মাত্র একটা ফোঁটায় মানুষকে মেরে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে লুনি। লুনি চেতনের স্ত্রী। আগে স্বামীর ওপরে আক্রোশে এসব করত। এখন ইচ্ছামৃত্যু আইনসিদ্ধ হওয়ায় এটাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে লুনি। চেতন যখন আপন খেয়ালে একের পর এক চরিত্র আঁকে, আর ঠিক এর উল্টো পিঠে লুনি লিখে দেয় সহজ মৃত্যুর পরোয়ানা! তবে চেতনের মতো লুনি মোটেই খালি হাতে রাজি হয় না। এর জন্যে তাকে ন্যূনতম নজরানা দিতে হয়।
বউকে পাশে বসিয়ে রেখে আজ অনেক রাত অব্দি আঁকিবুঁকি করল চেতন। কিন্তু নাহ! কেউ এল না। আকাশের চাঁদ সরে গিয়ে কালো মেঘ এল। চরিত্রদের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে চেতন। এখন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, বিষের পাত্রটা থেকে বাষ্পটুকু উড়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করতে করতে একসময় রাতের পারায় নেশার পরত লাগল। পাখিদের কণ্ঠে আরও দুয়েকবার ধ্বনিত হল স্বপ্নতাড়িত পীতস্বরা প্রহর। তখনও কেউ এল না।
এবার স্বামীকে একপাশে রেখে ক্লান্তির কোলে ঢুলে পড়ল লুনি। এখন সরাটা নিয়ে একা একাই বসে আছে চেতন,--একজন অসুখী অক্ষর সাধক! বিষের পাত্র কেন তুলে নিল চেতন? ওর কাজ তো জীবন দান করা! তাহলে সেও কি লুনির পথ বেছে নিল? জানে না চেতন।
পেটে গামছা বেঁধে চরিত্রদের চোখমুখ আঁকে চেতন। চরিত্ররা যখন ওর কাছে আসে, তখন অক্ষর দিয়ে চেতন ওদের চোখমুখ এঁকে দেয়। কারও কারও মুখের বুলি, অন্তরের দ্রোহ এসবও লিখে দেয় চেতন। কেউ হয়ত সন্ন্যাসী হতে আসে। কেউ হতে আসে লুঠেরা, অথবা নেতা। তবে ছেঁড়া আটপৌরে কাপড়ের সরল সাদাসিধে মুখ এখন আর কেউ আঁকাতে আসে না। লুনি আরও লক্ষ করেছে, যারা আসে তারা অধিকাংশই প্রত্যাখ্যাত অথবা পলায়নকামী! আর এইখানেই লুনির ক্ষোভ! অন্ধকার একখানা ঘরে খালিখালি খাগ নিয়ে বসে থাকে চেতন। অভাব অনটন কুমীরের কঙ্কালের মতো হাঁ করে থাকে সারাক্ষণ! সেদিকে চেতনের খেয়াল নেই। একপ্রকার অনাহারী সংসার! অনেক আগেই বিষয় বাসনা বিসর্জন দিয়ে বসে আছে লুনি! সংসারের স্বার্থে একপ্রকার মারমুখী হয়ে আছে লুনি! কিন্তু কিছু বলতে পারে না। স্বামী সাধক বলে কথা! প্রতিদিন এমন কতশত অভিযোগ আর আক্রোশ নিয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে লুনি।
এমনসম ঠক ঠক শব্দ। চেতন খিড়কি খুলে দিল।
আজ অভিসারী চাঁদের মতো চেতনের ঘরে পা রাখল একটি মেয়ে। মেয়েটি বলল, ওর নাম নাকি প্রবাহ। চেতন বিষের পাত্রটি আলগা করবার আগেই মেয়েটি ছোট্ট একটা কাঠের বাক্স চেতনের সামনে তুলে ধরল।
চেতনের চোখ ঝকমক করে উঠল, “এ কী? এত গহনা কোত্থেকে আনলে?”
“এক পাগল শিল্পীর থেকে পেয়েছিলাম।”
“সত্যি করে বলো কোথায় পেলে?”
“ডাকো বউকে, ওকেই নাহয় বলি?”
চেতন পা টিপে টিপে বউয়ের কাছে এল। বড্ড আলুথালু হয়ে আছে লুনি। আর আঁকশিটাও হয়েছে তেমনি! ঘুমের মধ্যেও তার মায়ের স্তন মুখের মধ্যে পুরে রাখা চাই! চেতন আস্তে করে আঁকশির ঠোঁট থেকে লুনির স্তনের বোঁটাটাকে ছাড়িয়ে নিল। এরপর পাশ ফিরে শুইয়ে দিয়ে লুনির ঘাড়ের কাছে আলতো করে আদর বুলিয়ে ডাকল, “লুনি, ওঠো। আজ আমাদের কুটিরে কে এসেছে দেখো!”
লুনি ঘুমচোখে চেতনের কামরায় এল।
প্রবাহ তার বাক্স থেকে হাতির দাঁতের একখানি চিরুনি বার করল। এরপর অনেকক্ষণ ধরে লুনির কেশ বিন্যাস করল। নরম আঙুলের আদরে লুনির ঘুম আসতে লাগল। এবার সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, “এতগুলো গহনা সব আমাকে দিয়ে দিলে যে?”
“চাইলে আরও দেব। তবে তার বিনিময়ে তোমাকে আরেকটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে!”
লুনি ঘুরে বসল।
এবার প্রবাহ লুনির হাত দুখানি ধরে অনুনয় করে উঠল, “একটা সুন্দর মৃত্যু লুনি,--যতটা সম্ভব একটা সুন্দর মৃত্যু তুমি আমাকে উপহার দেবে!”
“যেমন?”
প্রবাহ পাথরের মতো স্থির হয়ে রইল।
লুনি সহজভাবে অফারটা লুফে নিল, “যাতনাহীন নিশ্চয়?”
“সে তো কমন চাওয়া। প্রথমে আমাকে অনেকটা ঘুমোতে দেবে। তবে একদম ডার্ক শ্যাডোর মধ্যে নয়। তার মধ্যে যথাসম্ভব স্বপ্ন থাকবে, সঞ্চার থাকবে। চাইলে আমি আমি যেন আমার আকাঙ্ক্ষায় আঁকা পৃথিবীকে একলহমায় দেখে নিতে পারি।”
“এইভাবে কতক্ষণ থাকতে চাও?”
“একটা পারিজাত ফুলের মালা দিও। একটা উঁচু চূড়ার ওপরে দোলনায় বসব। সে এসে দোল দেবে। হাওয়ার বাড়ি খেয়ে মালা থেকে ফুলগুলো খসে পড়তে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকু!”
“কে সেই লোকটা যে তোমাকে দোল দেবে?”
“ধরে নাও একটা পাগল! যে আমার মৃত্যুর সাক্ষীসনদে স্বাক্ষর করবে!”
“যদি না আসে?”
এবার প্রবাহ এক ঝলক হাসির পালক উড়িয়ে দিল, “তখন নাহয় তোমার কর্তাকেই ডেকে নেব!”
ঘুমে লুনির চোখ দুটো আরও আঠা আঠা হয়ে এল। অনেকটা রাত ধরে প্রবাহ যত্ন করে লুনিকে প্রসাধন করালো। প্রথম ঘুমের ঘোরটুকু মুছে গিয়ে ফের নতুন করে যখন আচ্ছন্নতা আসতে আরম্ভ করল, ঠিক সেইসময় প্রবাহ তার বাক্সের গহনাগুলো সব একেক করে পরিয়ে দিল।
লুনি লাজবতীর লতার মতো বরের সামনে এসে দাঁড়াল। চেতন একটুখানি হাসল।
প্রবাহ জিজ্ঞেস করল, “এখন কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে লুনি?”
লুনি বলল, “সাগরে!”
“সাগরে এখন বড্ড বেশি নোনা। তুমি বরং ঝোরার নিচে যাও!”
চেতন একটা কলস এগিয়ে দিল। লুনি গা ভর্তি গহনা নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
লুনি চলে গেলে প্রবাহ চেতনের অগোছালো ঘরখানা গুছিয়ে দিল। এরপর শুকিয়ে আসা সরাটার ওপর একটুখানি জল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এমন কটূ বিষ কার জন্যে রাখা ছিল আজ?”
এবার চেতন একটুখানি লজ্জা পেল।
প্রবাহ আবারও বলে উঠল,“আমাদের নিয়ে তোমাদের এত অবহেলা কেন বলবে?”
“আমি যেটা করি সেটা বড্ড বাজে আর একঘেয়ে কাজ! লুনিও চায় না আমি এসব করি!”
“এই জন্যেই তো আজ ওকেই মারবার অর্ডার এসেছে!”
চেতন চমকে উঠল, “কে দিলেন এই অর্ডার?”
“আমার অদৃষ্ট! আরে না না। বউকে মারলে পুরুষের আর থাকে কী! বরং তুমি লিখে দাও, অনেক টাকার সোনাদানা নিয়ে লুনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!”
“না। আমার লুনি মোটেও এমন স্বভাবের নয়!”
প্রবাহ হেসে উঠল, “বড্ড বউ-পাগলা! বেশ লিখতে হবে না। কিন্তু বিবিজান আজ কী কী গয়না পরল তার একখানা প্রুফ রাখবে না?”
“প্রুফ মানে?”
“আরে মশাই! সংসারে সামান্য একটা পাতিল রাখতে গেলেও তার বৈধ কাগজপত্র রাখতে হয় বুঝলে! কোর্টকাছারি থেকে যেভাবে একের পর এক নতুন নতুন রায় বেরোচ্ছে, কে কখন এসে হিসেব চাইবে বলা যায়!”
সিরিয়ালে যেমন ডায়মন্ড কার্টিং সিস্টেমে অভিনেতাদের মুখে সংলাপ বসানো হয়, সেভাবে প্রবাহ এক লাইন করে বলে যাচ্ছে। আর সেই মোতাবেক শুনে শুনে চেতন বয়ান লিখছে, “লুনি এখন বালির চড়া ধরে হাঁটছে। ওর পায়ে রয়েছে পাঁচভরি ওজনের মল। কোমরে কোমরবিছে। চার তাকের চন্দ্রহার। কাঁকনগুলো কলসের সাথে ঠোকা খাচ্ছে। ওগুলোর ওজন যেন কত?”
প্রবাহ তার ওজন মাপ ডিজাইন সব বলে দিচ্ছে।
এভাবে অনেকগুলো কাগজ রেডি করে বাক্সে বন্দী করল চেতন।
এখন সকাল হতে না হতেই খবরের হেডলাইন হচ্ছে, “নদী থেকে বালি তুললেই তাতে দলা দলা সোনা পাওয়া যাচ্ছে।”
অপরদিকে টিভির টক-শোতেও তর্ক তুঙ্গে, “কুবেরগণের কালো সম্পদ এখন বৈঁচি ফলের বিচির মতো এদিক-সেদিক গড়াগড়ি খাচ্ছে!”
প্রবাহ বুদ্ধিমতীর মতো বলে চলেছে, “লেখো, লুনি কোথায় গেছে কেউ জানে না। আরও লেখো, স্বভাব চরিত্রে আঁকশি অনেকটাই প্রাকৃত। খাবার জন্যে সে মুমূর্ষু মানুষকে অব্দি অস্থির করে তুলছে। আজ অব্দি মায়ের স্তন ছাড়া কিছুই মুখে তোলেনি সে।” চেতন লিখল।
চেতন একলা ঘরে প্রবাহের মুখোমুখি হয়ে বসে থাকে। প্রবাহ বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। তার প্রদাহ বেড়ে যায়। প্রবাহ অনুরোধ করে, “পারলে নরম একটা বিছানা করে দাও।”
চেতন তার তোরঙ্গ খুলে সবচেয়ে সুন্দর আর সরু কল্কা পাড়ের কাঁথাখানি বিছিয়ে দেয়।
আর এই সময় আঁকশি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবাহ প্রবোধ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। আঁকশি আগ্রাসী লতার মতো প্রবাহর কোল বেয়ে উঠে, ওর স্তনে মুখ ঘষতে থাকে। কুমারী প্রবাহর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে আঁকশিকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। আঁকশি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। চেতন অসহায় চোখে প্রবাহর দিকে তাকায়। কিন্তু প্রবাহ নিরুপায়! এবার চেতন শুকনো সরাটা আঁকশির দিকে এগিয়ে দেয়।
প্রবাহ শিউরে ওঠে, “কী সর্বনাশ মরে যাবে তো!”
চেতন চুপ করে থাকে।
একসময় প্রবাহ বিছানা ছেড়ে উঠে আস্তে করে খিড়কির দরজাটা খুলে দিল। আর ঠিক সেই সময় একটা হরিণ শাবক এসে আঁকশিকে খেলাতে খেলাতে কোথায় যেন নিয়ে গেল।
আঁকশি বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাস উঠল। আর সেই বাতাসে চেতনের ঘরের পুরনো আসবাবপত্র, জামাকাপড় সব উড়ে গেল।
অনেক রাত্রে একটা প্রদীপ হাতে করে প্রবাহের শিথানের কাছে এসে দাঁড়াল চেতন। বাইরে তখনো পাতার ওপর জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
চেতন সনদ লিখবে বলে শব্দ প্রস্তুত করছিল। প্রবাহ ধড়মড়িয়ে ঠেলে উঠল, “কে লুনি? পারিজাত পেলে?”
“না। আমি চেতন। কেন এমন সিদ্ধান্তে এলে প্রবাহ?”
প্রবাহ ফণা তুলে বসল, “এমন করে ক্রিয়েট করেছিলে কেন? আমার হাত কোথায়? এগুলো তো প্লাস্টিকের চাইতেও পলকা! আমার চোখ নেই কেন? কাজল পরতে গেলে বুঝতে পারি জগতের কোনোকিছুই আমার কল্পনার মতো সুন্দর নয়! কেন? বিশ্বাস না হলে উপড়ে নিয়ে দেখো, এগুলো কাঁচের গুলির চাইতেও কঠোর! মাথা একটা এঁকেছ বটে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ালেই চারিদিক চক্কর দিয়ে ওঠে! আর চেতনা? একজন দুঃস্থ মানুষ সামান্য লক্ষ্মীর ভাঁড়ারেও যেটুকু সঞ্চয় রাখে, আমার তাও দাওনি!”
“ক্রিয়েশানে সবকিছু পারফেক্ট হয় না! এটুকু মেনে নিয়েই বাঁচতে হয়!”
“এটা তোমাদের মতো ব্যর্থ কারিগরদের দায় এড়ানোর কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়! সংসারকে সামনে রেখে যদি আমাকে আঁক, তাহলে আর পাঁচজনের সাথে সম্পর্ক থাকবে। আমার বেঁচে থাকবার মধ্যে কার্যকারণ সুত্র থাকবে। সমাজ ও সংগসারের কাছে আমার নিজস্ব একটা আইডেনটিটি তৈরি হবে।”
এবার হো হো করে হেসে উঠল চেতন, “আছে তো! আইডেনটিটি ছাড়া কোনোকিছুই সৃষ্টি সম্ভব নয়!”
“তাহলে আজ অব্দি আমার কোনও গতি হল না কেন? বাইরের পৃথিবীর কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। দেশীয় চলচ্চিত্রে, নাটকে, সিরিয়ালে, সোস্যাল মিডিয়ায় আমার সদগতি হল না কেন? এমনকি চটুল টিকটকেও আমাকে কেউ গ্রহণ করেনি! এমনভাবে তুমি আমাকে নির্মাণ করেছ, কেউই আমার ব্যাপারে মর্যাদাপূর্ণ একটা রিভিউ দেয়নি! অতএব আমার তো মরে যাওয়াই উত্তম, তাই না?
“সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছি মৃত্যু তো আমার চাইই! তা নইলে অপমানের বহর আরও বাড়বে। বেড়ে যাবে যাতনার জগৎ। দেখছো না প্রত্যেক মুহূর্তে পৃথিবীর সংজ্ঞা কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অথচ আমাদের এমন কপাল একটা মোচড়ানো মুড়ির ঠোঙার ওপরে উঠতে পারলাম না! অতএব সুন্দর একটা মৃত্যুর অধিকার আমারও আছে!”
অন্ধকার ক্রমশ আঠালো হোয়ে ওঠে। প্রবাহ পরিষ্কার দেখতে পায় চেতনের চোখের নিচে কে যেন মোটা করে কালি লেপে দিয়েছে! কী এক অব্যক্ত গ্লানি ওকেও যেন কাবু করে ফেলেছে!
“অনেকদিন হল, লুনি আসবে না? কোথায় গেল? কাগজে কী লিখেছো দেখি?”
চেতন কাগজ আনতে অন্যত্র সরে গেল। আর ঠিক দমকা বাতাসে এইসময় প্রদীপটা দপ করে নিভে গেল।
সকালবেলা অনেকটা সময় ধরে শুকনো সরাটার ওপর কল্কা আঁকল প্রবাহ। ওর ইচ্ছে, লুনি ফিরে এসে যে পাত্রটায় বিষ গুলবে সেটাও যেন সুন্দর হয়! তখনো চেতন জাগেনি। যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেলা বাড়তে লাগল। এবার প্রবাহ চঞ্চল হয়ে উঠল। সে চেতনের দরজায় কড়া নাড়ল। কিন্তু না। চেতন উঠল না। আরও খানিকটা অপেক্ষা করল। প্রহর অতিক্রান্ত হল। নাম ধরে ডাকল। তবু সাড়া দিল না! এবার প্রবাহ কঠিন থেকে কঠিনতর সিদ্ধান্ত নিলো। চেতনের দরজায় কুঠার হানল! কিন্তু হায়! চেতন নেই!
কোথায় গেল চেতন? মৃত্যুর এতটা কাছাকাছি এসেও শূন্য হাতে ফিরে যাবে সে? সেও কি সম্ভব?
নিজহাতে নকশা আঁকা সরাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রবাহ। এখন এলোমেলো ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে লুনিদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সে! পথের দুধারে ঝরা পাতার মতো ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ব্যর্থ কবিদের লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস! এখন এগুলো দুপায়ে দলে এগিয়ে যাচ্ছে প্রবাহ। প্রবাহ লক্ষ্য করল, তার মতো করে কেউ ককিয়ে উঠছে না। কেউ চিৎকার করছে না। সবাই যেন প্রকৃতির নিয়মে পচে পডসল হবার অপেক্ষায় প্রহর গুনে পড়ে আছে!
হঠাৎ নজরে পড়ল সেই দোলনাটা, যেটা অনেকগুলো গহনার বিনিময়ে অর্ডার দিয়েছিল প্রবাহ। দোলনাটা একটা উঁচু টিলার ওপরে বাঁধা। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে স্থির! আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখল, লুনি-- গাছের শেকড়ে বসা-- ঠিক যেন একটা খোবলানো চুনা পাথরের মূর্তি! অঙ্গে সাদা থান, গলায় পারিজাত ফুলের মালা! প্রবাহ লুনিকে জড়িয়ে ধরল, “এ কী লুনি, তোমার এই বেশ কেন?”
লুনি নিচের দিকে তাকাল।
প্রবাহ দেখল, নিচে খাদের মধ্যে চিৎ হয়ে পড়ে আছে চেতন!
প্রবাহ আর্তনাদ করে উঠল, “চেতন, ওঠো! ওঠো প্লিজ!”
এখন ঘন ঘন সংজ্ঞা হারাচ্ছে প্রবাহ। লুনি কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে তার গলা থেকে পারিজাতের মালাটা খুলে প্রবাহের সরার ওপরে রাখল! আর ঠিক তখন দোলনাটা অদ্ভুতভাবে দুলে উঠল!