আজকে যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন, বা জড়িয়ে গিয়েছেন, তা সে কবিতা-গল্প-উপন্যাসই হোক অথবা গুরুগম্ভীর নিবন্ধ বা রম্য-রচনা বা ভ্রমণ কাহিনীই হোক, তাঁরা লক্ষ করবেন যে আমাদের লেখার মাধ্যমটিকে এখন আর মাত্র দোয়াতের কালি, লেখার কলম বা কল্পলোকের ঘোড়ার মতো ব্যবহার করে পার পাওয়া যায় না - মাধ্যম দাবি করে যে রচয়িতা তার দিকেও তাকাবেন, ভাষার কথা ভাববেন। আবার অন্যপক্ষে যাঁরা এতদিন মাত্র বিদেশী ভাষা শেখানো বা দ্বিতীয় ভাষা-শিক্ষণ ও ভাষাতত্ত্বের চর্চা করে এসেছেন এবং ভাব করেছেন যে লেখালেখির পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ রাখার দরকার নেই - কেননা তাঁরা জেনে বা না-জেনে লিখতে গিয়ে ব্যাকরণ মানতে পারেন না বা প্রায়শঃই নিয়ম উল্লঙ্ঘন করেন, তাঁদের পক্ষেও আর সাহিত্যের দিকে বা সৃজন-প্রক্রিয়ার দিকে তাকানোর ব্যাপারটা এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ, কিছুদিন আগেও আমরা সবাই দেখেছি এই দুটি দলের মধ্যে প্রায় অহি-নকুল সম্বন্ধ। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে প্রাচীন গ্রীসে হোক বা প্রাচীন ভারতে তা কখনই হতো না । তবে আজকের প্রচার, প্রসার ও প্রকাশ-মাধ্যমের মধ্যে যে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে তা সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে । একই ভাবে, ভাষাতত্ত্ব বা ভাষা-বিশ্লেষণকেও সাহিত্যে নতুন অভিব্যক্তির ধরণ, সংক্ষিপ্ত রূপ, আভিধানিক মুদ্রা ইত্যাদি দেখি তখন এই প্ল্যাটফর্ম এবং প্রসঙ্গগুলি অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে রয়েছে এই বিষয়ে আলোচনা।
ভাষা-শিক্ষণ ও ভাষাতত্ত্বের শিক্ষা বা চর্চা এখন আর সাহিত্যের ক্ষেত্রের দিকে তাকানোর ব্যাপারটা এড়াতে পারে না। কিছুদিন আগেও দেখেছি এই দুটি অনুভাগের লোকদের মধ্যে প্রায় অহি-নকুল সম্বন্ধ। প্রাচীন গ্রীসে হোক বা প্রাচীন ভারতে হোক তা কখনই করা সম্ভব হতো না। তবে ইন্টারনেটে E-Zines-এর প্রবর্তন, অথবা অডিওবুকগুলির পাশাপাশি গল্প বলার প্ল্যাটফর্মগুলির জন্য বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ইদানিং ব্লগিং, বা ইনস্টাগ্রাম (যেখানে আমরা আজকাল 'ইনস্টাপোয়েট্রি' দিয়ে প্লাবিত হয়েছি) এবং এর সাথে বিভিন্ন অ্যাপ, কিন্ডল প্ল্যাটফর্ম, বা ট্যাবলেট, স্যাটেলাইট এবং কেবল-অন-ডিমান্ড টেলিভিশন সহ স্মার্টফোনের প্রবর্তন--এই সব কিছু মিলে সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই ভাবে, ভাষাতত্ত্ব বা ভাষা-বিশ্লেষণকেও সেই অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত বা ঢালাই করতে হবে কারণ যখন আমরা নতুন অভিব্যক্তির ধরণ, সংক্ষিপ্ত রূপ, আভিধানিক মুদ্রা ইত্যাদি দেখি তখন এই প্ল্যাটফর্ম এবং প্রসঙ্গগুলি অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এর সাথে যোগ করা যাক বাজারের বিভাজন এবং অ্যালগরিদমিক মার্কেটিং-কে। আমরা লক্ষ্য করবো যে একুশ শতকে অনেকগুলি বড়ো পরিবর্তন ঘটেছে যেগুলিকে ধরলে এই চ্যালেঞ্জটিকে আরও বিরল করে তোলে। ওদিকে, সারা বিশ্বে সাক্ষরতার পরিসংখ্যান বৃদ্ধির সাথে সাথে উপযুক্ত পঠন সামগ্রীর চাহিদাও বহুগুণ বেড়েছে। একসময় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সাহিত্যের বা সৃজনী ধারা ও বইগুলো আজ আবার দেখা দিতে শুরু করেছে। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, আর. স্কট বেকার তাঁর ‘থ্রি পাউন্ড ব্রেন’ শিরোনামের ব্লগে বলেছেন - "সংস্কৃতির পুরানো রেইনফরেস্টগুলি এখন মুছে ফেলা হয়েছে, এবং সাহিত্য ও তার বোঝদার সদা-মেলে দেওয়া হাত এবং জড়িয়ে ধরতে চাওয়া বাহু দিয়ে, এখন এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছে যা আর কেউ আরোহণ করতে পারে না এবং দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে যেখানে আর কিছু দেখতেও পায় না।"
এই প্রসঙ্গে বলতে পারি--যদি কেউ এবিষয়ে লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও বই-বিক্রেতাদের মধ্যে একটি 'কাল্পনিক সংলাপ' সম্পর্কে চিন্তা করে, আমরা সম্ভাব্য দৃশ্যটি কিছুটা এভাবে দেখতে পাবো--যেমন:
• "সমস্ত পাঠক কোথায় গেল?" - অনেক লেখকেরা হয়তো জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু লেখকের চেয়ে বেশি প্রশ্ন করেছেন প্রকাশক ও বইমেলার আয়োজকেরা।
• "কার পড়ার সময় আছে?" – কেউ কেউ হয়তো দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে, “আগে পাঠকেরা ইস্কুলের শ্রেণীকক্ষে বা পরিবার-জীবনে যা পায়নি তা সাহিত্যে বা লেখায় খোঁজার চেষ্টা করত। কিন্তু আমরা আর কোনও কিছু খুঁজতেই আর সাহিত্যের উপর নির্ভর করি না।"
• এটা সত্যি, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কারণ আমরা যাকে বলতে পারি 'অনুসন্ধানের শিল্প' অথবা আজকের সময়ে খোঁজ করার বিজ্ঞান - তার ওপরেও পুরো দৈত্যাকার একটা বাণিজ্য-সংস্থা রয়েছে - একটি ঠিকানা খুঁজে পেতে, বা দীর্ঘদিনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধু বা এমনকি একজন ভুলে যাওয়া লেখককে চিনতে জানতে, আমরা এখন ফেসবুক ঘাঁটতে বা গুগল করতে অভ্যস্ত। বুদ্ধিমান অনুসন্ধানকারীদের জন্য, এখন হয়তো আরও উপযুক্ত সার্চ ইঞ্জিন তৈরী হয়েছে ৷
"ভাবছি - সেক্ষেত্রে - সাহিত্য কি এখন একটি বিলাসবহুল বস্তু হয়ে উঠেছে, সাধারণ মানুষের যার আর প্রয়োজন নেই - যা বর্তমান সময়ে কেবলমাত্র লেখকদেরই তাদের নিজস্ব কল্পনাকে দূর-দূরান্তে চালাতে দেয়ার পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে?"
• উপরোক্ত কল্পিত আলোচনা যেদিকে এগোচ্ছে, সেইমতো একটা উপসংহার বা সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে, আর তা হলো: “আচ্ছা, তাহলে তো আজকের সময়ে আমরা সাহিত্যকে একটা নতুন কাজ দিতে পারি। এটিকে এখন আর নতুন কিছু খুঁজে বের করতে হবে না - তবে এটি পাঠকদের জন্য এখনও অনেক ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে। এটি খনন করতে পারে, অর্থাৎ কিনা ভিড়ের মধ্যে থেকে আমাদের অভীষ্ট কথা বা চিন্তা বা বস্তুকে খুঁজে বের করে দিতে পারে বা দাগিয়ে দিতে পারে বা বেশ সহজেই অন্য কথায় বর্ণনা করতে পারে, কেননা এটিকে বাছাই করার কাজে লাগানো যেতে পারে।"
আজকের যুগে সব ধরনের সৃজনশীল প্রচেষ্টার বা ক্রিয়ার একটি 'চাহিদা ও সরবরাহে'র দিক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আগেরকার যুগে 'প্রয়োজন'-ই ছিল একটি এমন চালিকা শক্তি যা আগেকার কালে চাহিদা ও সরবরাহের অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার দিকটা দেখে নানান ধরণের সিদ্ধান্ত নিত। ভাল লেখা, গ্র্যান্ড থিয়েটার, প্রশান্তিদায়ক সঙ্গীত বা শিল্পের দুর্দান্ত বহিঃপ্রকাশ - এ-সবই আমাদের জীবনের 'প্রয়োজন' হিসাবে এক সময়ে বিবেচিত হয়েছিল। তাই ১৯-শতক পর্যন্ত লেখালেখির দুনিয়া এবং লেখকরা এ থেকে খুব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে উন্নতি লাভ করেন ।
বিংশ শতকে দেখা গেল এসেছে একটা বিশাল পতন ও পরিবর্তন, রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং মহান বিশ্বাসঘাতকতা -আবার সেই সঙ্গে শিল্প-বিপ্লবও দেখা গেছে। এই শিল্প বিপ্লবই প্রধান অর্থনৈতিক চালক হিসেবে আমাদের ‘চাই’-কে বা চাওয়া-কে তুলে ধরেছে। তাই ধরে নিচ্ছি যে লেখা এখন একটি বিলাসবহুল সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে, এর পরিণতি হল তারা এখন চাহিদার যুগের প্রয়োজনীয়তাগুলিকে পূরণ করে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে। প্রকাশকরা এখন বিপুল পরিমাণে সম্ভাব্য ক্রেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বাজারের ভিত্তিতে কোনও রচনা বা রটনা বা ছবি/ছায়াছবি বিক্রি ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করবে। এটি সেই সব 'লক্ষ্যগুলি'-কে বা অবধারণাগুলিকে চেপে ধরবে বা তাদের কব্জা করতে চেষ্টা করবে যে কথা বা চিন্তাগুলিকে তারা আগে কখনই নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারতো না। যার জন্য তাদের ব্যাখ্যা বা পরিভাষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কোনও ধরণের বিশ্লেষণ তারা করতে পারতো না - কারণ এবিষয়ে কোনও টেঁকসই বা হার্ড ডেটা-বেস তাদের ছিলো না - ফলে তারা শুধুমাত্র 'অনুমান'-এর উপর নির্ভর করে সেই সব বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতো। অনেক বড়-বড় প্রকাশক এবং বিক্রয় আউটলেট কিভাবে তৈরি হলো এবং কেনই বা সফল হলো তার বিনির্মাণ পদ্ধতির জন্য পুরোপুরি আন্দাজের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা হতো - আগেকার সময়ে লেখার এই একটা উপযোগিতা ছিল।
একটি তথ্যসমৃদ্ধ যুগে, যাকে বলা হয় ইনফরমেশন এইজ - যাকিছু 'সঠিক' যা 'আছে' তার উপর আঘাত করার প্রক্রিয়া বা ক্ষমতা হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ - সঠিক উদ্ধৃতি, বা সঠিক দিকনির্দেশ, বা সঠিক পদক্ষেপ, সঠিক বিশেষণ এবং অভিব্যক্তি সহ। এই সময়ের আগে, বা ঠিক যখন বিনোদন শিল্প দর্শকদের কল্পনাকে জাগিয়ে তুলতে লেখার ব্যবহার করার বিষয়টি আত্মস্থ করে নিয়েছিল, চ্যালেঞ্জ ছিল 'কি চাই?' এবং 'কি প্রয়োজন?'-এদুটির মধ্যেকার ব্যবধানটিকে সনাক্ত করা। সংবাদপত্র গোষ্ঠী বা সিনেমার প্রযোজকেরা লেখকদের 'নিযুক্ত' করতো - যাদের দায়িত্ব ছিল সাধারণ মানুষের জীবনে কী বা কি-কি 'অভাব' আছে তা চিহ্নিত করা - টাকা-পয়সা বা অর্থ, প্রেম-ভালোবাসা বা রোমান্স, যাকে হিন্দিতে বলে 'দিখাওয়া' বা ঐশ্বর্য প্রদর্শন, এমনকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের অজানা এবং অপবিত্র সংযোগ এবং নানান ধরণের নেটওয়ার্ক ইত্যাদি। - যার জন্য তারা সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিল। তখন যে বটতলার উপন্যাস বা পাল্প ফিকশনস এবং বেস্ট-সেলার লেখা হতো সেই সব গল্প ও ছবিগুলি সরবরাহ করা এই লেখকীয় ক্ষমতার উপর উন্নতি করেছে সে-যুগে।
এই সব বইয়ের সরবরাহকারী এবং ক্রেতারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রেরক এবং প্রাপকের মতো। বুহলার-জাকবসনের অর্গানোন ম্যাট্রিক্সে এই যোগাযোগের মূল সৃজক বা বক্তারা হলেন আমাদের লেখক সম্প্রদায়, যাঁরা বক্তব্য -সুর-গান-সমৃদ্ধ গীতি কবিতা বা গল্পের 'প্রেরক'ও বটে। এবং তাঁরা প্রাপক পাঠক বা রিসিভারের সঙ্গে নিজেদের রচনার মাধ্যমে এই কম স্থিতিশীল সংযোগের এই সম্ভাবনাকে নিয়েই আনন্দে মেতে থাকতেন।
তাই তাত্ত্বিকভাবে, লেখকেরা সর্বদা এমন একটি অবস্থান নিতেই পারেন যে তিনি বা তাঁরা 'নিজের (নিজেদের) জন্য লেখেন', তাঁদের ইচ্ছা এবং অভিনব চিন্তাধারা বা কল্পনা অনুসারে, বা তাঁরা যা মনে করেন সাধারণ মানুষের জীবনে ফাঁক রয়ে গেছে সেটা বুঝে - এবং তাদের (মানে, সাধারণ মানুষের) চাওয়ার হিসাবকে উপলব্ধি করে। লেখকরা সেই সময়ে এই বিশ্বাস করেছিলেন যে সিস্টেমের অনিশ্চয়তা বা অদক্ষতা কোনো না কোনোভাবে তাদের 'তাদের পাঠকদের খুঁজে পেতে' অনুমতি দেবে। সেই সব দিনগুলিতে, ক্রেতা-গ্রহীতারাও প্রায়শই বই-বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করতেন এবং সেইসাথে স্থিতিশীল যোগাযোগমূলক সম্পর্কের চেয়ে কম 'মীমাংসা' করার জন্য অনুকূল পর্যালোচনার উপর নির্ভর করতেন এবং তাই নতুন লেখককে কেনা বা পড়ার জন্য ঝুঁকি নিয়েও নতুন নতুন সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার জন্য আরও উন্মুক্ত হতে পারতেন।
সেযুগে বই (অথবা সিনেমা) সরবরাহকারী-প্রকাশকেরা ও প্রযোজকেরা, ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্রের সাথে যোগসাজশ করে, তাদের বইয়ের জন্য অনুকূল সমালোচনা ছাপার অক্ষরে পাওয়ার জন্য কারসাজি তো করতেনই - বরং এই পদ্ধতির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতেন। গার্ডিয়ান বা টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টে সমালোচনা উল্লেখ ও উদ্ধৃতিগুলি তাদের বইকে বেস্ট-সেলার বা সেরা-বই হিসাবে প্রচার করার জন্য বইয়ের প্রচ্ছদেও সেসব চেপে দিতেন।
কিন্তু গত দুই দশকে, অ্যামাজন এবং ফ্লিপকার্টের চয়নিত পছন্দগুলির অন্তর্জাল পত্রে একটি বইয়ের ছবির নিচে 'আপনিও নিজের পছন্দ ব্যক্ত করতে পারেন...' - কথায় বা ইমোজি দিয়ে বা তার বৈশিষ্ট্য মত বোতাম টিপে। এই লাইক করা বা পছন্দ করার পদ্ধতি যোগ করে এঁরা যেন বই-বিক্রির গেমটিকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এবং বইয়ের সারাংশ তৈরী করা হচ্ছে ক্রেতাদের লক্ষ্য করে এবং তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কিছু পছন্দের অ্যালগরিদম পার্সিং-এর উপর নির্ভর করে যা এই আধুনিক ব্যবসায়িক সংস্থারা বলছে তাদের 'সহায়তা করেছে'। তারা ঠিক কি চান এই সঙ্গে, এই বিপণন অ্যালগরিদমগুলি যতক্ষণ না কেউ ওয়েব-প্ল্যাটফর্মে স্মার্ট বিক্রয় কৌশল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ততক্ষণ অবধি তাদের পাকাতে থাকতে হবে৷
প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে 'পাঠ্য'কে শ্রুতি (অর্থাৎ 'যা শোনা যায়') এবং স্মৃতি (অর্থাৎ 'যা মনে রাখা হয় বা হতে থাকে') এই ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে, অনেকগুলি সংস্কৃত গ্রন্থকে বলা যেতে পারে 'উদ্ঘাটন' এবং স্মৃতি বা 'স্মরণ'-নির্ভর - যেমনটা জন গ্রাইমস এবং অনুযায়ীরা যা ২০০৬-এ : ৩৫-৩৬ পৃষ্ঠায় দেখিয়েছেন। অর্থাত্ এক্ষেত্রে পাঠ্যগুলি স্মৃতি বা ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে রচিত, পুনর্লিখিত ও পরিবর্ধিত হয় - যেখানে পরেরটির ভূমিকা প্রাথমিক পাঠের উদ্ঘাটন ব্যাখ্যা, বিস্তারীকরণ এবং স্পষ্টীকরণ-এর উপর নির্ভর করে করা হয়, উদাহরণ হলো পুরাণ, মনু-স্মৃতি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং তান্ত্রিক গ্রন্থাবলী। শ্রুতি এবং স্মৃতির মতোই, ভারতীয় লেখার বৌদ্ধ তিব্বতি সংস্করণগুলিকেও ‘কাঞ্জুর’ (bka’ ‘gyur - বুদ্ধের আদেশ) এবং ‘তাঞ্জুর’ (bstan’gyur) বলা হয়ে থাকে - যেখানে পরবর্তী শিক্ষকদের দ্বারা প্রদত্ত মতবাদনির্ভর শিক্ষা দেওয়া হতো; এভাবে সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রের তিব্বতি সংস্করণগুলি শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল ।
ভারতীয় গ্রন্থের একাধিক রেফারেন্স এবং ক্রমবর্ধমান জটিলতা যাকে আমরা মাল্টিপল নেস্টিং পদ্ধতি বলতে পারি, সেগুলি পরবর্তী লেখকদের এই সৃজনভূমিতে প্রবেশ এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য একটি কৌশল হিসাবে কাজ করেছিল। এটি একটি পৃথক বিষয় যে গ্রেকো-রোমান এবং ভারতীয় ঐতিহ্য উভয়ই বিশ্বাস করেছিল যে লেখা বা কৃতি মানুষকে তাদের স্মৃতি বা স্মৃতির উপর নির্ভরতা থেকে দূরে রাখতে পরিচালিত করবে।
এই বার একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে আসবে, এবং আমরা এটিকে দূরে সরিয়ে দিতে পারি না: সাহিত্যকে (বা চলচ্চিত্র বা থিয়েটার, সেই একই ভাবে - মূল সাহিত্যপাঠ-নির্ভর হলে) কি আমরা সরাসরি 'ম্যানিপুলেশন' হিসাবে বিবেচনা করতে পারি - কারণ পশ্চিমা তত্ত্বে অনেকে সাহিত্যকে সর্ববৃহৎ 'ম্যানিপুলেশন' বলেছেন? এমনটা - মানে মুখের থেকে বিকৃত করার কাজ যে কখনো হয়নি তা নয়। আবার এমনও নয় যে এমন সম্ভাবনার কথা কেউ ভাবেনি।
প্রাচীন ভারতে, নিজের নাম না লিখে 'অন্য কেউ' হিসাবে লেখার প্রবণতা একটি পরিচিত ব্যাপার - এবং এটি নিজের সবে লেখা পাঠ এবং গল্পকে বহু দূর দূরান্তরে প্রসারিত করার ঘটনা সাধারণ ব্যাপার ছিল। তেমনি ভাবে অসংখ্য নাটক এবং কল্পকাহিনী বা উপাখ্যান প্রাচীন মহাকাব্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে দুটি মগধন ভাষা - বাংলা ও মৈথিলীতে মধ্যযুগে এই জন্য তেরো জন চণ্ডীদাস এবং তিন জন বিদ্যাপতি ছিলেন।
যাইহোক, পরবর্তীকালের পাঠ্যের লেখকরা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান এবং প্রশংসিত পাঠ্যগুলিতে একাধিক ছাঁচ তৈরি করতে ও এতে তাদের লেখা যুক্ত করতে থাকেন, যেমনটি রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৯১০) তাঁর রামায়ণ ও মহাভারতে উল্লেখ করেছেন:
The real Epic ends with the war and the funeral of the deceased warriors. Much of what follows in the original Sanscrit poem is either episodical or comparatively recent interpolation. The great and venerable warrior Bhishma, still lying on his death-bed, discourses for the instruction of the newly crowned Yudhishthir on various subjects like Duties of Kings, the Duties of the Four Castes, and the Four Stages of Life. He repeats the discourse of other saints, of Bhrigu and Bharadwaja, of Manu and Brihaspati, of Vyasa and Suka, of Yajnavalkya and Janaka, of Narada and Narayana. He explains Sankhya philosophy and Yoga philosophy, and lays down laws of Marriage, the laws of Succession, the rules of Gifts, and the rules of Funeral Rites. He preaches the cult of Krishna, and narrates endless legends, tales, traditions, and myths about sages and saints, gods and mortal kings. All this is told in two Books containing about twenty-two thousand couplets, and forming nearly one-fourth of the entire Sancrit Epic!
পরম্পরাগতভাবে, সবাই একমত যে সাহিত্য - বিশেষ করে ইংরেজির সাহিত্য, বা সাহিত্য অধ্যয়ন – যেমন কমনওয়েলথ সাহিত্য বা এশিয়ান স্টাডিজ, ইংরেজি মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ বিশেষ। কারণ অনেক মহাদেশ থেকে ইংরেজিতে লেখার প্রায় ক্রমাগত বর্ষণের মত হয়েছে এবং আরও অনেক কিছু শব্দ-পদবন্ধ বা বাক্য-সংরচনা এই ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আবার অনেক ডিভাইস এবং প্ল্যাটফর্ম, ইংরেজিতে সাহিত্য অধ্যয়নের কিছু অতিরিক্ত সমস্যাও তৈরি করেছে ৷ এই চ্যালেঞ্জটি কীভাবে কাটিয়ে উঠতে হয় সে সম্পর্কে সাম্প্রতিক অনেক পরামর্শ ইদানিং এসেছে ও আসছে। যেমন একটি হলো Nur & Nor-এর নিবন্ধ (2023) যেখানে ওঁরা পরামর্শ দিয়েছেন যাকে তাঁরা 'The Systematic Literature Review' (SLR) বলেছেন। এই SLR-কার্যকলাপ যাকে তাঁরা নাম দিয়েছেন PRISMA ফ্রেমওয়ার্ক, সেখানে SLR পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং মেটা-বিশ্লেষণের জন্য রচয়িতার পছন্দের রিপোর্টিং আইটেমগুলিকে অনুসরণ করে (PRISMA)৷ এতে নতুন যেটা হলো এঁদের তার প্রাপ্য ক্রেডিট দেওয়ার জন্য বলতে হয়: তাঁরা আমাদের একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় একটি গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা সামনে এনে দেন - পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং মেটা-বিশ্লেষণ, প্রাসঙ্গিক নিবন্ধগুলির অনুসন্ধান, নির্দিষ্ট মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে সেগুলিকে ফিল্টারিং এবং তাদের গুণমান মূল্যায়ন সহ। তবে চ্যালেঞ্জ বা সমস্যাগুলিকে শুধুমাত্র তিনটি সম্ভাবনা বা কারণের মধ্যে নির্দিষ্ট রাখেন : ছাত্র-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ, শিক্ষক-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ, এবং বাহ্যিক-স্থিতি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমার মনে হয় এই পদ্ধতির মূল ফাঁক এবং সীমাবদ্ধতা হল যে আমরা এখনও সৃজনশীলতার নতুন চ্যালেঞ্জগুলির উপর ফোকাস করতে শিখিনি যা আমি এখানে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আমার ধারণা হল পাঠকেরা যে কোনো রচনা বা পাঠ্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেতরে একটি প্রতিধ্বনি অনুভব করে, বা করতে পছন্দ করে – গল্পের সাথে এক ধরণের আংশিক পরিচিতি বা বর্ণনার শৈলী দেখতে দেখতে তাদের মনে হয় যেন গল্পটি তাদের নিজেদের - যেন তার 'মালিকানা' পাঠকদের নিজেদেরই - এটি তাদের গল্প, যা একজন লেখক বলেছেন। এটি ব্যাচেলার্ডের মতে সাহিত্যের 'অনুরণন' যা প্রতিধ্বনিত হয় পাঠকমনে আর তার একটা বড় কাজ হলো পাঠ্যগুলি হতে তাঁদের নিজেদের মনে যে চিত্র, স্মৃতি এবং আবেগগুলি রয়েছে তাকে জাগিয়ে তোলে। লেখার মধ্যে নতুন কোনও অবধারণা বা প্রস্তাব দেওয়া বা পাঠককে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে – সেগুলির প্রতিধ্বনিকে এমন হতে হবে, যাতে পাঠকেরা বিভিন্ন ধরণের পরিচিতি খুঁজে পান। মজার ব্যাপার হলো এই যে সাদৃশ্য এবং পরিচিতির এই যুগল ধারণাটি এমন বৈশিষ্ট্য যা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের গল্পগুলি যেভাবে শেষ হয় তা পাঠকদের আরও বেশি কিছুর জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় বা তাদের আকাঙ্ক্ষা বা পরবর্তীর কল্পনার সুযোগ দিয়ে ছেড়ে দেয়।
একইভাবে, আমাদের ঐতিহ্যে একটি সৃজনশীল পাঠ যেভাবে শুরু হয় তা যেন আমাদের চোখের সামনে একটি পরিচিত দৃশ্য বা একটি চিত্র বিকশিত হওয়ার কৌশলগুলি দেখাতে থাকে। প্রায়শই, আমরা একটি গল্প সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়ার আগে একটা ভাবীকালের - কোন পথে চলেছে তার 'গন্ধ' পেতে থাকি। তারপরের চমক বা লেখকীয় কৌশলটি হল পাঠক যা প্রত্যাশা করবে তার বিপরীত দিকে কাজ করা বা গল্পের গতিকে অন্য দিকে সরানো, এমনভাবে যাতে পাঠক হতবাক হবে - যেন তার সামনে একটি নতুন ভিস্তা বা দৃশ্য বা স্থান অথবা সম্ভাবনা খুলে গেল যা সে ইতিপূর্বে কল্পনাও করতে পারে নি। পরিচিত সমতল থেকে অপরিচিত অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হলো সেই কৌশল যা আমরা লেখকেরা প্রায়শই ব্যবহার করি।
অতএব, নতুন ধরনের সৃজনশীলতার মানচিত্র তৈরি করার জন্য আমাদের আরও শক্তিশালী গ্রাফিক-তাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োজন হবে শুধুমাত্র পশ্চিমা তত্ত্বের নকল না করে - আমাদের দরকার হবে একটি এদেশীয় বা এশীয় সাহিত্যতত্ত্ব তৈরি করা। এবং অবশেষে 'পাঠ্যের' প্রজন্ম এবং তাদের প্রভাবগুলি বিশ্লেষণ করার জন্য এই নতুন সাহিত্যের প্রতিমানকে নতুন ভাবে ভেবে চিনতে আমাদেরই আনতে হবে।
সন্দর্ভ:
Dutt, Romesh C. (1910/1969). Book XIII, ASWA-MEDHA, (Sacrifice of the Horse), The Ramayana & Mahabharata, condensed into English verse by, Dent: London, Everyman’s Library, First version 1910, last reprinted 1969, p. 312.
Grimes, John, Sushil Mittal, and Gene Thursby. (2006). “Hindu Dharma,” in Sushil Mittal and Gene Thursby (Eds.), Religion of South Asia: An Introduction, London/New York, Routledge, pp. 35-36.
Nur, Syafiqa Mohd Nawi & Nurul Asma’Amani Muhmad Nor. (2023). ‘The Challenges in the Teaching of English Literature.’ Journey: Journal of English Language & Pedagogy, 6.1: 130-147.