দেশান্তরের কথা (সন্ধ্যা ভট্টচার্যের ডায়েরি থেকে)-—সম্পাঃ উমা ভট্টাচার্য, পরবাস; ২০২১; ISBN: 978-1-946582-23-2
১৯২৯-এর লাহৌর কংগ্রেস অধিবেশনে তরুণ জওহরলাল যখন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব রাখলেন তখন বারোশো মাইল দূরে অবিভক্ত বঙ্গদেশের ময়মনসিংহের এক দরিদ্র পণ্ডিতের ঘরে একটি কন্যার জন্ম হয়েছিল। সে কি আর তখন ভারতবর্ষ চিনতো, জানতো স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা? তাঁর বাপ-দাদারা, অবিশ্যি, অজ্ঞাত ছিলেন না, কারণ স্বদেশী করার অপরাধে তাঁর বড়ো ভাইকে দেশছাড়া হতে হয়। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’! হ্যাঁ, লতা মঙ্গেশকর নামের এক কন্যেও ওই বছরেই হোলকারদের রাজ্য ইন্দৌরে জন্মেছিলেন বটে।
এসব সমাপতনের কথা।
যেটা সমাপতন নয় সেটা হলো ওই গ্রাম্য মেয়েটিকেই জন্মের সতেরো বছরের মধ্যে খালি পায়ে হেঁটে বা কখনও ট্রেনে বা কখনও বোটে চড়ে জম্মের শোধ ময়মনসিংহ ছেড়ে দিয়ে নগর-কলিকাতার সন্নিকটে গঙ্গার তীরে নৈহাটি গ্রামে চলে আসতে হবে। হবে না, দেশ স্বাধীন হয়েছে যে গো?! স্বাধীনতার মূল্য চোকাতে হবে তো!
ইনিই সত্তর বছর বয়স ছুঁয়ে কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে। তখন বিংশ শতাব্দী শেষ হয় হয়। ততদিনে পুত্রকন্যারা তাঁর সুপ্রতিষ্ঠিত, সারা জীবনের সংগ্রাম সফল হয়েছে তাঁর। এখন লিখবেন না তো আর কখন? যদিও ছেঁড়া ছেঁড়া ডায়েরির পৃষ্ঠা হিসাবে নানান টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা সন্ধ্যাদবী লিখে এসেছিলেন আজীবন--তাঁর ‘প্রায়-নিরক্ষর’ কলমটিকে জীবন-মসীতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। পড়ি আর ভাবি,---হেই ভগবান, এমন ‘প্রায়-নিরক্ষর’ কলম আমাদের হয় না?! এ-লেখার চার আনা বের করতে পারলে ধন্য হয়ে যেত যে-কোনো কলমচি।
কেন?
বিদূষী অধ্যাপিকা কল্যাণী দত্তের লেখার (দ্র. পরবাস , সংখ্যাঃ ৫৪, ৫৯, ৮৩) কথা বলতে গিয়ে বারংবার তাঁর নিজস্ব স্টাইলটির কথা বলতে হয়েছে। সন্ধ্যাদেবীর লিখনশৈলীতেও সেই অনন্যতা স্পষ্ট--কেবল কল্যাণীদি ছিলেন ভূয়োদর্শী অতি উচ্চশিক্ষিতা, আর সন্ধ্যাদেবীর কোনো বিদ্যালয়ের ছাপ ছিল না। তাঁর কলম বারে বারে ডুবেছে জীবন-কালিতে। তার একটা বিশেষ আকর্ষণ নেই!--কী বলেন, সুধী পাঠিকা?
***
অন্তর্গত অধ্যায়গুলির বেশ কয়েকটি নাম এখানে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না, কারণ সন্ধ্যাদেবীর জীবনপদ্মের পাপড়িগুলি পরতে পরতে কী ভাবে মেলে ধরেছিল তার মর্মোদ্ধার হবে না এ’সরণী বেয়ে চলে চলে না গেলেঃ স্মৃতির পাখিরা এসো; দিদির কথা; আহ্নিকে আজানে; মন্বন্তরের কাল; জলচল বনতল; বাল্যসখী মণি; আনন্দ ভৈরবী; খেলনাবাটির সংসার; নদীর সঙ্গে জীবন; বকুল ফুল, বকুল ফুল; সোয়ারীতে বসে, যাব দূরদেশে; যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা; দেশভাগ ও সংসার জীবনের শুরু; কার্তিকের জ্যোৎস্নার রাতে; বাঘ নয়, সে বাঘাইল্যা রে; কলের গান পটের গান; ব্রহ্মপুত্রের তীরে; স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি; দেশছাড়া; গেরস্থালীর খুঁটিনাটি; গৌরী, মৈত্রেয়ী ও দেবযানীর কথা; মধুরেণ; শিলং পাহাড়ে।
এত বিস্তারিতভাবে অধ্যায়গুলির নাম দেবার আরেকটি কারণ তাদের নাম--মাধুর্যে, সৌকর্যে; যদিও সেগুলি সন্ধ্যাদেবীর নিজের যে দেওয়া নয় তা বোধগম্য, এগুলি সম্পাদকের কাজ। সম্পাদকঃ অধ্যা. উমা ভট্টাচার্য, তাঁর প্রথমা কন্যা।
***
কেন এই স্মৃতিকথা এত মন কাড়ে? কেবলই স্টাইল? না, কন্টেন্টও আছে। কী? যেমন, উদা., চলে যাই 'বকুল ফুল বকুল ফুল' উপ-অধ্যায়টিতে (পৃ. ৬৮)।
গানঃ
'চোখের জলে পূজব এবার উমা মায়ের চরণদুটি/ বলবো মাগো কৃপা করো, দশভূজার মূর্তি ধরো/দশহাতে মা বিনাশ করো অসুর যে ওই আসছে ছুটি।।'
বা,
ব্রহ্মপুত্র নদতীরে পালকি-বেহারাদের গানঃ (পৃ. ৪২)
'রাম-রহিম না জুদা কর ভাই/ দিল-টা সাচ্চা রাখো জী/দেশের কথা ভাব ভাই রে, দেশ আমাদের মাতাজী!'
কী বলেন পাঠক, হারিয়ে যেত না কি এ'সব গান, সন্ধ্যা দেবী লিখে না রেখে গেলে? এই পালকি-বেহারারা ছিল আদতে উত্তর-ভারতাগত, ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। আর কালটা তখন স্বদেশীর!
***
আরও কিছু ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই এই স্মৃতিকথনেরঃ
---বাড়ির বউ-এর পায়ে জুতো পরা বড়ই নিন্দার্হ ছিল সেকালে। তাই পূর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ যাত্রাপথ সন্ধ্যার নগ্নপদেই হয়েছিল।
---পুরুলিয়ার ছৌ-এর মতো সেকালে 'কাচ' নাচের দল ছিল ময়মনসিংহে যাদের বড় বড় মূর্তি ও মুখোশ এবং সজোর বাদ্যি শুনে শিশুরা ভয়ে পালাতো!
---ভগীরথ দশহরার দিন নৈহাটির গঙ্গাবক্ষে দীর্ঘ সন্তরণ প্রতিযোগিতা হতো (এখনও হয়) । সন্ধ্যদেবীর পতিদেব ছিলেন ফি-বছর তার চ্যাম্পিয়ন!
এমন এমন দেশাচার থেকে লোকসংস্কৃতি থেকে ক্রীড়ানুষ্ঠানের ঘটনায় ভরা 'দেশান্তরের কথা', পুনঃ পুনঃ পাঠেও যা ফুরোয় না।
***
শেষে এক না-প্রাপ্তির কথা বলব।
"পরবাস" পত্রিকায় ৬৪ থেকে ৮১--এই আঠেরো সংখ্যা জুড়ে (সেপ্টেম্বর '১৬—জানুয়ারি '২১) 'দেশান্তরের কথা' যখন বেরোচ্ছিল অনবদ্য লেখনের পাশাপাশি রাহুল মজুমদার-কৃত অলংকরণের রসেও হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ এই পুস্তকাকারে প্রকাশকালে সেই ছবিগুলি বাদ পড়ায় হতাশ হয়েছি। মানি, শিশু-কিশোরসাহিত্য ছাড়া বইয়ের ভিতরে ভিতরে ছবি ছাপার রেওয়াজ নেই (তাই না, উদা., শারদীয়া দেশ পত্রিকার সুধীর মৈত্র থেকে দেবাশিস দেবের কত কত অপূর্ব ছবি হারিয়ে গিয়েছে উপন্যাসগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে)। তবু রাহুলের আঁকা ছবিগুলি রাখলে ভালো করতেন প্রকাশক। সন্ধ্যাদেবীর গল্প মূর্ত হয়ে উঠেছিল শিল্পীর তুলিতে।
যদিও অতনু দেব কৃত প্রচ্ছদখানি অতুলনীয় হয়েছে! স্মৃতিকথাটির মূল সুর ধরা পড়েছে অতনুর তুলিতে।
পান্তীর মাঠ—শ্রীমতী কৃষ্ণকামিনী দাসী (সম্পাদনাঃ বিশ্বজিৎ মিত্র); প্রকাশনাঃ 'অভেদ ফাউন্ডেশন', কলকাতা-৬. প্রথম প্রকাশঃ ২০২১; ISBN: নেই
পরপর দুটি একই রকম বইয়ের রিভিউ পড়তে ভালো লাগবে পাঠকের? ৫৯ বা ৭৫-সংখ্যায় এমন দ্বিধায় পড়েছিলাম বটে, তবে উৎরে গিয়েছে পাঠকমহলে। শুধুমাত্র সে কারণেই যে 'দেশান্তরের' পরে এই 'পান্তীর মাঠ' নিয়ে লিখতে ধরেছি তা-ই নয়, ওই যে প্রথমটিতে অলংকরণ না থাকার আক্ষেপ করছিলাম সেটা বহুগুণে পুষিয়ে দিয়েছে এ'বইতে শুভেন সিংহের আঁকা অনেক অনেক অনেক ছবি, যাদের মাদকতা মাতিয়ে রেখেছে এই বইয়ের পাঠসুখ।
৭১-সংখ্যায় সম্বিত বসুর বইটিতে ভাস্কর হাজারিকা কর্তৃক আঁকা ছবিগুলি দেখতে দেখতে এমনই মনে হয়েছিল বটে।
***
প্রায় এক শত বছরের আয়ু ছিল বর্তমান নায়িকা-তথা-লেখিকা ছদ্মনাম্নী কৃষ্ণকামিনী দাসী (দত্ত)র---১৯০৫-২০০৪ খ্রি.। বিবাহের পরে পরে বছর দশেকের মেয়েটি বাঁকুড়ার গ্রাম থেকে উত্তর কলিকাতায় নিঃসন্তান মামাশ্বশুরের সংসারে থাকে বছর আষ্টেক। সে বাড়ির সংলগ্ন ছিল এক 'পান্তীর মাঠ'---যেটা ছিল নায়িকার মনের উন্মুক্ত দ্বার।
এ'থেকেই বইয়ের নাম।
এ'বই কেন পড়া উচিত তদর্থে সম্পাদক মশাই দ্বিতীয় মলাটে দীর্ঘ উপক্রমণিকা লিখে দিয়েছেন। দরকার ছিল না। এই লেখা নিজ ভারেই কাটে। তবে এখানে এক মজার টুইস্টও আছে। তাঁর এক পূর্বমহিলার (পূর্বপুরুষ স্ত্রীলিঙ্গে কী হয়?) লেখা কিছু ডায়েরি হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলে সেটা ছাপানোর সময়ে 'লোকলজ্জা এড়াতে' সম্পাদক লেখিকার নামটাই দিলেন বদলে! না পাঠক, এটা ১৯২১র কথা নয়, ২০২১র কথা। এই বছরেই প্রকাশিত বইখানি। পড়ে দেখি, কৃষ্ণকামিনী (ডাকনামে 'ভাবি') এমন কিছু কেলেঙ্কার করে বসেননি যে একশো বছর পরেও 'নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে' এতো লুকোছাপা করতে হবে। পড়তে পড়তে বারবার গজেন্দ্রকুমার মিত্রের 'শ্যামা ট্রিলজী'-র কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, বা আশাপূর্ণার সত্যবতী-সুবর্ণ-বকুল। সে সব ফিকশন যদিও, তাদের সোর্স এমন এমন কৃষ্ণকামিনীই বটেন।
***
নানান ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ফার্স্ট হ্যান্ড তথ্য পাওয়া এই লেখার বিশেষ আকর্ষণ। যেমন, কলকাতা ময়দানে উড়োজাহাজের উড়ান। কলকাতা শহর ভেঙে লোক গিয়েছিল দেখতে। আমাদের এই বালিকা নায়িকা কৃষ্ণকামিনীরও সুযোগ হয়েছিল মামাশ্বশুর-শাশুড়ির হাত ধরে সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাবার। তবে, এটি বোধহয় প্রথম উড়ান ছিল না। ওঁর বর্ণনা অনুযায়ী এ' উড়ানের ঘটনাটির সময়কাল ১৯১৪ খ্রি. নাগাদ। কিন্তু লিখিত ইতিহাসে রয়েছে যে বেলজিয়ান বৈমানিক ব্যারন ডি কেটার্স ও জুল টিক ১৯১০ সালের ২০শে ডিসেম্বর টালিগঞ্জ ক্লাবের মাঠ থেকে কলকাতায় প্রথম বিমান উড়িয়েছিলেন। ধাতুর তৈরি 'ফড়িং'!
এ'ছাড়াও নানান কেজো তথ্যের ফার্স্ট হ্যান্ড রিপোর্ট পড়তে পাওয়া এ'বইয়ের বড় আকর্ষণ ---সে কলকেতা শহরে হাওয়াগাড়ির চল হোক্ বা বিদ্যুতচালিত ট্রামকার, বা গোষ্ঠ পালের ফুটবল, বা সেকালের কলকাতার নাট্যশালা ('তাও তো তোরা গিরীশ বাবুর অভিনয় দেখতে পেলিনি'--বলে আক্ষেপ করেছিলেন ওঁর মামীশাশুড়ি।)
***
তবে, এ'সব ডিঙিয়ে এই স্মৃতিকথার মূল গপ্পোটা এক প্রেমকাহিনী। যে সে নয়, পরকীয়া প্রেম। নায়িকার। দয়িত তার চেয়ে সামান্য জ্যেষ্ঠ এক দরিদ্র কিন্তু মেধাবী তরুণ, ভাবি-র গৃহশিক্ষক হিসেবে যার আবির্ভাব। এই মন্মথের প্রতি ভাবির যে উদগ্র প্রেম এবং অকপট তার বহিঃপ্রকাশ---বারে বারে কৃষ্ণপ্রেমের সাথে তার তুলনা---বইটিতে অন্য তার এনে দেয়। এ'প্রকাশকে কেউ 'নির্লজ্জ' বলতে পারেন আবার কেউ 'অকপট'। আর পাশাপাশি চলেছে শুভেনের আঁকা অনবদ্য ছবির মিছিল! কিশোরী বধূটির প্রেমোন্মাদ ভাব, কামশীলতা, আবার কখনও বা বিরহে পাগলিনী---শিল্পীর তুলিতে অনবদ্য ফুটে উঠেছে।
এই প্রেমাস্পদ আবার স্বদেশী নিকলা! ভাবির প্রতি তার প্রেম না দেশমাতৃকার প্রতি সমর্পণ---কার জয় হবে?
না, বলে দেবো না, পাঠক পড়ে নেবেন। আনন্দ পাবেন।
***
বইটিতে পুরনো পুরনো গন্ধ আনতে বটতলার ধাঁচে ভাঙা ভাঙা টাইপ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে আগাগোড়া। নূতন ভাবনা। বেশ। প্রচ্ছদের ছবিটিও উডকাট ধাঁচের । আর হ্যাঁ, এই পুরনোত্বের খাতিরে নায়িকার মুখে-বলা-শব্দ (উদা. 'রিষ' , 'হঠঠ্যাং' , 'পা-ভারী') বা আটপৌরে দ্রব্যাদি (উদা. 'খুঞ্চেপোষ' , 'ফুলোবাঁশি')-র উল্লেখ বড় উপযোগী হয়েছে। ওরাল হিস্ট্রির পাঠে দাগ কেটে রেখে দিয়ে যাবে যে গো এ'সব!
সব মিলিয়ে একটি অ-পেশাদার প্রকাশনের এই কেতাবখানি মনে রয়ে গেল--এটি ধরা থাক।
ভেবলির ডায়রি—সরিতা আহমেদ; 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা; হাওড়া; ২০১৮; ISBN 978-93-86937-61-2
ভেবলির নাম কী?
মানে, ভালো নাম?
নাও! ভেবলির আবার নাম কী গো? ভেবলি ইজ্ ভেবলি। সে এস্ আহমেদ হতে পারে বা কমলাবালা দাসী। যতক্ষণ সে আলুর পুতুলের মতো থাবড়ি-থুবড়ি, চোখের কাজল ধেবড়ে নতুন ফ্রক ভিজিয়ে মাটিতে গেঁড়ে বসে 'মাঁআআআ' বলে পা-ছড়িয়ে কাঁদতে পারে ততক্ষণ তার ধর্ম-টর্ম কিছু নাই বাপু। সে ভেবলি।
বড্ড মায়া হলো। কারণ একে তো আমি দেকিচি।
কিন্তু বড় হয়েও কি ভেবলির ভেবলিত্ব কিছু কমেছিল? একবার উত্তরবঙ্গের অজ পাড়াগাঁয়ের আজিজুর মাস্টারের ইস্কুল থেকে হাওড়ার নামী আল আমিন মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়া, বা শেষে কলকেতার নামী সরকারি মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে লায়েক হয়ে বেরোনো---সবের মধ্যেই তার ভেবলে যাওয়াটা লেখিকার কলমের গুণ। পড়তে বসলে মনে হয় এ' আমার কথাই তো বলছে! যদিও এই ভেবলিপনাই শেষ কথা নয়। নৈলে অতি নামজাদা আল আমিন মিশন স্কুলের মেয়েদের ঐস্লামিক পোশাকের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে অনশনে বসতে পারে কিশোরী মেয়েটি? বা, জলপাইগুড়ির 'হিন্দু হিন্দু' পরিবেশে হাঁফিয়ে ওঠা পিতৃদেবের কথার অমান্য করে নিজের কেরিয়ার ডিসিশন নেয়?
তা বলে কি সুদর্শন ইংরিজি স্যরের অতি-ম্যাসকুলাইন পারফ্যুমের গন্ধে ক্রাশ্ খায় না মেয়েটি? প্রতিবাদী বলেই ভোঁতা হতে হবে কে বলল? তাই না এ'বইয়ের ভূমিকায় তসলিমা নাসরিন লিখে দেন, "ভাষার জাদু সরিতা জানে, তা ছাড়াও সবচেয়ে বড় যে সম্পদ ওর আছে, সে হল ওর দেখার চোখ, ওর বোঝার মন!”
হ্যাঁ, কিশোরী সরিতা আহমেদের এই বহুল প্রচারিত-সমালোচিত-পুরস্কৃত বইটির প্রধান আকর্ষণ তার তরতরে ভাষা, আর নেকুপুকু করে নয় সোজা কথা সাপ্টে বলা, এবং অবশ্যই ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা না করা।
বড়ই সুখপাঠ।
আর হ্যাঁ, দাগটা কোথাও মোটা করেননি লেখিকা (ওই পাত্রপক্ষের মেয়ে দেখতে আসার এপিসোডটা ছাড়া। পৃ. ১৪৩)---জেহাদ ঘোষণা নেই, কেবল সঠিক পথটি বেছে নিয়ে ঠন ঠন করে এগিয়ে যাওয়া।
চল্ মেয়ে, এগিয়ে চল্।
***
লেখার গতি সরলরৈখিক।
তা, কে বলেছে এটি ভূয়োদর্শী জীবনালেখ্য? নামেই তো 'ডায়রি'। নৈলে গরীব ঘরের মেয়েটি পড়াশোনা শেখার তাগিদে অদূর-আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে যখন রাতে দরোজায় বড়চাচার ঠকঠকানি পায়---সে তো আহমেদ না হয়ে লক্ষ্মীরাণী হলেও পেতে পারতো। নারীর অত্যাচারিতা রূপটা তো কেবল কাবুলেই পাওয়া যায় না, কলকেতাতেও ভুরি ভুরি। ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ যে হিন্দুবাড়ি আর মুসলমান বাড়িতে সম সংখ্যাতেই পাওয়া যায় এখানে-ওখানে আশ্রিতা হতে হতে জীবন থেকে ভালোই শিখে নিয়েছে ভেবলি। এখানে সে মুসলমান নয়, হিন্দুও নয়।
সারা আলেখ্যটি এই 'ভেবলি'-র প্রথম বচনে বলে যাওয়াটা বে-শ সুখপাঠ। পড়ে মুগ্ধ হলেম। অতি চমৎকার প্রচ্ছদচিত্র, সুমিত রায় কৃত।
শেষে এক কবয়িত্রীর প্রিয় দুটি লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে যে গো....
"সাতসকালে খড় কুড়োতে গিয়ে/ আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে।।"
Women at War: Subhas Chandra Bose & the Rani Jhansi Regiment--- Vera Hildebrand; HarperCollins, India; 2016;
P-ISBN: 978-93-5264-068-3;
E-ISBN: 978-93-5264-069-0
নির্মোহভাবে এই বইয়ের সমালোচনা লেখা অতি কঠিন কাজ।
কেন?
আবাল্য শিখে এসেছি, স্কুল-পাড়া-পরিবারের পরিমণ্ডলে, যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রসঙ্গে গান্ধী-সুভাষের দ্বন্দ্বে সুভাষকে সমর্থন করতে হবে (বাঙালি যে!)। পরের দিকে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে আরও নানান প্রভাবে। আরও পরে তো আরও।
সে সব বলার অবকাশ বা দরকার দুটোই এখানে নেই। কিন্তু এই গ্র.স. লেখার সময়ে মাথার পিছন দিকে সেই সেই বোধগুলো কাজ করে যাবে, যাবেই---সেটাকে উপেক্ষা করি কী করে ?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপিকা ড্যানিশ-কন্যা ভেরা হিল্ডেব্রান্ড ২০১৬তে এই গ্রন্থ প্রকাশ করেন (হার্পার কলিন্স) যার জন্যে তার আগের প্রায় দশটি বছর ধরে উনি সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, ব্রহ্মদেশ থেকে ভারত-আমেরিকা ঘুরে তচ্ করেছিলেন first hand information & interview পেতে। কারণ বিষয়টি স্পর্শকাতর তথা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।
কী ছিল সেই বিষয়টা?
এপ্রিল, ১৯৪৩-এ সাবমেরিনে চড়ে জার্মানি থেকে জাপানে পালিয়ে এসে নেতাজী সুভাষ বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর হাত থেকে 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি'-র দায়িত্ব নিলেন। নতুন করে প্রাণ পেল এই POW-দের বাহিনী। 'আজাদ হিন্দ্ ফৌজ'! এই ফৌজের ভিতরে জুলাই ১৯৪৩-এ নেতাজী এক অল-ফিমেল কমব্যাট-বাহিনী গড়ে তোলেনঃ 'রাণী ঝাঁসি বাহিনী' [RJR]. হ্যাঁ, ফুল কমব্যাট নারীবাহিনী! সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবার জন্যে।
এইখানেই 'বোন অব কনটেনশন'-টা!
সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে গিয়ে শত্রুকরতলগত হয়ে ধর্ষিতা হলে কে বাঁচাবে? এই জন্যেই না কম্ব্যাটে নারীদের রাখা হয় না?
ভেরা সরাসরি এই প্রশ্নটা রেখেছিলেন দাতুক রাসাম্মা, পোন্নামা নবরেদনাম বা অরুণা চট্টোপাধ্যায়ের মত 'রাণী'-দের কাছে।
আশ্চর্য, এঁরা কেউই ঠিক এই বিষয়টা তলিয়ে ভাবেনইনি!
শুধু তা-ই নয়, 'রাণী' জানকী বাঈ জানিয়েছেন যে INA-র সিনিয়র অফিসররা ক্যাম্পে এসে তাঁদের ট্রেনিং কোর্সে বলতেন যে ধরা পড়লে মাতা-হারি-র মতো 'sex for secrets'-ও তাঁদের করতে হতে পারে---'ভারতমাতার শৃঙ্খলামুক্তির স্বার্থে'!! (পৃ. ১০৪) ভাবো!!
আরও আরও অপ্রিয় প্রশ্ন তুলেছেন লেখিকা। যেমন, বাহিনীর মধ্যেই নারী-পুরুষের প্রেম সম্পর্ক।
বাহিনীর অধিনায়িকা ক্যাপ্টেন ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন সেহগলের (১৯১৪-২০১২) একাধিক প্রেম-সম্পর্ক নিয়ে তখনই বাহিনীর মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস চলতো। অন্তত দুই জন 'রাণী' (নারী সৈনিক) গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল (পৃ. ১৪৯)। লেখিকা ভেরা দিদিমণি এমন সরাসরি প্রশ্নগুলি না ওঠালে 'দেশাত্মবোধের' আড়ালে ধামাচাপাই থেকে থাকত এমন এমন তথ্যগুলি, নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসের তাগিদে যে বিষয়গুলির উত্থাপন অতি জরুরি।
আই এন এ-র অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক ও ধর্ম-অসহিষ্ণু চরিত্রটি উন্মোচিত হয়ে পড়ে যখন নেতাজীর অতি প্রিয় সহকারী আবিদ হাসানের কামুক হাত এসে পড়ে কন্যাসমা 'রাণী' আশা সহায়ের গায়ে, বা মুসলিম বলে সাহিরের প্রেম 'রাণী' পোন্নামার সাথে ভ্রূকুঞ্চন আকর্ষণ করে।
এ'সব নগ্ন তথ্য। ভেরার গবেষণা ব্যতীত বেরিয়ে আসতো না।
RJRএর বেশিরভাগ সদস্যাই ছিলেন অশিক্ষিতা দক্ষিণভারতীয়া। ট্রেনিং ক্যাম্পের কঠিন নাওয়া-খাওয়া-থাকার পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের মধ্যে এমন খেয়োখেয়ি ঝগড়া করত যে সুশিক্ষিতা এক 'রাণী'-অফিসার আশা সহায় তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন যে এ'নিয়েই মেতে থাকলে তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়বে কখন?
এইসব ছোটখাট তথ্যের মধ্যে দিয়ে 'স্বাধীনতা সংগ্রামের' কঠোর স্বরূপটা বেরিয়ে আসে।
এ'বইয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দীর্ঘ 'unpublished sources', যার মধ্যে রয়েছে সদ্য উন্মুক্তিকৃত ব্রিটিশ লাইব্রেরির 'INA Interrogation Report', যা কিনা British Intelligence Servic-এর 'Combined Services Detailed Interrogation Centre (India)' দ্বারা প্রকাশিত।
৮০-৯০ বছর বয়সিনী অনেক অনেক 'রাণী'-র রঙিন ও সাদাকালো ছবি রয়েছে যাঁদের সাক্ষাৎকার ভেরা নিয়েছেন।
***
শেষাবধি এই নারীবাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে যেতে হয়নি, রেঙ্গুন শহর থেকেই সিঙ্গাপুরে রিট্রিট করে আসতে হয়। ভাগ্যিস! নৈলে কোহিমা থেকে পশ্চাদপসরণের কালে বর্ষা-কাদা-জোঁক-রোগে ফৌজের পুং বাহিনীকে যা নাকাল হতে হয়েছিল, নারীরা হলে তা সহ্য করতে পারত না। তাঁদের সে ট্রেনিং-ও ছিল না।
ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স তাই বারংবার খবর নিতে চেয়েছে RJR সত্যিই কি কোনো Combat force, না নেতাজীর গিমিক? ভেরার লেখাতেও আলগোছে এই সত্যই বারবার উঠে উঠে এসেছে। যদিও উনি বাহিনীর লোকবল যে ৫০০০ ছিল বলে লিখেছেন (পৃ. ৩) সেটার না কোনো সমর্থিত সোর্স আছে, না অন্যত্র এই তথ্যের পুষ্টি পেয়েছি। এক হাজারের বেশি নারীসদস্যা কখনওই ছিল না।
***
বিতর্কিত এক অধ্যায়ের ইতিহাস কত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হয়, কত নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়---ভেরা হিল্ডেব্রান্ড দেখিয়ে দিয়েছেন এই গ্রন্থে। তাই, বিষয়বস্তুর সঙ্গে কোথাও কোথাও একমত না হলেও তাঁর মেথডকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। কারণ, এমনিতে দেশপ্রেম-মসীতে ডোবানো পূরবী রায় নারায়ণ সান্যাল প্রমুখের লেখায় যে 'নেতাজী সাহিত্য' পড়তে আমরা অভ্যস্ত ভেরার এ বই তার থেকে শত যোজন দূরে।