদ্ধর বাঁ হাত চন্দনের উদ্যত হাতটাকে ব্লক করল। ছুরিটা ছিটকে গেল। চন্দন বাধা পেয়ে এক পা পিছোল। ওইটুকু স্পেসই দরকার ছিল। অনিরুদ্ধর ডান হাতের পাঞ্জা চন্দনের কণ্ঠনালীর ওপর আছড়ে পড়ল। একটা ভোঁতা শব্দ, চন্দন কাটা পড়া গাছের মত ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ল। অনিরুদ্ধ পিছন ফিরে দেখল না। ঠিক জায়গায় ঘা লাগলে দেখার মত বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
ব্ল্যাকির মাথাটা থেঁতলে গেছে। গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। যে ছেলেটা রডটা চালিয়েছিল তার শরীরটা ব্ল্যাকির শরীরের নিচে দেবে আছে। শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকি লাফটা দিতে পেরেছিল। ছেলেটার মাথাটা অস্বাভাবিক কোণে হেলানো। অনিরুদ্ধ ছেলেটার গলার পাশে আঙুল রেখে সাড় পেল না। ব্ল্যাকির গলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ উঠে আসছিল। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বেচারা যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। চন্দনের হাত থেকে খসে পড়া ছুরিটা খুঁজল অনিরুদ্ধ। দেখল, ঘাসের ওপর বিশ্বের নির্লিপ্তি মেখে পড়ে আছে। ছুরিটা তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে ব্ল্যাকিকে “সরি” বলল, যেমন সচরাচরের রীতি।
ব্ল্যাকির যন্ত্রণার উপশম হল। আরও দু-একটা আবশ্যিক কাজ বাকি। অনিরুদ্ধ শিক্ষিত দক্ষতায় কাজগুলো সেরে ফেলছিল। বডিগুলো টানতে টানতে নদীর ধারে নিয়ে যাচ্ছিল। পাশাপাশি কাদামাটির ওপর শুইয়ে রাখছিল। জোয়ারের জল বাড়ছে। জল একবার টান দিলে কে কোন ঘাট-আঘাটায় গিয়ে ফুলেফেঁপে ভেসে উঠবে কে জানে? ডাঙায় না উঠলে মাছে হাঙরে ছিঁড়ে খাবে, খাক গে। কী যায় আসে? ছেলেগুলোর মরবার পাখা গজিয়েছিল, মরেছে। এদের বাঁচা মরার হিসেব রাখার জন্য কেউ বসে থাকে না। ব্ল্যাকির জন্য অল্প মন খারাপ হল। অনিরুদ্ধ মাথা ঝাঁকাল। মন খারাপটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল।
আসলে ব্ল্যাকিকে নিয়ে বরাবরই একটা দ্বিধার মধ্যে ছিল অনিরুদ্ধ। কুকুরদের ঘ্রানশক্তি তীব্র হয়। তিনটে জলপাই পোষাকের মধ্যে একটাতে অনিরুদ্ধর নিজের ঘামের গন্ধ লাগা ছিল। মিলিটারি ব্যারাকের কুকের মেয়েটার রক্তের গন্ধও অবশিষ্ট ছিল মনে হয়। একদিন যখন অনিরুদ্ধ আলমারি খুলে দাঁড়িয়েছিল ব্ল্যাকি বুঝে গিয়েছিল। রিটায়ারমেন্টের পর শ্যামলী ইউনিফর্মটা কাচিয়ে ইস্ত্রি করিয়ে ওয়াড্রোবে টাঙিয়ে রেখেছিল। নাকের কাছে নিলে এখন ন্যাপথালিনের গন্ধ আশ্বস্ত করে বটে, কিন্তু পোশাকটার ভিতরের অন্ধকার ধোয়া যায়নি। কুকুরটা তার সঙ্গে থাকার পর থেকে অন্ধকারটা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে যাচ্ছিল, নিঃসন্দেহে...। কুকুরটা যেন একটু একটু করে অন্ধকার গিলে খাচ্ছিল। তার জন্য সে ব্ল্যাকির কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছিল যে ব্ল্যাকি দিনদিন অনিরুদ্ধর শরীরের সংগেও জুড়ে যাচ্ছিল। বেশি আদর পেলে যা হয়! ‘ব্ল্যাকি, গোওওও.. গো এওয়ে...,’ বলে হাঁক দিলেও ছেড়ে যাচ্ছিল না।
কাঁহাতক একটা কালো কুকুরকে শরীরের সংগে লেপ্টে রাখা যায়! বলতে নেই, অনিরুদ্ধ বেশ অস্বস্তির মধ্যে ছিল। সুশীলার ঘনঘন যাতায়াত অস্বস্তিটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। নিজেকে বোঝাল, ব্ল্যাকির মরে যাওয়াই উচিত ছিল, তাই না? না হলে হয়ত কোনদিন তাকে নিজে হাতে বিষ দিতে হত। এই ভাল হল। নির্ঝঞ্ঝাট মৃত্যু। এখন অনিরুদ্ধর অনেক হালকা লাগছে। জোয়ারের টান বাড়ছে। নদীর উল্টো পারের অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে, আলো ফুটছে। অনিরুদ্ধ ফেরার পথ ধরল। বশির মিয়াঁর ঝুপড়িতে আলো-আলো চা খেয়ে বাড়ি যাবে। বশির মিঁয়ার ঝুপড়ির ছেলেটা চালাক চতুর হয়ে উঠছে। বেড়াল তাড়াবার কায়দা কানুন শিখে গেছে। গ্লাস ভর্তি করে দুধ-চা এনে দিল, বলল, আদা ছেঁচে দিছি, সর্দির মুখে ভাল লাগবেনে।