• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গল্প
    Share
  • গ্রহশান্তির ফাঁড়া আর বিবেকানন্দের দাঁত : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত



    ফাটানো নাক নিয়ে পম্পাদের দরজায় যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন বেলা বারোটা। ভোরবেলা বাড়ি থেকে পাঁউরুটি খেয়ে বেরিয়েছি। তারপর ডক্টর বাজাজের নার্স মিস মুস্কান একটা হলুদবাটা মেশানো হলদি-চা মাস্টারনীর মতো সামনে বসে থেকে আমাকে খাইয়েছিলেন। সেটার পর থেকে মনের দুঃখে নাকটা দপ দপ আর মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।

    পম্পা দরজা খুলে আমাকে দেখেই পূর্ণবিস্ফারিত চোখে একটা আর্তনাদ করল। সেটা শুনে মাসিমা ছুটে এলেন সিঁড়ির মুখে। পুনরায় মধ্যবিত্ত বাঙালি-মার্কা শোরগোল। আমি ওদের পাড়ায় নাম কিনতে চাই না বলে ভাগ্যিস চট করে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

    কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে রব উঠেছে। আমি ঘোষণা করলাম – নাকটা বড্ড ছোট ছিল বলে প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে একটু বড় করেছি। কেমন হয়েছে বলুন মাসিমা?

    সিঁড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে উঠছি। উপর আর নিচ দুদিক থেকেই বন্যার মতো ধিক্কার আর ভর্ৎসনার গুলিবর্ষণ হচ্ছিল।

    নিচ থেকে পম্পা বলছে – অসভ্যের মতো কথা বলতে লজ্জা করে না? উপর থেকে মাসিমা বলছেন – জয় তুই সব জিনিসকে ঠাট্টা বানিয়ে দিস না। খুব খারাপ স্বভাব সেটা। সংসারে আমাদের একটু বুঝে-শুনে চলতে হয়।

    আমি উপরে উঠতে উঠতে জানালাম – সকালে দুর্গামন্দিরে একজন মহিলা বললেন আমাকে হয়তো দেখতে খারাপ হয়ে যাবে। আর একটা মেয়ে বলল বেশিদিন বাঁচব না। সেই থেকে আনন্দ্‌ সিনেমায় রাজেশ খান্নার মতো শুধু হাসি তামাশার মধ্যে জীবনের বাকি কটা দিন গুজরে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

    পম্পা বলল – ওকে সুযোগ দিয়ো না, মা। তাহলে ও বাজে কথা বলেই যাবে। ইন্‌করিজিব্‌ল্‌ ছেলে। একে আগাপাশতলা পেটাতে হয়। কী করে তুই এত বড় একটা চোট লাগালি বাঁদর?

    মাসিমা জিভটিভ কেটে বললেন – ছি-ছি। এরকম বলতে হয়? খবরদার তুই ওকে এরকম খারাপ কথা বলবি না। তুই না শ্রদ্ধা করলে অন্যরা করবে কেন?

    মাসিমার শেষোক্ত কথাটা যে কীরকম তাৎপর্য্যময় সেটা পম্পাকে বোঝাবার জন্য সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াতে যাব, এমন সময় পম্পা দাঁত কিড়মিড় করে বলল – শ্রদ্ধা!! এটার শ্রাদ্ধ করতে ইচ্ছে করছে আমার। দেখছ না মারামারি বাধিয়ে এসেছে আবার!

    পম্পার মুখে শ্রাদ্ধ শব্দটা শুনে মাসিমার দুচোখে নিমেষের মধ্যে আগুন ধরে গেল। চেঁচিয়ে উঠে তিনি বললেন - চুপ কর আবাগীর বেটি! মুখে একটা তালা দে!

    বেচারা পম্পা মায়ের মেজাজ দেখে একটু ভড়কে গিয়ে চুপ করে গেছে। তাড়াতাড়ি দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললাম – শান্ত, শান্ত, শান্ত। আমি সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। মোটেও মার খেয়ে আসিনি। সামান্য অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল কাল। একজনের মাথার হেলমেটের সঙ্গে আমার নাক ঠুকে যায়। ডক্টর বাজাজ বললেন ব্রেনে মাইনর কনকাশন হয়েছে আর হাঁটুতে একটু ব্যথা আছে। এ দুটোরই কোনো দাওয়াই লাগে না। নাকের জন্য সকাল থেকে ওষুধ খাচ্ছি। ইন্‌শা-আল্লা ফোলাটা শীগ্‌গিরই কমে যাবে।

    - এইটে আগে বলা উচিত ছিল জয়।

    - দেখতে খারাপ হয়ে গেছে বলে আপনাদের সামনে আসতে কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না, মাসিমা। তাই ঠিক করেছিলাম কেউ হাসার আগে নিজেই নিজের উপর হাসতে শুরু করব।

    - কেউ তোর উপর হাসবে কেন? আমরা কি পাষণ্ড নাকি? শোন, পম্পা যা বলল তার জন্য কিছু মনে করিস না জয়। ও তোর ভালো চায় বলেই না এরকম উতলা হয়ে গেছে। সেটা বুঝতে পারছিস তো? আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি।

    - ওঃ মাই গড! তুমি এখন এই নবাবজাদার কাছে হাতজোড় করে বসে থাকো। এই বলে পম্পা আমাদের কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল এবং ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে ভাঙতে লাগল।



    পরে যখন ওদের বাইরের ঘরের সোফায় বসে আমি সরবত খেতে খেতে নাকে বরফ লাগাচ্ছিলাম তখন মাসিমা পাশে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে ষাট ষাট বলতে লাগলেন আর পম্পা মাটিতে পজিশান নিয়ে আমার হাঁটুতে পাখির পালকের মতো হালকাভাবে হাত বোলাতে শুরু করল।

    - একটা পলা ধারণ করতে হবে। গ্রহটা ঠিক যাচ্ছে না তোর। নইলে সকালবেলা উঠে এত শিবের মাথায় জল দেওয়ার পর কারো এরকম হয়? মাসিমা বোঝালেন।

    পম্পার ক্রিশ্চান বন্ধু তানিয়ার জন্য তারই দেওয়া ফ্লাস্ক থেকে দুর্গামন্দিরের শিবের মাথায় এগারো দিন জল ঢালছি আমি। পুণ্যের পুরো ফলটা যে অ্যাডভান্সে অন্যের নামে লেখা হয়ে গেছে সেটা মাসিমাকে মনে করিয়ে দিলাম।

    - শোন তাহলে, আমার কাছে একটা ভালো পলা আছে। তোকে দিলে তোর মা আংটি বানিয়ে নিতে পারবেন না?

    সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! মায়ের অফিসে এক ডাইরেক্টার গোছের লোক, ইউ-পির ব্রাহ্মণ, শখের জ্যোতিষচর্চা করেন। অফিসের কাজের পর হাতে একদম সময় থাকে না। সেইজন্য দিল্লীর নির্বাচিত মাত্র ডজন খানেক মানুষের গ্রহের দোষ সামলাবার ভার নিয়েছেন। আছাড়-টাছাড় বেশি খাই আমি। তাই মা অনেক বলে-কয়ে বলে আমার কেসটা তাঁকে ধরিয়েছিল। ভদ্রলোকের হিসেব মতে অক্ষত থাকতে গেলে আঠেরো না হওয়া অবধি আমাকে ক্যাট্‌স্‌ আই পাথর ধারণ করতে হবে। তারপর সেটা স্যুট না করলে পালটাবার কথা। ভদ্রলোক মাকে একটা আংটিও কিনিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ইস্কুলে সবাই হাসাহাসি করবে বলে আমি এতদিন পর্যন্ত পরিনি। এখন আবার মাসিমা মায়ের হাতে পলা না ধরিয়ে দেন।

    একটু কুন্ঠিতভাবে ক্যাট্‌স্‌ আই’য়ের খবরটা ভাঙলাম। পম্পাও জানত না।

    পম্পার মা উৎসাহিত হয়ে বললেন – ওরে বাবা। এটা তো খুব শক্তিশালী পাথর শুনেছি। তাবিজ বানিয়ে বাজুতে পরে নে না? শার্টের তলায় থাকবে, কেউ দেখতে পাবে না।

    - আপনি জানেন না মাসিমা। ইস্কুলে ছেলেরা সব বুঝে যায়। একমাত্র যদি পায়ের আঙুলে পরে জুতো মোজা দিয়ে ঢেকে রাখি তাহলে গোপন থাকতে পারে। সেটাই করা হবে ভাবা হচ্ছিল।

    মাসিমা একটু চুপ করে থেকে বললেন – এ আবার কী সৃষ্টিছাড়া কথা? তোরা বাঙালরা বড় বেশি সাহসী। এই সব জিনিস কি পায়ে ঠেকাতে হয়?

    ভুল কিছু বলেননি মাসিমা। আসলে আমার মামাবাড়ি থেকে এরকম ফটিচর আইডিয়াই বেরোয়। মাসিমাকে বললাম - সব বাঙালরা সৃষ্টিছাড়া নয়। আমরা কিছুটা ব্যতিক্রম। আমাদের বাড়িতে কেউ কিচ্ছু জানে না বলে আমরা এরকম আনতাবড়ি কাজ করি। যাহোক এই প্রসঙ্গে আপনাদের একটা ঘটনার কথা বলি শুনুন। কিছুদিন আগে আমাদের ঠাকুরের আসন থেকে কী পাওয়া গেছে জানেন?

    - কী?

    - চিরকাল একটা ছোট লোহার ডিবে দেখে আসছি তার উপর। সিঁদুর আছে ভেবে মামিমা খুলে দেখে ভিতরে একটা হলুদ দাঁত।

    - দাঁত!!! মাসিমা শিউরে উঠে বললেন - এ মা গো!! কার?

    - দাদুর বা দিদার হতে পারে। কিম্বা কোনো গুরুর, বা আত্মীয়ের। পুরো নাম তো লেখা নেই উপরে। শুধু একটা V অক্ষর খোদাই করা। আমাদের বাড়িতে বীরু নামের একজন কাজের লোক ছিল। মামার অফিসের ক্যান্টিনেও রান্না করত সে। বীরু নিজের নামটা ইংরিজেতে V দিয়ে লিখত। টোটোদা বলল সে নাকি ছোটবেলায় দেখেছে কৌটোতে একটা সোনার দুল ছিল। টোটোদার থিওরি হল এই যে বীরু যাওয়ার সময় সেই দুলটা আমাদের স্মৃতি হিসেবে গ্রহণ করে নিজের স্মৃতি হিসেবে ওই দাঁতটাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু মামা চতুর্দিকে দিব্যি গেলে বলতে লাগল যে এটা বিবেকানন্দের দেহাবশেষ। কারণ সেরকম একটা পুরোনো পারিবারিক গল্পও আছে আমাদের। কোনো এক পূর্বপুরুষ নাকি টেরিটিবাজারের মাঞ্চুরিয়ান ডেন্টিস্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, মাইকেল, সবাইকে তাঁর চেয়ারে বসতে হয়েছে। আপনাদের বোর লাগছে না তো শুনতে?

    মাসিমা অবাক হয়ে বললেন - টেরিটিবাজারের মাঞ্চুরিয়ান ডেন্টিস্ট? সেখানে চীনেদের দোকান তো ছিল, কিন্তু তোর পূর্বপুরুষ...

    - ওঃ, বলা হয়নি আপনাদের? মামারা বলে যে আমাদের এক পূর্বপুরুষ আসলে চাইনীজ ছিলেন...

    পম্পা আর সইতে না পেরে বলল - জয়, দিস ইজ ইম্‌পসিবল্‌। মামাবাড়ির এত ওঁছা গুল আর মায়ের কাছে ঝাড়িস না। বেচারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে বসে থাকবে।

    আমি পম্পাকে বললাম - মামার কাছে একটা সে যুগের ছাপানো কার্ড আছে। হয় তিনি বাঙালির ছেলে হয়ে পসারের জন্য চীনে সেজে থাকতেন। অথবা চীনে হয়েও বাঙালিদের পরিবারে বিয়ে করে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন।

    - অথবা কার্ডটা কোথাও থেকে পেয়ে তোর মামারা একটা গল্প বানিয়ে দিয়েছেন। কী রাবিশ!

    পম্পার ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। মাসিমা আমার পিঠে একটা খোঁচা মেরে বললেন – থামলি কেন, বল, বল!

    আমি বললাম – আচ্ছা, এই কথাটা বিশ্বাস না করলেও কিছু এসে যায় না। আসল ঘটনাটাতে আসি। মাসিমা, আমি বলতে চাইছিলাম যে সব বাঙালরা সৃষ্টিছাড়া নয়। আমার মামিমাকে দেখুন। মোটেও আমার মামাদের মতো হদ্দ গরীব নয়। অবস্থাপন্ন ফ্যামিলির মেয়ে। এই দাঁতটা যারই হোক, মামিমা বলল সেটা কিছুতেই ঠাকুরের আসনে রাখা যাবে না, বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে। এদিকে বিবেকানন্দের দেহাবশেষ চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে শুনে তো মামার হার্টে ব্যথা উঠে গেছে। মা ছুটে এসে বলল – বৌদি ওটা একশো বছর ধরে ঠাকুরের আসনে ছিল। যা ক্ষতি হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন আর সরিয়ে কী লাভ? কিন্তু মামিমাকে নড়ানো গেল না। মামিমা বলল – বিবেকানন্দেরই হোক আর বুদ্ধেরই হোক, ওটাকে গয়ার গঙ্গায় ফেলে আসা চাই।

    মাসিমা নড়ে চড়ে উঠে বললেন - যাক একজন স্বাভাবিক মানুষ দেখতে পাচ্ছি। তারপর কী হল? গয়ায় ফেলে দেওয়া হল সেটা?

    - গয়ায় কে যাবে? মামি আবার পাটনার মেয়ে, কাছাকাছি হরিদ্বারের গঙ্গায় ভরসা নেই। তো বীরুকে খুঁজে বার করে তার দাঁতের একটা ছাপ আনানো হয়েছিল। দেখা গেল সেটা আমাদের দাঁতটার তুলনায় অনেক ছোট। তারপর আমরা পাড়ায় যাকেই দেখিয়েছি সে-ই বলেছে – এমন নিখুঁত একটা দাঁত বিবেকানন্দের না হয়ে যায় না। কিন্তু মামা যখন রামকৃষ্ণ মিশনে সেটা জমা দিতে গিয়েছিল, তখন তারা নিজেদের বড় বড় দাঁত বের করে আর আমার মামিমার মতো চোখ-টোখ পাকিয়ে দফা হয়ে যেতে বলে।

    পম্পা আমার হাঁটু ছেড়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সোফায় উঠে বসে বলল – তোর এই দাঁতের পাঁচালি কেন শুনছি আমরা বলতো? কোনো মাথামুণ্ডু...

    মাসিমা পম্পাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বললেন – থাম তুই। এর থেকে একটা কিছু শিক্ষা পাওয়া যাবে। তাই না জয়?

    আমি বললাম - ঠিক ধরেছেন মাসিমা। আপনি গ্রহশান্তির কথাটা তুললেন তো? সেই প্রসঙ্গেই বলছি। একটু ধৈর্য ধরুন, এক্ষুনি যোগসূত্রটা বোঝা যাবে। তো এই রকম স্টেলমেট অবস্থায় একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। সেই যে বীরু বলে ছেলেটা ছিল? সে একদিন সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে মামার সঙ্গে দেখা করতে আসে। বুকপকেটে একটা গিল্টি সোনার দুল।

    পম্পা আর তার মা দুজনেই হাঁ করে বলল – হোয়াট? সোনার দুল?

    - আসল নয়, গিল্টি সোনার। মামা দেখেই বুঝেছিল। এদিকে বীরু বলল টোটোদার কথা ঠিক, সে ডিবে থেকে একটা দুল চুরি করে তার জায়গায় নিজের দাঁত রেখে গিয়েছিল, এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইছে। আজ দুল ফেরত দিয়ে সেই অনুতপ্ত মহাপুরুষ নিজের হতভাগ্য দাঁত নিয়ে চলে যাবে। মামা বলল – তাড়া কীসের? রোসো! টোটোদাকে ডেকে এনে দুলটা দেখানো হল। টোটোদা সাফ বলল এটা মোটেও তার দেখা দুল নয়। সেটা ছিল পুরোনো পাকা সোনার ঝুমকো, আর এটা একটা সোনালী রং করা টিনের সস্তা মাকড়ি। মামিমা অবশ্য বলেছিল – দুল টুল চাই না, বীরু তুই গিয়ে ভিতর থেকে তোর হলুদ দাঁত নিয়ে চলে যা। কিন্তু টোটোদা আর মামা বীরুকে টিটকিরি দিয়ে দূর দূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। তারপর কী হল আন্দাজ করতে পারেন?

    - মামা আর মামির মধ্যে কথা বন্ধ তো? পম্পা তার আন্দাজ লাগিয়ে বলল।

    - কথা বন্ধ হবে কেন? তোর মামিমা দাঁতটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তাই না? মাসিমা বললেন।

    আমি বললাম - দুটোই হয়নি। সেদিন রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। পিছনে কাঠের জাফরির দরজাটাকে কীভাবে যেন খুলে ঠাকুরের আসন থেকে চোর সেই পুরোনো কৌটোটা তুলে নিয়ে যায়!

    - সর্বনাশ! সেই বীরুটাই এসেছিল নাকি? মাসিমা চোখ কপালে তুলে বললেন।

    - নইলে আর কে? আমাদের পাড়ার লোকেরা রটিয়ে দিয়েছিল V for Vishwamitra! মানে বুঝলেন তো? দাঁতটা ঋষি বিশ্বামিত্রের, যে পাবে সে-ই রাজা হয়ে যাবে। কিন্তু মজাটা কী জানেন? কৌটোর মধ্যে দাঁত তখন ছিল না। আগেই সেটাকে ঠাকুরের আসন থেকে সরিয়ে রান্নাঘরের তাকে একটা শিশির মধ্যে পাচার করা হয়। কৌটোটা গঙ্গাজলে ধুয়ে আমার মা তার মধ্যে তিন হাজার টাকার ক্যাট্‌স্‌ আই’য়ের আংটিটা পুরেছিল। তারপর আংটিটাকে আরো শক্তিশালী বানাবার জন্য ঠাকুরের পায়ের কাছে রেখে দেওয়া হয়।

    - ওঃ নো! পম্পা শিউরে উঠল। - তিন হাজারের আংটি গেল? সোফায় বসেই উত্তেজনার চোটে সে আবার আমার হাঁটুতে হাত বোলাতে শুরু করেছে।

    আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

    মাসিমা ব্যাকুল হয়ে বললেন – চোর ধরা পড়ল না?

    - কে ধরবে? প্রমাণ তো নেই। বীরুও আস্তানা ছেড়ে কোথায় গা ঢাকা দিল কে জানে। আর সেই দাঁত? মামা বা টোটোদা কেউ আর সেটাকে তারপর গঙ্গায় ফেলতে দেয়নি। বড়মামি গত হওয়ার পর থেকে আমার বড়মামা দেরাদুনে একা। তিনি এসে পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। একদিন চলুন না? সবাই মিলে দেরাদুনে যাই। দাঁতটা আপনাদের দেখিয়ে আনব।

    - খুব ভালো হয় জয়। বাড়িতে বসে বসে আমার যে কী বোর লাগে। সবাই মিলে চল একদিন দেরাদুন বেড়িয়ে আসি।



    এরপর আমরা তিনজন খাবারের টেবিলে উঠে আসি। আমার তো ক্ষিদের চোটে পেট কুঁই কুঁই করছিল। পম্পা পটলভাজা খেতে খেতে বলল – এর থেকে তুই কী শিক্ষা পেয়েছিস বয়ম্যান? আমরাও কি শুনতে পাব সেটা?

    মুখ ভর্তি ভাত গিলে ফেলে আমি বললাম – মা সেই জ্যোতিষী অফিসারের কাছে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একেবারে কেঁদে পড়েছিল। আরেকটা পাথর বলে দিন স্যর। তখন সেই ভদ্রলোক কী বললেন জানো? তিনি বললেন – ক্যাট্‌স্‌ আই চুরি যাওয়াতে ছেলেটা বেঁচে গেছে। নইলে তার থেকেই ভাগ্যে রিয়্যাকশন হয়ে ওর সর্বনাশ ঘটত একটা। জ্যোতিষীর শেষ কথাগুলোই হল এই অভিজ্ঞতার শিক্ষা। মাসিমা আর পম্পার দিকে তাকিয়ে আমি ইতি করলাম। - তিনি বলেছিলেন, গ্রহের পাথর জোর করে চাপানো যায় না ম্যাডাম। সময় হলে সেই পাথর নিজে ওকে খুঁজে নেবে।

    মাসিমা এমন আপ্লুত হয়েছিলেন যে খাবারের টেবিলে বসেই হাততালি দিয়ে উঠলেন। - ঠিক বলেছিস! তিন হাজার গচ্চা গেলেও, তার থেকে লাখ টাকার একটা শিক্ষা পেয়েছিস জয়! এই কথাটা আমি খুব মানি, তোর পাথর নিজে এসে তোকে খুঁজে নেবে।



    যাক, গ্রহশান্তির ফাঁড়াটা কেটেছে। আমিও সহর্ষে উঠে মাসিমাকে তাঁর নিজেরই বানানো কুমড়োর ছক্কা আরেকটু নেওয়ার জন্য সাধাসাধি করতে লাগলাম।

    পরে পম্পা তার মধুর অপাঙ্গের তলোয়ার দিয়ে আমার কপাল থেকে দুই উরুর মাঝখান অবধি একটা শিরশিরে রেখা টানার সময় শকুন্তলার মতো ফিক ফিক করে হাসছিল। আমি বুঝেছিলাম যে আমায় যতই খারাপ দেখাক, খেলনা হিসেবে তার কাছে এখনো ফেলনা নই।


    (শেষ)


    [ অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে গৃহীত গল্প ]


    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments