একসময় এমনও মনে করা হত যে বিস্ময় ও বিন্যাসের গুরুভারে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সফল মঞ্চায়ন দুষ্কর, অসম্ভবও হয়ত বা। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বহুরূপী গোষ্ঠী প্রথম এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন, তাঁদের অনুধাবনের গভীরতা ও অভিনয়দক্ষতা দিয়েই। খুবই আশার কথা যে আজকাল অনেকেই রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করার “সাহস” করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে একবার রক্তকরবীর অভিনয় দেখেছিলাম। পরিভাষার 3rd form, কোনো সেট বা এমনকি মঞ্চেরও সাহায্য ছাড়াই; এখনও মনে আছে সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিজ্ঞতা।
রবীন্দ্রনাটকের তাত্ত্বিক গাম্ভীর্যের জন্যই হয়ত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বিদগ্ধমহলে। এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত যে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব নাটকেই থাকে কোনো গভীর দার্শনিক প্রেক্ষাপট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় কোনো প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে protagonist-দের বিদ্রোহ, বা কোনো নতুন দিগন্তের সন্ধান এবং কোনো চরম পরিণতির ভিতর দিয়েই উত্তরণ। রবীন্দ্রনাথের নাটক এতটাই রূপকধর্মী যে মাঝে মাঝেই নাটকের বাস্তব পটভূমি মিলেমিশে যায় রূপকথার সঙ্গে। তাঁর শিবতরাই, উত্তরকূট, পাতালপুরী বা অচলায়তন যেন কোনো সমসাময়িকাতাতেই আবদ্ধ নয়, মঞ্চনির্দেশ প্রায় নেই বললেই চলে, দেশ কালের সব যতিচিহ্নই সেখানে অবাস্তব। তাঁর নাটকের ভিতরে নাট্যকারের রাষ্ট্রনৈতিক, সমাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক পক্ষপাত খুবই স্পষ্ট, যা রবীন্দ্রনাথের অন্য সাহিত্য-সৃষ্টিতে (প্রবন্ধ ছাড়া) অনেকটাই প্রছন্ন। রবীন্দ্রনাটকে থাকেন রাজা বা রাজবংশীয় ধর্মযাজক আর থাকেন সাধারণ মানুষ। নাটকের protagonist বেরিয়ে আসতে পারেন সাধারণ মানুষ বা শাসকশ্রেণীর ভিতর থেকেই। রবীন্দ্রনাটকে আরেক ধরনের চরিত্রেরও অমোঘ উপস্থিতি; দাদাঠাকুর, ঠাকুরদাদা, গুরু, গোঁসাই, বিশুপাগলা, অন্ধবাউল, ধনঞ্জয় বৈরাগীদের আমরা পাই প্রায় সব নাটকেই। সংসার-নির্লিপ্ত, প্রায় ভবঘুরে গোত্রের মানুষ এঁরা। নাটকের ঘটনাস্রোতের অভিনব বাঁকে এসে হাজির হন, শোনান সহজ ভাষায় অনেক গভীর দর্শন, আর শোনান গান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন নাটকে। এবং সে ব্যবহার যে প্রক্ষিপ্ত মনে হয় না তার অনেকটাই কারণ যাদের মুখে গানগুলি দেওয়া হয়েছে তাঁরাই তা মানানসই করে তোলেন।
ধনঞ্জয় বৈরাগী—রবীন্দ্রনাটকের এমনই এক উজ্জ্বল পার্শ্বচরিত্রকে নিয়ে আমার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
রবীন্দ্রনাটকের কথা উঠলেই প্রায় একই নিঃশ্বাসে এসে পড়ে রক্তকরবী–মুক্তধারা। এই দুই নাটকই গভীরভাবে রূপক-সাংকেতিক, তবে তাদের মিলের জায়গা বোধহয় এই অবধিই। রক্তকরবীতে খুব স্পষ্টভাবে একধরনের সমাজব্যবস্থাকে কটাক্ষ করা হয়েছে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পতনের সংকেত পাওয়া যায় এমন এক ব্যাখ্যা বহুল প্রচলিত। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেও রক্তকরবীর “মূল” বিষয়বস্তু ও “অন্তর্নিহিত” অর্থ নিয়ে কম বিশ্লেষণ হয়নি। শেষে নাকি নাট্যকার নিজেই বলেছিলেন (একরকম অতিষ্ঠ হয়েই হয়ত) যে রক্তকরবী শুধুই নন্দিনী নামের একটি মেয়ের গল্প। (“রক্তকরবী” নামকরণের আগে নাকি নাটকটির নাম “নন্দিনী” ভাবা হয়েছিল।)
মুক্তধারা, রক্তকরবীর তথাকথিত সমগোত্রীয় হলেও, তাকে এত সহজে কোনো ভাল-মন্দের, দ্বন্দ্বের ছাঁচে ফেলা যায় না। বার্তার বৈচিত্র্যে মুক্তধারা আরও জটিল, যদি ধরে নেওয়াই হয় “রূপক-সাংকেতিক” হওয়ার সুবাদে কোনো বার্তা থাকতেই হবে।
উত্তরকূটের যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারা ঝর্ণায় বাঁধ বেঁধেছেন। বহু পরিশ্রমের পর, বহু প্রাণের বিনিময়ে, বহু ব্যর্থতার শেষে এসেছে সাফল্য। মুক্তধারার জল উত্তরকূটের অঙ্গরাজ্য শিবতরাইয়ের তৃষ্ণা মেটায়। উত্তরকূটের শাসকদের কাছ থেকে শিবতরাই পেয়েছে বঞ্চনা এবং অবদমন। উত্তরকূট ও শিবতরাইয়ের জীবনযাত্রা, রুচি ও ব্যবহারের তারতম্যে মনে হয় তাদের এক রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়ত অনেকটাই উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিতের শাসন পরিচালনায় ছিল, রাজা রণজিতের থেকে যুবরাজের প্রতিই শিবতরাইয়ের প্রজারা বেশি অনুরক্ত, তাঁকেই পেতে চায় তাদের রাজা হিসেবে। অভিজিতের নির্দেশে শিবতরাইয়ের সঙ্গে বর্হিবিশ্বের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে নন্দিসংকটের গড় ভেঙ্গে, সে পথে শিবতরাইয়ের পশম বিকোবে বিদেশের হাটে। অর্থনৈতিক সাবলম্বন আসবে, শিবতরাইকে উত্তরকূটের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না অন্নবস্ত্রের সংস্থানের জন্য। কিন্তু শিবতরাইয়ের খাজনা বাকি অনেকদিন, অভিজিৎ কোনো উদ্যোগই নেননি তার প্রতিকারের। মুক্তধারাকে বেঁধে ফেলা প্রকৃতির পরাক্রমের উপর মানুষের যন্ত্রশক্তির জয়োৎসব, বিভূতির সম্বর্ধনার তোড়জোড় চলতে থাকে। তবে এই প্রযুক্তির সৌধের ভিত্তি আসলে রাজনৈতিক কৌটিল্য, তৃষ্ণার জল নিয়ন্ত্রণ করে শিবতরাইয়ের আনুগত্য চিরস্থায়ী করা।
অভিজিৎ নিজের জন্মবৃত্তান্ত জেনে গেছেন, তাঁকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল মুক্তধারার স্রোতের পাশ থেকে, তাই রাজবাড়ির প্রতি তাঁর আকর্ষণ বিলীয়মান। মুক্তধারাকে বেঁধে শিবতরাইয়ের প্রজাদের উপর কর্তৃত্ব কায়েমের চক্রান্তে অভিজিৎ মর্মাহত, তার প্রতিবাদে মুখর এবং তার প্রতিকারে বদ্ধপরিকর।
রাজা রণজিৎ তাঁরই প্রযত্নে লালিত বিভূতির কীর্তিতে গর্বিত, শিবতরাইয়ের দুষ্ট প্রজাদের উচিত শিক্ষার অস্ত্র হাতে পেয়ে নিশ্চিন্ত। তবে দন্তনখবিকশিত বাঁধের আকাশ-ঢাকা হিংস্র মূর্তি তাঁর মনেও এক অজানা অমঙ্গলের আশংকা জাগায়। একদিকে উত্তরকূটের জনগণ মেতে উঠেছে বিভূতি সম্বর্ধনা উৎসবে, অন্যদিকে আগ্রাসী তৃষ্ণার ভ্রূকুটি শিবতরাইয়ের মানুষদের বিক্ষুব্ধ করছে। বাঁধ তৈরির মজুরির কাজে অনেককেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই আর ফিরে আসেনি; পুত্রহারা মায়েদের বিলাপও শোনা যায় আনাচেকানাচে।
শিবতরাইয়ের রাজদ্রোহিতায় পরোক্ষ মদতের অপরাধে রাজা রণজিৎ যুবরাজ অভিজিতকে বন্দী করেছেন। শিবতরাইয়ের প্রতি অভিজিতের আপাত পক্ষপাত উত্তরকূটের জনমানসেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া এনেছে।
নাটকের এমনই এক সম্ভাবনাময় মুহূর্তে “শিবতরাইয়ের ধনঞ্জয় বৈরাগীর প্রবেশ”। তার প্রবেশ সংবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাদটীকায় নাট্যকার বলেন “এই নাটকের পাত্র ধনঞ্জয় ও তাহার কথোপকথনের অনেকটা অংশ প্রায়শ্চিত্ত নামক আমার একটি নাটক হইতে লওয়া। সে নাটক এখন হইতে পনেরো বছরেরও পূর্বে লিখিত।” মুক্তধারার শেষে তারিখের উল্লেখ, “পৌষসংক্রান্তি ১৩২৮”। প্রায়শ্চিত্ত নাটকের শুরুতেই ‘বিজ্ঞাপন শীর্ষক’ একটি বিজ্ঞপ্তিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বউঠাকুরানীর হাট নামক উপন্যাস হইতে এই প্রায়শ্চিত্ত গ্রন্থখানি নাট্যীকৃত হইল। মুল উপন্যাসটির অনেক পরিবর্তন হওয়াতে এই নাটকটি প্রায় নতুন গ্রন্থের মতই হইয়াছে।” তারিখের উল্লেখ, “৩১ শে বৈশাখ সন ১৩১৬” সালে। এই দুই নাটকের কাহিনীসূত্রেও আবছা মিল পাওয়া যায়, রাজ্যের একাংশের প্রতি ব্যবহার নিয়ে রাজার সঙ্গে যুবরাজের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে যুবরাজের বন্দী হওয়া, বিক্ষুব্ধ প্রজাদের একাংশ ধনঞ্জয় বৈরাগীর পিছনে সংগঠিত হওয়া ইত্যাদি। তবে এই দুই নাটকের বিষয় ও বক্তব্যের বিন্যাসে কোনো সাযুজ্য নেই বললেই চলে। প্রায়শ্চিত্ত মূলত রাজার ক্ষমতামদমত্ততা ও রাজান্তঃপুরের নানা টানাপোড়েনের কাহিনী, কোনো বৃহৎ প্রেক্ষিত বা গুহ্য তত্ত্বের ঝংকার সেখানে শোনা যায় না। মনে প্রশ্ন জাগে, এক যুগেরও বেশি সময় পরে রবীন্দ্রনাথ কেন ধনঞ্জয় বৈরাগীকে আবার ব্যবহার করলেন মুক্তধারা নাটকে? আজকাল অবশ্য “হিট” সিনেমার ফর্মুলা “রিপিট” করা বেশ চলনসই ব্যাপার, তবে তাঁর নাটক “হিট” করানোর এমন কোনো দুরাশায় রবীন্দ্রনাথ বিচলিত ছিলেন বলে মনে হয় না। ধনঞ্জয় বৈরাগী হয়ত তাঁর অবচেতন মনে থেকে গিয়েছিল, এবং এও মনে ছিল যে চরিত্রটির পুরো সম্ভাবনা প্রায়শ্চিত্ত-এ ব্যবহৃত হয়নি।
১৯০৯–১৯২১ এই মাঝখানের সময়টা কিন্তু বেশ ঘটনাবহুল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়া, নাইটহুডে ভূষণ, জালিয়ানওয়ালাবাগ, নাইটহুড পরিত্যাগ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসী প্রভাব এবং ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘনায়মান উদ্দীপনা।
ধনঞ্জয় বৈরাগীর প্রথম সংলাপ গান— “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব/ বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে…”। বাধাবিপত্তির ঝঞ্ঝা পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছনোর আস্থা ধ্বনিত হয় এই পরিচিত সঙ্গীতে। “মার” এখানে নিশ্চয় শারীরিক প্রহারের সমার্থক নয়, জীবনপথের নানা প্রতিকূলতারই প্রতীক। তবে আক্ষরিক মারের প্রসঙ্গও এসে পড়ে অল্প পরের সংলাপেই। ধনঞ্জয়ের গান শেষ হতেই একদল শিবতরাইয়ের প্রজার প্রবেশ। তাদের অত্যাচারের নালিশের উত্তরে ধনঞ্জয়ের জিজ্ঞাসা,
—ওরে, আজও মারকে জিততে পারলি নে? আজও লাগে?
প্রজাদের গণেশ সর্দারের কথায় সহিংস প্রতিবাদের হুমকি,
—ঠাকুর একবার হুকুম করো, ঐ ষণ্ডামার্কা চণ্ডপালের দণ্ডটা খসিয়ে দিয়ে মার কাকে বলে একবার দেখিয়ে দিই।
ধনঞ্জয়। মার কাকে বলে তা দেখাতে পারিস নে? জোর বেশি লাগে বুঝি? ঢেউকে বাড়ি মারলে ঢেউ থামে না, হালটাকে স্থির করে রাখলে তবেই ঢেউ জয় করা যায়।
ধনঞ্জয়ের অনেক সংলাপই নানা উপমায় ঋদ্ধ। খুব গম্ভীর বীক্ষণও অনেক সময় তরল করে বলা হয় এই উপমার দ্যোতনেই। রবীন্দ্রনাথের সবরকম রচনাতেই উপমার ব্যবহার ব্যাপক, এমনকি গানেও। কী অবলীলায় গাওয়া হয় উপমার ঘটনাটা, “আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে, পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর ধারা জাগে/ মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে, বিশ্বনাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে/ তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও, যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে…”
ধনঞ্জয় আর প্রজা সর্দারের সংলাপে এটা স্পষ্ট যে বৈরাগীই তাদের অবিসংবাদী নেতা, তার অনুমতির অপেক্ষাতেই থমকে আছে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ। ধনঞ্জয়ের এই নেতৃত্বে অবস্থান কী কারণে তা আমাদের ভাবায়। সে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি নয়, যে যুবরাজের সঙ্গে তার হৃদ্যতা তিনিও এখন কারান্তরীণ। তবে নিশ্চয়ই জনচেতনার মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার কোনো পন্থা ধনঞ্জয়ের জানা আছে; সে হয়ত তার গান, তার কথা বা তার বৈরাগ্যমণ্ডিত জীবনচর্যা। ধনঞ্জয়ের উপর শিবতরাইয়ের প্রজাদের আস্থার প্রকার ও গভীরতা বোঝা যায় এই কথোপকথনের মধ্যে—
২য় প্রজা। তোমাকেই আমরা বুঝি, কথা তোমার নাই বুঝলুম।
ধনঞ্জয়। তা হলেই সর্বনাশ হয়েছে।
গণেশ। কথা বুঝতে সময় লাগে, সে তর সয়না; তোমাকেই বুঝে নিয়েছি, তাতেই সকাল সকাল তরে যাব।
ধনঞ্জয়। তার পরে বিকেল যখন হবে? তখন দেখবি কূলের কাছে তরী এসে ডুবেছে। যে কথাটা পাকা, সেটাকে ভিতর থেকে পাকা করে না বুঝিস তো মজবি।
এই অল্পকয়েক লাইনের আপাত আটপৌরে সংলাপ ধনঞ্জয়ের সঙ্গে তার অনুগামীদের সম্পর্ক অনেকটাই পরিষ্কার করে দেয়। ধনঞ্জয়কে শিবতরাইয়ের প্রজারা গুরু মেনেছে। তাদের সব জাগতিক ও হয়ত বা আধ্যাত্মিক সংকটমোচনের দায় ধনঞ্জয়ের, তাদের বুদ্ধি বিবেচনা সবই বৈরাগীর জিম্মায় দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত। ধনঞ্জয় বললে তারা মারতে উঠবে, না বললে নয়। তাদের সরল স্বীকারোক্তি ধনঞ্জয়ের কথা তারা বোঝে না এবং না বুঝেও পার পাওয়ার সহজ উপায়ও তাদের জানা—অন্ধ আনুগত্য।
পৃথিবীর আর সব গুরুর মত, ধনঞ্জয়ও এখানে icon বিশেষ, তার নির্দেশিত পথই পথ, পথ নির্বাচনের কার্যকারণের দায় তার একারই। এমন ব্যবস্থা বেয়ে আশু ভবিষ্যতের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হয়ত পৌঁছনো যায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন উন্নতির পারম্পর্য পাকা করা দুরূহ। সব গুরু একথা মনে মনে বুঝলেও, ভক্তদের ভুলেও বলেন না। আর এখানেই ধনঞ্জয় ব্যতিক্রম। তার কথাকে বুঝতে না চেষ্টা করে তাকেই সকাল সকাল মেনে নেওয়া সহজ বটে, কিন্তু এমন সস্তায় বাজিমাতের মধ্যে বিকেলের ছায়াও যে নিহিত থাকে তা মনে করিয়ে দেয় শিবতরাইয়ের প্রজাদের। পাকা কথা ভিতর থেকে না বুঝে বাইরে তার অভিব্যক্তি নকল করার চেষ্টায় কিরকম ফল হয়, তার নিদর্শন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল নয়। ধনঞ্জয় বৈরাগী চলেছে উত্তরকূটের রাজা রণজিতের সাক্ষাতে, এক অর্থে স্বেচ্ছা কারাবরণে। সেখানে তার অনিষ্টের আশংকায় প্রজারা সরব হলে, বৈরাগী বলে…
—তোরা যে মনে মনে মারতে চাস তাই ভয় করিস, আমি মারতে চাই নে তাই ভয় করিনে। যার হিংসা আছে, ভয় তাকে কামড়ে লেগে থাকে।
অহিংসা ধনঞ্জয়ের নীতি, হয়ত কার্যসিদ্ধির কৌশলও। তবে তাকে খুব কাছ থেকে পাওয়া যে তার অনুগামীর আত্মশক্তিকে খর্ব করছে এ নিয়ে ধনঞ্জয় গভীরভাবে চিন্তিত। তাই এই স্বেচ্ছা কারাবরণ পরিকল্পিত, শিবতরাইয়ের প্রজাদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর শিক্ষা।
১ম প্রজা। যাই বল, রাজদুয়ারে কেন চলেছো বুঝতে পারলুম না।
ধনঞ্জয়। বেশ, বলব? মনে বড় ধোঁকা লেগেছে।
১ম প্রজা। সেকি কথা?
গুরুর মনেও যে প্রশ্ন থাকতে পারে, তিনিও যে নিঃসংশয় নন তা জেনে আমরাও ধাক্কা খাই।
ধনঞ্জয়। তোরা আমাকে যত জড়িয়ে ধরছিস তোদের সাঁতার শেখা ততই পিছিয়ে যাচ্ছে। আমারও পার হওয়া দায় হল। তাই ছুটি নেবার জন্য চলেছি সেইখানে আমাকে কেউ মানে না।
প্রজাদের প্রশ্নহীন আনুগত্য সময় সময় ধনঞ্জয়ের নিজের সাধনার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতি পদে অন্যকে পথের হদিশ দিতে গিয়ে, ধনঞ্জয়ের নিজের যাত্রাও বিঘ্নিত হয়।
রাজা রণজিতের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের স্বভাবতই মধুর আলাপচারিতা নয়…
রণজিৎ। … খাজনা দেবে কি বল?
ধনঞ্জয়। না মহারাজ দেব না।
রণজিৎ। দেবে না? এত বড়ো আস্পর্ধা?
ধনঞ্জয়। যা তোমার নয়, তা তোমাকে দিতে পারব না।
রণজিৎ। আমার নয়?
ধনঞ্জয়। আমার উদ্বৃত্ত অন্ন আমার ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।
ধনঞ্জয়ের বিদ্রোহের পথ অসহযোগ। তার সঙ্গে তার অহিংসার মিশ্রণ আমাদের চেনা এক দর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
রাজদ্রোহিতায় এমন সোচ্চার ঘোষণায় ধনঞ্জয়কে গ্রেপ্তার হতে হল। তার সঙ্গে আসা শিবতরাইয়ের প্রজারা ফিরে যেতে নারাজ, তাদের একমাত্র ভরসাকে হারিয়ে তারা বিহ্বল।
গণেশ। … আমাদের সকলের জোর একা তোমারই মধ্যে।
ধনঞ্জয়। তবে আমার হার হয়েছে। আমাকে সরে দাঁড়াতে হল।
দেশের মানুষের আত্মশক্তিকে না জাগাতে পারা অবশ্যই কোনো দায়িত্বপূর্ণ দেশনেতার ব্যর্থতা; তাঁর ব্যক্তিসত্তা যদি তাঁর বাণীকে ঢেকে দেয় তবে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। “আমার হার হয়েছে…”, খুব সহজভাবে বলা হলেও পরাজয়ের গভীর গ্লানি বয়ে আনে।
ধনঞ্জয়ের অনেক উপরোধে প্রজারা শেষ পর্যন্ত ফিরে গেলেও, শেষ মুহূর্তে শুনিয়ে গেল এক বিষম দুর্বলতার কথা… “চললুম, কিন্তু আমার বলবুদ্ধি রইল এইখানেই পড়ে”।
বিদ্রোহের সব ছিদ্রই এখন বন্ধ করা গেছে, অভিজিৎ রাজবন্দী, দুষ্ট বৈরাগীও তাঁর আয়ত্তের মধ্যে। তাই রাজা রণজিৎ ধনঞ্জয়ের সঙ্গে কিছু দার্শনিক আলোচনার ঝুঁকি নিতে পারেন। বা হয়ত ধনঞ্জয়ের প্রতি শিবতরাইয়ের প্রজাদের আনুগত্য তাঁকে খানিক ভাবিয়েছে। নৃপতি হয়েও তিনি যা পাননি, তা কী করে পেল এই ছন্নছাড়া সন্ন্যাসী?
রণজিৎ। কী বৈরাগী, চুপ করে রইলে যে।
ধনঞ্জয়। ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে রাজা।
ধনঞ্জয়। … এতদিন ঠাউরেছিলাম আমি ওদের বলবুদ্ধি বাড়াচ্ছি। আজ মুখের উপর বলে গেল আমিই ওদের বলবুদ্ধি হরণ করছি।
ধনঞ্জয়। ওদের যতই মাতিয়ে তুলেছি ততই পাকিয়ে তোলা হয়নি।
যে-কোনো আন্দোলনে একটা উন্মাদনা লাগে। কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন বা সম্ভাবনার প্রথমে দেখা দেয় বৌদ্ধিক অংকুর, একজন বা অল্প কয়েকজনের মনে। তার পরে বাস্তবে পরিবর্তনের পথ কাটতে হলে লাগে বহু মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এবং এই বহুমানুষকে একই সূত্রে বাঁধতে হলে মাতিয়ে তুলতে হয়, হয়ত বা কোনো মন্ত্র দিয়ে। কিন্তু যে পরিবর্তনের জন্য এত প্রয়াস, সেই পরিবর্তিত অবস্থাটি কেমন হবে তা নিয়ে আন্দোলনকারী mob-এর কোনো স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। হয়ত থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু যে নীতির প্রশ্নে আন্দোলন তাও কি বুঝতে হবে না? শিবতরাইয়ের প্রজাদের কথায় কিন্তু মুক্তধারার বাঁধ বা নন্দিসংকটের পথ সম্বন্ধে সংশয় বা উল্লেখ নেই বললেই চলে।
ধনঞ্জয়ের কথায় এক চিরায়ত দ্বন্দ্বের প্রকাশ, মানুষকে মাতানো যতটাই সহজ, পাকানো ততটাই কঠিন।
তাঁর দ্বন্দ্বকে দৌর্বল্য বলে মনে করে রণজিৎ নেতৃত্ব থেকে সরে আসতে বললে ধনঞ্জয়ের উত্তর…
—আমি সরে দাঁড়ালেই ওরা একেবারে তোমার চণ্ডপালের ঘাড়ের উপর গিয়ে চড়াও হবে। তখন যে দণ্ড আমার পাওনা সেটা পড়বে ওদেরই মাথার খুলির উপরে। এই ভাবনায় সরতে পারিনে।
যে-কোনো গণ আন্দোলনেই অনেক মানুষের আবেগকে একটি দিকে সঞ্চালিত করা হয়। সব সময়েই ভয় থাকে এই আবেগের অভিব্যক্তি হিংসার সহজ পথ নেবে। ধনঞ্জয় তার আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী পরিণতি আটকানোর একমাত্র প্রহরী। সে জানে পুরোপুরি না-বোঝা আর পুরোদস্তুর উত্তেজনার রসায়ন একটু অসাবধান হলেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তাই… “সরতে পারি নে”।
নাটকের ঘটনা এগোতে থাকে। বন্দীশিবিরে আগুন লাগিয়ে মুক্তি দেওয়া হয় অভিজিৎ ও ধনঞ্জয়কে। মুক্তি পেয়ে অভিজিৎ চলতে থাকেন একা, তাঁর সংকল্পের পথে। অভিজিতকে না পায়ে উত্তরকূটের কিছু ক্রুদ্ধ প্রজা ধনঞ্জয়কে তাঁর সহযোগী সন্দেহে বন্দী করে, তাঁকে বেঁধে পথের ধারেই ফেলে রাখা হয়। তার পরে সেই বাঁধন ঘুচিয়ে দেয় বন্দীকারীদেরই একজন, সমূহ বিপদের আশংকায় বৈরাগীকে শিবতরাই ফিরে যেতে অনুরোধ করে। ধনঞ্জয় বলে আজ রাত্রেই তার ডাক পড়ার সম্ভাবনা, তাঁকে থাকতেই হবে। এদিকে নন্দিসংকটের খুলে দেওয়া পথ বন্ধ করতে সচেষ্ট বিভূতি, জোর করে লোক ধরে এনে এই কাজে লাগানো হচ্ছে। হঠাৎ শোনা যায় শিবতরাই থেকে দলে দলে লোক আসছে তাদের প্রিয় যুবরাজকে মুক্ত করবার জন্য। একই সঙ্গে উত্তরকূটের বিক্ষুব্ধ জনতাও খুঁজছে অভিজিতকে। রাজা রণজিৎ শংকিত যুবরাজের নিরাপত্তার জন্য। এমনই এক টান টান উত্তেজনার মুহূর্তে প্রবল জলোচ্ছাসের শব্দ জানিয়ে দেয় মুক্তধারার বাঁধ পরাস্ত হয়েছে। আর তার সঙ্গে বয়ে আনে আরেক অমোঘ বার্তা, অভিজিৎ বাঁধের গোপন ছিদ্রে আঘাত করে বিভূতির কীর্তি নস্যাৎ করেছেন। কিন্তু যন্ত্রদানব তার ঘাতককেও প্রত্যাঘাত করেছে, মুক্তধারার উন্মুক্ত স্রোত অভিজিতকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তাঁর অস্তিত্বের উৎসে। বিস্মিত, মর্মাহত, নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ধনঞ্জয়ের কন্ঠে গান… “বাজে রে বাজে ডমরু বাজে/ হৃদয় মাঝে হৃদয় মাঝে/ নাচে রে নাচে চরণ নাচে/ প্রাণের কাছে প্রাণের কাছে”।
যন্ত্রসভ্যতার গহ্বরে যে সর্বনাশের বীজ লুকোনো থাকতে পারে তার প্রতি এক বলিষ্ঠ কটাক্ষ পাওয়া যায় মুক্তধারা নাটকে। প্রযুক্তির স্বার্থলিপ্সু ব্যবহার কী ভীষণ অমঙ্গলের সোপান হতে পারে তারও স্পষ্ট সংকেত দেওয়া হয়। সম্প্রতি ভারতবর্ষে একতি বিরাট বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে সোচ্চার প্রতিরোধ আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তা’তে এই নাটকের প্রাসঙ্গিকতা মনে এসেছে। মুক্তধারাতে চিত্রায়িত হয়েছে বৃহত্তর স্বার্থে এক ব্যক্তিমানুষের চরমতম উৎসর্গের কাহিনীও।
তবে নাটকের পরিণতিতে ধনঞ্জয় বৈরাগীর কোনো প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই। বাঁধ ভেঙে দিয়ে মৃত্যুবরণ একান্ত অভিজিতেরই নিজস্ব সংকল্প। শিবতরাইয়ের উপর উত্তরকূটের কর্তৃত্ব শেষ পর্যন্ত অভিজিতের এই চরম আত্মদানের ভিতর দিয়েই আলগা হয়। ধনঞ্জয় বৈরাগী সেখানে দর্শকমাত্র, এমন ঘটনার কোনো পূর্ব-ইঙ্গিতও তার কথা বা গানে মেলে না। তবে ধনঞ্জয় বৈরাগী চরিত্রটির তাৎপর্য কী মুক্তধারা নাটকে? প্রায়শ্চিত্ত-এর এত বছর পরে কেনই বা তাকে আবার বাঁচিয়ে তোলা? কেন এই ভারি চরিত্রটির আমদানী? “শুধু হাসিখেলা প্রমোদের মেলা?”
মুক্তধারায় যন্ত্রদানবের ভ্রুকুটি ইত্যাদি তথাকথিত মূল বক্তব্যের সমান্তরালে আরেকটি ধারাও বলিষ্ঠভাবে বহমান। তা হল একটি ব্যাপক গণ-আন্দোলন ও তার নেতৃত্বের বিবর্তন-রূপরেখা বা genesis.
সমসাময়িক ঘটনার দিকে তাকালে প্রেক্ষিতটা চেনা মনে হয়। ১৯২১ সাল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধছে, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে নেতৃত্ব। দলে দলে লোক ঝাঁপিয়ে পড়ছে সংগ্রামে, অনেকটাই নেতার ব্যক্তিত্বজৌলুসের মোহে। নেতা বলতে শুরু করেছেন আত্মশক্তি উদ্বোধনের কথা, অহিংসাকে ব্যবহারিক নীতি রূপে গ্রহণ করার কথা। তাঁর অনুগামীদের উৎসাহ ষোল-আনা, কিন্তু তাঁর দীক্ষার অনুধাবন ততটাই কি?
পরাধীন ভারতের জনমানসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তখন হয়ে উঠেছেন আসমুদ্রহিমাচলের গান্ধীজি।
গান্ধীর নেতৃত্বের মডেল ছিল নিজের ব্যক্তিজীবনের দৃষ্টান্ত দিয়ে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলা। ভারতের আমজনতা গান্ধীর চরকা, খদ্দরের দুর্বার আকর্ষণে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়েছিল স্বাধীনতার সংকল্পে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, গান্ধীর শিক্ষা মানুষের কতখানি আত্তীকরণ হয়েছিল। গান্ধীর ব্যক্তিজীবনের কঠোর অনুশাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে হওয়া আশ্চর্যের নয়। কিন্তু তাঁর মূল অহিংস অসহযোগের মন্ত্রও ভারতবাসীর পুরোপুরি হজম হয়নি; তাদের উদ্বেলিত করেছিল, উদ্বোধিত করেনি। চৌরিচোরার ঘটনা, স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে ও পরের ব্যাপক দাঙ্গা ইত্যাদি এই কঠিন সত্যের সাক্ষর বহন করে। দেশকে স্বাধীন করার অভীষ্ট লক্ষ্যে গান্ধী পৌঁছেছিলেন। কিন্তু জাতির আত্মনির্ভরতার সংস্থান ও নৈতিক উত্তরণের ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াস কোনো বিরাট সাফল্যের দাবি রাখে না। এ তাঁর দোষ বা অপূর্ণতা নয়, নিজের নির্দিষ্ট পথে নিজে একলা চলেছেন আজীবন, সমান ঋজু। এ যেন এক অনিবার্য এবং খানিক প্রত্যাশিত ঐতিহাসিক tragedy.
রবীন্দ্রনাথ যে কথা বারবার বলেছেন, তিনি নিজে মূলত ও মুখ্যত কবি। তবে যে কবি লেখেন “লড়বি কে আয় ধ্বজা বেয়ে/ গান আছে যার ওঠ্-না গেয়ে/ চলবি যারা চল রে ধেয়ে/ আয় না রে নিঃশঙ্ক” প্রভৃতি ছত্র, তাঁর মনে দেশহিতের প্রবল কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের বাসনা স্বভাবতই ছিল। তবে স্বভাবকবি বলেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দ্রষ্টাও। তাই সাময়িক উত্তেজনার জোয়ারে কোনো আশু কাজ হাসিল হলেও তা যে জাতির অগ্রগতির পদক্ষেপ নয় তা তিনি গভীরভাবে বুঝেছিলেন ও বলিষ্ঠভাবে বলেওছিলেন। রাজনৈতিক উদ্দীপনা একবারই রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ্য সহযোগিতা পেয়েছিল, বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনের সময়। তার পরেও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে বহুবার আহ্বান পেয়েছন তিনি; কিন্তু প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন, সময় সময় কঠোরভাবেও। এ জন্য রবীন্দ্রনাথের ভর্ৎসনাও কম জোটেনি; তাঁর দেশপ্রেমও অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় পড়েছিল। তবে “Education can wait, but Swaraj can not” যে ধরনের অবিমৃশ্যকারী দেশপ্রেমের নিশান, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কখনই নিজেকে মেলাতে পারেননি।
ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ও অনুরক্ত ছিলেন। “গুরুদেব” ও “মহাত্মা” এই দুই উপাধি তাদের একে অপরকেই দেওয়া। ভারতবর্ষের আমজনতার উপর গান্ধীর সর্বাত্মক প্রভাব যেমন রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তবে তাঁকে “বাপুজি” সম্বোধনের শুধু একটি fetish রূপে গণ্য করার বর্ধমান প্রবণতায় রবীন্দ্রনাথ শংকিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল গান্ধী নিজের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শুধুই দেশকে মাতিয়ে তুলেছেন, কিন্তু পাকিয়ে তুলছেন না। এবং বোধনরহিত এই উন্মাদনা যে দেশের ভবিষ্যতের পথে অন্তরায় হবে তাও তিনি বুঝেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গেয়েছেন তাঁর এই আশংকার কথা… “এসেছি হেথায় যশের কাঙালি/ কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি/ মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে মিছে কাজে নিশিযাপনা! কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ…”। একজন কবির যা ক্ষেত্র সেখানেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন। রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিয়ে এ কথা বলতে পারেননি কারণ সে ভাষা তাঁর জানা ছিল না।
ধনঞ্জয় বৈরাগীর ভিতরে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা ও স্বদেশচিন্তার এক অভিনব রসায়ন। ধনঞ্জয়ের গান শুনে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকেই, আর তার কথা যেন মনে করায় এক অত্যন্ত পরিচিত রাষ্ট্রনেতাকে। প্রহারের সার্থক প্রতিবাদ যে পালটা প্রহার না-করেও সম্ভব এবং শাসকের প্রবল পরাক্রমও যে পরাস্ত হতে পারে অসহযোগের অনড় ব্রতে, এই বিশ্বাসের যিনি প্রথম প্রতিভূ তার খানিক ছায়াপাতও কি ধনঞ্জয়ের মধ্যে নেই?
তবে চরিত্রটি অতিবাস্তব। জননেতা যদি দ্রষ্টাও হন, তাঁর দৃষ্টিগোচর সব কিছুই অনুগামীদের দেখিয়ে ফেললে মুস্কিল। আর কবির চিরন্তন উপলব্ধিতে যা অনায়াসে ভাস্বর, তার প্রতিফলন পড়ে না জনমানসে। অনুগামীদের থেকে নেতা যত বড় হন, তত তাঁর প্রয়োজন হয় নিজের বাণীকে সহজপাচ্য এবং হয়ত বা উপাদেয় করে শোনানো। “তবে আমার হার হয়েছে। আমাকে সরে দাঁড়াতে হল”। এটা বুঝলেও, বাস্তবের নেতার পক্ষে এ কথা বলা এক মারাত্মক ঝুঁকি। ধনঞ্জয়কে যখন এমনই অনেক কথা বলতে হয় তখন মনে হয় না কি তার গান যত সহজে আসে, নেতৃত্ব ঠিক ততটা নয়?
কিন্তু এ সত্ত্বেও ধনঞ্জয় বৈরাগীর সহজ সজীবতাই তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। নাটক পড়বার সময় একবারও তার কথা তত্ত্বের কচকচি বলে মনে হয় না, তার গানও ইস্তেহারের পাঁচালির মত শোনায় না। মুক্তধারায় ১১টি গান ধনঞ্জয়ের কন্ঠে এবং এগুলিই নাটকের ধমনি। বেশির ভাগই বাউলাঙ্গের এবং প্রায় সবকটিই গভীর অধ্যাত্মচিন্তার দ্যোতক। নাটকের পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য থাকলেও গানগুলির অভিঘাত আরও দূরবিস্তৃত। ধনঞ্জয়ের অনেক সংশয় ও মানসযাত্রার সন্ধান মেলে তার গানের মধ্যে। পাড়ায় পাড়ায় যে খ্যাপা খেপিয়ে বেড়ায় সে ধনঞ্জয়ই তবে, “আরো আরো প্রভু আরো আরো, এমনি করে আমায় মারো”, অথবা “আমাকে যে বাঁধবে ধরে সেই এই হবে যার সাধন”, বা “আগুন আমার ভাই আমি তোমারই জয় গাই” ইত্যাদি জানিয়ে দেয় যে মাতিয়ে তোলাই তার একমাত্র কাজ নয়, সে আত্মজিজ্ঞাসারও পথিক। রবীন্দ্রনাথের অক্ষয়তূণের সর্বোৎকৃষ্ট যে অস্ত্র, সেই সঙ্গীতের ক্ষেপক হিসেবে মুক্তধারাতে ধনঞ্জয় বৈরাগীর গুরুত্ব গভীর।
রক্তকরবীকে শুধুই নন্দিনীর গল্প যদি মনে করা যায় তবে মুক্তধারায় ধনঞ্জয় বৈরাগীর উপস্থিতিরও কোনো গুহ্য কারণ থাকতেই হবে এমন কোনো দায় বোধ হয় নেই। ‘সোনার তরী’ কবিতাটি বর্ষণস্নাত সন্ধ্যার স্নিগ্ধ নৈসর্গিক বর্ণনা ও মানব মননে তার প্রতিফলন মনে করে পড়লেও কি রসাস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটে?