(স্থান/কালঃ দিল্লী/১৯৮৩)
এই গল্পের ভূতটা ছিল ব্রিটিশ যুগের। দুই যুদ্ধের মাঝখানে কয়েকটা বছর কলকাতার ইস্টবেঙ্গল মেসে কাটিয়েছিল বড়মামা। তখন এই বদরাগী ভূতটা রোজ রাতে মামাকে কুস্তি করে খাট থেকে মেঝেতে ফেলার পর আলনায় ঝোলানো সব জামাকাপড় লণ্ডভণ্ড করে মাটিতে ছড়িয়ে মশারি আর বিছানা অধিকার করত। দিনের পর দিন এরকম চলার পর ব্যাপারটা এমন একঘেয়ে হয়ে যায় যে ভূতটা আসার আগেই মামা দূর ছাই বলে আলনা থেকে কাপড়গুলো টেনে মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে শতরঞ্চিতে শুয়ে পড়ছিল।
বড়মামার ইয়ার-দোস্তদের মধ্যে একজন গোবরবাবুর শিষ্য ছিলেন। সব জানার পর তিনি উপদেশ দিলেন – লুকিয়ে ব্যায়াম শুরু করো। ছমাস আখাড়ায় গামার মতো ডন আর বৈঠক করে করে যখন ছাতি আর বাইসেপ পিপের মতো হয়েছে তখন একদিন বড়মামা মেঝেতে না নেমে খাটেই শুয়ে ছিল। ভূতটা যথারীতি এসে মামাকে তুলে আছাড় মারতে গিয়ে গোবরবাবুর নির্দেশমতো সাজিয়ে রাখা একটা চোক-হোল্ডের ফাঁদে ধরা পড়ে যায়। বেনারসের মছলি-গোটা প্যাঁচ। মানুষের ক্ষেত্রে ফুল-প্রুফ এবং ভূতেদের জন্য মোক্ষম। চমকে যাওয়া ভূতটাকে বিধি অনুসারে খানিকক্ষণ কাতলা মাছের মতো তড়পাতে দিয়েছিল মামা। তারপর তার বুকের পুরো হাওয়াটা যখন ফুস হয়ে বেরিয়ে গেছে, তখন সেটাকে কাঁধের উপর উঁচু করে তুলে ধোবীঘাটের পাঞ্জাবী পাট লাগায়। হতভাগাটা নারকেল ছোবড়ার তোষকের উপর দড়াম করে পড়ে ঘেঁয়াও বলে রিবাউণ্ডে একটু লাফিয়ে উঠেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে আবিষ্কার করে তার পিঠটা মামার মুগুরের মতো শক্ত হাঁটুর উপর চেতানো, আর পিশাওয়রী সাঁড়াশী পকড়ের টানে গলা থেকে জিভ বেরিয়ে আসছে। আর কী। দস্যুটা হাত পা খিঁচিয়ে নিঃসাড়। মামাও তখন তাকে মরা টিকটিকির মতো শতরঞ্চির উপর ছুঁড়ে দিয়ে ঘুমোতে গেল।
পরের দিন ভূতটা আকাশপথে গরুড়পক্ষীর মতো এল। মামা (বালটিস্তানের) বালটি-প্যাঁচ নিয়ে প্রস্তুত। উড়ে আসা জন্তুটাকে প্রথমে ছিটকে পাঠানো হলো সিলিংয়ের দিকে। সেখানে ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে নামছিল সে। মাঝপথে বেচারার সরু গলা সলতের মতো পাকিয়ে দুটো ঠ্যাঙের সঙ্গে ট্রিপ্ল্-গিঁট মেরে দিয়ে মামা বস্তুটাকে হ্যাঙ্গারের মতো দেয়ালের পেরেক থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
তারপর থেকে ভূতটা রাতে সুপুরি গাছ থেকে নেমে এসে লক্ষ্মী ছেলের মতো মেঝেতেই শুয়ে পড়ত। বড়মামার দয়ার শরীর। কয়েক দিন পরে শতরঞ্চির উপর একটা বালিশ পেতে রাখল মামা। তারপর একটা ভাঙা হাত পাখা। ভূতটা বলতে গেলে পোষা হয়ে যায়। পরে মামা যা বলত সে তাই শুনত। বাজার টাজার করা তো ছিলই, এমন দাঁড়িয়েছিল যে সকালবেলা বড়মামা ভাত-টাত খেয়ে ঘরে এসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর ভূতটা মামার কোট আর প্যান্ট পরে অফিস করতে যাচ্ছে। এইভাবে দুজনেরই জীবনটা সুন্দর কেটে যেতে পারত, যদি না অফিস থেকে দেরাদুনে বদলির অর্ডারটা আসত।
ভূতের পক্ষে ইস্টবেঙ্গল মেস ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে তখন তার কোট-প্যান্ট পরে চাকরি করার ভয়ঙ্কর নেশা। দিনের পর দিন বড়মামা বেচারার কাছে এই মর্মান্তিক খবরটা ভাঙতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত কোট-প্যান্ট ছাড়াও, এক জোড়া কাফ লেদারের জুতো, একটা হ্যাট, তিন প্রস্থ আসলাম ব্রাদার্সের তৈরী শার্ট আর আণ্ডারওয়্যার, আর তিন জোড়া ম্যাঞ্চেস্টারের মোজা খাটের উপর তার জন্য ছেড়ে মামা হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে। ফেলে আসা কোটের ভিতরের পকেটে বিদায়ের চিঠিটা ছিল।
আমার গল্প এখানেই শেষ। যুদ্ধের পরে বড়মামা কলকাতায় ফিরে গিয়ে নিজের মেসের সঙ্গীদের খোঁজও করেছিল। সেটা মামার জীবনীর আরেকটা রোমাঞ্চকর অধ্যায়। কিন্তু সে ভূতের কী হল তা ভালো করে জানা যেত না। দিদিরা জিজ্ঞেস করত সে গেল কোথায়? কেন তাকে আমরা পুষলাম না? কারণ এরকম একটা ভূত পেলে আরো আদর-যত্ন আর ভালোবাসা দিতে পারত তারা। বড়মামা নিজের ধোঁয়া ফুরিয়ে যাওয়া প্রাচীন স্যাণ্ডব্লাস্টেড ব্রায়ারের পাইপটা খোঁচাতে খোঁচাতে জানায় ভূতের গা দিয়ে যে ফিটকিরিওয়ালা শেভিং ক্রীম আর নতুন লণ্ড্রি থেকে আসা পেট্রলের হালকা সুবাস বেরোত সেটা নাকি হাওড়া-দিল্লীর কর্ড লাইনের ট্রেনে যাতায়াতের সময় পরেও অনেকবার পাওয়া গিয়েছিল। গল্পটা দুপাতায় রাখার জন্য আমি এই সব জিনিসগুলো বাদ দিই।
লেখা পাঠাবার পর ওদের কাছ থেকে একটা চিঠি আসে। সঙ্গে সাড়ে এগারো টাকা দক্ষিণা। ওরা লিখেছে ছাপাবে, কিন্তু তার আগে জানতে চেয়েছিল এই গল্প থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি।
মেজোমামার ছেলে টোটোদা চিঠিটা দেখে তিলমিল করে জ্বলে উঠে বলেছিল – শিক্ষা! শিক্ষা! শিক্ষা! ডাফারের গুষ্টিতে ছেয়ে গেছে দেশটা! পত্রিকা চালাচ্ছে না পাঠশালা? ওদের বল ছাপাতে হবে না। চাস তো মায়াপুরীর ফিল্মী পত্রিকায় ছাপিয়ে দিচ্ছি। শুধু ভূতটাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ফিমেল করতে হবে আর কুস্তিতে জেঠু হারবে।
টোটোদা গল্প ছাপাবার জন্য তার জেঠুকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারে কিন্তু নিজের বড়মামাকে কুস্তিতে হারাবার মতো বিশ্বাসঘাতক ভাগ্নে আমি নই। আমার সমস্যা হল এই যে বড়মামা থাকে দেরাদুনে। মূল উৎসের কাছে গিয়ে গল্পের মরাল জেনে আসার সময় ছিল না। টোটোদা বলল – গিয়েও কী লাভ? জেঠুর কাছ থেকে কী শাস্ত্রজ্ঞান আমরা পেয়েছি এতদিন? এই তো যে বাঙালি মেয়েদের একনাগাড়ে প্রশংসা করে গেলে ওদের জেনারেশানের পুরুষদের বাড়ির কোনো কাজ করতে হত না? সেটা তুই এলাহাবাদকে বলতে পারবি? একে তো আমাদের যুগে এই শিক্ষা অচল হয়ে গেছে। তার উপরে এই গল্পটায় কোনো বাঙালি মেয়েই নেই।
প্রবুদ্ধর কাছে গেলাম। সে বলল – এত টেনশন লিচ্ছিস কায়কু? যে কোনো জিনিসের মধ্যে থেকে র্যানডম যে কোনো শিক্ষা বের করে আনাতেই ইন্ডিয়ার গ্রেটনেস। ‘ওং’ শব্দটার মধ্যে গোটা বেদ খুঁজে পাওয়ার মতো। রাসলীলার মধ্যে ভক্তিযোগ। টুপিতে হাত ঢোকা আর যে যা চাইছে বার করে দে। খরগোশ চাইলে খরগোশ, পায়রা চাইলে পায়রা। নইলে আর ভারতে জন্মেছিস কেন?
- একটা কিছু হিন্ট দে। তুই ফার্স্ট বয়। প্রবুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলাম আমি।
- এলাহাবাদের সার্কিট তো? কংগ্রেসী লাগা। মনে মনে ভাব তোর বড়মামা সবে ব্রিটিশ জেল খেটে বেরিয়েছেন। পিঠ জুড়ে চাবুকের দাগ। চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন। এটা একটা দেশপ্রেমের গল্প।
প্রবুদ্ধর কথামতো আমি জবাবে লিখলাম যে আমার মামা পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন। তাঁর জীবনে যত ভূত যাওয়া আসা করেছে তারা সব এই কলোনিয়ালিজমের প্রতীক। কুস্তি হল জাতীয়তাবাদের সাহিত্যিক রূপায়ন। তার এক একটা প্যাঁচ ভারতের এক একটা সম্প্রদায়। সবাইকে এক করলে হয় অখণ্ড ভারতবর্ষ। শেষ পর্যন্ত ভূতের কাছে কোট, প্যান্ট, হ্যাট, ম্যাঞ্চেস্টারের মোজা ইত্যাদি রেখে আসার মধ্যে দিয়ে আমি দেখাতে চেয়েছি কীভাবে আমার পূর্বপুরুষরা ঔপনিবেশিকতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গান্ধীজীর প্রেরণায় স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের রেলগাড়িতে উঠে পড়েন।
গল্পের এই টীকা পাঠাবার পর এলাহাবাদ থেকে প্রচুর সাধুবাদ সহ আরো দশটা টাকা চলে আসে। ইন্ডিয়ার গ্রেটনেস সম্বন্ধে মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল এক নিমেষের মধ্যে সব দূর হয়!
সেই একুশ টাকার সঙ্গে আগের আরো দুটো পত্রিকা থেকে পাওয়া দু পাঁচ টাকার সেলামী জমা করলে সব মিলিয়ে আমার জীবনের উপার্জন পঁয়তিরিশের মতো। এ-কটা টাকা দিয়ে আমার তন্বী বান্ধবীর উপযুক্ত কোনো উপহার আমি খুঁজে পাইনি এবং কর্মক্ষেত্রে পদার্পণের আগেই জীবনের একটা প্রধান শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম।
শিক্ষাটা এই: ভূতের গল্প লিখে পেট চলে না বলেই এত খেটেও বাঙালিদের এই দৈন্যদশা।