• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গল্প
    Share
  • হৃদয়ঘটিত : বিশ্বদীপ সেনশর্মা



    নীলেশবাবু সল্টলেকে থাকেন, বাড়ির কাছেই একটা ব্যাঙ্কে কাজ করেন। স্ত্রী ও এক পুত্র নিয়ে সুখের সংসার। ব্যাঙ্কে অনেকদিন নিষ্ঠা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন, অবসরের আর খুব বেশিদিন বাকি নেই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার পড়ছে।

    একদিন ব্যাঙ্কে নিজের কিউবিকলে বসে কাজ করছেন, গ্রাহকদের ভিড়, হঠাৎ বুকে অস্বস্তি বোধ করলেন। বাঁ-দিকে একটা চিনচিনে ভাব। প্রথমে গ্যাসফ্যাস হয়েছে ভেবে আমল দেননি। কিন্তু একটু পরে বুঝলেন অস্বস্তিটা বাড়ছে। একটু যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট। ব্যথাটা ধীরেধীরে বাঁ-হাতের দিকেও ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন পা একটু কাঁপছে। অল্প অল্প ঘামও হচ্ছে। তিনি হাত তুলে পাশের কিউবিকল থেকে এক সহকর্মীকে ডাকলেন। ততক্ষণে ব্যথাটা আরও বেড়েছে।

    ছেলেটি সব শুনে সঙ্গেসঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে দিল। তাকে শুইয়ে দিয়ে জামার বোতাম খুলে দিল। ততক্ষণে আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন চলে এসেছে। একজনের কাছে সরবিট্রেট ছিল, জিভের তলায় একটা রেখে দিল

    অ্যাম্বুলেন্স তাকে সোজা সবথেকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। প্রেসার, ই সি জি, ব্লাড-টেস্ট ইত্যাদি করিয়ে ঘন্টাখানেক পরে তাকে বেডে দেওয়া হল। ততক্ষণে ব্যথাটা কিছুটা কমেছে। একটু পরে অল্পবয়সী এক ডাক্তারবাবু এসে আবার প্রেসার দেখলেন, তারপর হাসিমুখে বললেন, আপনার কি এখনও ব্যথা আছে? টেস্ট কিন্তু সব মোটামুটি নর্মাল দেখাচ্ছে। দুপুরে কী খেয়েছিলেন?

    ইতিমধ্যে খবর পেয়ে স্ত্রী বনানী তাঁর এক ডাক্তার বন্ধু সুগতকে নিয়ে চলে এসেছেন। সুগত নিজে কার্ডিওলজিস্ট। নিজের নার্সিংহোমও আছে। ইনিও দেখে-টেখে বললেন, রিপোর্টে কিছু নেই। গ্যাস বা মাস্কুলার পেন থেকে হতে পারে। তোকে আমার ওখানে শিফট করে নিচ্ছি, দু-দিন মনিটর করে ছেড়ে দেব।

    বন্ধুর নার্সিংহোমে গিয়ে নীলেশবাবু বুকে মনিটর লাগিয়ে শুয়ে রইলেন। আরও কিছু টেস্টও করান হল। একবার একটা মেশিনের সামনে গিয়ে মিনিট দশেক দৌড়েও এলেন। এমনিতে অবশ্য দিব্যি আছেন, ব্যথাট্যথা কিছু নেই। বইটই পড়ে ভালই সময় কাটছে।

    দুদিন পরে বন্ধু এসে একগাল হেসে বললেন, বাড়ি যা, সব রিপোর্ট নর্মাল। মনে হচ্ছে গ্যাস বা অন্য কোন সমস্যা থেকে সামান্য ব্যথা হয়েছিল, তারপর ভয় পেয়ে এই কাণ্ড বাঁধিয়েছিস। বেশি চিন্তা করবি না আর গুগল করে রোগের সিম্পটম দেখবি না।

    নীলেশবাবু মহানন্দে বাড়ি এলেন। পরের দিন থেকে কাজেও যোগ দিলেন। সহকর্মীরা খুশি, আবদার ধরল, খাওয়াতে হবে। তো লাঞ্চে একদিন সবার জন্য বিরিয়ানির প্যাকেটও এসে গেল।

    দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। নীলেশবাবু এখন রোজ সকালে উঠে সেন্ট্রাল পার্কে একঘন্টা হাঁটেন। খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক। অফিস চলছে। রিটায়ারমেন্টের দিন প্রায় এসে গেল। তবে তা নিয়ে নীলেশের বিশেষ হেলদোল নেই। তাঁর যা অভিজ্ঞতা, কোন না কোন পার্ট-টাইম কাজ অনায়াসে পেয়ে যাবেন, কিন্তু আপাতত বিশেষ ইচ্ছে নেই৷ কিছুদিন হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করার বাসনা। তিনি বইপোকা, সারা জীবন হুইলার আর এয়ারপোর্টের স্টল থেকে প্রচুর বই কিনে গেছেন, ইদানীং অনলাইনেও আনান, কিন্তু সব পড়া হয়নি। সেগুলো শেষ করতে হবে৷ একসময়ে একটু-আধটু লেখালেখি করতেন, বেশ কিছু ছাপাও হয়েছিল। সে কাজটাও আবার শুরু করা যেতে পারে। এছাড়া মাঝে-মধ্যে বনানীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ারও ইচ্ছে আছে। বাবার একটা অ্যামবাসাডর ছিল, সেটা অনেকদিন আগেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। গ্যারাজটা খালিই পড়ে আছে। নীলেশ হিসেব করে দেখেছেন যা পেনসন পাবেন তা দিয়ে মাসের খরচা ছাড়াও একটা গাড়ির তেলের খরচ আর ড্রাইভারের খরচা অনায়াসে উঠে যাবে। আজকাল অবশ্য অনেকেই মাস-মাইনে দিয়ে ড্রাইভার রাখে না, সেন্টার থেকে যখন যেমন দরকার পড়ে ডেকে নেয়। ছেলেরও পড়া প্রায় শেষ, কলকাতায় যদি একটা চাকরিবাকরি পায় তাহলে সেও ব্যবহার করতে পারবে।

    মাঝেমধ্যেই এইসব প্ল্যানিং ও আলাপ-আলোচনা হয়। ছেলে শুভ্রাংশু বলে গাড়ি পরে হলেও চলবে কিন্তু রিটায়ার করে আগে মাকে নিয়ে কুলু-মানালি ঘুরে এস। মার অনেকদিনের ইচ্ছে।

    এর মধ্যেই একদিন নীলেশ আবার বুকে অস্বস্তি অনুভব করলেন। হাঁটতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছেন। সিঁড়ি ভাঙ্গতে গেলে অসুবিধা হচ্ছে।

    ভয় পেয়ে তিনি বন্ধুর কাছে ছুটলেন। আগে ফোনে কথা বলে নিয়েছিলেন। বন্ধু গম্ভীর মুখে স্টেথো লাগিয়ে বুক-পিঠ সব পরীক্ষা করলেন,তারপর নার্সকে ডেকে ই সি জি করাতে বললেন। ই সি জি রিপোর্ট দেখে বললেন, একদম নর্মাল। বলে রাগতভাবে নীলেশের দিকে চেয়ে রইলেন। নীলেশ চুপ করে রইলেন কিন্তু টের পেলেন ব্যথা বা অস্বস্তি আর নেই।

    বন্ধু এবার মুচকি হেসে বললেন তোর হার্টের নয় অন্য ব্যামো হয়েছে। আমাদের শাস্ত্রে এটাকে হাইপোকন্ড্রিয়া বলে। রোগী যেকোন রোগের লক্ষণ জানলে মনে করে তারও সেই রোগ হয়েছে।

    নীলেশ ভয়ে ভয়ে বললেন, এর চিকিৎসা কি?

    বন্ধু বললেন, কিছুদিন কাউন্সেলিং করিয়ে দেখতে পারিস। সমস্যাটা কেন হচ্ছে, কী করতে হবে ওঁরা তোকে বুঝিয়ে দেবেন। আমি তোকে একটি মেয়ের নম্বর দিচ্ছি, সল্টলেকেই বসে৷ কথা বলে দেখ কেমন লাগে।

    নীলেশ দুদিন পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেলেন। মেয়েটি অল্পবয়েস, হাসিখুশি। মন দিয়ে তাঁর কথা শুনল। কিছু প্রশ্ন করল। কথার ফাঁকে ফাঁকে কিছু সাজেশনও দিল। প্রায় ঘন্টাখানেক কথা হল।

    চেম্বার থেকে বেরিয়ে নীলেশ দেখলেন বেশ হাল্কা লাগছে। মেয়েটি পনের দিন পরে আবার যেতে বলেছিল৷ তাও গেলেন। আর একপ্রস্থ কথা হল। তারপর মেয়েটি নিজেই বলল, আঙ্কল, আপাতত আর আসার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আপনার সেরকম কোন সমস্যা নেই। এটা নিয়ে বেশি ভাববেন না। বেড়াতে যান, ভাল বইটই পড়ুন, বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। মন ভাল থাকলে দুশ্চিন্তা আপনা থেকেই চলে যাবে।

    কিছুদিন পরে নীলেশবাবু রিটায়ার করলেন। দুদিন জিরিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে হিমাচল সফরে বেরিয়ে পড়লেন। সিমলা, কুলু, মানালি, ধর্মশালা, ডালহাউসি সব মিলিয়ে হপ্তা দুয়েকের সফর। ফেরার সময় দিল্লীতে বনানীর এক বোন থাকেন, তাদের ওখানে কিছুদিন থেকে এলেন। বনানীর জামাইবাবু হুল্লোড়ে মানুষ; ক’টা দিন আড্ডা দিয়ে আর হইচই করে বেশ কাটল।

    ফিরে এসে নীলেশবাবুর অবসরজীবন শুরু হল। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কিছু একটা পার্টটাইম কাজ নিয়ে নিতে, নয়ত সময় কাটান মুশকিল হবে। নীলেশবাবুর অবশ্য সেরকম কোন সমস্যা নেই। সকালে উঠে ঘন্টা খানেক হেঁটে আসেন, তারপর ব্রেকফাস্টের ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি, বাংলা দুটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়েন। হোয়াটসঅ্যাপে স্কুল, কলেজ, পাড়া-প্রতিবেশী বা প্রাক্তন কলিগদের গ্রুপ আছে, সেখানে কিছুটা সময় কাটান। ব্যাঙ্কে বা অন্যত্র কোন কাজ থাকলে সেরে আসেন। তারপর একটা বই নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে যান। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু ভাতঘুম। বিকেলে চা-টা খেয়ে একটু লেখালেখির চেষ্টা করেন। গল্প, ভ্রমণকাহিনী যা মনে আসে। একটা গল্প বন্ধুরা প্রশংসা করেছিল,সাহস করে একটি নামকরা পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যা বেলা টিভি দেখার সময়, খেলা থাকলে তো কথাই নেই, না হলে নিউজ চ্যানেল তো আছেই। নীলেশবাবুরা তাড়াতাড়ি খান, আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার পর্ব সেরে নিয়ে বনানীকে নিয়ে ওটিটি'তে সিনেমা বা সিরিজ দেখেন। আজকাল ওটিটি'তে এত ভাল ভাল কনটেন্ট থাকে নীলেশবাবুর কোন ধারণাই ছিল না, এখন মহানন্দে দেখেন।

    সব মিলিয়ে দিব্যি আছেন। তবে ছেলে বাঙ্গালোর থেকে ভাল অফার পেয়ে চলে গেছে, ওখানে একটা ফ্ল্যাটে দুই বন্ধু শেয়ার করে থাকে। তাঁদের এতবড় ফ্ল্যাট একটু ফাঁকাফাঁকা লাগে। চেনা-পরিচিতর মধ্যে অবশ্য অনেকেরই ছেলেমেয়ে আজকাল বাইরে থাকে। রোজরাতে ভিডিও কলে কথা হয়।

    নীলেশের হৃদয়ঘটিত সেই সমস্যা অবশ্য পুরোপুরি যায়নি, কিছুদিন আগে আবার মাথাচাড়া দিয়েছিল। এবারে অবশ্য নীলেশ ঘাবড়াননি, নিজেই গিয়ে বন্ধুকে দেখিয়ে এসেছেন এবং যথারীতি প্রচুর বকুনি খেয়ে এসেছেন। তবে তাঁর মনে হয়েছে এবারে ব্যথা থাকলেও আতঙ্ক ছিল না। মেয়েটি তাকে শিখিয়েছিল দুশ্চিন্তা আপনার একার নয়, অল্প-বিস্তর সকলেরই হয়। বেশি গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। উপেক্ষা করুন৷ ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

    এরই মধ্যে একদিন গভীর রাতে বুকে যন্ত্রণা শুরু হল। নীলেশবাবু প্রথমে আমল দেননি, তারপর বিস্মিত হয়ে দেখলেন ব্যথাটা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন দম আটকে যাচ্ছে। এরকম আগে কখনও হয়নি।

    তিনি বনানীকে ডেকে তুললেন। বনানী বন্ধুকে ফোন করলেন। তিনি বললেন, সবসময়ে মানসিক সমস্যা নাও হতে পারে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি, ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাও, আমি আসছি।

    নার্সিংহোমে যেতেই প্রথামাফিক চিকিৎসা ও টেস্ট ইত্যাদি করিয়ে নীলেশকে বেডে দেওয়া হল। আর এম ও এসে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, এখন কেমন বোধ করছেন?

    নীলেশ বললেন, ব্যথাটা আছে।

    ছেলেটি বলল, ওষুধ দেওয়া হয়েছে, ওটা কমে যাবে।

    নীলেশ বললেন, রিপোর্টে কিছু পাওয়া গেল?

    ছেলেটি বলল, ই সি জি'তে সামান্য চেঞ্জ আছে, তবে ওটা দেখে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। আর একটা টেস্টও করান হয়েছে। স্যার আপনাকে অনেকদিন থেকে দেখছেন, উনিই ভাল বলতে পারবেন।

    বলতে বলতেই বন্ধুটি এসে পৌঁছলেন। রিপোর্টগুলো দেখলেন, নীলেশের বুক পরীক্ষা করলেন। এর মধ্যে একটি নার্স দ্রুত এসে আর একটা রিপোর্ট দিয়ে গেল, তাতেও চোখ বোলালেন।

    নীলেশ আর থাকতে না পেরে বললেন, সব ঠিক আছে?

    বন্ধুটি বললেন, না রে, এবারে রিপোর্ট খুব ভাল নয়। মনে হচ্ছে একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেছে। মেজর কিছু নয়, ঠিক হয়ে যাবি তবে নিয়মমত তোকে বাহাত্তর ঘন্টা অবসারভেশনে রাখতে হবে। যা দরকার ওষুধপত্র সব দেওয়া হয়েছে, এবারে ঘুমিয়ে পড়।

    বন্ধু বনানীকে নিয়ে চলে গেলেন। এই বাহাত্তর ঘন্টার ব্যাপারটা নীলেশ জানেন। ডাক্তাররা বলেন, তার আগে কিছু বলা যাবে না।

    নীলেশ অবাক হয়ে দেখলেন, তার বিশেষ চিন্তা হচ্ছে না। ব্যথাটা এখনও আছে৷ তবে একই সঙ্গে মনে হচ্ছে বুক থেকে অনেকদিন ধরে জমে থাকা একটুকরো পাথর সুট করে নেমে গেছে।

    যেতে তো একদিন হবেই। তবে জীবন তাকে দুহাত ভরে দিয়েছে। বনানীর মত স্ত্রী, শুভ্রাংশুর মত ছেলে, এত বন্ধুবান্ধব। কর্মক্ষেত্রেও কাজের সুযোগ পেয়েছেন। বৈষয়িক সমস্যাও নেই। ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে আর যা পেনসন পান বনানীর স্বচ্ছন্দে চলে যাবে।

    এরা বোধহয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।

    ঘুমিয়ে পড়ার আগে নীলেশ ভাবলেন, বাড়িতে একটা ভাল বই পড়তে শুরু করেছিলেন বনানীকে কাল বলতে হবে ওটা দিয়ে যেতে।

    পরের দিন সকালে উঠে নীলেশ দেখলেন, বুকে একটা অস্বস্তি এখনও আছে। এখনও হাঁটাচলা বারণ তাই একটু পরে একজন এসে তার হাতমুখ ধুইয়ে দিয়ে গেল। আর একজন এসে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। নীলেশ গভীর তৃপ্তির সঙ্গে চায়ে চুমুক দিলেন। নার্সিংহোমের চা হিসাবে বেশ ভালই।

    একটু পরে বনানী এলেন। বললেন, কেমন আছ? বুকে আর ব্যথাট্যাথা হয়নি তো? তারপর তাকে ভাল করে দেখে একটু অবাক হয়েই বললেন, তোমার মুখচোখ দেখে বোঝার উপায় নেই তোমার শরীর খারাপ।

    বনানী বুদ্ধি করে সেই বইটা এবং আরও একটা বই নিয়ে এসেছেন। নীলেশের আনন্দ দেখে কে।

    একটু বসে বনানী চলে গেলেন, নীচে কাউন্টারে গিয়ে ইনসিওরেন্স সংক্রান্ত কিছু ফর্মালিটিজ করতে হবে। নীলেশ বইটা নিয়ে যত অবধি পড়েছিলেন তার পর থেকে শুরু করলেন। একটু পরে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। টোস্ট, ছানা আর ফল। নীলেশ তাই তৃপ্তি করে খেলেন। এর মধ্যে বনানী আবার এসে নীলেশের মোবাইলটা দিয়ে গেলেন। বললেন, সুগতদাকে বলেটলে পারমিশন পেয়েছি। তবে বলেছেন সাইলেন্ট মোডে রাখতে। শুধু চ্যাট করতে পারো।

    নীলেশ হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন গ্রুপে গিয়ে দেখলেন প্রায় সবাই তাঁর আরোগ্য কামনা করে পোস্ট করেছেন। তিনি লিখলেন, আমি খুব ভাল আছি। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়ান টু ওয়ান মেসেজ করেছেন তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করলেন।

    এইসব করে আর বইটা পড়ে সারাদিন কেটে গেল।

    বিকেলে অনেকে দেখা করতে এলেন কাছেপিঠের বন্ধুরা, পাড়া-প্রতিবেশীরা, ভাইপো আর ভাইঝি। নীলেশ মহা উৎসাহে জমিয়ে আড্ডা দিলেন। ভাইঝিকে বললেন তোর স্কুলের কাছে নকুড়ের দোকান না? কাল কটা কড়াপাক নিয়ে আসিস তো।

    ভাইঝি হেসে বলল, আচ্ছা আনব।

    ডিনারের পর বড় আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। নার্সরা নিয়মিত এসে চেক করে যাচ্ছেন। আশপাশের বেডে সকলেই ঘুমোচ্ছেন। অধিকাংশেরই হাতে স্যালাইন দিয়ে ওষুধ চলছে, দু-একজনের নাকে অক্সিজেনের নল গোঁজা। একটু মন খারাপ করা পরিবেশ। এরই মধ্যে একজনের বোধহয় কোন অসুবিধা হচ্ছিল, আর এম ও ছেলেটি এসে দেখে গেল, নার্সকে কিছু নির্দেশ দিল। নীলেশের হঠাৎ একবার গা-ছমছম করে উঠল। তাঁর মনে হল, এই লোকগুলির কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ফিরে যাবেন, সকলে নয়। তারপর নিজের মনেই হেসে ফেললেন।

    পরের দিন সকাল আটটার সময় সুগত আর বনানী এলেন। নীলেশ এত সকালে দুজনকে একসঙ্গে দেখে একটু অবাক। সুগত তাকে পরীক্ষা করলেন, কাল রাতের রিপোর্টগুলি দেখলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, তোর এ যাত্রা বিপদ কেটে গেছে। বাড়ি গিয়ে আরাম কর। তবে সাবধানে থাকবি।

    নীলেশ অবাক হয়ে বললেন, তা হলে… বাহাত্তর ঘন্টা…

    সুগত কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। বনানী আর থাকতে পারলেন না, হেসে ফেললেন। নীলেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বিদ্যুচ্চমকের মত ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি সুগতের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, তুই...

    সুগত এখন হাসছেন। বললেন, যা নিয়ে এত ভয় পেতি, সেটা তোকে দেখিয়ে দিলাম। কাল তো তোকে দেখে মনে হচ্ছিল ভয়টয় ভুলে বেশ আনন্দেই ছিলি। এবার প্রাণ ভরে বাঁচ। আর এমুখো হতে হবে না।

    নীলেশের বিস্ময় এখনও কাটেনি। ওরই মধ্যে তিনি কোনরকমে অস্ফুটে “শালা" বললেন।

    বনানী উচ্চকন্ঠে হেসে উঠলেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)